নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সাবেক সভাপতি।৯০ এর দশকে কমিউনিস্ট আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী।বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, চট্টগ্রাম জেলার সংগঠক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।

ফজলুল কবির

ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক

ফজলুল কবির › বিস্তারিত পোস্টঃ

পাদুকা শিল্প রক্ষায় করনীয়

০৭ ই অক্টোবর, ২০১৮ দুপুর ১২:১৭

পাদুকা শিল্পের পথচলা শুরু সত্তরের দশক থেকেই। চট্টগ্রামের মাদারবাড়ি, পশ্চিম মাদারবাড়ি, অক্সিজেন ও কর্নেলহাটে পুরাতন ঢাকার সিদ্দিকবাজার, বংশাল, কামরাঙ্গিচর পাদুকা কারখানা গড়ে উঠে। অধিকাংশ কারখানাই আকারে খুবই ছোট। এই সমস্ত কারখানার মালিকদেরকে মালিক না বলে স্বনিয়োজিত শ্রমিক বললে যথার্থ হবে। ঢাকা এবং চট্টগ্রামে মিলে প্রায় ত্রিশ হাজার শ্রমিক এখানে কর্মরত আছে। এই সেক্টরে কোন নারী শ্রমিক নাই তবে প্রচুর শিশু শ্রমিকের অস্তিত্ব আছে। কাঠের সিলিং দিয়ে ছোট্ট এক একটা ঘরকে দুটো ঘরে পরিণত করা হয়। এই ঘরগুলোতে মাথা সোজা করে দাঁড়ানোর সুযোগ থাকেনা, মাথা নীচু করে এবং বসে কাজ করতে হয়। এইরকম অর্ধেক ঘরই এক একটি পাদুকা ‘কারখানা’, এইসব আলো বাতাসহীন স্যাতস্যাতে ছোট্ট ঘরেই দিনরাত একটানা ১০/১২ ঘণ্টা কাজ করেন পাদুকা শ্রমিকরা। আয়ের স্বল্পতার কারনে অধিকাংশ শ্রমিকেরা কারখানাতেই থাকে খায় আর ঘুমায়। শ্রম আইনের ৫ম অধ্যায়ে ৫১ থেকে ৬০ নং ধারায় বর্ণিত আছে নিরাপদ কর্ম পরিবেশ সংক্রান্ত বিভিন্ন নিয়ম কানুন। কিন্তু কেউ এ ব্যাপারে সচেতন নয়। সম্পূর্ণ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অত্যন্ত মানবেতর জীবন যাপন করে এই খাতে কর্মরত শ্রমিকেরা। দাহ্য পদার্থ পরিবেষ্টিত কারখানাগুলোতে আগুনের ঝুঁকি থাকলেও অগ্নি নির্বাপনের কোন ব্যবস্থা নাই। এডহেসিভ, আইকা, ফোম সহ নানা রকম কেমিক্যালের তীব্র গন্ধের মধ্যে একরকম দমবন্ধ পরিবেশে শ্রমিকেরা দিনরাত কাজ করে। মালিক পক্ষ শ্রমিকদেরকে কোন ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামাদি সরবরাহ করেনা। সচেতনতার অভাবে শ্রমিকরাও এর প্রয়োজন অনুভব করেনা। কাজ করতে গিয়ে হাত কেটে গেলে কিংবা অসুস্থ হলে মালিক চিকিৎসার কোন দায় নেয় না। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে পরিদর্শন করা হয় কিনা তাও শ্রমিকেরা জানেনা। এই রকম অস্বাস্থ্যকর এবং কেমিক্যালযুক্ত পরিবেশে কাজ করার কারনে পেশাগত রোগের ঝুঁকি প্রবল।
এই সেক্টরে কর্মরত শ্রমিকদের নিয়োগ পত্র, পরিচয় পত্র দেওয়া হয়না। কোন সবেতন ছুটি নাই। অধিকাংশ শ্রমিকের মাসিক নির্দিষ্ট মজুরি নাই। এরা কাজ করে কানামনা অর্থাৎ কাজ নাই মজুরি নাই ভিত্তিতে। অধিকাংশ শ্রমিকের পুরো মাস কাজ থাকেনা। মাসে ১৫ থেকে ২০ দিন কাজ থাকে। দৈনিক ১০/১২ ঘন্টা কাজ করার পরও উৎপাদন হিসাব করে শ্রমিকদেরকে ২০০/২৫০ টাকা মজুরি দেয়া হয়। দক্ষ কারিগর হলে মাসিক ৯০০০ থেকে ১০০০০ টাকা মজুরি পেয়ে থাকে। ক্রম বর্ধমান উর্ধগতির বাজারে শ্রমিকেরা যে আয় করে তা দিয়ে তাদের পারিবার পরিজন নিয়ে জীবনযাপন করা কঠিন হয়ে পড়ে। না খেয়ে কিংবা অর্ধাহারে তাদের দিনাতিপাত করতে হয়। প্রয়োজনের তুলনায় আয় এত কম যে, কোন সঞ্চয় তাদের থাকেনা। ফলে কোন শ্রমিকের বা তাদের পরিবারের সদস্যদের অসুখ বিসুখ হলে চিকিৎসা করাতে পারেনা। সৃষ্টি কর্তার উপর ভরসাই তাদের একমাত্র নিয়তি। শ্রমিকের চাকুরীর কোন স্থায়িত্ব নাই। কোন কারনে মালিকের রোষানলে পড়লে বিনা নোটিসে কেবল মৌখিক নির্দেশে শ্রমিকেরা চাকুরি হারায়। চাকুরীর ক্ষতিপূরণ, গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড কিছুই নাই।
