নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

তুমি একটা খারাপ কাজ করেছো তার মানে তুমি একজন মানুষ; তুমি সেই খারাপ কাজটার জন্য অনুতপ্ত হয়েছো তার মানে তুমি একজন ভাল মানুষ। \n\nwww.facebook.com/bandar.khola

হাফিজ রাহমান

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম আদালত হলো মানুষের বিবেক।

হাফিজ রাহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

নীল সাগরের তীরে (১)

২৫ শে মার্চ, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:০০

[অনুসন্ধিৎসা- মানুষের একটি মহৎ গুণ। জানার আগ্রহের সিঁড়ি বেয়ে মানুষ অনেক উঁচোয় উঠে যেতে পারে। এ অনুসন্ধিৎসার রয়েছে নানা সূত্র। নাক কান মুখসহ মানুষের প্রধান অঙ্গগুলো কম বেশের ব্যবধানে অনুসন্ধিৎসার একেকটি সূত্র। অনুসন্ধিৎসাকে যথাযথ রূপে পূর্ণতা দিতে হলে গণ্ডিবদ্ধতাকে দু পায় মাড়াতে হয়। পৃথিবীর খ্যাতিমানেরা অতি কাছের গণ্ডিরেখাকেও সযত্নে লঙ্ঘন করেছেন। সংকোচিত গণ্ডির মাঝে নিজেকে সপে দিলে তারা আজ পৃথিবীর মুখে মুখে উচ্চারিত হতেন না। শাস্ত্রীয় গ্রন্থগুলোতেও এ বিষয়টিতে সবিশেষ যত্ন দেখিয়েছে। অনুসন্ধিৎসাকে ষোলকলায় পূর্ণতা দেওয়ার স্বপ্ন নিয়ে গণ্ডিবদ্ধতাকে ছিন্ন করতে যে জিনিস বা শব্দটিকে আমরা প্রয়োগ করি সেটা হলো সফর, ভ্রমণ কিংবা ট্যুর। বিনোদন ব্যবসাসহ নানা মানসিকতা নিয়ে মানুষ সফর করে। মানুষ, রুচি ভেদে এ মানসিকতায় ব্যবধান দেখা দেয়। যে সফরের সাথে অনুসন্ধিৎসা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে সেটাই শিক্ষাসফর। কখনো সখনো অনুসন্ধিৎসা কিংবা শিক্ষাকে মূল উপাদান বানিয়ে সফর করা হয় না। প্রাসঙ্গিকভাবে ও জিনিসটা এসে যায়। ওটা বস্তুত শিক্ষা সফর নয়। যখন বিনোদন তার মৌলিকত্ব হারিয়ে প্রাসঙ্গিকতায় গিয়ে দাঁড়াবে আর অনুসন্ধিৎসাটা হবে মূল প্রতিপাদ্য তখনি সেটা শিক্ষাসফর রূপে পরিগণিত হবে। শিক্ষা বা অনুসন্ধিৎসার রয়েছে বিধানিক, অবিধানিক নানা মাত্রিকতা। সবকিছু শিখতে নেই। সবকিছু জানতে নেই। সবকিছু জানার আগ্রহও জন্মাতে নেই। আমাদের জীবন সংবিধানে যেটা শেখার অনুমতি রয়েছে শুধু সেটাই শিখব, সেটাই জানব । এ সীমাবদ্ধতাকে ডিঙানো নীতিমানের কর্ম নয়। অনীতিমানেরাই কেবল গাঁট ছাড়া সীমানাহীন হতে পারে। অনুসন্ধিৎসার এক ঝুড়ি আগ্রহ নিয়ে রাহমানিয়ার এক ঝাঁক অনুসন্ধিৎসু পাড়ি জমিয়ে ছিল সাগর পাড়ের সবুজ ভূমে। তারা তাদের তারুণ্যদীপ্ত অনুসন্ধিৎসা দিয়ে চাটগাঁয়ের মাটিকে খুঁটে খুঁটে দেখতে চেষ্টা করেছে। অনুসন্ধিৎসার আবেদনে কখনো এরা সাগর তীরের হাঁটু জলে পা ডুবিয়েছে। কখনো আকাশ ছোঁয়া পাহাড় চূড়ায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। কখনোবা নারকেলের ঝিরঝিরে পাতার ছায়ায় ঠাঁই নিয়েছে। বক্ষ্যমান সফরপাতাটি এ অভিযাত্রারই একটি কাঁচা হাতের গোঁজামিল উপস্থাপনা। বস্তুত এ সফরনামাটির শব্দ সাজাতে গিয়ে তারুণ্য মানসিকতাকে ক্ষণিকের জন্যও দমানো যায় নি। সাথে শিক্ষার ঝুলিটিও তেমনভাবে পাশে ছিল না। তাই পাঠক দু এক পশলা অনুসন্ধিৎসার উপাদান পেলেও পেয়ে যেতে পারেন। তবে জাঁদরেল অনুসন্ধিৎসুদের জন্য হয়ত এখানে তেমন কিছু নেই। সফর ডেট সোমবার, ২৫.০১.’১০]
পেছন ফিরে দেখা
আমার চার পাশের সবুজ এ পৃথিবীটা একদিন ছিল না। ছিল না রহস্যঘেরা এ মহাজগত। জমাটবদ্ধ ধোঁয়া পিণ্ডের এক মহা বিস্ফোরণে এক সময় তৈরি হয় নিখিল এ বিশ্ব ভুবন। তারই একচিলতে মাটির আস্তর সবুজ এ পৃথিবী। এখানে এক কালে প্রাণের আবাস ছিল না। মহামহিমের কুশলী হাতে প্রথমে সৃজিত হয় অশরীরী জিন সমাজ। এরপর সময়ের পালাবদলে ধূলো কাদায় তৈরি হয় পৃথিবীর আদি মানুষটি। পৃথিবীর মাঠে ঘাটে মানুষের পদচারণা ধারা তখন থেকেই শুরু হয়। অনন্ত এক মহাকাল ব্যাপী এ পৃথিবীতে আমি ছিলাম না। পৃথিবীর আলো বাতাসে ছিল না আমার অণু প্রমাণু। একসময় আমার উপকরণ তৈরি হয়। খাদ্য, রক্ত, জিনকোষ, জমাটরক্ত এবং মাংসপিণ্ডের পর্যায়গুলো পেরিয়ে আমি বেজায় ছোট্ট একটি অন্তঃসত্ত্ব বলে গণ্য হই। তখন আমার বাস নীরব নিস্তব্ধ রক্ত মাংসে গড়া ছোট্ট একটি কুঠরিতে। মুঠোয় মুঠোয় সময় পেরিয়ে শিশু শব্দ গায়ে মেখে একদিন বেরিয়ে আসি আলো বাতাসের এ পৃথিবীতে। ফুটফুটে শৈশব পেছনে ফেলে পা বাড়াই দুরন্ত কৈশোরে। উতল কৈশোরের পাঠ চুকিয়ে এখন জীবন যৌবনের বালিয়াড়ি প্রান্তরে আমি আমরা। এক চিলতে মাটির উপরে পা দুটো জড়ো করে বসে আছি। স্কেল মাপে এক দেড় বর্গ ফুট হবে হয়তো। আরো কিছু জায়গা মিলে একটি কুঠরি। বেশ কটি কুঠরি গায়ে গায়ে লেগে আধো পাকা বাংলোর মতন দুচালা একটি ঘর। দুচালার সংখ্যা বেড়ে গিয়ে এর নাম হয়েছে প্রতিষ্ঠান। আকাশ ছোঁয়া আরো কটা প্রাসাদ মিলে একটি মহল্লা কিংবা এলাকা। দু’ চারটে এলাকার দলবদ্ধ রূপ একটি ওয়ার্ড।পল্লি-গায়ে পা বাড়ালে একটি ফর্দ বেড়ে ইউনিয়ন হবে। বালু সিমেন্টের এ গিজগিজে শহরে বাড়তি এ ফর্দটি নেই। এক ঝাঁপি ওয়ার্ড মিলে নাম হয়েছে থানা কিংবা উপজেলা। আশ পাশের আরো কটা থানাকে জড়ো করে তার নাম করা হয়েছে জেলা। দু’চারটে জিলার সমন্বিত রূপ হলো বিভাগ। দূর দেশে গেলে প্রদেশ নামের আরেকটি ফর্দ বেরোবে। আমরা ছোট; তাই আমাদের ওটা নেই। আমাদের ছোট্ট এ সীমানায় আমাদের দেশের নামটাই তো ধরে না। প্রদেশ রাখবো জায়গা কোথায়? এমন ছ’ সাতটি বিভাগ নিয়ে আমাদের বাংলাদেশ। এবার সীমানা পেরিয়ে আরো কটি দেশ পাশাপাশি হয়ে গঠিত হয়েছে একটি উপমহাদেশ।-উপমহাদেশ শব্দের ব্যবহারটা আর কোথাও আছে কি না জানি না।-এরূপ কটি উপমহাদেশ জড়ো হয়ে একটি মহাদেশের গড়ে উঠা। এভাবে সাতটি মহাদেশ মিলে মিশে আমাদের এ সবুজ পৃথিবী। মহাশূন্যে আমাদের পৃথিবীটা নেহাত ছোট্ট একটি গ্রহ। ছোট বড় এগারোটি গ্রহ উপগ্রহ নিয়ে আমাদের সৌরপরিবার। দিনের আলোয় দুচোখ মেলে যে আলোক বস্তুটি আমরা সূর্য নামে দেখি সেটা এতটুকু একটা তারকা বৈ কিছু নয়।এমন দশ হাজার কোটি সৌরজগত নিয়ে আমাদের ছায়াপথ। অসীম এ ছায়াপথের কোনো এক কোণে পড়ে আছে আমাদের ছোট্ট সৌরজগতটি। এরূপ আনুমানিক দশ কোটি ছায়াপথ নিয়ে আমাদের এ মহাবিশ্ব। এ মহাজগতের বিশালতা কতটুকু? বোধ করি প্রশ্নটা যে কারো জন্যে অনধিকার চর্চা কিংবা অনবগতি প্রসূত বলে স্বীকৃত হবে। যদি কেউ বলে পৃথিবীতে কটা বালুকণা আছে? প্রশ্ন কর্তার অভিধাটা আর বলছি না। তবে এ প্রশ্নটার একটা উত্তরকে সম্ভাবনার ডোরে গাঁথা গেলেও মহাজগতের বিশালতা সম্বন্ধে কোন উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে না। কল্পনারাও এখানে বড় অসহায়। আর হিসাব বিজ্ঞান এ জায়গাটায় মুখ থুবড়ে পড়ে বারবার রক্তাক্ত হয়। যদি এক এর পরে শূন্য বসাতে আরম্ভ করি। এক সময় কালি ফুরিয়ে যাবে, কাগজ শেষ হয়ে যাবে; তবু মহাজগতিক এ বিশালতার ব্যাপ্তি শেষ হবে না। মহাশূন্যের এ বিশালতা সম্বন্ধে সামান্য একটু ধারণা লাভের জন্যে বিজ্ঞানী সমাজ ‘আলোকবর্ষ’ শব্দটি তৈরী করেছেন। সেকেণ্ডে আলো এক লাখ ছিয়াশি হাজার মাইল অতিক্রম করে। তো এক মিনিটে! এক ঘন্টায়!! একদিনে!!! এক সপ্তাহে!!!! এক মাসে!!!!! সবশেষে এক বছরে সে আলো কতটা সীমানা অতিক্রম করে!!!?!! এক বছরের এ দূরত্বটাই হলো আলোকবর্ষ। মহা এবিশ্বজগতের ব্যাপ্তি এক দুশো কিংবা এক দু হাজার আলোক বর্ষ নয়। আরো বেশি। কত বেশি তা শুধু তিনিই জানেন যিনি তৈরী করেছেন এ বিশ্বজগত।
যদি আমার দুটো পাখা গজাত! যদি ডানা ঝাপটিয়ে কোন এক ছায়াপথের কিনারায় গিয়ে বসতে পারতাম!! তবে কি দেখতে পেতাম আমাদের এ সবুজ পৃথিবী। দুচোখের সীমানায় কি ভেসে উঠত আঁকা বাঁকা সে পাহাড়ি পথ। সাগর পাড়ের সারি সারি নারিকেল বীথিকা। ..যদি এমন হতো!
কোন ছায়াপথে কি আছে পাহাড়ি ঝরনা, আঁকা বাঁকা গিরিপথ এবং আকাশ ছোঁয়া পাহাড় চূড়া। কোনো সৌরজগতে কি আছে সাগর নদী কিংবা বালু চিকচিকে সাগর পাড়। হয়তো বা আছে। বিজ্ঞানীদের পদ রেখা আর কটা গ্রহেই বা পড়েছে। অজানা গ্রহগুলোতে হয়তো আছে সপ্তাশ্চর্যের চে’ বড় কিছু। সেসব কি আমরা দেখতে পাবো?
কোন ছায়া পথে যদি নির্মিত হতো কোটি গুণ উঁচু কোন বুর্জ খলিফা। তার প্রান্ত চূড়ায় চড়ে যদি দেখতে পেতাম মহাজগতের সবটুকু সুন্দর! শিবচরের কৃতি ছেলে ফজলুর রহমান যদি পারত মহাজাগতিক এমন স্থাপনা গড়ে দিতে!
মানুষ বিজ্ঞানের রকেট ছুটিয়ে পারি জমাচ্ছে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। অজানাকে জয় করতে জীবনের সবটুকু সাধনাকে বিলিয়ে দিচ্ছে। তবু মহামহিমের সৃষ্টির কতটুকুই বা তারা জানতে পেরেছে। তাইতো জগতখ্যাত বিজ্ঞানী নিউটন জীবনের বেলা ভূমিতে দাঁড়িয়ে আক্ষেপ করে বলেছিল, জ্ঞান সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে বালু নিয়ে খেলা করেই জীবনটা শেষ হয়ে গেল; সমুদ্র জলে আর নামা হলো না!
