![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
জানতে চাই, জানাতে চাই মানুষের অনুভুতির এপিঠ ওপিঠ
(আয়তনে বড় হওয়ায় রচনাটি ২টি পর্বে বিভক্ত)
চলচ্চিত্র র্নিমাণের ক্ষেত্রে মন্তাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত সবাই কম বেশী মন্তাজ নিয়ে আলোচনা করে থাকে। কিন্তু কেন যেন “মন্তাজ” নামক বিষয়টিকে সব সময় খুবই জটিল, কঠিন ও অতি গভীর একটা বিষয় হিসাবে উপস্থাপন করার রেওয়াজ আমাদের দেশে রয়েছে। আমি চেষ্টা করব বিষয়টা সহজ করে উপস্থাপন করতে।
মন্তাজ মূলতঃ সম্পাদনার একটি বিশেষ পদ্ধতি। আসেন, প্রথমেই বুঝতে চেষ্টা করি সম্পাদনা বিষয়টা আদতে কি? আমি পেশায় ভিডিও বা চলচ্চিত্র সম্পাদক না হলেও আমার দীর্ঘ মিডিয়া জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি একটি শটের সাথে আরেকটি শট জোড়া লাগিয়ে লাগিয়ে একটি কাহিনীকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নামই হল চলচ্চিত্র সম্পাদনা। কাহিনীটি কি ভাবে আগাবে তা র্নিভর করে লেখক এবং পরিচালকের উপরে। সেই সাথে কিছুটা দায় ক্যমেরাম্যানেরও রয়েছে, কারণ তার চিত্র ধারনের পদ্ধতি কি, সেটাও সম্পাদনায় কম বেশী প্রভাব ফেলে। অপরদিকে শটের সাথে শটের জোড়াগুলোকে সাধ্যমত মসৃণ ও যুক্তিগ্রাহ করাই একজন সম্পাদকের কাজ।
এখন, কাহিনী শুধু সামনে এগিয়ে গেলেই তো হবে না। সেখানে যদি কিছু ইমোশন বা উত্তেজনা না দেয়া যায় তাহলে মানুষ কেন পয়সা খরচ করে সিনেমা দেখতে আসবে? ঠিক এই জায়গাটাতে মন্তাজের আবির্ভাব। একটা সরল সোজা জিনিসকে একটু ঘুরিয়ে বললেই সেটা শিল্প হয়ে যায়। যেমন, “বাঁশ বাগানে আসলে দেখা হবে”- এই সাদামাঠা কথাটাকে যখন ঘুরিয়ে বলা- “আসো যদি বাঁশ বাগানে আবার হবে দেখা বন্ধু আবার হবে দেখা” তখন সেটা গানের লাইন হয়ে যায়।
ঠিক তেমনি, নায়ক নায়িকাকে ছেড়ে চলে যেতে যেতে হঠাৎ করে ঘুরে আবার নায়িকার দিকেই ছুটে গেল, এর মাঝে কাহিনীর পরিসমাপ্তি আছে কিন্তু কোন অনুভুতি বা উত্তেজনা নাই। কিন্তু নায়ক নায়িকাকে ছেড়ে যখন দূরে যাওয়ার জন্যে হাঁটছে তখন যদি অতীতে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু দৃশ্যকে পর পর রিপিট করা যায় এবং তারপরে নায়ককে ঘুরে নায়িকার দিকে ছুটে যেতে দেখানো হয় তবে এই ছুটে যাওয়ার মাঝে স্বাভাবিক ভাবেই আলাদা একটা রিনরিনে অনুভুতি কাজ করে। আর এটাই হচ্ছে মন্তাজের মূলমন্ত্র।
মন্তাজের কাজ হচ্ছে মানুষের অনুভুতিতে নাড়া দেয়া। নাড়া দেয়ার ধরনের উপরে ভিত্তি করে মন্তাজকে মোট চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্লেইন (Plain) মন্তাজ, ডায়ালেকটিক (Dialectic) মন্তাজ, মেট্রিক্স (Matrix) মন্তাজ ও ইন্টেলেকচুয়াল (Intellectual) মন্তাজ।
প্লেইন মন্তাজ- একটু আগে যে উদাহরণ দিলাম নায়কের নায়িকার কাছে ফিরে যাওয়ার, এটাই প্লেইন মন্তাজ। বাংলা সিনেমায় এককালে এর ব্যাপক ব্যবহার হয়েছে। ইদানিং কালের বাংলা সিনেমায় এর ব্যবহার একটু কম দেখতে পাই। তবে হলিউডি বা বলিউডি সিনেমায় এর ব্যাপক ব্যবহার এখনও রয়েছে। “পিকে” সিনেমায় আমির খান যখন আনুশকার হাত ধরে তার পুরনো প্রেমিকের বিষয় জেনে নিচ্ছিল তখন পরপর পূর্বে দেখানো শট রিপিট করা হয়েছে। ঐ দৃশ্যটা নিশ্চয় আপনাদের মনে নাড়া দিয়েছে। যদি ওভাবে না দেখানো হত তবে কি এই অনুভুতির সৃষ্টি হত?
