নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

তুমি একটা খারাপ কাজ করেছো তার মানে তুমি একজন মানুষ; তুমি সেই খারাপ কাজটার জন্য অনুতপ্ত হয়েছো তার মানে তুমি একজন ভাল মানুষ। \n\nwww.facebook.com/bandar.khola

হাফিজ রাহমান

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম আদালত হলো মানুষের বিবেক।

হাফিজ রাহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত

১০ ই মার্চ, ২০১৭ রাত ১০:৩৯

(১)
একটি গল্প হয়ে যাক।
এসো বাবা ভিতরে এসো। না আঙ্কেল, সমস্যা নেই। যেভাবে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলে ভিজে চুপ চুপ হয়ে যাবে। বাবার মত দেখতে মুরব্বি গোছের মানুষটির মায়া দেখে সামিনের সংকোচ কেটে গেল। এতক্ষণ সামিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। বারান্দায় কোন বেড়া গোড়া নেই। তিন পাশ উদাম খোলা। ঝাপসা বৃষ্টিতে সামিন অনেকটা ভিজে গেছে।
গ্রামের নাম জীবনতলা। এখনো আধুনিক জীবনের ছোঁয়া লাগে নি এখানে। তবুও গ্রামীণ সুন্দর সুষমার কোন কমতি নেই। নদী নালা খাল বিল আর সবুজের সমারোহে মধুময় হয়ে আছে আবহ বাংলার সুন্দর এ গ্রামখানি। বছর খানেক হল এখানে গড়ে উঠেছে ইসলামী বিদ্যাপীঠ জামিয়া ইসলামিয়ার মনকাড়া প্রাসাদ। অল্প সময়ে বেশ সাড়া জাগিয়েছে গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলোর হৃদয়ে। তারা এত বড় দালান কোঠার চাকচিক্য এর আগে কখনো দেখে নি। তাই মাদরাসাটিকে নিয়ে তাদের স্বপ্ন ভালবাসার শেষ নেই। মাদরাসাটি গ্রামবাসীদের শুধু দিয়েই যাচ্ছে। বিনিময়ে নিচ্ছে না এতটুকু। মাদরাসাটির পরিচালনায় রয়েছেন বিশিষ্ট মেধাবী আলেম মুফতী মাওলানা নাগিব হাসান। তিনি ঢাকা শহরের বেশ কয়েকটা নামী মাদরাসাও পরিচালনা করছেন। তার ফিনিন্সিয়াল হাত বড় মজবুত।
মাওলানা নাগিব হাসান সাহেবের তিন ছেলে। বড় ছেলে তামিম শাকের আল-আজহার ভার্সিটিতে ইসলামী আইনের উপর পি এইচ ডি করছে। দ্বিতীয় ছেলে নাঈম মাহফুজ মদীনা ভার্সিটিতে হাদীসের উপর বি এ অনার্স করছে। ছোট্ট ছেলে সামিন কুরআনের হিফজ শেষ করে এখন সেভেন সমমান নাহুমির ক্লাসে পড়ছে। ছোট ছেলেটা বেশ প্রকৃতি প্রেমিক। এ তরুণ বয়সে সাহিত্যেও বেশ হাত হয়েছে ওর। শহুরের বিলাসী জীবনে ওর মন বসে না। সামীন মনে করে, গ্রামের সাদামাটা নীরব নিস্তব্ধ পরিবশই মূলত লেখা পড়ার জন্য সবচে বেশি উপযোগী। বাবা মা চান আদরের ছেলেটাকে একটু কাছে রাখতে। সামিন বাবা মাকে বুঝাতে চেষ্টা করে। প্রথম প্রথম সে ব্যর্থ হয়। শেষে বাবা মা ছোট্ট আদরের ছেলের আবদার মেনে নেয়। এবার আনন্দে সামীনের মন নেচে উঠে। কংক্রিটের ঢাকা শহরকে বিদায় জানিয়ে সামীন বাবার গড়া গ্রামের মাদরাসায় চলে আসে। রোজ বিকালে সামিন কিতাব হাতে বেরিয়ে পড়ে সবুজ শ্যামল খোলা প্রান্তরে। খোলা আকাশের নিচে সবুজের নরম গালিচায় বসে পড়ে। ছেলেটা একটু ভাবুক প্রকৃতির। যে কোন বিষয় নিয়ে ভাবনায় বুঁদ হয়ে থাকে। প্রতিটি বিষয়ের শিকড়ে পোঁছুতে চেষ্টা করে। নরম সবুজ দুর্বা ডগায় বসে সামীন ভাবনার অতল গহীনে হারিয়ে যায়। ছেলেটার মন লেখা পড়ায় অতটা নেই। তবে মাঝে মধ্যে লেখা পড়ায় মন দিয়ে সবাইকে চমকে দেয়। অবশ্য লেখা পড়ায় একটু মন দিতে চেষ্টা করে নিজের মানটাকে ধরে রাখার জন্য।
এখন বোশেখ মাস। মাঝে মধ্যে আকাশটা গর্জে উঠে। আজ বিকেলে সামিন বেরিয়েছে একটুখানি সবুজের বুকে হারিয়ে যেতে। কিন্তু আচমকা চার দিক কালো করে আকাশটা গম্ভীর হয়ে আসে। সামিন তাড়া করে মাদরাসায় ফিরতে চেষ্টা করে। কিন্তু পথেই পেয়ে বসে বৃষ্টিতে। গ্রামীণ পথের শেষ মাথায় শান বাধানো পুকুর ধারে মাদরাসা প্রাসাদ। এখনো প্রায় আধা কিলো পথ বাকি। এমন সময় প্রচণ্ড বাতাসের সাথে বৃষ্টির গতি বেড়ে যায়। সামিন অবস্থা বেগতিক দেখে আশ্রয় খুঁজে। এ টুপি জামা নিয়ে হুট করে কোনো বাড়িতে ঢুকে পড়াটাও একটা লজ্জার ব্যাপার। দু’পা আগালে রাস্তা ঘেষে ছোট্ট একটা কুঠির। সাথে ছোট্ট একটা খোলা বারান্দা। আমগাছের ডাল পালায় ছোট্ট ঘরটা খানিকটা ঢেকে আছে। সামিন জানে এ বাড়িটায় তেমন লোকজনের সমাগম নেই। এ বাড়ির আঙ্গিনা জুড়ে এক বছরে একটি নারী মূর্তিও চোখে পড়ে নি। রাস্তা হতে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ছোট্ট ঘরটির দরজা ভিতর থেকে এঁটে দেয়া। সামিন দৌড়ে গিয়ে খোলা বারান্দায় দাঁড়ায়। খানিকটা হলেও বাঁচা গেল। কিন্তু বৃষ্টির গতি শো শো করে বেড়েই চলছে। এদিকে রফিক মিয়া বৃষ্টির গতি প্রকৃতি আঁচ করার জন্য জানালা খোলে বারান্দা দিয়ে বাহিরে তাকায়।। চোখ ঘোরাতেই দেখে পাটখড়ির বেড়ার সাথে টেক লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফুটফুটে চেহারার সুন্দর একটি কিশোর। সাদা টুপি পাজামায় চেহারা আরো জ্বল জ্বল করছে। কাল বৈশাখীর ঝড়ো হাওয়ায় পশলা পশলা বৃষ্টি এসে ছেলেটাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। রফিক মিয়ার খুব মায়া হল। তাই আদর করে ডেকে বলল বাবা ভিতরে এসো। সামিন প্রথমে কিছুটা সংকোচ করলেও বারবার অনুরোধ করায় দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকে। রফিক মিয়া সামিনকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে চকিতে বসায়।
রফিক মিয়া এক সময় টুপি দাড়িকে খুব ঘৃণা করত। ‘মোল্লা মৌলভীরা দেশ ও সমাজের বোঝা’ ‘এরা প্রগতির অন্তরায়’ ‘মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত’ ‘এরা শুধু মসজিদ মাদরাসাই বুঝে। জাতি সত্তা ও দেশমাতৃকা সম্বন্ধে এরা গণ্ড মূর্খ’ জাতীয় মুখরোচক বাক্যগুলো তার মুখে খুব শোভা পেত। তার কথা বার্তার বড় একটা অংশ জুড়ে মোল্লা মৌলভী হুযুর মুন্সী শব্দগুলো খুব চাউর হত।