মহাজগতের কোনো এক কোণে অসহায় পড়ে থাকা প্রমাণুর মত এ পৃথিবীর অধিবাসী আমরা। ছোট্ট এ পৃথিবীর অনেক কিছুই আমরা জানি না। সপ্তাশ্চর্যের কোন একটিও তো এ যাবৎ ছুঁয়ে দেখি নি। আরো কত কিছু যে লুকিয়ে আছে আমাদের অজানা জাম্বিলে তার হিসাব কে নেবে? ছোট্ট পৃথিবীর ছোট্ট দেশ আমার সবুজ বাংলাদেশ। এর কত কিছুই তো আমরা দেখি না, জানি না।
মানুষ বেড়াতে ভলোবাসে। উঠোন পেরিয়ে দু’পা বাড়াতে তার খুব ইচ্ছে করে। দু’দণ্ড ঘুরে বেরাতে মনটা উতালা হয়। অজানাকে জেনে আনন্দ পায়। অদেখা জিনিসের ছোঁয়া পেয়ে বিমুগ্ধ হয়। ঘুরে ঘুরে পৃথিবীর সুন্দরগুলোকে নেড়ে চেড়ে গভীর করে দেখতে চায়।
জীবনের অনেকগুলো পাতা ঝরে গেছে। দেখেছি অনেক কিছু। লব্ধ হয়েছে অনেক অভিজ্ঞতা। তবে দুর্গম গিরি পথ, আকাশ ছোঁয়া পাহাড় চূড়া, পাহাড়ের গা বেয়ে ঝরে পড়া অবিরল ঝরনা ধারা, সাগর পাড়ের ভেজা সৈকত, সমুদ্রের শো শো গর্জন, সাগর ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ গুঞ্জন, সাগর তীরের সারি সারি নারিকেল বীথিকা- এসব দেখা হয় নি দুচোখ মেলে। ঘুরে বেড়াবার এতটুকু সুযোগও হাতমুঠো হয় নি কখনো। হৃদয়ে স্বপ্ন ছিলো পাহাড়ি পৃথিবীটাকে হেঁটে দেখার। সে স্বপ্ন পাপড়ি মেলে সুবাস ছড়ায় নি অনেক দিন। দিনের সূর্য পাটে নেমেছে, দিগন্ত রেখা হারিয়ে গেছে, তবু রাতের আঁধার কেটে ভোর আসে নি। দিগন্ত রেখায় আলো ফুটে নি।
এক দিন ক্লান্ত দুপুরে বসে আছি দুচোখ মেলে। আমার চোখের সীমানায় একটি বেঞ্চি। তার উপর এক দুটো কিতাব। একটি ডানা মেলা পাখির মত উন্মুক্ত হয়ে আছে। চোখ দুটো আমার ওতেই জুলজুল করছে। গভীর কী যেন পড়ছি। আচমকা দরজা ঠেলে এগিয়ে আসে একজন মানুষ। আনমনা ভেঙ্গে সাদা কাগজের গা থেকে চোখ দুটোকে উপরে তুলি। দেখি সহপাঠী মাহমূদ! ঠোটের কিনারায় এক টুকরো হাসি ঝুলিয়ে আমার কাছটায় এসে বসে। কথার ফাঁকে বেড়াতে যাবার সুন্দর একটা জিনিস আমার সামনে তুলে ধরে। আমি আনমনা ভেঙ্গে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করি। গাম্ভির্যতা তখনো আমার চোখে মুখে ছলছল করছে। ভেবে পাই না কি বলব? চট করে হ্যা বলে ফেলতে সাহস পাচ্ছি না। একটি ভ্রমণ যাত্রা মানে অনেক কিছু। এর সাথে জড়িয়ে আছে অনেক ব্যাপার স্যাপার। মনে হল আমার চোখের সামনে এক টুকরো তেতুল ঝুলছে। ভেজা রসনাটি রসে চপচপ করছে। ওর দিকে হাত বাড়াবো কি বাড়াবো না দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগি। শেষে এক অজানা সাহসে অস্পষ্ট সম্মতিটা দিয়েই ফেলি। ভ্রমণ হবে সুন্দরবনে। মনে মনে বাঘ হরিণের দেশ দেখার আনন্দে উতালা হই। রাতের স্বপনে টাইগার ভাল্লুকেরা আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। আর মুখ হা করে বলে, এসো এসো আমাদে দেশে এসো, তোমাদে মজা করে খাব। ভয়ে গা শিউরে উঠে। সময়ের ফাঁকে ফাঁকে কল্পনার সাম্পানে চড়ে ভেসে বেড়াই সুন্দরবনের আঁকা বাঁকা জলপথে। চোখের তারায় ভেসে উঠে সপ্ন মাখা সুন্দরবন।
সহযাত্রীদের সীমানা বেড়ে চলে। সুন্দরবনের কথা মুখে মুখে গুঞ্জরিত হয়। এখানে ওখানে ছোট ছোট জটলায় প্রমোদ বিহারের ফিসফিসে শব্দ। এদিক ওদিকে বেশ সাড়া পড়ে যায়। এক দু’ করে দিনগুলো বহতা নদীর মত বয়ে চলে।
কদিন পর আমার মনে হয় পা দু’টি যেন ক্রমে পেছনে সরে যাচ্ছে। সাত পাঁচের ভাবনায় সমুখে এগুবার সাহস খুঁজে পাই না। কে যেন আমাকে পিছন দিকে টেনে চলছে অবিরাম। সুহৃদ মহমূদ মঝে মধ্যে এসে অমার আগ্রহের গতি সীমানা মেপে যায়। প্রথম দু একদিন উৎফুল্লমাখা হ্যাঁ জবাব দিয়ে মন জুড়িয়েছি। পরে একদিন মলিন হেসে বললাম, আমি যেতে পারছি না। আমার আগ্রহের দেয়ালে চিড় ধরেছে। কাঙ্ক্ষিত জবাব না পেয়ে সুহৃদ মাহমূদ মুখটাকে শুকনো করে চলে যায়।
বাবা চলে গেছেন কিছু দিন হলো। শোক তাপের ছাপ চিহ্ন এখনো শুকায় নি। এর উপর ছোট ভাইটা গাড়ীর চাপায় পড়ে ঘর পড়া হয়ে আছে। ওর পিছনে ছুটাছুটির শেষ নেই। বাড়িটি অগোছালো পড়ে আছে। ছুটিতে বাড়িতে অনেক কাজ। এ সময় আনন্দ ভ্রমণ! ভাবতেও কষ্ট হয়। দেহটা চলে গেলেও হৃদয়টা পড়ে থাকবে সবুজ গায়ের ঐ ঘরের কোণে। বেরোবে না এক ফোঁটা আনন্দ হাসি। আগ পিছ মিলিয়ে আমি জায়গায় থেমে যাই। এতটুকু পা নাড়াবার সাহস হয় না।
একদিন রোদেলা ভোরে সতীর্থ মাহমূদের সাথে দেখা। চোখে মুখে রাজ্যের হাসি। কিছু বলার আগেই দু ঠোটের ফাঁক দিয়ে কটা শব্দ ছুড়ে দেয়, আমি আপনার সাথে আছি। আমি চোখ দুটো কপালে তুলে বলি, আরে! আপনি আমার সাথে ছিলেন না কবে। ব্যাপারটা খুলে বলুন। এবার মাহমূদ পাতলা গলায় বলে, সুন্দরবন যাওয়া হচ্ছে না। এখন ওখানে বনদস্যুদের বড় উৎপাত।
শুনে বড় ব্যথা পেলাম। আমি না হয় আমার আনন্দটা নিজেই খেয়েছি। তাই বলে একান্ত কিছু কাছের মানুষের প্রমোদ বিহারটা কিছু অমানুষের হিংস্রতায় পণ্ড হবে? ভাবতে বড় কষ্ট হয়। একি মেনে নেয়ার মত? মানুষ এতটা নিষ্ঠুর হয়! তার পশুত্ব হতে মুক্ত নয় সবুজের স্বর্গ সুন্দরবনও। সুদূর বনবাদাড় থেকেও চুষে নিচ্ছে মানব হৃদয়ের লালিত স্বপ্নগুলো। এ সব পশুমানুষের দন্ত নখর হতে কি মুক্ত হবে না আমার সবুজ বাংলাদেশ? আমাদের ললাটের অশুভ তিলক কি আর মুছবে না কোনো দিন!?
মহামহিমের অপরূপ জায়গাগুলো আজ নর পিশাচের স্বর্গ দেশ। ওদের হায়েনাবৎ হিংস্রতা হতে নিরাপদ নয় বন বাদাড়ের চির স্বাধীন প্রাণীগুলো। মাতৃভূমির দুঃখ ব্যথাগুলো আমাদের দু চোখে পানি এনে দেয়। স্বাধীন হয়েও পরাধীনতার শিকল হাতে আর কত কাল বেঁচে থাকবো। প্রভু! অশুভ দিনগুলোকে বদলে দেবার শক্তি দাও...।
এভাবে ব্যথার দিনগুলো বয়ে যায়। এক দিন শুকনো গাঙ্গে আবার জোয়ার আসে। ঝরা পাতার শূন্য ডালে গজিয়ে উঠে কচি সবুজের সুন্দর পাতা।
প্রমোদ যাত্রা এবার সুন্দরবন ছেড়ে সিলেট অভিমুখে। আমার ভিতরে উঁকি দিয়ে উঠে চা বাগানের সবুজ স্বপ্ন। অনুভবের ডানা মেলে উড়ে যাই জাফলঙের পাথুরে ভূমে। আঁখি মেলে দেখি রাশি রাশি জামারায়ে যমযম।
অনিঃশেষ পাথরের বিশাল মজুদ এখানে। অবিরাম সরবরাহ করে চলছে খেটে খাওয়া মানুষগুলো। তবু পাথরের শেষ নাহি হয়। চা বাগানের ছায়ায় ছায়ায় চষে বেড়াই আঁকা বাঁকা পাহাড়ি পথ। হৃদয়ের আয়নায় ভেসে উঠে ভোলাগঞ্জ, চর গ্রাম এবং তমাবিলের মনছুঁয়ে দেয়া ছবিগুলো। কর্ণ কুহরে ধ্বনিত হয় মাজার পুঁজারী ছেচকা ফকিরদের হুক্কা হাওয়া শব্দগুলো। শাহ জলাল, শাহ পরাণ রহ. এর আহ শব্দগুলো যেন আমার হৃদয়ের তলদেশে গিয়ে ক্ষত রেখা সৃষ্টি করে দেয়। কল্পনার পাখা মেলে উড়ে বেড়াই সিলেটের আকাশে বাতাসে। দু চোখ ভরে দেখি স্বপ্নআঁকা ছবিগুলো।
মানুষের প্রকৃতি বড় বৈচিত্র্যময়। সুখের ছোঁয়া পেলে নিমিষেই ভুলে যায় পেছনের সব দুঃখ। আমিও ভুলে যাই আমার মাথার উপরে থাকা এক ঝাকি কষ্টের কথা। মনটাকে ঝরঝরে করে ছুটে যেতে ইচ্ছে হলো সীমান্ত ঘেষা সিলেট ভূমে।
কিন্তু দু’দিন পর সিলেটের আবেদন ফুরিয়ে য়ায। এবারের অভিযাত্রা উতাল পাতাল ঢেউয়ের দেশে। স্পটের ফর্দও বেড়ে যায়। প্রাথমিক তথ্য উপাত্তে অনুমিত হয় চট্টগ্রামের সৌন্দর্য্য বিবেচনায় সিলেটের মূল্যমান জিরো পয়েন্টে। তবে এ মানসূচক নির্ণয় সব দিক থেকে বিশুদ্ধ নয়। কিছু কিছু সৌন্দের্য্যে সিলেটের স্বাতন্ত্র্য অবশ্যই রয়েছে। নতুবা এমনি কি ভ্রমণ স্পটে সিলেটের নাম উঠেছে? প্রতিটি ফুলের সৌন্দর্য্য সৌরভে ভিন্নতা রয়েছে। কম বেশ কিছু ব্যাপারে তো ব্যাবধান হতেই পারে।
সিলেটের আছে প্রাতিস্বিক ঐতিহ্য। মরক্কোর জগৎখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা যে নদীটিকে তার ভ্রমণ লিপিতে নীল দরিয়া নামে অভিহিত করেছেন সেটা সিলেটের সুরমা নদী। সুরমা বিধৌত সিলেট সম্বন্ধে আর্য পণ্ডিতরা বলত ‘শ্রীহট্ট মধ্যমা নাস্তে’। মানে সিলেট কোন মাধ্যম ধরনের জনপদ নয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সুষমায় এটাকে তুলনা করা হয় ভূস্বর্গ কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরের সাথে। বিশাল এ উপমহাদেশে শ্রী শব্দ যোগে গঠিত নামকরা মাত্র দুটি জনপদ রয়েছে। প্রথমটি শ্রীনগর আর দিত্বীয়টি ‘শ্রীহট্ট’ অর্থাৎ সিলেট। হিন্দু পণ্ডিতদের ব্যাখ্যায় যেখানে শ্রীর হাত পড়েছে সেটাই শ্রীহট্ট। আর মুসলিম ব্যাখ্যায় শেষ হিন্দু রাজা গৌর গোবিন্দর হাতে গড়া প্রাচীর ডিঙ্গানোর সময় শাহ জালাল রহ. বলেছিলেন ‘শিল হট’। মানে হে পাথর সরে যা। ইংরেজরা তাদের বানানে লিখত ংুষবঃ। শেষ অবধি শাহ জালাল র. এর দেয়া সে নামেই বিশ্ব মাঝারে পরিচিতি লাভ করে সুন্দর এ জনপদটি। তবে এ তথ্যবৈষম্য নিয়ে আরো গবেষণা হতে পারে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হাওর ‘হাকালুকি’ এশিয়ার নামকরা অথিতি পাখীদের অভয়ারণ্য ‘টাঙ্গুয়ার হাওর’ আর এ উপমহাদেশের সব চেয়ে বড় গ্রাম ‘বানিয়াচং’ এ সিলেটেই অবস্থিত। এ জন্য জাত মানে, গর্ব গৌরবে, সৌন্দর্য্য মাধুর্যে সিলেটও পিছিয়ে নেই কোনো অংশে।
এ দিক বদলে কিছু সতীর্থ ঝরে পড়ে। যেমন আমি। তবে একান্ত আড়ালে। কারণ আমি তো রণে ভঙ্গ দিয়েছি বহু আগে সে সুন্দরবন থেকে।
পূর্ব আকাশে সূর্য হাসে। আলো বিলিয়ে আবার হারিয়ে যায় আঁধার গহীনে। গাছে গাছে পাখি ডাকে। ঝিরঝিরে বাতাস বয়। বাগ বাগিচায় নানা ফুল ফুটে। দিন রাত বয়ে চলে আগের মত মহা কালের অবিরাম পথ চলায়। এক দু করে তুরাগ পাড়ের মহাসমারোহ শেষ হয়। যে যার মত ছুটে যায় আপন ঠিকানায়। আর আমি পা দুটোকে শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকি আপন জায়গায়। যেন দূর যাত্রার অনন্দঘন ঝড়ো হাওয়া আমাকে টলিয়ে না দেয়। সতীর্থরা ফিরে এলে ছুটে যাব মদারীপুর। সব গুছ গাছ। বাড়ীর সবাই জানে আমি আসছি। দিন তারিখও ঠিক।
