নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইল্লু

ইল্লু › বিস্তারিত পোস্টঃ

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ) ধারাবাহিক

২৭ শে এপ্রিল, ২০২৩ রাত ১২:৪৪

ফেনিত অর্হান পামুক
জন্মঃ জুন,১৯৫২
তুরস্কের খ্যাতনামা এক উপন্যাস লেখক
২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান
খ্যাতনামা লেখার মধ্যে My name is red,Silent house,white castle আরও অন্যান্য অনেক লেখা
(৯)

বে

বেহেশতের অধিবাসী,আইনদাতা,আমাদের মহামান্য সুলতান সুলেয়মান খান-কালিগ্রাফারদেরকে পছন্দ করতো অঙ্কন শিল্পীদের চেয়ে অনেক বেশী,হতভাগা অঙ্কন শিল্পীরা মনে করে সেই সময়কার কথা যখন কালিগ্রাফারদের প্রাধান্য ছিল,দুঃখে তাদের মন ভরে যায়।তবে যারা বোঝে,তারা জানে,এই গল্পটা আসলে স্মৃতি আর অন্ধত্ব নিয়ে।
তৈমুর লং,পৃথিবীর শাসনকর্তা,তার ছেলে,নাতিরা একে অন্যকে আক্রমন করা আরম্ভ করলো ক্ষমতা দখল নিয়ে।যখনই কোন একজন একটা শহর দখল করতো,তার প্রথম কাজ ছিল নতুন মোহর ঢালাই আর মসজিদে তার জয়ের ঘোষনা।দ্বিতীয় কাজ ছিল,
দখলে আসা পুরোনো বই ছিঁড়ে ফেলে নতুন বই লেখার প্রস্ততি,বিজয়ীর কাহিনীতে উৎসর্গ করা সম্পূর্ন বই,পৃথিবীর নতুন ক্ষমতাশালী শাসক হিসাবে,বই এর শেষ পাতাটা নতুন করে সাজানো,নতুন করে বাঁধাই বইটা দেখলে যে কারও মনে হবে এ এক ক্ষমতাশালী শাসনকর্তার জীবন কাহিনী।
যখন তৈমুর লং এর নাতি উলুগ বেগের ছেলে আবদুল লতিফ হেরাত দখল করলো,সে তার নিজের শিল্পী,কালিগ্রাফারদের জমায়েত করে আদেশ করলো,তার বাবা উলুগ বেগের জীবনী,বিজয়ের ইতিহাস নিয়ে একটা বই তৈরী করার জন্যে।তাড়াহুড়াতে শিল্পী,
কালিগ্রাফেরা এলোপাথাড়ি মিশিয়ে একটা জগাখিচুড়ী করে ফেললো।উপায় না দেখে আবদুল লতিফ হেরাতের শিল্পীদের একত্র করে বই এর পাতা যথাযথ ছবি দিয়ে তৈরী করতে বললো।কিন্ত একেক জন শিল্পীর মনে ঘটনাগুলো সাজানো ছিল একেকভাবে,তাই ছবিগুলো দিয়ে সমস্যার কোন সমাধান হলো না।আরম্ভ হলো সবচেয়ে বৃদ্ধ শিল্পীর খোঁজ,অন্ধ হয়ে গেছে,আর আবদুল লতিফের অনুরোধে তার কাজ হলো গত পঞ্চাশ বছরের শাহজাদা শাহজাদীদের ছবি আঁকা।
তাকে দেখে অনেকেই বেশ হাসাহাসি করলেও,সবকিছু উপেক্ষা করে ওস্তাদ শিল্পী বললো,এমন একজন বাচ্চা ছেলেকে আনতে,য়ার বয়স সাত,আট বছর,আর কোন লেখপড়া জানে না।আবদুল লতিফের পাশ্বর্চরেরা একজন ছেলেকে খুঁজে আনলো,শেষমেষ।
বুড়ো শিল্পী ছেলেটার সামনে কটা ছবি রেখে,তাকে প্রশ্ন করা আরম্ভ করলো, ‘বল,কি দেখছো,তুমি’?ছেলেটার বর্ননা শুনে বুড়ো শিল্পী আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আলেকজান্ডার মৃতপ্রায় দারিয়ুসকে শুইয়ে দিচ্ছে ওটা লেখা ফেরদৌসীর শাহনামায়’
...সাদীর ছাত্রের প্রেমে পড়া যাওয়া শিক্ষকের গল্প...বোস্তান...ডাক্তারদের প্রতিযোগীতা নিজামীর...মাকজান আল আসরার।অন্যান্য শিল্পীরা,বুড়ো শিল্পীর স্মৃতি দেখে মন্তব্য করলো, ‘ওখানে অবাক হওয়ার কি আছে,ওটা তো আমাদেরও জানা ছিল,ওগুলো তো সবগুলোয় নামকরা কাহিনীর অংশ’।এর পর বুড়ো শিল্পী ছেলেটার সামনে বেশ কঠিন কিছু ছবি দিতে বললো,একই ভাবে ছেলেটার বর্ননা শুনে আকাশের দিকে তাকিয়ে বর্ননা করা আরম্ভ করলো, ‘এক এক করে কালিগ্রাফারদের বিষ খাওয়ানো্‌…ফেরদৌসীর শাহনামা’, ‘সস্তা অনুকরণ রুমীর মাসনাভীর...নাসপাতি গাছের নীচে স্বামীর হাতে অসতী স্ত্রী আর তার প্রেমিকের ধরা’।এ ভাবেই একের পর এক বুড়ো শিল্পী ছেলেটার বর্ননা শুনে বলে গেল সব দৃশ্যগুলো,আর আবদুল লতিফের বই বাঁধাইকার যথাযথ বইগুলো শেষ করলো।
যখন উলুগ বেগ সৈন্যসামন্ত নিয়ে হেরাতে পৌছালো,সব ঘটনা শুনে তার কৌতুহলের শেষ ছিল না,জানতে চাইলো বুড়ো শিল্পীর কাছে,অন্যান্য ওস্তাদেরা চোখে দেখেও যা বলতে পারেনি,কি ভাবে সেটা তার পক্ষে সম্ভব হলো?

