নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইল্লু

ইল্লু › বিস্তারিত পোস্টঃ

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ) ধারাবাহিক

২০ শে জানুয়ারি, ২০২১ ভোর ৪:১২

৪) আমাকে ডেকে আনা,আবার

ছেলেটার মুখটা দেখে,বুঝতে কষ্ট হয়নি আমার মনে সাজানো সেকুরের চেহারায় অনেক ভুল।
সেকুরের মুখটা অর্হানের মুখটার মতই একটুঁ লম্বাটে,তবে যতদূর মনে পড়ে,তার থুতনি একটুঁ লম্বা,প্রিয়ার মুখটা বদলে গেছে,কল্পনা ছেড়ে বাস্তবতায় এক নতুন চেহারা।ঘুরতে ঘুরতে বার বছরে আমার কাছে ধরে রাখা সেকুরের মুখটা অন্যরকম হয়ে গেছে,ঠোট দুটো হয়ে গেছে আরও পুরু,ভরাট,লোভনীয়-অনেকটা টসটসে,লাল,রসাল চেরীর মত।

আমি যদি ভেনিসের ওস্তাদ চারুশিল্পীদের অনুকরণে আঁকা সেকুরের পোট্রেটটা সাথে নিয়ে যেতাম,তা হলে প্রেয়সীর মুখটা অচেনা হতো,না এ ভাবে।প্রিয়ার মুখটা যখন মনের খাতায় ধরা থাকে,তখন সারা পৃথিবীটাই তোমার আপনার।

সেকুরের ছোট ছেলেটাকে দেখে,মুখটা কাছে টেনে নিয়ে চুমু খেয়ে অদ্ভুত এক অনুভুতি তখন আমার মনে,অনেকটা খুনী আর পাপীদের মত।মনটা বলছিল,‘ছুটে যাও দেরী করো না,
আর’।

কিছুটা সময়,এনিস্টের উপস্থিতি ভুলে গিয়ে প্রতিটা দরজা খুলে খুঁজছিলাম সেকুরেকে,
আসার সময় চোখের কোন দিয়ে ঘরের দরজাগুলো আগেই গুনে নিয়েছি।পাঁচটা অন্ধকার দরজা যার একটা সিঁড়ি সেটা পার হয়ে দেখি সেকুরে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।কোন কিছু না বলাটাই ভাল তখন,প্রিয়ার সাথে প্রায় বার বছরের বিচ্ছেদ,বার বছর আগে মনের ঝড়ের কটা কথা বলেই আমার প্রেমের সমাপ্তি।ঠিক করলাম এখন শুধু এনিষ্টের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনবো আর চারপাশের সেকুরের ছোঁয়া জিনিষপত্রের মাঝে খুঁজে নিব আমার ছড়ানো হতাশার সান্তনা।

এনিষ্টে বললো,ইসলামের পবিত্র হিজরতের ১০০০ বছর পূর্তি উদযাপনের জন্য,আমাদের সুলতানের একটা বই বের করার ইচ্ছা।সুলতান ইসলাম সাম্রাজ্যের শক্তিশালী একজন,সারা পৃথিবী যার কাছে আশ্রয় খোঁজে,তার ইচ্ছা মুসলিম পঞ্জিকার হাজার বছর পূর্তিতে,সারা পৃথিবীর কাছে তার রাজত্বের সম্পদ প্রতিপত্তি,বিকাশ দেখানো,ওটাই তো মানানসই।বইটার দায়িত্ব সুলতানের নিজের হাতেই,নাম করা চারুশিল্পীরা যারা মোটামুটি সব সময় ব্যাস্ত তারা বাড়ী থেকে কাজ করার অনুমতি পেল,অবশ্য সবাই গোপনে এনিষ্টের সাথে দেখা করতো,
তার প্রতিনিধি হিসাবে,তাদের কাজের প্রগতি,অনুমোদেনের জন্য।

এনিষ্টে আমাকে বললো,‘তুমি ওস্তাদ ওসমান,প্রধান চারুশিল্পী,তার সাথে দেখা করবে’।অনেকে বলে সে নাকি অন্ধ হয়ে গেছে,আবার অনেকে বলে হারিয়ে গেছে তার অনুভুতির ইন্দ্রিয়টাও।
তবে আমার মনে হয় উনি অন্ধ আর বার্ধক্যে কিছুটা দিকজ্ঞান হারানো।

