![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
গত জানুয়ারী মাসে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি পূনর্মূল্যায়নের জন্য ন্যূনতম মজুরি বোর্ড গঠিত হওয়ার পর থেকে এই খাতে কর্মরত প্রায় চল্লিশ লক্ষ শ্রমিক একটি গ্রহণযোগ্য ও ন্যায় সংগত মজুরি ঘোষণার আশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) এর তত্ত্বাবধানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক অধ্যাপক জাকিরের এক গবেষণার তথ্যমতে বাংলাদেশে চার সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিবারের খেয়েপড়ে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম ১৬০০০ টাকা প্রয়োজন হয়। কিছু শ্রমিক সংগঠন ১৮০০০ টাকা ন্যূনতম মজুরির দাবী জানালেও অধিকাংশ শ্রমিক সংগঠন, ১৬০০০ টাকা ন্যূনতম মজুরির দাবীতে আন্দোলন গড়ে তোলে। কার্যত ১৬০০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি সর্বমহলে গ্রহণযোগ্যতা পায় এবং ইহা জাতীয় দাবীতে পরিণত হয়। অন্যদিকে গবেষণা সংস্থা সিপিডি পোশাক মালিকদের সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার টাকা করার পক্ষে মত দেয়। এমন বাস্তবতায় কোন হিসাব নিকাশ আমলে না নিয়ে দেশের পোশাক শ্রমিকদের প্রত্যাশাকে অবজ্ঞা করে গত ১৩ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার শ্রম প্রতি মন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু একতরফাভাবে ন্যূনতম মজুরি ৮০০০ টাকা ঘোষণা করেন। যা তাৎক্ষণিকভাবে সকল শ্রমিক সংগঠন প্রত্যাখ্যান করেছে।
বর্তমানে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৫৩০০ টাকা এবং মূল মজুরি ৩০০০ টাকা কিন্তু ঘোষিত ন্যূনতম মজুরিতে মূল মজুরি ধার্য্য করা হয়েছে ৪১০০ টাকা। মোট মজুরির সাথে আনুপাতিক হারে বর্তমানের তুলনায় ঘোষিত ন্যূনতম মজুরির সাথে মূল মজুরিও কম ধার্য্য করা হয়েছে। এর মাধ্যমে শ্রমিকেরা ওভারটাইমভাতা কম পাবে। চাকুরির ক্ষতিপূরণ, গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ডে মালিকের কন্ট্রিবিউশন, উৎসব বোনাস ইত্যাদি ক্ষেত্রে শ্রমিক বঞ্চিত হবে অর্থাৎ শ্রমিক ঠকানোর সব চেষ্টাই লক্ষ্য করা গেছে এবার ন্যূনতম মজুরি ঘোষণার সময়।
বাংলাদেশ জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অংশীদার। জাতিসংঘ ২০৩০ সালের মধ্যে উক্ত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। টেকসই উন্নয়নের অন্যতম শর্ত হচ্ছে শোভন মজুরি নিশ্চিত করা ও আয় বৈষম্য কমানো। কিন্তু শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত না করে কিভাবে শোভন মজুরি নিশ্চিত হবে ও আয় বৈষম্য কমানো যাবে?
১৯৯৪ সালে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ছিল ৯৩০ টাকা। ২০০৬ সালে তা ১ হাজার ৬৬২ টাকা ৫০ পয়সা করা হয়। ২০১০ সালে ন্যূনতম মজুরি করা হয় ৩ হাজার টাকা এবং সর্বশেষ ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ৫ হাজার ৩০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি ধার্য্য হয়েছিল। কিন্তু কোন বারই শ্রমিকেরা বাজারদরের সাথে সংগতিপূর্ণ গ্রণযোগ্য ন্যায্য মজুরি পায়নি এবং শ্রমিকের ন্যূনতম জীবনমান অদ্যাবধি নিশ্চিত করা যায়নি।
একটি গবেষণা সংস্থার তথ্যমতে পোশাক শ্রমিকদের মজুরি কম হওয়ায় অনেকে উচ্চ সুদে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে। এতে তাদেরকে মোট প্রয়োজনীয় ব্যয়ের ২২ শতাংশ অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়। এতে পোশাক শ্রমিকদের মজুরি কমের চিত্রটি স্পষ্ট হয় এবং তাদের মজুরি ব্যাপকভাবে সমন্বয়ের যৌক্তিকতাও প্রমাণিত হয়।
