নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

তুমি একটা খারাপ কাজ করেছো তার মানে তুমি একজন মানুষ; তুমি সেই খারাপ কাজটার জন্য অনুতপ্ত হয়েছো তার মানে তুমি একজন ভাল মানুষ। \n\nwww.facebook.com/bandar.khola

হাফিজ রাহমান

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম আদালত হলো মানুষের বিবেক।

হাফিজ রাহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

সীমাবদ্ধতার ঘেরাটোপে দাওয়াত ও তাবলীগ

২৯ শে মার্চ, ২০১৮ সকাল ৮:৪১

সূচনা কথা

দাওয়াত ও তাবলীগ। অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি পালনীয় বিষয়। দীনের প্রতিটি শাখার সাথে এর আবশ্যিক সম্পৃক্তি আবশ্যিকরূপেই বিরাজমান। যখন তখন যে কোনো উপায়ে দীনের যে কোনো কথাকে মানুষের নিকট পৌঁছে দেয়া হলেই দাওয়াত ও তাবলীগের গুরু দায়িত্বটা পালিত হবে। কাজটা অতি ব্যাপক ও বিস্তীর্ণ। এর সুনির্দিষ্ট কোনো সীমা রেখা বা পথ পদ্ধতি নেই। এ কাজে শরীয়ত সমর্থিত যে কোনো পন্থাই গৃহীত হতে পারে। কেউ কাওকে কুরআন শেখালো। সে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করলো। মাহফিলের প্যাণ্ডেলে বক্তা দীনের কথা শোনালো। সে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করলো। কিন্তু অতীব আক্ষেপের কথা, দাওয়াত ও তাবলীগের এ বিস্তৃতি ও ব্যপ্তির কথাগুলো আজ হাস্যকর বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সুনির্দিষ্ট একটি পদ্ধতির মাঝে দাওয়াত ও তাবলীগের অসীম প্রক্রিয়াগুলো সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। দীনের প্রচারে জীবন উৎসর্গকারী ব্যক্তিকেও প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে, সে দাওয়াতের কাজে সময় দেয় কি না ? সংকোচন ও সীমাবদ্ধতার এ ক্রমধারার পথ ধরেই দীনে ইসলামে বিপথগমিতা ও বিভ্রান্তির বীজ বপিত হয়। এক সময় ফুলে ফেঁপে একটি সুস্পষ্ট ভ্রান্ত দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। দাওয়াত ও তাবলীগ বললে আজ একটি গ্রুপ নেম ও সুনির্দিষ্ট একটি প্লাটফর্ম দৃশ্যমান হয়ে উঠে। দাওয়াত ও তাবলীগ মানে সুনির্দিষ্ট সে গ্রুপ ও প্লাটফর্মের কার্যক্রম। এ ছাড়া অন্য কোনো কার্যক্রম দাওয়াত ও তাবলীগ হতে পারে না। দীন প্রচারের অন্য কোনো কাজকে দাওয়াত ও তাবলীগ বলা আজ মহা অন্যায়। এখনকার নির্মম বাস্তবতা হলো, এখন যদি হকপন্থী কেউ শরীয়ত সমর্থিত আরো বেশি ফলপ্রসূ, উপকারী ও উপযোগী পন্থায় দীন প্রচারের কাজে অবতীর্ণ হন তাহলে প্রচলিত দাওয়াত ও তাবলীগের নিবেদিতপ্রাণ মানুষগুলো সে দীনী কার্যক্রমকে মেনে নিতে পারবে না। তাদেরকে হয়তো কোনো মসজিদে উঠতে দেয়া হবে না। অথচ শরীয়াগত দিক থেকে মুসলিম উম্মাহ বিভিন্ন পদ্ধতিতে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করার অধিকার রাখে। দাওয়াত ও তাবলীগ তো কোনো ব্যক্তি বা পদ্ধতির নাম নয়। তিক্ত হলেও সত্য, বর্তমানে দাওয়াত ও তাবলীগ নামটি রেজিষ্ট্রেশনকৃত ট্রেডমার্ক বা ব্যবসায়ী লোগোর রূপ ধারণ করেছে। যেন এটি নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তি বা নির্দিষ্ট একটি গ্রুপের পৈতৃক সম্পদ। এ সম্পদ অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারবে না। অনাকাক্সিক্ষ এ সঙ্কোচন ও সীমাবদ্ধতা ঈমানের জন্য ক্ষতিকর বৈ কিছুই নয়। দাওয়াত ও তাবলীগের এ সীমাবদ্ধতা ও সঙ্কোচনের ব্যাপারটি এতটাই পরিপক্বতা অর্জন করেছে যে, এখন এ সঙ্কোচনকে সম্প্রসারণ করাটা একটি রক্তাক্ত অপারেশন বলে গণ্য হবে। আল্লাহ আমাদেরকে সর্বক্ষেত্রে মধ্যপন্থা গ্রহণের তাওফীক দান করুন।

দাওয়াত শব্দের আভিধানিক সংজ্ঞা

দাওয়াত শব্দটি একটি ক্রিয়া বিশেষ্য। এর আভিধানিক অর্থ আহবান, আমন্ত্রণ।

দাওয়াত শব্দের পারিভাষিক সংজ্ঞা

অল্পকথায় পারিভাষিক সংজ্ঞায় ইসলাম ও রিসালাতের প্রচার প্রসারের কার্যক্রমকেই দাওয়াত বলা হয় । গুরুত্ব বিবেচনায় এখানে দাওয়াতের আরো কিছু পারিভাষিক সংজ্ঞা প্রদত্ত হলো।
১। আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন, তাঁর রাসূলগণ যেসব বিষয়ে উম্মাহকে অবহিত করেছেন সেসব বিষয়ে তাঁদেরকে সত্য জ্ঞান করে এবং তাঁরা যেসব বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন সেসব বিষয়ে আনুগত্য প্রকাশ করে তদআনীত বিষয়াদির প্রতি মানুষকে আহবান করাই হলো দাওয়াত। আর এ বিষয়টি আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষ্য ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রাসূল হওয়ার সাক্ষ্য, নামাজ কায়েম, যাকাত প্রদান, রমাযানের রোযা ও বাইতুল্লাহর হজে¦র প্রতি আহবানকে এবং আল্লাহ, ফেরেশতা, অবতীর্ণ কিতাব, নবী রাসূল, মৃত্যুর পরবর্তী সময়ে পুনরুত্থান, ভাল মন্দের ভাগ্যে বিশ^াস স্থাপন সর্বোপরি প্রতিপালকের ইবাদতে এমনভাবে রত হওয়ার আহবানকেও ব্যপৃত করে যেন সে তার প্রভুকে দেখতে পাচ্ছে। মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া ১৫/১৫৭
২। মানুষের নিকট দীনে ইসলামকে পৌঁছে দেয়া, তাদেরকে দীন শিক্ষা দেয়া এবং বাস্তব জীবনে তা অনুশীলন করতে উদ্বুদ্ধ করাই হলো দাওয়াত। মুহাম্মদ আলবায়ানুনী, আলমাদখাল ইলা ইলমিদ দাওয়াহ ১৭
৩। ভাল কর্ম করা, মন্দ কর্ম পরিহার করা, সৎ কাজের আদেশ করা, অসৎ কাজ থেকে নিবৃত্ত রাখা, মহৎ কাজকে প্রিয় করে তোলা, অন্যায় অনাচার থেকে নিবৃত্ত থাকা এবং সত্যের অনুসরণ ও মিথ্যার অপনোদনের ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করাকেই দাওয়াত বলা হয়। মুহাম্মদ নামির আলখাতীব, মুরশিদুদ দুআত ২৪
৪। আল্লাহর একত্ববাদ, দু সাক্ষ্যের স্বীকৃতি প্রদান এবং কথা ও কাজে আল্লাহর নীতি বিধানকে পৃথিবীতে বাস্তবায়িত করার প্রতি আহবানই হলো দাওয়াত। তাওফীক আলওয়ায়ী, আদদাওয়াহ ইলাল্লাহ-আররিসালাহ আলওয়াসীলাহ আলহাদাফ ১৯
৫। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহকে কথা কাজে ও আচরণে অনুকরণ ও তাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করার উদ্দেশে সর্বকালে ও সর্বস্তরে যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ কর্তৃক সকল মানুষকে আহবান করাই হলো দাওয়াত। মুহাম্মদ ইবনে সাইয়িদী ইবনে হাবীব, আদদাওয়াহ ইলাল্লাহ ফি সূরাতি ইবরাহীম আলখালীল ২৭
৬। স্থান কাল পাত্র ভেদে বিভিন্ন পদ্ধতি ও বিভিন্ন উপায় গ্রহণের মাধ্যমে সর্বসময়ে সর্বক্ষেত্রে মানুষের নিকট ইসলামের আবেদন ও আহবান পৌঁছে দেয়াকেই দাওয়াত বলা হয়। আলী সালিহ আলমুরশিদ, মুসতালযামাতুদ দাওয়াহ ফিল আসরিল হাযির ২১
৭। দাওয়াত এমন একটি বিষয় যাতে উপযুক্ত কিছু রূপরেখা অনুসন্ধান করা হয় যার মাধ্যমে অন্যদেরকে ইসলামের প্রতি আগ্রহী করে তোলা যায় এবং তাদের দীনী অবস্থানকে সুরক্ষা দেয়া যায়। আব্দুল্লাহ ইউসুফ আশশাযলী, আদদাওয়াহ ওয়াল ইনসান ৩৯
৮। মানুষকে পথচ্যুতি ও অনাচার থেকে থেকে মুক্ত করা এবং যেসব ক্ষতি ও অকল্যাণে প্রবৃত্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে সেসব ক্ষতি ও অকল্যাণের ব্যাপারে মানুষকে ভীতসন্ত্রস্ত করাই হলো দাওয়াত। মুহাম্মদ আলখাযির হুসাইন, আদদাওয়াহ ইলাল ইসলাহ ১৭
৯। দাওয়াত হলো একটি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির পুনর্জীবন দান প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে উম্মাহ এক পরিবেশ থেকে অন্য পরিবেশে স্থানান্তরিত হতে পারে। রউফ শালবী, আদদাওয়াতুল ইসলামিয়া ফি আহদিহাল মাক্কী মানাহিজুহা ওয়া গাইয়াতুহা ৩২
১০। মানুষের শ্রেণীভাগ বিবেচনায় সর্বসময় ও সর্বক্ষেত্রে মানুষের পরিবেশ পরিস্থিতি উপযোগী যথার্থ কোনো পন্থা অনুসারে যোগ্যবান মানুষের মাধ্যমে দীনে ইসলামকে সর্বশ্রেণীর মানুষের নিকট পৌঁছে দেয়ার কাজই হলো দাওয়াত। আব্দুর রহীম আলমাগযাবী, আলউসুসুল ইলমিয়া লিমানহাজিদ দাওয়াতিল ইসলামিয়া ৪৯
দাওয়াতের উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলোর মাঝে বৈচিত্র আছে; বৈপরীত্য নেই। সবগুলো সংজ্ঞার সারমর্ম এক ও অভিন্ন। আর সেটা হলো দীনে ইসলামের প্রতি মানুষকে আহবান করা। সুতরাং দীনের শত কোটি শাখা প্রশাখার মধ্য হতে যে কোনো শাখা প্রশাখার প্রতি আহবানই দাওয়াত হিসেবে বিবেচিত হবে। এক্ষেত্রে উপযোগী যে কোনো সময় বা যে কোনো পন্থাই গ্রহণ করা হোক তাতে দাওয়াতের মূল লক্ষ্য ও সংজ্ঞায় কোনো রূপ সংকীর্ণতা বা সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে না।

তাবলীগ শব্দের আবিধানিক সংজ্ঞা

তাবলীগ শব্দটি একটি আরবী ক্রিয়ামূল। এর অভিধানগত অর্থ হলো পৌঁছে দেয়া, প্রচার করা।
তাবলীগ শব্দের পারিভাষিক সংজ্ঞা
ওহীভিত্তিক ইসলামী শিক্ষা ও দিকনির্দেশনাকে মানুষের নিকট পৌঁছে দেয়াই হলো তাবলীগ। পবিত্র কুরআনেও তাবলীগের এ পরিভাষাটি ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, হে রাসূল ! আপনার প্রতিপালকের নিকট থেকে যা কিছু আপনার উপর অবতীর্ণ হয়েছে তাই (মানুষের নিকট) পৌঁছে দিন। সূরা মায়িদা ৬৭
সুতরাং ইসলামী বিধি নিষেধ, আল্লাহর পরিচয়, মুমিনদেরকে জান্নাত এবং খোদাপ্রদত্ত নেয়ামত সম্বন্ধে সুসংবাদ প্রদান, অবিশ্বাসীদেরকে পরকালীন শাস্তি সম্বন্ধে ভীতি প্রদর্শন, জাগতিক মোহ ও ভোগ বিলাস এবং কৃপ্রবৃত্তির তাড়নায় পদস্খলনের পরিণতি এবং পরকাল বিস্মৃতির ব্যাপারে তাদেরকে সতর্ক করা- এসবই তাবলীগে দীন তথা দীন পৌঁছানোর অন্যতম অনুসঙ্গ। সারকথা, তাবলীগ মানে দীনের কথা মানুষের নিকট পৌঁছে দেয়া। এখানে সময় বা পদ্ধতিগত কোনো সংকীর্ণতা নেই। যে কোনো সময় যে কোনো পদ্ধতিতে দীনের যে কোনো বিষয়কে যে কোনো মানুষের নিকট পৌঁছানোই হলো তাবলীগ। এক্ষেত্রে কোনো সময়, পদ্ধতি বা শ্রেণীকে নির্দিষ্ট করে ফেলা হলে মস্ত বড় পদস্খলন হবে।