যদিও এনিষ্টে ওস্তাদ ওসমানের সমকক্ষ চারুশিল্পী না,আর যদিও চারুবিদ্যা তার দক্ষতার বিষয় না,তবুও সম্পূর্ন বইটার দায়িত্ব সুলতানের তার কাঁধেই দেয়া।যে কোন কারনেই হউক সুলতানের কথায়,বা উৎসাহে তার সাথে ওস্তাদ ওসমানের সম্পর্কটা এখন বেশ খারাপ।

ছেলেবেলার কথা মনে পড়ছিল,বাড়ীর আসবাবপত্র,চারপাশের জিনিষপত্রের সাথে আমার ফেলে আসা সময়ের জড়ানো স্মৃতি।বছর বার আগের কথা,তবু এখনও ঝকঝকে মনে পড়ে,
কুলা শহর থেকে আনা নীল পাথরের কারুকাজ করা মেঝে,তামার বদনা,কলসী,পর্তুগাল থেকে আনা কফিরকাপ,পিরিচ সবই যেন একই জায়গায়,একই রকম-যা আমার স্বর্গীয় খালা বেশ গর্ব করে দেখাতো।এই সব জিনিষপত্র,মুক্তা দিয়ে কাজ করা পড়ার টেবিল,দেয়ালে লাগানো পাগড়ীর আলনা,লাল ভেলভেটের মসৃনবালিশ,আকসারার বাসা থেকে নিয়ে আসা,যেখানে সেকুরের সাথে কেটেছে আমার ছোটবেলাটা।আজও আমার ছবি আঁকায় ছোটবেলার স্মৃতিটা অদ্ভুত একটা প্রভাব ছড়িয়ে দেয়।

ছবি আঁকা আর পড়াশোনা,পাঠকেরা যারা গল্পটা মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করে যাচ্ছে,তাদের এ টুকু বলতে দ্বিধা নেই,ও দুটোয় আমার জীবনের সব কিছুর উৎস।বই এর জগত,
কালিগ্রাফি,ছবি আঁকার ব্রাশ,ছবি,এ ছাড়া আর কিছু ছিল না আমার জীবনে।তারপর ভালবাসার আকাশ খুঁজতে গিয়ে স্বর্গ থেকে হলো আমার বিদায়।বছরের পর বছর কাটালাম নির্বাসনের যন্ত্রনায়,তবু কোনদিন দোষ দেইনি সেকুরেকে,বরং তার ভালবাসার প্রেরনায় সুবাদে আজ আমি একজন নামকরা চারুশিল্পী।জানতাম আমার ভালবাসার রাজ্যটা একদিন ফিরে পাবই,আর তার প্রচন্ডতার স্রোতে নতুন অজানা হবে,আমার জানা। শুধু ছবি আঁকা না একই ভাবে ব্যাস্ততা ছিল আমার ধর্মীয় পড়াশোনাতেও,ঠিক যে ভাবে এনিষ্টে আমাকে শিক্ষা দিয়েছিল।জীবনের প্রথম দিকটা ছিল যে ভাবে ভালবাসার ছোঁয়ায় সোনালী,আনন্দে ভঁরা-ঠিক সে ভাবেই পরের সময়টা ছিল প্রত্যাখানের সুরে বিষাক্ত,যেন চূলার শেষ আগুনের দপদপ করে জ্বলে যাওয়ার যন্ত্রনায় হারানো,জীবনটা ছিল অর্থহীন সেকুরের ভালবাসা ছাড়া।

‘তোমার কি জানা আছে’,এনিষ্টে কিছুক্ষন পরে বললো, ‘ভালবাসার দম্পতিদের দেখা হয় মৃত্যুর পরেও,ভালবাসার সুরটা হারায় না কখনও’।
‘না,ওটা আমার জানা ছিল না’।
‘বেশ দূরের একটা যাত্রা এই মৃত্যুপথ,মরণের ভয় নেই আমার,শুধু এটাই ভয় যে তার আগে সুলতানের বইটা শেষ করা হবে সম্ভব হবে কি না।

মানসিক ভাবে আমি বেশ দৃঢ়মনা,যুক্তিতর্কে এনিষ্টের চেয়ে কোন অংশেই কম না,প্রতিপত্তিও খুব একটা কম নাই এখন-তার জন্যে কেনা দামী পোষাক,কাজ করা রুপার বেল্ট,আর ঘোড়ার চামড়ার জিনের জন্য খরচ করতে আমার দ্বিধা হয়নি,কেন না ঐ লোকটার কারণে আমার জীবনটা সম্পুর্ন বদলে গেছে।