মধ্য রাতের কোন এক প্রহরে শূন্য আয়তনটা ভরে যায়। মধুপাখিগুলো সমারোহ থেকে ফিরে এসেছে গভীর রাত করে। দূর পাল্লার সতীর্থরাও উপস্থিত। বাকিরা পৌঁছে যাবে যথাসময়ে। রাত পোহায়ে ভোর নেমেছে। আমি এক আধটু করে প্রস্তুতি নিচ্ছি। কী যেন একটা প্রয়োজনে দাঁড়িয়ে আছি। হয়তোবা গোছানো জাতীয় কিছু হবে। চিকন করিডোর পথে থপ থপ করে হেঁটে যায় মাহমূদ ভাই। তখন জানালার ফাঁক গলিয়ে হাসি মুখে হালকা গলায় বলে যায়, তৈরী হোন তৈরী হোন। আমি ঝটিকা শব্দ দু’টোর আগা মাথা কিছুই অনুমান করতে পারি না। কিছু সময় পর হুড়মুড় করে আবার দৌঁড়ে আসে সে মানুষটি। শব্দ দু’টো তখনো আমার মাথায় দাপাদাপি করছে। ওর ছড়ানো কুয়াশা তখনো কাটে নি। মানুষটা তাড়াহুড়ো করে রুমে ঢুকে পুরাতন সে হাসিটার সাথে কিছুটা গাম্ভির্য মিশিয়ে বললো আসেন আসেন। আমি ভড়কে গেলাম। কোথাও কিছু হল না তো! কিন্তু সেটাও পরিস্কার নয়। কারণ তার চোখে মুখে লেগে আছে প্রচ্ছন্ন হাসির রেখা। এতটুকু অনুভূত হলো, আমার সামনে যে ব্যপারটি এসে দাঁড়াবে সেটা ফেলনা কিংবা গুরুত্বহীন কিছু নয়। এর চে বেশি কিছু বুঝার আমার সাধ্য ছিল না। আচমকা তড়িৎকর্মা বনে যাওয়া এ মানুষটাকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করবো তারও সুযোগ নেই। আর জিজ্ঞেস করে কত পার্সেন্ট লাভ হবে তার একটা খসড়া হিসাব আমার হাতে আগে ভাগেই প্রস্তুত হয়ে আছে। তাই অনর্থক শব্দ ব্যয় না করে আগ পিছ না ভেবে পিছনে পিছনে হন হন করে হাঁটতে হল। গুরফাতুল ইসতিরাহায় (প্রিন্সিপ্যালের বিশ্রাম কক্ষ) আমাকে ঢুকিয়ে দিয়ে ‘এই যে’ শব্দটি উচ্চারণ করেই মাহমূদ চম্পট। আমি ঢাকেশ্বরী মন্দির ঘরে দাঁড়িয়ে থাকা কালো মন্দিরটার মত থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। যেন আমি ছাউনি চিড়ে সোজা আকাশ থেকে পড়লাম। লাল দালানের মুখশুকনো মানুষগুলোও এক আধটু সুযোগ হাতে পায়। আমার কপালে সেটুকুও জুটে নি। আমি যেন তাদের চে’ বড় কিছু করেছি। মাহমূদ মুরগীর ছানা খাওয়া উড়াল পঙ্খির মত আমাকে ছোঁ মেরে নিয়ে এসে এখানে রেখে উড়ে চলে গেল দূর আকাশে। সামনে সুহৃদ আতাউল্লাহ। দাঁড়িয়ে মিটি মিটি হাসছে। কিছুটা দূরে শুআইব খচমচ করে কী যেন গুছাচ্ছে। আমাকে নিয়ে কি হচ্ছে, হবে বুঝতে পারছি না। তবে অনুমান হলো, এভাবে আসামী করে আমাকে তুলে আনতে বলা হয় নি। এ টু জেট পুরোটাই মাহমূদের হাতে গড়া ষড় নয়; সপ্তযন্ত্র। এ মানুষটার মাথায় দুষ্টুমি গিজগিজ করে। সব সময় এক গাদা দুষ্টুমি মাথায় করে ঘুরে বেড়ায়। কিছু একটা পেলে ওর গা জুড়ে দুষ্টুমির রঙ চড়িয়ে দেয়।
আতাউল্লাহ হালকা করে হেসে বলল চলুন। এবার নাটকের অভিনয়টা পরিস্কার হল। আমি আমার সে পুরনো না কে মুখে তুলে আনি একটু গাড় করেই। কারণ আমার সব গুছ গাছ। আজ ছোট ভাইকে নিয়ে ভাইয়া ঢাকায় আসবেন। ডাক্তার দেখিয়ে রাতে তিন ভাই মিলে বাড়িতে যাবো। আতাউল্লার অনুরোধের রঙটা এবার আরেকটু গাঢ় হল। পাশ থেকে খচমচে ব্যস্ত শুআইবের অনুরোধ এসে জড়ো হয়। এ মানুষটা ঝরে পড়া পাপড়ি ছিল। অনুরোধের তুফানে আবার জায়গা মত এসে লেগে গেছে। এখন আমাকে নিজেদের কাতারে ভিড়ানোর জন্য অনুরোধের ঝড় তুলতে হাত মিলাচ্ছে। মনের অজান্তে আমার অনিচ্ছার দেয়ালে চিড় ধরে যায়। আমার ভেতরকার অনিচ্ছার শক্ত আবরণটা কেন যেন -বুঝি না- ফুটো বেলুনের মত চুপসে যেতে থাকে। গুছিয়ে রাখা অনিচ্ছার উপকরণগুলো ধূলো বালু হয়ে কোথায় যেন হু হু শব্দ করে উড়ে যেতে শুরু করে। ‘অনিচ্ছার আদলে গড়া দেয়াল যত কঠিনই হোক আনন্দ যাত্রার অভিঘাতে তা নিমিষেই বিচূর্ণ হয়ে যায়’ ব্যপারটা খুব উপলব্ধ হলো। কথা বাড়ানোর শক্তি পেলাম না। যেন সব অবস হয়ে আছে। কথার আঁচল খানা গুছিয়ে আস্তে করে বেরিয়ে আসি। মাথায় আমার এক আকাশ ভাবনা। ভাইয়াকে কি বলব। আম্মার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কি জবাব দেব। গভীর ভাবনায় বুঁদ হয়ে থাকি। ভিতরে সুখ শঙ্কার খুনসুটি হয়। সমতালে বয়ে চলে অন্যরকম এক রণধারা। সময়ের রঙ্গিন আবরণে আনন্দ বিজয় লালিমা ছড়ায়। মুঠোয় মুঠোয় সময়ের তালে প্রাপ্তির আনন্দ ঘনিভূত হয়।
আচমকা খোলা বাতায়ন বেয়ে মনটা বাড়ীর উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালে হৃদয়ের মাঝখানটায় চিনচিনে ভাব অনুভূত হয়। আবার কল্পনার ডানা মেলে সাগর পাড়ের নারিকেল ছায়ায় পাড়ি জমালে ভাবনায় বুঁদ হয়ে থাকা চেহারাটি আলো ঝলমলে হয়ে উঠে। চোখমুখ জুড়ে আলোর ফোয়ারা বয়ে যায়।
কি পরে বেরুবো। মন্থিত পরিচ্ছেদ তো আলী ভাইয়ের ঘরে। দোকান মেলবে দশটায়। মাইক্রো ছেড়ে যাবে এখনি। গায়ে আমার দু তিন দিনের পুরনো জামা। দূর পাল্লার প্রমোদ বিহারে বেরুচ্ছি; ঝলমল করা কিছু না হলে কি হয়? সবার আপাদ-মস্তক ঝিলমিল করছে। মনটা একটু ব্যথিত হল। মানুষের যেমন হয়। ভাই আতাউল্লাহ বলল, এটা পরেই চলুন। আমার গায়ে কিছু না থাকলেও যেন আমাকে যেতে হবে। গায়ের জামা গায়ে রেখেই তৈরি হলাম। অবশ্য আমার জামার রঙ্গের একটা মহত্ত্ব ছিল। ধুলে যেমন না ধুলেও তেমন। নতুন পুরনোতে কোন বিভেদ নেই। ব্যাপারটা ভেবে একটুখানি সান্ত¡না পেলাম।
সাথে একটা ব্যাগ নিতে হবে এবং কিছু অনুষঙ্গ। তাই ব্যাগটা গুছাচ্ছি। এ সময় আতাউল্লাহ তাড়া করে বলে যায় সাথে ডয়েরীটিও নিয়েন। আমার মাথায় একটি জিজ্ঞাসা অঙ্কুরিত হয়। ডায়েরী? ডায়েরীর সাথে এ দূর যাত্রার যোজনা কিসের? খানিক পর কথাটার অর্থ খুঁজে পাই। ভ্রমণ গাঁথা লেখার সাথে এ ডায়েরীটার আলাদা একটা যোগসূত্র আছে।
আমি ছোট্ট এ জীবনে আঁকাবাঁকা অনেক পথ হেঁটেছি। স্বপ্ন ছিল সবগুলো পদরেখাকে ডায়েরীর সাদা পাতায় স্মৃতি করে রাখব। স্বপ্নের সবগুলো পাপড়ি প্রস্ফুটিত হয় নি। দু চারটে পাপড়ি মেলেছে হয়তো। আবার কিছু কিছু অর্ধাঙ্গ হয়ে অসহায় পড়ে আছে ডায়েরীর পাতায়। যেন দেখার কেউ নেই। তবে এগুলো ভ্রমণ বলতে যেটা বুঝি তেমন কিছু ছিল না। উপভ্রমণ কিংবা মিনি ভ্রমণ জাতীয় কিছু একটা বলা যেতে পারে। আমার জীবনে এটাই সর্বপ্রথম এবং সম্পূর্ণ ভ্রমণ অভিযাত্রা। এ ভ্রমণটাকে স্মৃতিময় করে রাখতে একটু ভিন্ন মাত্রা দিতে হবে। বিষয়টির দিকে নখ উঁচিয়ে গেল ভাই আতাউল্লাহ। র্যা ক ঘেটে ডায়েরীটি খুঁজে বের করে ব্যাগের ভিতরে ঢুকালাম।
শুরু হলো পথচলা
সবাই দৌড় ঝাপ করছে। গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের এ ব্যাপারগুলো পর্দার আড়ালে চুপিসারে হচ্ছে। আমাদের উপরের বিভাগের দু’ চার জন ছাড়া আর কারো গোচরিভূত হয় নি ব্যাপারটি। গুছিয়ে উঠতে আমার খানিকটা বিলম্ব হয়ে যায়। ঝুপড়ি থেকে সতীর্থরা বেরিয়ে পড়েছে। আমি ব্যাগটি কাঁধে ঝুলিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ি। দ্বিতীয় সুড়ঙ্গ পথটা পেরিয়ে চত্তরে পা রাখতেই চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেল। শিক্ষাসচিব সাহেব চত্তরের ঠিক মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে আছেন। আশে পাশে কজন ছাত্র ছোট খাট একটা জটলা তৈরি করে রেখেছে। গলায় কাটা বেধার মত হল। না এগুতে পারছি না পেছাতে। কি করব ভেবে পাই না। খানিকটা দাঁড়িয়ে থেকে কিছুটা সাহস যোগাড় করে দ্রুত পা ফেলে সামনে এগিয়ে যাই। চত্তরের মধ্যিখানটায় এসে চোরের মত পেছনে তাকাতেই চোখে চোখ পড়ে যায়। পায়ের গতি আমার থেমে নেই। একেবারে গেট পেরিয়ে গতি রোধ করি। যেন সুন্দরবন পাড়ি দিয়ে এলাম। ভেতরটা তখনও ধড়ফড় করছিল। নাযেম সাহেব হুযুর হয়তো ভেবেছেন, ছেলেটা এভাবে না বলে দ্রুত চলে গেল কেন? প্রতিবারই তো আমাকে বলে যায়। আজ এমনটি করল কেন....? ভাবলাম, দেখা করতে গিয়ে না জানি কোন জালে আটকে যাই। আর কিছু না হোক তরতাজা একটি মিথ্যে কথা তো বলতেই হবে। নতুবা আশার গুঢ়ে বালু পড়ে যাবে। এজন্য নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে বাইম মাছের মত কাদা মাখা হাত ফসকে বেরিয়ে পড়ি।
আজ যদি আমি ভার্সিটি পড়–য়া স্টুডেন্ট হতাম তবে আমাকে ভয়ংকর এ সুন্দরবন পাড়ি দিতে হত না। সিনা টানটান করে বেরিয়ে যেতাম। টিচার মিচারের কোন কেয়ার করতাম না।
ভাষার টোনটা একটু অন্যরকম শোনালেও কথা বাস্তব। সিনা টানটান করে আমার প্রিয় উস্তাদের সামনে দিয়ে নির্ভয়ে আসতে না পারার জন্য আজ আমি গর্বিত।
ভার্সিটি এবং জামিয়ার ছাত্রদের মাঝে এই একটি ব্যকরণিক পার্থক্য। তারা তাদের টিচারদেরকে এক চোখে দেখে। আমরা আমাদের উস্তাদদেরকে অন্য নয়নে দেখি। তারা তাদের শিক্ষকদের ভয় করে না। সুযোগ পেলে গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করে না। আমরা আমাদের উস্তাদদের হৃদয়ের সবটুকু দিয়ে ভয় করি। মানে হামলে খাওয়ার মত ভয় নয়। হৃত্বিক সম্মান এবং শ্রদ্ধা ভালবাসার ভয়। এ ভয় সিংহের গর্জন থেকেও ভয়ংকর এবং মা বাবার স্নেহ মমতার মতই প্রশান্তিময়।
ছুটি মানেই দুরন্ত স্বাধিনতা। নীল আকাশে ডানা মেলে যেথায় ইচ্ছে উড়ে বেড়াও। এ সংস্কৃতি শুধু মাদরাসা ভার্সিটিতেই নয় সব প্রতিষ্ঠানেই সমভাবে প্রযোজ্য। তবে সত্যিকারের মানুষের কোন ছুটি নেই। ছুটি মানে অবসর অবকাশ। একজন অন্বেষী মানুষ কখনো অবসর হতে পারে না। এটা মূলত কাজে হাঁপিয়ে উঠা মানুষের জন্য পুনরোদ্দমে কাজকে আরো গতিময় করার উদ্দেশে সাময়িক বিশ্রাম গ্রহণ।
আমাদের মাদরাসা ছুটি। সে মতে যেথায় ইচ্ছে সেথায় ছুটে যেতে পারি। এ সময় সুদূর চাঁদের দেশে চলে গেলেও কেউ কিছু বলবেন না। আমাদের উস্তাদদের সম্বন্ধে যতটুকু ধারণা রাখি তাতে এ না বলাটা নিশ্চিত। উপরন্তু শিক্ষাসচিব সাহেব মমতা সমৃদ্ধ এক উদার মনের মানুষ। হুযুরকে সাহস করে বলে আসলে আমার ধারণা হুযুর যারপর নাই খুশি হতেন। তবু মনের কোণে এক টুকরো ভীতি কাজ করেছিল। না জানি হুযুর কি ভেবে বসেন। এ ভীতিকে অনুসরণ করেই আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে যাওয়া। এতে করে ভীতিটা ফুলে ফেঁপে আরো বড় আকার ধারণ করে। ফলে দুর্গম গিরি কান্তার মরুর মত এক ভীতিকর এলাকা পার হওয়ার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
একটু পেছনে যেতেই হয়। আমার লেখা পড়ার এ ছোট্ট জীবন ঘটনা বহুল একটি মিশ্র জীবন। বেদনা ব্যথার হাজারো স্মৃতিতে ঋদ্ধ আমার অগোছালো এ শিক্ষা জীবনটি। একদা মাঝ দরিয়ায় এসে আমি খৈ হারিয়ে ফেলি। সমুখে তিমির আঁধার। কোথও আলোর ইশারা নেই। বৈরি স্রোতের বিপরীতে সাতরে আসা এক ক্লান্ত সাতারু মুহূর্তেই হাত পা ছেড়ে দিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। আলগা স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়া ছাড়া যেন আর কোন উপায় নেই। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি...। রক্তপিচ্ছিল এ বন্ধুর পথ আমার নয়। মাঝ মরুতে এসে বেদনা ব্যথায় ন্যুব্জ হয়ে অশ্রু সজল নয়নে পেছনের পথে পা বাড়াই। জীবনে অনেক হেঁটেছি। সমুখে আগাবার আর এতটুকু সাধ্যও নেই। তাই সবার অগোচরে গহীন রাতে পা বাড়াই অজানা পথে। হঠাৎ কেন যেন হৃদয়ের গভীরে একটু খানি টান অনুভূত হয়। ভাবি, এভাবে পথ চলায় দু একটি হৃদয় কি ব্যথিত হবে না! যারা আমাকে সন্তর্পনে স্নেহ মমতা দেন। থমকে দাঁড়ালাম। অন্তত একটু বলে যাই। যারা আমায় এত শত দিনে এত কিছু দিলন তারা কি আমার এতটুকু বলে যাওয়া পান না! বিবেকের আদালতে নির্বাক হলাম।