দাওয়াত ও তাবলীগের নববী পন্থা

মক্কী জীবনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাওয়াতের কাজ করেছেন। পারিপাশি^ক বিবেচনায় দাওয়াতের ক্ষেত্রে নমনীয় পথ গ্রহণ করেছেন। তবে সে নমনীয়তারও একটি সীমারেখা ছিল। রক্তাক্ত হয়েছেন তবুও দাওয়াতের কাজ করেছেন। আক্রান্ত হয়েছেন তবুও দাওয়াতের কাজ করেছেন। কোনো বাধাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে টলাতে পারে নি। এ কাজে তিনি শিশাঢালা প্রাচীরের ন্যায় পাহাড়সম অটলত প্রদর্শন করেছেন। স্বজাতির লোকজন তাকে এ কাজ থেকে নিবৃত্ত থাকতে বললে তিনি দ্বিধাহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, তোমরা যদি আমার ডান হাতে সূর্য আর বাম হাতে চন্দ্র এনে দাও তবুও আমি এ কাজ থেকে নিবৃত্ত হবো না। কথার ভয়ে কিংবা আক্রান্ত হবার ভয়ে ভীতু হয়ে এ কাজ থেকে পিছপা হয়ে নমনীয়তা প্রদর্শন করেন নি। সুতরাং নবীওয়ালা মেহনত বলতে হলে মক্কী জীবনের সামগ্রিক বিষয়গুলোই বিবেচনায় রাখতে হবে। মাদানী জীবনে গিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাওয়াত ও তাবলীগের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবদ্দশায় এবং খোলাফায়ের রাশেদার সোনালী যুগে মদীনা থেকে যতগুলো কাফেলা বের হয়েছে সবগুলোতেই সে দাওয়াতের পরিবর্তিত পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছে। সেখানে মক্কী জীবনের দাওয়াতী পদ্ধতি অনুসৃত হয় নি। মাদানী জীবনের সে দাওয়াত ও তাবলীগের পদ্ধতি ছিলো, প্রথমে মানুষকে ইসলামের প্রতি আহবান করবে। ইসলামে প্রবিষ্ট হতে উৎসাহিত করবে। যদি এ ক্ষেত্রে বিতর্ক ও যুক্তি প্রমাণের প্রয়োজন হয় তাহলে সেগুলোও গ্রহণ করবে। এতে যদি তারা মুসলিম হয়ে যায় তবে ভালো কথা। আর ইসলাম গ্রহণ না করলে জিযিয়া প্রদান করে তাদের ধর্মে বহাল থাকার সুযোগ দিবে। সর্বশেষ যদি তারা জিযিয়া প্রদানে গড়িমসি করে তবে জিহাদের মাধ্যমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। বুরাইদা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহর নামে আল্লাহর পথে জিহাদ করো। যারা আল্লাহকে অস্বীকার করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। যখন তুমি তোমার কোনো মুশরিক শত্রুর মুখোমুখী হবে তখন তাকে প্রথমে তিনটি বিষয়ের প্রতি আহবান করো। তিনটি আহবানের কোনো একটিতে যদি সে সাড়া দেয় তাহলে তা গ্রহণ করে নাও এবং তার সাথে যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকো। প্রথমে তাকে ইসলামের প্রতি আহবান করো। যদি সে ইসলাম গ্রহণ করে তবে তাকে গ্রহণ করে নাও। এবং তার থেকে নিবৃত্ত থাকো। যদি সে ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায় তাহলে তার প্রতি জিযিয়া আরোপের কথা বলো। যদি সে জিযিয়াকে স্বীকার করে নেয় তাহলে তাদেরকে গ্রহণ করে নাও। এবং তাদের থেকে নিবৃত্ত থাকো। কিন্তু যদি সে জিযিয়া প্রদানে অস্বীকৃতি জানায় তাহলে আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করে তার বিরুদ্ধে জিহাদে অবতীর্ণ হও। সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৬১৯ সুতরাং দাওয়াত ও তাবলীগের একটি মাত্র পদ্ধতিকেই একচেটিয়া নবীওয়ালা মেহনত বলে স্বীকৃতি দেয়া এবং অন্যগুলাকে নবীওয়ালা মেহনত বলে স্বীকৃতি না দেয়া বড়ই কূপম-ুকতার লক্ষণ।

দাওয়াত ও তাবলীগ মৌলিক না প্রাসঙ্গিক ?

দাওয়াত অর্থ আহবান করা আর তাবলীগ অর্থ পৌঁছে দেয়া। দুটি ক্রিয়াই সকর্মক। ব্যকরণ মতে সকর্মক ক্রিয়ার কর্মপদের প্রয়োজন হয়। দাওয়াত বা আহবান করা ক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে হলে কিসের প্রতি আহবান করা হচ্ছে এবং কাকে আহবান করা হচ্ছে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে কর্মপদ বের করতে হবে। নতুবা এ ক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে পারবে না। তদ্রƒপ তাবলীগ বা পৌঁছে দেয়া ক্রিয়াটিও সম্পন্ন হতে হলে কর্মপদ খুঁজে বের করতে হবে। কর্মপদ না থাকলে ক্রিয়াগুলো অর্থহীন হয়ে পড়বে। এগুলোর কোনো মূল্যায়ন থাকবে না। কারণ এ ক্রিয়ার অস্তিত্ব সে কর্মপদের উপর নির্ভরশীল। কর্মপদ না হলে ক্রিয়া অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। সে হিসেবে দীনের মূলগত বা শাখাগত পালনীয় বা বর্জনীয় বিষয়গুলো হলো দীনে ইসলামের প্রাণ। দাওয়াত বা তাবলীগ হলো সে প্রাণের জন্য আরেজি বা প্রাসঙ্গিক। নামাজ রোজার মত ইবাদতগুলো হলো জাত বা সত্তা। আর তার জন্য দাওয়াত বা তাবলীগ হলো জাতী বা সত্তাগত বা সত্তাসংশ্লিষ্ট। সুতরাং দীনী বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করেই দাওয়াত ও তাবলীগের প্রয়োজনীয়তা বিদ্যমান। দীনী বিষয় ব্যতীত দাওয়াত ও তাবলীগের অস্তিত্ব কল্পনা করা আদৌ সম্ভব নয়। হ্যাঁ এ কথা সত্য, দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমে দীন দীর্ঘজীবী হয় এবং তার অস্তিত্বের কর্মধারা দীর্ঘায়িত হয়। কিন্তু এ কারণে মূলকে অস্বীকার করে প্রসঙ্গ বিষয়কে মূল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলে বড় ধরনের পদস্খলন ঘটে যাবে। মৌদুদী সাহেব এ জাতীয় একটি উক্তি করেই বড় ধরনের পদস্খলনের শিকার হয়েছিলেন। মৌদুদী সাহেব বলেছিলেন, নামাজ এটি খেলাফত প্রতিষ্ঠার পূর্বপ্রস্তুতি স্বরূপ। এটি মৌলিক কোনো পালনীয় বিষয় নয়; প্রাসঙ্গিক পালনীয়। মূল হলো খেলাফত। এ জাতীয় কথাই এখন দাওয়াত ও তাবলীগের উপর মহল থেকে পরিবেশিত হচ্ছে। তবে কি মৌদুদী সাহেবের জামাত আর তাবলীগ জামাত পদস্খলনের দিক থেকে একাকার হয়ে যাবে ? শাখা বা প্রসঙ্গ বিষয়ের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে যদি শাখাকে কা-, প্রসঙ্গকে মূল হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাহলে সেটাকে শুধু অপরাধ বলা অন্যায় হবে। মূল শাখার এ বিষয়গুলো যদি নিরক্ষর মানুষগুলোর মুখেই শোভা পেত তবে কিছুটা সান্ত¡নার জায়গা ছিলো। কিন্তু আপত্তিকর এ কথাগুলো ধর্মশিক্ষিত উপর মহল থেকেই পরিবেশিত হচ্ছে। আগে ভাবতাম, ঈমানের জন্য ক্ষতিকর অগভীর এ শুকনো কথাগুলো শুধু ধর্মজ্ঞান সম্বন্ধে আনাড়ি লোকগুলোই বলে থাকে। কিন্তু এখন প্রতীয়মান হচ্ছে, কথাগুলো উপর থেকেই পরিবেশিত হয়। সেগুলো এক পর্যায়ে তৃণমূল পর্যন্ত সংক্রমিত হয়। এর দায়ভার কে নিবে ? আলেম সমাজ এ ব্যাপারে সতর্ক করেন না তা নয়। সতর্ক করেন। কিন্তু সেগুলোকে পাত্তা দেয়া হয় না। কারণ এ আলেম তো কাজের সাথে জড়িত নন বা সময় লাগান নি। কাজের সাথে জড়িত আলেমই এ কথা বলেছেন। সুতরাং তারটা শিরোধার্য। আপনি কোথাকার কে ? আলেম সমাজের জন্য কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখেই সতর্ক করা চাই। কারণ এ কাজের সাথে আত্মপ্রাণ হয়ে গেলে তারাও সীমাবদ্ধতার ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। অবশ্য কথাগুলো সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

