নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সময় সীমাহীন

হুমায়রা হারুন

এ নিরন্তর সংশয়ে হায় পারি নে যুঝিতে / আমি তোমারেই শুধু পেরেছি বুঝিতে

হুমায়রা হারুন › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাইরে ধলা অন্তরে…

২১ শে অক্টোবর, ২০২৫ রাত ৮:২৩


বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখে আমি যতই অন্যের প্রতি মুগ্ধ হয়েছি, আকৃষ্ট হয়ে বা তাদের চাকচিক্যে মোহিত হয়েছি, পরবর্তীতে সবার কাছ থেকেই খারাপ ব্যবহার পেয়েছি, উপেক্ষার শিকার হয়েছি। আমি বুঝি না, আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করার বেলায় তখন কেন তারা তাদের বাইরের সৌন্দর্য সে সময়ে ধরে রাখতে পারেন না। নাকি তারা জানেন না যে তারা যে রকম সুন্দর তার সাথে এমন ব্যবহার তাদেরকে মানায় না!
কিন্তু তা কি করে হয়?
সুন্দর যারা, তারা তো নিজেদের নিয়ে বেশী সচেতন থাকে বলেই নিজেকে সবসময় সুন্দর রাখে। আর ব্যাপারটা এমন না যে আমি তাদের কোন ক্ষতি করেছি বা আমি তাদের কোন ব্যক্তিগত স্বার্থে আঘাত হেনেছি বা আমি তাদের কোন প্রকারের ভাই ভাতিজা লাগি, যার কারণে তাদের পারিবারিক বা ব্যক্তিগত আক্রোশ আমার ওপর ঝাড়তে হবে।

আজ মনে পড়লো একজনের কথা যাকে বাংলাদেশের মালাইকা অরোরা বললে অত্যুক্তি হবে না । বলিউডের সেই নায়িকার মতই রয়েছে তার সেই কন্ঠ, সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব, স্মার্টনেস, বাচনভঙ্গি আর চমৎকার ব্যবহার। ঘর সাজাতে এবং নিজেকে সাজাতে রয়েছে আধুনিকতা ও রুচির ছোঁয়া। এত সকল গুণের অধিকারী এই নারীকে আমি সেই বাল্যকাল থেকে ভীষণ ভালোবাসি। আসলে গুণ কে না পছন্দ করে? গুণী মানুষ দেখলেই মনটা ভরে যায় আর তার উপর সে যদি হয় এত মায়াময়ী এবং এত সুন্দর!

আমার ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথের সাথে পরিচয় তার মাধ্যমেই। রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ সেই নয় বছর বয়সে প্রথম গিফট হিসেবে পেয়েছিলাম ওনার কাছ থেকেই। নয় বছর বয়স মাত্র। কিন্তু গল্পগুচ্ছ বইটি দেখেই আমি মুগ্ধ! রবি ঠাকুরের বই পড়ার যোগ্যতা তো তখনো হয়নি, কিন্তু রবিঠাকুরের বইয়ের সাথে এই যে পরিচয় করিয়ে দেয়া, সেই শিশু কাল থেকে, এটা তারই কৃতিত্ব। জন্মদিনের উপহার হিসেবে সাথে ছিল বিদেশি একটি ছোট্ট ফটো এলবাম। ১৯৮১ সালের কথা। তখন থেকেই আমার প্রতি তার স্নেহ, আমাকে অন্ধ করে রাখতে।

একবার ভীষণ বড় অ্যাক্সিডেন্ট হলো আমার। গরম পানিতে পুড়লে যেমন হয় তেমন। আমাকে দেখতে আসলেন। কত আন্তরিকতা, আদর, স্নেহ। ভুলিনি আমি। আরো ভালোবাসা বেড়েছে। আরও একটি আমার বিশেষ অনুষ্ঠানে তার উপহার ছিল রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা। শেলফে এখনো আছে বইটা। হাতে লেখা আছে ,
‘শুভেচ্ছা সহ আন্টি। ৩রা নভেম্বর ১৯৯৫।’
আমাদের পাড়ায় খুব জনপ্রিয়তা ছিল তার একটি বিশেষ আচরণের কারণে। আর তা হলো, তার শাশুড়ির সাথে তার চমৎকার মধুর সম্পর্ক। এত ভালো সম্পর্ক , যা সত্যিই সচরাচর দেখা যায় না। আসলে দুজনার মিল, মানে চারিত্রিক মিল এক না হলে তো এত মধুর সম্পর্ক হতে পারত না।

