নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আরেকটা জীবন যদি পেতাম আমি নির্ঘাত কবি হতাম
তিনশ তিনদিন ধরে প্রতিটি দীর্ঘরাত
শাহেদ অঘুমে কাটাচ্ছে ছোট্ট বদ্ধ একটি ঘরে,
রাতের কুকুরের মতো সজাগ থাকে পাহারাদারদের মতো,সারারাত নিজের সাথে কথা বলে সে ।একটিও বুকভরা নিঃশ্বাস ফেলেনি শাহেদ দীর্ঘ তিনশ তিনদিন!
শাহেদের এই অঘুমে জীবন পার করাতে কারোর কিচ্ছু আসে যায় না, সে অঘুমে থাকলেই কী, আর বেঁচে থাকলেইবা কী!
রাত হলেই শাহেদের কেন যেন মনে হয়
এখনো “মরতে না পারার নির্মম অক্ষমতা”
ডানাভাঙা জোনাকির মতো বারবার তার ঘরের কাঁচের জানালায় বসে থাকে,
আর জানালার গ্রীলে অন্ধ পেঁচার মতো উল্টো হয়ে ঝুলতে থাকে তার বুক জ্বলে যাওয়া দরিদ্রতার অপমান।
শাহেদ এখনো ভেবে পায় না তার মতো খুবই সামান্য একজন অক্ষম মানুষের বুক এফোঁড়ওফোঁড় করে পারুলের মতো কেউ এভাবেও যে চলে যেতে পারে! শাহেদের মনে হয় তার কষ্টে স্বয়ং খোদাও বোধহয় বিষণ্ন হয়ে আছেন।তিনিও হয়তো লিখতেই ভুলে গিয়েছিলেন নিয়তির ডায়রিতে তার ভবিষ্যৎ।
শাহেদ এখন বিশ্বাস করে সব সুখ লুকানো আছে টাকা পয়সায়। তার মতো দরিদ্র মানুষের জীবনে সুখ বলে কোনো শব্দ নেই ;
না হলে পারুল এভাবে চলে যায় তাকে ছেড়ে!
যদি পারুলের ঠিকানা জানত তাহলে চিঠি লিখে জানতে চাইতো কেন তাকে এভাবে পরিত্যক্ত করে চলে গেল। বিয়ের পর আর কখনোই চিঠি লেখা হয়নি পারুলকে। মাঝে মাঝে পারুল তাকে বলতো, তুমিতো এখন আমাকে চিঠি লিখো না।
আজকাল পারুলকে সে প্রায়ই মনে মনে চিঠি লিখে।সেসব চিঠি হয় তার কষ্টের সব রং মেশানো, এই সব চিঠি প্রেম,ভালোবাসা, অভিমান আর অভিযোগের চিঠি নয়,
এ চিঠি হয় একজন স্বামীর অক্ষমতার স্বীকারোক্তি, এ চিঠি হয় একজন পিতার অক্ষমতার বিলাপ।
করোনা ভাইরাস নামক এক অসুখ শাহেদের সুখেও অসুখের আগুন ধরিয়ে দিল।ছোট্ট একটা চাকরি করত সে। যা বেতন পেত কোনো মতে চলে যেত তার সংসার। কপালটা এমনই খারাপ কোম্পানীর মালিকটা মরে গেল একদিনেই এই অসুখে!
আশ্চর্য, মালিকের এত টাকা পয়সা ছিল অথচ শহরের সবচেয়ে দামি ব্রান্ডেড হাসপাতালও তাকে বাঁচাতে পারল না।
মালিক নাই, অফিস বন্ধ তাই বেকার হয়ে গেল শাহেদ।
তখন চারদিকে শুধু মৃত্যু আর বেকার মানুষের ছড়াছড়ি।বাড়ি ভাড়া জমতে শুরু করল। অল্প যাকিছু জমানো টাকা তাও শেষ হয়ে গেলে বুঝতে না বুঝতে। চাকরির জন্য শাহেদ সারাদিন ক্ষুধার্ত কাকের মতো ঘোরাঘুরি করে অফিস পাড়ায়। সবখানে আতংক আর অস্হিরতা,লকডাউন আর শাটডাউনের জাঁতাকলে শাহেদের মেরুদণ্ড তখন ভেঙে চৌচির।
শাহেদের সক্ষমতার উপর পারুলের অবিশ্বাস তখন থেকেই। ব্যবহার বদলে গেছে, কন্ঠে মায়া নেই। পারুলের চোখেমুখে ভয় আর অসহায়ত্বের নির্মম ছায়া সারাদিন উড়ে বেড়ায় । শাহেদের অভাব তখন দু’পায়ে দাবড়ায় তার সংসারের বুকে।
শাহেদ সারাদিন রাস্তায় হাঁটে আর হাঁটে নাক মুখে মাস্ক পরে। কেউ যেন তাকে না চিনে। সব জমানো টাকা শেষ একসময়। ঘরের বাজার করার ভয়ে পারুলের কাছ থেকে সারাদিন লুকিয়ে শাহেদ পথেঘাটে ঘুরে বেড়ায়। বাড়ি ফিরে গভীর রাত করে,
কিছু না বলে চুপচাপ শুয়ে পড়ে ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত শরীরে।পারুলও ভয়ে জানতে চাওয়া ছেড়ে দিয়েছ সারাদিন শাহেদ কী খেল বা না খেয়ে আছে।