দাওয়াত ও তাবলীগ কি তবে নতুন চেতনার প্রতিচ্ছবি হতে চলেছে ?

নতুন এ চেতনায় রাজনীতি নেই। প্রকৃত জিহাদ নেই। রাষ্ট্র পরিচালনা নেই। দীন শেখার প্রচলিত পদ্ধতিও নেই। পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ উভয় পদ্ধতিতেই এ কথাগুলোর সুস্পষ্ট বক্তব্য শোনার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যেটাই হোক- আমাদের হয়েছে। নবীগণ নাকি এ পৃথিবীতে রাজনীতির জন্য আগমন করেন নি। নিছক দাওয়াতের জন্যই এসেছিলেন তাঁরা। কেমন শুকনো উদ্ভট কথা ! যদি বলা হতো, নবীগণ প্রচলিত রাজনীতির উদ্দেশে পৃথিবীতে আগমন করেন নি তবে হৃদয়ে প্রশান্তি অনুভূত হতো। কিন্তু তারা বেশ পরিষ্কার করে বলছেন, আল্লাহ নবীদেরকে পৃথিবীতে রাজনীতির জন্য প্রেরণ করেন নি। একমাত্র দাওয়াত দেয়ার জন্যই প্রেরণ করেছেন। তবে আমাদের প্রিয়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামসহ যেসব আম্বিয়ায়ে কেরাম রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন তারা কি তবে নবুওয়াত পরিপন্থী কাজ করে ফেলেছেন ?
কথার উপস্থাপনায় প্রতীয়মান হয়, দাওয়াতই একমাত্র দীনের কাজ। অন্যগুলো হলো সেকে- বা থার্ড পার্সন। নামাজ রোজায় গ্যাভ হলে সমস্যা নেই। দাওয়াতের মানবরচিত পদ্ধতি পালনে যেন কোনো ধরনের গ্যাভ না হয়। কথাগুলো তিক্ত শোনালেও বাস্তবসম্মত ও বেদনাবিধুর। জিহাদের কথা বলুন। তাযকিয়া কিংবা আত্মশুদ্ধির কথা বলুন। দেখবেন চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেছে। ‘যে ব্যক্তি সাড়ে তিন হাত বডিতেই দীন প্রতিষ্ঠা করতে পারে না সে আবার জিহাদের কথা বলে !’ মুখ বাঁকানো এমন বিদ্রƒপাত্মক তীর্যক মন্তব্য শোনার জন্য আপনাকে প্রস্তুত থাকতে হবে। কুরআনের সবগুলো জিহাদের আয়াতকে প্রচলিত দাওয়াত ও তাবলীগের ক্ষেত্রে ব্যবহারের উপযোগী করে ছোট খাটো একটি তাফসীর গ্রন্থ প্রায় প্রস্তুত করে ফেলেছেন। বাকি কাজ সম্পন্ন করতে দুআ প্রার্থনা করেছেন। এমন ধর্মশিক্ষিত মানুষও আমাদের প্রচলিত তাবলীগ মহলে তৈরী হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে নিশ্চয় তাকে কিতাল শব্দের ব্যাখ্যা জিহাদ করতে হয়েছে। কারণ এ ছাড়া উপায়ন্তর নেই। জিহাদের আভিধানিক অর্থের জোরে তো খুব সহজেই জিহাদকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করা যায়। কিন্তু কিতাল শব্দে এসে তো সেটা সম্ভব নয়। ফলে তাকে অন্য কৌশল গ্রহণ করতেই হবে। ‘এ কাজে সময় লাগালে স্বতন্ত্র আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন হয় না!’ এটা আমাদের ভাইদের ঝাঁঝাঁলো মন্তব্য। এভাবে যদি চলে বা চলতে দেয়া হয় তাহলে রেজাল্ট দেখতে খুব বেশি বিলম্ব করতে হবে না। অদূর ভবিষ্যতে ইলয়াস রা. এর শঙ্কিত স্বপ্ন বাস্তবতার মুখ দেখবে।
হাদীস ও ফিকহের গ্রন্থগুলোতে তাওয়াত বা তাবলীগ শিরোনামে স্বতন্ত্র কোনো অধ্যায় বা উপাধ্যায় রচিত হয় নি। এর অর্থ এই নয়, ইসলামী শরীয়াতে দাওয়াত ও তাবলীগের কোনো গুরুত্ব নেই। এর অর্থ হলো হাদীস বা ফিকহের গ্রন্থগুলোর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতি অধ্যায় উপাধ্যায়ের প্রতিটি বিধানের সাথে দাওয়াত ও তাবলীগের বিষয়টি ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। কোনো বিধান থেকেই দাওয়াত ও তাবলীগকে আলাদা করার সুযোগ নেই। নামাজ রোজাকে আলাদা করে দেখানো সম্ভব। কিন্তু নামাজ, রোজা বা অন্যান্য পালনীয় বিষয় থেকে দাওয়াত ও তাবলীগকে আলাদা করে দেখানো সম্ভব নয়। নামাজা পড়া যেমন ফরজ তদ্রূপ নামাজের কথা অন্যকে বলাও তারতম্য ভেদে ফরজ। ঢাকা শহরের মধ্য হতে ঢাকাকে আলাদা করে দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। কারণ ঢাকা শহরের প্রতিটি জায়গার সাথে ঢাকা ওৎপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে আছে। এর স্বতন্ত্র কোনো অস্তিত্ব নেই। দাওয়াত ও তাবলীগের ব্যাপারটিও তদ্রূপ। ইবাদাতের প্রতিটি শাখা প্রশাখার সাথে ওৎপ্রোতভাবে সে জড়িত হয়ে আছে। দীনী বিষয় ব্যতিরেকে এর স্বতন্ত্র কোনো রূপ নেই। সুতরাং প্রাসঙ্গিক এ বিষয়টিকে যদি মৌলিক জ্ঞান করা হয় তাহলে বড় ধরনের পদস্খলন হয়ে যাবে।

