![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এক কথায় ভাবুক! বহুকথায় আমি একজন স্বাধীন মানুষ, রোবট নই! তাই কারো কথায় সহজে প্রভাবিত হই না,সবার কথা শুনি, সবার লিখা পড়ি, হৃদয় দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি , কেন তিনি এমন করে ভাবছেন!বুদ্ধিমান মানুষের সঙ্গ খুব উপভোগ করি,তাদের সাথে মতের মিল হলে ভাল, না হলে আরও ভাল, গলায় জড়াজড়ি করে বলি, আসেন আপনার কাছ থেকেই নতুন কিছু শেখা যাবে!
১
সেই তখন থেকে একটানা পোঁ-পোঁ শব্দে মাথার ঘিলু ঘুরপাক খাচ্ছে বিবি মোমেনার, মাথার যদি পেটের মত বুদ্ধি থাকত তাহলে এতক্ষনে ভিতর থেকে ওয়াক থু করে সব বের করে দিত ! দু:খ লাগে মাঝেমধ্যে মাথাটার জন্য ,আল্লাহ পাক যে কেন মাথাটারে পেটের মত বুদ্ধিমান বানান নাই তিনিই জনেন । দুপুর দুইটা বাইজা গেছে ফেলানির বাপ এখনো চাউল নিয়া আসে নাই , কি সুন্দর সেই খবর মনের মধ্যে জানান দিতেছে পেট! ফেলানির স্কুলের মাষ্টারেরা নাকি কয় বুদ্ধি হইল মাথার মইধ্যে ,এত পড়াশুনা কইরা শেষ পর্যন্ত এই জ্ঞান লাভ হইল! সেই জন্যই বলা হয় খালি বই পড়লেই হয় না আউট নলেজও থাকা লাগে কিছু ! উঠোনে বসে হাতপাখা বানাচ্ছেন আর এইসব ভাবছেন বিবি মোমেনা। ভাবনা চিন্তা যে তিনি ইচ্ছে করেই করছেন তা না, এই চিন্তা ভাবনাগুলি এমনিতেই মাথার মধ্যে আসে। কি কারনে আসে তা নিয়ে ছোটকালে খুব গবেষণা করতেন তিনি, উত্তর না পেয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছেন সেই কবে!পেটের চিন্তা ভাবনা করা মাথার চিন্তা ভাবনার চেয়ে ভাল, মাথার চিন্তাগুলি অকারন বিলাসিতা কিন্তু পেটের চিন্তা আসল চিন্তা। একটু বেখেয়াল হইলেই ডাক দেওয়া শুরু করে।
বাঁশীর শব্দ শুনেই বুঝলেন এইটা ফেলানি ছাড়া কেউ না,গায়ের সব জোর লাগিয়ে ফুঁ দিবে বাঁশির ফুটোয়, যেন একটু কম আওয়াজ হইলেই বাঁশিটাকে অসম্মান করা হবে। গেল আশ্বিন মাস থেকেই তিনি আর ফেলানিকে বিদ্যালয়ে পাঠান না । কারনটা হল স্কুল যেই টাকা দেয় ছয় মাস পর পর, মাইন্সের বাড়িতে একমাসেই এর বেশি টাকা পাওয়া যায় !কি দরকার গরীবের পড়ালেখার ! স্কুল থেকে ফিরে আসলেই ফেলানি নাক ফুলিয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে ,এই নাক ফুলান স্বভাবের জন্যই বান্ধবীরা নাম দিয়েছিল ফুলানি,সেইখান থেকেই কালের বিবর্তনে ফেলানি । সবাই কত্ত সুন্দর জুতা ,জামা পরে ক্লাসে যায় । আর ফেলানি ? শিকদার বাড়ির মেয়ের পুরাতন জামা জোড়াতালি দিয়ে হাসি মুখে স্কুলে হাযির হয়ে বলতঃউপস্থিত স্যার! একজামা আর কয়দিন পরা যায় ? মেয়েটার ভিজা চোখ দেখতে একদম ভাল লাগে না !এর চেয়ে বিদ্যালয়ে না যাওয়াই ভাল !
