![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ফরিদের স্মৃতিশক্তি ইদানিং গোল্ডফিশের মত হয়ে গেছে। দুই সেকেন্ডের বেশি কোন স্মৃতি মাথায় থাকে না। পরিচিত মানুষজনের সামনে প্রায়ই সমস্যায় পড়তে হয়। মনে হয় মুখটা চেনা কিন্তু নামটা মাথায় আসে না। সেদিন বাসে এক মেয়ের সাথে দেখা, মনে হল মেয়েটাকে কোথায় যেন দেখেছে। কোন আত্মীয়? নাকি নায়িকা পপির সাথে চেহারায় মিল আছে দেখে পরিচিতের মত লাগছে? অনেকক্ষণ চিন্তা করেও ফরিদ মনে করতে পারল না। মেয়েটাও সরাসরি না তাকিয়ে হাসি হাসি মুখ করে অন্যদিক তাকিয়ে আছে। তাকে চিনতে পেরে হাসছে নাকি তার অস্বস্তি টের পেয়ে গেছে? ফরিদ বসেও ছিল মেয়েদের সিটের ঠিক সামনে, ইঞ্জিন কাভারের উপর। সামনে তাকালেই মেয়েটার চোখে চোখ পড়ে যাচ্ছে। আচ্ছা, মেয়েটা যদি পরিচিত না হয় তাহলে কি ভাবছে এই ব্যাটা চামে চিক্কনে তার বুক দেখার চেষ্টা করছে! ফরিদ মুখ ঘুরিয়ে ডাইনে তাকিয়ে থাকল। ঘাড় ব্যাথা হয়ে গেলে বায়ে। নাক মুখ ঘেমে একাকার। যাত্রার পুরোটা সময়ই এমন অস্বস্তিতে কেটে গেল। বাসার গেট দিয়ে ঢোকার সময় মনে পড়ে গেল এটা রোকেয়া খালার মেয়ে শারমিন ছিল। কি লজ্জার ব্যাপার। নিশ্চয় বাসায় যেয়ে বলবে ফরিদ ভাইয়ের সাথে দেখা হল আমাকে চিনলেনই না! খালাও এটাকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে সবাইকে বলে বেড়াবে ফরিদটার এত ভাব হয়েছে পথে ঘাটে দেখা হলে চিনেই না কাউকে!
সেদিন বুথে টাকা তুলতে যেয়ে দেখে গোপন কোড নাম্বারটা দিব্বি ভুলে বসে আছে। বেশ কয়েকবার ভুল নাম্বার চাপতে কার্ডটাই ব্লক হয়ে গেল। বুথের দারোয়ান কেমন সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। ব্যাটা ছিনতাইকারী ভেবেছে কিনা কে জানে!
এই স্মৃতিশক্তির কারণেই জীবনের শেষ ভুলটা করে ফেলল। রাস্তা পারাপারের সময় ফরিদ সাবধানতা বশত রাস্তার দুই দিক দেখে তারপর পার হয়। সেদিনও বাজার থেকে ফেরার পথে প্রথমে ডান দিক তারপর বাম দিক দেখে নিল। ডান দিকে কোন গাড়ি নেই, বা দিকে রং সাইড দিয়ে একটা হিউম্যান হলার বেশ জোরে চালিয়ে আসছিল। ফরিদ রাস্তার দিকে পা বাড়াল। তার গোল্ডফিস মেমরি তাকে তথ্য দিতে ভুলে গেল যে রাস্তা পার হওয়া এখন নিরাপদ নয়। এক সেকেন্ডের মধ্যেই ঘটনা ঘটে গেল। ফরিদের মনে হল ২৪ তলা একটা বিল্ডিং তার গায়ের উপর আছড়ে পড়ল। অকল্পনীয়, অসহনীয় ব্যাথার স্রোত বয়ে গেল। শরীরের সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ তীব্র ঝাঁকুনিতে যেন গুড়ো গুড়ো হয়ে ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইল। কেউ যেন তাকে ইট ভাঙ্গার মেশিনে ঢুকিয়ে দিয়েছে। হাজার টনি কংক্রিট তার মাংস থেঁতলে দিচ্ছে।