একটি অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্কের অভ্যুত্থান

ইসলামী খিলাফত বা জিহাদ আগে না দীনী দাওয়াত আগে ? প্রশ্নটি মূলত অস্বীকৃতিবাচক। এ প্রশ্ন দ্বারা একটি ধারণার অপনোদন উদ্দেশ্য। আর তা হলো প্রথমে দাওয়াতের কাজ করতে হবে। তারপর হলো জিহাদ ও খেলাফতের কাজ। বিতর্কটিকে মূলত বৃক্ষ আগে না ফল আগে জাতীয় বিতর্কের মত একটি অনাকাঙ্ক্ষিত নিরস বিতর্ক বলে মনে হয়। কারণ দীনের দাওয়াত বা তাবলীগে দীনের অর্থ দীনের প্রতি মানুষকে আহ্বান করা বা মানুষের কাছে দীনের বার্তা পৌঁছে দেয়া। দীন হল অসংখ্য শাখা প্রশাখার একটি সমন্বিত রূপ। অন্য শব্দে দীন হল, আল্লাহ প্রদত্ত পূর্ণাঙ্গ একটি জীবন ব্যবস্থা। দীনের যে কোনো শাখা বা কথার প্রতি আহ্বান মানেই দীনের প্রতি আহ্বান বা দীনী দাওয়াত। দীনের যে কোনো শাখা বা কথার প্রচার মানেই দীনের প্রচার-প্রসার বা তাবলীগে দীন। অন্যদিকে জিহাদ ও ইসলামী খিলাফত দীনে ইসলামের অন্যতম দুটি শাখা। সাথে সাথে ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠা দীনে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি চাহিদা ও প্রয়োজনীয় বিষয়ও বটে। খিলাফত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য কিছু আত্মত্যাগী মুমিনের প্রয়োজন হয়। এ প্রয়োজনীয়তা পূরণের লক্ষে মানুষের নিকট পূর্ণাঙ্গ দীনের গুরুত্বের সাথে সাথে খিলাফত ব্যবস্থার গুরুত্বের বিষয়টিও তুলে ধরতে হয়। তবেই কেবল কিছু মানুষ এ শূন্যতা পূরণের লক্ষে প্রস্তুত হবে। সুতরাং এ যে দীনের গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখার প্রতি মানুষকে আহ্বান করা বা এ সংক্রান্ত বার্তা মানুষের নিকট পৌছে দেয়াÑএগুলোও দীনী দাওয়াত বা তাবলীগে দীনের অন্তর্গত। সুতরাং জিহাদ বা ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য যারা কাজ করবেন বা করেন তারা আবশ্যিকভাবে দীনী দাওয়াত বা তাবলীগে দীনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। তাদের ক্ষেত্রে তাবলীগে দাীন বা দাওয়াতে দীন এবং ইসলামী খিলাফত ব্যবস্থার মাঝে বিভাজন সৃষ্টি করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ সাধারণ মানুষের কাছে ইসলামী খিলাফত ব্যবস্থার গুরুত্বের কথা তুলে ধরতে হলে প্রথমে তার সামনে দীনের পূর্ণাঙ্গ চিত্রের প্রয়োজনীয়তার কথাটিও তুলে ধরতে হবে। পূর্বেও বলা হয়েছে, দাওয়াত বা তাবলীগ স্বতন্ত্র সত্তাগত কোনো বিষয় নয়। এগুলো দীনে ইসলামের প্রতিটি শাখার সাথে আবশ্যিক রূপে জড়িত একটি বিষয়। দীনী বিষয় ব্যতীত এগুলোর আলাদা কোনো সত্তাগত অস্তিত্ব নেই। যে কোনো দাওয়াহ বা তাবলীগের সাথে দীনী বিষয় জড়িত হওয়া আবশ্যক নয়। কারণ পৃথিবীতে দীনবিহীন বহু আহ্বান ও প্রচার-প্রচারণা রয়েছে। পক্ষান্তরে দীনের প্রতিটি শাখা প্রশাখার সাথে দাওয়াত বা তাবলীগের বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কারণ দীনী দাওয়াত বা দীনের প্রতি আহ্বান ব্যতিরেকে দীনে ইসলামের কোনো শাখার দায়িত্বই পূর্ণাঙ্গতা লাভ করতে পারে না। অন্যদিকে ‘আগে দীনের সাধারণ দাওয়াত তারপর খিলাফত। সাধারণ দাওয়াতের কাজ করার পূর্বে ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠার উদ্দেশে কোনো কাজ করা যাবে না।’-এমন শুকনো দৃষ্টিভঙ্গিও যুক্তিপূর্ণ কোনো অর্থ বহন করে না। কারণ ইসলামী শরীয়তে এ ক্ষেত্রে আবশ্যকীয় কোনো ধারাক্রম নেই। তাছাড়া দাওয়াত বা তাবলীগের চূড়ান্ত কোনো সীমা-রেখা নেই, যে তার পর আর দাওয়াতের আবেদন অক্ষুণœ থাকবে না। দাওয়াতের সেই চূড়ান্ত সীমানায় পৌঁছেই কেবল খিলাফতের কাজে হাত দিতে হবে, এর আগে নয়। ইসলামী শরীয়তে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা বা সীমাবদ্ধতা নেই। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, দাওয়াতের ব্যাপারটি দীনে ইসলামের প্রতিটি বিষয়ের সাথেই ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার পক্ষ হতে একটি বাণী হলেও তোমরা পৌঁছে দাও। সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৪৬১। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখানে দীন প্রচারের জন্য স্থান, কাল, পদ্ধতি কিংবা বিষয় নির্ধারণ করে দেন নি। দীনের যে কোনো বিষয়ের কথা তুমি জানো তাই যে কোনো সময় যে কোনো পদ্ধতিতে অন্যকে পৌঁছে দাও। সাধারণ এ দীনী দাওয়াতের ক্ষেত্রে কোনো পূর্ব-পর নেই। তবে বিশেষ কোনো পরিস্থিতি বিবেচনায় দীনের কোনো বিষয়কে অন্য একটি বিষয়ের উপর প্রাধান্য দেয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিহাদের ময়দানে বিশেষ পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ ফরজ বিধান নামাজকেও বিলম্বিত করেছেন। এমন কি জিহাদের ময়দানে আল্লাহ তাআলা সূর্যকে পর্যন্ত স্থগিত করে দিয়েছেন। এগুলো ছিল বিশেষ পরিস্থিতি সাপেক্ষ বিবেচনা। সুতরাং পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায় স্বাভাবিক দীনী দাওয়াতের তুলনায় ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটিও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। তখন দীনের বিশেষ একটি শাখা সংক্রান্ত দাওয়াতি কার্যক্রম অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। সুতরাং ঢালাওভাবে আগে সাধারণ দাওয়াত তারপর খিলাফত বলে মন্তব্য করার কোনো সুযোগ নেই। ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কী জীবনে দাওয়াতের কাজ করেছেন। এরপর মাদানী জীবনে গিয়ে খিলাফতের কাজ করেছেন। সুতরাং আমাদের প্রথমে দাওয়াতের কাজ করতে হবে তারপর খিলাফতের কাজ।’-এমন শুকনো যুক্তি ইসলামী শরীয়তের রুচির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কারণ এ ধারাক্রম মুসলিম উম্মাহর জন্য আবশ্যকীয় কোনো কর্মপন্থা নয়। ইসলামের উন্মেষ কালে চার পাশের পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কর্মপন্থা গ্রহণ করেছিলেন। এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাওয়াতের কাজ শুধু মক্কী জীবনেই সীমাবদ্ধ রাখেন নি; মাদানী জীবনেও দাওয়াতের এ ধারা অব্যাহত ছিল। প্রতি যুগে যদি এ ক্রমবিন্যাসকে গ্রহণ করা হয় তবে কোনো যুগেই আর মাদানী জীবন ফিরে আসবে না। সাধারণ দাওয়াতের পথ অফুরন্ত এবং অনিঃশেষ হওয়ায় সবাই মক্কী জীবনেই জীবন পার করে দিবে। সারকথা, দীনে ইসলামের সকল শাখার ব্যাপারে আমাদেরকে প্রান্তিকতা মুক্ত উদার ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতে হবে। কারণ সকল শাখার সমন্বিত রূপই হলো দীন। দীনের কোনো একটি শাখাই একমাত্র দীন নয়। দীনের সকল শাখায় কাজ না করতে পারাটা আমাদের একটি সীমাবদ্ধতা। সুতরাং দীনের সকল শাখায় কাজ না করতে পারলেও সেগুলোকে মনে প্রাণে সমর্থন ও সহযোগিতা করতে হবে। কখনো দীনের কোনো শাখার ব্যাপারে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করা যাবে না। দীনের কোনো শাখার কর্মপন্থায় অসঙ্গতি কিংবা বিচ্যুতি দৃষ্টিগোচর হলে আমাদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও অনাগ্রহের বাগডোরকে ত্রুটিপূর্ণ সে কর্মপন্থার মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। শাখাগত দীনের সে মূল কাজকে অনাগ্রহের কেন্দ্র বিন্দু বানানো যাবে না। আল্লাহ আমাদেরকে দীনের যাবতীয় বিষয়ের ক্ষেত্রে প্রান্তিকতা মুক্ত উদার দৃষ্টিভঙ্গি লালন করার তাওফীক দান করুন। সূরা ইউসুফ ১০৮, সূরা হামীম সাজদা ৩৩, সূরা মায়িদা ২, সূরা নিসা ৭৫, সূরা আলে ইমরান ১০৫, সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৬১৯

