নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সময় সীমাহীন

হুমায়রা হারুন

এ নিরন্তর সংশয়ে হায় পারি নে যুঝিতে / আমি তোমারেই শুধু পেরেছি বুঝিতে

হুমায়রা হারুন › বিস্তারিত পোস্টঃ

চৌকো মুখো

২০ শে অক্টোবর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৮


আমি কখনোই মনে করতে পারবো না যে, স্কুলে আমাকে কেউ বুলি করেছে। একসেপ্ট ওই চৌকো মুখো একটি মেয়ে ছাড়া।
তখন বিদেশী বিস্কিট আমরা চোখেও দেখতে পেতাম না। খাওয়া তো দূরের কথা। সেই ১৯৮০ সালের কথা। ১৯৮০ থেকে ৮৭ এর মধ্যে। প্রথম বিদেশী আদলে বিস্কিট নির্মিত হলো আমাদের দেশে। বিস্কিটের নাম ছিল মিস্টার কুকি। পুরোটাই চৌকো আকৃতির বিস্কিট। দেখতে বেশ অন্যরকম লাগতো। সেরকম চৌকো মুখের ওই বিস্কিটের মত দেখতেই একটি মেয়ে জীবনে চলার পথে দেখলাম স্কুলে।

তার নাম ‘এন’। কখনো কথা বলার কোন ইচ্ছা জাগ্রত হয়নি। অন্য গ্রুপের মেয়ে, কিন্তু কি অজ্ঞাত কারণে সে আমাকে টার্গেট করে বুলি করতো আমি বলতে পারবো না। ১৯৮২ সাল, তখন আমরা এগার বছর বয়স। তখন থেকেই সে খুব চালাক চতুর ছিল সে। কেন বুলি করতো তার কারণ আমাকে এখনো ভাবায়। কেউ তো এমন ছিল না। তাই তার আচরণ খুব অদ্ভুত ঠেকতো। আজও কারণ আমার একদমই অজানা।

চৌকো মুখ বলে যতটা মনে রাখতাম না তাকে, (তত একটা) তবে তাকে এখনও আমি মনে রাখতে পেরেছি তার এই টন্ট করার আচরণের কারণে। একমাত্র মেয়ে পুরো স্কুল জীবনে আমার স্মরণীয় হয়ে আছে এই কারণে, যে কিনা আমাকে বুলি করেছিল বা করতো। অদ্ভুত ব্যাপার হলো যে, আমাদের ক্লাশে বয়স্ক ধরণের , পড়ালেখায় dull ক্যাটাগরির 'এস’ নামে একটা মেয়ে ছিল। ‘এম’ নামে আরেকটা মেয়ে ছিল। এরা দুটো একটু ক্রিমিনাল গোছের ছিল।এবং আরো অন্যান্য কতজনই তো ছিল। তারাও এসব বুলি করার কাজ করেনি। যে বয়স্ক মেয়েটির কথা বলছি ‘এস’, সে তো করেইনি। আর ‘এম’ ছিল তার সাগরেদ। খুব পাকা। ব্রোকেন ফ্যামিলি থেকে আসারা খুব পাক্কু হয় যেমন সেও তেমন ছিল। তবে সেও বুলি করে নাই। তারা ক্রাইম করতো অনেক। তাদের ক্রাইম করার টেকনিক খুব ইউনিক ছিল। তারা ক্রাইম করেছে, হ্যারাস করেছে আমাকে কিন্তু বুলির ব্যাপারে দেখেছি এই চৌকোর মত না। এই কাজটা আমার প্রতি করতো শুধুই চৌকো মুখো ‘Boxy the bully’;