গাণিতিক হিসাবে ঘোষিত মজুরি বর্তমান মজুরির তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ বেশী হলেও বাস্তবে বর্তমান বাজার দরের সাথে সংগতি রেখে গ্রহণযোগ্য ও ন্যায় সংগত মজুরির তুলনায় তা ৫০ শতাংশ কম হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করে। ফলে বরাবরের মত এবারও শ্রমিক শ্রেণীর প্রত্যাশা পূরন হয়নি। অবশ্য ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্র বা মালিক কর্তৃক শ্রমিক শ্রেণীর প্রত্যাশা পূরন হবে এমনটি ভাবা আর উলুবনে মুক্ত ছড়ানো যে একই কথা।
ন্যূনতম মজুরি বোর্ডে শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি শামছুন্নাহার ভূঁইয়ার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তিনি শ্রমিক প্রতিনিধিদের সাথে আলাপ আলোচনা না করে ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের বৈঠকে ১২০০০ টাকা মজুরির প্রস্তাব দেন এবং পরবর্তী বৈঠকে আরো কম হলেও মেনে নেবেন বলে জানান। ফলে তার এমন ভূমিকা শ্রমিক সমাজকে বিক্ষুদ্ধ ও হতাশ করেছে। রাষ্ট্র কর্তৃক মনোনীত শ্রমিক প্রতিনিধি প্রতিবারই শ্রমিক সমাজকে হতাশ করেছে তাই শ্রমিকের প্রতিনিধি রাষ্ট্র কর্তৃক মনোনীত না হয়ে শ্রমিক সংগঠন সমূহ কর্তৃক মনোনীত হওয়া উচিত বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করে।
মজুরি বাড়ানোর কথা আলোচিত হলে মালিক পক্ষ সমস্বরে বলতে থাকেন তারা সিএম কম পান ফলে মজুরি বাড়ালে তাদের ব্যবসায় লোকসান হবে। লোকসানের ভার বহন করতে না পেরে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলেও তারা আশংকা প্রকাশ করেন। এ পর্যন্ত যে সকল কারখানা বন্ধ হয়েছে তার কারনগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় একর্ড এবং এলায়েন্সের অডিটের পর নিরাপত্তা ইস্যুর কারনে কিছু কারখানা বন্ধ হয়েছে। বাকীগুলো কারখানার মালিক পক্ষের ব্যবস্থাপনা দক্ষতার অভাব, অংশীদারদের মধ্যে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা সরিয়ে নিয়ে অন্যত্র বিনিয়োগ কিংবা বিদেশে টাকা পাচার ইত্যাদি কারনেই অধিকাংশ কারখানা রুগ্ন হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। মজুরি বৃদ্ধির কারনে কারখানা বন্ধ হওয়ার তথ্য মোটেও সত্য নয়।
এছাড়া অভিজ্ঞ মহল মনে করে সিএম যদি ৮/১০ সেন্ট বাড়ানো সম্ভব হয় তাহলে ১৬০০০ টাকা মজুরি দেয়াও কঠিন নয়। এখন ৮/১০ সেন্ট সিএম বাড়ানোর জন্য বৈশ্বিক ক্রেতাজোটের সাথে দর কষাকষির সক্ষমতা যদি বাংলাদেশের মালিক পক্ষের না থাকে তার দায় শ্রমিকদের উপর চাপিয়ে দেয়া এবং সিএম কমের অজুহাতে শ্রমিকের মজুরি কম দেয়া কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা।
বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরী পোশাক রপ্তানীকারক দেশ। বৈদেশিক আয়ের ৮০% আয় হয় এই খাত থেকে। প্রায় চল্লিশ লক্ষ শ্রমিক এই শিল্পের সাথে জড়িত রয়েছে। আশির দশকে শুরু হওয়া এই শিল্প নিজে বিকশিত হওয়ার পাশাপাশি ব্যাংক ও বীমাসহ আমদানি-রপ্তানি সংশ্লিষ্ট আরো অনেক খাতকেও বিকশিত করে দেশের অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চার করে চলেছে। কিন্তু এই শিল্পের অন্যতম চালিকা শক্তি শ্রমিকের কাংখিত উন্নয়ন হচ্ছেনা।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প মূলত শ্রমিকের শ্রম এবং ঘাম বিপনন করেই বিকশিত হয়েছে। শ্রমিকের শ্রম ও ঘামের মূল্য যদি প্রতিষ্ঠিত না হয়, শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি যদি নিশ্চিত না হয় তাহলে শিল্পের বিকাশ ব্যহত হবে। শিল্পের স্বার্থে শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিৎ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৮০০০ টাকা ঘোষণা অবিবেচনা প্রসূত হয়েছে। তাই ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি পূনর্বিবেচনা করা জরুরী বলে সংশ্লিষ্ট সকল মহল মনে করে।
©somewhere in net ltd.