| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সুমনার দুইজন সহপাঠী ছিল বদিউল আলম বদি আর সাজু। ডাক নামে তো তাদেরকে ক্লাসে টিচাররা সম্বোধন করতেন না, কিন্তু কোন না কোন ভাবে সুমনা জানতো যে তার ওই সহপাঠী বন্ধু দুটির নাম বদি আর সাজু। তারা তাদের হরিহর আত্মা। আর তা না হলেও খুব কাছের তো বটেই। পাড়াতে না হলেও ক্লাসে তারা দুজনেই একটু পান্ডা প্রকৃতির। সেই ১৯৮০ সালের কথা। সুমনা চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। তার স্পষ্ট মনে আছে তার ক্লাসেরই ছেলে দুটির কথা। কারণ স্কুলটি চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত কো-এডুকেশন ছিল। পঞ্চম শ্রেণী থেকে ছেলেরা আলাদা স্কুলে চলে যেত। আর মেয়েরা ম্যাট্রিক পর্যন্ত স্কুল সমাপ্ত করতো।
বদিউল ও তার বন্ধু সাজু কখনো পান্ডাগিরি দেখায়নি কারোর সাথে। তবে সাজুর হাঁটা চলা ছোট থেকেই একটু মাস্তান টাইপের ছিল। আরেকটু বড় হয়ে গলির মোড়ে যেয়ে মাস্তানি করেছে কিনা পরবর্তীতে, তা সুমনা আর জানতে পারেনি। তবে গলিতে থাকলে ১৪/১৫ বছর বয়স থেকে ওভাবেই চলতে ফিরতে হয়; বেঁচে থাকার জন্য। না হলে গলির যে পরিবেশ, সে পরিবেশে টেকা দায়। আর চলায় ফেরায় ১৪/১৫ বছরের ভাব যদি ৯ বছরেই প্রকাশিত হয়, তাহলে সেই বাচ্চাটি একটু তো নয়, অনেক অনেক পাক্কু।
তবে বদিউলকে ওই নয় বছরে কখনোই মনে হয়নি যে তার শিশু সুলভ আচরণ আছে। জীবনের যে জটিলতার মাঝে সে বেড়ে উঠেছিল, তাকে দেখে সুমনার সবসময় মনে হতো, বদি তার সহপাঠী হলেও তার সমবয়সী যেন নয়। বদিউল যেন একটা আস্ত বড় মানুষ। আব্বু আম্মুদের মত। বদিউলের মায়ের তখন থেকে আরেকটা সুখ্যাতি ছিল বাংলাদেশের কালচারের পরিপ্রেক্ষিতে। তিনি ছিলেন ধূমপায়ি একজন মহিলা। বদির বড় বোনটি ছিল সুমনাদের থেকে বছর চারেকের বড়। বিদেশীদের মত দেখতে বলে সুমনা সেই আপাটার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতো। অত ছোটবেলায়, তখন পাঁচ বছর হবে সুমনার, মনে হতো ওই আপাটা যেন মাত্র বিদেশ থেকে এসেছে। আসলে কোথা থেকে কিভাবে বদিউলেরর মা এই সন্তানটি এনেছিল, তা ওই পাড়ার কেউই জানতো না। আর ছোট বয়সে সুমনার তো এসব কথা জানার প্রশ্নই ওঠে না। তবে হ্যা, বড় হয়ে জানতে পেরেছে। আমাদের দেশের মানুষ তো শংকর জাতি। অনেক বাচ্চাই তো আছে সাদাদের মত। বিশেষ করে ফ্রেঞ্চদের মত হয় দেখতে। তেমনই সুন্দর ছিল আপাটা।
একদিন অসুস্থতার কারণে সুমনা স্কুলে যেতে পারেনি। তার বাবা, বদিদের বাসার নম্বর ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ক্লাসের পড়াটুকু ওর কাছ থেকে জেনে নাও।’ সুমনার কেমন জানি অস্বস্তি লাগছিল কিন্তু অত ছোট বয়সে কি ভাবে তার বাবাকে সে বুঝাবে তার অস্বস্তির কথা! তাই সে বুঝতে পারছিল ছিল না। বাধ্য হয়েই বদিউলেরর কাছ থেকে ফোনে পড়া টুকে নিল। ক্লাস ফোরের হোমওয়ার্ক।
পরের দিন ক্লাসে গেলে সাজু এলো সুমনার কাছে। কালো মতন কোকড়া চুলের একটু ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী, গাট্টা গুট্টা ছেলে। একটু আফ্রিকান ট্রেইট ছিল তার। আর বদির চেহারাটা ছিল সেই ইউরোপিয়ানদের মত। তার বড় আপার মতই।
সাজুকে দেখলেই বারবার মনে হতো ছিনতাই, রাহাজানি কিছু একটা করে এসেছে এইমাত্র বোধহয় ক্লাসে এসেছে। আর না করে থাকলে আরেকটু বড় হলে মানে ১৪/১৫ বছর হলেই সে তার গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে পড়বে ওইসব কাজ করতে। এখন বদিউলের সাগরেদ সে। বদিউল তার ওস্তাদ। বদিউল তাকে যা বলে সে তাই করে। তাই আজ সে সাজুকে পাঠিয়েছে সুমনার কাছে, কিছু কথা জানাতে। সাজু এসে বলল, অনেকটা রাস্তার ভাষায়, ‘আরেকবার যদি বদির বাসায় ফোন দিছোস, এক্কেরে উড়ায় দিমু। স্কুল থেইক্কা বাইর কইরা দিমু।’
ওরে বাবা!