১৯৮৫ সাল তখন। ক্লাস নাইনে পড়ি। সবাই সিনিয়র সেকশনের বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসে আছি। আমি বসি নাই , মাঠের সামনে হাঁটছিলাম। সকালের ক্লাস কেন জানি হচ্ছে না, অথবা গেমস ক্লাস ছিল। আর্টস এবং সাইন্স দুই সেকশনের মেয়েরা আমরা বাইরে ছিলাম। ঝলমলে রোদ সেইদিন। Boxy the bully মেয়েটি অনর্গল কথা বলতে পারতো। কিন্তু তার মত প্রগলভ, বিশেষ করে হিন্দি সিনেমা বয়ানে পারদর্শী আমাদের ক্লাসে কেউ ছিল না। ক্লাস এইটে তো আমরা একসঙ্গেই পড়তাম, সাইন্স আর্টস মিলিয়ে। বাসা থেকে এসেই শুরু হতো এবং পিরিয়ডের ফাঁকে অনর্গল বলে যেত সিনেমার গল্প। দিনে দুইটা থেকে তিনটা হিন্দি সিনেমা সে বয়ান করে দিত। আর তাকে ঘিরে গোল হয়ে বসত অন্যান্যরা। এবং সেই সিনেমার প্রতিটি লাইন প্রতিটি অ্যাকশন, মুভ, ডায়ালগ, ইমোশান তারা তার কাছ থেকে শুনতে পেত। কারণ তার বাসায়ই শুধু ভি-সি-য়ার ছিল (video cassette recorder)। আর কারো বাসায় ভিসিয়ার ছিল না।
পরে শুনেছি যে, তার মামা ফিল্মের লোক ছিল, খুব বড় মাপের, মেধাবী পরিচালক। তিনিও চৌকো মুখায়বের অধিকারী ছিলেন। এজন্যই চেহারার এই অদ্ভুত গঠন এদের। পারিবারিক কারণেই বোধহয় তাদের সিনেমা ফিল্ডে আনাগোনা একটু বেশিই ছিল। অন্যান্য ফ্যামিলিরা তো সিনেমার ব্যাপারে কখনই উদার হয়না। দেখা তো দূরের কথা। তাও আবার শ্রী দেবীর সাপের নাচ গান। বাবা মায়েরা তো বাসায় অ্যালাউ -ই করতেন না। মেয়েটির ভাইও বলে সিনেমায় কিশোর চরিত্রে পাট করেছিল। আমি এ জগত নিয়ে তেমন একটা আগ্রহী ছিলাম না বলে সিনেমার বিষয়ে তেমন জানতামও না। আর তার সাথে বা তার সেই গ্রুপের সাথে আমি মিশতামও না। তাই সিনেমার গল্পও আমি শুনতাম না।

সেদিনের কথা বলি। আমার মনে আছে, সে বারান্দায় পা ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে বসে বসে আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে কটাক্ষ করে হাসছিল। আর কিছু একটা বলছিল। যা আমি এই প্রথম লক্ষ্য করলাম। কি বলছিল আমি জানিনা। তবে টন্ট করছিলএবং অনর্গল ঘাড় বাঁকিয়ে পিছনে তাকিয়ে কথা বলে যাচ্ছিল আমাকে নিয়ে। আমার খুব খারাপ লাগছিল। কারণ খারাপ অভিজ্ঞতা তো হয়নি কখনো। সেই প্রথম চোদ্দ বছর বয়সে। নিজেকে যেন ছোট বোধ না করি সেজন্য বাবা মা-ই তো আশ্রয়। তাই কিছু ভাববার চেষ্টা করে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম এই বলে, 'যে আমার বাবা আছেন, যিনি খুবই সম্মানিত। আমাকে অসম্মান করে কোন লাভ নেই।'

আরো পরের দিকের কথা। তখন বোধয় ক্লাস নাইন –এ। আমরা সাইন্স আর্টস আলাদা হয়ে গেছি। সে আর্টসে চলে গেছে।
একদিন এয়ারপোর্টের ভিআইপি লাউঞ্জ থেকে আমাদের গেস্ট নিয়ে আমি বের হচ্ছি। দেখি বাইরে জনতার কাতারে সে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছে। চিনে ফেললে যেমন হয়, কোন অচেনা স্থানে পরিচিত কাউকে দেখলে যেমন হঠাত করেই কথা বলে ফেলি বা হেসে মাথা দুলাই, কিন্তু সে সময়ে তৎক্ষনাত মনে হলো তাকে এখন না চিনতে পারাটাই উত্তম হবে। অর্থাৎ তার সাথের পূর্ব অভিজ্ঞতা আমাকে বেশ সাহসী করেছে। শক্ত করেছে। সে আমাকে দেখল যে, আমি ভি- আই- পি লাউঞ্জ থেকে বের হচ্ছি। তার থেকে বেশ দূরত্ব রেখে। তখন আর তাকে আমি চিনতে পারিনি এবং তার সাথে আমি কথাও বলিনি।

