![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
===সকাল থেকেই প্রকৃতি এক ধরনের গুমট ভাব নিয়ে ঝিম ধরে ছিল। মাঝে মধ্যে দমকা হাওয়া আর ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি। খেলার মাঠ কাদা আর জলে মাখামাখি।
বিকেলে শিহাব এসে ডাক দিল। চল, আজ কাদা-জলে মাখামাখি করে ফুটবল খেলবো। খেলাটা হবে মজার।
তারপর অনেকক্ষণ ফুটবল খেলে বাসায় ফিরছিলাম। জুবায়েরকাকার বাসার সামনে আসতেই মিষ্টি স্বরের গান কানে ভেসে এলো।
সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের কোলাহল থেমে নিস্তব্ধতায় পরিণত হলো।
আমাদের কয়েক বাসা পরই থাকেন জুবায়েরকাকা। বেতারের নিয়মিত শিল্পী। প্রতিদিন মাগরিবের আগে হারমনিয়াম নিয়ে বসে রেওয়াজে মত্ত থাকেন। দারুণ গলা। প্রগতিবাদী হওয়ায় ধর্ম-কর্মের প্রতি মনোযোগ কম। তাই পাখিরা যখন নীড়ে ফেরে, মুয়াজ্জিন যখন আজান দেন তখন তিনি বসেন গানের রেওয়াজে।
নিজেরা বলাবলি করছিলাম, কাকা একদিন অনেক বড় শিল্পী হবেন। কথাগুলো বলতে বলতে যে যার ঘরে গিয়ে কাদামাখা শরীর পরিষ্কার করলাম। তারপর নাশতা খেয়ে পড়ার টেবিলে গিয়ে বসলাম।
মাস্টারমশাই এলেন।
পড়ার টেবিলে বসে পড়তে পড়তে ঘুমের ভাব এসে ঝিমুনিটা আমার ছোটবেলার অভ্যাস। এ জন্য মারও খেতে হয়েছে প্রচুর। এভাবে কিছু সময় কেটে গেল।
মাঝে মধ্যে মাস্টারমশাইয়ের রক্ত চোখ আমাকে সচল করছিল। হঠাৎ দূর থেকে একটা মেয়েলি স্বরের বিকট চিৎকার সন্ধ্যার নীরবতা ভেঙে খান খান করে দিল।
সজাগ হয়ে উঠলাম আমরা সবাই।
আমার আব্বা, আম্মা ভেতরের কাজ-কর্ম ফেলে ছুটে গেলেন বাইরের দিকে।
আমরাও পড়ার টেবিল ছেড়ে তাদের পিছু নিলাম। আবিষ্কার করার চেষ্টা করলাম চিৎকারটা কোনদিক থেকে এসেছে।
হঠাৎ আম্মা বলে উঠলেন, জুবায়েরভাবীর চিৎকার মনে হচ্ছে?