মাথার ভেতর তীব্র আলোর ঝলকানি। ফরিদ যেন নিজের মাথার ভেতর ঢুকে পড়ল। কেমন কালো অতল গহবর। লাইব্রেরির মত থরে থরে সাজানো জীবনের স্মৃতিগুলো মুহূর্তেই ভেসে আসলো চোখের সামনে। ফরিদ একে একে স্মৃতির ভেতর ঢুকে পড়ল। কেমন অন্ধকার, কোমল নদীর মাঝে ভাসছিল সে। আঁধার, কালো অথচ মনে হচ্ছিল নিরাপদ! হঠাৎ একটা দুলুনি উঠল, চারপাশটা কেমন চেপে আসলো, তীব্র একটা স্রোত তাকে ঠেলে দিল বাইরে। তীব্র অন্ধকার থেকে আলোতে বেরিয়ে আসলো।
চারপাশে অনেক মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে। মোমবাতির মত মৃদু আলো জ্বলছে। শান্ত একটা পরিবেশ। ফরিদের কেমন ভয় লাগলো। তার পরিচিত, নিরাপদ কালো গুহাটায় আবার ফিরে যেতে মন চাইল। নিজেকে কেমন একা মনে হল। তখনই সে চিৎকার করে উঠল। হঠাৎ করেই সব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। প্রচণ্ড আলোড়নের পর শান্ত হয়ে গেল সবকিছু। ব্যথার রেশ মিলিয়ে গেল পরক্ষনেই। কেমন শূন্যতায় মিলিয়ে গেল সবকিছু।
ফরিদকে ঘিরে বেশ একটা ভিড় জমে গেছে। আশেপাশে মানুষ ভীত আবার করুণ মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ কেউ মোবাইলে ছবি তোলা শুরু করে দিল। হয়ত তার ফেসবুক পেজ এ ছবি দিয়ে লিখে দিবে "লোকটা চোখের সামনে মারা গেল, জীবনে এই প্রথম সামনে থেকে মৃত্যু দেখলাম!"
লুঙ্গি গেঞ্জি পড়া মধ্যবয়সী একটা লোক সরেন, সরেন, পুলিশ কেস কেউ কাছে আসবেন না বলে আমার পাশে এসে বসল। এতগুলো মানুষের মাঝেও সে চুপচাপ পকেট হাতড়াতে শুরু করল। নিখুঁত তার হাতের কাজ। আশেপাশের কেউ টেরই পেল না আমার মোবাইল আর মানিব্যাগ সে সরিয়ে ফেলল। তবে লোকটার মানবিকতা আছে। মানিব্যাগ থেকে টাকা সরিয়ে মানিব্যাগটা এক ফাঁকে তার পকেটে ঢুকিয়ে দিল।
ভিড় বাড়ছে। কয়েকজন অতি উৎসাহী লোক রাস্তা বন্ধ করে দিল। হুমকি ধামকি দিয়ে দুপাশের রাস্তায় গাড়ি চলাচল । একজন কোথা থেকে একটা লোহার রড এনে সামনে যেই গাড়ি পেল সেটার কাঁচের গ্লাসে একটা বাড়ি বসিয়ে দিল। গাড়ির কাঁচ ভেঙ্গে চুরমার। মৌচাকে ঢিল পড়ার অবস্থা। আশেপাশের লোকজন যে যা পেল সামনের গাড়িগুলোর উপর ঝাপিয়ে পড়ল। দেখতে দেখতে গোটা তিরিশেক গাড়ির গ্লাস ভেঙ্গে চুরমার। পিছনের রিকশা গাড়িগুলোর মধ্যে হুলস্থূল পড়ে গেল। দেখতে দেখতে এলাকা রিকশা গাড়ি শূন্য হয়ে গেল।
ফরিদের বেশ আনন্দই হচ্ছিল। তার কারণেই এত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। লাফিয়ে পড়ে দুই চারটা গাড়ির কাঁচ ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছে করছে। মরার পর শরীরের রক্ত নাকি ঠাণ্ডা হয়ে যায়। তার উল্টো গরম গরম লাগছে। উত্তেজনায় চনমনে একটা ভাব। যদিও শরীরের কোন সাড়া পাচ্ছে না।