স্কুল শেষে কলেজে তাকে পাইনি। অন্য কোথাও পড়েছে । আমার কলেজে নয়। কিন্তু আবার ইউনিভার্সিটিতে তাকে পেলাম। ১৯৯১ সাল। ইউনিভার্সিটির সাবসিডিয়ারি ক্লাসগুলো বেশ গাদাগাদি করে হয়। সব ডিপার্টমেন্ট থেকে ছাত্ররা আসে তো কমন সাবজেক্ট পড়তে, তাই ছাত্র সংখ্যা বেশী হওয়াতে অনেক সময় ক্লাশের বাইরে থেকে দাঁড়িয়ে লেকচার শুনতে হয়। আমি তখন সেই ক্লাসে ঢুকতে যাচ্ছি। ছাত্র সংখ্যার তুলনায় ছোট হয়ে গেছে যেন বিশাল ক্লাসরুমের আকার। দাঁড়ানোর জায়গা নেই। বসা তো দূরের কথা। সেই মেয়েটি বসার সিট কোনভাবে পেয়ে গেছে। হয়তোবা আমার অনেক আগে সে ক্লাসে এসে ঢুকেছে।আমি পিছনের দিকে দাঁড়িয়ে অনেকের সাথে। সে আমাকে দেখা মাত্র বলে উঠলো, ‘সামনে যেয়ে বসো। সামনে যেয়ে বসো । ঠিক আছে?! তাহলে ফার্স্ট হবা! ভালো রেজাল্ট করবা।'
মহা মুশকিলে পড়লাম আমি। তার এই চোখ নাচানি ভঙ্গি এবং টন্টিং কথা শুনে তো আমি কুলকিনারা কিছুই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মেয়েটির হয়েছে কি। এতদিন পরও স্বভাব ঠিক হয়না।

পরবর্তীতে আমার শুভাকাঙ্ক্ষী আরেকটি মেয়ে, আমার স্কুলের ফ্রেন্ড এবং তারও স্কুলের ফ্রেন্ড এবং সে আমাকেও ভাল চিনে, তাকেও চিনে, সে আমাকে জানালো – “চৌকো মুখো, তো বই খুলে বইয়ের ছাপা অক্ষর দেখতে পায় না, শুধু তোমার মুখচ্ছবি দেখতে পায়, আর হায় হায় করে! বলেছে এবার যদি এক্সামে তুমি ক্লাস হায়েস্ট মার্কস না পাও, তারা ফিস্ট করবে। এই বলে তারা সকলে বাজি ধরেছে।' সেদিন মনে হয়েছিল, আমার মৃত্যূ সংবাদ শুনলে এরাই তো মেছবানী দিবে। যাই হোক। এই খবরটি শোনার পর আমার আর কিছু বলাই নাই ওই চৌকো সম্বন্ধে। কারণ সে তো আমার ডিপার্টমেন্টেরই মেয়ে।

পরবর্তীতে আরো একদিনের ঘটনা। একটা হোমিও হল ছিল নিউ মার্কেটে। নিউ মার্কেটের পিছনের দিকের চালডালের সেকশনের দোকানগুলোর কাছ ঘেঁষে। সেদিক দিয়ে আমরা চালডালের সেকশনে যাচ্ছিলাম গ্রসারি করবো বলে। আমরা মানে আমি, আব্বা, আম্মা সবাই মিলে। যাবার সময় দেখি সেই হোমিও হলে চৌকো বসে আছে, আর সাথে তার সার্বক্ষণিক আরেকটা বান্ধবী ছিল ইউনিভার্সিটিতে, ওই একই ডিপার্টমেন্টে, সেটাও তার পাশ ঘেঁষে বসা। এক ঝলক দেখে দোকানের পাশ দিয়ে চলে গেলাম এবং এই প্রথম মনে হলো (সেই বাল্যকাল টাল পেরিয়ে এসে) পরিচিত কোন মানুষকে দেখে hi না বলে ইগনোর করে চলে যাওয়ার একটা শক্তি যেন অর্জন করেছি। অর্থাৎ অতিভদ্র থেকে একটু অভদ্র হতে পেরেছি সত্যি অর্থে। সাধারণত হঠাৎ পরিচিত কাউকে দেখলে যে রিফ্ল্যাক্স কাজ করে, তা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। ইনোসেন্ট থেকে ম্যাচিউরে উত্তীর্ণ হচ্ছি। সেই এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে একটু আধটু চর্চা তো তার সাথে করা হয়েই ছিল। এ নিয়ে আবার।
অভদ্রদের সাথে আসলে অভদ্রই হয়। কিন্তু আমি যে সেটাও পারতাম না বা এভাবে বলা যায় যে জানতাম না। পরে আমার শিক্ষকরাও আমাকে এ আচরণ আরো ভালমতো শিখিয়েছিল তাদের নীচ আচরণ দিয়ে (আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে।) সে গল্পও করবো আরেক লেখায়। আসলে কত কিছুই না শেখার আছে , বিশেষ করে পচা মানুষদের থেকে। অথবা পচা মানুষ যদি শিক্ষকও হয় তাহলে তো কথাই নেই। সরাসরি তাদের থেকেও।