একদিন ভর দুপুরে চেহারায় নীল বেদনার ছাপ মেখে শিক্ষা সচিবের কুঠরিতে গিয়ে উপস্থিত হই। আমি চলে যাচ্ছি শুধু এতটুকুই বলব। হুযুর আমার মনভাঙ্গা চেহারা দেখে যেন বুঝে ফেললেন এমন একটা কিছুই আমি বলব। তাই হুযুর আগে ভাগেই জিজ্ঞেস করে ফেললেন কি হয়েছে। আমি কোনো রকম জড়তা ছাড়াই বলে ফেললাম ‘আমি চলে যাচ্ছি’। হুযুর আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করুক- আমি চাচ্ছিলাম না। আমার বাসনা ছিল, আমার প্রথম কথা আমার শেষ কথা হোক- আমি চলে যাচ্ছি। কিন্তু আমার কামনা বাসনা শিকেয় তুলে হুযুর আমাকে ধরে বসলেন। আমি চাপা স্বভাবের মানুষ। ভাল হোক মন্দ হোক কোন ব্যপারেই আমি নিজেকে উন্মুক্ত করতে চাই না। হুযুরের পিতৃসুলভ স্নেহপূর্ণ ভাষার কাছে নিজেকে সপে দিতে বাধ্য হলাম। এই প্রথম আমার ভিতরের দাউ দাউ আগুনের কথা একজন মানুষ জানতে পেল। এ যাবত আর কেউ আমাকে জানতে পারে নি। একান্ত হৃদয়ের বন্ধুও না। হুযুরকে সব খুলে খুলে বললাম। হুযুর সীমাহীন ব্যথিত হলেন। পিতৃত্বের ছায়ায় আমাকে আগলে নিলেন। এবং স্নেহ ও দরদ মাখা অনেক কথা আমাকে বললেন। নিজের জীবনের দু চারটে কষ্টের স্মৃতিও আমাকে শুনালেন। পথহারা আমি মাঝ মরুতে এসে পথের দিশা পেলাম। তিমির আঁধারে আলোর ইশারা দেখতে পেলাম। আবার পথ চলা শুরু হল। এ পথ চলায় আর বিরতি হয় নি। বন্দরে নোঙ্গর ফেলে তবেই ক্ষান্ত হই।
ঝঞ্জা বিক্ষুব্ধ এক অশান্ত সাগরের অতল গহীনে তলিয়ে যাওয়া হতে উদ্ধার করে মুক্তির মহাসড়কে এনে দাঁড় করিয়ে দিলেন পিতৃপ্রতিম যে পবিত্র সত্তাটি- তার আমি কি করতে পেরেছি? ....।
আমি জীবনে অনেক মানুষের স্নেহ ভালবাসা পেয়েছি। কিন্তু তাদের ভালবাসার মূল্য দিতে পারি নি। আত্মকেন্দ্রিকতা আর বাকস্বল্পতার ছুতো দিয়ে শুধু আড়ালে আড়ালেই থেকেছি হতভাগা এই অধম আমি।
ছাত্র মমতায় হযরত ইবরাহীম হিলাল সাহেব হুযুরের তুলনা হুযুর নিজেই। ছাত্র সমাজের মাঝে স্নেহ ভালবাসা আর মায়া মমতায় হুযুর এক জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে আছেন। ছাত্রদের মাঝে হুযুর আজ আব্বাজান অভিধায় অভিষিক্ত। হুযুরের দক্ষ সঞ্চালনায় রাহমানিয়ার শিক্ষার মান আজ দেশ ব্যাপী আলোচিত।
আশ্রয় দুর্গ
জা জাগ্রত সান্ত্রীর আশ্রয় দুর্গ
মি মিলযুক পর্শে শান তার সর্গ
আ আধ্মাত মিত তার অঙ্গন নিত্যে
রা রাশ হিত ন্যায় নীত সৎ জ্ঞান তত্ত্বে
হ হর্ষিত দীক্ষণে নেই তুল বঙ্গে
মা মার্জিত পাঠলিপে যশ তার তুঙ্গে
নি নির্মল অবয়ব নয় শ্রী রিক্ত
আ আর্দ্রে সত্যের কুল হৃদ সিক্ত
আ আত্মিক ক্ষমে হৃদ ছিনে নেয় সূর্য
রা রাজতুল অন্বেষী লীনে বদ তুর্য
বি বিষধড় রাজক্ষম হরদম বেপমান
আ আরবীয় মনীষা, দ্যুতে কুল দীপমান
ঢা ঢাক ঢাক গুড় গুড় নয়, সৎ হিতবাক
কা কাঙ্খিত মার্গ রচে করে নত হতবাক
গেট পেরিয়ে দেখি সাদা পোষাক পরে দু হাত দুলিয়ে এগিয়ে আসছে সুহৃদ মামুন। সবাই বেরিয়ে পড়েছে। আমি একা পেছনে পড়ে আছি। আমাকে তাড়া করে এগিয়ে নিতেই সুহৃদ মামুনের এ ছুটে আসা। উত্তর দিকে মুখ করে পা চালিয়ে দুজনে সামনে এগিয়ে যাই।
আমরা যে পথটি ধরে হেঁটে চলছি তার দু ধারে আজ সারি সারি আকাশ ছোঁয়া ইমারাত। এক সময় এলাকাটি ছিল পূতিগন্ধময় এক ভাগাড় ভূমি। নাক চেপে ধরে মানুষ চলাচল করত। ৯৯ তে আমি নিজেও নাক চেপে ধরে হেঁটেছি মনে পড়ে। আশির দশকে এখানে রাহমানিয়া ভবন ছাড়া আর কোনো ভবন চোখে পড়ত না। রাহমানিয়ার আশ পাশ জুড়ে ছিল খা খা শূন্যতা। তখনকার ছবিগুলো আজো মনে করিয়ে দেয় সে খা খা শূন্যতার স্মৃতিকথা। এ পথের ধারেই ছিল পূতিগন্ধময় মাথা মোটা মাগুরের আবাস ভূমি। উৎকট গন্ধে রি রি করে উঠত চারি ধার। এই সেদিন মুড়ি ছিটিয়ে মাগুরের সাথে খেলা করেছি। আজ এখানে ‘ওয়া বিহি ক্বলা হাদ্দাসানা’ এর রিমিঝিমি শোনা যায়। এসবি মাহা মহিমের বিচিত্র করুণা।
তিন রাস্তার মোহনায় এসে দেখি, ধবধবে সাদা মাইক্রোটি আমাদের দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে। ওর পেটের ভেতরে সাদা সাদা এক দুজন ঢুকছে বেরুচ্ছে করছে। আমি গাড়ির গা ঘেষা সিঙ্গেল আসনটিতে গিয়ে বসে পড়ি। ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে কোলের ভেতরে গুঁজে রাখি। বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখি সদ্য গজিয়ে উঠা ভদ্রলোকের মত আসন পেতে বসে আছে বহু দিনের পুরনো সাথি সফিউল্লাহ। আরে সফিউল্লাহ তুমি! দু’ ঠোটের মাঝে এক গাদা খিলখিলে হাসির প্রলেপ মেখে দুখান হাত বাড়িয়ে দেয় সফিউল্লাহ। হাত চেপে বলি কথা বার্তা সাবধানে বলো। ভ্রমণ এমনি কষ্টকর। বেশি হাসা যাবে না কিন্তু!
আমি নয়া মুসাফির। আদ্যোপান্ত কিছুই জানি না। সতীর্থ হাবীবকে খুব ব্যস্ত দেখাচ্ছে। দুএকটি কথা উড়ে এসে আমার কানের কাছটায় হালকা শব্দ করছে। শব্দগুলোকে জোড়া তালি দিয়ে বুঝার চেষ্টা করি। কিন্তু ব্যর্থ হই। সবাই আমার বহু দিনের পুরনো সাথী। তবু কেন যেন আমার খুব নতুন নতুন লাগছে। পুরনোদের মাঝে নতুনদের যে একটা সংকোচ ভাব সৃষ্টি হয়, সেটা আমি খুব অনুভব করছি। পুরনো হয়েও যেন আমি নতুন মানুষ।
সহযাত্রী কত জন এবং কে কে এর ফিরিস্তি আমার কাছে নেই। তবে এক আধটু আমি জানি। সুহৃদ মাহমূদ থেকে জেনেছি, আমাদের চালক বন্ধু আমাদের মত সাদা মাথার মানুষ। শুনে প্রীত হলাম। আমরা সবে একি নায়ের মাঝি। খুব মজা হবে তবে। চালক বন্ধুকে দুচোখে দেখে তো আক্কেলগুড়–ম। এ তো দূর দেশ থেকে উড়ে আসা ফুটফুটে চেহারার এক মহান সাধক। ধবধবে ইয়া এক জুব্বা গায়ে জড়িয়ে গাড়ির কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা মাইক্রোটি আমাদের মুখে পুরে নিলেই ছুটে পালাবে দখিনা হাওয়ায়।
আমরা গাড়িতে চড়ে বসেছি। দুএকজন বাহিরে ঘুরঘুর করছে। আমি সুহৃদ শুআইব থেকে মোবাইলটা নিয়ে ভাইয়াকে ফোন দেই। ওপার থেকে ভাইয়ার ঘুমো ঘুমো কন্ঠ ভেসে আসে। ঠিক এসময় আমাদের প্রিয় শিক্ষক মাওলানা হিলালুদ্দীন সাহেব মা’হাদু উলূমিল কুরআন থেকে বের হন। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মাইক্রোর ভিতরে বাহিরে চির চেনা মুখগুলোকে দেখে বেশ কবার এদিক ওদিক তাকান। জিজ্ঞেস করার মত কাউকে কাছে পেলেন না। সাথীদের যারা ছিল নিমিষেই চোখের আড়াল হয়ে যায়। আমরা ভয়ে জড়ো সড়ো হয়ে গুটিসুটি মেরে বসে থাকি। ভয় শঙ্কা আমাদের তাড়া করে ফিরে। না জানি ব্যপারটা হুযুর জেনে যান কি না। কথায় কথায় বড়দের কানে চলে যায় কি না। পাঁচ ছ গজ এগুতেই সামনে পড়ে যায় সুহৃদ মামুন। জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যচ্ছো। কী জবাব দিয়েছিল কানে শুনি নি। এক সূত্রে জেনেছি, চট্টগ্রাম সতীর্থ আবুজরদের বাসায় বেড়াতে যাচ্ছি বলে পার পেয়েছে। জবাব পেয়ে হুজুর তুষ্ট হয়েছেন কি না জানতে পারি নি। তবে সময়ের অসহযোগিতায় আবুজরদের বাসায় আমরা উঠতে পারি নি।
আকস্মিক এ ঝড়ো হাওয়ার কবলে পড়ে আমার কথার টোন বদলে যায়। মুঠো ফোনটা কানের কাছে ধরে হালকা গলায় বলি, আমি তিন দিনে যাচ্ছি। তাবলিগ না ভ্রমণ স্পষ্ট করে বলি নি। এখানেও একই ভয় কাজ করেছিল। ভাইয়া ভেবেছেন, আমি তিন দিনের তাবলিগে যাচ্ছি। তাই গাঢ় গলায় জিজ্ঞেস করলেন, টাকা পয়সা আছে? বললাম, প্রয়োজন নেই, সব ব্যবস্থা হবে। একথা বলেই আলাপনিটা রেখে দেই।
চালক বন্ধুর সোজা পেছনে জোড়া সিট দুটোয় এসে বসে মাহমূদ আর আতাউল্লাহ। তার পরে শুআইব সফিউল্লাহ। এরপরের দুটোয় মামুন মাহবুব। সবার শেষে পেছনের সিটে এসে বসে ভ্রমণ প্যাকেজের অন্যতম উদ্যোক্তা আমের দেশের হাবীবুর রহমান। বাম দিকটায় সিঙ্গেল তিনটে সিট। একেবারে সামনেরটা এখনো শূন্য পড়ে আছে। এর পর দরজা ঘেষা যেটা সেটাও শূন্য। তৃতীটায় আমি। আমার পেছনে চার পাঁচ জনের একটা লম্বা আসন। কেউ ইচ্ছে করলে পা মেলে ঘুমোতেও পারবে। ফেরার পথে যেমনটি করেছিল স্বঘোষিত মুসলিম বিশ্বের একমাত্র খলিফা সফিউল্লাহ।
অনন্ত দূরের পানে
আগপিছ করে সবাই গাড়িতে চড়ে বসেছি। এবার শুরু হবে দূর পাল্লার অভিযাত্রা। পিচ ঢালা পথ মাড়িয়ে সবুজ বাংলার বুক চিড়ে শুরু হবে দূর দিগন্তে ছুটে চলা। যখন ইঞ্জিনের বাটন চেপে বিলাল ভাইয়া গাড়ি ছুটালেন তখন আমাদের হাতে মোবাইল ছিল, মোবাইলে ঘড়িও ছিল। তবে আমাদের সময় দেখার সময় ছিল না। কারণ আনন্দ অভিযাত্রায় সময়ের হিসাব নিকাশ করা হয়ে উঠে না। উপরন্তু এতে করে আনন্দ জোয়ারে খানিকটা হলেও ভাটা পড়ে যায়। তবু আমাদের পুরোটা ভ্রমণ জুড়ে সময়ের হিসেব কষে বেড়াতে হয়েছে। রাখালের মত আমাদের তাড়িয়ে বেড়িয়েছে এ সময়গুলো। যেখানে পা রেখেছি সময় আমাদের পিছু নিয়েছে। পদে পদে সময়কে আমাদের সেলুট করতে হয়েছে। আমরা ছিলাম সময়ের হাতের পুতুল। সময়কে আমাদের বসে আনতে পারি নি। আমাদের হাতে সময় মাত্র তিন দিন। এ সময়ের ভিতরেই আমাদের ভ্রমণ যাত্রা গুছিয়ে সাগর পাড়ের এলাকা ত্যাগ করতে হবে।
মিষ্টি সকালের নীরবতা ভেঙ্গে আমরা এগিয়ে চলছি। চিরচেনা উঁচু উঁচু দালানগুলোকে হাত নেড়ে বিদেয় জানাই। বিদেয় জানাই এক সময়ের মোহনপুর আজকের মুহাম্মদপুরকে। আমাদের হাঁটা চলায় মুখরিত হয়ে থাকা পথটুকু চালক বন্ধুকে বলে দ্রুত পেছনে ফেলে যাই। কারণ আশপাশে মৃদু ভয় শংকার আনাগোনা ছিল। জামি‘আ ঘেষা পথটুকু পেরুতে ভয়ে আমাদের চোখগুলো বড় বড় হয়ে উঠে। না জানি তিলকে তাল বানানো কেউ দেখে ফেলে কিনা। চোখে মুখে ভয়ের ধুলো মেখে সবাই এক যোগে এদিক ওদিক উঁকি ঝুঁকি করি। যেন আমরা পাচারকারী কোনো দস্যুদল।
নরম ভোরের অবারিত রাজপথ। সুন্দর ঝকঝকে পরিস্কার। দেখে হৃদয়টা সজীব হয়ে উঠে। হায়! যদি আমাদের ঢাকাটা সবসময় এমন ঝকঝকে হতো। গণমানুষ আর যানজটের এ শহুরে জীবন বড়ই পীড়াদায়ক। তবু মানুষ ঢাকা মুখী। এত হাও কাও এত জঞ্জাল। তবু মানুষ ঢাকা থেকে বেরুতে চায় না। যেন পান্না হিরা আর মতি জওহর সব ঢাকার গর্ভেই লুকিয়ে আছে। আমরা চাকা ঘুরিয়ে এগুচ্ছি। আর দুচোখ মেলে ভোরের নরম আলো মাখা আমাদের স্ন্দুর ঢাকার দেহখানি নিবিড় করে দেখছি।
