নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি চিন্তা করি....সুতরাং আমি অস্তিত্বশীল

সাজ্জাতুল ইমরান ফয়সাল

একজন সাধারণ মানুষ

সাজ্জাতুল ইমরান ফয়সাল › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমার মিনি

১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৩:৫৮




রসুনের মা। পানের লাল রসে টসটসে হয়ে থাকত তার মুখ। সাদা চুল আর সাদা শাড়ির অপূর্ব সংমিশ্রনের ছিপ ছিপে গড়নের বুড়ি টি প্রায় ই আমাদের বাসায় আসতো।একদিন অনেক গুলো হাঁসের ডিম নিয়ে আসলো।প্রথমে ভেবেছিলাম খাওয়ার জন্য নিয়ে এসেছেন , কিন্তু আম্মা সেগুলোকে ডিম এ তা দেয়া এক মুরগির নিচে রাখলেন। ডিম আর কয়টা হবে - এই ৮/১০ টা।

সকাল গড়িয়ে সন্ধা আসে, দিন এর পর দিন কেটে যায়, ডিম ফুটে কখন বাচ্চা বের হবে - তার প্রতীক্ষা আমার কাটে না। প্রতিদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার সময় একবার এবং স্কুল থেকে আসার পর আরেকবার মুরগির পাখা সরিয়ে চেক করতাম। যদিও এতে ঠোকর খাওয়ার রিস্ক থাকত , তারপর ও নিজের অদম্য আগ্রহের কাছে তা ছিল সামান্যই।

একদিন সকাল বেলা চোখ কচলাতে কচলাতে মুরগিটার কাছে এসে দেখতে পেলাম - ডিম এর একটা ভাঙ্গা খোলস পড়ে আছে। বুকের ভেতরে উত্তেজনার ঢেউ বয়ে গেল।আরেকটু কাছে এসে বসলাম , দেখলাম একটা ছোট্ট হাঁসের মুখ মুরগির পাখার ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে আছে। আমি যে কি শান্তি অনুভব করলাম তা ভাষায় প্রকাশ যোগ্য নয়।

দৌড়ে গিয়ে আম্মাকে ডেকে নিয়ে আসলাম। আম্মা মুরগি সরিয়ে দেখলেন - ৩ টা বাচ্চা ফুটেছে , আরও বাকি আছে ৬ টা ডিম। আম্মা ডিমের খোলস গুলো ফেলে দিলেন এবং মুরগিটাকে আবার তা দেয়ার জন্য বসিয়ে দিলেন। বাকি ডিম গুলো থেকে কি আর বাচ্চা হবে না ,..? আমার উত্কন্ঠিত প্রশ্নের প্রেক্ষিতে আশ্বস্ত হলাম - যে বাকি ডিম গুলো আস্তে আস্তে ফুটবে।সেদিন স্কুলে গিয়ে পড়াশুনার মন আর রইলো না।

পরদিন সকালে - হাত মুখ না ধুয়েই সোজা গেলাম মুরগিটার কাছে। দেখি দু একটা ডিমের খোলস আজ ও পড়ে আছে , আর মুরগিটা মাথা নিচু করে ডিমে ঠোকর দিচ্ছে। প্রথমে ভাবলাম - এ কি ! নিজেই ডিম গুলো ভেঙ্গে নষ্ট করে ফেলছে !!! পরে বুঝলাম - ডিম থেকে বাচ্চা গুলো বের হতে সাহায্য করছিল মুরগি টা।
সেদিন স্কুল থেকে এসে দেখলাম - ছয়টা হাঁসের বাচ্চা নিয়ে মুরগিটা কে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। পরে জানতে পারলাম ৯ টা ডিমের মধ্যে ৩ টা নষ্ট ছিল। হাঁসের বাচ্চাগুলোর পাঁচটি ই ছিল কালো এবং ধুসর রঙের আর একটি ছিল সাদা। সবগুলা বাচ্চা ই ছিল অসাধারণ ফুটফুটে।

হাঁস এবং মুরগি দুটি ভিন্ন প্রজাতি বলেই হয়ত - লক্ষ্য করলাম ডিম এ তা দেয়া মা (মুরগি ) তার এতদিনের তা দেয়ার ফসল বাচ্চাগুলোকে (হাঁস ) অনেকটা এড়িয়ে ই চলছে।সেক্ষেত্রে বাচ্চাগুলোকে আলাদা ই রাখা হলো। সকালে স্কুলে যাওয়ার সময় দেখলাম পুঁচকা হাঁস গুলোকে মুরগির খোপের ভেতর রাখা হয়েছে , ভেতরে ধানের কুড়া খেতে দেয়া হয়েছে। খোপের দরজা বন্ধ রাখা হয়েছে , কারণ ইদানিং গুইসাপের অত্যাচার বেড়ে গেছে।

স্কুল থেকে ফিরেই হাঁসের বাচ্চা গুলোকে দেখার জন্য মন আনচান করছিল , স্কুলের বই খাতা সাথে নিয়েই দৌড়ে গিয়ে মুরগির খোপ খুলে দেখলাম। দেখলাম সবগুলো হাঁসের ছানা ই চুপটি করে বসে আছে। সবগুলা কে একটু একটু করে ধরে আদর করে দিচ্ছিলাম। পেছন থেকে আম্মা চিল্লা চিল্লি শুরু করলো স্কুলের ড্রেস চেঞ্জ করে আগে কিছু খেয়ে নিতে। আমি তাৎক্ষণিক দৌড়ে ঘরের ভেতর গেলাম ,..কিন্তু অনেক বড় একটা ভুল করে গেলাম....!