পরে কার্জন হলে ক্লাস শুরু হলো। তখন আর আর্টস ফ্যাকাল্টির দিকে বেশি যাওয়া হয় না। একদিন গিয়েছি রোকেয়া হলে কাজের জন্য ওইদিকে বা কোন একটা কারণে। তারপরে কলাভবনে, একটু ঘোরার জন্য। দেখি হাত ছড়িয়ে, পা ছড়িয়ে, হাত পা সব নাড়াতে নাড়াতে, শিয়ালের মত লাফাতে লাফাতে, কোথা থেকে যেন আচমকা চৌকো ঝপাৎ করে আমার সামনে এসে পড়ল। খুব আগ্রহ করে তার। বিশেষ ভাবে সে জানতে চাইল আমার কথা। আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি নাকি অন্য ডিপার্টমেন্টে চলে গেছো?’ মানে, তার এখন কি যে শান্তি। এখন খালি মাঠ । এখন আর আমি নেই। তার বিশেষ কোন কম্পিটিটর নেই। বুঝলাম না আমি, যে আমি থাকলেই বা তার কি হতো। সে চৌকো কিন্তু চৌকষ তো আর না।

আমার অভিজ্ঞতা বলে, সাপের পেটে সাপ জন্মায়। তার জন্ম কোন অরিজিন থেকে হয়েছে আমি জানিনা। এবং obviously সেই চৌকোও তার মত আরো কয়েকটা সাপ জন্ম দিবে এ দুনিয়াতে। হয়তোবা দিয়েছেও। আসলে সাপ বলবো নাকি সারমেয় বলবো, নাকি সারমেয়-এর স্ত্রী বচন বলবো জানিনা, তবে গালি অর্থে নয়, মানসিকতার দিক দিয়ে এই সকল শব্দই যেন তাকে বেশি মানায়।
আমার চলার পথে প্রচুর মানুষরূপী ইবলিশ আমি দেখেছি। কিন্তু খ্যাকখ্যাক গলায়, ফ্যাশফ্যাশ করে, ধ্যাবড়া ভাবে হেসে হেসে, এই চৌকো মুখখানা যে বুলি আমাকে করত, সে এই একজনই ছিল – আমার স্মরণীয়।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২০ শে অক্টোবর, ২০২৫ রাত ৯:২৫

শায়মা বলেছেন: হা হা হা আপুনি!!!

লেখাটা পড়ে সত্যি হাসছি!!!

শয়তান মেয়ে চৌকো তোমার মনে এমন করেই দাঁগ কেটে রয়ে গেলো যে তুমি এত সময় নষ্ট করে তাকে নিয়েই লিখলে!!!!!!!!


যাইহোক ভালো হলো রাগ হলে লিখে ফেলে রাগ দূর হয়ে যায়!!!


এরপর থেকে আর তার কথা মনেও পড়বে না তোমার!!! :)

২০ শে অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১০:০৪

হুমায়রা হারুন বলেছেন: একদম ঠিক। আর মনে পড়ছে না এখন।

২| ২০ শে অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১০:০৭

শায়মা বলেছেন: গুড গুড!!! এখন গোল বা ডিম ডিম মুখের ভালো বন্ধু ভালো মানুষ নিয়ে লেখো ....:)

২০ শে অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১১:৩১

হুমায়রা হারুন বলেছেন: ম ম্মম্ম --- গোল তো আমি নিজেই !

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.