প্যাঁ পু করতে করতে পুলিশের একটা গাড়ি এসে হাজির। ওসি সাহেব চার পাঁচজন কনস্টেবল নিয়ে তার পাশে দাঁড়ালেন। ওনাকে ফরিদ আগে থেকেই চিনে। অত্যন্ত মাই ডিয়ার টাইপ লোক। মুখে সারাক্ষণ হাসি লেগেই থাকে। আজও হাসি হসি মুখ। কোন কথাবার্তা বললেন না কিংবা হইচই করলেন না। এক পাশে দাড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালেন। তার সিগারেট ধরানো দেখে ফরিদের তৃষ্ণা পেয়ে গেল।
একটা জিপে করে ফরিদের লাশ ঢাকা মেডিকেলে আনা হয়েছে। মর্গের একটা ট্রলিতে তাকে শুইয়ে রাখা হল। গায়ের জামাকাপড় সব খুলে রেখেছে। ট্রলিটা স্টেনলেস স্স্টিলের। ঠাণ্ডা লাগছে। গায়ের উপর একটা সাদা চাদর বিছিয়ে রেখেছে। ঘরটা ছোট। আরও দুইটা ট্রলি মত আছে। সেইগুলো অবশ্য খালি। আজকে মনে হয় এই পর্যন্ত একটাই ডেডবডি।
ফরিদের লাশ একটা এ্যাম্বুলেন্সে তোলা হল। পোস্ট মরটেম করার কথা, মনে হয় টাকা পয়সা দিয়ে ম্যানেজ করেছে কেউ। পোস্ট মরটেম বীভৎস ব্যাপার। একবার এক ডাক্তার বন্ধুর সাথে পোস্ট মরটেম দেখতে গিয়েছিল। এক্সিডেন্টে মারা যাওয়া বাচ্চা একটা মেয়ের ডেডবডি নিয়ে ডোম ঠক ঠক করে প্রথমে মাথার খুলিটা কাটল। এরপর ছোট শরীরটাকে বীভৎস ভাবে কাটাকাটি শুরু করে দিল। দেখে তার মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে উঠল। সকালে শরিফের দোকানে এক পিস বাসি কেক আর কলা খেয়েছিল, সব পেট থেকে উগলে আসতে চাইল।
এ্যাম্বুলেন্স বাসায় ঢুকতেই কান্নার রোল শুনলাম। পলি খালা মনে হয় চলে এসেছেন। পলি খালা কান্না স্পেশালিষ্ট। যে কোন বিদায়ের অনুষ্ঠানে উনি কান্নাকাটির দায়িত্ব পালন করে থাকেন। বিয়েতে মেয়ে বিদায়ের সময়, এয়ারপোর্টে, কারও মৃত্যুতে। আজকে খালা দারুণ ফর্মে আছেন। বিলাপের সুরটাও সে ভালো তুলেছে, কেমন সানাই এর মত শোনা যাচ্ছে। আমি গলির মাথা থেকেই তার কান্না শুনতে পাচ্ছিলাম।
বাড়িটাকে বেশ বিয়ে বাড়ি মনে হচ্ছে। সামনে বেশ কয়েকটা চেয়ার সেখানে কয়েকজন মুরুব্বিরা বসে কথা বার্তা বলছেন। ছোট বাচ্চা কাচ্চা কয়েকটা হৈ হুল্লোড় দৌড়ঝাপ করছে। বাসা ভর্তি লোকজন। ঢাকায় ফরিদের এত আত্মীয় সজন আছে জানতো না। অনেকেই বেশ গল্প গুজবে বসে গেছে। কে একজন পান আনতে গেল। পান ছাড়া আলাপ নাকি জমে না। লাইটিং এর ব্যাবস্থা থাকলে ভালো হত। উৎসব উৎসব ভাবটা পূর্ণতা পেত। বিয়ে বাড়ি না মরা বাড়ি কেউ চট করে আলাদা করতে পারত না।