‘অনেকে হয়তো ভাবতে পারে,অন্ধত্ত্বে আমার স্মৃতি আরও প্রখর হয়ে গেছে,কিন্ত তা না প্রতিটা ছবির সাথে একটা গল্প আছে’।উলুগ বেগ বললো,’আমার শিল্পীরা সেটা খুজে পাই নি,কেন’।‘তারা শুধু ছবি আঁকতেই জানে,কিন্ত তাদের জানা ছিল না পুরোনো ওস্তাদদের ছবিগুলো আঁকা আল্লাহর কথা মনে রেখে’।উলুগ বেগ প্রশ্ন করলো, ‘একটা সাত বছরের পক্ষে সেটা কি ভাবে দেখা সম্ভব’? ‘ছেলেটা জানে না’,বুড়ো শিল্পী উত্তর দিল, ‘তবে একজন বুড়ো শিল্পী জানে,আল্লাহর তৈরী এই পৃথিবী একজন সাত বছরের ছেলের কাছেও দূর্বোধ্য না,সেখানে কথা সুর যোগ দেয়া আছে,যাতে আমরা একে অন্যের সাথে আদানপ্রদান করতে পারি।আমরা অনেক সময় ভুল করে ভাবি,গল্প শুধু ছুটে আসা ঐ শব্দগুলো থেকে আর ছবিগুলো শুধু গল্পের কথাগুলোকে সাহায্য করার জন্যে।কিন্ত বিপরীতটাই সত্যিই ছবির মাধ্যমে আমরা পৌঁছাতে চেষ্টা করি আল্লাহর স্মৃতিতে,পৃথিবীর কিছুটা তার চোখে দেখার চেষ্টা’।