পোওওওওওও পোও!
মায়ের কানের কাছে যেয়ে সজোরে দুই টাকার বাঁশিতে ফু দিল ফেলানী !
বিবি মোমেনা তিন সেকেন্ড কানে কিছুই শুনলেন না ,এরপর ঠাস করে চড় লাগালেন ফেলানির কানের নিচে।
:বেশরম মাইয়া কি করছে দেখছনি কামডা?
উত্তরে মাকে জড়িয়ে ধরে ফিক করে হেসে দিল ফেলানি !
-মা ভাত খামু,পেট জ্বলে!
-আমারে কামড়াইয়া খা! তোর বাপরে ক গিয়া খাওন দিতে!দুইটা ছাওয়াল খাওয়াইতে পারে না নুরুল হুদা, আবার বিয়াও করছে!
বাজানের কথা আসতেই চুপ হয়ে যায় ফেলানি।
-কি চুপ ক্যেন? বাজানের সাত খুন মাফ তাই না!
ফেলানি তার নামকরন সার্থক করে নাক ফুলিয়ে হাটা দিল জমিনের দিকে, বাজানের নামে মায় এখন উল্টা-পাল্টা বকবে,তার সহ্য হবে না সেইকথা!বাজান নিশ্চিত খাওন নিয়া সন্ধ্যার আগেই ফিরা আসবে!আইসা মিষ্টি করে ডাকবেঃ আমার ফুল বিবি কই? বুকের মাঝে আসতো দেখি। না খাইয়া আছিলা?
ফেলানি মাথা নেড়ে বলে নাহঃআল্লায় খাওয়াইছে!তুমি না খাওয়াইলে কি হবে!
-আস মা জান এইবার বাজানের হাতে একটু খাও!
তখন কি আর কারো রাগ থাকে? চউক্ষের পানি হইয়া যায় না সব? বাবার বুকের ঘামের ঘ্রাণ কাঁঠালচাপার চেয়েও মিষ্টি!
২
নুরুল হুদা একটানা মাটি কেটে চলেছে, বেলা কয়টা খেয়াল নাই।সূর্যের দিকে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠলেন তিনি। আইজকা ঘরে ফিরলে মোমেনা তার মানইজ্জত বাংলা সোডা দিয়া ধুইয়া সাফ কইরা ফেলব। আর একটু কাম বাকী, বেশী হইলে দশ মিনিট লাগব,মনে মনে ভাবছেন নুরুল হুদা!
-তোর হাতে জোর আছেরে নুরুল, দুইজনের কাম তুই একলাই করতে পারস! পারলে পুস্কুনির(পুকুর) ওই পাড়েও মাটি দিস আইজকা,যেই কোন সময় মেঘ লাগতে পারে। পাড়খান ভাইঙ্গা যাইব না হইলে!
ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলল নুরুল হুদাঃআইজ আর পারুম না, ছাওয়ালেরা না খাইয়া আছে।ট্যাকা দেন যাইগা!
-কাইল নিলে হয়না?
-বাকীর কাম এই নুরুল হুদা করেনা, নগদ গতর খাটছি নগদ দেন!হাতের কোদালটা একদিকে ছুঁড়ে ফেলেন তিনি!
-আইজ পুরাটা নিস না, পোলা আসছে শহর থেইকা, বড় বোয়াল মাছ কিনলাম একটা, ট্যাকা শর্ট আছে কিছু, ১২০ টাকা রাখ বাকিটা কাইলকা নিস!
নুরুল হুদা অবাক হলনা, ধনী মানুষগুলারে আল্লাহ যে হৃদয় দেন নাই সেইটা সেই ছোটবেলা থেকেই জানেন তিনি,তাদের বুকের মাইঝখানে কি মেশিন যে দিছেন তিনিই মালুম!