তুই তোকারি করে কথা!
এই প্রথম শুনলো সুমনা তার জীবনে, তুই তোকারি করে অনেকটা বস্তি স্টাইলের কথা। স্কুলটা যেহেতু গলির মোড়ের বস্তির স্কুল না, খুবই অভিজাত এলাকায় অভিজাত শ্রেণীর স্কুল, তাই সহপাঠীর কাছ থেকে বস্তির ভাষা, বস্তির অ্যাটিচিউড সুমনা একদমই আশা করেনি। এ ধরনের কথা শুনে আর ভাব দেখে সুমনা আকাশ থেকে পড়ল।
সুমনা এই প্রথম শিখল, এই প্রথম জানল থ্রেট কাকে বলে। টিফিন পিরিয়ড তখন। সাজুর সেই উক্তি শুনতে শুনতে সুমনা চারিদিকে চেয়ে খুঁজে বের করল বদি কোথায়। দেখলো ক্লাসের মাঝে দূরের ঐ জানালার দিকে মুখ করে পা দুটো ফাঁক করে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মানে ক্লাসের দিকে পিঠ করে, জানালার দিকে মাথাটা উঁচু করে, উদাস ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে। তার ওই কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ানোই তার মাস্তানি ভাবের প্রকাশ ঘটাচ্দেছে। কোথা থেকে শিখেছে সে এসব স্টাইল করে পান্ডাগিরি দেখানো, সুমনা তা বুঝতে পারছিল না।
বন্ধু সাজুকে মিশনে পাঠিয়ে বদি এখন খবর পাবার আশায় অপেক্ষমান।
বদি সেইদিন (তার নয় বছর বয়সেই) কোমরে হাত রেখে দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা দিয়ে যা বুঝিয়েছে আর সাজুর দেয়া সেই থ্রেটে সাজু যা বলেছে, যেভাবে বলেছে, তা দেখে সুমনার বুঝতে বাকি ছিল না যে বড় হলে এই দুই দুইবান্দা নির্ঘাৎ গ্যাংস্টার হবে এবং এই পথ তাদের সুনিশ্চিত। এখনই তো তারা পান্ডা। আসলে তাদের পান্ডাগিরি এটাই প্রথম কিনা কে জানে তবে ক্লাসে সে নমুনা সুমনাকে তারা সেদিনই দেখিয়ে দিয়েছে।
বাস্তবে কে কি হবে জীবনে, তা তার বাল্যকালের ব্যক্তিত্বই বলে দেয়। বড়রা শিশুদের মাঝে শিশুসুলভ আচরণ ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পায় না। কিন্তু একজন শিশুর রাইভাল (প্রতিপক্ষ) আরেকজন শিশুই, যারা তাদের সম-জেনারেশন। তার ব্যক্তিত্বের ধরণ দিয়ে সে নিজেই অন্যদের কাছে আবির্ভুত হয়। সেই কারণেই সেই ছোটবেলার ভাবটা সহপাঠীরা যখন ছোট থেকেই দেখতে পায় তারাই ভালো বুঝতে পারে তাদের সম্বন্ধে। তাদেরকে নিয়ে একটা স্পেকুলেশন বা একটা ধারণা অন্যদের আপনা আপনিই গড়ে ওঠে, যা তাদের বাবা মা-ও জানে না, ভাইবোনও জানে না। আর যদি ক্রিমিনাল ব্যাকগ্রাউন্ডের ছেলে মেয়ে হয় তাহলে তো কথাই নেই। এই ভাব, এই ধরণ তারা প্রদর্শন করে প্রতি পদক্ষেপে, জীবনের প্রতিটি স্তরে। স্কুলের অথরিটি, ক্লাস টিচার হয়তোবা টের পায়। আবার বাচ্চাটি খুব চালাক হলে, নিজেকে গুটিয়ে রাখলে টের নাও পেতে পারে।
