নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইল্লু

ইল্লু › বিস্তারিত পোস্টঃ

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ) ধারাবাহিক

১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ রাত ১২:১২

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ)
ধারাবাহিক
ফেনিত অর্হান পামুক
জন্মঃ জুন,১৯৫২
তুরস্কের খ্যাতনামা এক উপন্যাস লেখক
২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান
খ্যাতনামা লেখার মধ্যে My name is red,Silent house,white castle আরও অন্যান্য অনেক লেখা



২১)

‘আমরাই জয়ী হলাম শেষমেষ’,আমি বললাম, ‘তুমি কি শোন নি,জারিফ এফেন্দীর কাছ থেকে ভেনিসের শিল্পীদের অনুকরন করার অপবাদের যন্ত্রনা,কত অসহনীয়।আমরা তাদেরকে নকল করে ছবি আঁকলে,সময়ে আমাদের ছবি হারাবে তার রং এর বৈচিত্র,ফ্যাকাসে হয়ে যাবে আমদের আবেগ,উদ্বেগ।সময়ে লোকজন উৎসাহ দেখাবে না আমাদের বই এ,আর যদি কেউ উৎসাহ দেখায়ও,ছবি আর কথার সামঞ্জস্যটা উপলদ্ধি করতে পারবে না,তারা।বই বাঁধানো হয় আরবের আঠা দিয়ে,মধূ,মাছ,হাড়,আর পাতাগুলো ঢাকা ডিমের সাদা অংশ,আটা মেশানো কিছু একটা।

লোভী,নির্লজ্জ ইঁদুর,উইপোকা,পোকা,হাজারো ধরণের পোকামাকড় ধারাল দাঁত দিয়ে বই এর পাতা কুটে কুটে শেষ করে দেয়।বাধাই ছিড়ে যায়,পাতাগুলো ছিঁড়ে যায়,তারপর অনেক সময় আর ওটার কোন অস্তিত্বও থাকে না।কাজের মেয়েরা চুলার আগুনের জন্যে পাতা ছিঁড়ে নেয়,কম বয়সী শাহজাদারা বই এর পাতায় হিজিবিজি এঁকে খেলা করে,চোখগুলো কাল করে দেয়,নাকের সর্দি ঝেড়ে নোংরা করে,আর ধর্মীয় কথাবার্তা যা লেখা সবই ঢাকা পড়ে হারায় অজানায়।ছবিগুলো ছিঁড়ে নতুন ছবিও তৈরী হয়,খেলাধুলা-আনন্দের জন্য।মায়েরা ছিঁড়ে ফেলে ছবি যা তাদের চোখে মনে অশ্লীল-আর বাবা,বড় ভাই এর দল অনেকে হস্তমৈথুন করে ছবির উপরেই বীর্যপাত করতে দ্বিধাবোধ করে না,একটা পাতা আরেকটা পাতার সাথে আটকে থাকে,শুধু এ কারণেই না,কাদামাটি,খারাপ আঠা,থুতু আরও অনেক কিছু আছে,সময়ে সেখানে চিতি পড়ে ফুলের মত ছড়ায় চারপাশে।

আর যদি একটা বই কোনভাবে যদি বেঁচে যায়,এক সময় সেটাও আগুনে পড়ে নষ্ট হয়।ইস্তাম্বুলে এমন কোন বাড়ী নাই যা একবার না একবার আগুন পুড়ে যায় নি।ইস্তাম্বুলে প্রতি তিন বছরে যত বই আর লাইব্রেরী নষ্ট হয়,মঙ্গোলদের বাগদাদের আগুনেও তত বই নষ্ট হয়নি।কোন চারুশিল্পী কি ভাবতে পারে তার ছবির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে একশ বছর পরে-বা তার ছবি একদিন বিহজাদের ছবির মত সবাই অবাক চোখে দেখবে?শুধু আমাদের ছবি না বেশীর ভাগ ছবিই একদিন হারাবে পৃথিবীর চোখ থেকে-হয়তো আগুনে না হয় পোকার দাতেঃশিরিনের জানালা দিয়ে অবাক চোখে হুসরেভকে দেখার দৃশ্য,
হুসরেভের লুকিয়ে লুকিয়ে শিরিনের গোসলের দৃশ্য দেখা,প্রেমিক প্রেমিকার এঁকে অন্যেতে অবাক হয়ে হারিয়ে যাওয়া,প্রেমে বিভ্রান্ত মেজনুনের পাহাড়ী ভেড়া আর সাদা বাঘের কাছে
দুঃখের কাহিনী শোনানোর দৃশ্য,ফেরেশতা,ফুল,পাখী-ফোঁটা দিয়ে সাজানো বই এর পাতা।
বাশের বাশী যা ছিল হাফিজের রহস্যভঁরা মনমুগ্ধ করা কবিতায়,পাতার দেয়ালের রং হয়তো শত শত শিক্ষানবীসের চোখের আলো চলে গেছে ছবিগুলো আঁকতে গিয়ে,দেয়ালে ঝোলানো ছবি,কোন একজায়গায় আছে লুকানো শিল্পীর চিহ্ন,তা ছাড়া জানার উপায় কোথায় ঐ সব শিল্পীদের নাম।সুলতানের দাদা জয়ের গর্বে হেঁটে যাচ্ছে শত্রুপক্ষের দূর্গ,কামান,বন্ধুক,তাবুর মাঝখানে,কৈশোরে তুমি কম সাহায্য করনি ছবিটা আঁকতে,পেছনে কাফেরদের রাষ্ট্রদুত নত হয়ে সুলতানের দাদার পায়ে চুমু খাচ্ছে,এক পাশে দাঁড়ানো শয়তান শিং নিয়ে,হতে পারে শিং ছাড়া,লেজ নিয়ে বা লেজ ছাড়া,ধারালো দাঁত,ধারালো নখঃ সাথে আছে নানান ধরণের পাখী,এমন কি বাদশাহ সোলায়মানের জ্ঞানী কাঠঠোকরা পাখীও বাদ পড়েনি,ডো ডো পাখী,কুকুর বিড়াল,ভেসে যাওয়া মেঘ,নেচে যাওয়া ঘাস এক এক করে সাজানো,ঝাউ গাছ,ডালিমের গাছ সবকিছুই ধৈর্যের সাথে তুলির ছোঁয়ায় জীবন্ত,কোন কিছুই বাদ পড়েনি-প্রাসাদের ছবি এক একটা করে ইটে তুলে ধরা,আছে তৈমুর লং বা শাহ তামাসাপ,তবে গল্পগুলো তার চেয়েও পুরোনো।

দলে দলে শাহজাদারা রকমারী ফুল আর ফুলের গাছের সাজানো গালিচায় বসে গান শুনছে,গালিচা,ফুলদানী সমরখন্দ থেকে আনা ইস্তাম্বুলে,শতশত শিক্ষানবীসের অত্যাচারের,
চোখের জলের কাহিনী আছে সেখানে।বাগান,ছুটে যাওয়া ঘুড়ি যা তুমি তোমার পুরোনো উৎসাহ নিয়ে আজও এঁকে যাচ্ছ,যুদ্ধ আর মৃত্যুর দৃশ্য,সুলতানের শিকারের দৃশ্য,সেই একই সৌন্দর্যে আঁকা ছুটে যাওয়া হরিনের দল,মৃত্যুপথ যাত্রী শাহ,যুদ্ধবন্ধী,অবিশ্বাসী-এমন কি অন্ধকার রাত্রির কালো কুচকুচে আকাশ,সবই যেন জীবন্ত হয়ে আছে তোমার তুলির ছোঁয়ায়।তোমার আঁকা এত সব কিছু হয়তো কোন্ কিছুই টিকে থাকবে না সময়ের খাতায়...’।

