নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইল্লু

ইল্লু › বিস্তারিত পোস্টঃ

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ) ধারাবাহিক

২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ রাত ১:৫৮

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ)
ধারাবাহিক
ফেনিত অর্হান পামুক
জন্মঃ জুন,১৯৫২
তুরস্কের খ্যাতনামা এক উপন্যাস লেখক
২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান
খ্যাতনামা লেখার মধ্যে My name is red,Silent house,white castle আরও অন্যান্য অনেক লেখা



(২২)

সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে দেখি,বাবাকে কেউ খুন করে গেছে।ছোটবেলার মতই আমার চুল ছিঁড়ছিলাম,বাবাকে জড়িয়ে তার শরীরের গন্ধটা খুঁজছিলাম।কাঁপছিলাম মাঝে মাঝে,আল্লাহর কাছে দোয়া করছিলাম,আল্লাহ যদি কোনভাবে ফিরিয়ে দেয় বাবাকে,বাবা যেন ফিরে যায় ছবি আঁকার টেবিলে,বই পত্রের পাশে।বাবা দোহাই তোমার চলে যেও না,ছেড়ে যাবে না আমাকে একা,এই পৃথিবীর জঙ্গলে,উঠে বস,জড়িয়ে আদর কর তোমার সেকুরেকে।বাবার রক্তাক্ত মাথা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে।ছেড়া কাগজ,ছেড়া বই,ভাঙ্গা টেবিল,কালির দোয়াত,ছেড়া বসার তোষক,রাগে কেউ একজন সবকিছু তছনছ করে বাবাকে খুন করে গেছে।ঘরের চারপাশে ঘৃনা,নিষ্ঠুরতার প্রভাব প্রকট হয়ে ছিল,কান্না ছিল না আমার চোখে,ভাবছিলাম ঐ অজানা আততায়ীর জন্যে আমার অবিশ্বাস্য ক্ষোভ আর প্রতিশোধের স্বাদ।অন্ধকারে এক স্বামী স্ত্রীর হাসিঠাট্টার কথা ভেসে আসছিল কানে,কিন্ত আমাদের পৃথিবীতে তখন অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা,নাকের পানি,চোখের কান্না মুছে ভাবছিলাম,ছেলেদের,এই সংসারের কি হবে,কে হাল ধরবে এই ঝড়ে হারানো নৌকার।

বাবার শরীরটা টেনে বাইরে নিয়ে গেলাম,যে কারণেই হউক,অনেক ভারী হয়ে গেছে শরীরটা,সিড়িতে কিছুদূর নিয়েই ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লাম,একটু বিশ্রাম নিয়ে নীচে নিয়ে গেলাম,কোনরকমে।রান্নাঘর থেকে বাতি এনে ঘরটা দেখে অবাক হচ্ছিলাম,কারও পক্ষে এভাবে চারপাশটা তছনছ করে দেওয়া কি সম্ভব,কিইবা হতে পারে তার রাগের কারণ?

কে করলো এই কাজ,কোন জানোয়ার করলো এই কাজটা?নানান ভাবে বিশ্লেষন করেও,
কোন কুল কিনারা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।কেন হলো এ সব?বালতিতে পানি এনে ঘরটা পরিষ্কার করলাম,রক্ত মাখানো কাঁপড় খুলে নতুন কাঁপড়ও পরলাম,বাবার লাশকে।বালতি নিয়ে নীল দরজার ঘরে যখন ঢুকতে যাব,আঙ্গিনার দরজাটা খোলার শব্দ শুনলাম।