দাওয়াত ও তাবলীগ সংকীর্ণতামুক্ত বিস্তীর্ণ এক বেলাভূমি

দাওয়াত ও তাবলীগের কথা কুরআনে আছে, হাদীসে আছে। দাওয়াত ও তাবলীগের নির্ধারিত কোনো গতি পথ নেই। কুরআন হাদীসে অবারিত দাওয়াত ও তাবলীগ তথা দীন ইসলাম পৌঁছে দেয়ার কথা আছে। সেখানে কোনো বিধিবদ্ধ নীতিমালা বা সীমা রেখা নেই। তাবলীগের চলমান প্রক্রিয়া তাবলীগের সত্তাগত কোনো বিষয় নয়। বরং এটা একটা সাময়িক সুবিধাগত পারিপাশ্বিক বিষয়। স্থান কাল পাত্র ভেদে যেকোনো সময় এতে পরিবর্তন আসতে পারে। দাওয়াতি কাজে উন্নয়ন, সমৃদ্ধি এবং শৃঙ্খলা সৃষ্টির স্বার্থে একটি প্রক্রিয়া গ্রহণ করতেই হয়। আর এ প্রক্রিয়া গ্রহণের ব্যাপারটি উন্মুক্ত ও অবারিত। এক্ষেত্রে ধরা বাধা কোনো বিধি প্রণালী নেই। দীনের যে ব্যাপারটিকে উদার উন্মুক্ত রেখে দেয়া হয়েছে সে ব্যাপারটিকে খামোকা সংকীর্ণতা ও সীমাবদ্ধতার ঘেরাটোপে আবদ্ধ করে ফেলাটা আদৌ বিধিবদ্ধ নীতির পর্যায়ে পড়ে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, তাবিয়ীনে ইযামসহ দীনে ইসলামের মহামনীষীগণ দাওয়াত ও তাবলীগের সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মপন্থা গ্রহণ করেন নি। তাই তাবলীগের ক্ষেত্রে কোনো লিমিটেশন বা সীমাবদ্ধতা নেই। ব্যক্তি, পরিবেশ, সময়, যুগ এবং পরিস্থিতি অনুপাতে তাবলীগের ক্ষেত্রে যেকোনো কর্মপন্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার পক্ষ থেকে একটি বাণী হলেও তোমরা পৌঁছিয়ে দাও। সহীহ বুখারী ৩৪৬১
হাদীস ব্যাখ্যাতাগণ হাদীসটির ব্যাখ্যায় বলেন, তোমরা আল্লাহ এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী যথা সাধ্য মানুষের কাছে বিবৃত করো এবং এক্ষেত্রে তাদেরকে উপকৃত করো।-মিরকাতুল মাফাতীহ ২/৯১ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে তাঁরা ما أمكنكم أو ما استطعتم বাক্য দুটি ব্যবহার করেছেন। আর বাক্য দুটির অর্থ ব্যাপক। যতটুকু সম্ভব, যেভাবে সম্ভব, যে উপায়ে সম্ভব- এসবি বাক্যদ্বয়ের স্বার্থক অর্থ। দাওয়াতের ক্ষেত্রে তারা উপকৃত হওয়া, করার ব্যাপারটি এনেছেন। উদ্দেশ্য হলো, দাওয়াত তথা ক্যাম্পেইনের এমন উপায় এবং কর্মপন্থা গ্রহণ করা উচিৎ যাতে দাওয়অতের কাজটি ফলপ্রসূ এবং কল্যাণকর হয়। সুতরাং দাওয়াত ও তাবলীগের ক্ষেত্রে শরীয়ত সমর্থিত সর্বরকমের উপায় এবং কর্মপন্থা গ্রহণের অবারিত সুযোগ রয়েছে। উমদাতুল আহকাম গ্রন্থের ব্যাখ্যাকার আব্দুর রহমান ইবনে আব্দুল্লাহ বলেন, ... যখন তাদের আহবানে সারা না দিয়ে কোনো উপায় ছিল না তখন তাদের আগ্রহকে মূল্যায়ন করে হাদীসের ব্যাখ্যা গ্রন্থ লেখায় মনোযোগী হলাম। যাতে আমি ঐসব লোকের দলভুক্ত হতে পারি যাদের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার বাণী শুনে আত্মস্থ করলো এরপর অন্যদের নিকট পৌঁছিয়ে দিলো আল্লাহ তা‘আলা তার চেহারাকে সজীব এবং প্রফুল্যময় করে তুলুক। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ৩৬৬০) এবং যাতে ঐসব লোকের দলভুক্ত হতে পারি যারা রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অমোঘ বাণী ‘আমার পক্ষ থেকে একটি বাণী হলেও তোমরা পৌঁছিয়ে দাও। (সহীহ বুখারী ৩৪৬১) এর অনুকরণ করে।-ইতহাফুল কিরাম বিশরহি উমদাতিল আহকাম ১/১
হাদীস ব্যাখ্যাতাগণ একটি বিশেষ প্রক্রিয়া গ্রহণ করে হাদীসের ধারাভাষ্য রচনা করেন। দীনের এ সেবাধর্মী কর্মপন্থাটিকে উপরোক্ত ভাষ্যকর মহোদয় তাবলীগধর্মী কর্ম বলে অভিহিত করতে চেয়েছেন। দীনের প্রচার প্রসারে যেসব উলামায়ে কেরাম এবং দায়ীগণ ব্যাপৃত আছেন তারা সবাই নিজেদের সে দীনী কার্যক্রমকে তাবলীগ শিরোনামে অভিহিত করে থাকেন। অথচ সবার কার্যক্রমের মাঝে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে রয়েছে বিশাল তফাত ও ব্যবধান। কিন্তু তাদের প্রচারধর্মী দীনী কার্যক্রমের ক্ষেত্রে তাবলীগ শিরোনাম ব্যবহার করার কারণে অতীত ইতিহাসে কেউ প্রশ্ন তুলেছেন বলে জানা যায় না। কিন্তু বর্তমানে তাবলীগধর্মী অন্যান্য দীনী কাজে দাওয়াত ও তাবলীগ নাম ব্যবহার করার উন্মুক্ত স্বাধীনতা আজ ভূলুণ্ঠিত হওয়ার পথে। আজ তাবলীগধর্মী সেসব দীনী কজের ক্ষেত্রে তাবলীগ শব্দ ব্যবহার করা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে।