আমি এনিষ্টেকে বললাম,এই বার বছরে নানান সময়ে বিখ্যাত চারুশিল্পীদের কাছে যা কিছু শেখা আমার, বিস্তারিত সবকিছুই আলোচনা করবো পরে,আরেকদিন।বের হয়ে যাওয়ার আগে তার হাতে আলতো করে চুমু দিয়ে কপালে ঠেকালাম,সিড়ি দিয়ে নেমে আঙ্গিনা পার হওয়ার সময় মনে হলো আমি তো আর সেই ছোট ছেলেটা না,তবে আবার বুড়োও হয়ে
যাইনিঃআনন্দের আকাশ ছড়ানো আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে।আস্তাবলের দরজা বন্ধ করে দেয়ার পর একটা দমকা বাতাস এসে চমকে দিল আমাকে,আমার সাদা ঘোড়াটাকে রশি ধরে পাথর ছড়ানো আঙ্গিনা দিয়ে টেনে নিয়ে গেলাম,দুজনেই গা ঝাড়া দিয়ে শীতটাকে সরিয়ে দিচ্ছিলাম।মনে হচ্ছিল ঘোড়ার অস্থিরতা আর জেদী ভাবটা যেন আমার মনেরই প্রতিফলন।
রাস্তায় আসার পর তাড়াতাড়ি ঘোড়ার পিঠে চড়ে নাম করা সওয়ারীর মত ছুটে বের হয়ে গেলাম।গোলাপী রং এর এক ভারিক্কী চেহারার ইহুদী মহিলা হঠাৎ কোথা থেকে বের হয়ে এসে দাঁড়াল ঘোড়ার সামনে,ঘোড়া থামিয়ে আলাপ আরম্ভ হলো।বিশাল আর চওড়ায় বিরাট এক আলমারীর মতই চেহারা হবে,তবুও হাসিখুশী আর উচ্ছাসে ভরা।

‘আমার সাহসী সুপুরুষ বন্ধু,তোমাকে লোকে যে দেখতে সুন্দর বলে সেটাই একেবারেই যথাযথ’, সে বললো, ‘তা বিয়ে করেছ?নাকি এখনও একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছো?তুমি এসথার,ইস্তাম্বুলের সবচেয়ে নামকরা ফেরীওয়ালার কাছ থেকে তোমার প্রেমিকার জন্যে একটা সিল্কের রুমাল না নিয়ে গেলে কেমন দেখাবে’?
‘না,না লাগবে না’।
‘টকটকে লাল এটলাসের সিল্ক’?
‘না’।
‘না দেখেই,শুধু শুধু না বলো না,তোমার মত একজন সাহসী সুপুরুষ তার প্রেমিকার জন্যে কিছু নিয়ে যাবে না,এটা কি খুব একটা ভাল দেখাবে?কে জানে কতজন সুন্দরী মেয়ে তোমার জন্যে হাপিত্যেশ করে বসে আছে’?

তারপর অনেকটা দক্ষ খেলোয়াড়ের ভঙ্গীতে এসথার আমার কাছে এসে যেন আকাশ থেকে কিছু একটা বের করে দেখালো,একটা চিঠি।এই মুহুর্তের জন্যেই আমি অপেক্ষা করে ছিলাম,এ ভাবেই হাত থেকে চিঠিটা ছিনিয়ে,তাড়াতাড়ি করে আমার পকেটে ঢুকিয়ে রাখলাম।বেশ মোটা একটা চিঠি,উত্তেজনায় আগুনের ছটা ছড়ানো আমার শরীরে তখন।ঠিক যে ভাবে আসা এসথারের,সেই ভাবেই চলে গেল,সে।

আবার ঘোড়াতে যাওয়ার প্রস্ততি,তবে তখন আমি যেন অনভিজ্ঞ এক সওয়ারী।মনটা ছুটছিল ঘোড়ার গতিতে,উত্তেজনা বোধশক্তি হারানো আমি,হাতটাও যেন ভুলে গেছে কি ভাবে ঘোড়ার লাগামটা ধরতে,তবে আমার পা আর শরীর সবকিছু আয়ত্বের মধ্যে আনার চেষ্টা করছিল।
যেন এসথার বলায় এরপর ঘোড়া বেশ দৃঢ় পায়ে ধীরে ধীরে ছোট রাস্তায় নেমে এগিয়ে গেল।