‘মা,তুমি কোথায়’?অর্হান বললো।
‘হাইরিয়ে কোথায় ছিলে তোমরা সবাই’,চীৎকার করে জিজ্ঞাসা করতে চাচ্ছিলাম,তবে
কথাগুলো বেরোলো যেন ফিসফিস করে।
‘কিন্ত মা,আমরা তো মাগরেবের নামাজ আরম্ভ হওয়ার আগেই তো চলে আসলাম...’,
সেভকেত বললো।
‘চুপ কর,তোর নানা খুব অসুস্থ,একটু ঘুমাচ্ছে এখন’।
‘অসুস্থ’?হাইরিয়ে জিজ্ঞাসা করলো।আমাকে দেখে হাইরিয়ে বুঝতে পারলো,আমি রেগে আছি।‘সেকুরে,আমরা কসতার জন্যে অপেক্ষা করেছিলাম,মাছটা নিয়ে তেজপাতা,বাচ্চাদের জন্য শুকনা ফল কিনে নিয়ে তো তাড়াতাড়ি ফিরলাম’।
আমি নীচে গিয়ে কিছু বলতে চাচ্ছিলাম,কিন্ত বাতি নিয়ে হগেলে সিড়ির রক্তের দাগগুলো হয়তো দেখা যেতে পারে।ছেলেরা হৈচৈ করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে জুতা খুলে রাখলো।
‘আহ,আহ,ঐ ঘরে যাবি না,তোর নানা ঘুমাচ্ছে’,তারপর দুজনের হাত ধরে অন্য ঘরে নিয়ে গেলাম।একটু ইতস্ততা করছিল সেভকেত,তাই বললাম ‘তোমার নানাকে যে শয়তান জিনটা ভর করে তাকে অসুস্থ করলো,আমি চাই না সে আবার তোমাদের উপর ভর করুক,চল পাশের ঘরে’,দুজনকে শোবার ঘরে নিয়ে গেলাম।
‘এতক্ষন কোথায় ছিলি,তোরা’?
‘রাস্তায় দুজন কালো ফকিরকে দেখলাম’,সেভকেত বললো।
‘কোথায়’?আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ওরা কি কোন ফ্ল্যাগ নিয়ে যাচ্ছিল,হাতে’?
‘যখন পাহাড়ের দিকে যাচ্ছিলাম,ওরা হাইরিয়ের হাতে কটা লেবু দিল।হাইরিয়েও ওদেরকে কিছু পয়সা দিল।ওদের শরীর ঢাকা ছিল বরফে’,সেভকেত বললো।
‘আর কি দেখলি’?
‘দেখলাম,লোকজন বরফ নিয়ে খেলা করছিল’।
‘এই প্রচন্ড শীতে’?
‘মা,আমার খুব ঠান্ডা লাগছে’, ‘আমি ঐ নানার নীল দরজার ঘরটাতে যাচ্ছি’।
‘এ ঘর ছেড়ে কোথাও যাবি না,না হলে কিন্ত মারা যাবি ঐ জিনের হাতে।আমি বিছানা ঘরম করার গামলা নিয়ে আসছি’।
‘মা তুমি কেন বলছো,আমরা মরে যাব ঐ ঘরে গেলে’?সেভকেত বললো।
‘আমি তোদেরকে কিছু কথা বলছি,আর কাউকে বলবি না কিন্ত,ঠিক আছে’?আমি বললাম।
ওরা প্রতিজ্ঞ করলো,বলবে না কাউকে।
‘তোরা যখন বাইরে ছিলি,এক ধবধবে চেহারার লোক এসে তোর নানার সাথে কথা বলছিল,লোকটা অবশ্য মারা গেছে অনেকদিন আগে,জানা গেল সে একটা জিন’।
ছেলেরা জিজ্ঞাসা করলো,জিন কোথায় থাকে।
‘নদীর ওপারে’,আমি উত্তর দিলাম।
‘যেখানে আমাদের বাবা আছে’,সেভকেত বললো।
‘হ্যা,ওখানে।জিনটা তোর নানার বই এর একটা ছবি দেখতে এসে বলে গেল,যে দেখবে ঐ ছবিগুলো সাথে সাথেই সে মারা যাবে’।
একটা নিস্তব্ধতা,সবাই চুপ হয়ে গেছে তখন।
‘শোন আমি নীচে হাইরিয়ের সাথে কথা বলতে যাচ্ছি,ঘর গরম করার গামলাটা দিয়ে যাচ্ছি।তোদের খাবার এখানে নিয়ে আসবো,অন্য ঘরে যাওয়ার কথা চিন্তা করবি না।জিনটা কিন্ত এখনও বাড়ীতে আছে’।
‘মা,তুমি যাবে না,আমার খুব ভঁয় করছে’,অর্হান চীৎকার করে বললো।
সেভকেতেকে বললাম, ‘নীচে যাচ্ছি,ভাই এর দায়িত্ব এখন তোর,ভাইকে রেখে ঘর ছেড়ে অন্য কোথাও যদি যাস,জিনটা তোকে মেরে না ফেললেও,আমি তোকে মেরে ফেলবো’।
চোখে মুখে ভঁয়ের ছাপ নিয়ে বললাম, ‘দোয়া কর আল্লাহর কাছে যেন তোর নানা মারা না যায়।ভাল ব্যাবহার করলে আল্লাহ নিশ্চয় তোর দোয়ার কথা শুনবে’।আমি রান্নাগরের দিকে গেলাম,ওরা দুই ভাই তখন দোয়া করতে ব্যাস্ত।
‘কে যেন কমলা লেবুর জ্যাম সবটুকুই মাটিতে ফেলে গেছে,কে করলো এমন কাজ?
বিড়ালের পক্ষে তো করা সম্ভব না,আর কুকুর তো এখানে ঢুকতে পারবে না,তা হলে...’।হাইরিয়ে বললো।
আমার চোখে মুখে ভঁয় আর কান্না দেখে হাইরিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, ‘কি হলো’,নিশ্চয় কিছু একটা ঘটে গেছে।তোমার বাবার কিছু হলো নাকি’?
‘বাবা আর নাই’।
হাইরিয়ে কেঁপে উঠলো,তার হাতের পেয়াজ কাটার চাকু পড়ে গেল নীচের মাছ কাটার কাঠটায়।আবার কেঁপে উঠলো হাইরিয়ে,দেখলাম হাতে বেশ একটু রক্ত,সেটা হাইরিয়ের রক্ত,মাছের রক্ত না।হাইরিয়ে হাত বাঁধার জন্য কাপড় আনতে ছুটে গেলাম,পাশের ঘরে ছেলেদের চীৎকার শোনা যাচ্ছিল।দেখি সেভকেত অর্হানকে মাটিতে ফেলে ওর উপরে হাঁটু গেড়ে বসে আছে।
‘তোরা কি কোনদিন মানুষ হবি না,সারাটা জীবন জ্বালাবি আমাকে’,চীৎকার করে জিজ্ঞাসা করলাম।
‘অর্হান তো ঘর ছেড়ে বের হয়ে যাচ্ছিল,কি করবো’,সেভকেত বললো।
‘একেবারেই মিথ্যা কথা’,অর্হান বললো, ‘সেভকেত দরজা খুলে বাইরে যাচ্ছিল,আমি ওকে থামানোর চেষ্টা করছিলাম’,তারপরেই কান্না আরম্ভ হয়ে গেল।