তখন খুব সম্ভবত সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছি। ছোট থেকে তখন বেশ বড় হয়ে গিয়েছি। একদিন ক্লাস শেষে সকাল সকাল বাড়ি এসেই দেখি আমার প্রিয় আন্টি আর তার শাশুড়ি (যাকে আমরা পাড়াতে দাদি বলে সম্মোধন করতাম) তারা দুজন আমাদের ড্রইং রুমে বসে আছেন! কি যে খুশি হয়েছি দেখে। তারাও যথারীতি খুব আন্তরিক ভাবে স্নেহশীল ছিলেন আমার প্রতি। মনে আছে কানের পাশে হাত রেখে আন্টি বললেন,সুমনা, তোমায় না দেখে শুধু যদি তোমার কণ্ঠ শুনি, মনে হবে তুমি নও, যেন তোমার আম্মু কথা বলছেন। একদম ভাবীর কন্ঠ।' (মানে আমার কন্ঠের সাথে আম্মার কন্ঠের মিল পাচ্ছেন তিনি ভীষণ ভাবে)। আর এদিকে তো আমি ওনার মাঝে মালাইকার সৌন্দর্য দেখে সারা! সেদিন একটা সাদামাটা রঙের থান কাপড় দিয়ে ভারী চওড়া ওড়না পড়ে এসেছেন। সুন্দর ফিগারে তাকে কি যে সুন্দর লাগছিল! সাদা ভারী ওড়নার কথা বললাম, কারণ তিনি নায়িকাদের মত খোলামেলা স্টাইলিশ পোশাকও আবির্ভুত হতেন এবং তাতেও তাকে ভীষণ মানাতো।

সেই ছোটবেলায় নয় দশ বছর বয়স হবে। সংগীত শাস্ত্র নিয়ে মাত্র যাত্রা শুরু করেছি। গানের বই খুলে, হারমোনিয়ামের পাশে বসে গান সিলেক্ট করে দিয়ে বললেন এটা গাও।
খেলিছে জলদেবী, সুনীল সাগর জলে
তরঙ্গ লহর তুলে, লীলায়িত কুন্তলে।।
কি যে কঠিন সুর। কিভাবে যে গাইবো ভেবে না পাই কূল। তবুও চেষ্টা করেছি যথাসাধ্য।
একবার মনে আছে, ১৯৯৮ সালের দিকের কথা। আন্টির বিশ কি বাইশ বছরের ছেলেটি অ্যাক্সিডেন্ট করলো। আমার বাবা-মা তটস্থ হয়ে গেলেন। ওর খবর জানতে ফোন করলেন। খুব আন্তরিক ছিল আমাদের পরিবারের সাথে তাদের পরিবারের বন্ধন। কিছুদিন পর পাড়া ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছি আমরা। বেশ কয়েক বছর যোগাযোগ নেই। আমরা চলে আসার পর তো আমাদের একসাথে এক পাড়ায় আর থাকা হয় না। যাওয়া আসা হয়না। আমার খবর পান এর থেকে বা ওর থেকে। কি শুনেন আর কি বুঝেন তা তো আমি আর জানি না।

পরের বছর, ১৯৯৯ সাল। শুনলাম দাদি খুব অসুস্থ। তারা তখনোও তাদের বাসা বদল করেন নি। ঐ পাড়ায় আছেন। আমার ফেলে আসা ছোটবেলার স্মৃতি বিজড়িত সেই স্থানে, সেই মাঠে ঘেরা ছায়া সুনিবিড় ছোট্ট বেলায় বেড়ে উঠা বিল্ডিংগুলোর একটিতে। মে মাসের সুন্দর এক বিকেলে ঠিক করলাম দাদিকে দেখতে যাব, আমি, আম্মু আর আমাদের প্রিয় প্রতিবেশী একজন আন্টিকে নিয়ে। স্বাভাবিক মাধুর্যে পূর্ণ দাদি আমাদের সকলের কাছে কত স্নেহশীল এক বয়োজেষ্ঠ্যা রমণী। আমাদের সকলের দাদি তিনি সেই ছোটবেলা থেকে।
বাসায় যেয়ে দাদির পায়ের কাছে আমরা সকলে বসলাম। একটা মেয়েলোক তার পায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। খুব ব্যথা ওনার সর্বাংগে। যদিও দেখে মনে হলো না যে দাদি খুব, খুব অসুস্থ। ওই যে বললাম, খুব গ্রেইস্ফুল চেহারা ওনার। তাই কষ্ট বা অসুস্থতার ছাপ তার চেহারায় বিন্দুমাত্র প্রকাশ পায় না। অথচ এর থেকে ঠিক ছয়মাস পরেই দাদি চলে গিয়েছিলেন আমাদের ছেড়ে। তখনো জানতাম না যে, আমারা আমাদের অজান্তেই তাকে দেখতে গিয়েছি, যখন আর মাত্র মাস ছয়েক সময় নির্ধারিত তার জন্য।