রুপকথার গল্পের মত জানালায় জানালায় সুন্দরী মেয়েরা উঁকি দিয়ে দেখছিল,
আমাকে।যে আগুনটা আমাকে কিছুটা পুড়িয়েছে আগেই,সেটা আরও বিশাল হয়ে আমাকে গ্রাস করতে আসছে।এটাই কি আমার চাওয়া?আমি আবার জড়িয়ে যাচ্ছি সেই অসুখে যা এর আগেও আমাকে কম ভোগায় নি।মেঘের গোমরা মুখটা ছাড়িয়ে সূর্যটা হাসিমুখে নিয়ে বের হলো।

বেদানার গাছটা কোথায় ছিল,এখানে না অন্য কোথাও?এই মরা,পাতলা গাছটা কি এখানে ছিল?কোথায় গাছের পেছনের ডানদিকের জানালায় তো কেউ নেই,ঐ শয়তান এসথার কি আমাকে ঠকালো?
এই কথাগুলো যখন ভাবছিলাম,দেখি তুষারে ছেয়ে থাকা জানালাটা হঠাৎ শব্দ করে খুললো,
অভাবনীয় বিশাল এক বিস্ফোরণ,বার বছর পর তুষার ঢাকা গাছের ফাঁক দিয়ে দেখলাম আমার প্রেয়সীর মুখ,বরফের ছিটকে আসা আলোয়,বেহেশতের এক হুর যেন।

কাজল চোখের প্রেয়সী কি আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল নাকি বসে ছিল অন্য কোন মুখের আশায়?বুঝতে পারিনি,তার মুখটা কি হাসিতে ভঁরা ছিল,নাকি মুখটা সাজানো ছিল দুঃখে?
বেকুব ঘোড়া আমার মনটা বুঝতে পারছিস না,আস্তে আস্তে যা!ঘোড়ার জিনটা আরেকটুঁ নড়াচড়া করে আমার বসার একটুঁ আরাম করে নিলাম,যতক্ষন তার মুখটা দেখা যায়।

চিঠিটা খুলে দেখি তার ভেতরে আঁকা সেকুরেকে দেয়া আমার ছবিটা,ঘোড়ায় বসে জানালায় প্রেয়সীর মুখটা হাজার হাজার বার ভিন্ন ভিন্ন সুরে এঁকে গেলাম মনের খাতায়,যেন হুসরেভের শিরিনের সাথে প্রথম দেখার দৃশ্য,শুধু আমার এ দৃশ্যে একটা মরা শুকনো গাছ ছিল,মাঝখানে।এই সাদৃশ্যের কথা যখন মনে হলো, নানান বই লেখা ভালবাসার কাহিনী,ছবি যা আমাদের আবেহের স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যায়,সেই ভালবাসার আগুনেই আমি পুড়ে যাচ্ছে,আমার শরীর,মন।


আমি এসথার

এটা নিশ্চয় সকলেরই জানার ইচ্ছা ব্ল্যাককে দেয়ায় সেকু্রের চিঠিতে কি লেখা,আমার জানার ইচ্ছাটাও তো কম না।অবশ্য আমার যতটুকু জানার জেনেই ফেলেছি,আর তোমরাও যদি জান,তবে ভান কর না জানার,সময়ের পাতা কিছুটা উল্টে দিয়ে,আমাকে বলতে দাও কি ঘটেছে।

এখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসছে,আমি ইহুদীদের এলাকায় আমার বাড়ীটায় বসে আরাম করছি,সাথে নেসিম,দুজন বুড়ো মানুষ নাড়াচাড়া করে কোনভাবে শীত এড়ানোর চেষ্টা করছি।যাকগে আমি নিজেকে যে বয়স্ক বলছি তা নিয়ে অযথা কোন তর্ক,বির্তক করার দরকার নেই।আমি জিনিষপত্র ফেরী করি-সস্তার আংটি,কানের দুল,গলার হার,খেলনা-সস্তা যদিও দেখতে বেশ দামী-সিল্কের রুমাল,দস্তানা,বিছানার চাদর,সার্টের মধ্যে সাজানো,যা পর্তুগীজরা জাহাজে নিয়ে আসে।কাঁধে নিয়ে ঘুরি চামচ,কেটলী এগুলোও সাথে ইস্তাম্বুলের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি।এমন কোন মুখরোচক খবর বা চিঠি নেই যা আমি এক বাড়ী থেকে আরেক বাড়ীতে পৌঁছে দেইনি,আর ইস্তাম্বুলের অর্ধেক সুন্দরীদের ঘটকালী তো আমারই হাতে,তবে কেউ যেন মনে না করে আমি বড়াই করে কিছু বলছি।যাক যা বলছিলাম সন্ধ্যার দিকে বসে আছি ঘরে,ঠিক তখনই ‘ঠক,ঠক,কেউ একজন দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিল।
দেখলাম দরজায় হারিইয়ে,বোকা ক্রীতদাসী মেয়েটা,তার হাতে চিঠি,ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি শীতে না উত্তেজনায় কাপছিল মেয়েটা যখন সে সেকুরের কথাগুলো বলছিল।