কালির দোয়াতটা উঁচু করে ধরে তার সব শক্তি দিয়ে সে মারলো আমার মাথায়,টলে কিছুদুর এগিয়ে পড়ে গেলাম,প্রচন্ড একটা ব্যাথা মাথায় যা ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা ছিল না আমার।সারা পৃথিবী কাঁদছিল আমার ব্যাথায়,চারপাশে সবকিছুই হলুদ হয়ে গেল,কিছুক্ষনের মধ্যেই।কোন সন্দেহ ছিল আঘাতটা একেবারেই ইচ্ছাকৃত-তবুও বিশ্বাস হচ্ছিল না মার,অন্য কিছু একটা ভাবতে ইচ্ছা হচ্ছিল,‘দয়া করে বলবে এটা কি করলে, তুমি কি ভুলে আঘাত করলে আমাকে’।
কোন উত্তর না দিয়ে সে,কালির দোয়াতটা তুলে আবার মারলো আমাকে।আমার অবিশ্বাসী মনটা বুঝতে পারলো,ওটা ভুল ছিল না,নিঃসন্দেহে ইচ্ছাকৃত ভাবেই সে আঘাত করে যাচ্ছে,কিন্ত কেন,এভাবেই কি শেষ হবে আমার জীবনের গল্প?সারা শরীর কাঁপছিল ভঁয়ে,চুপ করে থাকলে হয়তো ও কোন কিছু করতো না,তবে অসহ্য যন্ত্রনায় চীৎকার করলাম,সমস্ত শক্তি জড় করে।সন্ধ্যার এই সময়টায়,চারপাশের বরফে ঢেকে রাখা রাস্তার নির্জনতায় কেই বা শুনবে আমার চীৎকার,একা আমি আর নিস্তবদ্ধতা।

আমার চীৎকার আর অসহায়তায় কিছুটা ইতস্তত হলেও,সে থেমে যায়নি।চোখে চোখে হলে বুঝতে পারলাম লজ্জা আর ভয় থাকলেও,সে যা করতে চায় সেটা সে করবেই এটা।তখন সে আর খ্যাতনামা একজন চারুশিল্পী না,অজানা এক শয়তান যার সাথে আমার দুরত্ব হাজার বছরের।ওর হাতটা ধরে পৃথিবীতে ফিরে আসার চেষ্টা করছিলাম,কিন্ত পারলাম না।বললাম,নাকি ওটা শুধু ভাবনা জানি না, ‘শোন,দয়া করে আমার কথাটা শোন,এ ভাবে আমার জীবনটা শেষ করে দিও না’।

কোন শব্দ ছিল না আমার মুখে,কথাগুলো আটকে ছিল কোথাও,কালির দোয়াতটা তুলে ও আবার মারলো আমার মাথায়।আমার চিন্তাধারা,দেখাগুলো,স্মৃতির আকাশ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে তখম,কিছুই ছিল না কোথাও শুধু অজানা একটা ভয়।শুধু লাল,টকটকে লাল,লাল রং ভেসে যাচ্ছি আমি,ভাবছিলাম রক্ত,তবে সেটা লাল কালি,আর ওর হাতে লাল রংটা কালি না শুধুই আমার রক্ত।

এটা অন্যায়,এত নিষ্ঠুর ভবিতব্য আমার প্রতি,আমি কি মারা যাচ্ছি সেই মুহুর্তে,আমার মন সেটাই বলে দিচ্ছিল।দেখলাম,আমার স্মৃতিতে শুধু শূন্যতা,কিছুই নেই সেখানে,বাইরের ধবধবে সাদা বরফের মত,আমার হ্রদপিন্ড ছুটে গেছে আমার মুখে।

মৃত্যুর বর্ননা দিচ্ছি,সবাই জানে,মৃত্যু সবকিছুর শেষ না,এটাও সবাই জানে মৃত্যু আসবেই কোন না কোন একসময়।যেমন লেখা আছে নানান কেতাবে,মৃত্যু যন্ত্রনাদায়ক চিন্তার বাইরে এক অনুভুতি।শুধু আমার ফেটে যাওয়া মাথা,মগজ না শরীরের সব অঙ্গপ্রতঙ্গ যেন অভাবনীয় যন্ত্রনায় পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে,এই অশেষ যন্ত্রনা থেকে শরীরটাকে উদ্ধার করার জন্যে-আমি ঘুমের রাজ্য খুঁজছিলাম।

মৃতুর আগে মনে কৈশোরে শোনা এক কাহিনীর কথা মনে পড়লো।একজন বুড়ো যে একাই থাকতো,একরাতে ঘুম থেকে উঠে এক গ্লাস পানি খেয়ে গ্লাসটা একপাশে রেখে শুতে যাওয়ার সময় দেখে তার মোমবাতিটা সেখানে নাই।কোথায় গেল মোমবাতি?দেখলো হাল্কা একটা বাতি আসছে ঘরের ভেতর থেকে।আলোটা ধরে ঘরে ফিরে সে দেখে তার বিছানায় মোমবাতি হাতে অন্য কেউ শুয়ে আছে।বুড়ো অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, ‘তুমি কে’?শুয়ে থাকা মানুষটা বললো, ‘কে আবার,আমি আজরাইল,আমি মৃত্যু’।বুড়ো হতবাক হয়ে চুপচাপ ছিল কিহুক্ষন,তারপর সে প্রশ্ন করলো, ‘তা হলে তুমি আমাকে নিয়ে যেতে চাও’?‘হ্যা’,একটু ঔদ্ধত্যের সুরে সে উত্তর দিল।‘না’,বুড়ো বেশ দৃঢ় সুরেই বললো, ‘ আমি জানি,তুমি আমার দুঃস্বপ্নের একটা অংশ’।বুড়ো তার বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটার মোমবাতি ফুঁ দিয়ে নিভাল,ঘন অন্ধকারে সবকিছু হারিয়ে গেল।বুড়ো নিজের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো আবার,প্রায় আরও বিশটা বছর বেঁচে ছিল,সে।

আমি জানি আমার ভাগ্যে ও ধরণের অলৌকিক কিছু ঘটবে না,সে আমার মাথায় কালির দোয়াত দিয়ে আরেকবার মারলো।যন্ত্রনা তখন এমন এক পর্যায়ে,সমস্ত অনুভুতি ভোঁতা হয়ে গেছে।সে,কালির দোয়াত,মোমবাতি সবকিছুই আমার দৃষ্টি ছেড়ে গেছে।বেঁচে আছি আমি তখনও,বেঁচে থাকার আগ্রহটা বেড়ে গেছে হাজার গুন,তার কাছ থেকে কোনভাবে পালিয়ে নিজেকে রক্ষা করার আগ্রহ আরও প্রচন্ড তখন।তার হাতে বেশ জোরে কামড় দিলাম,আর আমার মুখে ধাক্কা দিয়ে সে আবার বললো ভারী কালির দোয়াতের কথা।
কিছুক্ষন ধ্বস্তাধস্তি চললো,অবশ্য সেটাকে যদি ধ্বস্তাধস্তি বলা যায়,তার শরীরের শক্তি তখন আরেক পর্যায়ে,সে তখন এক খুনী।সে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল আমাকে,চিত হয়ে
পড়েছিলাম।

হাঁটু দিয়ে আমাকে আটকে নোংরা ভাষায় গালাগালি করছিল ও,কেন যে সে মৃত্যু পথযাত্রী এক বুড়োকে ও ভাবে অত্যাচার করছিল!জানি না তার কথা কাঙে আসছিল না,নাকি আমার কোন কিছু বোঝার শক্তি ছিল না আর।সে কালির দোয়াতটা দিয়ে আরেক বার মারলো আমাকে,ওর রক্তজবার লাল টকটকে চোখের দিকে তাকানোর কোন ইচ্ছা ছিল না আমার।তার শরীর কাঁপড়চোপড়,লাল হয়ে গেছে দোয়াতের কালিতে সাথে আমার ছুটে যাওয়া রক্তে।