মিম


তা প্রায় দুইশ পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা,আরবের শিল্পীরা তখন অন্ধ হওয়ার ভঁয়ে শুধু গোধুলির আকাশ ছাড়া অন্য কোন সময় আলোর দিকে তাকাতো না।একই কারণে,একই ভাবে প্রায় একশ বছর পরে আরও কিছু শিল্পীরা সকালে খালি পেটে আখরোট গোলাপের পাপড়ির সাথে মিশিয়ে খাওয়া আরম্ভ করলো।আবার ইস্পাহানের শিল্পীরা ভাবতো,অন্ধত্বের কারণ যেহেতু সূর্যের আলো,তাই ঘরের আলোআঁধারি কোনায় বসে বসে ছবি আঁকাটাই ভাল,সুর্যের কোন ছোঁয়া যেন না পড়ে তাদের কাজের টেবিলে।দিনের শেষে কাজের পরে বুখারার,উজবেক শিল্পীরা তাদের চোখ ধুয়ে ফেলতো শেখদের দোয়া পড়া পানি দিয়ে।এত সব কিছুর পরে অন্ধত্বের সবচেয়ে ভাল উপমা ছিল হেরাতের সৈয়দ মেরেকের কাছ থেকে,খ্যাতনামা শিল্পী বিহজাদের পরামর্শদাতা আর ওস্তাদ হিসাবে নাম ডাক ছিল আত্র।ওস্তাদ শিল্পী মিরেকের মতে অন্ধত্ব কোন অভিশাপ না,ওটা আল্লাহর উপহার শিল্পীদের জন্যে,যাদের সারাটা জীবন কেটে গেছে আল্লাহর মহত্ব তুলে ধরতে।এটা তখনই সম্ভব যখন সারাটা জীবন ছবি আঁকতে আঁকতে অন্ধ হয়ে যাওয়ার শিল্পীর আঁকা ছবিগুলো যেন সবই আল্লাহর চোখে দেখা,তুলির টান যেন স্মৃতির পাতা থেকে টেনে আনা।এই অন্ধত্ব সওয়াবের মত নেমে আসে শিল্পীর চোখে যে ভাবে আল্লাহ দেখে অন্ধকার,আর স্মৃতির ঐ রাজ্যে পৌছানোর আশায় শিল্পী সারাজীবন অভ্যাস করে যায় তুলির টান দিয়ে।ঐতিহাসিক মির্জা মুহাম্মেদ হায়দার দুলগাতের,হেরাতের শিল্পীদের নিয়ে একগাদা লেখা আছে,সেখানে ওস্তাদ সৈয়দ মেরেকের একজন শিল্পীর ঘোড়া আঁকা ছবি নিয়ে বেশ কিছু গল্পও আছে।আর ও বিস্তারিত ভাবে চিন্তা করে যায়,শিল্পীরা সারাজীবন কাজ করে যায় এই অন্ধত্ব আর স্মৃতির অন্ধকার পৌঁছানোর আশায়,ঐ সব শাহজাদা,
সুলতান,শাহদের সেই পর্বটার একটা অংশ মাত্র।
দিনের দিন শিল্পীরা ছবি আঁকতো.২১৭,রাতে মোমবাতির আলোয় খুঁটে খুঁটে আনন্দ খুঁজে নেয়া,তারপর এক সময় পৌঁছে যায় সেই অন্ধকারের রাজ্যে।ওস্তাদ সৈয়দ মেরেক যেন সেই অন্ধত্বে ছুটে যাওয়ার জন্যে এঁকে গেছে,চালের কণায়,ধানের শীষে,নখের উপরে এঁকে গেছে নানান ছবি।ওস্তাদের বয়স যখন সত্তর,উপহার হিসাবে সুলতান হুসেন বাইকারার খাজাঞ্চীখানার বইগুলো দেখার সুযোগ হলো।

খাজাঞ্চীখানায় ছিল সোনাদানা,দামী হীরা জহরত,অস্ত্রশস্ত্র,দামী সিল্ক,ভেলভেট,এক পাশের ঝাড়বাতিতে,ওস্তাদ সৈয়দ মেরেক পুরোনো ওস্তাদদের আঁকা ছবি দেখতে দেখতে তিনদিনেই অন্ধ হয়ে গেল।অন্যান্য যে কোন মহাপুরুষের মতই ওস্তাদ সৈয়দ মেরেক মেনে নিল ভাগ্যের পরিহাস,কোন অভিযোগ ছিল না তার,আর কোনদিন ছবির কথা বলে দুঃখও করেনি।

মির্জা মুহাম্মেদ হায়দার দুলহাতের লেখা ‘রাশীদের ইতিহাসে’,ঘটনাগুলো এ ভাবেই বলাঃ ‘একজন শিল্পী যার আল্লাহর মহান দৃষ্টি আর সময়ের কাছাকাছি পৌঁছানোর সূযোগ হয়,তার পক্ষে মানুষের জন্যে তৈরী বই এর পাতার কাছে যাওয়া আর সম্ভব হয় না’,এটাও বলা আছে তার বইএ, ‘একজন শিল্পীর স্মৃতি যখন পৌছায় আল্লাহর দরজায়,সেখানে আর কিছু নেই আছে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা,অন্ধকার আর শূন্যতার রাজ্য’।

