![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লেখালেখির মোটামুটি ইচ্ছে থেকেই ব্লগে ঢু মারি। ভাল লাগে বই পড়তে আর নিজের ইচ্ছে মতো লিখতে।
ভূমি বালূ প্রাণ কেড়ে নেয়ার প্রতিযোগিতায় এখানে ভোর হয়-সূর্য ডোবে, আঁধার নামে। এখানে শান্তির পায়রা উড়ে গেছে-অস্ত্রের ঝনঝনানিতে। এটি গুম, অপহরণ আর খুনের নগরী। এটি এখন দেশের একটা আতঙ্কের নগরীর নাম। একটা সন্ত্রাসকবলিত জনপদের নাম। বলছি বন্দর নগরী নারায়ণগঞ্জের কথা। অথচ এই নগরটির রয়েছে অতি সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য।
দেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৩ বছর আগে। তবু আজও গণতন্ত্র কোথায়- তার ঠিকানা খুঁজে বের করেতে বেগ পেতে হয়। তাহলে গণতন্ত্র কি শুধুই কাগজে কলমে! নাকি একটি অর্থবহ চর্চা? আমাদের বিবেক আজ প“লিত। বুলেট আর বুটের চাপায় পিষ্ট আজকে আমাদের এই গণতন্ত্র। কেউ আমরা ভাগ্য গড়ি আবার কেউবা ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। এরই নাম গণতন্ত্র!! কষ্টার্জিত অর্জন আজ স্বার্থের সম্মুখে প্রকম্পিত। আব্রাহাম লিংকনের গণতন্ত্রের চমৎকার সংজ্ঞাটিও আজ ‘সংজ্ঞাহীন’।
একদিকে প্রতিহিংসা। আর একদিকে মানবিকতা। এই দুয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব।
দিকে দিকে অপহরণ, খুন আর নৈরাজ্য। খোদ আতুঁর ঘরেই ডুবছে ক্ষমতাসীন দলের ঐতিহাসিক তরী। ‘হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, খান সাহেব ওসমান আলী, বঙ্গবন্ধু, আলী আহমেদ চুনকার তীর্থস্থান- বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সুন্দর সাহিত্যের নগরী’ নারায়ণগঞ্জ আজ বিপন্ন। গত ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও ৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ ৭ জনকে দিনে দুপুরে অপহরণ করে সন্ত্রাসীরা। ওই দিন সন্ধ্যায় গাজীপুর থেকে নজরুলের গাড়ি উদ্ধার করা হয়। এরপর বুধবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শীতলক্ষ্যা নদী থেকে অপহৃতদের সবার মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
কোথায় গণতন্ত্র, তা জানতে হলে গণতন্ত্র কী- সে বিষয়টিই আমাদের স্পষ্ট হওয়া দরকার। গণতন্ত্র হচ্ছে জনগণের দ্বারা পরিচালিত, জনগণের জন্য এবং জনগণের সরকার। বর্তমানে দেশে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা হচ্ছে জনগণের দ্বারা কিন্তু না জনগণের জন্য, না জনগণের। তাহলে প্রশ্ন কোথায় গণতন্ত্র! কোন তন্ত্রে শাসিত আমরা?
গণতন্ত্র হচ্ছে প্রশ্ন করতে জানা, আন্তরিকতার সঙ্গে প্রশ্ন শুনতে জানা। হাজারো-লক্ষ প্রশ্ন আজ নাগরিকদের ক্ষোভ আর বিক্ষোভের আগুনে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিচ্ছে। গণতন্ত্র আজ অন্তঃসারহীন, নিছক স্লোগান, প্রবঞ্চনা। আজ গণতন্ত্রের নামে দখল হয়ে যায় খাল-নদী, জলাশয় এমনকি ভিটেমাটিও। হয় অপহরণ, গুম খুন। রাজনীতিকেরা আজ ভয়ঙ্কর দুরাচারী।
ফিরে যেতে হয় পেছনে- ইতিহাসের কাছে। ইতিহাস গণতন্ত্রের লেবাসে ওলট-পালট হলেও ইতিহাস হলো- যা কিছু এইরূপই ছিল, তাই-ই। দূর-অতীত বা নিকটঅতীতের দেশ-কাল-ব্যক্তির অবিকৃত ও সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত রূপই ইতিহাস। ইতিহাস শুধু প্রমাণনির্ভরই নয়, সর্বক্ষেত্রেই নির্মোহ, নির্মম, অপ্রিয় এবং নগ্ন সত্য। তাই ইতিহাসেই আশ্রয় খুঁজতে হয়। আশ্রয় খুঁজি।
মনে পড়ে নারায়ণগঞ্জের ২৭ বছর আগের সেইসব দিনের কথা!