কথা হল ইকবাল হোসেন নামে একজন প্রবীন পাদুকা শ্রমিকের সাথে। তিনি কাজ করেন চট্টগ্রামের পাদুকা পল্লি হিসাবে খ্যাত মাদারবাড়ির একটি ছোট পাদুকা কারখানায়। বয়স ৫০ এর বেশী। ১৯৯৫ সন থেকে এই শিল্পে কর্মরত আছেন। সে হিসাবে এই শিল্পে তার চাকুরীর বয়স প্রায় ২৩ বছর। বেতন কত পান জিজ্ঞাসা করতেই ইকবাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন দীর্ঘ সময় চাকুরি করেও এখনো কোন মাসে দশ হাজার টাকা মজুরি তুলতে পারেননি। কাজ করলে কেবল দৈনিক দুই শত টাকা মজুরি পান। একদিকে কারখানায় কাজ কম আবার অন্যদিকে বয়সের ভারে ইকবালের শরীর এখন আর চলেনা তাই মাসে সর্বোচ্চ ১৯/২০ দিন কাজ করতে পারেন। অর্থাৎ মাসিক চার হাজার টাকার বেশী মজুরি কখনো পায়না। স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়েই তার সংসার। চার হাজার টাকা ঘর ভাড়া বাবদ খরচ হয়ে যায়। তাহলে ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া কিভাবে করাবেন আর খাওয়াবেনও কি? বাকী খরচ কিভাবে মিটান জিজ্ঞাসা করার পর জানতে পারি ইকবাল হোসেনের স্ত্রীও চাকুরীজীবী। তিনি গার্মেন্টস এ চাকুরি করেন। তার মাসিক মজুরি সাত হাজার টাকা। ওভার টাইম সহ মাসে নয় থেকে দশ হজার টাকা্র মত মজুরি পান। তা দিয়েই মূলত সংসার চলে। দুইজন চাকুরি করে অমানুষিক পরিশ্রম করেও ভবিষ্যতের জন্য কিংবা দূর্দিনের জরুরী খরচ মিটানোর জন্য তাদের সংসারে এক টাকাও জমা নাই। এমনকি প্রয়োজনীয় খরচ মিটানোর জন্য অনেক সময় উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হয়। পরে ঐ ঋন শোধ করতে গিয়ে তাদেরকে প্রচুর বেগ পেতে হয়। ইকবাল হোসেন বলেন, শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ। আর বেশী দিন চাকুরী করতে পারবেন কিনা তা নিয়ে তিনি সংশয়ে আছেন। নিজেকে নিয়ে বেশী ভাবতে চাননা ইকবাল। কিন্তু ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে অস্থির। কথা বলতে বলতে ইকবালের চোখের কোণে জল জমে যায়। কথা বলার সময় তার ঠোট কাঁপছিল। ইকবালরা বড় অসহায়। তাদের এই অসহায়ত্ব থেকে মুক্তি দিতে রাষ্ট্র বা সমাজের কি কোন দায় নাই। ইকবালকে শান্তনা দেয়ার ভাষা খুঁজে পাইনা। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয়। লজ্জায় মুখ লুকোবার চেষ্টা করি। কথা আর বাড়ালাম না। ইকবালের সাথে হাত মিলিয়ে বিদায় নিলাম। ইকবাল যেন পাদুকা শিল্প শ্রমিকদের এক মূর্ত প্রতীক। একে একে আরো অনেকের সাথে কথা হলো। সবার কন্ঠে যেন ইকবালের কথার প্রতিধ্বনি। পুরো শিল্প জুড়েই হতাশা আর হাহাকার। এখানে শ্রমিক বঞ্চিত হয় মালিক দ্বারা আর মালিক বঞ্চিত হয় বাজার ব্যবস্থার কারনে।