যাই হোক আমি যখন ওস্তাদ ওসমানের অন্ধত্ব আর স্মৃতির গল্পটা বলছি,সিয়াহর দৃষ্টি ছিল তখন আমার ঘরের এপাশ ওপাশে ছড়ানো ছবিগুলোতে।তবে দেখে কিছুটা ভালই লাগলো,যে গল্পটা শুনে সে বেশ কিছুটা বিচলিত।‘অন্ধত্ব এক ধরনের আর্শীবাদ যেখানে পাপবোধ আর শয়তানের কোন অস্তিত্ব নেই’,আমি বললাম।

‘তাব্রিজে’,সিয়াহ বললো, ‘ওস্তাদ মেরেকের প্রভাবে অনেক শিল্পীই ভাবতো অন্ধত্ব শিল্পীর আল্লাহর কাছ থেকে দেয়া সবচেয়ে বড় উপহার,নিজেদেরকে বুড়ো ভাবতে লজ্জা হতো তাদের,তবে অন্ধ হওয়াতে আপত্তি ছিল না কারও।ঐ জন্যেই আজও অনেক শিল্পীই প্রতিভার অভাবে অন্ধ হওয়ার ভান করে।এই মানসিকতার জন্যে কাজভিনের জেমালুদ্দিনের প্রভাবে,তাদের অনেকেই অন্ধকারে চারপাশে আয়নায় সপ্তাহের সপ্তাহ বসে থাকে,হাল্কা আলোয়,খাওয়া দাওয়া নেই,শুধু হেরাতের পুরোনো ওস্তাদদের ছবির দিকে তাকিয়ে উপলদ্ধি করার চেষ্টা করে ছবিতে সাজানো সুর,একজন অন্ধ মানুষের সুরে’।

কেউ একজন দরজায় ধাক্কা দিল,দেখি নীল চোখের বেশ দেখতে,এক জন ছাত্র দাড়িয়ে আছে।ঞ্ছেলেটা বললো আমাদের সহকর্মী শিল্পী,জারিফ এফেন্দীর পাশ খুজে পাওয়া গেছে, কূয়ায়,মিহরিমাহ মসজিদে আসরের নামাজের পর জানাজা হবে।আল্লাহ আমাদের যেন বিপদ থেকে রক্ষা করেন,এটা বলে সে ছুটে গেল খবরটা অন্যান্যদের দেয়ার জন্যে ।


আমি এসথার

তাহলে,ভালবাসা কি মানুষকে বোকা করে দেয়,না কি বোকারাই শুধু প্রেমে পড়ে?আমি অনেক বছর ধরে কাপড়ের ফেরী করি,সূযোগ পেলে ঘটকালীও করি,তবে ও ব্যাপারে আমার বিশেষ কোন দক্ষতা আছে,তা না।এটা নিঃসন্দেহে আনন্দের ঘটনা হতো-যদি দেখা হতো কোন পুরুষের সাথে বা স্বামী স্ত্রীর সাথে ভালবাসায় বদলে চালাক চতুর হয়ে গেছে,যারা।জানি না যারা ফুসলান,ধোকা দেয়ায় যারা ব্যাস্ত,ভালবাসা কি জানা নেই তাদের।সিয়াহ এফেন্দীর কথা বলতে গেলে এটা বলতেই সেকুরের জন্যে তার অসহিষ্ণুতা,চালচলন একেবারেই বেমানান-মাঝে মাঝে আত্মসংযমও হারিয়ে ফেলে সে।

বাজারে যখন সিয়াহর সাথে দেখা হলো,নাটকীয় ভাবে আমার সাজানো মিথ্যা কথাগুলোই বললামঃসেকুরে সবসময় তার কথা বলে,জিজ্ঞাসা করে সিয়াহ চিঠির কি হলো,এত বিচলিত তাকে কোনসময় দেখিনি।সিয়াহর করুন দৃষ্টি দেখে আমারও মায়া হচ্ছিল,যখন ও বললো চিঠিটা সোজা সেকুরের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।সব বোকা প্রেমিকই ভাবে প্রেমের ব্যাপারে একটুঁ তাড়াহুড়া করা দরকার,ভালবাসার অন্ধত্বে নগ্ন হয়ে যায় সবাই-আর নিজের অজান্তেই অস্ত্রগুলো তুলে দেয় প্রেমিকার হাতে।প্রেমিকা যদি চালাক হয় তবে তো কথা নাই,ইচ্ছা করেই চিঠির উত্তর দিতে দেরী করবে,এক কথায়ঃগল্পের নীতিকথা এটাইঃতাড়াহুড়ায় ভালবাসা হারায় তার ফল।