চুপচাপ হাত বাড়িয়ে দেন তিনি, যেন এটা তার প্রাপ্য টাকা নয়।আসলে যার টাকা পয়সা নাই,তার কথাবলার ক্ষমতাও নাই! টাকাপয়সা থাকলে কাঠের মঞ্চে দাঁড়াইয়া মাছির মত ভনভন করলেও লোকে বিমানের আওয়াজ মনে কইরা উপ্রের দিকে চাইয়া থাকে!
দ্রুত বাজারের দিকে হাটা দেন তিনি,তার মা জান ফুল বিবি এখনও না খাইয়া কই জানি খেলতাছে!
৩
কুড়িগ্রামের অনন্তপুর-দিনহাটা সীমান্তে পোস্টিং হওয়ার পর মনমেজাজ কিছুদিন খারাপ ছিল সুবেদার মেজর মাহতাব হোসেনের। এমনিতেই বয়স হয়েছে,তার উপর মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরির মেয়াদ আরও বেড়েছে! এই বয়সে কোথায় সারাদিন বিশ্রাম নইলে খোদাকে ডাকবেন তা না, তার ভাগ্যেই ছিল নিজ গ্রাম থেকে ৫৪০ কিমি দূরে পোস্টিং? নেহাত দরকার না হলে তিনি এই চাকরী করতেন না, ছোট মেয়েটার শ্বশুরপক্ষ ভালো না। কয়দিন পরপর টাকা পয়সার জন্য চাপ দেয় জামাই! টাকা না দিলে টুকুনের গায়ে হাতও তুলে মনে হয়!মেয়েটা যে তাকে কিছু বলে তা না,কিন্তু চেহারা দেখে ঠিক আন্দাজ করতে পারেন তিনি।আগে মেয়ে কি সুন্দর তার চোখে তাকিয়ে কথা বলত, এখন ভুলেও তাকায় না! একেকবার মেয়েটার জন্য বুকের মাঝে হু-হু করে উঠে , যেই বয়সে মেয়েরা বাবার কোলে বসে গল্প শুনে ঠিক সেই বয়সে বিয়ে হয়েছে টুকুনের!
তার একদমই ইচ্ছে ছিল না এত অল্পবয়সে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার, কিন্তু টুকুনের মা এত করে ধরল যে কিছুই করার ছিল না তার। তিনি বাড়ি গিয়ে দেখেন বিয়ে প্রায় ঠিক,তার সম্মতির প্রয়োজনও বোধ করেনি টুকুনের মা।অবশ্য বছরে ১১ মাস যেই লোক বাড়ির বাইরে থাকে পরিবারে তার মতামত বলে কিছু থাকে কিনা তাও সন্দেহ আছে! ছেলে পক্ষ নাকি বিশাল পয়সাওয়ালা, বাড়ির সামনে নাকি দীঘিও আছে, খালি মেয়েটাই চাই তাদের আর কিচ্ছুনা।পরে অবশ্য তিনি বুঝতে পারেন এই বিয়েতে টুকুনের আগ্রহটাই বেশী তাই নিমরাজি হয়েছিলেন মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে!
