![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
জান্নাতমহল !!!
…………………………… মোঃ গোলাম কিবরিয়া.
.
পাশের বাসার নবাগত ভাড়াটিয়া তিনি। পরিচিত হতে এলেন দেয়ালের অপর পাশে বসবাসকারী প্রতিবেশীর সঙ্গে। এ ঘরের বাচ্চা গুলো অন্য সবার চেয়ে আলাদা। চোখে পড়ে। ভদ্র, শান্ত শিষ্ট। আশেপাশে আরো কয়েকটি ফ্ল্যাটেও এ-কয়েকদিনে যাওয়া হয়েছে। গিন্নিদের সাথে খোশগল্প হয়েছে। কিন্তু এ ঘরের মানুষগুলোকে কেন যেন ব্যতিক্রম মনে হচ্ছে তার। মেজবান হাসিমুখে অভ্যর্থনা করে বসালেন। ঘরের সাজানো-গোছানো পরিবেশ দেখে মেহমানের চোখ জুড়িয়ে গেল। চারটা ফুটফুটে বাচ্চা । তিনটা ঘর জুড়ে হুটোফুটো করছে। বেড়াল ছানার মত। তিন নাম্বার বাচ্চার বয়স তিন কি চার বছর হবে।
.
জড়ানো আদূরে কন্ঠে বলে উঠলঃ আম্মু ! আজ জান্নাতে ঘর বানাবে না ?
তার দেখাদেখি বাকি দুইজনও বলতে শুরু করলঃ আম্মু ! আজ জান্নাতে ঘর বানাবে না ?
মেহমান তো দারুণ অবাক ! এতটুকু ছোট বাচ্চা এটা কী বলছে ? জান্নাতে ঘর কিভাবে বানাবে ? তিনি বাচ্চার মায়ের কাছে কৌতূহলী প্রশ্ন করেন।
প্রশ্ন শুনে মেজবানের মুখে স্মিত হাসি ফুটে উঠে। শরবতের গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বলেন- একটু অপেক্ষা করুন! নিজের চোখেই দেখে যাবেন ব্যাপারটা। আসলে ওটা আমার ছানাদের ঘরোয়া খেলা ! মা হাতের কাজটা গুছিয়ে এলেন। মেহমানকে হালকা নাস্তা দিলেন। তারপর কোলেরটাকে নিয়ে মেঝেতে বসে গেলেন। বড় মেয়েটা ছোট দু’ভাইকে নিয়ে মাকে ঘিরে বসল। সবার চোখমুখ থেকে উৎসাহ উদ্দীপনা যেন ছিটকে বেরুচ্ছে ।
.
এক................! দুই...................!! তিন ................!!! শুরু “জান্নাতমহল” নির্মাআআআআণ !
মায়ের ঘোষণা শেষ হতেই তিন কচিকাঁচা একসাথে সূরা ইখলাস পড়া শুরু করল। পড়া শেষ হলো। একে একে দশবার পড়া হলো। পড়া শেষ করেই সবাই সমস্বরে হৈ চৈ করে উঠল- ‘আলহামদুলিল্লাহ ! আমরা জান্নাতে একটা প্রাসাদ বানিয়ে বানিয়েছি ।’
খুব ভালো করেছ ! এবার বলত বাছারা, তোমরা এই প্রাসাদে কী রাখতে চাও ?
আম্মু! ধনভান্ডার রাখতে চাই !
ঠিক আছে রাখ!
লা হাওলা ওয়া লা কুউয়াতা ইল্লা বিল্লাহ! লা হাওলা ...................... ইল্লা বিল্লাহ!
বা”চারা সমস্বরে ইস্তেগফার পড়া শেষ করল। মায়ের মুখে ফুটে উঠল তৃপ্তির হাসি! আশ্চর্য কন্ঠে তিনি বলতে লাগলেন- ওমা! কী বড় কুনুজ বানিয়েছ তোমরা! আচ্ছা, এবার বল তো তোমরা কাকে বেশী ভালোবাসো ?
আল্লাহকে !
তারপর ?
আমাদের দয়াল নবিজী (সাঃ) কে।
কেয়ামতের দিন সবার কেমন লাগবে ?
ভিষণ পিপাসা লাগবে আম্মু!
তখন কোন জিনিসটা মানুষের সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন হবে ?
নবীজি (সাঃ) এর সুপারিশ!
তোমরা কি সেদিন নবীজি (সাঃ) এর সুপারিশ আর পানি পেতে চাও ?
জ্বি চাই!
তাহলে তোমাদের এখন কী করতে হবে ?
আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা সাইয়্যেদীনা মুহাম্মদ ............ ওয়া আলিহি ওয়া সাহাবীহি ওয়াসাল্লাম।
বাচ্চাগুলো সূর করে দুরুদ শরীফ পড়া শেষ করে। হাসিমুখে মা এবার নতুন প্রশ্ন করেন- আচ্ছা, কার কার জান্নাতে বাগান করার শখ ?
আমার আম্মু ! আমার !! আমার !!!
সকলেই হাত তুলে সোৎসাহে চিৎকার করে ওঠে। মা সবাইকে সামলে নিয়ে বলেন আচ্ছা ঠিক আছে। সবাই বাগান করবে। তাহলে তোমাদের এখন কী করতে হবে ?
.
সুবহানাল্লাহ ! সুবহানাল্লাহ !! সুবহানাল্লাহ !!!
.
বাচ্চারা এক এক জন বিভিন্ন রকম জিকির করে যায়। এক সময় জিকির জিকির খেলা শেষ হলো। সবাই খুশিমনে আগের হুটোপুটিতে ফিরে গেল। মহিলাও খুশিমাখা চেহেরায় ঘরের মেঝে থেকে উঠে এসে অতিথীর সামনে গিয়ে বসলেন।ততক্ষণে মেজবানের দু’চোখ কপালে। হায় খোদা! এত সুন্দর খেলা দেখা দূরে থাক, এমন পবিত্র এবং শিক্ষণীয় খেলার কথা তো কল্পনাতেও আসেনি কখনো। আরো আফসোসের বিষয় হলো তার নিজের ছেলে মেয়েগুলো জিকির আসগার দূরের কথা নবীজি (সাঃ) কে ঠিকমত চিনবে কি না ঘোরতর সন্দেহ! আগুন্তক মহিলাটির কপালে দুশ্চিনতার ভাঁজ দেখা যায়। আজ, এই সফল মা’ এর সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বড় বেশী ব্যর্থ, প্রচন্ড অযোগ্য বলে মনে হতে থাকে তার। অনুতাপে মনটা সংকুচিত হয়ে ওঠে। একটা লম্বা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চরম আশ্চর্যে মেজবানের দিকে তাকিয়ে জিঞ্জাসা করেন- আপা তাদের কিভাবে এরকম করে গড়ে তুললেন ? আমার সন্তানগুলো তো আরবী অক্ষরও চিনে না। রাজ্যের বিস্ময় মহিলাটির চোখে মুখে। এ ঘরের মা মানুষটি এবার সহসা বলতে থাকেন- আসলে সবই সু অভ্যাসের ফল। ছোটরা গল্প শুনতে ভালোবাসে! খেলাধুলা করতে পছন্দ করে। ছোটবেলা থেকেই এদেরকে খেলাচ্ছলে, গল্পচ্ছলে এসব শিক্ষা দিয়েছি। সহজ সহজ আয়াতের অর্থ শুনিয়েছি। সহজ সহজ হাদীস এর অর্থ বুঝিয়েছি। বিভিন্ন জিকির শিখিয়েছি। দো’আ শিখিয়েছি। সাথে সাথে কোন আমলের কী লাভ, সেটা জানিয়েছি!
.
এভাবেই শুনতে শুনতে, খেলতে খেলতে একসময় ওরা নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের সাথেই মিলিয়ে ফেলেছে ব্যাপারগুলোকে। আমার ঘরে যে এমন করা অসম্ভব! আমার কী হবে ? আমি নিজে খুব একটা ধর্ম কর্ম করি না! তবে এ’টুকু বুঝি যে এটা করা দরকার। নবাগতার কন্ঠে ব্যাকুলতা ঝরে পড়ে। এ বাড়ির মহিলাটি তাকে আশ্বস্ত করতে চান- সন্তানকে মানুষ করতে হলেসবচেয়ে বেশী দরকার মা-বাবার দু’আ। নবীগণও যেখানে সন্তানের জন্য দু’আ করেছেন! আমরা সাধারণ মানুষকী করা উচিত ভেবে দেখুন !কী কী দু’আ করতে পারি আপা ? আপনি তাদেরকে যেমনটা করতে চান, সেই দু’আ করবেন খোদার কাছে। একজন নেককার হওয়ার দু’আ করবেন! তাছাড়া ওদের আব্বু আর আমি মিলে কিছু নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করি! সন্তানকে মানুষ করতে হলে কিছু কষ্ট স্বীকার করতেই হয়! নিয়মগুলো একটু আমাকে বলবেন প্লিজ?