খুব দুঃখের কথা এই যে আমাকে শেষ দেখতে হবে,আমার খুনীর মুখটা,হাল্কা একটা আলো দেখে আমার যন্ত্রনার মাত্রাটা কিছুটা কমে গেছে তখন।আলো হাতে দাঁড়িয়েছিল অজানা,
অস্পষ্ট,কেউ,জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি কে’?
‘আমি,আর কে আবার,আমি আজরাইল’,সে বললো, ‘আমি,যার কাজ হলো মানুষের এ পৃথিবীর যাত্রা শেষ করা।আমি মাকে তার সন্তানদের কাছ থেকে নিয়ে যাই,বিচ্ছিন্ন করি,স্বামীদের বৌ এর কাছ থেকে,বাবাদের মেয়েদের কাছ থেকে,এই পৃথিবির কারও অব্যাহতি নেই আমার হাত থেকে।
বুঝলাম,মৃত্যু অবধারিত,কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম,কাঁদতে কাঁদতে বেশ পিপাসা লাগলো,একদিকে মুখের মাথার যন্ত্রনা,চোখে রক্ত গড়িয়ে আসছে,আরেক দিকে ভাবছিলাম চেনা জগতের নিষ্ঠুরতার কথা,ব্যাথা থেমে গেছে,তবুও সামনে আছে জগতটা অচেনা আর ভঁয়ে সাজানো।
ওটা মৃতের দেশ,আজরাইল আমাকে নিয়ে যাচ্ছে,আর আমি তখন ভঁয়ে কাতর,এই পৃথিবীতে আমার সময় শেষ হয়ে গেছে।এই পৃথিবীতে থাকার অযোগ্য আমি,এই বুড়ো ভেঙ্গে পড়া শরীরে সেটা একেবারেই অসম্ভব।

মৃত্যুর আগে যন্ত্রনায় মৃত্যুকে ডাকছিলাম,এখন সেই অজানা প্রশ্নটা না জেনেই চলে যেতে হবে,যার উত্তর খুঁজে পাই নি কোন বই এ,এ ভাবেই কি সবাই মৃত্যুর রাজ্যে ছুটে যায়?ইচ্ছা অনিচ্ছায় ছুটে যাচ্ছি মৃত্যুর দেশে,আরও নতুন অনেক না দেখা,না জানার রাজ্যে আমি।

একজন মানুষ অন্য পৃথিবীর যাত্রার জন্যে যার প্রস্ততি পর্ব শেষ,তার মন তবুও দোটানায়-ভুলে যেতে পারছে না ঘরটা,চোখ বুলাচ্ছে আসবাবপত্রে।মেয়েকে আরেকবার দেখার ইচ্ছা হচ্ছিল,দাঁতে দাঁত কামড়ে আমাকে কোন না কোনভাবে অপেক্ষা করতে মেয়ে সেকুরের ফিরে আসার জন্যে,একবার দেখা হয় যেন।

মৃত্যুর সেই আলো কিছুটা সরে গেছে তখন,মন,চোখ,কান শুনতে পাচ্ছে,কিছুটা অনুভব করতে পারছে চারপাশের শব্দ,হৈচৈ।শুনতে পাচ্ছিলাম আমার খুনী খুঁজে বেড়াচ্ছে,কাগজপত্র,
আলমারীর মধ্যে শেষ ছবিটা।শব্দ পেলাম চাকু দিয়ে রং এর বাক্স খোলার শব্দ,লাথি মেরে ফেলে দিচ্ছিল সে বাক্সগুলো এলোপাথাড়ি ভাবে,ছুঁড়ে দিচ্ছিল কালির দোয়াত।অনুভব করছিলাম বেঁচে থাকার জন্যে আমার হাহাকার,মাঝে মাঝে হাত পা কাপুনি দিচ্ছিল।
আমি অপেক্ষা করছি,এমন না যে আমার যন্ত্রনা একেবারেই কমে গেছে।চুপচাপ হয়ে গেছি,দাঁত কামড়ে ধরে থাকার শক্তিটা যদিও নেই,তবুও অপেক্ষা করছি
একসময় মনে হলো,সেকুরে যদি তখন আসে,সেও তো বিপদে পড়বে,এই খুনী কি তখন তাকে ছেড়ে দিবে?তবে কেন জানি ঐ চিন্তাটা দূরে সরিয়ে রাখছিলাম।এক সময় মনে হলো খুনী ঘর ছেড়ে চলে গেছে,হয়তো সাথে নিয়ে গেছে শেষ ছবিটা।

গলাটা আর ও শুকিয়ে যাচ্ছে,বড্ড পিপাসা পাচ্ছে,তবুও আমি অপেক্ষা করছি।আমার প্রিয় সেকুরের জন্যে,সেকুরে কোথায় তুই,তাড়াতাড়ি আয়,আর যে দেখা হবে না কখনও।
সেকুরে এলো না।
যন্ত্রনা সহ্য হচ্ছিল না,আর,হয়তো সেকুরেকে না দেখেই চলে যাব এই পৃথিবী থেকে।এই তিক্ততা নিয়ে,এই হতাশা নিয়ে চলে যেতে হবে আমাকে।তারপর অচেনা এক মুখ পাশে এসে দাড়াল,সহানুভুতিতে হেসে এক গ্লাস পানি তুলে দিল,আমাকে।
সবকিছু ভুলে পানির গ্লাসের জন্যে হাতটা বাড়ালাম,গ্লাসটা না দিয়ে সে বললো, ‘যদি পানি চাও,তবে বল পয়গম্বর মোহাম্মদ একজন মিথ্যাবাদী,তার যা যা শিক্ষা সবকিছু মিথ্যা,যদি বল,এখনই পানি পাবে তুমি’।
ওটা শয়তান।আমি কোন উত্তর দেইনি,ভঁয়ও পাইনি তাকে দেখে।আমার কোন সন্দেহ নাই যে ছবির সাথে শয়তানের প্রভাব বা সে ধরণের কোন কিছু নাই।আমি অপেক্ষা করে ছিলাম ওপারের যাত্রা শুরু করার জন্যে।এর পর আলো ছড়ানো এক ফেরেশতাকে দেখলাম,শয়তান ছুটে পালিয়ে গেল।আমার মনটা বলে দিচ্ছিল,ঐ আলোর ফেরেশতা আর কেউ না,স্বয়ং আজরাইল।কিন্ত আমার মনের বিদ্রোহী ভাব বললো,কেয়ামতের বর্ননায় আজরাইল তো হাজার ডানার ফেরেশতা,তার ডানা ছড়ানো পুর্ব থেকে পশ্চিমে,
পৃথিবীটা ধরা তার হাতের মুঠোয়।
চিন্তা যতই এলেমেলো হয়ে যাচ্ছিল-আলোর সেই ফেরেশতা আমার সাহায্যের জন্যে এগিয়ে এলো,অনেকটা ইমাম গাজ্জালীর মুক্তার স্নিগ্ধতা নিয়ে বললো,‘মুখটা খুলো,যাতে তোমার আত্মা তার যাত্রা শুরু করতে পারে’।
‘আমার মুখ আল্লাহর কাছে দোয়া চাওয়া ছাড়া আর কিছুর জন্যে খুলবে না’,আমি বললাম।ওটাই ছিল একমাত্র অজুহাত যা না বলে পারলাম না,যদিও জানতাম হাতে সময় নাই আর।কি ভাবে শুধু এই রক্তাক্ত শরীর রেখে যাব আমার মেয়ের জন্যে,যার সাথে দেখা হবে না আর।কিন্ত পৃথিবীটা তখন আমার কাছে একটা আঁটসাঁট একটা পোষাকের মত যা খুলে ফেলতে পারলেই বাঁচি।