সবার চোখে মুখে নান্দনিক রেখা ফুটে উঠেছে। কমলার কোয়ার মতন দুধরাঙ্গা ঠোটগুলোর গা জুড়ে অন্যরকম এক হাসির প্রলেপ লেগে আছে। সুহৃদ মাহমূদের ঠোটের এক কোণে ঝুলে থাকা এক ফোঁটা হাসি পেছন থেকে দেখা যাচ্ছে। বাকিটুকু কালো মাথাটার আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে। শুআইবের চোখে মুখে লেগে থাকা আনন্দ রেখা পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে না। ঘুমের ভারে চোখ দুটো ছোট হয়ে আছে। আনন্দ রেখার উপর দিয়ে রাতজাগা ক্লান্তির ধূলো বালি পড়েছে। সুতীব্র নিদ্রা জোয়ারে আনন্দের বিকাশ ঘটাতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কারণ এ মানুষটাকে লেপের তলদেশ থেকে সদ্য তুলে আনা হয়েছে। সুহৃদ মামুন কাচুমাচু করে একটুখানি মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজছে। যেখানে রাত সেখানেই কাত এর মত একটুখানি জায়গা পেলেই হল। ব্যস, দুচোখ জুড়ে এসে ভর করবে সাতসমুদ্র তের নদীর ঘুম। নিমিষেই বন্ধ হয়ে যাবে দুটি চোখের লোমশ কপাট। হয়তোবা মিলে যাবে খানিকটা নরম তুলতুলে জায়গা। এখন শুধু সুযোগটুকু হাতের মুঠোয় পুরে নিতে বাকি।
আমাদের গারিটি ধানমন্ডি, জিগাতলা, সিটিকলেজ, নিউমার্কেট এবং ইডেন কলেজ হয়ে বেরিয়ে যাবে। ইডেন কলেজ থেকে আমাদের দূর পাল্লায় যোগ দিবে আরেক সতীর্থ। নয়া এ মুসাফির আমাদের চিরচেনা বিশারতুল্লাহ। হৃদয়ে স্বপ্ন আঁকা উতাল দিনের পড়ার সাথী। তিন বছর নয়-যেন একজনমের পরিচিত মুখ।
স্মৃতি পথের বাঁকে বাঁকে
দুরন্ত কৈশোরের অনেক চেহারাই আজ হারিয়ে গেছে। হয়তোবা হৃদয় থেকে মুছে গেছে কোনো কোনো চেহারার ছাপচি‎‎হ্ন।‎‎ বড় মধুর ছিল রাহমানিয়ার সে সোনালী দিনগুলো। সোনালী দিনের সোনালী মানুষগুলো আজ কোথায় হারিয়ে গেল! সেসব আজ শুধুই স্মৃতি।
তখন ১৯৯৯ সাল। দুরন্ত কৈশোর পেরিয়ে সবে তারুণ্যে পা দিয়েছি। ঢাকায় লেখা পড়া করার আগ্রহ তখন আমার চরমে। বাবা মা ভাই বোন সবার এক বাক্য, তুমি ঢাকা যেতে পারবে না। পরিস্থিতি অনুকূলে না পেয়ে নিরস্ত্র এক কিশোর যোদ্ধা পরিবারের বিরুদ্ধে বুক চেতিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। তাদের হাজারো যুক্তি হাজারো ভয় শংকা আমাকে এতটুকু টলাতে পারে নি। আমার বক্তব্য, আমি মরি বাঁচি ঢাকাতে লেখা পড়া করবই। এবং দেশ সেরা রাহমানিয়াতেই লেখা পড়া করব।
বড় ভাইয়ার ভয়ার্ত যুক্তি ছিল, রাহমানিয়ার মত প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার মত মেধা যোগ্যতা এখনো তোমার হয় নি। আমি ভিতরে ভিতরে ভয়ে সিটিয়ে থাকি। কিন্তু মুখে বলি অবশ্যই পারব।
আমি আসলে রগচটা এক জিদ্দী ছেলে। সহজেই রেগে যেতে পারি না। কিন্তু মাথায় রাগ উঠে গেলে নিজেই নিজের কাছে অসহায় হয়ে পড়ি। এ ক্ষেত্রেও চরম জিদ্দী মানষিকতা আমার ভিতরে টগবগ করতে থাকে। নিজের একান্ত ব্যক্তিগত কিছু টাকাই ছিল আমার শেষ পাথেয়। মা বাবা ভাই বোনদেরকে টেক্কা দিয়ে ঢাকার পথে চলছি। তাই বিদায় বেলা তাদের স্নেহ মমতার হাত প্রসারিত হয় নি। মুহূর্তেই আমি একা হয়ে যাই। এক বুক বেদনা নিয়ে অশ্রু সজল নয়নে বেরিয়ে পড়ি ঢাকার পথে। সারা পথ জুড়ে মুখ হৃদয়ে ছিল দু‘আ দরুদের সমারোহ। মনে মনে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। রাহমানিয়ায় বিফল হলে জীবনে এ মুখ আর কাউকে দেখাব না। চির দিনের জন্য হারিয়ে যাব অজানা কোথাও। দুরু দুরু মনে রাহমানিয়া চত্তরে পা রাখি। সাথে ছিলেন পাশের গায়ের বড় ভাই শাহাদত হুসাইন। তিনিও নতুন আমিও নতুন। তখন রাহমানিয়ার স্বর্ণালী যুগ। বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মত ধেয়ে আসছে নতুন পুরাতন ছাত্র। ভর্তিচ্ছুক ছাত্রদের উপস্থিতিতে রাহমানিয়ার আঙ্গিনা টইটম্বুর হয়ে থাকে সারাক্ষণ।
নতুন মানুষ। নতুন পরিবেশ। ডান বাম চিনি না। কোনো কিছুতে কারো দ্বারস্থ হবার অভ্যাস তেমন একটা নেই। ফলে ফরম ফিলাপের কাজটাকে কিছুটা গুছিয়ে নিতে দু তিন লেগে যায়। এক সময়ে আসে ভয়ে কেঁপে উঠা ভর্তি পরীক্ষার পর্ব। পরীক্ষা নেবেন শায়খ দৌহিত্র মুফতী হাসান আহমদ সাহেব দা. বা.। ভয়ে আমি এতটুকু হয়ে যাচ্ছি। এ আমার জীবন মরণের লড়াই। দেখি আমার সামনে দিয়ে ভাল ভাল ছাত্ররা বিফল হয়ে মুখ চোখ কালো করে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমার হৃদ কম্পন বেড়ে যায়। এক সময় আমার নাম আসে। জড়ো সড়ো হয়ে হুযুরের সামনে গিয়ে বসি। দু তিনটে প্রশ্নের জবাব দিয়েই আমি গা ঝাড়া দিয়ে উঠি। বিজয় আনন্দে তখন আমার চোখ দুটো চিকচিক করে উঠে। নিমিষেই হুযুরের চেহারা হতে গভীর ঘন গাম্ভির্যতার মেঘমালা সরে যায়। হুযুর স্বাভাবিক হয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে আমার সব কিছু জিজ্ঞেস করলেন। শেষে হুযুর এক ধাপ এগিয়ে আমার কাছে রক্ষিত টাকার অঙ্কটাও জানতে চাইলেন। আমি নিঃসংকোচে বলে ফেলি। মুদ্রা সংকট দেখে হুযুর আমাকে কিছু টিপস দিলেন। এতে আমার বেশ মুদ্রা সঞ্চয় হয়। ব্যপারটা ছিল তখন আমার জন্য রতœাধারতুল্য।
দু তিন মাস বাড়িতে কোন যোগাযোগ করি নি। তিন মাস পর বাড়িতে গিয়ে সবাইকে বিজয়ের হাসি উপহার দিয়েছিলাম। আমার এ বিজয় আনন্দে তারা পরাজিত হয়েও আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিল। কারণ ছেলের বিজয় মানেই মা বাবার বিজয়।
অজপাড়া গা থেকে উঠে এসে ইবতেদায় সানী হতেই আমার পথ চলা। ইবতেদায়ী সানীর চত্তর জুড়ে তখন ছাত্র থৈ থৈ করছে। ট্রাঙ্কের উপর ট্রাঙ্ক রেখে সামান পত্র রাখছে। ক খ দুটি গ্রুপে আমরা প্রায় শ খানেক ছাত্র। প্রতিটি গ্রুপ আবার তিন শ্রেণীতে বিভক্ত। বড় মেজো ছোট।
সিনিয়ার গ্রুপ
১. মাহমূদুল আমীন ভাই
বহুমাত্রিক মেধার এক অনন্য মানুষ। মা’হাদুল বুহুসিল ইসলামিয়ার অধ্যক্ষ। তখন থেকে এখন একি সাথে পাশাপাশি।
২. মাসুদ ভাই
বিশুদ্ধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। মা’হাদ অর্থসচিব।
৩. আরিফ ভাই
মা’হাদ পরিচালনা পরিষদ সদস্য এবং মা’হাদের দক্ষ ইংলিস টিচার। জগন্নাথ ভার্সিটির স্টুডেন্ট। আবাহনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।
৪. আবু হুরায়রা ভাই
মা’হাদ সেক্রেটারি। আবাহনের উপরস্থ কর্মকর্তা।
৫. শামস ভাই
মা’হাদ পরিচালনা পরিষদের সদস্য। আবহনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
৬. হাবিব ভাই
সভ্য শান্ত ভদ্র মানুষ। মা’হাদু উলূমিল কুরআনে তাফসীর করে এখন সম্ভবত কর্মমুখী।
৭. আহমদ হুসাইন ভাই
দীর্ঘ দেহী এক সভ্য মানুষ। দীর্ঘ এক যুগ ধরে আড়াল হয়ে আছেন।
৮. বিশারতুল্লাহ ভাই
সদা সহাস্য এক অদ্ভুতুড়ে মানুষ। মানুষটার জীবনে দুঃখ বলতে বোধ হয় কিছু নেই। কম্পিউটার জগতের এক মহা কিংবদন্তি। বড় সড় এক কোম্পানীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। মা’হাদের কম্পিউটার বিভাগের খণ্ডকালীন টিচার।
৯. নূর মুহাম্মাদ ভাই
টনটনে স্বাস্থের একজন সুন্দর মনের মানুষ। হৃদয়টা বেশ স্বচ্ছ। এখন ডাকসাইটে এক ড্রাইভার। মাঝে মধ্যে দেখা হয়।
১০. মুসলেহুদ্দীন রাজু ভাই
দেশ কাঁপানো এক কালজয়ী মনীষীর গর্বিত সন্তান। শাইখ গওহর পুরী রহ. এর রেখে যাওয়া অমূল্য রতন। সুস্থ রুচিবোধ সম্পন্ন এক উদার মনের মানুষ। সে ইবতেদায়ী সানী থেকেই আমাকে খুব স্নেহ করতেন। দেখা হলেই মিষ্টি হাসি দিয়ে ভাল মন্দ জিজ্ঞেস করতেন। এর মাঝে কত উত্থান পতন কত ঝড় ঝাপটা গত হয়েছে; কিন্তু রাজু ভাইয়ের কোমল ঠোটের সে মিষ্টি হাসি এখনো সজীব রয়েছে।
রাহমানিয়ার ডিভাইড কালের কথা। সবেমাত্র দেশ সেরা একটি রাহমানিয়া ফেটে দু’ টুকরো হল। যেন তরতাজা একটি কলিজার উপর দিয়ে চকচকে একটি ছুড়ি চালিয়ে দেয়া হল। বেদনা ব্যথার লাল রক্তে আশ পাশ রঞ্জিত হল। এতে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত প্রতিটি শ্রেণী ভেঙ্গে দু টুকরো হয়ে যায়।
কি একটা ইস্যু নিয়ে পল্টনে সমাবেশের ডাক পড়ে। ধর্মীয় ইস্যু হওয়ায় দুটি রাহমানিয়াই সেখানে জড়ো হয়। বিপরীত মেরুতে থাকা আমাদের ক্লাসের কয়েক জনের সাথে দেখা। সেখানে রাজু ভাই ও ছিলেন। নতুন মেরু করণ হলেও আমরা দীর্ঘ দুটি বছর একি সাথে বেড়ে উঠা সাথী। তাই হৃদয়ের টানে হাত বাড়ালাম মুসাফাহার জন্য। যার দিকে আমার হাতটি ছুটে গিয়েছিল তিনি হাত গুটিয়ে নিয়ে স্বচ্ছ সুন্দর চেহারাটা কালো করে বললেন, আশরাফুজ্জামান সাহেব কথা বলতে নিষেধ করেছেন। কথা বলাই যেখানে নিষেধ মুসাফাহা তো সেখানে মহাপাপ! শুনে অবাক হলাম। আশরাফুজ্জামান সাহেব এমন কথা বলেছেন! হুযুর তো এমন কথা বলতে পারেন না। জানতে পারি নি হুযুর কোনো কালে এমন কথা বলেছিলেন কি না। হুযুর তো দেখা হলে মিষ্টি করে হাফিজ বলে ডাক দিয়ে ভাল মন্দ জিজ্ঞেস করেন। হুযুর তো আমাদের প্রিয় উস্তাদ। লেখা পড়ার মূল ফাউণ্ডেশন তো হুযুরের কাছ থেকেই করিয়ে নিয়েছি। এ সংযোগ তো কোনো কালেও বিচ্ছিন্ন হবার নয়।
এরপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রাজু ভাইয়ের দিকে হাত বাড়ালাম। রাজু ভাই ঠিক আগের মত মিষ্টি হাসি দিয়ে পরম স্নেহে হাত মেলালেন। আগের রাজু ভাই এবং এ রাজু ভাইয়ের মাঝে কোন ব্যবধান নেই। একেই বলে উদারতা, হৃদয়ের স্বচ্ছতা! তবে রাজু ভাই আশরাফুজ্জামান সাহেব হুযুরের কমান্ড অমান্য করে বোধ হয় বড় অন্যায় করে ফেলেছিলেন সেদিন!!
দীর্ঘ এক যুগ ধরে রাজু ভাইয়ের সাথে দেখা নেই। বাবার তিরোধানের পর হাজারো দায়িত্বে আটকা পড়ে যান রাজু ভাই। বাবার শূন্যতা পূরণ এবং সীমাহীন দায়িত্ব পালনে ন্যুব্জ হয়ে নিজের অজান্তেই অনেক বড় হয়ে উঠেন। সিলেটের আলেম সমাজ এক নামে চেনেন।
উড়ো মুখে শুনি। রাজু ভাই এখন সেই আগের রাজু ভাই নেই। অনেক বড় হয়ে গেছেন। অনেক বদলে গেছেন। কথা বার্তায়ও রং ধরেছে। তবে আমি জানতাম, সহপাঠী বন্ধুদের কাছে কেউ কখনো বড় হয় না। পরিবেশের তাড়নায় কেউ এর ব্যতিক্রম হতে পারে। হয়ও অনেক সময়। রাজু ভাই যদি ব্যতিক্রম ভাবধারায় আমাদের কাছে বড় হয়ে যান। যাক; সমস্যা কি। আমাদের দেখে যদি সে মুখ ফিরিয়ে রাখে; রাখুক। আমরা তো বলতে পারব, মুসলেহুদ্দীন রাজু ভাই আমাদের সহপাঠী ছিল। আমাদের মুখের এ গর্বটুকু তো আর কেড়ে নিতে পারবে না!