তখন রফিক সাহেব সরকারী পর্যায়ের এক ডাকসাইটে কর্মকর্তা। তার কথায় শত শত মানুষ উঠ বস করে। তারা ছিলেন তিন ভাই। ভাইদের মাঝে রফিক সাহেব সবার বড়। লেখা পড়া শেষ করে যখন তিনি চাকরিতে ঢুকেন তখন তার বাবা মারা যায়। বড় ভইয়ের স্বপ্ন, ছোট দুটি ভাইকে লেখা পড়া করিয়ে তার মত ডাকসাইটে অফিসার বানাবে। কিন্তু কলেজ পড়ুয়া ছোট ভাই নাগিব বেঁকে বসে। সে আর কলেজে পড়বে না। মাদরাসায় লেখা পড়া করবে। বড় ভাই রফিক সাহেবের মাথায় রক্ত চড়ে যায়। কি এত বড় কথা! আমি যাদের দু চোখে দেখতে পারি না তাদের পাঠশালায় ভর্তি হবে আমার টাকায় হৃষ্ট পুষ্ট হওয়া আমারই ভাই। না এ মেনে নেয়া যায় না। রফিক সাহেব তার মাকে বলল, তুমি ওকে না কর; নতুবা আমি ওকে জ্যান্ত কবর দেব। এ অপমান আমি বয়ে বেড়াতে পারব না। ও মোল্লা হলে আমি সোসাইটিতে মুখ দেখাতে পারব না। মা মেঝ ছেলে নাগিবকে অনেক বুঝায়। কিন্তু নাগিবের এক কথা। আমি প্রাণহীন এ জাগতিক শিক্ষা আর শিখতে চাই না। আমি এখন প্রকৃত শিক্ষার সন্ধান পেয়েছি। সে শিক্ষাই আমি শিখব। এতে আমার উপর ঝড় আসুক তুফান আসুক; আমি আমার মতে অটল থাকব। কেউ আমাকে টলাতে পারবে না। একথা শুনে বদমেজাজী রফিক সাহেব ছোট ভাইয়ের গায়ে হাত চড়িয়ে দেয়। এক পর্যায়ে মেরে রক্তাক্ত করে ফেলে। কিন্তু নাগিব নীরবে সব সয়ে যায়। শক্তি থাকা সত্ত্বেও বড় ভাইয়ের গায়ে হাত তুলে নি।
একদিন গভীর রাতে নাগিব কাউকে না জানিয়ে অজানা পথে পা বাড়ায়। বড় ভাই ও ছোট ভাইকে ত্যাজ্যভ্রাতা বলে ঘোষণা দিয়ে দেয়। সবার ছোট নাহিদ মেঝ ভাইয়ের উপর বড় ভাইয়ের এ হিংস্রতা দেখে নীরবে ডুকরে ডুকরে কাঁদে। ভাই হারানো বেদনা তাকে বিষিয়ে তোলে। সে ভাবে মেঝ ভাই এমন কি অপরাধ করল যে তাকে মেরে রক্তাক্ত করে বাসা থেকে বের করে দেয়া হল। ইসলামী শিক্ষা এটা কি কোন শিক্ষা নয়? এ শিক্ষার উপর ভাইয়ার এত ক্রোধ কেন? যারা মাদরাসায় লেখা পড়া করে তারা দেশ ও জাতির কি এমন ক্ষতি করে ফেলল? আমি তো দেখি না তাদের দ্বারা দেশের কোন ক্ষতি হতে। তারা তো কোন মারা মারি কাটা কাটি করে না। মানুষকে মানুষ বানানোর চেষ্টাই তো তারা করে। এমন হাজারো ইতিবাচক ভাবনা তাকে আবিষ্ট করে রাখে।
একদিন নাহিদ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, সেও তার মেঝ ভাইয়ের পথ নিবে। সত্যিই একদিন পড়ন্ত বিকেলে শহরে বের হওয়ার নাম করে নাহিদ হারিয়ে যায়। এবার রফিক সাহেবের মাথার টনক নড়ে। ক্রমে ক্রমে নার্ভাস হয়ে পড়ে। এখন আর রফিক সাহেবের মুখে মোল্লা মৌলভী নিয়ে মুখ চড়া ডায়ালগ উঠে না। রফিক সাহেব নিজেকে বড় দুর্বল ও পরাজিত ভাবতে লাগল। ছোট্ট দুটি ভাই তাকে টেক্কা দিয়ে মোল্লা মৌলভীদের কাতারে নাম লেখাল। এ অপমানে সে ন্যুব্জ হয়ে পড়ে। এদিকে ছোট দুই ছেলেকে হারিয়ে মা এখন পাগল প্রায়। নাওয়া নেই খাওয়া নেই। দু চোখ বেয়ে শুধু অশ্রু ঝরে। কোন ভাবেই তাকে স্বাভাবিক করা যাচ্ছে না। এতে রফিক সাহেব খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে।