সবাই আমরা প্রায় দৌড়েই গেলাম কাকার ঘরের দিকে। খুব জটলা ঘরের সামনে। কে যেন একটা কানের কাছে এসে ফিশফিশ করে বললো, বিষ খেয়েছেন কাকা।
কথাটা শুনে মাথা ঘুরে উঠলো আমার।
ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছে, বন্দরের অ্যাকাউন্টস অফিসার জুবায়ের সাহেব বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন।
ইতিমধ্যে সাইরেন বাজাতে বাজাতে বন্দর হসপিটালের সাদা রঙের অ্যাম্বুলেন্স এসে হাজির হলো।
কয়েকজন ধরাধরি করে কাকাকে মুমূর্ষু অবস্থায় গাড়িতে এনে ওঠালেন।
অ্যাম্বুলেন্সটা সাইরেন বাজাতে বাজাতে হসপিটালের দিকে ছুটলো।
বাসার সামনে সকল প্রতিবেশীর ভিড়। চোখে-মুখে বিস্ময়। প্রশ্ন আর কথার ঝড় উঠতে শুরু করেছে তখন।
অত্যন্ত সাদাসিধা মানুষ জুবায়ের সাহেব। একটা হাসি লেগে থাকতো তার মুখে সব সময়। সদা সুখী এ মানুষটি।
অল্প বয়সী জুবায়েরকাকার ছেলে সোহাগের পাশে গিয়ে দাড়ালাম।
আমাকে দেখেই হাউমাউ করে জড়িয়ে ধরলো সোহাগ। বলতে লাগলো, আম্মু, এতো নিষ্ঠুর কেন? কি অপরাধ করেছিলেন আমার বাবা? মা বাবাকে চড় মারলেন কেন ? বলতে বলতে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়লো সোহাগ।
ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছে, জুবায়ের সাহেবের স্ত্রী, আমরা যাকে শীলাআন্টি বলে ডাকি, তার সঙ্গে সোহাগের আব্বার কথা কাটাকাটি চলছিল অনেক্ষণ ধরে। এক পর্যায়ে শীলাআন্টি তার স্বামীর গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দেন।
এতে জুবায়ের অপমানে ইদুর মারার বিষের বোতলটি এনে গটগট করে খেয়ে ফেলেন সবটুকু। তাই এ দুর্ঘটনা।
কি নিয়ে ঝগড়া হচ্ছিল দুজনের ভেতরে? আবারও প্রশ্নটা সবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো।
আব্বা, আম্মা দুজনেই ছুটে গেলেন শীলাআন্টির পাশে।
তাদের দেখে হাউমাউ করে কেদে আম্মাকে জড়িয়ে ধরলেন শীলাআন্টি। তারপর গড়গড় করে বলতে শুরু করলেন মূল ঘটনা।
সেদিন সকালে হসপিটালে গিয়ে ডায়াবেটিসের মাত্রা চেক করা হয়েছিল। প্রায় বিশের মতো ছিল তার রেজাল্ট। সন্ধ্যায় বসে গানের চর্চায় মগ্ন ছিলেল। তারপর হঠাৎ গান বন্ধ করে রেফৃজারেটর থেকে মিষ্টির বাক্সটা বের করে মিষ্টি খেতে থাকেন জুবায়ের।
ওপাশ থেকে সেটা দেখেই হই হই করে ছুটে আসি আর চিৎকার শুরু করে দেই।
সেও আমার ওপর তেড়ে আসে।
আমিও নাছোড়বান্দা। বললাম, মিষ্টি খেয়ে ডায়াবেটিস বাড়িয়ে মরার যদি অতোই শখ থাকে তাহলে প্রেম করে আমাকে বিয়ে করলে কেন?
চোখের কোণাটা একবার মুছে হয়তোবা প্রেমের স্মৃতিই আওড়ালেন শীলাআন্টি কিছুক্ষণ। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন।
সে আমার কথা কেন শুনলো না? তাহলে তো এই দুর্ঘটনা ঘটতো না। আমি তো তার ভালোর জন্যই বলেছিলাম।
বাকবিতন্ডার এক পর্যায়ে আমি রেগে গিয়ে তার গালে একটা চড় বসিয়ে দেই।
সে তখন ছুটে যায় স্টোররুমের দিকে। দরজার কাছেই ছিল বিষের বোতলটা। আমি দৌড়ে ধরার আগেই সে খেয়ে ফেলে ওই মরণ পানি।
তারপর আমার আব্বার দিকে সজল চোখে তাকালে শীলাআন্টি বলতে থাকলেন, এখন আমি কি করবো বলে দিন? আমার তো সর্বনাশ হয়ে গেছে।
হসপিটাল থেকে খবর এলো জুবায়ের চিরবিদায় নিয়েছেন। একে তো মিষ্টি খাওয়ার কারণে ডায়াবেটিসের মাত্রা ছিল বেশি। তারপর আবার দ্রুত গতিতে বিষ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ায় ডাক্তারদের পক্ষে আর সম্ভব হয়নি তার মৃত্যু ঠেকানো।
©somewhere in net ltd.