নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাংলাদেশ

ফেরদৌস আহমেদ

আমি কি লিখব জানি না

ফেরদৌস আহমেদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

পাসমার্ক

১৬ ই মে, ২০১৬ সকাল ৯:৫৩

আমরা যখন স্কুলে ছিলাম, তখন শিক্ষা পদ্ধতি এখনকার মত এত উন্নত ছিল না। সৃজনশীল পদ্ধতির পড়াশোনা-পরীক্ষা তখনো শুরু হয় নি। আমাদের পরীক্ষায় বড় প্রশ্ন থাকত, ছোট প্রশ্ন থাকত, শূণ্যস্থান পূরন, সঠিক উত্তর বাছাই-এসবের একটা মিশ্রণ থাকত। এর মধ্যে বড় প্রশ্নগুলোতে ১০ করে মার্ক। পাঁচটা বড় প্রশ্ন উত্তর করলে পঞ্চাশ, ছোট প্রশ্ন ৫টা তে আরো পঁচিশ। বাকি সব মিলিয়ে আরো পঁচিশ। এটা একটা উদাহরণ হিসেবে বললাম, সব সময় এই একই রকম মান বন্টন থাকত না। তবে পাশ করার জন্য ১০০তে তেত্রিশ পেতে হত। এই হিসাবে পাঁচটা বড় প্রশ্ন মোটামুটি ভবে উত্তর দিতে পারলেই পাশ করার সম্ভাবনা। গড়ে ৭ করে পেলেই মোট ৩৫, মানে পাশ। কেউ যদি বড় প্রশ্ন উত্তর না দিয়ে শূণ্যস্থান পূরণ, সঠিক উত্তর বাছাই সবগুলোর উত্তর দেয়, তাহলে তার পাস করার সম্ভাবনা খুব কম। কেউ যদি পাঁচটা বড় প্রশ্ন আর পাঁচটা ছোট প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিতে পারে, তাহলে তো নিশ্চিত পাস। আর এই দশটা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বাকি পচিশে পচিশ পেলেও ফেল।
ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থা হয়েছে ওই ছাত্রের মত, যে বড় প্রশ্নগুলো রেখে শূণ্যস্থান পূরণ আর সঠিক উত্তর বাছাইয়ের পচিশ মার্কস-এর পেছনে লেগেছে। অমুক দোয়া পড়লে ৭০ হাজার ফেরেশতা আপনার জন্য দোয়া করতে থাকবে, সকাল-সন্ধ্যায় এই দোয়াটা পড়লে অভাব থাকবে না, প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে এই দোয়া পড়লে রুজিতে বরকৎ হবে, যে দোয়া পড়লে ১ মাসের গুনাহ মাপ হয়ে যায়... ইত্যাদি ইত্যাদি। এর বেশিরভাগই সত্য। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ওই যে, এই সবের মোট মার্কস হচ্ছে পচিশ। এই পচিশে পঁচিশ পেলেও আমরা পরীক্ষা পাস করতে পারছি না। আমাদের মেইন প্রশ্ন হচ্ছে ঈমান, সালাহ, সাওম, যাকাত, হজ্জ, হালাল রোজগার, হারাম থেকে বেঁচে থাকা। আমরা সেটা না করে সকাল সন্ধ্যা কোন একটা দোয়া পড়ে ধনী হয়ে যাওয়ার প্ল্যান করি। বাকি সব কিছুর মত আমরা ধর্ম পালনের ক্ষেত্রেও শর্টকাট খোজা শুরু করেছি। শর্টকাট খোঁজাটা দোষের না; কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বেসিক শর্তগুলো পূরণ না করে শুধু শর্টকাট-এর উপর ভরসা করে চললে ফেল করা প্রায় নিশ্চিত।
এসব দোয়া ও আমলের আরেকটা লক্ষণীয় দিক হচ্ছে এর সবই ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য এবং বেশিরভাগই পার্থিব লাভের লক্ষ্যে। বিভিন্ন ওয়েবপেজ, ফেইসবুক, ইত্যাদিতে সবচেয়ে বেশি যে দুয়াগুলো উল্লেখ করা হয়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ থাকে ধনী হওয়ার দুয়া, অভাব দূর করার দুয়া। আমি এখন পর্যন্ত কোথাও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণের জন্য কোন দুয়া পোস্ট হতে দেখিনি, কোন দুয়া দেখিনি আমাদের শিক্ষকদের জন্য, সহপাঠীদের জন্য, মহল্লার লোকের জন্য, নিপীড়িত মানুষের জন্য, নীপিড়কের হেদায়াতের জন্য।