বাংলাদেশে এক সময় পাদুকা শিল্পের অবস্থা খুব রমরমা ছিল। স্থানীয় চাহিদার শতভাগ পূরন করতো দেশীয় পাদুকা কারখানা সমূহ। কিন্তু বর্তমানে ৮৫ থেকে ৯০ ভাগ বাজার চীন, ভারত ও মিয়ানমার থেকে আমদানীকৃত পাদুকার দখলে চলে গেছে। দেশীয় পাদুকা কারখানা সমূহের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মাত্র ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বাজার। ফলে দেশীয় পাদুকা শিল্প এখন অস্তিত্ব রক্ষার চ্যালেঞ্জে পড়েছে। অনেক পাদুকা কারখানা ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। এখনো যারা উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করছে তারা কোন রকমে রুগ্নভাবে টিকে আছে। তাই পাদুকা শিল্প রক্ষায় সরকারকে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিদেশ থেকে পাদুকা আমদানী পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব না হলেও নিয়ন্ত্রন করে যাতে দেশীয় চাহিদার ৫০% এর বেশী পাদুকা আমদানী করা না যায় সে ব্যাপারে নজর দেয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। দেশীয় পাদুকা শিল্প রক্ষার স্বার্থে বিদেশ থেকে আমদানীকৃত পাদুকার উপর করের হার বাড়ানো যায়। মিয়ানমার কিংবা ভারত থেকে যাতে অবৈধভাবে পাদুকা আমদানী করা না যায় সেই ব্যাপারেও বিশেষ নজর দেয়া খুব জরুরী।
পাদুকা শিল্পের জন্য পৃথক শিল্প এলাকা গড়ে তুলে সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কহার কমানো ও শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে পাদুকা শিল্পে প্রাণ সঞ্চার করা সম্ভব বলে সংশ্লিষ্ট সকল মহল মনে করে।
পাদুকা শিল্পে মালিকের অস্তিত্ব খুবই দূর্বল। এখানে মালিকও শ্রমিকের মত কাজ করে। মালিকের আর্থিক সক্ষমতাও খুব বেশী নয়। তাই পাদুকা শিল্প রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের উপরই বর্তায়।
৭০ এর দশকে শুরু হওয়া পাদুকা শিল্প ৯০ এর দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ভালভাবেই চলছিল। মুক্ত বাজার অর্থনীতির নামে রাষ্ট্রের অদূরদর্শী সিদ্ধান্তে বিদেশ থেকে অবাধে পাদুকা আমদানী করতে দেয়ায় পাদুকা শিল্প এখন মৃত প্রায়। পাদুকা শিল্পের অতিত অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে দেশীয় চাহিদার ৫০% আমাদের দেশের উদপাদিত পাদুকা দিয়ে পূরণ করার পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন করা সময়ের দাবী। এতে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে এবং দেশের শিল্প ও শ্রমিক বাঁচবে।

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই অক্টোবর, ২০১৮ দুপুর ১২:৩৫

স্বপ্নের শঙ্খচিল বলেছেন: দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে এবং দেশের শিল্প ও শ্রমিক বাঁচবে।

বক্তব্য জোরালো যুক্তি আছে
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দৃষ্টি দান করুন

২| ০৭ ই অক্টোবর, ২০১৮ দুপুর ২:৫০

সনেট কবি বলেছেন: ভাল লিখেছেন।

৩| ০৭ ই অক্টোবর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:১২

সৈকত জোহা বলেছেন: মাদারবাড়ি এলাকায় একসময় অনেক পাদুকা শিল্প ছিল। এখন বোধহয় নাই।
বড় কোম্পানি গুলো কোন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাকে বেঁচে থাকতে দিবে বলে মনে হয় না

৪| ০৭ ই অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১০:২২

বিচার মানি তালগাছ আমার বলেছেন: আধুনিক যন্ত্রপাতি এসে এই শিল্পকেও রুগ্ন করে দিচ্ছে...

৫| ০৭ ই অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১০:২৮

রাজীব নুর বলেছেন: শুধু পাদুকা শিল্প না অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এই রকম চলছে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.