হঠাৎ মুখটা খুললাম,রং এর প্রাচুর্যতায় ভঁরা সারা পৃথিবী,অনেকটা আমদের আঁকা পয়গম্বরের মেরাজ যাত্রার ছবি,তার সশরীরে বেহেশতে যাওয়ার ছবিটা।চারপাশে সবকিছুই ঝকঝকে উজ্জল,যেন সোনা দিয়ে মোড়ানো।কান্নায় ভেসে যাচ্ছিল চোখ,একটা কিছু বের হয়ে গেল মুখ দিয়ে,তারপর চুপচাপ,শুধু নিস্তব্ধতা ছড়ানো এক পৃথিবী।
বুঝতে পারছিলাম,আত্মা ছেড়ে গেছে আমার শরীর,আমি এখন আজরাইলের হাতে পারদের মত এপাশ থেকে ওপাশে পারদের মত নেচে বেড়াচ্ছি।আমার চিন্তাধারায় আর এ পৃথিবীরকোন কিছু মানায় না,নতুন এক পৃথিবীতে আবার যাত্রা হলো শুরু।
যন্ত্রনার ঝড় ধাক্কা ছেড়ে তখন আমি শান্তশিষ্ট নতুন এক চরিত্র।মৃত্যু আমাকে দেয়নি নতুন কোন যন্ত্রনা যা ছড়ানো ছিল আমার মনে,এই জীবন তো আমার শত বছরের না হাজার হাজার বছরের।
এটা আমাকে কোন আনন্দ দেয়নি।জীবনের ঘটনাগুলো যা ভাগ করে ছিল একটা সময়ের খাচায়,এখন সেটা ছড়ানো এখন অনন্তের সুরে।যেন কোন এক দক্ষ চারুশিল্পীর আঁকা দুই পাতার ছবিতে,এখানে ওখানে ছড়ানো আছে সামঞ্জস্য ছাড়া নানান মুখ,অনেক কিছু ঘটে গেল খুব অল্প সময়ে।



আমি সেকুরে

তুষারপাত হচ্ছিল বেশ জোরেসোরে,মাঝে মাঝে বরফ নেকাবের ফাঁক দিয়ে চোখে মুখে লাগছিল।বাগানের কাদামাটি,পচা ঘাস,গাছের ভাঙ্গা ডালের টুকরোর মাঝ দিয়ে হেঁটে বের হলাম,বাড়ীর দিকে।নিশ্চয় সবাই ভাবছে আমার মনের অবস্থাটা,কি?কতটুকু বিশ্বাস আছে আমার সিয়াহর প্রতি?তাহলে বলেই ফেলি,সত্যি কথা বলতে কি আমার নিজেরই জানা নাই,প্রশ্নের উত্তর।নিশ্চয় কারও বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না?আমি কিছুটা হতবুদ্ধি,এ টুকুই বলতে পারি।
এর পর যা হবে সেটা অবশ্য আমার জানা,রান্নাবান্না,ছেলেদের নিয়ে ব্যাস্ত থাকা,মাঝে মাঝে বাবার কাজ নিয়ে ছোটাছুটি করে যাব।এর মাঝে হয়তো কোন একসময় আমার মন না জানান দিবে,কাকে বিয়ে করবো,আমি।

ভাবছি বাড়ীতে পৌঁছানোর আগে আমার অনুভুতি ঝড়ো আবহাওয়াটা কিছুটা পরিষ্কার করে ফেলি।বলতে গেলে সিয়াহর ঐ জঘন্য ব্যাবহারের কথাটা বলতেই হয়,তবে সেটা পরে বললেও চলে।যা বলতে চাচ্ছিলাম সেটা হলো সিয়াহর তাড়াহুড়া করে ঝাপিয়ে পড়াটা,অবশ্য এটা বলাটা ঠিক হবে না,সে কামনার জোয়ারে অন্ধ হয়ে ছিল।এমন না যে আমার খুব একটা আপত্তি ছিল,তবে তার জংলী ভাবের বোকামীতে অবাক না হয়ে পারিনি!তার এত চাওয়ার প্রচন্ডতায় মনে হয়নি,সেটা শুধু শরীর খেলায় ভেসে জোর করে আনন্দে মত্ত হয়ে,ক্লান্তিতে একসময় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে।চোখের ভাষায় এটুকু বুঝতে কষ্ট হয়নি,সিয়াহ আমাকে যথেষ্ট ভালবাসে,প্রচন্ড ভাবে কামনা করে।তবে বারটা বছর অপেক্ষা করার পর কেন সে বোকার মত ব্যাবহার করলো,জন্তর মত ব্যাবহারটা ওকে মানায় না।

কেন জানি ওর শিশুসুলভ সরলতা,নিজেকে সামলে রাখার অক্ষমতা আমাকে আরও টেনে নিয়ে গেছে ওর দিকে,আমি প্রেমে পড়ে গেছি।এ সময় হয়তো আমার রাগে দুঃখে ক্ষেপে যাওয়ার কথা,তা না হয়ে সহানুভুতিই হচ্ছিল আমার, ‘হতভাগা মানুষটা,একেবারেই বাচ্চা ছেলে একটা’,আমার ভেতরের কেউ বললো, ‘তুমি এত যন্ত্রনায় ভুগছো,অথচ কি করা দরকার একেবারেই জানা নেই তোমার’?
আমি ঐ পাগলটার প্রেমে একেবারেই পাগল হয়ে গেছি।আমার ছেলেদের কথা চিন্তা করে তাড়াহুড়া করে হেঁটে যাচ্ছিলাম।তুষারের ঝড়ে আর অন্ধকারে ছায়ার মত,কেউ একজন দৌড়ে পালাচ্ছিল,তাড়াতাড়ি একপাশে সরে গেলাম।
আঙ্গিনার দরজা দিয়ে ঢুকে মনে হলো,হাইরিয়ে তখনও ছেলেদের নিয়া বাড়ীতে ফিরেনি।
মাগরেবের নামাজের আজান হয়নি তখনও,সময়মতই বাড়ীতে ফিরলাম বলে মনে হলো।
সিড়ি দিয়ে উপরে উঠার সময় মনে হলো,সারা বাড়ীতে কেমন জানি মার্মালেডের গন্ধে ভঁরে গেছে।বাবা হয়তো অন্ধকারে নীল দরজার ঘরটাতে একা বসে আছে,পা গুলো ঠান্ডায় একেবারে জমে যাচ্ছে।বাতি নিয়ে ঘরে ঢুকে দেখি,ড্রয়ারগুলো খোলা,জিনিষপত্র চারপাশে ছড়ানো ছিটানো,মনে হয় শয়তান অর্হান আর সেভকেতের কাজ।কেমন জানি বেশ চুপচাপ হয়ে আছে বাড়ীটা তবে অন্যান্য দিনের নিঃস্তব্ধতায় ভঁরা না,এটা সম্পুর্ন অজানা আরেক জগত।কাপড়চোপড় খুলে ঘরে চুপচাপ বসে ছিলাম,বাবা হয়তো কোথাও গেছে,
আস্তাবলের পাশের ঘরটা থেকে শব্দ আসছিল,কে আবার এলো এ সময়।নাকি বাবা গেল আস্তাবলে,
এই ঠান্ডায় বাবা কি করছে ওখানে?কিন্ত কোন আলো তো ছিল না ওখানে।দরজার শব্দ আর কতগুলো কুকুরের কান্নার শব্দ ভেসে আসছিল একপাশ থেকে।
চীৎকার করে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হাইরিয়ে,সেভকেত,অর্হান...’।
শীতের হাল্কা ছোঁয়ায় শরীরটা কাঁপছিল,বাবাকে ঘর গরম করার তামার ঘামলার কাছে নিয়ে বসাতে হবে,ঠান্ডা হয়ে গেছে শরীর তার।বললাম, ‘বাবা ঘরটা এভাবে তছনছ করে রাখলো কেন’?
মাটিতে শুয়ে আছে,বাবা।
চীৎকার করলাম,ভঁয়ে আমার শরীর কাঁপছিল,আবার চীৎকার করলাম।বাবার শরীরটা মাটিতে পড়ে আছে,আর চারপাশে অদ্ভুত এক নিঃস্তব্ধতা।
শোন,আমি বলতে পারি তোমাদের যাদের ঠোঁট একেবারে তালামারা আর যাদের সাপের মত ঠান্ডা রক্ত,তারা তো সবই জানা কি ঘটে গেছে এই ঘরটায়,যদি ও সম্পূর্নটা না ও হয় নিঃসন্দেহে জানা আছে বেশির ভাগটাই।এখন হয়তো ঐ ঘটনায় আমার প্রতিক্রিয়া জানার জন্যে সবাই উচাটন হয়ে আছে।অনেকটা যেমন ছবির চেহারার পাঠকেরা গল্পের চরিত্রের যন্ত্রনাটা উপলদ্ধি করতে চায়।এখন নিশ্চয় কেঁউ বোঝার চেষ্টা করবে না,আমার যন্ত্রনাটা,বরং সবাই কল্পনা করবে যদি তাদের বাবা খুন হতো এ ভাবে,তা হলে কি করতো তারা।