ইসলামের একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে যে ইসলামে সৃষ্টিকর্তা যেভাবে মানুষের কাছ গুরুত্বপূর্ণ, সেই সৃষ্টিকর্তার সকল সৃষ্টিও গুরুত্বপূর্ণ। একজন মানুষের উপর প্রধানত দুই ধরনের হক (অধিকার) রয়েছে। একটা হচ্ছে হাক্কুল্লাহ বা আল্লাহ’র অধিকার এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে হাক্কুল ঈবাদ বা সৃষ্টির অধিকার। মানুষের উপর আল্লাহর সরাসরি অধিকার হচ্ছে যে মানুষ আল্লাহকে একমাত্র উপাস্য হিসাবে মানবে, সালাহ আদায় করবে এবং সাওম পালন করবে। এই তিনটি ব্যাপার ছাড়া বাকি যা কিছু ইসলামের বিধান রয়েছে, তার সবই প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে আল্লাহর অন্যান্য সৃষ্টির সাথে যুক্ত। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ, যাকাত। নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে বেশি সম্পদের অধিকারীদের জন্য যাকাত দেয়া আবশ্যকীয়। এক যাকাতের কানা পয়সাও কিন্তু আল্লাহ পাকের কাছে যায় না; যায় অন্য মানুষের কাছে। যাকাত ধনীদের উপর গরীবের অধিকার, এটা কারো প্রতি অনুগ্রহ নয়।
আমাদের প্রতিবেশির অধিকার রয়েছে আমাদের উপর। আমি ভরপেট খেয়ে ঘুমাব, আর আমার প্রতিবেশি না খেয়ে থাকবে, এটা হতে পারে না। আমাদের শিক্ষকের অধিকার তো বলে শেষ করার মত না। আমাদের জন্য যারা কাজ করে, তাদের অধিকার রয়েছে আমাদের উপর। শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগে তার মজুরি মিটিয়ে দেয়ার হাদিস তো আমরা সবাই জানি। সমাজের সব মানুষের অধিকার আছে আমাদের উপর। আত্মীয় স্বজনের অধিকার আছে, তাদের খোজ খবর নেয়া, বিপদে সাহায্য করা আমাদের উপর তাদের অধিকার। মানুষের সাথে হাসিমুখে কথা বলাও একটা সদকা।
এ তো গেল মানুষের কথা। আমাদের উপর পশুপাখির হক আছে। প্রয়োজন ছাড়া কোন ধরনের পশুপাখি হত্যা ইসলামে নিষেধ। বিনা কারণে এমনকি গাছ কাটাও নিষেধ।
পরিবেশ সংরক্ষণের আইন তো এই সেদিন হয়েছে। অথচ ইসলাম মানুষের উপর এই পরিবেশের হক নির্ধারণ করে দিয়েছে দেড় হাজার বছর আগে থেকে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, পানির অপচয় করো না, এমনকি যদি তুমি প্রবাহমান ঝর্ণার মধ্যেও থাকো। আরেকটি হাদিসে আছে, একজন মুসলমান যদি একটি গাছ লাগায় অথবা ফসল ফলায়, আর সেই ফল ফসল থেকে যদি কোন পশুপাখি অথবা অন্য মানুষ খায়, সেটা সদকা হিসাবে গণ্য হবে।
হাক্কুল ইবাদ বা সৃষ্টির অধিকারের সবচেয়ে কঠিন দিক হচ্ছে, যার অধিকার আপনি তাকে দেননি, সে যদি আপনাকে ক্ষমা না করে, তাহলে আপনার ক্ষমা পাওয়া কঠিন। আল্লাহর কাছে অপরাধ করলে তো আল্লাহর কাছে যে কোন সময় ক্ষমা চাওয়া যায়, কিন্তু আপনি কোন মানুষের প্রতি অন্যায় করলে আপনি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার আগে সেই মানুষটি আপনাকে ক্ষমা করতে হবে। এখন যদি আমি কারো প্রতি অন্যায় করি, আর তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার আগেই যদি সে আল্লাহর হুকুমে মারা যায়, তাহলে আমি কিভাবে তার কাছ থেকে ক্ষমা পাব?
এসব-ই আমরা জানি। কিন্তু পৃথিবীর বিপরীতমুখি গতি আমাদের দুনিয়াবি সবকিছুর দিকে টেনে নিয়ে যায়, আত্মকেন্দ্রিক করে তোলে। আর সোস্যাল নেটোয়ার্ক সেই আত্মকেন্দ্রিকতার মাত্রাকে ঝড়ের বেগে বাড়িয়ে তুলছে। আর এই আত্মকেন্দ্রিকতার প্রভাব সবকিছুর শেষে আমাদের ধর্ম পালনকেও আত্মকেন্দ্রিক করে তুলছে। যে কারণে আজো কিছু একটার ছবি শেয়ার দিতে দেখি যার ক্যাপশন থাকে, শেয়ার করলে সুসংবাদ পাবেন, আর না করলে বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে।আমরা সত্য অসত্য যাচাই না করেই তা শেয়ার করি ধর্মের বাণী প্রচারের জন্য না, শেয়ার না করলে বাই চান্স আমাদের নিজেদের কোন ক্ষতি যদি হয়ে যায়, এই ভয়ে।