ভুল টা ছিল - আমি বের হওয়ার সময় খোপের দরজা টা আটকে যাই নি। আমার জানা ছিল না যখন হাঁস ছানাদের আদর করছিলাম ঠিক সেই মুহুর্তেই খোপের বাইরে ওৎ পেতে ছিল একটা কুমিরাকৃতির গুইসাপ..! আমি ড্রেস চেঞ্জ করতে না করতেই বাইরে ব্যপক দাপাদাপির শব্দ আর আম্মুর চিৎকারে আমি ছুটে বের হয়ে আসলাম ঘর থেকে। দেখলাম খোপের দরজা দিয়ে গুইসাপের বিশালাকার লেজ টি বের হয়ে আছে , মাথায় রক্ত উঠে গেল। একটা গদা নিয়ে ঝাপিয়ে পরলাম গুইসাপ টার উপর , কিন্তু বাড়ি টা লাগলো লেজ এ। উল্টো ঘুরেই গুই সাপ টা দিল ছুট , তার মুখ ভর্তি ছিল হাঁসের ছানায়। আর আমি নিথর দাড়িয়ে রইলাম।


যখন সম্বিত ফিরে পেলাম - খোপের মুখে তাকিয়ে দেখি ভেতরে দুটো হাঁস ছানা মৃত পড়ে আছে আর দুটো ছানা খোপের কোনায় দাড়িয়ে চিত্কার করছে। বাকি দুটো ওই গুইসাপের মুখেই ছিল বোধয়। বেঁচে যাওয়া দুটো ছানার একটি ছিল ধুসর রঙের, যার একটি ডানা ছিল ভাঙ্গা। অন্যটি ছিল একমাত্র সাদা ছানা টি যেটি ছিল অক্ষত। খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম নিজের কৃত ভুলের কারণে আর বাচ্চা দুটোকে যখন হাতে তুলে নিলাম , চোখের কোনে পানি জমে উঠলো।

কষ্টে আমি সেদিন দুপুরে ভাত খেতে পারি নি। খুব উঠে পরে লাগলাম হাঁস ছানা দুটোকে টিকিয়ে রাখার জন্য। দুদিন পর ই আহত হাঁস ছানা টি মারা যায়। ফলে একমাত্র সাদা ছানাটি ই হয়ে উঠলো আমার যক্ষের ধন।

২য় শ্রেনীর বাংলা বাইয়ের একটি গল্প ছিল যেখানে "মিনি " নামক এক পোষা বিড়াল ছানার কথা বলা হয়েছে। সেটা দেখেই আমি সাদা হংস ছানা টির নাম দিয়ে দিলাম "মিনি " ....:-)

হাঁস কি কি খায় , কিভাবে রাখতে হয় , ইত্যাদি বিষয় জানার জন্য রসুনের মা'র স্মরণাপন্ন হলাম। ওনার শিখিয়ে দেয়া পথ ই অনুসরণ করতে লাগলাম। ধানের কুড়া, ভাত , শামুক , ইত্যাদি খাওয়াতে লাগলাম। মিনি যেন হয়ে উঠলো আমার সবচেয়ে প্রিয় খেলার সাথী। খুব সাবধানে-...খুব যত্নে বড় হতে থাকে মিনি।
স্কুল থেকে এসেই আমি কোলে নিয়ে ঘুরতাম। হাসের নিয়মিত খাবার ছাড়াও আমি খাওয়াতে লাগলাম সব। বিস্কিট , চানাচুর , শাক -সবজি কোনটাই বাদ দিতাম না। দেখতে দেখতে মিনি যে কত বড় হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। সাদা ধবধবে মিনি কে আদরে যখন জড়িয়ে ধরতাম তখন সে ও পরম মমতায় আমার চুল কামড়ে দিত।

স্কুল থেকে এসে "মিনি আয় আয় "- বললেই হত , ব্যাস।যেখানেই থাকুক প্যাঁক প্যাঁক শব্দ করে দৌড়ে ছুটে আসত আমার কাছে। আমার হাত থেকে খুবলে যখন মুড়ি খেত , কি যে ভালো লাগত তা তখনকার আমি ই বোধয় জানতাম। আমি দৌড় দিলে আমার পায়ে পায়ে মিনি ও দৌড়। আমি থামলে সাথে সাথে সে ও থেমে যেত। আবার দৌড়ালে - সে ও দৌড়াতো। খুব মজা পেতাম ক্ষুদ্র মস্তিস্কের বোবা প্রানীটির পোষ মানা আচরণে।