‘তোদের দুজনকেই আমি মেরে ফেলবো,যদি চুপচাপ বসে না থাকিস’।
‘মা,তুমি আমাদের একেলা রেখে যাচ্ছ কেন’?অর্হান বললো।
নীচে কাপড় আর ওষুধ দিয়ে হাইরিয়ের আঙ্গুলটা বেঁধে দিলাম,হাইরিয়েকে বললাম যা বোঝা যাচ্ছে বাবার মৃতুটা স্বাভাবিক না,ওটা খুন’,ভয়ে আরও কেঁপে উঠলো হাইরিয়ে,আর আল্লাহর কাছে আমাদের রক্ষার জন্যে দোয়া পড়া আরম্ভ করলো।তারপর কাটা আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে কাঁদছিল হাইরিয়ে,ভাবছিলাম বাবার জন্যে তার কি অনুভুতিটা এতই প্রখর ছিল যে কান্নাকে আটকে রাখতে পারেনি।বাবাকে দেখতে উপরে যাচ্ছিল,সে।
‘বাবা উপরে নাই,পেছনের ঘরটায়’,আমি বললাম।
অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল,হাইরিয়ে আর কিছু না বলে বাতি নিয়ে বাবাকে দেখতে গেল।রান্নার ঘর থেকে চার পাঁচ পা দূরে দরজা খুলে হাইরিয়ে ঘরে ঢুকে অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছিল না,এক সময় বাতি তুলে দেখলো দরজার পাশে পড়ে থাকা বাবাকে।
‘আহ’,চীৎকার করে উঠলো,হাইরিয়ে,নিষ্ঠুরতার ঐ ছবি দেখে হতবাক হয়ে গেছে।
রান্নাঘরে ফিরে তার মুখে কোন কথা ছিল না,কান্নাকাটিও ছিল না।একদিক দিয়ে ভালই হলো,হাইরিয়েকে সব কথা গুছিয়ে বলা যাবে।
‘হাইরিয়ে ঠান্ডা মাথায় আমার কথা শোন’,আমি বললাম, ‘উপরের ঘর একেবারে তছনছ হয়ে আছে,জিনিষপত্র চারপাশে ছড়ানো ছিটানো।ওখানেই কেউ বাবার মাথাটা ভেঙ্গে চুরমার করে গেছে,ছেলেরা দেখে যাতে হৈচৈ না করে সে জন্যেই বাবাকে নীচে আনলাম।তোমরা যাওয়ার পর আমিও বাড়ীতে ছিলাম না,বাবা একাই ছিল বাড়ীতে’।
‘আমি তো জানতাম না;হাইরিয়ে বললো, ‘কোথায় ছিলে তুমি’।
কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর আমি উত্তর দিলাম, ‘আমি সিয়াহর সাথে ছিলাম,ঐ ফাঁসী দেয়া ইহুদীর বাসায়,আমরা দুজনে আলাপ করছিলাম।তোমাকে একটা অনুরোধ করছি, কাউকে কিছু বলবে না,বাবার খুন হওয়ার কথাটাও যেন কেউ না জানে’।
‘কে খুন করলো’?
হাইরিয়ে কি বেকুব,নাকি সে আমাকেই দোষী ভাবছে।
‘কে করলো,যদি জানতাম,তবে ঘটনাটা লুকানোর কথা বলার কি দরকার ছিল’?বললাম, ‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না,তুমি কি কিছু জান’?
‘আমি কি ভাবে জানবো’?হাইরিয়ে বললো, ‘এখন কি করবো,আমরা’?
‘আমরা এমন ভাব দেখাবো যেন কিছুই ঘটেনি’,আমি বললাম।ইচ্ছা হচ্ছিল চীৎকার করে কাঁদি,পারলাম না,দুজনে চুপচাপ বসে ছিলাম।
কিছুক্ষন পরে বললাম, ‘শোন মাছ রান্নার কথা ভুলে যাও,বাচ্চাদের জন্যে এমনি কিছু খাবার তৈরী করে দাও’।কিছু না বলে হাউমাউ করে কাঁদছিল হাইরিয়ে,তাকে জড়িয়ে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করলাম।একটাই চিন্তা ছিল আমার,আমাকে আর ছেলেদেরকে নিয়ে না,হাইরিয়েও তো আমাদের পরিবারের এক অংশ।একে অন্যকে জড়িয়ে ছিলাম আমরা,তবুও নানান চিন্তা চাকুর মত খোঁচা দিয়ে রক্তাক্ত করছিল,আমাকে।
বাবাকে বাড়ীতে একা রেখে,কেন আমি গেলাম,তা ছাড়া হাইরিয়েকে নিয়ে ছেলেদেরকে তো আমিই পাঠালাম।কিন্ত হাইরিয়ে কতটুকু জানতো?হাইরিয়েকে যা বুঝিয়ে বললাম,সে কি বুঝবে,মানবে আমার কথা?যদিও হাইরিয়েকে জড়িয়ে ছিলাম,তার মনেও হয়তো সন্দেহের ঝড় বয়ে যাচ্ছে।বাবা যখন খুন হচ্ছে,আমি তো তখন সিয়াহর সাথে শরীর খেলায় ব্যাস্ত।আমি যদি হাইরিয়ে হতাম,নিঃসন্দেহে আমার সন্দেহ তেমন একটা কম হতোনা।হয়তো হাইরিয়ে নিশ্চয় ভাবছে আমি কোন না কোন ভাবে দোষী।কাঁদছিলাম,হাইরিয়েও আমাকে জড়িয়ে কান্না আরম্ভ করলো।উপরে খাবার টেবিলে বসে আমি খাবার ভান করছিলাম,মাঝে মাঝে ছেলেদেরকে নানাকে দেখতে যাচ্ছি বলে ছুটেও যাচ্ছিলাম।তবে সেটার পাশের ঘরে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়া ছাড়া আর কিছু না।
দুই ছেলেই তখন জিনের ভয়ে অতিষ্ঠ,বিছানায় আমাকে জড়িয়ে শুয়ে ছিল।‘মা কি একটা শব্দ পেলাম যেন’,গল্প বলে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছিলাম,অন্ধকারে গল্পের চরিত্রগুলো যেন ডানায় ভর করে উড়ে যাচ্ছিল।
‘মা,তুমি কি আবার বিয়ে করবে’?সেভকেত জিজ্ঞাসা করলো।
‘শোন’,আমি বললাম,‘এক শাহজাদা দূরের দেশের কোন এক মেয়েকে না দেখেই তার প্রেমে পড়লো।কি ভাবে সেটা সম্ভব হলো,জান কি ভাবে হলো,যদিও মেয়েটাকে দেখেনি শাহজাদা,
তবে মেয়েটার আঁকা ছবি দেখেই প্রেমে পাগল হয়ে গেছে,শাহজাদা’।