দিন দিন অসহায় হতে হতে শাহেদ মাটির সাথে মিশে যাচ্ছিল। যখন তার বাচ্চা মেয়েটার দুধের টাকাও আর জোগাড় করতে পারছিল না।কেউ ধার দেয় না, তখনই টের পেল এই শহরে তার বন্ধু বলে আর কেউ নেই।
একবার ঠিক করলো কয়েকদিন রিকশা চালাবে, কিন্তু সেই চেষ্টাও বৃথা। তাকে কোনো মালিক রিকশাও দেয় না। শেষ পর্যন্ত কতবার ভেবেছে মুখে বড় মাস্ক পরে ভিক্ষায় নেমে যাবে। নিম্নবিত্ত অহং বার বার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাই তাও পারেনি। একবার সিদ্ধান্ত প্রায় নিয়েই ফেলেছিল চুরি বা ডাকাতি শুরু করবে। শেষ পর্যন্ত সেই সাহস হয়নি।
সারাদিন রাস্তায় ঘোরাঘুরি করে গভীর রাতে একদিন বাড়ি ফিরে দেখে পারুল নেই,
মেয়েটাও নেই ! দরজা হালকা ভেজানো ছিল। অথচ শূন্য পড়ে আছে তার ভাড়ায় থাকা ঘর সংসার।
প্রথমে ভেবেছে বাড়িওয়ালার প্রতিদিনের অপমান সহ্য করতে না পেরে পারুল হয়তো বাবার বাড়ি চলে গেছে। তারপরই চোখে পড়ল টেবিলের উপর সাদা কাগজে। এতে লেখা ছিল “দরিদ্রতার এই অপমান মরণের চেয়েও বড় কষ্টের।"
পারুল তার বাবার বাড়িতেও নেই!
সব পরিচিত-অপরিচিতের দরজায়,
থানা-পুলিশ, হাসপাতাল কোথাও নেই পারুল আর তার মেয়ের খবর,
শুধু শূন্য আর শূন্য এই জগত।
কোথায় গেল পারুলরা শাহেদ একটু জানতেও পারল না!
শ্বশুড় বাড়ির লোকজন শাহেদের নামে মামলা করে দিল। তাদের মেয়ে আর নাতনিকে খুন আর গুম করার অভিযোগে।
ছয়মাস জেল খেটে জামিনে বের হয়ে দিনরাত পারুল আর মেয়েটাকে খুঁজে, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে সন্ধান চাই লিখে পারুল আর মেয়েটার ছবি বিলি করে। ফেসবুকে প্রতিদিনই সন্ধান চাই বলে একই লিফলেটের ছবি পোস্ট করে।
এত কিছুর পরও পারুল আর মেয়ের সন্ধান কেউ দেয় না। একা থাকার ভয়ে
শাহেদ কতবার যে মরতে চেয়েছে।
সেই জন্য সে মাস্কবিহীন ঘুরেছে রাস্তা রাস্তায় হাজারো মানুষের ভীড়ে সারাদিন।এমনকি হাসপাতালে গিয়ে করোনা রোগীর পাশে বসে থেকেছে, তবুও করোনা তাকে আপন করল না।
পারুলের বন্ধ মোবাইলে ফোন করতে করতে শাহেদের হাতের আঙুলে ক্লান্তি ভর করেছে।
সেই একই নারী কন্ঠে একই কথা বারবার বলে "আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটি আর ব্যবহৃত হচ্ছে না!”
তিনশ তিনদিন শাহেদ পারুল আর মেয়েটাকে দেখে না। তার মেয়েটা বোধহয় কথা বলা শিখে গেছে এতদিনে। শাহেদের চেহারা হয়তো ভুলে গেছে। আহারে, বাবা বলে ডাকা হয়তো শিখতে পারেনি।
লকডাউন শাটডাউনের খেলা শেষ, করোনা এখন দুর্বল। বন্ধু তারেক দয়া করে একটা মোটর সাইকেল কিনে দিয়েছে শাহেদকে।
এটা দিয়ে শাহেদ পাঠাও আর উবারে মানুষ টানে আর সারাদিন পারুলদের খোঁজে।
তারপর একদিন সেই ফেসবুকেই শাহেদ পারুলকে দেখল। পাশে মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকা একজন পুরুষ।
শাহেদ এত আশ্চর্য হলো সেই পুরুষের ছবি দেখে, পুরুষটি তারই বন্ধু তারেক! সেই আবার তাকে মোটর সাইকেল কিনে দিয়েছে!
প্রায়ই সময় পেলে সেও শাহেদের সাথে পারুলদের খোঁজত, জেল থেকে জামিনে তারেকই তাকে বের করেছে।শাহেদ কিছুই বুঝতে পারল না কিভাবে কী হয়েছে!