যাই হোক। তার সামনে যাবার পর খেয়াল করলাম এত পরিচয় সেই ছোট্ট বেলা থেকে, অথচ একটা টু শব্দ উচ্চারণ করছেন না তিনি আমাকে দেখে, আমার সাথে। এতদিন পর দেখা তার সাথে, প্রায় ছয় সাত বছর তো হবেই। কিন্তু তিনি আমার প্রতি একদম চুপ। তার চুপ থাকাটা নিয়ে তারপরও অন্য কোন ভাবনা আমার মনে আসেনি। কারণ অসুস্থ মানুষ তিনি।

দাদির ঘর থেকে বের হয়ে ঘরের ভিতরকার লিভিং রুমে বসিয়েছে আমাদের। কত খুশী আমি, এতদিন পর আমার পরীর মত সুন্দর আন্টিকে দেখে! আমার কত প্রিয় আধুনিক মনের এই মানুষটি, আজ এখন আমার সামনেই বসে আছে। কিন্তু খেয়াল করে দেখলাম তিনিও আমার সাথে একটা টু শব্দ উচ্চারণ করলেন না। চমকে উঠলাম আমি! দাদির সাথে তো শল্যা করে বসেন নি তিনি। কিন্তু ওই যে বললাম, দাদির সাথে ভীষণভাবে বনতো তার বউমার। তাই আমার প্রিয় সেই সুন্দর আন্টিকে দেখলাম এবার দাদির পথ অবলম্বন করতে। ঘণ্টাখানেক আমরা তিনজন তাদের বাসায় ছিলাম। এতক্ষণ থাকাকালীন সময়টুকুতে একটি কথাও বললেন না। জিজ্ঞাসাও করলেন না, সুমনা কেমন আছো? সারাটাক্ষণ তো আম্মা আর আমাদের প্রতিবেশী আন্টি তার সাথে কথা বলে গেছেন। কিন্তু আমাদের সকলের মুখের ওপর দেখলাম তিনি, শুধু আমার প্রতিই - একদম চুপ।

আমাদের প্রতিবেশী সেই ভদ্রমহিলা তা খেয়াল করেছেন কিনা জানিনা, তবে আমি অবশ্যই মনে করি আমার প্রিয় এই মানুষটির আচরণ আমার প্রতি সেদিন অকল্পনীয় ভাবে রুক্ষ ছিল। তিনি যে পর্যায়ের স্মার্ট তা ভাবলে, তার এই আচরণটুকু তার ব্যক্তিত্বের সাথে যায় না। তার আমাকে উপেক্ষা করাটা আমাকে সেদিন এটাই বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে যে, এতদিন পরে দেখা হবার পর তিনি যদি সামনা সামনি এই ব্যবহার করেন, তাহলে মনের ভিতরে না কত বিরক্তি বহন করছেন আমার প্রতি। সাথে ঘৃণাও থাকতে পারে! তাদের বাড়িতে গিয়েছি তাদের ভালবেসে, আপন মনে করে; তার থেকে বহুদিনের ভাল ব্যবহার ও আন্তরিকতা পেয়ে। আর সেই ভালো লাগার, প্রিয় মানুষটি তার বাড়িতে যাবার পর, তার তৈরী করা (সারা জীবনের) ইম্প্রেশন- এর তোয়াক্কা না করে নিজেকে একেবারেই উল্টো ভাবে যখন উপস্থাপন করলেন, তখন মনে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে, এতদিনের এই স্নেহ ভরা আচরণ কি আসলে খুব ঠুনকো ছিল, যা এক টোকাতেই, কারোর কান ভারী করা কথাতে উল্টে গেল? ছোট বাচ্চা তো আর না তিনি। আমি না হয়, তার তুলনায় অনেক ছোট। কি এমন অপরাধ করলাম তার কাছে, তা আমি জানি না। তার এই উলটো আচরণ তাই আজও মনে হলে খুব অবাক লাগে।

মানুষের মুখ যখন আছে, সে মুখ দিয়ে তারা কথা বলবেই। আর কান যখন আছে, সে কান দিয়ে অপরের কথা শুনবেই। ওনার কানে কেউ কিছু ঢালতেই পারে। কিন্তু আমাকে যে, এতদিন ধরে তিনি এতো আদর, স্নেহ প্রদর্শন করলেন, তা অন্য কাউকে দিয়ে তার কানে ভরে দেয়া কথায়- একেবারেই হারিয়ে যাবে?

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.