ভালবাসায় অন্ধ সিয়াহ কি আর জানে,চিঠিটা তাড়াহুড়া করে দেয়ার কথা বলে আমি সময় নিয়ে বাজারে ঘোরাফেরা করি, ‘তাড়াহুড়া না করে’,দেই,তা হলে সে কি আর আমাকে ধন্যবাদ জানাতো?বাজারে তার জন্যে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আমি ঠান্ডায় একেবারেই জমে গেলাম।সিয়াহ চলে গেলে ভাবলাম, ‘মেয়ের’, সাথে দেখা করে আসি।যে সব মেয়েদের বিয়ের ঘটকালি আমি করি,কষ্টে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে,তাদের তো আমার ‘মেয়ে’,বলাটাই স্বাভাবিক।আমার এই কুৎসিত মেয়েটা আমাকে দেখলেই অস্থির হয়ে যায়,
শুধু খাওয়াদাওয়া না,ফিরে আসার সময় দু চারটে রুপার মোহরও দিতে ভুলে যায় না। মেয়েটা এখন গর্ভবতী,আনন্দ,উচ্ছাসে ভরে আছে তার মন।আমার জন্যে লেবু চা গরম করে আনলো,আমি মজা করে খেতে খেতে এক ফাঁকে সিয়াহ এফেন্দীর দেয়া মোহর গুনছিলাম,পচিশটা ঝকঝকে রুপোর মোহর।

হেঁটে যাচ্ছি,এক পাশের রাস্তা বরফ,কাদামাটিতে ভঁরে ছিল আর সেখান দিয়ে যাওয়া অনেকটা অসম্ভবই বলা যায়।বাড়ীর দরজায় যদিও ধাক্কা দিচ্ছিলাম,তবে ধাক্কার শব্দটা ভেতরের অট্টহাসিতে হারিয়ে যাচ্ছিল,তাই বাধ্য হয়ে আমাকে চীৎকার করে ডাকতে হলো।

‘কাপড়ের ফেরীওয়ালা!কাপড়ের ফেরীওয়ালা’,আমি বললাম, ‘দেখে যাও চমৎকার মসলিন কাপড়,যে কোন সুলতানের উপযোগ্য কাপড় এটা।দেখে যাও কাশ্মীরের সুন্দর শাল,বুর্সার সুন্দর ভেলভেট,মিশরের হাতের কাজকরা টেবিল ক্লথ,বিছানার চাদর,সিল্কের রুমাল।
কাপড়ের ফেরীওয়ালা’।

দরাজাটা খুলে গেল,বাড়ীর ভেতরে ঢুকলাম।যথারীতি বাড়ীতে বিদঘুটে একটা গন্ধ,ভেজা
ভেজা মেঝে,রান্নার তেল সব মিশিয়ে বোঝাই যাচ্ছিল একটা অবিবাহিত লোকের বাড়ীর চেহারা।

‘এই বুড়ী,এত চীৎকার করছো,কেন’?জিজ্ঞাসা করলো,হাসান।
বেশী কিছু না বলে সিয়াহর চিঠিটা বের করলাম,হাল্কা আলোর ঘরটায় ছুটে এসে আমার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে নিল,আরেকটা ঘরে গিয়ে চিঠিটা পড়ছিল হাসান,আর আলো আঁধারের ঘরটায় আমি অপেক্ষা করেছিলাম।

‘তোমার বাবা কি বাড়ীতে নেই’?

উত্তর পেলাম না,চিঠি পড়াতে মগ্ন তখন সে,চিঠিটা একবার শেষ করে আবার পড়া আরম্ভ করলো।

‘হ্যা,চিঠিটায় কি লেখা আছে’?আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