এদিকে নির্বাচন ঘনিয়ে আসে। রফিক সাহেব দলীয় দাপটে সাধের চাকরীটাকে সহজেই বাগাতে পেরেছিলেন। নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় সে তার অতি সাধের চাকরীটা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে।
নাগিব নাহিদ দুই ভাই ভিন্ন ভিন্ন দুটি কওমী মাদরাসায় ভর্তি হয়ে খুব কষ্টে লেখা পড়া করছে। তাদের স্বপ্ন, একদিন এ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেখিয়ে দিবে আমরাও পারি।। মেধা পরিস্কার হওয়ায় অল্প দিনের মধ্যেই তারা বেশ নাম কুড়াতে সক্ষম হয়। ফলে তাদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। নাগিব নাহিদ গোপনে গোপনে তাদের মার সাথে যোগাযোগ করে। মাকে বলে দেয় যেন তার বড় ছেলেকে না জানায়। মা এবার ধড়ে প্রাণ ফিরে পায়। আবার কর্মচঞ্চল হয়ে হয়ে উঠে।
এদিকে কেটে যায় বেশ কটি বছর। নির্বাচনে রফিক সাহেবের দলের ভরাডুবি হয়। নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে। এতে তার সাধের চাকরীটাই খোয়া যায় নি; এক ডর্জন মামলার সাথে জরিমানা হয় কয়েক কোটি টাকা। তার এ দুর্দিনে কারো সে আশ্রয় পায় নি। তার অতি কাছের লেকজনও তাকে দূর দূর করে সরিয়ে দিয়েছে। এক পর্যায়ে সে ভিটা মাটি সব খুইয়ে পথে বসতে বাধ্য হয়। তার অতি আদরের অর্ধাঙ্গিনীও এ দুর্দিনে তাকে সঙ্গ দেয় নি। সে এ সুযোগে অন্যের হাত ধরে বিদেশে পাড়ি জমায়।
রফিক সাহেব বহু বছর পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছে। ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করেছে বার বার। কিন্তু প্রতিবারই হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে। শেষে জীবনের আশা ছেড়ে দিয়ে এক অজোপাড়া গায়ে গিয়ে উঠেন রফিক সাহেব। এলাকার লেকদের বলে কয়ে এক টুকরো জমি কেনেন। এক পাশে ছোট্ট একটা দু চালা করে তাতেই দিন যাপন শুরু করেন। আর বাকি জমিটুকু কাউকে বর্গা দিয়ে তাতে যতটুকু আয় হয় তাই দিয়ে এক দু বেলার আহার যোগান।
রফিক সাহেব এখন আর রফিক সহেব নেই। স্বাস্থ্য শরীর নুইয়ে পড়েছে। তাকে দেখলে এখন পাড়া গায়ের একজন কৃষক বলেই মনে হয়। এলাকার লেকজন তাই তাকে রফিক মিয়া নামেই চেনে। রফিক মিয়া গোপনে গোপনে তার মাদরাসা পড়ুয়া দুটি ভাইয়ের খবর নিতে চেষ্টা করে। একদিন জানতে পারে তার ছোট মেঝ ভাইটি ঢাকা শহরের একজন নামী দামী কোটিপতি। দেশের নাম করা কয়েকটি মাদরাসার প্রিন্সিপ্যাল। তার