অবশ্যই! আসলে এটা তেমন কঠিন কিছু নয় ।
• ঘরে ধর্মীয় পরিবেশ বজায় রাখা।
• বাইরের কারো সামনে তাদেরকে জামা কাপড় পড়াই না, এমনকি ভাই বোনদের সামনেও না। একটু বুঝ হওয়ার পর থেকে চেষ্টা করেছি, তাদের ‘সতর’ যেন কেউ না দেখে। নিজেই যেন আড়ালে গিয়ে পোশাক পরতে পারে।
• বাড়িতে মেহমান এলে তাদের সাথে কোনও বাচ্চাকে ঘুমুতে দেই না। খেয়াল রাখি সন্তান যেন আলাদা রুমে এককী রাত না কাটায়।
• পুরুষ মেহমান এলে খেয়াল রাখি বাচ্চারা যেন তাদের কোলে না বসে।
• মুখে বা ঠোঁটে চুমু খাওয়া যাবে না, সর্বোচ্চ কপালে চুমু খাওয়া যেতে পারে। তাও একদম ছোটবেলায়। শিশুকেও অন্য কাউকে চুমু খেতে জোরাজুরি না করা। কারো কোলে বসতে না চাইলে জোরাজুরি করে না বসানো। তাদের মনের উপর চাপ তৈরী না করা।
• হারাম বা গুনাহ করতে পারে,এমন কোনও সুযোগই তাদেরকে দেই না। সবসময় একটা চোখ তাদের প্রতি নিয়োজিত রাখি। চাচা-মামা-কাকা কারও হাতেই পুরোপুরি ছেড়ে দেই না। এমনকি তার সমবয়সী বন্ধুর সাথেও না। অল্প সময়ের জন্য হতে পারে, তবে নিয়মিত নয়
মোটেও।
• শিশুদের সাথে সম্পর্ক অত্যন্ত স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসা। সে যেন আমাকে সবকিছু মন খুলেবলতে পারে। দ্বিধা সংকোচ ছাড়াই।
• যতদূর সম্ভব অবাস্তব এবং অনৈসলামিক কার্টুন দেখা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা। কারন ‘এ’থেকেই ভবিষ্যতে ‘গুনাহ’ দেখার পথ তৈরী হয়।
• গণজমায়েত, অন্ধকার স্থান ও পরিত্যক্ত স্থানে সন্তানকে একা বা অন্যকারো সাথে যেতে না দেয়া।
• বিনোদন কেন্দ্রগুলোর ব্যাপারেও সতর্ক থাকা। শিশুমনে পাপের দৃশ্যগুলো গভীরভাবে রেখাপাত করে। দু’জনের হাত ধরাধরি করে হাঁটার জীবন্ত দৃশ্য পর্দায় অসভ্য ছবি দেখার চেয়েও মারাত্মক। তার অবচেতন মনে অনুসিদ্ধান্ত তৈরী হতে থাকে, এভাবে দু’জন নারী-পুরুষ হাত ধরাধরি করে হাঁটা বা একান্তে বসে থাকা বুঝি বৈধ !
• ছেলে হলে মেয়ে শিক্ষক, মেয়ে হলে ছেলে শিক্ষক এর কাছে না পড়ানোর শতভাগ চেষ্টা করা। এমনকি শিক্ষাদানটা পর্দার আড়াল থেকে হলেও নিরাপদ মনে না করা। মেয়ে বা”চাদেরকে যথা সম্ভব কম বাইরে পড়তে পাঠানো।
• বাড়াবাড়ি পরিহার করা। আদর ও শাসন উভয় ক্ষেত্রেই। ভালো কাজের জন্য নগদ কিছু পুরস্কার দেয়া, উৎসাহ দেওয়া।
• সর্ব অবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা করতে শেখানো। নামাজের সময় তাদেরকে সঙ্গে রাখা। ছোট ছোট আমল শেখানো।
এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে মহিলাটি থামেন। ততক্ষণে অতিথীর তো চক্ষু চড়কগাছ !!! অশ্রুসজল চোখে শূণ্যে আপন মনে ভাবছিলেন, এ পৃথিবীর চমৎকার একটা রুপ এতাদিন তার অদেখা ছিলো। জীবনের কত চমৎকার একটা সুখের দৃশ্যে তার নজরে আসে নি এতো বছরেও। নিজের অজ্ঞতার দুঃখে মন খারাপ হতে থাকে তার। তবে দেরীতে হলেও এই অসাধারণ দৃশ্যটি তার দৃষ্টিগোচর করেছেন এবং এই সফল মহিলাটির মাধ্যমে তাকে শেখানোর ব্যবস্থা করেছেন এই আনন্দে তিনি অফুষ্টে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে বলে উঠেন -
“আলহামদুলিল্লাহ”
©somewhere in net ltd.