অন্য দিকে কুরআন হাদীসের লিখিত যে রূপরেখা আমাদের সামনে দৃশ্যমান তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে ছিল না। এবং এ ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিশেষ কোনো নির্দেশনাও ছিল না। বরং এ রূপ-রেখা প্রস্তুত হয়েছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তিরোধানের পরবর্তী যুগে। তো কুরআন হাদীসের লিখিত এ সংরক্ষণ পদ্ধতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী ‘আমার পক্ষ হতে একটি বাণী হলেও পৌঁছে দাও’ এর সাথে সাংঘর্ষিক নয়; বরং ফলপ্রসূ ও সহায়ক মাধ্যম। উপরন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রচারধর্মী হাদীসগুলোর মাঝেই কুরআন হাদীস লিখে রাখার বৈধতা নিহিত রয়েছে। কারণ স্মৃতি বিভ্রাট মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম। আর যে ব্যক্তি আপন স্মৃতি শক্তির উপর আস্থা পোষণ করে সে ত্রুটি বিচ্চুতি থেকে নিরাপদ থাকতে পারে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রচারধর্মী হাদীসগুলোকে যদি সংকীর্ণ করে রাখা হতো এবং কুরআন হাদীসের লিখিত রূপ না দেয়া হতো তাহলে অধিকাংশ হাদীস ভাণ্ডার অন্তরালে চলে যেত। ফলে দীনী প্রচারনা অসাধ্য হয়ে পড়তো। এবং মুসলিম উম্মাহ বিশাল একটা দীনী জ্ঞান ভাণ্ডার থেকে বঞ্চিত থেকে যেত। তাই উমর রা. বলতেন, তোমরা দীনী জ্ঞান ভাণ্ডারকে লিখিত রূপ দিয়ে আবদ্ধ করে ফেলো।- শরহুস সুন্নাহ লিলইমাম বাগাবী ১/২৯৫, শরহে মুসলি লিননাবাবী ১৮/১৩০
সুতরাং কুরআন হাদীসের এ গ্রন্থবদ্ধরূপ এবং এর প্রকাশনা ও প্রচারণাও দাওয়াত ও তাবলীগের অন্যতম কর্ম হিসেবে পরিগণিত।
আল্লাহ তা‘লা পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন, হে রাসূল! আপনার প্রভুর পক্ষ থেকে আপনার উপর যা কিছু অবতীর্ণ হয়েছে তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিন।-সূরা মায়িদা আয়াত ৬৭
মুফাসসিরীনে কেরাম আয়াতটির ব্যাখ্যায় বলেছেন, ইহজগত এবং পরজগতে মানুষের জন্য কল্যাণকর যেসব বিষয় আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে তা আপনি মানুষের কাছে পৌঁছে দিন।-তাফসীরে ইবাজী
উক্ত আয়াত বা ব্যাখ্যার ভিতরে বেশ ব্যাপকতা লক্ষণীয়। তাতে কোনো সংকীর্ণতা বা প্রান্তিকতা নেই। যার পক্ষে যেভাবে সুবিধাজনক এবং সাম্ভবপর হবে সে সেভাবে দাওয়াতি কার্যক্রম সম্পাদন করবে।
অন্যদিকে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, তোমার প্রভুর পথে আহ্বান করো প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার সাথে।Ñসূরা নাহল আয়াত ১২৫
আয়াতটির ব্যাখ্যায় মুফাসসিরীনে কেরামের ভাষ্য লক্ষ্য করুন :
১. হে রাসূল আপনি আপনার সম্প্রদায়কে আল্লাহর পথে চলতে আহ্বান করুন, যে পথ সত্য, এবং যে পথ আল্লাহ নিজে মানুষের কল্যাণের জন্য প্রবর্তন করেছেন। আপনি মানুষকে আহ্বানের ক্ষেত্রে এমন মাধ্যম বা কর্মপন্থা গ্রহণ করুন যা তাদের জন্য ফলপ্রদ এবং উপকারী।-আইসারুত তাফাসীর ১/২০২৬
২. হে রাসূল! আপনি এবং আপনার অনুসারীবৃন্দকে যুতসই পথ-পন্থার মাধ্যমে আহ্বান করুন আপনার প্রভুর দীনের প্রতি এবং তাঁর সঠিক সত্য পথের প্রতি যা আল্লাহ তা‘আলা কুরআন সুন্নাহর মাঝে অবতীর্ণ করেছেন। এবং আপনি মানুষকে আহবান করুন তাদের উপযোগী কর্মনীতি প্রয়োগ করে। আর তাদেরকে সুন্দর উপদেশ প্রদান করুন।-আততাফসীরুল মুয়াসসার ৪/৪৯১
৩. হে নবী! আপনি মানুষকে সত্য পথে আহ্বান করুন, যে পথ আপনার প্রভু প্রবর্তন করেছেন। এবং আপনি মানুষকে আহ্বানের ক্ষেত্রে এমন কর্মপন্থা গ্রহণ করুন যেটা তাদের জন্য উপযোগী। সুতরাং বিশিষ্ট জ্ঞানী ব্যক্তিদের দাওয়াতের ক্ষেত্রে এমন কৌশলী বাক্য প্রয়োগ করুন যা তাদের জন্য উপযোগী। নিরক্ষর সাধারণ মানুষকে দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে উপদেশ এবং উপমা সম্বলিত বাক্য ব্যবহার করুন।-তাফসীরুল মুন্তাখাব ১/৪৬৫