যোহরের ওয়াক্ত ! নামায পড়ে সালাম ফিরালেন তিনি। খিলখিল হাসি আর হৈচৈএর শব্দে নামাজই পড়তে পারছিলেন না। সালাম ফিরানোর আগেই অবশ্য বুঝতে পারলেন বিপদজ্জনক ছোট্ট ছেলেমেয়েদের দলটা আশেপাশেই কোথাও আছে। এদের একমাত্র খেলার জায়গা হল এই বিজিবি ক্যম্প!আর একমাত্র খেলা হল আমগাছটা থেকে একদৌড়ে কে আগে গিয়ে সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া ছুয়ে আসতে পারে সেটা!ধমক দিয়েও কোন লাভ হয় না। তাছাড়া এই বয়সের ছেলেমেয়েদেরকে নিষেধ করলে তা আরও বেশী করে। তাই তিনি চুপচাপ থাকেন। তার উপর ভোলাভালা তাকে পেলে যেন আরও মেতে উঠে তারা, একটা মেয়েতো এত অস্থির প্রকৃতির যে তার বন্দুক নিয়েই খেলতে চায়! মেয়েটাকে খুব আদর লাগে। কোথায় যেন মিল আছে টুকুনের সাথে, কি সেটা? চোখে চোখে রেখে বড় মানুষের মত কথা বলার ভঙ্গি নাকি হি হি হাসি ?
কিন্তু সেই আদর দেখান হয় না,তিনি জানেন তার পশ্রয় এই মেয়ের মৃত্যুর কারন হতে পারে!
-এই ভাগ এইখান থেকে!গুলি করে দিলাম কিন্তু! বলে তিনি চোখ বড় করে মুখ দিয়ে বুম বুম শব্দ করেন!
উত্তরে মেয়েটার হি হি আরও বেড়ে যায়।
-মিছা কথা কন ক্যান? আপনার বন্দুক খেলনার, ওইটাতে বুলুট নাই!
-কে কইছে তোরে ফুটাই দিলাম কিন্তু? বুম !
-যান! ওইই যে বেড়ার ওইপাশের উনারা কত বুলুট ফুটায় সত্যিকারে! আপনার মত খালি মুখ দিয়া বুম বুম করে না!
মাহতাব হোসেনের চোখে ভয়ের ছায়া দেখা দিল।তিনি ধমক দিয়ে জানতে চাইলেনঃতুই কেমনে জানস ওরা সত্যিকারের গুলি করে?
-আওয়াজ শোনা যায় না বুঝি! ফেলানি তার চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল!
তিনি মেয়েটার চেহারার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন কিছু গোপন করছে সে।
-তোক বাবার নাম কি?আইজ ই আমার সাথে দেখা করতে কইবি। নাইলে তোর বাবারে জেলে দিমু।ফেলানিকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করেন তিনি!
-উত্তরে ফেলানি বুম্ম বুম শব্দ করে তাকে ভেংচি কেটে পালিয়ে যায়!
মেয়েটার দৌড় দেওয়ার ভঙ্গিটাও টুকুনের মত।খোদা কি কারনে দুইজন মানুষের মধ্যে একই স্বভাব দেন কে জানে?নাকি এটা তার আদরের ছোট্ট টুকুনকে কখনও বড় না হতে দেখার বাসনা!
৪
বিট্টূ, আবু, বাবু, মিতু ফেলানির খেলার সাথী এত্ত নাম একসাথে বলা ঝামেলা তাই তাদের সবার চরিত্র বিশ্লেষণ করে ফেলানি একশব্দে ভীতু রেখেছে! আরে এত ভয় পেলে হয় নাকি? বন্দুকঅলারা তো মানুষ তাই না?
সে কোন বন্দুকঅলাকে ভয় পায় না! সবার সাথে তার বেশ খাতির বিশেষ করে দাড়িওয়ালা বন্দুকটার মালিকের সাথে! লোকটা ধমক দিলেও তাকে মাঝে মধ্যে তেঁতুল খেতে দেয় ক্যাম্পের!
কাঁটাতারের ওইপারে যা সুন্দর! এই ভীতুর দলকে সে কখনও তা বোঝাতে পারে না। কত্ত বিশাল মাঠ ওইপারে! সেখানে গিয়া বইসা থাকলেও শান্তি। ঝিম্মম ঝিম্মম একধরনের শব্দ হয় মাঠে নীরবতার কারনে, সে ওইখানে শুয়ে আকাশ দেখে আর তেঁতুল খায়!একটা তেঁতুল খাইলেই পুরাদিন আর খিদা লাগে না! আইজ সে ঠিক করেছে সবাইকে দেখাবে কিভাবে ওইপারে যেতে হয় ।
ফেলানির সাথে দৌড়ে কেউ পারে না। এইবারও তাই হল, সবার আগে সে কাঁটাতারের বেড়ার কাছে গিয়ে পৌছাল! সবার শেষে পৌছাল বীট্টূ !বেচারার ১২ মাসই পেট খারাপ থাকে তার আর কি দোষ!