০০০০০০০০০



(২১)

‘আমরাই জয়ী হলাম শেষমেষ’,আমি বললাম, ‘তুমি কি শোন নি,জারিফ এফেন্দীর কাছ থেকে ভেনিসের শিল্পীদের অনুকরন করার অপবাদের যন্ত্রনা,কত অসহনীয়।আমরা তাদেরকে নকল করে ছবি আঁকলে,সময়ে আমাদের ছবি হারাবে তার রং এর বৈচিত্র,ফ্যাকাসে হয়ে যাবে আমদের আবেগ,উদ্বেগ।সময়ে লোকজন উৎসাহ দেখাবে না আমাদের বই এ,আর যদি কেউ উৎসাহ দেখায়ও,ছবি আর কথার সামঞ্জস্যটা উপলদ্ধি করতে পারবে না,তারা।বই বাঁধানো হয় আরবের আঠা দিয়ে,মধূ,মাছ,হাড়,আর পাতাগুলো ঢাকা ডিমের সাদা অংশ,আটা মেশানো কিছু একটা।

লোভী,নির্লজ্জ ইঁদুর,উইপোকা,পোকা,হাজারো ধরণের পোকামাকড় ধারাল দাঁত দিয়ে বই এর পাতা কুটে কুটে শেষ করে দেয়।বাধাই ছিড়ে যায়,পাতাগুলো ছিঁড়ে যায়,তারপর অনেক সময় আর ওটার কোন অস্তিত্বও থাকে না।কাজের মেয়েরা চুলার আগুনের জন্যে পাতা ছিঁড়ে নেয়,কম বয়সী শাহজাদারা বই এর পাতায় হিজিবিজি এঁকে খেলা করে,চোখগুলো কাল করে দেয়,নাকের সর্দি ঝেড়ে নোংরা করে,আর ধর্মীয় কথাবার্তা যা লেখা সবই ঢাকা পড়ে হারায় অজানায়।ছবিগুলো ছিঁড়ে নতুন ছবিও তৈরী হয়,খেলাধুলা-আনন্দের জন্য।মায়েরা ছিঁড়ে ফেলে ছবি যা তাদের চোখে মনে অশ্লীল-আর বাবা,বড় ভাই এর দল অনেকে হস্তমৈথুন করে ছবির উপরেই বীর্যপাত করতে দ্বিধাবোধ করে না,একটা পাতা আরেকটা পাতার সাথে আটকে থাকে,শুধু এ কারণেই না,কাদামাটি,খারাপ আঠা,থুতু আরও অনেক কিছু আছে,সময়ে সেখানে চিতি পড়ে ফুলের মত ছড়ায় চারপাশে।

আর যদি একটা বই কোনভাবে যদি বেঁচে যায়,এক সময় সেটাও আগুনে পড়ে নষ্ট হয়।ইস্তাম্বুলে এমন কোন বাড়ী নাই যা একবার না একবার আগুন পুড়ে যায় নি।ইস্তাম্বুলে প্রতি তিন বছরে যত বই আর লাইব্রেরী নষ্ট হয়,মঙ্গোলদের বাগদাদের আগুনেও তত বই নষ্ট হয়নি।কোন চারুশিল্পী কি ভাবতে পারে তার ছবির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে একশ বছর পরে-বা তার ছবি একদিন বিহজাদের ছবির মত সবাই অবাক চোখে দেখবে?শুধু আমাদের ছবি না বেশীর ভাগ ছবিই একদিন হারাবে পৃথিবীর চোখ থেকে-হয়তো আগুনে না হয় পোকার দাতেঃশিরিনের জানালা দিয়ে অবাক চোখে হুসরেভকে দেখার দৃশ্য,
হুসরেভের লুকিয়ে লুকিয়ে শিরিনের গোসলের দৃশ্য দেখা,প্রেমিক প্রেমিকার এঁকে অন্যেতে অবাক হয়ে হারিয়ে যাওয়া,প্রেমে বিভ্রান্ত মেজনুনের পাহাড়ী ভেড়া আর সাদা বাঘের কাছে
দুঃখের কাহিনী শোনানোর দৃশ্য,ফেরেশতা,ফুল,পাখী-ফোঁটা দিয়ে সাজানো বই এর পাতা।
বাশের বাশী যা ছিল হাফিজের রহস্যভঁরা মনমুগ্ধ করা কবিতায়,পাতার দেয়ালের রং হয়তো শত শত শিক্ষানবীসের চোখের আলো চলে গেছে ছবিগুলো আঁকতে গিয়ে,দেয়ালে ঝোলানো ছবি,কোন একজায়গায় আছে লুকানো শিল্পীর চিহ্ন,তা ছাড়া জানার উপায় কোথায় ঐ সব শিল্পীদের নাম।সুলতানের দাদা জয়ের গর্বে হেঁটে যাচ্ছে শত্রুপক্ষের দূর্গ,কামান,বন্ধুক,তাবুর মাঝখানে,কৈশোরে তুমি কম সাহায্য করনি ছবিটা আঁকতে,পেছনে কাফেরদের রাষ্ট্রদুত নত হয়ে সুলতানের দাদার পায়ে চুমু খাচ্ছে,এক পাশে দাঁড়ানো শয়তান শিং নিয়ে,হতে পারে শিং ছাড়া,লেজ নিয়ে বা লেজ ছাড়া,ধারালো দাঁত,ধারালো নখঃ সাথে আছে নানান ধরণের পাখী,এমন কি বাদশাহ সোলায়মানের জ্ঞানী কাঠঠোকরা পাখীও বাদ পড়েনি,ডো ডো পাখী,কুকুর বিড়াল,ভেসে যাওয়া মেঘ,নেচে যাওয়া ঘাস এক এক করে সাজানো,ঝাউ গাছ,ডালিমের গাছ সবকিছুই ধৈর্যের সাথে তুলির ছোঁয়ায় জীবন্ত,কোন কিছুই বাদ পড়েনি-প্রাসাদের ছবি এক একটা করে ইটে তুলে ধরা,আছে তৈমুর লং বা শাহ তামাসাপ,তবে গল্পগুলো তার চেয়েও পুরোনো।

দলে দলে শাহজাদারা রকমারী ফুল আর ফুলের গাছের সাজানো গালিচায় বসে গান শুনছে,গালিচা,ফুলদানী সমরখন্দ থেকে আনা ইস্তাম্বুলে,শতশত শিক্ষানবীসের অত্যাচারের,
চোখের জলের কাহিনী আছে সেখানে।বাগান,ছুটে যাওয়া ঘুড়ি যা তুমি তোমার পুরোনো উৎসাহ নিয়ে আজও এঁকে যাচ্ছ,যুদ্ধ আর মৃত্যুর দৃশ্য,সুলতানের শিকারের দৃশ্য,সেই একই সৌন্দর্যে আঁকা ছুটে যাওয়া হরিনের দল,মৃত্যুপথ যাত্রী শাহ,যুদ্ধবন্ধী,অবিশ্বাসী-এমন কি অন্ধকার রাত্রির কালো কুচকুচে আকাশ,সবই যেন জীবন্ত হয়ে আছে তোমার তুলির ছোঁয়ায়।তোমার আঁকা এত সব কিছু হয়তো কোন্ কিছুই টিকে থাকবে না সময়ের খাতায়...’।