৪. আপনার প্রভুর সঠিক সত্য পথের আহ্বান যেন সমগ্র মানব সম্প্রদায়কে ব্যপৃত করে, যে আহ্বান হবে কল্যাণকর জ্ঞান এবং সঠিক কর্মপন্থাসমৃদ্ধ। এবং প্রত্যেককে তার অবস্থা, বোধ, উক্তি এবং আনুগত্য বিবেচনায় দাওয়াত প্রদান করবে। দাওয়াতের বিষয়ে যথাযথ জ্ঞানার্জন করে দাওয়াতি কাজে অগ্রসর হওয়া, দাওয়াতের ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া, মানুষের মেধা ও বোধ উপযোগী সাহজিক পন্থা অবলম্বন করা, সর্বাধিক বোধগম্য ও সর্বজন বিদিত কর্মনীতি গ্রহণ করা এবং বিনয় ও নম্রতা অবলম্বন করা- এসবি হিকমত তথা প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার পর্যায়ভুক্ত।- তাইসীরুল কারীম ফি তাফসীরি কালামিল মান্নান ১/৪৫২
৫. মানুষের পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী দাওয়াতি কর্মপন্থা গ্রহণ করা। এবং এমন কর্মনীতি অবলম্বন করা যা মানুষের জন্য বেধগম্য এবং সহজসাধ্য হয়। এবং স্থান কাল পাত্র ভেদে দাওয়াতি কর্মপন্থার ক্ষেত্রে বৈচিত্র আনয়ন করা।-ফি জিলালি কুরআন ৪/৪৯৭
ব্যাখ্যাগুলোর সার উক্তি হলো, দাওয়াতি কজের ক্ষেত্রে তোমার কর্মনীতিটা যেন ফলপ্রসূ এবং কার্যকর হয় তার জন্য প্রজ্ঞাপূর্ণ কৌশল এবং বিচক্ষণতা অবলম্বন করো। কুরআনিক এ নীতির আলোকে চলমান তাবলীগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ পারিপাশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় তাবলীগের ফলপ্রসূ এ নীতিটি গ্রহণ করেছেন। সুতরাং ফলপ্রসূ এ নীতিকেই যদি একমাত্র দাওয়াত ও তাবলীগ বলে প্রচারণা চালানো হয় তাহলে বড় ধরনের বিচ্যুতি হবে। রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জ্ঞানান্বেষণের কথা বলেছেন। এখন মানুষ বিভিন্ন উপায়ে জ্ঞান অন্বেষণ করছে। কেউ কওমাী মাদরাসার আদলে, কেউ আলিয়া মাদরাসার আদলে দীনী জ্ঞান অন্বেষণ করছে। এক্ষেত্রে নানা উপায় এবং নানা পদ্ধতি অবলম্বিত হচ্ছে। এখন যদি দীন শিক্ষার এসব প্রক্রিয়ার কোনো একটিকেই একমাত্র দীন শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হয় এবং শুধুমাত্র পদ্ধতিগত মিল না থাকার কারণে দীন শিক্ষার অন্যান্য মাধ্যমগুলোর দীন শিক্ষাকে দীন শিক্ষা বলে স্বীকৃতি না দেয়া হয় তাহলে বড় ভুল হবে। এমন সীমাবদ্ধাবে যৌক্তিক মনে করা হলে তো কোনো দীন প্রচার বা দীন শিক্ষার প্রচলিত কোনো পদ্ধতিই বিধিত হবে না। কারণ গাসত, চিল্লা, সাল এবং পাঁচ কাজের প্রচলিত পদ্ধতি কুরআনে হাদীরে কোথাও নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরামের যুগেও দাওয়াতের ক্ষেত্রে প্রচলিত এ পদ্ধতি অনুসৃত হয় নি। তদ্রƒপ এভাবে কমিটি করে উস্তাদ শিক্ষকদের বেতন ভাতা নির্ধারণ করে নির্দিষ্ট শিক্ষা কারিকুলাম তৈরি করে শিক্ষা দানের এ পদ্ধতি কুরআন হাদীসে কোথাও নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগেও এ পদ্ধতির প্রচলন ছিল না। যে যুক্তি প্রমাণের আলোকে প্রচলিত দাওয়াত ও তাবলীগের কাজকে দাওয়াত ও তাবলীগ বলার সুযোগ সৃষ্টি হবে ঠিক সে যুক্তি প্রমাণের আলোকেই তাবলীগধর্মী অন্যান্য দীনী কাজকেও দাওয়াত ও তাবলীগ বলার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
সুতরাং কেউ যদি বলে, চলমান তাবলীগের এ কর্মপন্থাটাই একমাত্র দাওয়াত ও তাবলীগের পথ; এছাড়া তাবলীগের অন্য কোনো পথ-পদ্ধতি গৃহীত নয় তবে এ কথার সাথে কোনো ক্রমেই উলামায়ে কেরামের একমত হওয়ার সুযোগ হবে না। এখন নানা পদ্ধতিতে এবং নানা উপায়ে দীনের প্রচার হচ্ছে। দীনের কথা যদি বিশুদ্ধ হয় তবে সে কথা পৌঁছানোর শরীয়া গৃহীত সব মাধ্যমকেই স্বীকৃতি দিতে হবে। এবং সাধ্যমত সহায়তাও করতে হবে। ইসলামে বাড়াবাড়ি ছাড়াছাড়ি উভয়টিই নিন্দনীয়। আল্লাহ আমাদের দীনের কাজ করার ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহ অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন।


মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.