অর্থায়নে গ্রাম গঞ্জে বহু মাদরাসা ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়। মন্ত্রীপাড়ার বড়সড় একটি মসজিদের খতীব। সচিব অফিসার হতে শুরু করে মন্ত্রী মিনিস্টাররা পর্যন্ত তার জুতা হাতে তুলে নিতে দ্বিধা করে না। তার ছোট ভাই নাহিদ বাংলাদেশে লেখা পড়া শেষ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য পাকিস্তান চলে যায়। সেখানে লেখা পড়া শেষ করে কয়েক বছর ওখানেই নামকরা একটি মাদরাসায় বেশ সুনামের সাথে অধ্যাপনা করে। এরপর পাকিস্তানের সিটিজেনশিপ লাভ করেন। এক পর্যায়ে সৌভাগ্যক্রমে গভমেন্ট হতে বিদেশের স্কলারশিপ লাভ করেন। সে সুবাদে সৌদিআরবের উম্মুল কুরা ইউনিভার্সিটিতে ফিকহের উপর গবেষণায় নিরত হন। বেশ ক’বছর এক টানা গবেষণার পাঠ চুকিয়ে হৈচৈ ফেলে দেয়ার মত একটি অভিসন্দর্ভ তৈরি করে ফেলেন। এরপর থেকে তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হতে থাকে। ডক্টরেট লাভ করার পর উম্মুল কুরাতেই অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে যান। এখন তিনি অধ্যাপনার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানের একজন দায়ী হিসেবেও খ্যাতি লাভ করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে দাওয়াতী কনফারেন্সে প্রোগ্রাম করে তার সময় কাটে। দাওয়াত ও তাবলীগের মুরব্বীদের সাথে তার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তার হাতে এ যাবৎ ডজন খানেক মানুষ আলোর দিশা পেয়ে এখন সত্য পথের অভিযাত্রী।

রফিক মিয়া লুকিয়ে লুকিয়ে তার মৌলভী দুটি ভাইয়ের কীর্তিগাথা সংগ্রহ করে। আর মাঝে মধ্যে আনমনা হয়ে হারিয়ে যায় স্মৃতির বেলা ভূমিতে। চোখ দুটো ছল ছল করে উঠে। মনের অজান্তে গড়িয়ে পড়ে দু ফোঁটা তপ্ত অশ্রু।
টুপি জামা পরা কিশোর সামীনকে দেখে রফিক মিয়ার স্মৃতিগুলো জ্যান্ত হয়ে উঠে।। সামীনকে আগলে ধরে রফিক মিয়া কিছুক্ষণের জন্য আনমনা হয়ে যায়। টুপ টাপ বৃষ্টি ঝরছে। বৃষ্টির ছন্দে স্মৃতিগুলো নড়ে চড়ে উঠে। এক সময় আনমনা ভেঙ্গে রফিক মিয়া সামীনকে জিজ্ঞেস করে বাবা তোমার নাম কি?
আমার নাম সামীন।
কোথায় লেখা পড়া কর?
জামিয়া ইসলামিয়া মাদরাসায়।
মাদরাসাটা কোথায়?
এই তো এখান থেকে আধা কিলো দূরে।
কেন আপনি চেনেন না?
না বাবা। আমি শুনেছি এ এলাকায় একটি মাদরাসা হয়েছে। কিন্তু কোনো দিন যাই নি। আমি তেমন একটা বাহিরে বের হই না বাবা।
সামীন বিস্মিত হয়। এলাকার এমন কোন লোক নেই যে এ মাদরাসাটিকে চিনে না। অথচ সে কিনা মাদরাসাটিকে দেখেই নি।
এবার রফিক মিয়া জিজ্ঞেস করে তোমরা কয় ভাই?
আমরা তিন ভাই। আমি সবার ছোট।
আচ্ছা তোমার বাবার নাম কি?
আমার বাবার নাম মুফতী মাওলানা নাগিব হাসান।
নাগিব নাম শুনতেই রফিক মিয়া চমকে উঠেন। ভাবেন কে এই নাগিব?