মন খারাপ থাকলে গল্প বলার সময়,ভুলে যেতাম গল্পের কথা,যা মনে আসতো সেটাই বানিয়ে বলতাম,যা বলতাম সেটা মনের পাতায় রং দিয়ে অজানা একটা আঁকা ছবি।
ছেলেরা ঘুমানোর পর,হাইরিয়েকে নিয়ে বাবার ঘরটা পরিষ্কার করছিলাম,কোন এক অজানা দানব খুনীর কাজ।ভাঙ্গা টেবিল,থালা বাসন,কালির দোয়াত,রং এর বাক্স,কাগজ দেখে এক সময় ভুলেই গেলাম বাবার কথা।কারও প্রিয়জন যখন চলে যায়,বাড়ীর আসবাব পত্র সব একই রকম থেকে যায় চারপাশটা দেখে মনে হয় না,প্রিয়জনকে আজরাইল নিয়ে গেছে। বাড়ীটা,চারপাশের বাবার স্নেহের একটা একটা ইট ধরে বানানো,কোন এক শয়তান দানবের হাতে সব তছনছ হয়ে গেছে,দানবটা স্মৃতির পাতাগুলোকে ছিঁড়ে ছিড়ে টুকরো করে দিয়ে গেছে।

পানি এনে,বাবাকে গোসল করাচ্ছিলাম,আর সাথে সুরা আল ইমরান থেকে তেলাওয়াত করছিলাম,বাবার খুব প্রিয় একটা সুরা,ওটাতে বলা আছে মৃত্যু আর আশা পাশাপাশি।বাবা হেরাতের বাঁধাই কোরানের থেকে প্রায়ই তেলাওয়াত করতো সুরাটা,বাইরে আঙ্গিনার দরজা খোলা বন্ধের শব্দ,আমরা দুজনে ভয়ে বেশ বিচলিত হয়ে গেছি তখন তদারক গেটে একটা পদিনার পাতার টব ঠেলে বন্ধ করলাম,যাতে নিজে নিজে খোলা বন্ধটা না হয় আর।বাবার রক্তাক্ত ছেঁড়া কাপড় বদলে সাজানো হিসেবে বাবার মৃত্যুর সময়টা ঠিক করে দিলাম যেন।