ভাবলাম চিঠিটা বোধহয় হাসানের কাছে নিয়ে যেতে হবে,তাই কিছুটা অবাক আমি তখন।
সবাই জানে সেকুরের স্বামীর কথা,বছর চারেক যুদ্ধে যেয়ে আর ফিরে আসে নি,আমার কেন জানি মনে হয় সে কোথাও লুকিয়ে আছে।যাকগে,সেকুরের হারিয়ে যাওয়া স্বামীর ভাই হাসান, যে সেকুরের প্রেমের পাগল,কিন্ত চিঠির নামটা দেখে অবাক আমি,সেটা তো হাসানের জন্য না,অন্য কারও জন্যে।চিঠিতে কি লেখা?এসথারের মনটা তো বিচলিত হয়ে উঠলো,জানার জন্যে,শেষ পর্যন্ত জানতে অবশ্য আমার তেমন কষ্ট হয়নি,যদিও।

এটা না বলে পারছি না,মানুষ মানুষকে কতটুকুই বা চেনে?সত্যি কথা বলতে কি সবকিছু জানার জন্যে,আমার মনটা ছিল চিন্তায় আর উত্তেজনায় বেশ অস্থির।কি ভাবে আমি চিঠিটা পড়লাম সেটা কেউ জানবে না কোনদিন।অনেকেই হয়তো বলবে,‘এটা অবিশ্বাস্য,অন্যের ব্যাপারে এ ভাবে নাক গলানোর কোন মানে হয় না-কিন্ত নাপিতদের মত কার না উৎসাহ আছে।যাকগে এটা আমাদের সুন্দরী সেকুরের লেখা কথাগুলোঃ

‘ব্ল্যাক এফেন্দী,তুমি আমাদের বাড়ীর একজন মেহমান,আমার বাবার সাথে তোমার সম্পর্কটাও বেশ ভাল।কিন্ত ভেবে নিও না এটা তোমার প্রেমের অনুভুতির সম্মতি,অনেক কিছু এ জীবনটায় যা হয়তো তোমার জানা নেই।আমার বিয়ে হয়ে গেছে,দুটো ছেলেও আছে,
যাদের দুষ্টামি আর লাফালাফিতে আমি সবসময়ই ব্যাস্ত থাকি।একজন অর্হান যাকে তুমি দেখেছ,বাবার ছবি আঁকার ঘরে।এই যে বছর চারেক আমি অপেক্ষা করে আছি স্বামীর জন্যে,কোন সময় আর কারও কথা মনে আসেনি কোনদিন।জানি আমি একটা দূর্বল মেয়ে মানুষ,যে বুড়ো বাবা,আর দুই ছেলের সাথে জীবনটা কাটিয়ে যাচ্ছে।জানি একটা পুরুষের সাহস,সহায়তা নেই আমার জীবনে যদিও,তবে তাই বলে কেউ যদি ভাবে সেটার সূযোগ নিবে,তবে নিশ্চিতে সে ভুল করবে।একটা অনুরোধ করছি,তুমি যেন আমাদের বাড়ীতে অযথা আর এসো না।হয়তো তমার জানা নেই,এর আগেও তোমার জন্যে বাবার কাছে অনেক গালাগালি খেয়েছি,আর তার বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতেও আমাকে কম কষ্ট করতে হয় নি।চিঠিটার সাথে সাথে তোমার আঁকা ছবিটাও ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছি।জানি না তোমার কি ধারণা,শুধু একটা ছবি দেখে কেউ কি কারও প্রেমে পড়ে?অনুরোধ করছি আবার,সবচেয়ে ভাল হয় তুমি যদি আমাদের বাসায় আর না আস’।