হাসান পড়ছিল চিঠিটাঃ

আমার প্রিয় সেকুরে,কতগুলো বছর কেটে গেছে শুধু একজনের কথা ভেবে,তুমি তো জানই,কে সে,সেটা তুমিই।বুঝতে পারছি তোমার মন অপেক্ষা করে আছে,তোমার স্বামীর,জন্য।তোমার মত একজন সুন্দরী আর সৎ মানুষের জন্য ওটাই স্বাভাবিক,(হেসে উঠলো হাসান)।
তোমার বাবার বই এর ছবিগুলো যখন দেখতে গেলাম,তোমাকে দেখার প্রচন্ড ইচ্ছা থাকলেও,তুমি বিরক্ত হবে ভেবে সাহস করতে পারিনি।এটা ঠিক আমি কোনসময়েই তোমার কাছ থেকে কোন উৎসাহ বা উচ্ছাস দেখিনি কোনদিন,তাই ইচ্ছা থাকলেও সাহস না হওয়াটাই স্বাভাবিক।তোমার মুখটা জানালায় দেখে মনে হলো,আল্লাহর কাছ থেকে পাঠানো বিশেষ একটা উপহার,ক্ষনকিছুর জন্যে হলেও তোমাকে দেখার স্বর্গীয় আনন্দটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না,ওটা আমার অন্তরের এক কোনায় সাজানো আছে অনন্য চেহারায়(নিজামীর থেকে সব কথা চুরি করা,থেমে গিয়ে হাসান রেগে বললো)।যদি আমাকে দূরে থাকতে বল,একটা প্রশ্ন করবো শুধু,তুমি কি একজন ফেরেশতা যার কাছ থেকে ভঁয়ে দূরে থাকতে হবে?শোন যা বলতে চাইঃএক সময় অনেক রাত্ত কেটে গেছে আমার খোলা আকাশের নীচে চাঁদের আলোয় পাহাড়ের ধারে কাফেলার মানুষজনের সাথে,আশেপাশে ছিল শুধু কজন ‘হান’ জাতির লোক,আর ডাকাতেদের দল।রাতের একাকীত্বে হায়েনাদের ডাকই ছিল একমাত্র সান্তনা,সবসময় একটা আশা ছিল মনে হয়তো কোন একদিন কোন এক সুরে দেখা পাব তোমার।কোথাও কোন একদিন কোন এক জানালা থেকে উঁকি দিবে তুমি আমার মনের জানালায়।তোমার বাবার কাছে ছবি দেখতে যাওয়ার পর চিঠির সাথে আমার আঁকা ছবিটাও ফিরিয়ে দিলে।বেশ দুঃখ পেলাম যদিও,তবুও তার মানে এই না যে হারিয়ে গেছ তুমি আমার মন থেকে,বরং নতুন করে খুঁজে পেলাম,তোমাকে।তোমার বাপ মরা ছেলে অর্হানকে দেখে এটাই মনে হলো,হয়তো আমিই একদিন তার বাবা হবো।

‘আল্লাহ তাকে রক্ষা করুক,বেশ ভালই সিয়াহর লেখাটা ’,আমি বললাম, ‘একটা কবিতার মত সাজানো’।

‘তুমি কি একজন ফেরেশতা যে তোমার কাছে যেতে ভঁয় হবে আমার’?হাসান বললো, ‘এই লাইনটাও তো জেরহানীর কাছ থেকে নেয়া,আমি এর চেয়ে ভাল লিখতে পারতাম’।
নিজের একটা চিঠি বের করে সে বললো, ‘ধর এই চিঠিটা নাও,এটা দিবে সেকুরেকে’।

মোহর নেয়ার ব্যাপারটা আমার কাছে তেমন নতুন কিছু না,তবু এই প্রথমবার চিঠির সাথে টাকা নেয়ার ব্যাপারটা আমাকে বেশ বিচলিত করলো।অদ্ভুত একটা ঘৃনায় ছেয়ে গেল আমার মন,এই মানুষটার নোংরা পাগলামি দেখে,এক তরফা ভালবাসার অন্ধত্ব দেখে।দেখলাম হাসান কেমন জানি একটু রুঢ় ব্যাবহার করে বললো।

‘সত্যি সত্যিই তুমি এটা আমাকে বলতে বলছো’?

অদ্ভুত একটা নিস্তব্ধতা ছেয়ে ছিল চারপাশ।হাল্কা আলোয় হাসানের মুখটা দেখে মনে হচ্ছিল যেন,অপরাধী এক শিশু।হাসানের চরিত্রটা বেশ ভালই জানা ছিল আমার,কেউ যেন আবার না ভাবে শূধু মোহরের জন্যেই এ কথাটা বললাম।

বাড়ী থেকে যখন বের হয়ে যাচ্ছিলাম,হাসান এসে অনেকটা বোকার মতই বললো, ‘তুমি কি সেকুরেকে বলতে পারবে,আমি যে তাকে পাগলের মত ভালবাসি’।

‘তোমার চিঠিতেই সেটা বলতে পার’।

‘বল কি ভাবে আমি তার বাবার মন বদলাতে পারি?কি ভাবে আমি সেকুরে,তার বাবাকে বোঝাতে পারি,আমার মনের কথাটা’?