কাপড়চোপড় খুলে নীচের কাপড় খোলার পর অবাক হয়ে দেখছিলাম,বাবার শরীরের আলোটা বাতির আলোটাকেও ম্লান করে দিচ্ছে।ভয়ের দৃশ্যটা ছিল যে বাবার শরীর ভঁরা আঁচিলে আর ক্ষতে,হাইরিয়ে যখন উপর থেকে কাপড় আনতে গেল,এক সময় বাবার যৌনাঙ্গে চোখ পড়লে মুখটা ফিরে নিলাম।কাপড় চোপড় বদলে বাবাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছিলাম।অনেকে হয়তো ভাবছে আমি অনুভুতি ছাড়া একটা নিষ্ঠুর মেয়ে,আর যে কতবার কাঁদলাম সেটা বলি তাহলেঃ
১)ঘর পরিষ্কার করছিলাম যাতে ছেলেরা জানতে না পারে,কি ঘটে গেছে,একটা শামুকের খোলস যা ছোট বেলায় কানের কাছে নিয়ে সমুদ্রের কান্না শুনতাম,দেখি সমুদ্র যেন নাই সেই শামুকের খোলসে আর।
২) বাবার বসার তোষক যা অনেকটা বাবার শরীরের একটা অঙ্গ ছিল,সেটা ছিঁড়ে তছনছ হয়ে গেছে।