আমার প্রিয় সেকুরে তুমি কোন পাশা বা বিরাট প্রতিপত্তিশালী কিছু একটা না।সেকুরে তার চিঠিটায় অনেকটা রাজকীয় নিয়মে বিশেষ একটা পাখীর ছবিতে তার নামের অক্ষরটা দিয়ে শেষ করেছে।
অবশ্য কেউ যেন সন্দেহ না করে বলে,বন্ধ করা চিঠিটা কিভাবে আমি পড়ে ফেললাম,চিঠিটা তো বন্ধ করাই ছিল না।আর এসথার তো মূর্খ এক ইহুদী না, ‘হয়তো আমার প্রিয় সেকুরে যা ভেবেছে’।সে হয়তো আমার লেখাটা ঠিক বুঝে উঠতে পারবে না,আর আমি তো অন্য কাউকে দিয়েও লেখাটা পড়িয়ে নিতে পারি।আর যা লেখা নেই সেটাও আমি পড়ে নিতে পারি।কি বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে?

যারা মোটা মাথার লোকজন তাদের জন্য আরেকটুঁ পরিষ্কার করে বলিঃ
চিঠিতে শুধু অক্ষর দিয়ে যোগাযোগ বা লেখা হয় না।চিঠিটা অনেকটা একটা বই এর মত,যা মানুষ বোঝার চেষ্টা করে ছোঁয়ার,ঘ্রানের আর আদরের অনুভুতিতে।বুদ্ধিমান যারা তার ফেলবে, ‘যাও পড়েই দেখ,চিঠিটা কি বলে’?আর যারা নির্বোধ তার বলবে, ‘যাও পড়ে দেখ,কি লেখা আছে চিঠিতে’?যাকগে এখন সেকুরের চিঠির বাকী রহস্যটা বলিঃযদিও সেটা লেখা নেই কোথাও,তবুও বলা,

১)চিঠিটা গোপনে এসথারের হাতে পাঠালাম,চিঠি দেয়া নেয়া যার আরেকটা ব্যাবসা।এ জন্যেই এ কথাগুলো বলছি যে আমার কথাগুলো গোপন করার ইচ্ছা নেই আমার।

২)আমি চিঠিটা ফ্রেঞ্চ প্যাস্ট্রীর মত ভাঁজ করে পাঠালাম,যেটাতে গোপনীয়তা আর লুকানোর চিহ্ন আছে।তবে চিঠিটা বন্ধ করা নেই আর ওটাতে বিরাট একটা ছবি আছে।এটাতে যেন বলা, ‘দোহাই,এ রহস্যটা যেন আর কেউ না জানে’,ভঙ্গীটা অনেকটা প্রেমের একটা চিঠি’।

৩)চিঠির গন্ধটা অনেকটা বলে দেয় আমার সন্দেহটা,ঠিক।হাল্কা একটা সুগন্ধি ছুটে আসছিল চিঠিটা থেকে,সুগন্ধিটা যেন ইচ্ছা করেই দেয়া।তবে আমি ঠিক বলে দিতে পারবো না,এটা আতরের গন্ধ না,তার হাতের?আর এই সুগন্ধি যা মাতোয়ারা করলো যে লোকটা চিঠি পড়লো যে ভাবে,নিঃসন্দেহে ব্ল্যাকের উপর তার চেয়ে কিছু কম হবে না।

৪)আমি এসথার,পড়তে ও জানিনা,লিখতেও জানিনা,কিন্ত এটুকু জানি লেখার ধরণ স্রোতটা বলে দেয় মনের কথা।এমন কি অর্হানকে নিয়ে বলা কথাগুলোর ভাব,যেন চিঠিটা তখনই লেখা।

৫)চিঠির সাথে পাঠানো শিরিন হুসরেভের একটা ছবি-অদ্ভুত এক ছোঁয়াচে তুলে ধরা তাদের প্রেমের কথাগুলো,যেটা এই বোকা ইহুদীও জানে।ইস্তাম্বুলের প্রেম পাগল সবাই জানে শিরিন হুসরেভের কাহিনী,তবে কেউ কোনদিন ছবিতে এ ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেনি।


তোমরা যারা শিক্ষিত আর ভাগ্যবান তাদের জানাই,প্রায়ইঃ সুন্দরী মেয়েরা তার প্রেমের চিঠি নিয়ে গর্ব করে যদিও হয়তো জানা নেই,কি ভাবে পড়তে হয়।চিঠি অবাক করে মনটাকে,
উত্তেজনায় বিচলিত চিঠি পাওয়া মানুষটা আবার শুনতে চায় কথাগুলো।তবে চিঠিটা পড়তে পড়তে যে পড়ে আর যে শোনে দুজনাই মনের খাতায় ধরে রাখে।তারপর চিঠিটা হাতে নিয়ে সে জিজ্ঞাসা করবে, ‘আচ্ছা এখানে কি এই কথাগুলো লেখা আছে’?তারপর আঁকাবাঁকা অক্ষরগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকবে,মাঝে মাঝে আমিও ভুলে যাই,আমি যে পড়তে জানিনা।