-চল এইবার যাইগা, ওই বুড়া দারোয়ান দেখলে মাইর দিব!বিট্টূ মাথা দুলিয়ে বলল।
-তোরা যাইতে চাইলে যা, আমি ওই পারে যামু!
-ক্যান? সবাই চেচিয়ে উঠল!
-না গেলে কমু না , একটা বিষয় আছে!
-নাহ আমরা বিষয় জানতে চাইনা! বিট্টূ আবারো মাথা দুলিয়ে বিজ্ঞের মত জবাব দিল!
শালা কচ্ছপের বাচ্চা,বিড়বিড় করল ফেলানি!
-কিছু কইলি?
-নাহ, তাইলে তোরা থাক, দেখ আমি কেমনে যাই!
কাউকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কাঁটাতারের ছোট্ট ফাঁক দিয়ে ইঁদুরের মত ওইপারে চলে গেল ফেলানি!
সে যেইভাবে ওই ছোট্ট ফাঁকটা দিয়ে ঢুকে গেল তা দেখে আবুর কোন সন্দেহই রইল না যে, ফেলানি আস্তা একটা জ্বীন নাইলে ভূত!সে ভয়ে উল্টা দিকে দৌড় দিল।
ফেলানি এইপারে এসে ভীতু পার্টির দিকে করুনার চোখে তাকিয়ে এক ছুট দিল মাঠের দিকে! আকাশে অনেক মেঘ, ফেলানি শুয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, আর পকেট থেকে তেঁতুল বের করে কচকচ করে খাচ্ছে!
গুড়ুম-গুড়ুম করে মেঘ ডাকছে বহু দূরে,সেই শব্দ শুনছে সে চোখ বন্ধ করে! দূর থেকে যেন বিট্টূর গলাও শুনতে পাচ্ছে।আরও ভালো করে শোনার জন্য উঠে বসল , দেখল তার দিকে তাকিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে বিট্টূ কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে! ভাবল বিট্টূও আসতে চাইছে এইপারে !বেটা মরুক ওইখানে,সবাই চলে গিয়েছে বিট্টূ একলা কি করে ঐখানে? সে চুপচাপ ঘাসের বিছানায় শুয়ে আবার আবার আকাশ দেখতে লাগল!সাই সাই করে মেঘগুল যখন সরে যায় মনে হয় সে নিজেই আকাশে উড়ছে ডানা মেলে!আকাশে উড়াল দেওয়ার জন্য পাখির ডানার প্রয়োজন নাই, মনের ডানা থাকলেই চলে। চোখ বন্ধ করার পর মনে হল বিট্টূ যেন আরও কিছু বলতে চাইছিল। কাছেই কোথাও আবার মেঘ ডাকল! এইবার বুঝতে পারল বিট্টূর গলাঃ ফেলুনি ভাগ! ফেলুনিইই!
শোনামাত্র বুঝতে পারল এতক্ষন মেঘের আওয়াজ ছিল না ওইটা!সে প্রানপনে দৌড় লাগাল, একবার ফাঁকা জায়গাটার কাছে যেতে পারলেই হয়! এইতো তার কাঁটা বেড়া, কিন্তু ফাঁকটা কই গেল?কই?
-ফেলুনিই, ফাঁক খুঁজার সময় নাই, তুই তারকাঁটা বাইয়া আইসা পর!