‘একটা ভাল,সৎ মানুষ হয়ে’,বলে আমি দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলাম।

‘এই বয়সে!সেটা একটা যন্ত্রনা…অনেক দেরী হয়ে গেছে’,হাসানের উত্তর ভেসে আসলো,আমার কানে।
‘অনেক টাকা উর্পাজন কর,বন্দরের উঁচুদরের কর্মচারী অফিসার তুমি হাসান,এটাই তো বলে দেয় তুমি একজন ভাল মানুষ…’,কথাগুলো বলেই আমি ছুটে বের হয়ে গেলাম।

অন্ধকার আর নিস্তব্ধতায় বাড়ী ভেতরটায় এতই ঠান্ডা ছিল যে শীতের রাতের,বাইরের আবহাওয়াটা মনে হচ্ছিল গরম আর আরামদায়ক।সূর্যের আলোটা আমার মুখে আলতো করে একটা চুমু দিয়ে গেল,সেকুরের মানসিক অবস্থা ছাড়া আর কোন কিছুই আমার মনে ছিল না তখন।তবুও ঐ স্যাতস্যাতে ঘরটায় হতভাগা লোকটার জন্যে মনটা কেন জানি খচখচ করছিল,অন্ধকারে আলো জ্বালিয়ে নিজেকে খুঁজছে সে।অজান্তেই লালেলির মশলার বাজারে আমি তখন,দারুচিনি,জাফরান,মরিচের গন্ধ হয়তো আমাকে নতুন ভাবে উদ্বুদ্ধ করবে,তবে সেটা আমার বোঝার ভুল।

সেকুরেকে চিঠিটা দেয়ার পর পরই সে সিয়াহর কথা জানতে চাইলো।বললাম ভালবাসার আগুনে গ্রাস হয়ে গেছে সারা পৃথিবী,শুনে বেশ খুশীই হলো সেকুরে।

বিষয়টা বদলে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘শহরের ছোটখাট সবাই আলোচনা করছে,জারিফ এফেন্দী কেন খুন হলো’?

‘হাইরিয়ে,কিছু হালুয়া বানিয়ে কালবিয়েকে দিয়ে আসবে,হতভাগা জারিফ এফেন্দীর বিধবা,কত যন্ত্রনার মধ্যে দিয়ে সময় কাটাচ্ছে বেচারী’,সেকুরে বললো।

‘ইরুজুমির সব লোকজন ছাড়া আরও অনেকেই যাবে তার জানাজায়’,আমি বললাম, ‘যতদূর শোনা যাচ্ছে জারিফ এফেন্দীর আত্মীয় স্বজনেরা এই খুনের প্রতিশোধ নিবে,ওরা ছেড়ে দিবে না’।

সেকুরে সিয়াহর চিঠি পড়ছিল,তার মুখের দিকে আগ্রহে আর রাগে তাকিয়েছিলাম। মেয়েটা এতই চালাক যে মনের কথাটার সাথে মুখের চেহারাটার কোন মিল নাই।চিঠি পড়ার সময়টায় চুপচাপ বসে ছিলাম,সেকুরেকে চিঠিটা শেষ করে সেকুরে হাসছিল।

‘কি বললো সিয়াহ এফেন্দী’,জিজ্ঞাসা না করে পারলাম না।

‘সেই ছোটবেলার গল্প,এখনও আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে’।
‘তোমার মন কি চায়’?
‘আমি তো বিবাহিতা,অপেক্ষা করছি স্বামীর জন্যে,কবে ফিরে আসবে,কে জানে’?
যদিও সেকুরের কথায় ছিল প্রেমের খেলা,তবু কেন জানি তার উত্তরে রেগে যায়নি,
আমি।চিঠি দেয়া এই যে সব মেয়েদের অর্ধেকও যদি সেকুরের মত বুদ্ধিমতো হতো,
আমার মনের চাপটা কমে যেত অনেক,আর তাদের অনেকেরই আরও ভাল জায়গায় বিয়ে হতো।