এবার (২০১২ খ্রি.) সিলেট শিক্ষা সফরে গিয়ে রাজু ভাইয়ের সাথে দেখা। আগে থেকেই ভয়ে ছিলাম আমাকে দেখে চেনেন কি না। কিন্তু রাজু ভাই আমাকে অবাক করে দিয়ে উজ্জ্বল রোদের মত ঝকঝকে হাসি ছড়িয়ে সাথে সাথে বুকে জড়িয়ে নিলেন। এক যুগ আগের সে হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় এখনো সে হাসির রেখা জ্বলজ্বল করছে। খুব অবাক হলাম। রাজু ভাই না বদলে গেছেন। অনেক বড় হয়ে গেছেন। সে হিসেবে তো চেনার কথা নয়। আমাকে দেখে রাজু ভাই অনেক খুশি হলেন। আর আমি হলাম অনেক অবাক। অনেক কথা বললেন। আমার স্বাস্থ্য স্বল্পতা দেখে আক্ষেপটুকু করতেও ভুললেন না। সিলেটের একটি নাম করা হোটেলে ঢুকিয়ে আমাদের রাজকীয় আসনে বসালেন। চেয়ারে বসা পর্যন্ত আমার হাতটি তার হাতেই পড়ে ছিল। চেয়ারটিতে তার পাশ ঘেষেই বসতে হয়েছিল। সুখ আনন্দের অনেক কথা হল। হৃদয়ের টানে রাজু ভাই সিলেট শহরে আমাদের গাড়ি থামিয়ে দিয়ে গওহরপুর থেকে গাড়ি হাঁকিয়ে ছুটে এসেছিলেন আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য। এর আগের রাতে তার মাদরাসায় আমরা রজকীয় আয়োজনে রাত্রি যাপন করেছিলাম। তখন রাজু ভাই মাদরাসার কাজে শহরে ছিলেন।
১১. আসাদুজ্জামান ভাই
লৌহ প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। অন্যায় অপরাধ হলে সাথে সাথে শোধ নিয়ে ফেলতেন। বিচারের কাঠগড়ায় পৌছুবার সময় দিতেন না। এক সহপাঠী ভাইয়ের দয়ার্ত অনুরোধে তার হয়ে আমি মালিবাগ মাদরাসায় ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। নির্বিবাদে ভর্তিও হয়ে গিয়েছিলেন। কাজটা কিন্তু বিধানিক ছিল না। এ বোধটুকু তখনো গড়ে উঠে নি। এক যুগ ধরে দেখা নেই।
১২. তাওহীদ ভাই
মানুষটার পায়ে একটু সমস্যা ছিল। বেশ চমৎকার হাতের লেখা ছিল। কড়কড়ে ভাজা মটর শুটির মত ঝরঝরে সুন্দর। শুনেছি এ পথে বেশি দিন থাকে নি। গাড়ি চালনার হাত ধরে এখন কর্মমুখী।
১৩. মুফিজুল ইসলাম ভাই
নম্র ভদ্র এক সুফি সাধক প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। ফরিদাবাদ হতে গ্রাজুয়েট হয়ে এখন সম্ভবত কর্মমুখী। অনেক বছর ধরে দেখা নেই।
১৪. রিজাউল করিম ভাই
তীক্ষè মেধার এক সাধক ছাত্র। কিতাব পত্র নিয়ে সদা পড়ে থাকার মানুষ। বন্দরে জাহাজ নোঙ্গর করা পর্যন্ত আমরা এক সাথেই ছিলাম। লেখা পড়ার প্রায় সব চ্যাপটারই শেষ করে ফেলেছেন। ঢাকায় মসজিদ মাদরাসা বেশ ভালই আছেন।
১৫. হাফীজুর রহমান সাতক্ষীরা
বেশ গল্পপ্রিয় মানুষ। ঢাকাতেই মাদরাসা নিয়ে আছেন। শেষ অবধি এক সাথেই ছিলাম। এখন রাহমানিয়ার হিফজ বিভাগে কর্মরত।
১৬. শিব্বির ভাই
বেশ নম্র ভদ্র মোটা তাজা গোছের মানুষ। বহুকাল যাবৎ দেখা নেই। কোথায় আছে কেমন আছে জানি না। এক সূত্রে শুনেছি আমেরিকাতে বেশ ভালই আছে।
১৭. নজরুল ইসলাম ভাই
নম্র ভদ্র গল্পপ্রিয় মানুষ। নিজ গায়ের অনেক গল্প শুনাতেন আমাদের। অনেক বছর ধরে দেখা নেই। কওমী থেকে আলিয়া হয়ে এখন কোথায় আছে জানতে পারি নি।
১৮. মুনীরুল ইসলাম
সুঠাম দেহের এক সুর শিল্পী। নাত শের গেয়ে বেশ নাম কুড়িয়েছিল। শেষ পর্যন্ত এক তরীতেই ছিলাম। এখন ঢাকায় এক মসজিদ মাদরাসা নিয়ে বেশ ভালই আছে।
১৯. মিসবাহুদ্দীন
জন্ম প্রতিবন্ধি মানুষ। ক্রাচে ভর করে চলা ফেরা করতেন। আমার সাথে বেশ সখ্যতা ছিল। পাকিস্তান হয়ে এখন গাজীপুরে এক মাদরাসায় আছেন।
২০. হানীন জামান
ধনী পরিবারের ধনি ছেলে। বেশ সভ্য শান্ত মানুষ ছিল। এখন আমেরিকাতে আছে।
২১. আনসারুল্লাহ
বেশ ভাল মানুষ। মাঝে মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হয়। এখন মুহাম্মদপুরে এক হিফজ বিভাগের প্রধান হিসেবে আছেন।
২২. কবীর হুসাইন
পুরো বছর ছিল না মানুষটা। যে কদিন দেখেছি ভালই দেখেছি। এরপর আর দেখা হয় নি। শুনেছিলাম যাত্রাবাড়িতে বেশ ক’ বছর ছিল।
২৩. সাদিকুর রহমান
বেশ নম্র ভদ্র হসি খুশি প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। এখন দাওয়াতী কাজের সাথে জুড়ে আছেন।
২৪. আবু সালেহ মুহাম্মদ মুসা
খুব মিশুক প্রকৃতির মানুষ। সিরিয়ালের ছাত্র ছিলেন। তখন রাহমানি পয়গাম আদর্শনারীসহ বেশ কটি পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। আমি তখন লেখালেখি কি জিনিস বুঝতাম না।
২৫. ওমর বিন আলী
হৃদয়ে ঝড় তোলা এক সঙ্গীত শিল্পী। বেশ মনকাড়া সুললিত কন্ঠের অধিকারী ছিলেন। শুনেছি, ছাত্র শিবিরের সঙ্গীত সংগঠন সাইমুমের হয়েও সঙ্গীত গেয়েছেন। এখন ঢাকা ভার্সিটিতে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ছাত্র।
২৬. হাসিব ভাই
তুখোর মেধার এক ধীমান ছাত্র। হাটহাজারী থেকে দাওরা করে এখন রাজশাহী ভার্সিটিতে বেশ সুনামের সাথে লেখা পড়া করছেন। বহু বছর ধরে দেখা নেই।
২৭. কামারুজ্জামান
শান্ত শিষ্ট এক ভদ্র মানুষ। অনেক বছর এক সাথেই ছিলাম। এরপর বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফরিদাবাদ থেকে গ্রাজুয়েট হয়ে এখন কোথায় আছে জানতে পারি নি।
২৮. আনিস ভাই
সদা সহাস্য এক কিংবদন্তী মানুষ। আমোদ প্রমোদ আর হাস্য রসিকতায় সবাইকে মাতিয়ে রাখত। কাব্যিকতা আর অংকন শিল্পে ছিল বেশ সিদ্ধ হস্ত। ফরিদাবাদ থেকে গ্রাজুয়েট হয়ে এখন মাদারীপুরে কর্মরত।
২৯. জাহিদুল ইসলাম
শান্ত শিষ্ট এক অনন্য চরিত্রের মানুষ। শেষ অবধি আমরা এক সাথেই ছিলাম। এখন মা’হাদু উলূমিল কুরআনের মহামান্য শিক্ষা সচিব। খুব কাছের বলে এখনো কাছাকাছি আছি।
৩০. মাহমুদুল হাসান মুন্সিগঞ্জ
সভ্য শান্ত ভদ্র মানুষ। এক সাথে বেশি দিন ছিল না। কামরাঙ্গীর চর কিছু দিন ছিল। এরপর কোথায় ছিল এখন কোথায় আছে জানতে পারি নি।
৩১. মুইজুদ্দীন
দীর্ঘ দেহের এক রসিক মানুষ। রস কৌতুকে সবাইকে মাতিয়ে রাখত। মাঝে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এরপর আবার এসে রাহমানিয়া ভবন থেকে গ্রাজুয়েট হয়। এখন কোথায় আছে জানতে পারি নি।
৩২. ইমদাদ
মানুষটার ফেস মনে ছিল বেশ ভাল করেই। কিন্তু নামটি উদ্ধার করতে সুহৃদ আতাউল্লবহর সাহায্য পেতে হয়েছে। বড় সড় গোছের একজন সবল মানুষ ছিল। আশরাফুজ্জামান সাহেবের খুব কাছের ছাত্র ছিল। হুযুরের খুব সেবা করত। খানা দানার আয়োজনে তাকেই ছুটাছুটি করতে দেখা যেত।
৩৩. কিফায়াতুল্লাহ
সদ্য গ্রাম হতে উঠে আসা দীর্ঘ কায়ার একজন সরল মানুষ। আমল তথা Emplementation এ ছিল দারুন মনোযোগী। বছরটা শেষ করেছে বলে মনে পড়ে না। বহুকাল ধরে দেখা নেই।
মিডিল গ্রুপ
৩৪. মুহাম্মদ আলী
হাস্য রসিক এক ধীমান ছেলে। শত দুঃখের মাঝেও ফিক করে হেসে উঠে। কিংবদন্তি তুল্য এক মিশুক মানুষ। কলম হাতে যে লেখালেখি করা যায় এ মানুষটিই আমাকে শিখিয়েছিল। স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে রাহমানী পয়গামের সদস্য করে দিয়েছিল। রাহমানিয়া হয়ে এখন লালমাটিয়া মাদরাসার মুফতী মুহাদ্দিস। মানুষটা সম্পর্কে লেখার মত অনেক কিছু আছে। ও দিকে আগালে কালি শেষ হয়ে যাবে। তাই এতটুকুই।...............................................
৩৫. আতাউল্লাহ
স্বচ্ছ মেধার ধীমান ছাত্র। মুহাদ্দিস রাহ. এর সুযোগ্য দৌহিত্র। ঝকঝকে পরিষ্কার স্মৃতি শক্তি। শৃঙ্খলিত পরিপাটি জীবন ধারণে অভ্যস্ত। বন্দর পেরিয়ে সম্মুখ পথেও আমরা এক সাথে ছিলাম। এখন ঢাকা আমীন বাজার মাদরাসার নবীন মুহাদ্দিস।
৩৬. মাহবুবুর রহমান
মুহাদ্দিস রহ. এর ধীমান দৌহিত্র। শেষ পর্যন্ত আমরা এক সাথেই ছিলাম। এখন ঢাকাতেই এক মাদরাসায় কর্মরত। কাছে বলে মাঝে মাঝে দেখা হয়।
৩৭. রহমতুল্লাহ
বেশ প্রাণোচ্ছল মানুষ ছিল। মাঝে মধ্যে দেখা হত। এখন কোথায় আছে কেমন আছে জানতে পারি নি।
৩৮. ফারুক হুসাইন
শান্ত শিষ্ট প্রকৃতির ছিল। আরজাবাদে বেশ ক’ বছর লেখা পড়া করেছে। এর পর আর দেখা নেই। শুনেছি, মিরপুর এক মাদরাসায় কর্মরত আছে।
৩৯. মামুনুর রশিদ
ঢাকার গোরানে বাড়ি ছিল। বেশ সদালাপী মানুষ ছিল। রোজ সকালে মিষ্টি পেটিস দিয়ে নাস্তা করত। ফলে মিষ্টি পেটিস নামে পরিচিত হয়ে উঠে। এর পর আর দেখা নেই।
৪০. মিরাজ
শহরে এসেও গেয়ো ভাব ধরে রাখত। গ্রামীণ কালচার ব্যবহারে সামান্য দ্বিধা করত না। মিশুক প্রকৃতির মানুষ ছিল। বহু বছর যাবৎ দেখা নেই।
৪১. আব্দুল মতীন
সভ্য শান্ত নিরীহ প্রকৃতির মানুষ ছিল। আমরা এক সাথে দাওর (পারস্পারিক কুরআন মুখস্থ শ্রবণ) করতাম। শুনেছি, ছাত্র জীবন থেকে বাণিজ্য করে এখন ঢাকা শহরে গাড়ি বাড়ির মালিক। বহু দিন হয় দেখা নেই।
৪২. সাইফুল ইসলাম
অতি চঞ্চল স্বভাবের মানুষ ছিল। কারো সাথে খুনসুটি বাধাতে দ্বিধা করত না। এরপর আর দেখা নেই।
৪৩. মহিউদ্দীন
আমার সাথের আসনে বসত। বেশ সদালাপী মানুষ ছিল। সবাই বিহারী বলে ডাকত। আসলে বিহারী ছিল কি না জানতে পারি নি। বহুকাল ধরে দেখা নেই।
৪৪. আরিফুর রহমান
ফর্সা সুন্দর লাল চেহারার মানুষ। শুনেছি, পরে মেখল মাদরাসায় লেখা পড়া করেছিল। এখন পাবনার এক নাম করা মাদরাসার মুহাদ্দিস এবং মাসিক সিদ্দিকী পয়গামের সম্পাদক। বহুকাল ধরে দেখা নেই।
৪৫. আব্দুল কাইউম
ফর্সা সুন্দর মেধাবী ছাত্র। ঢালকা নগর থেকে গ্রাজুয়েট হয়ে মারকাযুদ্দওয়া হতে ইফতা করে এখন আমীন বাজার মাদরাসার নবীন মুহাদ্দিস। সাথে মীরপুর বড় সড় একটি মসজিদের খতীবও বটে।
৪৬. মুহাম্মদুল্লাহ
রাহামানিয়া যুগের নাম করা আর্ট শিল্পী আব্দুল্লাহ আল ফিরোজের ছোট ভাই। বেশ মেধাবী ছাত্র। আমার সাথে বেশ ঘনিষ্টতা ছিল। এখনো মাঝে মধ্যে দেখা হয়। ভাল মন্দ কথা হয়। নিজেদের এলাকায় দু’ ভাই মিলে একটি মাদরাসা করেছে। এখন ওখানেই আছে।
৪৭. ফরিদ
নম্র ভদ্র স্বাস্থবান ছেলে। রাহমানিয়া ভবন থেকে গ্রাজুয়েট হয়ে এখন নিজেদের মাদরাসায় কর্মমুখী।
৪৮. বশির
ফরিদের ছোট ভাই বশির। রুগ্ন শুকনো টনটনে দেহের অধিকারী। স্বাস্থ্যে দু ভাইকে মেলানো দায় ছিল। পরে দেখেছি স্বাস্থ্যে বড় ভাইকেও টেক্কা দিয়েছে। চমৎকার সুন্দর হাতের লেখা ছিল। এখন গাজীপুরে এক হিফজ বিভাগে কর্মরত।
৪৯.৫০. ইবরাহীম ইসমাইল
মহা মসিবতের দুই ভাই। যত দিন ছিল যময দুটি ভাইকে আমি চিহ্নিত করতে পারি নি। বিড়ম্বনার ভয়ে কাউকে আমি নাম ধরে ডাকতাম না। এক চেহারার দুটি ভাই বেশি দিন থাকে নি। শুনেছি মাদরাসা থেকে কলেজে গিয়ে পাড়ি জমিয়ে ছিল। এরপর আর দেখা নেই।
৫১. ইমরান হুসাইন
পরে এসে আমাদের সাথে যুক্ত হয়। ভাল মেধাবী ছেলে। শুনেছি হাটহাজারী থেকে গ্রাজুয়েট হয়ে জাগতিক বৈচিত্র্যে হারিয়ে গিয়েছিল। এখন এক বৎসরের জন্য তাবলীগে আছে। বহু কাল ধরে দেখা নেই।
৫২. মামুন বসিলা
এখন উসমান গণী মামুন। এলাকার ছেলে। শেষ অবধি এক সাথেই ছিলাম। বেশ মিশুক মানুষ। এখন মাদরাসা ও বাণিজ্য নিয়ে খুব ব্যস্ত।
৫৩. নিজামুদ্দীন
দম ফাটানো হাসিতে বেশ পটু ছিল। এক টুকরো হাসি সদা মুখে লেগেই থাকত। শেষের দিকে এসে দল ছুট হয়ে যায়। এখন বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত দিন কাটাচ্ছে।
৫৪. আবুল কালাম
উজ্জ্বল কালো বর্ণের একজন মানুষ। ঘুমের সময় আমার পাশেই ঘুমাত। এপথে বেশি দিন টেকে নি। এরপর আর দেখা নেই।
৫৫. আহমদ হুসাইন
সদা হাস্য চেহারার মানুষ। কন্ঠ ও ছিল বেশ সুললিত। অনেক বছর এক সাথেই ছিলাম। শেষ দিকে এসে মাথায় কিছুটা উন্মাদনা ভর করে। মাঝে মধ্যে দেখা হয়।
৫৬. আমিমুল ইহসান
তুখোড় মেধাবী ছেলে ছিল। কিন্তু লেখা পড়ায় মন ছিল না। আমার হাতের লেখার প্রথম গুরু। যাদুকরি হাতের লেখা ছিল। এখন ভার্সিটির ডাকসাইটে ছাত্র।