কালির দোয়াতটা উঁচু করে ধরে তার সব শক্তি দিয়ে সে মারলো আমার মাথায়,টলে কিছুদুর এগিয়ে পড়ে গেলাম,প্রচন্ড একটা ব্যাথা মাথায় যা ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা ছিল না আমার।সারা পৃথিবী কাঁদছিল আমার ব্যাথায়,চারপাশে সবকিছুই হলুদ হয়ে গেল,কিছুক্ষনের মধ্যেই।কোন সন্দেহ ছিল আঘাতটা একেবারেই ইচ্ছাকৃত-তবুও বিশ্বাস হচ্ছিল না মার,অন্য কিছু একটা ভাবতে ইচ্ছা হচ্ছিল,‘দয়া করে বলবে এটা কি করলে, তুমি কি ভুলে আঘাত করলে আমাকে’।
কোন উত্তর না দিয়ে সে,কালির দোয়াতটা তুলে আবার মারলো আমাকে।আমার অবিশ্বাসী মনটা বুঝতে পারলো,ওটা ভুল ছিল না,নিঃসন্দেহে ইচ্ছাকৃত ভাবেই সে আঘাত করে যাচ্ছে,কিন্ত কেন,এভাবেই কি শেষ হবে আমার জীবনের গল্প?সারা শরীর কাঁপছিল ভঁয়ে,চুপ করে থাকলে হয়তো ও কোন কিছু করতো না,তবে অসহ্য যন্ত্রনায় চীৎকার করলাম,সমস্ত শক্তি জড় করে।সন্ধ্যার এই সময়টায়,চারপাশের বরফে ঢেকে রাখা রাস্তার নির্জনতায় কেই বা শুনবে আমার চীৎকার,একা আমি আর নিস্তবদ্ধতা।

আমার চীৎকার আর অসহায়তায় কিছুটা ইতস্তত হলেও,সে থেমে যায়নি।চোখে চোখে হলে বুঝতে পারলাম লজ্জা আর ভয় থাকলেও,সে যা করতে চায় সেটা সে করবেই এটা।তখন সে আর খ্যাতনামা একজন চারুশিল্পী না,অজানা এক শয়তান যার সাথে আমার দুরত্ব হাজার বছরের।ওর হাতটা ধরে পৃথিবীতে ফিরে আসার চেষ্টা করছিলাম,কিন্ত পারলাম না।বললাম,নাকি ওটা শুধু ভাবনা জানি না, ‘শোন,দয়া করে আমার কথাটা শোন,এ ভাবে আমার জীবনটা শেষ করে দিও না’।

কোন শব্দ ছিল না আমার মুখে,কথাগুলো আটকে ছিল কোথাও,কালির দোয়াতটা তুলে ও আবার মারলো আমার মাথায়।আমার চিন্তাধারা,দেখাগুলো,স্মৃতির আকাশ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে তখম,কিছুই ছিল না কোথাও শুধু অজানা একটা ভয়।শুধু লাল,টকটকে লাল,লাল রং ভেসে যাচ্ছি আমি,ভাবছিলাম রক্ত,তবে সেটা লাল কালি,আর ওর হাতে লাল রংটা কালি না শুধুই আমার রক্ত।

এটা অন্যায়,এত নিষ্ঠুর ভবিতব্য আমার প্রতি,আমি কি মারা যাচ্ছি সেই মুহুর্তে,আমার মন সেটাই বলে দিচ্ছিল।দেখলাম,আমার স্মৃতিতে শুধু শূন্যতা,কিছুই নেই সেখানে,বাইরের ধবধবে সাদা বরফের মত,আমার হ্রদপিন্ড ছুটে গেছে আমার মুখে।

মৃত্যুর বর্ননা দিচ্ছি,সবাই জানে,মৃত্যু সবকিছুর শেষ না,এটাও সবাই জানে মৃত্যু আসবেই কোন না কোন একসময়।যেমন লেখা আছে নানান কেতাবে,মৃত্যু যন্ত্রনাদায়ক চিন্তার বাইরে এক অনুভুতি।শুধু আমার ফেটে যাওয়া মাথা,মগজ না শরীরের সব অঙ্গপ্রতঙ্গ যেন অভাবনীয় যন্ত্রনায় পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে,এই অশেষ যন্ত্রনা থেকে শরীরটাকে উদ্ধার করার জন্যে-আমি ঘুমের রাজ্য খুঁজছিলাম।

মৃতুর আগে মনে কৈশোরে শোনা এক কাহিনীর কথা মনে পড়লো।একজন বুড়ো যে একাই থাকতো,একরাতে ঘুম থেকে উঠে এক গ্লাস পানি খেয়ে গ্লাসটা একপাশে রেখে শুতে যাওয়ার সময় দেখে তার মোমবাতিটা সেখানে নাই।কোথায় গেল মোমবাতি?দেখলো হাল্কা একটা বাতি আসছে ঘরের ভেতর থেকে।আলোটা ধরে ঘরে ফিরে সে দেখে তার বিছানায় মোমবাতি হাতে অন্য কেউ শুয়ে আছে।বুড়ো অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, ‘তুমি কে’?শুয়ে থাকা মানুষটা বললো, ‘কে আবার,আমি আজরাইল,আমি মৃত্যু’।বুড়ো হতবাক হয়ে চুপচাপ ছিল কিহুক্ষন,তারপর সে প্রশ্ন করলো, ‘তা হলে তুমি আমাকে নিয়ে যেতে চাও’?‘হ্যা’,একটু ঔদ্ধত্যের সুরে সে উত্তর দিল।‘না’,বুড়ো বেশ দৃঢ় সুরেই বললো, ‘ আমি জানি,তুমি আমার দুঃস্বপ্নের একটা অংশ’।বুড়ো তার বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটার মোমবাতি ফুঁ দিয়ে নিভাল,ঘন অন্ধকারে সবকিছু হারিয়ে গেল।বুড়ো নিজের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো আবার,প্রায় আরও বিশটা বছর বেঁচে ছিল,সে।

আমি জানি আমার ভাগ্যে ও ধরণের অলৌকিক কিছু ঘটবে না,সে আমার মাথায় কালির দোয়াত দিয়ে আরেকবার মারলো।যন্ত্রনা তখন এমন এক পর্যায়ে,সমস্ত অনুভুতি ভোঁতা হয়ে গেছে।সে,কালির দোয়াত,মোমবাতি সবকিছুই আমার দৃষ্টি ছেড়ে গেছে।বেঁচে আছি আমি তখনও,বেঁচে থাকার আগ্রহটা বেড়ে গেছে হাজার গুন,তার কাছ থেকে কোনভাবে পালিয়ে নিজেকে রক্ষা করার আগ্রহ আরও প্রচন্ড তখন।তার হাতে বেশ জোরে কামড় দিলাম,আর আমার মুখে ধাক্কা দিয়ে সে আবার বললো ভারী কালির দোয়াতের কথা।
কিছুক্ষন ধ্বস্তাধস্তি চললো,অবশ্য সেটাকে যদি ধ্বস্তাধস্তি বলা যায়,তার শরীরের শক্তি তখন আরেক পর্যায়ে,সে তখন এক খুনী।সে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল আমাকে,চিত হয়ে
পড়েছিলাম।

হাঁটু দিয়ে আমাকে আটকে নোংরা ভাষায় গালাগালি করছিল ও,কেন যে সে মৃত্যু পথযাত্রী এক বুড়োকে ও ভাবে অত্যাচার করছিল!জানি না তার কথা কাঙে আসছিল না,নাকি আমার কোন কিছু বোঝার শক্তি ছিল না আর।সে কালির দোয়াতটা দিয়ে আরেক বার মারলো আমাকে,ওর রক্তজবার লাল টকটকে চোখের দিকে তাকানোর কোন ইচ্ছা ছিল না আমার।তার শরীর কাঁপড়চোপড়,লাল হয়ে গেছে দোয়াতের কালিতে সাথে আমার ছুটে যাওয়া রক্তে।