তারেক শুধু একদিনই তার সাথে তারই বাসায় গিয়েছিল।এরপর আড়াঁলের ঘটনা তার জানা নেই। কোনদিন পারুলের মুখে একবারও তার নাম শুনেনি।
তারেক আর পারুলের হাসিখুশি ছবি,
মেয়েটা তারেকের কোলে। মেয়েটা অনেক সুন্দর হয়েছে পারুলের মতোই।
শাহেদের বেকারত্ব আর দরিদ্রতার বেড়াজালে পারুলের কীভাবে কী হয়েছিল
শাহেদ একবারের জন্যও বুঝতে পারেনি,
জানতেও পারিনি! পারুলের তো কোনো অভিযোগই ছিল না শাহেদের প্রতি কখনোই!
শাহেদ শুধু ভাবত তার বেকারত্ব,আর তার জলে ভাসা মানিব্যাগ পারুলকে কষ্টে রেখেছে প্রতিক্ষণ।
শাহেদ সেই সময় মনে মনে খোদার কাছে চাইত তার এই দরিদ্রতার অপমানের কষ্টটুকু শুধু তার বুকেই যেন থাকে।
পারুলকে যেন দরিদ্রতার এই অপমান,কষ্ট আর গ্লানি থেকে খোদা দূরে রাখে। শাহেদ না হয় মাটির সাথে আরেকটু মিশে যাবে অর্থ কষ্টে আর অপমানের চাপে।
শাহেদ এখন দরজা জানালা আটকে নিজেকে লুকিয়ে রাখে আর শান্তনা দেয়
পারুলরা ভালো আছে, সুখের সংসারে আছে। তার মেয়েটা তিনবেলা অন্তত খেয়ে পরে ভালো আছে। শাহেদের অক্ষম বুক এফোঁড়ওফোঁড় করে বিবশ দীর্ঘশ্বাসশূন্য ঘরের দেয়ালে দেয়ালে ধাক্কা খায়, শাহেদ কাঁদে আর কাঁদে।
এক মুহূর্তের জন্যও শাহেদের মন ভালো থাকে না। পারুলরা ভালো আছে ভেবেও
কাঁদে আর কাঁদে।
শাহেদ এখনো সেই একই ভাড়া বাড়িতেই থাকে এক অ-সংসারে, যেখান থেকে পারুলরা চলে গেছে শাহেদকে কিছুই বুঝতে না দিয়ে।
সে এখন প্রতিদিনই পারুলকে একটি করে চিঠি লিখে। তারপর পারুলের নাম লিখে সে ঘরের টেবিলে পাথর চাপা দিয়ে রেখে দেয়।
প্রতিটি চিঠির নিচে একই কথা লেখা থাকে,
“যদি তুমি কোনো একদিন এই শহরে ফিরে আসো, তবে তোমার কাছে লেখা আমার চিঠিগুলো নিতে একবার জন্য হলেও এই অ-সংসারের বাড়ির দরজায় টোকা দিও।
আমি কাঁদি আর কাঁদি সংসারের জন্য
আমি কাঁদি আর কাঁদি তোমার জন্য
আমি কাঁদি আর কাঁদি মেয়েটার জন্য
ইতি
তোমার শাহেদ।
—————-
রশিদ হারুন
মন্ট্রিয়াল, কানাডা
২৭/১২/২০২৩
২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ১০:১৪
জিএম হারুন -অর -রশিদ বলেছেন: ধন্যবাদ
২| ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৩:৫৮
মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বলেছেন:
জীবন এমনই হয়।
২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ১০:১৫
জিএম হারুন -অর -রশিদ বলেছেন: হা
৩| ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৫:৩২
রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর লেখা। আবেগ আছে। হাহাকার আছে।
আছে পাওয়া না পাওয়া।
২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ১০:১৫
জিএম হারুন -অর -রশিদ বলেছেন: ধন্যবাদ
৪| ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ১০:০২
সেলিম আনোয়ার বলেছেন: ভেবেছিলাম কবিতা এখন দেখি গল্প। আমি অবশ্য অল্প অল্প গল্পও পড়ি। হৃদয় এফোঁড়ওফোঁড় করার যাতনা সে বুঝবে যে এমন পরিস্থিতি মোকাবেলা করবে ।
২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ১০:১৬
জিএম হারুন -অর -রশিদ বলেছেন: ঠিক
৫| ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১২:৩১
মিরোরডডল বলেছেন:
রশিদের এমন লেখাগুলো পড়লেই আমার মতো হার্টলেস মানুষেরও চোখের কোনে এক বিন্দু পানি কখন যে চলে আসে!!!!
ভালোবাসার মানুষ কেনো এভাবে কষ্ট দিয়ে চলে যায়!!!!!
২৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ৩:২৫
জিএম হারুন -অর -রশিদ বলেছেন: আপনি ভালো থাকবেন
©somewhere in net ltd.
১| ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৩:৫১
স্বর্ণবন্ধন বলেছেন: ভালো লিখেছেন।