ঘনঘন শ্বাস পড়ছে ফেলানির, বহু দূর থেকে কারা যেন দৌড়ে আসছে! ওমা, এরাতো সত্যিকার বন্দুকওয়ালা, এতো ভয় পাওয়ার কী আছে!
-হাসিমুখে তাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল সে! বিং করে কিছু একটা তার কান ঘেঁষে চলে গেল!
-ওমা ফেলুনি ওরা বুম করে গুলি করে কেন? বিট্টূ ভয়ে দৌড় দেয়!
ফেলানি কাঁটাতারের প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছে, এইতো একটু এখনই লাফ দিবে, পায়ের কয়েকটা জায়গা থেকে রক্ত ঝরছে! শেষ মুহূর্তে দেখল তার জামার পিছনের অংশটা ছিড়ে কাঁটাতারে ঝুলে আছে!আজ মা খুব পিটুনি দিবে, এই জামা ছাড়া তার আর কোন জামাই নাই! সে পিছন ফিরে আর একবার দেখল ! বিশ্বাস হয় না বন্দুকওয়ালারা তাকেই গুলি করছিল? গুড়ুম! আর একবার মেঘ ডাকল!
ফেলানি আকাশের দিকে তাকিয়ে ঐ অনেক উপরের কারো কাছে কি ভেজা চোখে কোন বিচার দিতে চেয়েছিল?
৫
ভুল হওয়ার কথা নয়, মাহতাব হোসেনের ভুল হতে পারে না!নিশ্চিত এটা 7.62mm ইনসাস রাইফেলের গুলির শব্দ!এই শব্দেই ঘুম ভেঙ্গেছে তার, কিন্তু এই রাইফেল তো বিএসএফ ব্যবহার করে! অস্ত্রের মহড়াও হতে পারে না, হলে তিনি অবশ্যই জানতেন! মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে, সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরীদের অস্থির হলে চলে না, তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় বহু গুলির আওয়াজ শুনেছেন কিন্তু এতটুকুও বিচলিত হননি কোনদিন! আজ তবে এমন কেন লাগছে?
ওই যে একটা পিচ্চি ছেলে কাঁদতে কাঁদতে আসছে, এসেই তার বুকে ঝাপিয়ে পড়ল! কান্নার জন্য কথা বলতে পারছে না , হেঁচকি তুলে সে শুধু কাঁটাতারের দিকে দেখাল!
মাহতাব সাহেব পতাকা হাতে নিয়ে দৌড় দিলেন, অনন্তপুরের সীমান্তের দিকে, চোখের পানি যেন ভুলে গাল ছুয়ে দাড়ি ভিজিয়ে দিচ্ছে।এত সহযোদ্ধার মৃত্যু দেখেছেন কখনও কান্না করেন নি, একটা আশা ছিল দেশ স্বাধীন হবে। দাঁতমুখ খিঁচে সহযোদ্ধাদের জানাজা পড়েছেন, নিজের রাগকে অশ্রু হয়ে ঝরে যেতে দেননি ! আজ তার কান্না করার দিন, আজ কোন আশা নেই! স্বাধীনতার সব স্বপ্ন যেন অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ছে, কাঁটাতারের বেড়া ধরে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে অসহায় মানুষের কান্নার চেয়ে ভয়ানক কিচ্ছু নেই!
নুরুল হুদা আর মাটি কাটার কাজ করেন না,লাশের কবর খুঁড়েন বিনা পয়সায়! কেউ ভাত খেতে দিলে প্লেট ছুঁড়ে ফেলে হু হু করে কাঁদেন! বিবি মোমেনার মাথার মধ্যে সারাক্ষন তীব্র বাঁশির শব্দ ঘুরপাক খায়! আর তিনি অদৃশ্যে হাত বাড়িয়ে মেয়ের গাল ছুয়ে দেন, ভুলেও কখনও চড় মারেন না!
-সাচৌ
০৯-০৮-১৩ইং
©somewhere in net ltd.