বাড়ীর সবকিছু যা যা ঠিক করা সম্ভব,ঠিক করলাম।হাইরিয়ে ভঁয়ে আমাদের ঘরে ঘুমাতে চাচ্ছিল,নিষ্ঠুর ভাবে না বলে দিলাম।‘আমি চাই না,ছেলেরা সকালে উঠে কোন কিছু সন্দেহ করুক’,তাকে বোঝালাম।সত্যি কথা বলতে কি আমি চাচ্ছিলাম ছেলেদের সাথে একাই থাকতে।বিছানায় গেলাম কিন্ত চোখে ঘুম ছিল না,ভয়ের জন্যে না,নীচের ঘরে যা রাখা আছে ভেবে।

আমি কান কিরমজীসি( লাল, রক্তের রংও লাল )

আমি ছিলাম,গজনীর কবি ফেরদৌসীর শাহনামার শেষ অংশটায়,অবিশ্বাস্য সুন্দর ছন্দে লেখা,কিন্ত শাহনামা পড়ে সুলতান মাহমুদের সভাকবি তাকে অসভ্য গ্রামের কবি বলে ঠাট্টা করলো।আমি ছিলাম শাহনামার রুস্তম পর্বেও,যখন রুস্তম তার ঘোড়াকে খোঁজার জন্যে ছুটে যাচ্ছিল,অচল ঘোড়াকে তলোয়ার দিয়ে কেটে ফেলার পর যে লাল রংটা,সেটা তো আমারই চেহারা।

আমি ছিলাম বিছানায় যখন রুস্তম বাদশাহের মেয়ের সাথে কামনার জোয়ারে ভেসে যাচ্ছিল শরীর খেলায়।আমাকে পাবে এখানে ওখানে সব জায়গায়,আমি ছিলাম সালিমের
তুর পাহাড়ে যখন সে তার ভাই ইরাজের গলা কেটে ফেললো।আমাকে পাবে পাহাড় যুদ্ধে খ্যাতনামা যোদ্ধাদের সাথে,আমি ছিলাম সুর্যের তাপে আলেকজান্ডারের জীবনশক্তি যখন বের হয়ে যাচ্ছিল নাক দিয়ে।হ্যা,শাহ বেহরাম সপ্তাহের প্রতিটা দিন কাটাতো ভিন্ন ভিন্ন মেয়ের সাথে,রকমারী রং এর তাবুর নীচে প্রতি দিন নতুন গল্প শুনতে শুনতে,আমি ছিলাম ঐ সুন্দরীর পোষাকে যার কাছে মঙ্গলবারে যেত শাহ বেহরান,যার ছবি দেখেই প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিল সে,অনেকটা হুসরেভের শিরিনের প্রেমে পড়ার কাহিনী।

আমি ছিলাম সৈন্যদের সাথে যখন তারা কেল্লা দখল করছিল,ছিলাম জয়ের পরে ভোজের আনন্দের টেবিলে,ছিলাম রাষ্ট্রদূতদের মখমলের পোষাকে যখন তারা সুলতানের পায়ে চুমু খাচ্ছিল,ছিলাম তলোয়ারে যাদের গল্পে ছেলেরা কেঁপে উঠে।সুদর্শন শিল্পীর ছাত্ররা তাদের সুন্দর তুলির আঁচড় দিয়ে মোটা কাগজে টেনে গেছে আমাকে সূদূর হিন্দুস্থান থেকে বোখারা পর্যন্তঃআমি ছিলাম উসহাকের গালিচায়,দেয়ালের ছবিতে,মোরগ যুদ্ধের ছবিতে,ডালিমে,দেশ বিদেশ থেকে আনা ফলে,শয়তানের মুখে,তাবুর ছবিতে,হরিন চোখের সুন্দরীদের ব্লাউজে হারেমের জানালায় যারা পৃথিবী খোঁজে,চিনি দিয়ে তৈরী করা পাখীতে,মৃত,আহত সৈন্যদের গল্পকথায়,শুধু তাই না হাজার হাজার প্রেমিক,যোদ্ধা আর শাহদের ছবিতেও পাবে আমাকে।
আনন্দে নিজেকে দেখি আমি জংলী ফুলের মত রক্ত স্রোতের যুদ্ধের দৃশ্যে,আমি ছিলাম গ্রামের কবিদের পোষাকে গান শোনার পর্বে,ফেরেশতাদের ডানায়,সুন্দরী মেয়েদের ঠোঁটে,লাশের গলায়।
এই প্রশ্নটা প্রায়ই শুনিঃ রং নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করার কি আছে? রং সমন্ধে যাদের কোন ধারণা নেই তারাই এ ধরনের মন্তব্য করে,রং ছুয়ে যায় চোখ,ওটা শব্দহারাদের কানে জাগায় সুর,ওটা অন্ধকার থেকে ছুটে আসা অবিশ্বাস্য একটা ভাষা।এ কথাটা প্রায়ই শুনি মানুষের আত্মা নাকি ফিসফিস করে কথা বলে-বাতাসের শিস দেয়ার মত,যাদের উপলদ্ধি করা সম্ভব তারাই সেটা বুঝতে পারবে-একই ভাবে রং এর ছোঁয়া আছে বই থেকে বই এ,হাজার হাজার বছর ধরে আছে,ফেরেশতাদের স্বর্গীয় সুরের ছোঁয়ার মত।আমার অর্ধেক সুর মাতাল করে সকলের চোখকে,আরেকটা অংশ হারায় বাতাসে হাসি আনন্দে।