আবার হলিউডের “প্রি-ডেসটেইনড” সিনেমাটি যারা দেখেছেন তাদের নিশ্চয় মনে আছে সিনেমার শেষের দিকে যখন রহস্য খোলাসা করা হচ্ছে তখন বেশ কয়েক বারই আগের শটকে রিপিট করা হয়েছে। এটাও প্লেইন মন্তাজ। অনেকেই হয়ত বলবেন, এটা তো রোমান্টিক সিনেমা নয়, রহস্য বা থ্রিলার সিনেমা। তাহলে এখানে প্লেইন মন্তাজের বিষয়টা আসে কেমন করে?
আগেই বলেছি মন্তাজের মূল কাজ হচ্ছে অনুভুতিতে নাড়া নেয়া। সেই অনুভুতিটা যে শুধু রোমান্টিকই হবে তা আপনাদের কে বলল? প্লেইন মন্তাজে অনুভুতি সৃষ্টির জন্যে পূর্বে দেখানো কিছু শট রিপিট করা হয়। এখানেও পূর্বের শট রিপিট করে এক ধরনের অনুভুতির সৃষ্টি করা হয়েছে। সুতরাং এটা সর্ব অর্থেই প্লেইন মন্তাজ। অনেক সিনেমায় ভিলেনকে মারবার আগে নায়কের মনে পূর্বের কিছু স্মৃতি ভেসে উঠতে দেখা যায়, এটাও প্লেইন মন্তাজ। আপনার দেখা যতগুলো সিনেমা আপনি মনে করতে পারেন তার মধ্যে যেখানেই পূর্বের দেখানো একাধিক শটকে পরপর জুড়ে দিয়ে আপানার মাঝে কোন অনুভুতি বা উত্তেজনার সৃষ্টি করা হয়েছে, সবগুলো প্লেইন মন্তাজ। কেউ কেউ হয়ত বিষয়গুলোকে কাঁচা ভাবে দেখিয়েছে, কেউ বা নিপুন ভাবে। কিন্তু বিষয়টি যে প্লেইন মন্তাজ, এতে কোন সন্দেহ নাই।
ডায়ালেকটিক মন্তাজ- ইংরেজি Dialectic শব্দটির অর্থ হচ্ছে দ্বান্দ্বিকতা। দুটি বিষয়কে পাশাপাশি প্যারালাল কাটিংএর মাধ্যেমে দেখিয়ে যদি কোন অনুভতির সৃষ্টি করা হয় তবে সেটাকে ডায়ালেকটিক মন্তাজ বলে। এই ক্ষেত্রে শটগুলোর দৈর্ঘ্য কখনওই খুব বেশী হয় না। সেই সাথে পুরো বিষয়টার মাঝে একটা শুরু ও শেষ বা পরিনতি থাকে।
“ব্যটেলশীপ পটেমকিন” সিনেমাটিতে এই মন্তাজের উৎকৃষ্ট ব্যবহার রয়েছে। সিনেমার এক জায়গায় দেখানো হয়- একটি নাবিকের লাশ ডক ইয়ার্ডে রাখা হয়েছে, কাট। কিছু মানুষ এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে, কাট। আবার লাশের শট, কাট। আবার ঘুরে বেড়ানো মানুষের দৃশ্য, তবে এবার তারা লাশের বিষয়ে সচেতন, কাট। আবার লাশের শট, দুই এক জন মানুষ কাছে এসেছে, কাট। একজন লাশ নিয়ে কিছু বলা শুরু করল, কাট। লাশের কাছে মানুষ এগিয়ে যেতে লাগল, কাট। তারপর একবার লাশের শট, আরেকবার মানুষের এগিয়ে আসার শট। লাশের শট, মানুষের শট, লাশের শট মানুষের শট- এভাবে চলতেই থাকে এবং এক পর্যায়ে বিষয়টা একটা আন্দোলনে পরিনত হয়। এর পুরোটাই ডায়লেকটিক মন্তাজ। যদি শুধু লাশের ছবিটি টানা দেখানো হত যেখানে একটু একটু করে মানুষ জড় হচ্ছে তার পর সেটা আন্দোলনে রূপ নিচ্ছে তবে কি সেই আন্দোলন আপনাদেরও আন্দোলিত করত?
আরেকটি উদাহরণ দেই। আলেকজেন্ডার পুদভকিন পরিচালিত “মাদার” সিনেমাটিতে প্রথম থেকে দেখানো হয় দেশের অবস্থা খুব খারাপ এবং সময়টা শীতকাল। চারদিকে জমাট বাধানো বরফ। এক সময় মানুষ জেগে উঠল অন্যয়ের বিরুদ্ধে। সে সময় পাশাপাশি শীতও চলে যেতে লাগল। বরফ গলতে লাগল। মানুষ জেগে উঠছে, বরফের চাংগর ভেঙ্গে পড়ছে। মানুষ লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে, বরফ গলে পানিতে ভাসছে। মানুষ লড়াই করে জিতছে, তিরতির করে বরফ গলা পানি নদী হয়ে বয়ে যাচ্ছে। প্যারালাল কাটিংএর মাধমে দুটি বিষয়কে যখন পাশাপাশি দেখানো হয় তখন মনের মাঝে এক ধরনের অনুররণ জাগে।
চলবে......
২য় পর্বটি পড়তে ক্লিক করুন- Click This Link
©somewhere in net ltd.