তারপর আছে ঐ অভাগা মানুষ যারা চিঠি পড়ে দেয়ঃদোয়া কর,যেন তুমি তাদের একজন না হও।একজন প্রেমিকা যখন প্রেমিকের চিঠিটা হাতে নেয়,তার কাছে অজানা তখন অক্ষরের ঐ পিশাচগুলো তাকে কি বলবেঃ ‘কি করছো তুমি,তুমি তো পড়তেই জান না?পড়তে জান না,তবে কেন অযথা তাকিয়ে আছ অক্ষরগুলোর দিকে’?অনেকে যারা চিঠিগুলো পড়ে দেয়,অনেকসময় ফেরতও দেয় না,যেন চিঠিটা তার কাছেই লেখা।অনেক সময় ঐ চিঠি উদ্ধার করার দায়িত্ব পড়ে আমার কাঁধে,এসথারের।এ ধরণের মানুষ,আমি।এসথার যদি তোমাকে পছন্দ করে,সে তোমার সাহায্যের জন্য সবকিছু নিয়ে এগিয়ে যাবে,জীবন দিতেও কার্পন্যও করবে না।


আমি,সেকুরে


কেন আমি দাড়িয়েছিলাম জানালার ধারে,যখন ব্ল্যাক তার সাদা ঘোড়ায় চড়ে চলে যাচ্ছিল?কেন আমি ঠিক সেই মুহুর্তেই জানালাটা খুললাম আর তুষারে ছেয়ে থাকা বেদানা গাছের ফাঁক দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম?আমি নিজেও জানি না।আমি হাইরিয়েকে দিয়ে এসথারের কাছে যখন খবর পাঠালাম,এটা ঠিক জানতাম,যে ব্ল্যাক ঠিক ঐ রাস্তাটাই দিয়ে যাবে,এর ফাঁকে আমি দেয়ালের আলমারী যেটা বেদানা গাছের দিকে সাজানো,সেখানে চাদরগুলো দেখছিলাম।কোন এক মুহুর্তে আমি,সবশক্তি জড়িয়ে জানালাটা খুলে দিলাম,সূর্যের হাসিটা সারা ঘরটার চেহারা বদলে দিল।জানালার সামনে ব্ল্যাক,ওর চেহারাটা সূর্যের আলোর মতই আমার মনটাকে নতুন চমকের রাজ্যে নিয়ে গেল।

কৈশোরের সেই পাতলা,খিটখিটে চেহারা এখন যৌবনের সৌন্দর্যে ভঁরা এক সুপুরুষ।শোন সেকুরে,তোমার মন বলছে,ও শুধু দেখতেই ভালে না,ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখ,একটা শিশুর মনের পবিত্রতা,একাকীত্বতা ঐ সুপুরুষ শরীরটায়,ওকে বিয়ে কর।যদিও আমি তাকে যে চিঠিটা পাঠালাম,তাতে আমার ভাষাটা ছিল সম্পুর্ন উলটো।