৫৭. আবু সাঈদ
সুদূর সীমান্তের এলাকা মানুষ। বেশ সভ্য শান্ত এবং ভদ্র মানুষ ছিল। দুরারোগ্য পীড়ায় পড়ে দল ছুট হয়ে যায় অনেক আগেই। এর পর আর দেখা নেই।
৫৮. মুঈনুদ্দীন
নামটা কি মূলত মুঈনুদ্দীন কি না এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি নি। ছেলেটার সাথে বেশ সখ্যতা ছিল। বেশ ভদ্র ছেলে। এর পর আর দেখা নেই।
৫৯. যুবায়ের মাহমুদ
আমার সাথে বেশ ঘনিষ্টতা ছিল। খাট সাট গোছের বেশ মিশুক প্রকৃতির মানুষ। শেষ অবধি এক সাথেই ছিলাম। এখন কুমিল্লার এক মাদরাসা মসজিদের মুহাদ্দিস খতীব।
৬০. জাকারিয়া মাহমুদ
মন খোলা এক উদার মনের মানুষ। সদা উচ্ছ্বল এ মানুষটি মাঝ পথে এসে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এখন ঢাকাতেই মাদরাসা মসজিদ নিয়ে বেশ ভালই আছে।
৬১. হুমায়ুন কবীর
শেষ পথে এসে দোস্ত নামেই বেশ পরিচিত হয়ে উঠে। সরল প্রকৃতির এমানুষটার সাথে শেষ অবধি এক সাথেই ছিলাম। এখন ঢাকায় একটি মাদরাসায় কর্মরত।
৬২. শহীদুল ইসলাম
সুন্দরবন এলাকার মানুষ। বেশ চটপটে প্রকৃতির ছিল। এখন নিজ এলাকায় মাদরাসা নিয়ে আছে।
৬৩. আতীকুর রহমান
হাসি খুশি চঞ্চল প্রকৃতির মানুষ। মাঝ বছরে মালিবাগ চলে যায়। ওখান থেকে গ্রাজুয়েট হয়ে এখন নরসিংদিতে কর্মমুখী।
৬৪.আমানুল্লাহ
মানুষটার বড় ভাই তখন দাওরা পড়ত। বেশ প্রাণোচ্ছল মানুষ ছিল। বহু কাল যাবৎ দেখা নেই।
৬৫. ফিরদাউস
দূরে দূরে থাকতাম। কথা বার্তা তেমন হত না। যতটুকু দেখেছি ভালই দেখেছি। পুরো বছর ছিল না। শেষ অবধি এ পথে ছিল কি না জানতে পারি নি।
৬৬. বাহাউদ্দীন
আমানুল্লাহর সাথে সাথে থাকত। ভাল ছেলে ছিল। এরপর আর দেখা হয় নি।
৬৭. মিসবাহ
একটু আলাদা প্রকৃতির মানুষ ছিল। রাহমানিয়া হতে জামিউল উলূমে পাড়ি জমিয়ে ছিল। এর পর আর দেখা নেই।
৬৮. সলিমুল্লাহ
আমার সাথে বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল। বেশ আড্ডা প্রিয় মানুষ ছিল। হাটহাজারি থেকে গ্রাজুয়েট হয়ে এখন কিরাত নিয়ে লেখা পড়া করছে।
৬৯. হিযবুল্লাহ
তুখোড় মেধাবী ছেলে। শরীরে ঝড় তুলে লেখা পড়া করত। কিন্তু আমাদের মাঝে বেশি দিন থাকে নি। কোথা থেকে লেখা পড়া শেষ করেছে জানতে পারি নি। এখন ঢাকায় একটি মাদরাসার পরিচালক।
৭০. মাহবুবুর রহমান
শেখ মুজিবের দেশের সৌখিন মানুষ। কিরাত, সঙ্গীত এবং বক্তৃতায় বেশ সিদ্ধহস্ত ছিল। রাহমানিয়া ডিভাইডের সাথে সাথে সেও ডিভাইড হয়ে যায়। এরপর থেকে আর দেখা সাক্ষাৎ নেই।
৭১. মাসুম বিল্লাহ
নম্র ভদ্র স্বভাবের স্বাস্থ্যবান মানুষ। রাহমানিয়া ডিভাইড অবধি এক সাথেই ছিল। হাটহাজারী থেকে গ্রাজুয়েট হয়। এখন মা’হাদের সহকারী দফতর সম্পাদক। বাণিজ্য নিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।
৭২. হাফিজ মানিকগঞ্জ
বাঁধা শরীরের এক শক্তিমান মানুষ। মাঝ বছরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এখন ঢাকাতেই আছে। আগে মাঝে মধ্যে দেখা হত। এখন হয় না।
৭৩. হাফিজ বাগেরহাট
দীর্ঘ দেহের এক সুন্দর মানুষ। প্রথমে রাহমানিয়াতেই হিফজ বিভাগে ছিল। এরপর শিবচর হয়ে এখন অন্য পথের আহ্বায়ক।
৭৪. হাফিজ মাদারীপুর
এলোমেলো মেধার এক অদ্ভুতুড়ে মানুষ। আলাদা স্বভাবের এক ভিন্ন ঘরানার ছেলে। বুড়িগঙ্গার কোন এক তীরে কর্মরত।
জুনিয়র গ্রুপ
৭৫. মনসুর আলী
এখন মনসূরুল হক। তুখোড় মেধাবী ছেলে। বেশ নম্র ভদ্র মিশুক মানুষ। শেষ পর্যন্ত এক সাথেই ছিলাম। মাঝে মধ্যে কথা হয়। দেখা হয়। ঢাকা শহরে মসজিদ মাদরাসা নিয়ে বেশ ভালই আছে।
৭৬.আসাদুল্লাহ
ভোলার মানুষ। বেশ চঞ্চল প্রকৃতির ছেলে। পুলিশ নিহতের ঘটনায় লাল দালান দেখারও সুযোগ পেয়েছে। এতে করে আমাদের থেকে এক বছর পিছিয়ে যায়। ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে এখন খুব ব্যস্ত। মটর সাইকেলে মাঝে মধ্যে দেখা হয়।
৭৭. আহমদ হিযবুল্লাহ
ভাল ছেলে ছিল। দেখা হলে হাসি মুখে সালাম হত। এরপর আর দেখা নেই।
৭৮. আব্দুল মাজেদ
অগ্নিঝরা এক কিশোর বক্তা। ছোট্ট একটু মানুষ; গলার রগ ফুলিয়ে চোখ মুখ রাঙ্গিয়ে বক্তৃতা করত। ছোট্ট আব্দুল মাজেদ এখন অনেক বড়। বহু বছর পর আচমকা একদিন দেখা হলে অবিকল একজন অপরিচিত মানুষ বলেই ভেবেছিলাম। এখন কোথায় আছে জানতে পারি নি।
৭৯. মুহিব্বুল্লাহ মাসনুন
শায়খ দৌহিত্র। সভ্য শান্ত মেধাবী ছেলে। রাহমানিয়া হতে গ্রাজুয়েট হয়ে এখন ঢাকায় এক মাদরাসায় কর্মরত।
৮০.সফিউল্লাহ
খিলখিলিয়ে হাসার মানুষ। অদ্ভুতুড়ে বাক্য ব্যবহারে বেশ পারঙ্গম। বেশ ভদ্র ছেলে। শেষ পর্যন্ত এক সাথেই ছিলাম। এখন ঢাকার এক মাদরাসার শিক্ষাসচিব। পাশে বলে মাঝে মধ্যে দেখা হয়।
৮১. মাহবুবে রব্বানী
এলাকার ছেলে। বাসা থেকে এসে গিয়ে লেখা পড়া করত। আশরাফুজ্জামান সাহেব হুযুরের সাথে খুব ঘনিষ্টতা ছিল। হুযুর খুব আদর করতেন। মাঝ পথে এসে উতাল হাওয়ায় হারিয়ে যায়। ওখান থেকে এক যুগ পরে আবার ফিরে আসে সুশীতল ছায়ায়। এখন বাবার বাণিজ্য নিয়ে বেশ ভাল আছে।
৮২. শরীফ
ছেলেটার বাড়ি চট্টগ্রামে ছিল। মধ্য বছরে বেরিয়ে যায়। যতটুকু দেখেছি ভালই দেখেছি। এরপর আর দেখা নেই।
৮৩. নাজমুল ইসলাম
বেশ সভ্য শান্ত নিরীহ প্রকৃতির ছিল। শেষের দিকে এসে ছাত্র নেতা বনে যায়। এখন কোথায় আছে কেমন আছে জানতে পারি নি।
৮৪. ইবরাহীম
আমাদের এলাকার ছেলে। রাহমানিয়াতে এক সাথে এসে ভর্তি হই। এর আগে দেশে বাড়ির কাছে এক মাদরাসাতেই পড়তাম। তখন আমার এক ক্লাস নিচে ছিল। আমি বরিশাল হয়ে আসায় ঢাকায় এসে এক সাথে হয়ে যাই। ইবরাহীমের মামা আমার প্রিয় উস্তাদ। এদিক ওদিক ঘুরে এসে শেষ মেষ রাহমানিয়া (ভবন) হতে গ্রাজুয়েট হয়। এরপর ব্যতিক্রম ধারার এক আহ্বানে চলে যায়। আহ্বানটা ব্যতিক্রম বলে আমার মতের সাথে সব দিক দিয়ে মিলে নি। বিতর্ক ও হয়েছে বেশ। উচ্চ বাচ্চও। تذببت قبل ان تحصرم এর মত মনে হয়েছে অনেকটা। তবে দেখা হলে হাসি মুখে সালাম মুসাফাহা করে। সমাচার জিজ্ঞেস করে। সব মানুষেরই কিছু ভাল গুণ থাকে। ওর একটা ভাল গুণ হল, ও কোন কিছু জিইয়ে রাখে না। কারো সাথে মন কষা কষি হলে বেশি দিন মনে রাখে না। এটা ওর ভাল গুণ। ভাল গুণের প্রশংসা তো করতেই হয়।
সব ক্ষেত্রেই অতিরঞ্জন ও বাড়া বাড়ি নিন্দনীয়। মতের ভিন্নতা হতে পারে। তাই বলে সেটাকে পুঁজি করে প্রান্তিকতার আশ্রয় নেয়া শোভনীয় নয়। কারো ভুল হলে সে ভুল শোধরানোর ও নববী পন্থা রয়েছে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সুন্নতের অনুসরণ আবশ্যক। বিষয়টা আমরা অনেকেই অনেক ক্ষেত্রেই ভুলে যাই।
৮৫.আবু যর
সুন্দর হস্তলিপির এক উজ্জ্বল তারকা। ঈর্ষা করার মত হাতের লেখা ছিল ওর। সভ্য শান্ত এক ভাবুক ছেলে। এখন সাগর পাড়ের দেশ চাটগায়ে বাসা পেতে বেশ সুখেই আছে। বহু দিন পর একবারের জন্য দেখা হয়েছিল। এরপর আর হয় নি।
৮৬. মুনীরুজ্জামান
আমার সাথে খুব আন্তরিকতা ছিল। তাকরার (পুনঃপাঠ) আমার সাথেই করত। ভবন থেকে বেরুবার সময় এক সাথেই ছিলাম। এক দু বছর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ঢাকার কলাবাগান ছিল ওদের বাসা। লালমাটিয়া হয়ে ফরিদাবাদ থেকে গ্রাজুয়েট হয়েছে। মাঝে একবারের জন্য দেখা করতে এসেছিল। মনে হয়েছিল খুব বদলে গেছে। যারা বদলে যায় তাদের থেকে আমি নিজেকে স্বেচ্ছায় গুটিয়ে নিই। এখন কোথায় আছে কেমন আছে জানি না।
৮৭.রাশেদ সালমান
ফর্সা চেহারার এক সুন্দর ছেলে। উত্তর বঙ্গের হলেও বেশ চঞ্চল ছিল। আগে মাঝে মধ্যে দেখা হত। এখন আর হয় না।
৮৮. মুহাম্মদুল্লাহ বরিশালী
শ্যাম বর্ণের দীর্ঘ কায়ার একজন মানুষ। বেশ নম্র ভদ্র ছিল। বেশি দিন এক সাথে ছিল না। টিনসেডে আমাদের সাথেই ছিল। এরপর আর দেখা নেই।
৮৯. হায়াতুল ইসলাম।
চঞ্চল প্রকৃতির একটি ছেলে। সবসময় ঠোটের কোণে এক ফোঁটা হাসি লেগেই থাকতো। গল্প করতো বেশ জমিয়ে। বিচ্ছন্ন হবার পর আর দেখা নেই। কোথায় আছে কেমন আছে- কিছুই জানি না।
৯০. শফীকুল ইসলাম (বাগেরহাট)।
বেশ ভদ্র ছেলে। প্রচণ্ড মিশুক প্রকৃতির। শফীক বাগেরহাট নামে পরিচিত ছিল। শেষ পরীক্ষা শেস হবার আগেই সরে পড়ে। এই বিচ্ছিন্নতায় আমাদের থেকে এক বছর পিছিয়ে যায়। এখন কওমী শেষ করে আলিয়ামুখী। ঢাকাতে একটি মাদরাসার শিক্ষাসচিব। মাঝে মধ্যে দেখা হয়।
জানি না, আমার শৈশবের পাঠের সাথীরা সবাই বেঁচে আছে কিনা। কতজনকে কত কাল হয় দেখি নি! এ পৃথিবীটা তো একটি খেয়াঘাট। এখানে কত মানুষ আসে যায় তার হিসেব কে রাখে! ২০.০৩.’০৯ শুক্রবারের কথা। ভোরে নামায পড়ে বেরুলাম। করিডোরে মামুন ভাইয়ের সাথে দেখা। আমার হাঁটার গতি থামালেন। বুঝলাম গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা বলবেন। কিন্তু সে গুরুত্বটা যে আমাদের পরিচিত কারো চলে যাওয়া হবে ভাবি নি। মামুন ভাই আমাকে চমকে দিয়ে বললেন, ফয়সাল ইন্তেকাল করেছে। নিমিষেই চোখ দুটো কপালে উঠে গেল আমার। ফয়সাল মারা গেছে! একি বলেন!! দুঃখ বিস্ময়ে অনেকটা বেসামালের মত হলাম। গত পরশু মোটর সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে ছিল ফয়সাল। পথে কচি গোবৎসের জীবন বাঁচাতে গিয়ে নিজেকে সঁপে দিতে হল মৃত্যুর কোলে। মৃত্যুর পেয়ালা হাতে চলে গেল ফয়সাল। আর আসবে না ফিরে কোনো দিন। পৃথিবীটা এমনি। এখান থেকে কেউ চলে গেলে আর ফিরে আসে না। আমিও হয়তো একদিন চলে যাবো ফয়সালের মত। ছোট্ট এ পৃথিবীতে কিছু মানুষ থাকে। যারা মানুষকে আনন্দ দেয়; কষ্ট দেয় না। ফুল হয়ে বেঁচে থাকে কাটা হয়ে ব্যথা দেয় না। ফয়সাল তেমনি একটি সুরভিত ফুল ছিল। সেদিনের কথা। টুঙ্গির মাঠে লাখো মানুষের মাঝে সেও ছিল আমাদের সাথে একান্ত পাশে। হাসলো হাসালো। সেদিন তো বলে নি আমি চলে যাবো। তোমরা ভাল থেকো। এটাই কি পৃথিবী? আজকে আছি কালকে নেই?? ফয়সাল! আমরা দুঃখ পেলাম তুমি চলে গেছ বলে। দু’ হাত তুলে দুআ করি আল্লাহ যেন তোমাকে সুন্দর জায়গাটিতে রাখেন। তুমি সুখে থেকো। একদিন আমরাও আসবো তোমার কাছে।
ফয়সাল আমদের সাথে দু’ তিন বছর ছিল। কাফিয়া শরহেজামি সম্ভবত শরহে বেকায়াও। বড় মিশুক মানুষ ছিল। মানুষকে আনন্দ দেয়ার অসামান্য দক্ষতা ফয়সালের ছিল। মনটা বড় উদার ও পরস্কিার ছিল। কওমী থেকে ভার্সিটিতে পাড়ি জমিয়ে ছিল। কিন্তু ছায়া কায়া সবই ছিল আগের মত। মাঝে মাঝেই ভার্সিটি থেকে ছুটে আসতো আমাদে সাথে সাক্ষাতের জন্য। আল্লাহ! তুমি ফয়সালের সাথে মার্জনার আচরণ করো। তাকে জান্নাতের সুন্দর বাগিচায় জায়গা করে দিয়ো।
সুহৃদ বিশারতুল্লাহ এ পথে থেকেও ওপথের ডাকসাইটে কর্মকর্তা। ইন্টারনেট জগতের এক মহা কিংবদন্তি। সারাক্ষণ বাটন টিপে সময় পার করে। মানুষটা আমাদের মত নেই। দ্বিখন্ডিত হয়েছে অনেক আগেই। কোথাও গেলে হৃদয়ে টান লাগে। হৃদয়ের গহীনে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হয়। অর্ধাঙ্গ রেখে আমাদের সতীর্থ হচ্ছেন এটা তার জন্য অনেক বড় আত্মত্যাগ।
আমাদের সাদা ধবধবে মাইক্রোটি চাকা ঘুরিয়ে আজিমপুরের দোর গোড়ায় এসে গেছে। সুহৃদ হাবীব মুঠোফোনে বিশারতুল্লাহকে দাঁড়াবার জায়গা বলে দিচ্ছে। ‘আপনি ইডেন কলেজ ঘেষা ফুটপাতটিতে দাঁড়ান। আমরা আপনাকে নিয়ে যাবো।’ ইতিমধ্যে আমরা ইডেন কলেজের কাছে চলে আসি। কলেজ ঘেষা পথের ধারে লম্বা লম্বা বাসগুলো সারে সারে দাঁড়িয়ে আছে। যেন ভোর বিহানে কোন দাবি আদায়ের মিছিলে নেমেছে। সাকালে কোন কাজ নেই। তাই এ ফাঁকে দাবিটুকু আদায় করে নেয়া যায় কি না!
