নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
জীবন নদীর বাঁকে বাঁকে দুঃখ কতো লুকিয়ে থাকে কেউ তো জানে না....
কম্পন অনুভূত হবার পর উদোম গায়ে ছেলেকে কোলে জড়িয়ে ছয় লম্প দিয়ে তিন তলা থেকে রাস্তায় নেমে গেলুম।
উচ্চস্বরে আল্লাহ আল্লাহ করছি, এমন সময় পাশের বাসার বৌদি বললেন- "বাহ বেশ মাসল বানিয়েছো তো!"
বউ সেই কথা শুনতে পেয়ে ডর-ভয় ত্যাগ করে দৌড়ে বাসা থেকে চাদর এনে গায়ে জড়িয়ে দিয়ে ধমকের সুরে বলল, "তুমি উদোম গায়ে নিচে আসছো ক্যান?"
বললাম, "লুঙ্গিটা যে পরে এসতে পেরেছি সেটাই তো অনেক। কম্বলের নিচে সেটা খুঁজে পেতেই তো বেশ বেগ পেতে হয়েছে। ঐ যে চেয়ে দেখ, আমি তো তবু লুঙ্গি পড়ে এসেছি- ঐ ব্যাটা তো ক্ষুদ্র প্যান্ট পরেই চলে এসেছে। বড় প্যান্ট পরার আর সময় পায় নি।"
বউ ঝাঁপটা মেলে বলল, "আমি গেলাম। তুমি থাকো। আবার ভূমিকম্প হলে দেয়ালের নিচে চাপা পড়ে মরবো।"
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা উ্ত্তর ফ্ল্যাটের আশি বছরের এক নানি থর থর করে কাঁপছেন। দুইজন তার দুই বাহুতে ধরে সোজা করে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন।
জিজ্ঞেস করলাম, "নানি ভয় পেয়েছেন?"
নানি কান খাড়া করে ইশারায় জানতে চাইলেন, কি বলছি।
"নানি ভয় পেয়েছেন?"
নানি মাথা উপর নিচ করে জানালেন, ভয় পেয়েছেন। আশি আর আঠারো- বয়স যাই হওক না কেন, এই পৃথিবীতে জীবনের মায়া কারো কম নয়।
সামনের বিল্ডিং এর মেসে থাকা ব্যাচেলর মেয়েরা সব নেমে এসেছে রাস্তায়। উদোম গায়ে কিছুটা শীত শীত লাগছিলো আমার। হা করে কিছু সময় মেয়েদের দিকে তাকিয়ে রইলুম। মৃত্যু ভয় মুহূর্তে যেন কোথায় উবে গেল। মনে হলো ভূমিকম্প এক লাথিতে নরক থেকে স্বর্গে পাঠিয়ে দিয়েছে যেন। জয়তু ভূমিকম্প! জয়তু ভূমিকম্প!
দক্ষিণ পাশের দালানের এক আঙ্কেল কাছে এসে বললেন, "তুমি? চিনলাম না তো!"
বললাম, "জ্বি আমি অমুকের ছেলে।"
"আহহা বাবা, দেখ দেখি, আজ এত বছর একই জায়গায় থাকি অথচ কেউ কাউকে চিনি না। ভালোই হলো আজ তোমাকে চিনতে পারলাম। আমি তোমার শফিক আঙ্কেল।"
চারতলার পূর্ব পাশের আন্টি পশ্চিম পাশের আন্টিকে জড়িয়ে ধরে বললেন, "আহ হা ভাবি পাশাপাশি থাকি। অথচ দেখাই হয় না আমাদের। বাসায় আসবেন কিন্তু ভাবি...। আসবেন কিন্তু..।"
সদ্য রিটায়ার্ড করা ছয়তলার কবির আঙ্কেল কি এক চুটকি বলে সবাইকে হাসিয়ে দিলেন। এত ভয় ও আতঙ্কের ভেতরও সবাই হোহো করে হাসছে।
কিছু দিন আগে ঝগড়া হয়ে যাওয়া মিজান চাচাও কাছে এসে বললেন, "এই তোমার বাবা কই? উনাকে দেখছি না যে?"
সচিব আঙ্কেল গায়ে একটা গামছা জড়িয়ে নাটকের কোন চরিত্রের ন্যায় সবার মাঝে পায়চারি করছেন। বেমালুম ভুলে আছেন, তিনি একজন রাসভারি চরিত্রের মানুষ। তিনি সচিব আঙ্কেল।
দুইজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর অতি গুরুত্বপূর্ণ আত্মীয়ের পুরো পরিবার রাস্তায় নেমে সবার সাথে মিশে সুখ দুু:খের আলাপ করছেন কুশলাদি বিনিময় করছেন।
দুই বিল্ডিং পরের নিতু আপু বললেন, "কি রে দুষ্টু তোকে যে এখন আর দেখিই না। থাকিস কই? কোলে কে?"
"জ্বি আমার ছেলে।"
"বলিস কি রে কবে হলো! উমা... কিছুই তো জানি না। তলে তলে তুই এতদূর!"
"জ্বি সাড়ে তিন বছর!"
প্রায় মিনিট চল্লিশেক পর সবার আতঙ্ক কেটে গেল। যে যার মতো আবার নিজ নিজ বাসার পথে হাঁটতে লাগলো। ভেঙ্গে গেল মিলন মেলা।
ছোট বেলায় অপেক্ষায় থাকতাম, কখন কারেন্ট যাবে। কখন আশপাশের ছোটবড় সবাই রাস্তায় নেমে আসবে। ছুটেছুটি হবে। আনন্দ হবে। কুশলাদি বিনিময় হবে।
গতকাল মনে হলো, মাঝে মধ্যে এরকম একটু আধটু ঝাঁকুনির বড্ড প্রয়োজন আমাদের। কতো কাছাকাছি থেকেও যেন কতো দূরে আছি আমরা.... দিনে দিনে শুধু বেড়েই চলেছে সেই দূরত্ব....
©somewhere in net ltd.