‘আরেকজন কি বলছে’?
‘হাসানের চিঠিটা আমি এখন পড়তে চাই না’,সেকুরে বললো, ‘হাসান কি জানে সিয়াহ এখন ইস্তাম্বুলে’?
‘সে তো বিশ্বাসই করে না সিয়াহ বলে কেউ কোথাও আছে’।
‘হাসানের সাথে তোমার কথাবার্তা হয়’, সাগরের ভরাট,গভীর চোখে সেকুরে জিজ্ঞাসা করলো।
‘ঠিক যে ভাবে তোমার সাথে কথা বলি’?
‘হ্যা’?
‘মানসিক ভাবে প্রচন্ড যন্ত্রনায় ভুগছে,হাসান।পাগলের মত ভালবাসে তোমাকে।যদিও হয়তো তোমার মনটা অধিকার করে আছে অন্য কেউ,তবু ওকে কি তোমার মন থেকে ছুড়ে ফেলা সম্ভব হবে?তা ছাড়া তার চিঠিটা নিয়ে তুমি তাকে আরও উৎসাহিত করে যাচ্ছ।একটুঁ সর্তক থাকার চেষ্টা করো,হাসান শুধু চায় না যে তুমি ঐ বাড়ীতে ফিরে যাও,ভাই এর মৃত্যুর ব্যাপারটা হাকিমের কাছে জানানোর পর,যথাযথ ভাবে তোমাকে বিয়ে করতে চায়’,বাতাসটা একটুঁ হাল্কা করার জন্যে কথাগুলো আমি হেসে হেসেই বললাম,যাতে সেকুরে মনে না করে আমি আজেবাজে গুজব ছড়াচ্ছি।

‘আরেকজন কি বলে’?সেকুরে জিজ্ঞাসা করলো,কিন্ত সে কি নিজেই জানতো কার কথা বলছে?
‘আমাদের নামকরা শিল্পীর কথা বলছি’?
‘আমার মানসিক অবস্থা এখন যা,জানি না কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক’,সেকুরে বললো,হয়তো নিজের চিন্তার ঝড়ে নিজেই কিছুটা ভঁয় পেয়ে গেছে।‘যা মনে হচ্ছে আরও গোলমাল হবে সব মিলিয়ে।বাবাও বুড়ো হয়ে গেছে,আমার ছেলেদের কি হবে?কোন সন্দেহ নাই একটা ঝড় ছুটে আসছে আমাদের জীবনে,শয়তান নিয়ে আসছে অপকর্ম,
দূর্ভাগ্যের জোয়ার।এসথার কিছু একটা বল,যাতে সব কিছু ভুলে আমি কিছুটা আনন্দে থাকতে পারি’।

‘ভঁয় পাবে না ,সেকুরে,আমরা কি জন্যে আছি’,আবেগ ভাসিয়ে নিয়ে গেল আমাকে।
‘তুমি সুন্দরী,নিঃসন্দেহে বুদ্ধিমতী,একদিন আদরে জড়াজড়ি করে বিছানায় স্বামীর সাথে শুয়ে থাকবে,সময়ে এসব দুঃশ্চিন্তা চলে যাবে,সুখী হবে তুমি,তোমার চোখই সেটা বলে দিচ্ছে আমাকে’।
এমন একটা সুর ছিল আমার কথায়,কান্নায় ভঁরে গেল সেকুরে চোখদুটো।
‘ঠিক আছে,তুমিই বল,কে হচ্ছে আমার স্বামী’?
‘তোমার মন কি বলে দিচ্ছে না,উত্তরটা’?
‘বুঝতে পারছি না,কি বলছে আমার মন,তাই হতাশার প্লাবনে ভেসে যাচ্ছি’।
মনে হলো সেকুরে আমাকে একটূও বিশ্বাস করে না,বেশ চাতুরতার সাথে মনের কথা লুকিয়ে জানতে চাচ্ছে,আমার জানা,কিছুটা সহানুভুতি খুঁজছে হয়তো।
দেখলাম চিঠির কোন উত্তর লেখছে না সেকুরে,আমার সব মেয়েদের যা বলি,‘ভঁয় পাবে না,খারাপ কোন কিছু ঘটবে না তোমার জীবনে,আর কত দূর্ভাগ্যের জোয়ারে আল্লাহ পরীক্ষা করবে তোমাকে’?


০০০০০০০০


মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৩ দুপুর ১:২৮

রাজীব নুর বলেছেন: আপনার এই ধারাবাহিক আমি ছাড়া আর কেউ পড়ে না।

১৭ ই মে, ২০২৩ ভোর ৪:০৭

ইল্লু বলেছেন: তাই তো মনে হচ্ছে,আপনাকে ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.