প্রতিদিন আমি ই মিনি কে খোপের ভেতরে ঢুকিয়ে খোপ লাগিয়ে দিতাম। একদিন বিকালে এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আমার ভেতরে তখন চরম অস্থিরতা , কিন্তু নিজেকে বুঝ দিতে লাগলাম যে - কেউ না কেউ হয়ত মিনির খোপ টা লাগিয়ে দিবে ই। আমি খুব তাড়াহুড়ো করে বাসায় ফিরলাম। কিন্তু আমার আশংকা ই সত্য হলো। কেউ মিনির খোপ টি বন্ধ করে নাই। খোপের দরজা টা খোলা দেখে আমার বুকের ভেতরে ধ্বক করে উঠলো। আমি ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম আর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছিলাম যেন ভেতরে মিনি কে দেখতে পাই ,...কিন্তু আমি ছিলাম সত্তি ই অভাগা। মিনির খোপ টি ছিল শূন্য।


আমি চিত্কার করে মিনি মিনি ডাকতে লাগলাম। ঘর থেকে আম্মা , আপা, আব্বা সবাই বের হয়ে আসলো এবং মিনি কে খুঁজতে লাগলো। বাড়ির এপাশ থেকে ওপাশ , ঝোপ জঙ্গল কোনো কিছুই বাদ দেই নি। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় কিছুই ঠিক মত দেখতেও পারছিলাম না। মিনির প্যাঁক প্যাঁক ডাক বার বার আমাকে হ্যালুসিনেট করছিল। দর দর করে ঘামছিলাম আমি। অবশেষে না পেয়ে আব্বা আম্মা আমাকে জোর করে ধরে ঘরে নিয়ে গেল। সারা রাত ঘুমাতে পারি নি। শেষ রাতের দিকে একটু চোখটা লেগে এসেছিল , আর তাতেই স্বপ্নে দেখলাম - একটা বিশাল মরুভূমি , আমি আর মিনি দাড়িয়ে। আমি দৌড়ে গিয়ে মিনিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম , কিন্তু হায়!! পরক্ষনেই দেখি - আমি এক রাশ বালি ধরে আছি.....! সাথে সাথে ই ঘুম ভেঙ্গে গেল। বাইরে সবে মাত্র আলো ফুটতে শুরু করেছে। আমি বেরিয়ে গেলাম মিনি কে খুঁজতে।পাগলের মত এদিক সেদিক খুঁজতে লাগলাম। হটাথ গোয়াল ঘরের পেছনের ঝোপের কাছে গিয়ে দেখি সাদা সাদা পালকে সয়লাব, সাথে কিছু রক্ত ও। আমার মাথা তখন ঝিম ঝিম করছিল। আমার মিনির দেহাবশেষ যেন আমার প্রত্যেকটা নিউরনকে নাড়া দিচ্ছিল। চোখ বেয়ে ঝরছিল পানি।


পাওয়া না পাওয়ার এই পৃথিবীতে মানুষ অনেক কিছুই পায় , অনেক কিছু হারায় , আবার অনেক কিছু হারিয়ে পেয়ে আবার হারায়। পাওয়া না পাওয়ার এই উত্থান পতনের ঢেউয়ে হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা বিক্ষিপ্ত হয় চারপাশ।

এই ঘটনা টি একটি ৭/৮ বছরের শিশুর জন্য কতটা কষ্টদায়ক তা অনুভব করে আজ ও শিউরে উঠি।

মন্তব্য ৯ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৯) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:১৫

এহসান সাবির বলেছেন: মিনির গল্প ভালো লেগেছে।

এরকম ঘটনা একটি ৭/৮ বছরের শিশুর জন্য অনেক কষ্টদায়ক।

২| ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:৪৩

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: গল্প ভাল লাগলো।

১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৫:০২

সাজ্জাতুল ইমরান ফয়সাল বলেছেন: ধন্যবাদ

৩| ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:০৪

সাথিয়া বলেছেন: ভাইয়া এটা সত্যি নাকি গল্প? মন খারাপ লাগছে।
+++++

১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:০৬

সাজ্জাতুল ইমরান ফয়সাল বলেছেন: এটা আমার জীবনের সত্য ঘটনা ....।

৪| ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:০৭

প্রামানিক বলেছেন: ভাল লাগল।

১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৩:৩৩

সাজ্জাতুল ইমরান ফয়সাল বলেছেন: ধন্যবাদ

৫| ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ২:৩৩

ফেরদৌসা রুহী বলেছেন: আমার নিজের সাথেও এমন কিছু ঘটনা হয়েছিল। এখনো হয়। ছোটবেলা থেকেই আমার পশু পাখির প্রতি অনেক নেশা। অনেক কিছুই পুষতাম, এখনো পুষি। আর মাঝে মাঝেই এমন কিছু ঘটনা ঘটে যাতে অনেক কষ্ট পাই।

৬| ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:২৩

এম.এ.জি তালুকদার বলেছেন: স্মৃতিময় গল্পের জন্য ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.