ছোট্ট বেলায় হারিয়ে যাওয়া তার সেই জিদ্দী ভাইটি নয় তো! খানিক পর ভাবেন আরে ধুর নাগিব নামে কত মানুষই তো এই দুনিয়ায় আছে।
রফিক মিয়ার আনমনা দেখে সামীন ভাবে লোকটি বাবার নাম শুনে এমন অন্য মনস্ক হয়ে গেল কেন?
সামীন তার মায়ের মুখে শুনেছে তার বাবার শৈশব বেলার করুন কাহিনী। শুনেছে তার বড় চাচা বেশ কিছু দিন দাপটের সাথে চাকরি করে এখন নিরুদ্দেশ। তার বাবা তাকে অনেক খুঁজেছে। কিন্তু কোথাও কোন হদিস পায় নি। নিরুদ্দেশ হবার আগে সামীনের চাচা গুলশানের বাড়িটি বিক্রি করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তার মার কারণে পারে নি। অগত্যা তার প্রাপ্য একটি ফ্লাট বিক্রি করে টাকা নিয়ে গা ঢাকা দেয়।
রফিক মিয়া এরপর জিজ্ঞেস করে তোমার বাবারা কয় ভাই?
আমার বাবারা তিন ভাই। বড় চাচা হারিয়ে গেছেন। ছোট চাচা নাহিদ এখন সৌদি আরবে আছেন। এতটুকু বলতেই রফিক মিয়া সামীনকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে। সকিব! নাহিদ! বলে বলে অবুঝ শিশুর মত কাঁদতে শুরু করে। সামীন লেকটার হঠাৎ এমন ক্রন্দন দেখে কিছু বুঝে উঠতে পারে না। খানিক পর সামীনের চোখ বেয়েও অশ্রু গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। সামীনের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এই তার হারিয়ে যাওয়া চাচা। যিনি একসময় মোল্লা মৌলভীদের নিয়ে খুব ঠাট্ট বিদ্রƒপ করতেন। তারা ছিল তার দু চোখের কাটা। মাদরাসায় পড়তে চাওয়ার অপরাধে তার বাবাকে পিটিয়ে জখম করেছে তার এই চাচা। কিন্তু তার বাবা দুঃখ করে নি। লেখা পড়া শেষ করে নিজ পায়ে দাঁড়িয়ে তার আপন রক্তের ভাইকে অনেক খুঁজেছে; পায় নি।
সামীন বৃষ্টির ভিতরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে রফিক সাহেবের ডাক শুনে চমকে উঠেছিল। এতো তার বাবার কণ্ঠ! মানুষের কন্ঠে এমন মিলও কি হতে পারে। ভিতরে ঢুকে রফিক মিয়াকে দেখে তার চমক আরো বেড়ে যায়। চেহারায়ও তো তার বাবার সাথে বেশ মিলে যায়। সামীনের ইচ্ছে ছিল তাকে জিজ্ঞেস করবে। সামীনকে আর জিজ্ঞেস করতে হয় নি। এর আগেই সব পরিষ্কার হয়ে যায়।
বাহিরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। জাম গাছ তলায় ছোট্ট একটি দু চালা ঘরে চাচা ভাতিজার চার চারটি চোখে ঝরছে অবিরাম অশ্রু ধারা। বৃষ্টির সুরে সুরে অশ্রুর ধারা বেড়ে চলে। বিলাপ করে করে রফিক মিয়ার মুখ থেকে মাঝে মাঝে বেরিয়ে আসছে, হায় আল্লাহ! মোল্লার দৌড় বলে যাদের বিদ্রƒপ করেছি তাদের দৌড় হল কোথায়? আর আমার দৌড় হল কোথায়?......
গল্প শুধু গল্প নয়। গল্প মানে সমাজগর্ভে জন্ম নেয়া বাস্তবঘটিত চিত্রপট। গল্প নীল আকাশ হতে খসে পড়া কোন অদ্ভুত পদার্থ নয়। সমাজ পরিবারের গতি প্রবাহ হতেই এর উপাদান তৈরি হয়। তাই একটি ভালো গল্পের মাঝে আমরা খুঁজে পাই শেখার মত অনেক কিছ্। সমাজ ঘুরে জরিপ চালালে হয়তোবা এর চেয়েও আরো বাস্তব সত্য গল্প উঠে আসবে কাগজের পাতায়।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.