সাজু বাইরে থেকে আসা ছেলে। বদিউল, সুমনারা একই পাড়ার। তাই আরো পরে সুমনা তার স্কুলের অন্য বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে পেরেছিল যে বদির বাবা তার মাকে কোন এক হোটেল থেকে পরিচয়ের মাধ্যমে ধরে এনেছিল। ভদ্র মহিলা অ্যালকোহলিক ছিলেন বিধায় পরবর্তীতে বেশিদিন বাঁচেননি। বাংলাদেশের সামাজিক পরিস্থিতিতে ও পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে কোন্ নারীরা অত্যাধিক ফাস্ট হয় এবং ফাস্ট লাইফ মেইনটেন করতে গিয়ে অ্যালকোহল ও সিগারেটে আসক্ত হয় তা সকলের জানা। আর নেশায় বুদ হয়ে থাকা নারীরা কিভাবে পতিব্রতা হয়ে স্বামী ও সংসার ধর্ম পালন করবে তাও মোটামুটি ধারণা করা যায়। কিন্তু ছোটবেলায় তো অত সব সুমনার জানার কথা নয়, বোঝারও কথা নয়। তবুও তো সুমনা আঁচ করেছিল যে বদিউল খুব একটা সুবিধার ছেলে নয়। বদিউল যে ভাল না তা সুমনা আঁচ করেই হয়তোবা সেদিন অনিচ্ছা প্রকাশ করেছিল তার সাথে ফোনে কথা বলতে। সুমনার বাবা ওনার দৃষ্টিকোণ থেকে বদিউলকে দেখেছেন একটা শিশু হিসেবে, সুমনার সহপাঠী বলে। উনি হয়তোবা বদির বাবা মায়ের কথা জানতেন। কিন্তু সেটা তো আমলে নেন-ই নাই এমনকি বদিউলকে ভয়ংকর মাত্রার পান্ডা হিসাবে বিবেচনাও করেন নাই।
আসলে ডিস্টার্বড ফ্যামিলির সন্তানরা একটু বেশি যেন ইঁচড়ে পাকা হয়। কারণ তারা খুব ছোট থেকেই ভায়োলেন্স, বিশেষ করে ফ্যামিলি ভায়োলেন্স দেখে বেড়ে ওঠে। সুমনার মত নিটোল, সুন্দর পারিবারিক পরিবেশ তাদের ভাগ্যে জোটে না। অথচ একটি সুন্দর পরিবার কতজনেরই না আকাঙ্ক্ষিত! আবার সুমনার এদিক থেকে আফসোস হয় এই ভেবে যে, ডিস্টার্বড ফ্যামিলির, বস্তি টাইপের ক্যাচাল দেখে যদি বড় হতে পারা যায়, তাহলে বুঝি বেশি ভালো হয়। কারণ ছোট থেকেই তখন ইঁচরে পাকা হওয়া যায়। যত সহজ সরল, ইনোসেন্ট ভাব থাকুক না কেন, এই কর্দমাক্ত, বিষাক্ত পৃথিবীর তিক্ত পরিবেশে যেখানে কি না একে ধরে, তাকে মেরে টিকে থাকাটাই বড্ড দায়, সেখানে বদিউল বা সাজুর মত এরকম মাস্তানি ব্যক্তিত্ব নিয়ে বড় হলেই তো ভাল। তখন পান্ডামি করে সহজেই এই পৃথিবীতে টিকে থাকা সহজ হবে।
তারা তো নিশ্চয়ই এতদিনে তাদের মাস্তানি দিয়ে পান্ডাগিরি করে সমাজ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কে জানে!
০১ লা নভেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:১৬
হুমায়রা হারুন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ রিয়াজ ভাই। মাঝ দিয়ে ফেসবুক, ইউটিউব নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। আবার এলাম ৭ বছর পর ।
২|
০১ লা নভেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:২২
রিয়াজ হান্নান বলেছেন: সেম আমিও,যদিও আমি একটা বাজে সময় পার করেছিলাম ৫ আগস্টের পূর্বে বাট থামিনি,এখন মাঝেমধ্যে ব্লগ লেখার চেষ্টা করি,দুই জায়গায় টুকটাক চেষ্টা করি আরকি,তবে মন মেজাজ খুব খারাপ থাকলে ব্লগে চলে আসি,হাহাহা
©somewhere in net ltd.
১|
০১ লা নভেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৩৫
রিয়াজ হান্নান বলেছেন: আপনার কয়েকটা ব্লগ পড়লাম,যথেষ্ট ভালো লেখেন,যথেষ্ট,মার্জিত লেখা শিখতে চাই