১৯৮৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ভোরে মারা যান নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান আলী আহমেদ চুনকা। নারায়ণগঞ্জবাসীর চোখের মণি ছিলেন তিনি। বিদ্যুৎ গতিতে সে খবর ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। নারায়ণগঞ্জের অলিগলিতে ওড়ে কালো পতাকা। রাস্তায় নেমে আসে শহরের সর্বস্তরের মানুষ। বিকেলে ডিআইটি বাণিজ্যিক এলাকায় আনা হয় মরদেহ। জানাজায় অংশ নেয় কয়েক হাজার মানুষ। গণমানুষের নেতা আলী আহমেদ চুনকা।
তারও আগে। ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ এ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন অবিভক্ত বাংলার এমএলএ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য বায়ান্নর ভাষা সংগ্রামী খান সাহেব ওসমান আলী। আজও তার মৃত্যুবার্ষিকী যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়। বিশিষ্ট এ রাজনীতিকের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে নারায়ণগঞ্জ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলার মাদরাসা ও এতিমখানায় মিলাদ ও দোয়া অনুষ্ঠিত হয়।
নারায়ণগঞ্জের কৃতী সন্তান এম ওসমান আলী। ছাত্রজীবনে ১৯২০ সালে কলকাতার বেকার হোস্টেলে থাকতেন। সে সময় তরুণ ব্যারিস্টার শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিদেশ থেকে প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে সেই বেকার হোস্টেলেই এক সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। সোহরাওয়ার্দীর লম্বা বক্তৃতা (ইংরেজিতে) শুনে ওসমান আলীসহ সবাই মুগ্ধ হন। পরে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ও সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন ওসমান আলী। রাজনীতির জন্য ডিগ্রি পরীক্ষায় অংশ নেননি। শুধু তা-ই নয়, ডিগ্রি পাস করে তৎকালীন মোসলমান কোটা অনুযায়ী লোভনীয় সরকারি চাকরি, বিশেষতঃ শেরেবাংলার সহযোগিতায় সাব-রেজিস্ট্রির চাকরির সুযোগ গ্রহণ না করে বরং তিনি সাংবাদিকতা ও ব্যবসায়ে আত্মনিয়োগ করেন।
১৯২০ সাল থেকেই পাটের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়লেও সাহিত্য ও সাংবাদিকতা নেশা ছাড়েনি ওসমান আলীকে। তিরিশের দশকে নারায়ণগঞ্জ থেকে ‘সবুজ বাংলা’ নামে মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কিছুদিন এই পত্রিকার সম্পাদনা করেছিলেন। সেই সময় ওসমান আলীর আয়োজনে আট ইয়ারের বৈঠক শীর্ষক ধারাবাহিক গল্পপ্রতিযোগিতায় বিভিন্ন সাহিত্যিক গল্প প্রকাশ করতে থাকেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ, কবি বেনজীর আহমেদ, পল্লী কবি জসীমউদ্দীন, বন্দে আলী মিয়া, সাহিত্যিক মোহিত লাল মজুমদার, আব্দুল ওয়াদুদ প্রমুখের রচনায় সমৃদ্ধ ছিল সবুজ বাংলা। পাট ব্যবসার প্রাণকেন্দ্রে এরূপ সমৃদ্ধ ‘সবুজ বাংলার’ প্রকাশক ওসমান আলীকে বিশ্বকবি লিখেছিলেন, ‘ভেবেছিলুম নারায়ণগঞ্জ শহরটি একটি ব্যবসা কেন্দ্র। কিন্তু এখান থেকেও সুন্দর সাহিত্য প্রকাশনা দেখে মুগ্ধ হলুম। সবুজ দেশের অঙ্গে অঙ্গে সবুজ বাংলা মুখরিত হয়ে উঠুক, এই কামনা করি।’ -আশীর্বাদক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
সবুজ বাংলার কার্যালয় ছিল ওসমান আলীর নিজস্ব বাসভবন বায়তুল আমানে। সেখানে প্রায়ই কবি-সাহিত্যিক এবং সংগীতের আসর বসত। কবি জসীমউদ্দিন এবং সুরের পাখি আব্বাসউদ্দিন এ আসরে আসতেন প্রায়ই।
সাহিত্যের পাশাপাশি খুবই শিক্ষানুরাগীও ছিলেন ওসমান আলী। ১৯৩৮ সালে দাউদকান্দীর অন্তর্গত জামালকান্দীতে তিনি ওসমানিয়া হাইস্কুল ও মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন।
এই দুই ব্যক্তি ছিলেন-দুই সময়ের নারায়ণগঞ্জের মধ্যমণি। তাদের দেখানো পথেই চলত নারায়ণগঞ্জ। আলী আহমেদ চুনকা ভবন ও বায়তুল আমান ভবন আজও আছে। তাদের বংশধররা আজও নারায়ণগঞ্জ নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু নেই তাদের সেই আদর্শ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পদধূলীতে ধন্য বায়তুল আমান ভবনটিতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের।
নারায়ণগঞ্জের যে পরিবারটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আওয়ামী লীগের জন্মের ইতিহাস, সেই খান সাহেব ওসমান আলীর পরিবারের রাজনীতি তৃতীয় প্রজন্মে এসে এখন টালমাটাল। আলামত বলছে, চতুর্থ প্রজন্মে কেবল ভরাডুবিই অপেক্ষা করছে। এই দুই প্রজন্মের কা-কীর্তিতে ওসমান পরিবারের ঐতিহ্যের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতেও টান পড়েছে।
সেই খান সাহেব ওসমান আলীর সুযোগ্য সন্তান একেএম শামসুজ্জোহার ছেলে শামীম ওসমান এবং আলী আহমেদ চুনকার মেয়ে ডা. সেলিনা হায়াত আইভী যথাক্রমে নারায়ণগঞ্জের এমপি ও মেয়র।
একজন প্রচন্ড ক্ষমতাশালী, একজন জননন্দিত। আজ নগরপিতার আসনে থেকে আইভী লড়ছেন জনগণের হয়ে সন্ত্রাসী, ভূমিদস্য আর বালুসন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে। শামীম ওসমানকে ঘিরে রয়েছে অস্ত্রধারী কাডার। জনগণের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারী আবার অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিনিধি।
সবচেয়ে বড় কথা, নারায়ণগঞ্জ ছিল যে দলের আতুঁর ঘর, আজ সেই দল ক্ষমতায়। কিন্তু আঁতুরঘরটাই ঠিক রাখতে পারছে না আওয়ামী লীগ। অথচ একের পর এক ঘটনা যেন ঘটেই যাচ্ছে এখানে।
এ সবের শেষ কবে..?
©somewhere in net ltd.