ইসলাম সবকিছুতে অন্যকে অগ্রাধিকার দেয়ার শিক্ষা দেয়। যুদ্ধের ময়দানের সেই মৃত্যুপথযাত্রী সাহাবীদের কথা সবারই জানা। যুদ্ধ শেষে আহত সাহাবীরা পানির জন্য কাতরাচ্ছেন। এক সাহাবী পানি নিয়ে আসলেন গুরুতর আহত এক সাহাবীর কাছে। এমন সময় পাশে আহত আরেক সাহাবীর আওয়াজ পাওয়া গেল। প্রথম সাহাবী নিজে পানি পান না করে পাশের জনকে আগে পানি দিতে ইশারা করলেন। দ্বিতীয় জনের কাছে পানি নিয়ে গেলে তৃতীয় আরেকজনের আওয়াজ পাওয়া গেল। এই সাহাবীও তার আহত ভাইকে আগে পান করানোর ইশারা করলেন। পানি নিয়ে যিনি এসেছিলেন, তৃতীয় জনের কাছে গিয়ে দেখলেন তিনি ততক্ষণে শাহাদত বরণ করেছেন। দ্বিতীয় জনের কাছে ফিরে এসে দেখলেন ইনিও শহীদ হয়েছেন, ফিরে এলেন প্রথম জনের কাছে, ইনার ভাগ্যেও পানি নসিব হয় নি। মৃত্যুর মুহুর্তেও সাহাবীরা নিজেদের আগে অন্যদের কথা চিন্তা করেছেন। এসব কাহিনী আমাদের সবারই জানা। কিন্তু আমাদের কাছে সাফল্যের সংজ্ঞাই আজ বদলে গেছে। আমাদের কাছে আজকের দুনিয়ার সবচেয়ে সফল ব্যক্তি সেই, যার কাছে সবচেয়ে বেশি সম্পদ। সাহাবীদের কাহিনী আমাদের কাছে কাহিনী হয়েই থাকে। আমরা ব্যস্ত হয়ে থাকি নিজেদের নিয়ে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.