খুব দুঃখের কথা এই যে আমাকে শেষ দেখতে হবে,আমার খুনীর মুখটা,হাল্কা একটা আলো দেখে আমার যন্ত্রনার মাত্রাটা কিছুটা কমে গেছে তখন।আলো হাতে দাঁড়িয়েছিল অজানা,
অস্পষ্ট,কেউ,জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি কে’?
‘আমি,আর কে আবার,আমি আজরাইল’,সে বললো, ‘আমি,যার কাজ হলো মানুষের এ পৃথিবীর যাত্রা শেষ করা।আমি মাকে তার সন্তানদের কাছ থেকে নিয়ে যাই,বিচ্ছিন্ন করি,স্বামীদের বৌ এর কাছ থেকে,বাবাদের মেয়েদের কাছ থেকে,এই পৃথিবির কারও অব্যাহতি নেই আমার হাত থেকে।
বুঝলাম,মৃত্যু অবধারিত,কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম,কাঁদতে কাঁদতে বেশ পিপাসা লাগলো,একদিকে মুখের মাথার যন্ত্রনা,চোখে রক্ত গড়িয়ে আসছে,আরেক দিকে ভাবছিলাম চেনা জগতের নিষ্ঠুরতার কথা,ব্যাথা থেমে গেছে,তবুও সামনে আছে জগতটা অচেনা আর ভঁয়ে সাজানো।
ওটা মৃতের দেশ,আজরাইল আমাকে নিয়ে যাচ্ছে,আর আমি তখন ভঁয়ে কাতর,এই পৃথিবীতে আমার সময় শেষ হয়ে গেছে।এই পৃথিবীতে থাকার অযোগ্য আমি,এই বুড়ো ভেঙ্গে পড়া শরীরে সেটা একেবারেই অসম্ভব।

মৃত্যুর আগে যন্ত্রনায় মৃত্যুকে ডাকছিলাম,এখন সেই অজানা প্রশ্নটা না জেনেই চলে যেতে হবে,যার উত্তর খুঁজে পাই নি কোন বই এ,এ ভাবেই কি সবাই মৃত্যুর রাজ্যে ছুটে যায়?ইচ্ছা অনিচ্ছায় ছুটে যাচ্ছি মৃত্যুর দেশে,আরও নতুন অনেক না দেখা,না জানার রাজ্যে আমি।

একজন মানুষ অন্য পৃথিবীর যাত্রার জন্যে যার প্রস্ততি পর্ব শেষ,তার মন তবুও দোটানায়-ভুলে যেতে পারছে না ঘরটা,চোখ বুলাচ্ছে আসবাবপত্রে।মেয়েকে আরেকবার দেখার ইচ্ছা হচ্ছিল,দাঁতে দাঁত কামড়ে আমাকে কোন না কোনভাবে অপেক্ষা করতে মেয়ে সেকুরের ফিরে আসার জন্যে,একবার দেখা হয় যেন।

মৃত্যুর সেই আলো কিছুটা সরে গেছে তখন,মন,চোখ,কান শুনতে পাচ্ছে,কিছুটা অনুভব করতে পারছে চারপাশের শব্দ,হৈচৈ।শুনতে পাচ্ছিলাম আমার খুনী খুঁজে বেড়াচ্ছে,কাগজপত্র,
আলমারীর মধ্যে শেষ ছবিটা।শব্দ পেলাম চাকু দিয়ে রং এর বাক্স খোলার শব্দ,লাথি মেরে ফেলে দিচ্ছিল সে বাক্সগুলো এলোপাথাড়ি ভাবে,ছুঁড়ে দিচ্ছিল কালির দোয়াত।অনুভব করছিলাম বেঁচে থাকার জন্যে আমার হাহাকার,মাঝে মাঝে হাত পা কাপুনি দিচ্ছিল।
আমি অপেক্ষা করছি,এমন না যে আমার যন্ত্রনা একেবারেই কমে গেছে।চুপচাপ হয়ে গেছি,দাঁত কামড়ে ধরে থাকার শক্তিটা যদিও নেই,তবুও অপেক্ষা করছি
একসময় মনে হলো,সেকুরে যদি তখন আসে,সেও তো বিপদে পড়বে,এই খুনী কি তখন তাকে ছেড়ে দিবে?তবে কেন জানি ঐ চিন্তাটা দূরে সরিয়ে রাখছিলাম।এক সময় মনে হলো খুনী ঘর ছেড়ে চলে গেছে,হয়তো সাথে নিয়ে গেছে শেষ ছবিটা।

গলাটা আর ও শুকিয়ে যাচ্ছে,বড্ড পিপাসা পাচ্ছে,তবুও আমি অপেক্ষা করছি।আমার প্রিয় সেকুরের জন্যে,সেকুরে কোথায় তুই,তাড়াতাড়ি আয়,আর যে দেখা হবে না কখনও।
সেকুরে এলো না।
যন্ত্রনা সহ্য হচ্ছিল না,আর,হয়তো সেকুরেকে না দেখেই চলে যাব এই পৃথিবী থেকে।এই তিক্ততা নিয়ে,এই হতাশা নিয়ে চলে যেতে হবে আমাকে।তারপর অচেনা এক মুখ পাশে এসে দাড়াল,সহানুভুতিতে হেসে এক গ্লাস পানি তুলে দিল,আমাকে।
সবকিছু ভুলে পানির গ্লাসের জন্যে হাতটা বাড়ালাম,গ্লাসটা না দিয়ে সে বললো, ‘যদি পানি চাও,তবে বল পয়গম্বর মোহাম্মদ একজন মিথ্যাবাদী,তার যা যা শিক্ষা সবকিছু মিথ্যা,যদি বল,এখনই পানি পাবে তুমি’।
ওটা শয়তান।আমি কোন উত্তর দেইনি,ভঁয়ও পাইনি তাকে দেখে।আমার কোন সন্দেহ নাই যে ছবির সাথে শয়তানের প্রভাব বা সে ধরণের কোন কিছু নাই।আমি অপেক্ষা করে ছিলাম ওপারের যাত্রা শুরু করার জন্যে।এর পর আলো ছড়ানো এক ফেরেশতাকে দেখলাম,শয়তান ছুটে পালিয়ে গেল।আমার মনটা বলে দিচ্ছিল,ঐ আলোর ফেরেশতা আর কেউ না,স্বয়ং আজরাইল।কিন্ত আমার মনের বিদ্রোহী ভাব বললো,কেয়ামতের বর্ননায় আজরাইল তো হাজার ডানার ফেরেশতা,তার ডানা ছড়ানো পুর্ব থেকে পশ্চিমে,
পৃথিবীটা ধরা তার হাতের মুঠোয়।
চিন্তা যতই এলেমেলো হয়ে যাচ্ছিল-আলোর সেই ফেরেশতা আমার সাহায্যের জন্যে এগিয়ে এলো,অনেকটা ইমাম গাজ্জালীর মুক্তার স্নিগ্ধতা নিয়ে বললো,‘মুখটা খুলো,যাতে তোমার আত্মা তার যাত্রা শুরু করতে পারে’।
‘আমার মুখ আল্লাহর কাছে দোয়া চাওয়া ছাড়া আর কিছুর জন্যে খুলবে না’,আমি বললাম।ওটাই ছিল একমাত্র অজুহাত যা না বলে পারলাম না,যদিও জানতাম হাতে সময় নাই আর।কি ভাবে শুধু এই রক্তাক্ত শরীর রেখে যাব আমার মেয়ের জন্যে,যার সাথে দেখা হবে না আর।কিন্ত পৃথিবীটা তখন আমার কাছে একটা আঁটসাঁট একটা পোষাকের মত যা খুলে ফেলতে পারলেই বাঁচি।

হঠাৎ মুখটা খুললাম,রং এর প্রাচুর্যতায় ভঁরা সারা পৃথিবী,অনেকটা আমদের আঁকা পয়গম্বরের মেরাজ যাত্রার ছবি,তার সশরীরে বেহেশতে যাওয়ার ছবিটা।চারপাশে সবকিছুই ঝকঝকে উজ্জল,যেন সোনা দিয়ে মোড়ানো।কান্নায় ভেসে যাচ্ছিল চোখ,একটা কিছু বের হয়ে গেল মুখ দিয়ে,তারপর চুপচাপ,শুধু নিস্তব্ধতা ছড়ানো এক পৃথিবী।
বুঝতে পারছিলাম,আত্মা ছেড়ে গেছে আমার শরীর,আমি এখন আজরাইলের হাতে পারদের মত এপাশ থেকে ওপাশে পারদের মত নেচে বেড়াচ্ছি।আমার চিন্তাধারায় আর এ পৃথিবীরকোন কিছু মানায় না,নতুন এক পৃথিবীতে আবার যাত্রা হলো শুরু।
যন্ত্রনার ঝড় ধাক্কা ছেড়ে তখন আমি শান্তশিষ্ট নতুন এক চরিত্র।মৃত্যু আমাকে দেয়নি নতুন কোন যন্ত্রনা যা ছড়ানো ছিল আমার মনে,এই জীবন তো আমার শত বছরের না হাজার হাজার বছরের।
এটা আমাকে কোন আনন্দ দেয়নি।জীবনের ঘটনাগুলো যা ভাগ করে ছিল একটা সময়ের খাচায়,এখন সেটা ছড়ানো এখন অনন্তের সুরে।যেন কোন এক দক্ষ চারুশিল্পীর আঁকা দুই পাতার ছবিতে,এখানে ওখানে ছড়ানো আছে সামঞ্জস্য ছাড়া নানান মুখ,অনেক কিছু ঘটে গেল খুব অল্প সময়ে।