যদিও যখন বার বছর বয়সে,ও ছিল আমার চেয়ে আরও বার বছরের বড়,তবুও আমি ছিলাম ওর চেয়ে যে কোন অভিজ্ঞতায় অনেক এগিয়ে যাওয়া।সেই বয়সে যৌবনের সুরে লাফালাফি না করে,ও শুধু বই এর পাতায় না হয় ছবিতে ডুবে থাকতো,কোন মেয়ে দেখলেই বেশ অপ্রস্তত হয়ে পড়তো।আমার প্রেমে পড়ে গেল ব্ল্যাক,আর শুধু ছবি এঁকেই তার ভালবাসার প্রকাশ করতো।
মনে হতো ব্ল্যাক আমার চোখে কখনও সাহস করে তাকাবে না,সাহস ছিল না তার চোখে চোখে ভালবাসা প্রকাশ করার।হয়তো বললো,‘আমাকে ঐ হাতীর দাঁতের চাকুটা দিবে’,তবে চোখটা তার চাকুর দিকে,এর মাঝে একবারও তাকায়নি আমার দিকে।আমি যদি তাকে জিজ্ঞাসা করতাম, ‘এই চেরীর সরবতটা কি তোমার পচ্ছন্দ হয়েছে’?কিন্ত তার উত্তর কোনদিনই দেয়নি কথায়, একটা হাসিতে বা মাথা নাড়া দিয়ে,অনেক সময় চীৎকার করে বলতো, ‘হ্যা’,যেন আমি ঠসা বা ঐ ধরণের কিছু।তখন তো আমি দেখতে বেশ সুন্দরী তবুও সে ভুলেও চোখ তুলে আমার চোখে চোখ রাখে নি।আমি এটা কোন বড়াই করে কিছু বলছি না,সে সময় যে কোন পুরুষ পর্দার আড়ালে,বারান্দায়,এমন কি আমার হেজাবের আড়ালেও যদি একটুঁ দেখে থাকে,ভুলতে পারে নি আমাকে।আমি এগুলো এ কারণেই বলছি,সবাই যেন বুঝতে পারে আমার দুঃখ আর হতাশাটা।

একবার হুসরেভ আর শিরিনের খ্যাতনামা প্রেমের কাহিনী,কিছু সময়ের জন্যে আমি আর ব্ল্যাক নিয়ে আলোচনা করেছিলাম।হুসরেভের বন্ধু শাপুর,চেষ্টা করছিল কি ভাবে দুজনকে প্রেমের ফাঁদে আটকানো যায়।একদিন শিরিন তার বান্ধবীদের নিয়ে শহরের বাইরে কোথাও বনভোজনে গেছে,সেখানে শিরিন গাছে ঝোলানো হুসরেভের ছবিটা দেখলো,শাপুর যেটা গোপনে ঝুলিয়ে রেখেছিল।সুদর্শন হুসরেভের ছবি দেখে অভিভুত শিরিন আর প্রথম দেখায় প্রেমে উদ্বুদ্ধ।অনেক ছবিতে আঁকা এই প্রেমের দৃশ্য,শিল্পীরা তুলে ধরেছে শিরিনের অভিভূত দৃষ্টি নানান যখন আমার বাবার সাথে কাজ করতো তখন সে শিরিনের এই দৃশ্যটা একেবারে হুবুহু নকল করেছিল দুটো ছবি।তবে প্রেমে পড়ার সে যখন নতুন একটা ছবি আকলো তখন সেটাতে ছিলাম আমি আর সে,ব্ল্যাক আর সেকুরে।যদি নীচের ক্যাপশান দেয়াও না থাকতো,
তবুও আমি জানতাম,পুরুষ আর নারীটা কে,কেন না আমি যখন হাসি ঠাট্টা করতাম,সে মাঝে মাঝে আমাদেরকে নিয়ে ঠিক রং দিয়ে তুলে ধরতো।নীল রং এ আমি,আর লাল রং এ সে।তবে সেটা যদি যথেষ্ট না হয়ে থাকে,তাই নীচে লেখা দেয়া নাম দুটো আরও জোর দিয়ে বলা ভালবাসার কথা কটা।সে ছবিটা এমন ভাবে রেখে গেছে যাতে খুঁজে পেতে কোন কষ্ট না হয়,আর ছবিটা দেখে আমার প্রতিক্রিয়াটা কি হয়,তার অস্থির মনটার নিজেতে নিজেতে জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছিল।


এটা জানতাম শিরিনের ভালবাসার উচ্ছাস আমার নেই,তাই আমি বুঝেও না বোঝার ভান করতাম।গরমের সময় এক সন্ধ্যায় ব্ল্যাক যখন ছবিটা দিল,আমরা বসে বসে উলু পাহাড়ের বরফের চেরীর সরবত খাচ্ছিলাম।আমি বাবাকে বললাম ব্লেকের প্রেম নিবেদনের কথা,ব্ল্যাক তখন সবেমাত্র মাদ্রাসার লেখাপড়া শেষ করেছে,আর দূরের গ্রামে ছাত্রদের শেখাতে যেত,সেটা আমার বাবার নির্দেশে।ব্ল্যাক চেষ্টা করছিল কোনভাবে যদি নাইম পাশার অনুগ্রহে আসা যায়।


মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২০ শে জানুয়ারি, ২০২১ দুপুর ১২:৫৬

রাজীব নুর বলেছেন: হিজরতের ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সুলতানের বই। বিষয়টা ভালো লেগেছে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.