কিন্তু সারি বাধা বাসের ফাঁক ফোকড়ে সাদা টুপি পরা কাউকে দেখা যাচ্ছে না। রাস্তার অপজিটেও সবাই চোখ রাখছি। ওখানে দুএকজন পথচারি ছাড়া সাদা কিছু নেই। মাইক্রোটি পথ চেয়ে চেয়ে চার রাস্তার মোহনায় পৌঁছে যায়। সমুখে না এগিয়ে উপায় নেই। কারণ দাঁড়াবার মত যুৎসই জায়গা আশেপাশে নেই। গাড়িটা পূর্ব দিকে মোড় নিয়ে খানিকটা দাঁড়াল। এখানেও ভয়ের শেষ নেই। এদিক ওদিক পুলিশ বন্ধুরা হাঁটা হাঁটি করছে। আমাদের দুএকজন নেমে পড়ে বিশারতুল্লাহর খোঁজে। দুতিন মিনিট না যেতেই কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে মুখে হাসি ছড়িয়ে দৌড়ে এসে গাড়িতে চড়ে বিশারতুল্লাহ। আমরা মুখে হাসির ফোয়ারা ছড়িয়ে বিশারতুল্লাহকে বরণ করে নিই।
ইট ইমারতের ভিতরে আটকে থাকা মানুষগুলো রাস্তায় নেমে পড়েছে। নীরব শহর মুখরিত হয়ে উঠছে। শহুরে মানুষগুলোর হাত পাগুলো নড়ে চড়ে উঠছে আপন আপন কাজে। নাগরিক জীবন আবার জীবন্ত রূপে ফিরে এসেছে। একদু টুকরো উষার আলো আমাদের গাড়ির গাঢ় কাচ ভেদ করে আমাদের গায়ে এসে পড়ছে।
গাড়ির চাকা আবার সচল হয়। ভার্সিটি ক্যাম্পাস ঘেষে কাটা বন হয়ে এগিয়ে যাই মতিঝিলের দিকে। মতিঝিলে মতি নেই। আছে ইয়া বড় এক সাদা শাপলা। শাপলার পাপড়ি ঘেষে প্যাপু শব্দ করা চেলা পুটিগুলো ছুটাছুটি করে সারাক্ষণ। এ শাপলা চত্তর থেকে আমাদের সাথে যোগ হবে আরো দুজন ভ্রমণ পিয়াসী।
দুটি হৃদয়ের সংযোজন
আমাদের গাড়িটি শাপলা ফুলের পাশে এসে দাঁড়াতেই চোখে পড়ে, খানিকটা দূরে সাদা আবরণের দুজন মানুষ রিক্সা থেকে নামছে। গাড়িটি এলোমেলো অনেকগুলো রাস্তার মোহনা পেরিয়ে অপজিটে গিয়ে পার্ক করে। রিক্সা থেকে নামা সাদা মানুষ দুটি আমাদের গাড়িতে এসে চড়ে বসে। এদুটি চেহারা এর আগে আমি দেখি নি। দুজনই দারুর রাশাদে লেখা পড়া করে। সুহৃদ হাবীবের দূর কিংবা কাছের রক্তীয়। আমাদের সরাসরি না হলেও সুহৃদ হাবীব সূত্রে কিছু একটা হবে। তবু নতুন অনতুন, চেনা অচেনাদের মাঝে যে একটা প্রচ্ছন্নতা তৈরি হয় সেটা লেগেই ছিল সারাটা পথ আমাদের এবং দুজনের সাথে। দুজনের একজন চালক বন্ধুর অপজিটে গিয়ে বসে। যেন সাইড ড্রাইভার। আরেকজন পিছনে গিয়ে সুহৃদ হাবীবের সঙ্গ দেয়। পেছনে আরো দুটো আসন শূন্য পড়ে আছে। কয়েকটি কালো ব্যাগ ওই আসন দুটো পূরণ করে বসে। চালক বন্ধু গাড়ি সচকিত করে। গাড়ি ছুটে চলছে।
একটি ক্ষুদে বিড়ম্বনা
যাত্রাবাড়ির কাছে এসে গাড়িটি আচমকা থেমে যায়। কারণ আমি আমরা কেউ জানি না। জানেন ব্রেকে চাপ দিয়েছেন যিনি শুধুই তিনি। ভাবলাম, হয়তো কিছু একটা হয়েছে। না। ভাবনা ভুল হলো। কিছুই হয় নি। ড্রাইভার দিব্বি বসে আছে। মুঠো ফোনে কথা বলছে। আর জানালার ফাঁক গলিয়ে কালো মাথাটা বের করে বারবার পেছনে তাকাচ্ছে। কে আসছে কেন আসছে? কিছুই জানি না। আমরা ফিসফাস করি। এক আধটু বিরক্ত হই। চালক বলেন, এইতো এসে পড়েছে। কিন্তু ‘এইতো’ এর সীমানা বেড়ে চলে। সহজে শেষ হয় না। আমাদের বিড়ম্বনা বেড়ে যায়। যাত্রা পথে গাড়ি থামিয়ে এভাবে অকারণে বসে থাকতে বড় কষ্ট লাগে। আমাদের হাতে সময় সীমিত। পাঁচ মিনিটেরও অনেক মূল্য। এ পাঁচ মিনিট আমরা স্পটে কাটাব। লাভ হবে। সময়ের কদর এখন খুব উপলব্ধ হচ্ছে। অন্য সময় যদিও এতটা অনুভূত হয় না। তবে পরীক্ষার ব্যপারটা আলাদা। এ সময় সময়ের কদর হুহু করে বেড়ে যায়। যেন হিসু করার ও সময় নেই। এত দামের এ সময়গুলোর একটি নয় দুটি নয় পাকা দশ থেকে পনেরটি মিনিট ড্রাইভার সাহেব আস্ত মুখে পুরে খায়। তার একটাই জবাব, এতটুকু সময়ে কি হয়? আমাদের তো গা জ্বলে যাচ্ছে। ক্ষোভে হাত নিশপিশ করছে।
পনের মিনিট পর আলাদা রকমের একটা মানষ দৌড়ে আসে। এবং গাড়িতে চড়ে একেবারে চালক বন্ধুর গা ঘেষে গিয়ে বসে। অবয়ব আবরণে আমাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। চালক বন্ধুর সাথেও তেমন মিল নেই। আমাদের সাথে খানিকটা সাজুয্য রক্ষার্থে মাথায় একটা ঘন ফুটো সাদা কাপড় এঁটে নেয়। বুঝতে বেগ পেতে হল না মানুষটা আমাদের সাথ যাবে। চালক বন্ধু খুলে কিছু বলেন নি। এখনও বলছেন না। ব্যপারটি আমাদের কাছে ভাল ঠেকছে না। আমাদের মাঝে ফিসফাস এবং কানাকানি হচ্ছে। চালক বন্ধু শুনেও শুনে না। বুঝেও বুঝে না।
নতুন এ মানুষটা চালকের ভাগ্নে। ভেবেছিলাম, রক্তীয় এবং সহোদরার পেটের ছেলে হবে। পরে বুঝেছি, কাছের নয় দূরের- অনেক দূরের। ভাগ্নের- দূরের হলেও সে ভাগ্নে- বসার মত কিছু নেই। সামনে দুপাশে দুটো আসন। মাঝে একটুখানি খালি জায়গা। এখানে কেউ বসে না। মামা ও খালি জায়গাটুকুতে এক গুচ্ছ ময়লা কাপড় গুঁজে দেয়। কৃত্রিম নরম একটা বসার জায়গা বনে যায়। ভাগ্নে এখানে হাসি হাসি মুখ করে যুত করে বসে পড়ে। হাসিটা ছিল মামার প্রতি কৃতজ্ঞতার হাসি। দূরের হয়েও এ দূর যাত্রায় মামা ভাগ্নেকে এক দণ্ড ভুলতে পারে নি।
ভাগ্নের বসন পর্ব শেষ হলে মামা গাড়ি ছুটান। আমাদের মুখ ভার করা চেহারাগুলো মামা একটুও চেয়ে দেখলেন না। নাটকের এ অভিনয়টা যে আমাদের ভাল লাগে নি মামা বুঝেও বুঝলেন না। সব জায়গায় সব কিছু বুঝতে নেই-ইচ্ছে করেই- এটা মামা ভাল বুঝেন।
আসলে মামাটা ভাল মানুষ। ওপথ থেকে এপথে এসেছে। চেহারা শরীর বদলিয়েছে। এটা অনেক বড় কিছু। মানুষ হিসেবে এক আধটু কিছু থাকতেই পারে। যেমন আমরাও মুক্ত নই ছিটে ফোঁটা মানবীয় দোষ গুণ হতে। তবে মামাটা বেশ চটপটে। বেশ ডান পিঠে। বেশ রসিক এবং মিশুক। এসব আমাদের ভাল লেগেছে।
মুঠোয় মুঠোয় সময় পেরুচ্ছে। ঢাকার বাড়ি গাড়ি সব পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে চলছি সমুখ পানে।
বিষম বিরক্ত করা সে জ্যাম নামের যমের আয়োজন এখনো শুরু হয় নি। ওজিনিসটা তৈরি হবার আগেই এ মানুষ গাড়ি প্রাসাদ ভরা দুঃসহ্য ঢাকার উদর থেকে বেরুতে চাই।
গাড়িটা তুলনামূলক লম্বাটে। তাই ভিতরে বসে বুঝার উপায় নেই ওর চলার গতি। যেন খুব ধীর গতিতে কেঁচোর মত এগুচ্ছে। রাস্তার দুধারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো ঠিকই উপলব্ধি করছে কচ্ছপ নয় কান খাড়া করা বুনো খরগোসই ছুটে চলছে ঐদূর অজানায়। গিজ গিজ করা মানুষ আর এক গাদা দালান কোঠা ভরা ঢাকা নামের এ জিনিসটার পেট থেকে সুদীর্ঘ নাড়ি বেয়ে বেরুতে পারলেই আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।
বিদায় ঢাকা
পৃথিবী ঘুরছে। ঘুরছে আমাদের গাড়ির চাকা। ঘুরছে, ঘুরছে এবং ঘুরছে। কোনো বিরাম নেই। ক’বার ঘুরল। ক’বার পাঁক খেল। হাতে বুড়ো বেটে আঙ্গুলটাকে সচকিত করে এক দু কড় করে গুণি। ঝুলে থাকা লাল ব্রিজটার কাছে যেতে ক’বার পাঁক খাবে এ চাকাগুলো। ১ এর পেছনে ছোট ছোট ডিম্ব বসাতে শুরু করি। পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে গায়ে গায়ে লেগে থাকা মিম্বগুলোতে যদি ছোট্ট বাংলাদেশটা ভরে যায়। তবে কি ফলটা বেরিয়ে আসবে? হিসেবটা মিলে যাবে? নাকি বাংলার সীমানা পেরুতে হবে। বিজ্ঞানের বিস্ময় সময়ের খুব প্রয়োজনীয় জিনিসটাও হয়তো পা পিছলে যাবে এখানে এসে। জটিল একটা অংকের উপর চড়ে আমরা এগিয়ে চলছি।
ভোরে এক ঢোক পানি পান করারও সুযোগ হয় নি। ক্ষিধেয় পেট চো চো করছে। শুধু আমার নয়; তলহার ভাগ্নের মামার আতাউল্লাহর মাহমুদের -এমানুষটার অবশ্য ওতে কিছু হয় না। দিব্যি যন্ত্র মানব।- সফিউল্লাহর শুআইবের মাহবুবের মামুনের বিশারাতুল্লাহর (?)- না, এমানুষটাকে ভোর বিহানে কিছু খাইয়ে দিয়েছে...।- সুহৃদ হাবীবের এবং সবার। বাশ বাগানের মাথার উপরে যে লাল সূর্যটা হাসি হাসি করছে; আমাদের মনে হচ্ছে ওটা আস্ত একটা ঝলসানো পরোটা। হাত বাড়িয়ে ছিড়ে খেতে খুব ইচ্ছে করছে।
শুআইবের চোখের ক্ষুধার সামনে অবশ্য পেটের ক্ষুধা অসহায়। শুআইবের চোখে লাল সূর্যটা ঝলসানো এক গোল বালিশ। আমার পানির তেষ্টা পেয়েছে সে ভোর থেকে। বেলা বেড়ে তার সাথে যোগ হয়েছে জঠর জ্বালা। দুটোয় মিলে আমি এখন আমি ক্ষুৎপিপাসায় কাতর। তবে এক্ষুৎপিপাসা তেমন যুত করতে পারছে না। কারণ সুখ আনন্দে তো আমাদের দেহ মন ভরপুর। দূর যাত্রায় এ আনন্দ খেয়ে খেয়ে ক্ষুধার জ্বালা মিটাচ্ছি। তবে মাঝে মধ্যে ক্ষুধায় ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠছে।
এতক্ষণে আমরা বাস ট্রাকের প্যা-পু আর কলকারখানার ঘ্যানর ঘ্যানর করা শব্দে মুখরিত ঢাকা থেকে বেরিয়ে পড়েছি। নিঝুম নিস্তব্ধ সুন্দর প্রকৃতি। গ্রামীণ সবুজ আবহ আহা কতই না মনোরম। দিগন্ত জোড়া সবুজ মাঠ। সারি সারি ঘর বাঁধা ছোট ছোট গ্রাম। বাশবাগানের মাথার উপর দিয়ে জেগে উঠেছে সোনালী রবি। গাছ গাছালির ফাঁক গলিয়ে আমাদের চোখে মুখে গালে ঠোটে গায়ে বুকে ঠিকরে পড়ছে কাঁচা কাঁচা রোদ মাখা ভোরের আলো। কিষানেরা এক দুজন করে কাস্তে হাতে নেমে পড়ছে সবুজ মাঠে। আঁকা বাঁকা পথ বেয়ে শিশিরে ভেজা নরম ঘাস মাড়িয়ে রাখালেরা ছুটে চলছে গরু হাঁকিয়ে। খালে পুকুরে গায়ের কিশোরীরা নেমে পড়েছে কলসি কাঁখে। খর কুটোর বাসা ছেড়ে পাখিরা বেরিয়ে এসেছে দিনের আলোয়। ডানা মেলে এগাছ ওগাছ করছে বিষম আনন্দে। ছোট ছোট ছেলে মেয়রা কায়দা হাতে ছুটে চলছে মক্তব মাদরাসায়। মর্নিং স্কুলের কিশোর কিশোরীরা গায়ে এক রঙ্গা পোষাক ঝুলিয়ে হেঁটে চলছে পাঠশালায়।
(চলবে)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.