আমি সেকুরে

তুষারপাত হচ্ছিল বেশ জোরেসোরে,মাঝে মাঝে বরফ নেকাবের ফাঁক দিয়ে চোখে মুখে লাগছিল।বাগানের কাদামাটি,পচা ঘাস,গাছের ভাঙ্গা ডালের টুকরোর মাঝ দিয়ে হেঁটে বের হলাম,বাড়ীর দিকে।নিশ্চয় সবাই ভাবছে আমার মনের অবস্থাটা,কি?কতটুকু বিশ্বাস আছে আমার সিয়াহর প্রতি?তাহলে বলেই ফেলি,সত্যি কথা বলতে কি আমার নিজেরই জানা নাই,প্রশ্নের উত্তর।নিশ্চয় কারও বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না?আমি কিছুটা হতবুদ্ধি,এ টুকুই বলতে পারি।
এর পর যা হবে সেটা অবশ্য আমার জানা,রান্নাবান্না,ছেলেদের নিয়ে ব্যাস্ত থাকা,মাঝে মাঝে বাবার কাজ নিয়ে ছোটাছুটি করে যাব।এর মাঝে হয়তো কোন একসময় আমার মন না জানান দিবে,কাকে বিয়ে করবো,আমি।

ভাবছি বাড়ীতে পৌঁছানোর আগে আমার অনুভুতি ঝড়ো আবহাওয়াটা কিছুটা পরিষ্কার করে ফেলি।বলতে গেলে সিয়াহর ঐ জঘন্য ব্যাবহারের কথাটা বলতেই হয়,তবে সেটা পরে বললেও চলে।যা বলতে চাচ্ছিলাম সেটা হলো সিয়াহর তাড়াহুড়া করে ঝাপিয়ে পড়াটা,অবশ্য এটা বলাটা ঠিক হবে না,সে কামনার জোয়ারে অন্ধ হয়ে ছিল।এমন না যে আমার খুব একটা আপত্তি ছিল,তবে তার জংলী ভাবের বোকামীতে অবাক না হয়ে পারিনি!তার এত চাওয়ার প্রচন্ডতায় মনে হয়নি,সেটা শুধু শরীর খেলায় ভেসে জোর করে আনন্দে মত্ত হয়ে,ক্লান্তিতে একসময় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে।চোখের ভাষায় এটুকু বুঝতে কষ্ট হয়নি,সিয়াহ আমাকে যথেষ্ট ভালবাসে,প্রচন্ড ভাবে কামনা করে।তবে বারটা বছর অপেক্ষা করার পর কেন সে বোকার মত ব্যাবহার করলো,জন্তর মত ব্যাবহারটা ওকে মানায় না।

কেন জানি ওর শিশুসুলভ সরলতা,নিজেকে সামলে রাখার অক্ষমতা আমাকে আরও টেনে নিয়ে গেছে ওর দিকে,আমি প্রেমে পড়ে গেছি।এ সময় হয়তো আমার রাগে দুঃখে ক্ষেপে যাওয়ার কথা,তা না হয়ে সহানুভুতিই হচ্ছিল আমার, ‘হতভাগা মানুষটা,একেবারেই বাচ্চা ছেলে একটা’,আমার ভেতরের কেউ বললো, ‘তুমি এত যন্ত্রনায় ভুগছো,অথচ কি করা দরকার একেবারেই জানা নেই তোমার’?
আমি ঐ পাগলটার প্রেমে একেবারেই পাগল হয়ে গেছি।আমার ছেলেদের কথা চিন্তা করে তাড়াহুড়া করে হেঁটে যাচ্ছিলাম।তুষারের ঝড়ে আর অন্ধকারে ছায়ার মত,কেউ একজন দৌড়ে পালাচ্ছিল,তাড়াতাড়ি একপাশে সরে গেলাম।
আঙ্গিনার দরজা দিয়ে ঢুকে মনে হলো,হাইরিয়ে তখনও ছেলেদের নিয়া বাড়ীতে ফিরেনি।
মাগরেবের নামাজের আজান হয়নি তখনও,সময়মতই বাড়ীতে ফিরলাম বলে মনে হলো।
সিড়ি দিয়ে উপরে উঠার সময় মনে হলো,সারা বাড়ীতে কেমন জানি মার্মালেডের গন্ধে ভঁরে গেছে।বাবা হয়তো অন্ধকারে নীল দরজার ঘরটাতে একা বসে আছে,পা গুলো ঠান্ডায় একেবারে জমে যাচ্ছে।বাতি নিয়ে ঘরে ঢুকে দেখি,ড্রয়ারগুলো খোলা,জিনিষপত্র চারপাশে ছড়ানো ছিটানো,মনে হয় শয়তান অর্হান আর সেভকেতের কাজ।কেমন জানি বেশ চুপচাপ হয়ে আছে বাড়ীটা তবে অন্যান্য দিনের নিঃস্তব্ধতায় ভঁরা না,এটা সম্পুর্ন অজানা আরেক জগত।কাপড়চোপড় খুলে ঘরে চুপচাপ বসে ছিলাম,বাবা হয়তো কোথাও গেছে,
আস্তাবলের পাশের ঘরটা থেকে শব্দ আসছিল,কে আবার এলো এ সময়।নাকি বাবা গেল আস্তাবলে,
এই ঠান্ডায় বাবা কি করছে ওখানে?কিন্ত কোন আলো তো ছিল না ওখানে।দরজার শব্দ আর কতগুলো কুকুরের কান্নার শব্দ ভেসে আসছিল একপাশ থেকে।
চীৎকার করে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হাইরিয়ে,সেভকেত,অর্হান...’।
শীতের হাল্কা ছোঁয়ায় শরীরটা কাঁপছিল,বাবাকে ঘর গরম করার তামার ঘামলার কাছে নিয়ে বসাতে হবে,ঠান্ডা হয়ে গেছে শরীর তার।বললাম, ‘বাবা ঘরটা এভাবে তছনছ করে রাখলো কেন’?
মাটিতে শুয়ে আছে,বাবা।
চীৎকার করলাম,ভঁয়ে আমার শরীর কাঁপছিল,আবার চীৎকার করলাম।বাবার শরীরটা মাটিতে পড়ে আছে,আর চারপাশে অদ্ভুত এক নিঃস্তব্ধতা।
শোন,আমি বলতে পারি তোমাদের যাদের ঠোঁট একেবারে তালামারা আর যাদের সাপের মত ঠান্ডা রক্ত,তারা তো সবই জানা কি ঘটে গেছে এই ঘরটায়,যদি ও সম্পূর্নটা না ও হয় নিঃসন্দেহে জানা আছে বেশির ভাগটাই।এখন হয়তো ঐ ঘটনায় আমার প্রতিক্রিয়া জানার জন্যে সবাই উচাটন হয়ে আছে।অনেকটা যেমন ছবির চেহারার পাঠকেরা গল্পের চরিত্রের যন্ত্রনাটা উপলদ্ধি করতে চায়।এখন নিশ্চয় কেঁউ বোঝার চেষ্টা করবে না,আমার যন্ত্রনাটা,বরং সবাই কল্পনা করবে যদি তাদের বাবা খুন হতো এ ভাবে,তা হলে কি করতো তারা।

০০০০০০০০০


মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১:৪৩

রাজীব নুর বলেছেন: আপনার উচিৎ অন্যের পোস্ট পড়া, মন্তব্য করা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.