বাসার সামনে খোলা একটা জায়গায় তিরপল টানিয়ে আলাদা করা হয়েছে। সেখানে গোসল দেয়া হবে। মৌলানা সাহেব চলে এসেছেন। ফরিদ বাসার ভিতরের ঘরে চলে এলাম। মরিয়মকে অনেক্ষন ধরে খুঁজছিলাম। তার সাথে কথা বলার তো উপায় নেই, তার ধারে কাছে যাবার উপায় নেই। বেশ কয়েকজন মহিলা মরিয়মকে ঘিরে বসে আছে। মরিয়মেরও কথা বলার অবস্থা নেই। বেচারি একটু পরপরই জ্ঞান হারাচ্ছে। এমনিতেই বেচারা নরম সরম, ভীতু, মুখচোরা টাইপের। এত বড় শোক সে কিভাবে সামলাবে ভেবেই তার খারাপ লাগছে। ফরিদকে ছেড়ে দূরে থাকতে হবে বলে সে সরকারি স্কুলের চাকরিটাও করেনি। তাকে ছাড়া সে বাকি জীবন কাতাবে কিভাবে।
ফরিদের মেয়েটা মন খারাপ করে বারান্দায় বসে আছে। সাথে তার পুতুল। পুতুলের সাথে সে ফিসফিস করে কথা বলছে। তার মেয়েটা কি বুঝতে পারছে সে তার বাবাকে আর দেখতে পাবে না? ওর কি মন খারাপ? মামুনিটা কি এতক্ষণ কেঁদেছে? ফরিদ তার মেয়ের পাশে বসে থাকলো। খুব ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল। তার মনটা খারাপ হয়ে গেল, অসম্ভব খারাপ। এতক্ষণ খারাপ লাগেনি। এখন হু হু করে কান্না আসতে লাগলো।
ফরিদ উঠে পরলো। বাসা থেকে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। কোথায় যাচ্ছে জানে না। তার দু চোখ ভর্তি জল। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। রাতের শহর, সোডিয়াম বাতির শহর। সে হাঁটতে থাকলো। অজানার পথে হাঁটা। অসীমের পথে হাঁটা। রাতের আকাশ ভর্তি তারা। ঝাপসা চোখে তারাগুলো মিলে মিশে কেমন একাকার হয়ে যাচ্ছে। ফরিদ হাঁটতে লাগলো। এখন তাকে হেঁটে যেতে হবে। আজীবন, আমৃত্যু, অনন্তকাল।
২২ শে জুলাই, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:১৫
মি রুমি বলেছেন: এই সমস্যাটা আমার খুব হয়। হয়ত এক রুম থেকে আরেক রুমে গেলাম, মনে করতে পারি না এই রুমে কেন আসলাম! বাসা থেকে বের হলাম, মনে হতে পারে, কি যেন আনিনি! কখনো মোবাইল, কখনো মানিব্যাগ!!
২| ২১ শে জুলাই, ২০১৭ রাত ৮:২৪
Al Rajbari বলেছেন: ঐতিহাসিক ঘটনাদির মধ্যে......
৩| ২২ শে জুলাই, ২০১৭ রাত ১০:৩৯
আবেগি মন বলেছেন: আমার ও মাঝে মাঝে খুব কাছের বন্ধুর নাম ও মনে পড়ে না ।
২৪ শে জুলাই, ২০১৭ রাত ১১:১৯
মি রুমি বলেছেন: কেমন একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি বলুন!
©somewhere in net ltd.
১|
২১ শে জুলাই, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৫৭
নাঈম জাহাঙ্গীর নয়ন বলেছেন: ভালো লিখেছেন ভাই। এমন সমস্যা অনেকেরই।
মাঝেমধ্যে মনে হয় এটা জানি কিন্তু মনে হয় না কিছুই! অনেক মুখস্থ গানও মাঝেমধ্যে মনে করতে পারিনা! শুধু মনে হয় জানি, কিন্তু মনে আসে না!!
গল্প ভালো লাগলো, ফরিদের জন্য শুভকামনা