লাল বলে নিজেকে আমি খুব ভাগ্যবান মনে করি।আমি আছি আগুনের উত্তাপে,আমি শক্তিশালী,এক দেখার চমকেই সবার চোখ ছুয়ে যাই,আমি।
আমি নিজেকে লুকিয়ে রাখিনা।আমার মতে সূক্ষতা কোন দূর্বলতা প্রকাশ করে না,বরং বলে দেয় মনের দৃঢ়তা।এ জন্যেই আমি দৃষ্টি টেনে আনি আমার দিকে,ভয় হয় না আমার অন্যান্য রং দেখে,ভঁয় হয় না আমার একাকীত্বে।আমার চেহারা দেখে চোখ ঝলসে উঠে,
কামনার স্রোত বয়ে যায় মনে,কত আনন্দই এই বেঁচে থাকায়!
কত আনন্দই না নিজেকে এভাবে দেখায়।বেঁচে থাকাই দেখা।আমি তো সবজায়গায় আছি।জীবনের শুরু আর শেষটা তো আমাকে দিয়েই।যদি জানা না থাকে আমার কথায় বিশ্বাস করতে পার।
চুপচাপ শুনে যাও যা বলছি,আমি লাল রং এ অদ্ভুত এক অনুভুতি নিয়ে আসি।হিন্দুস্থানের এক ওস্তাদ চারুশিল্পী,রং নিয়ে যার দক্ষতা ছিল আকাশ ছোঁয়া,শুকনো লাল গোবর পোকা হামান্দিস্তায় গুড়ো করে রং এর চমৎকারিত্ব বাড়াতে।ওস্তাদ পাঁচ ড্রাকমা লাল রং এর সাথে,এক ড্রাকমা সাবানের গুড়া আর তার সাথে ছিল রাকুনের লোম,একটা পাত্রে তিন ওক্কা পরিমান সাবানের গুড়া দিয়ে পানি দিয়ে ফুটাতো।এক কাপ কফি খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত পানি ফুটতো আর তার কফি খাওয়ার ফাঁকে আমি এক নতুন শিশু জন্ম নেয়ার অপেক্ষায় থাকতাম।কফি ওস্তাদের মনটা পরিষ্কার করে নিয়ে যেত অন্য এক সীমানায়,তার দৃষ্টিটা হয়ে যেত এক জিনের মত।

ওস্তাদ পানিতে লাল রং মেশানোর পর একটা লাঠি দিয়ে নাড়তে নাড়তে মেশাতে থাকতো,আমি লাল হয়ে যাচ্ছি ধীরে ধীরে,আমার চেহারার বিশেষত্ব শুধু পানিকে ফুটতে দেয়া না,যথাযথ ভাবে মেশানো নাড়াচাড়ার ব্যাপারটারও আছে।ওস্তাদের বুড়ো আঙ্গুলের নখ দিয়ে নাড়া দিতে হবে(অন্য কোন ভাবে না),ঐ লালের সৌন্দর্য ছিল আকাশ ছাড়ানো।অত চমৎকার ভাবে নাড়ানোর নীচে কিছু জমা হয়ে পড়ে থাকে।চুলা থেকে নামানোর পর ওস্তাদ মিহি কাপড়ে ছেকে আরও বিশুদ্ধতা মিয়ে আসতো আমার চেহারায়,
তারপর ওর সাথে ফিটকিরি মেশানো।

এ ভাবে আমি পড়ে থাকতাম,কখন কোন কাগজে লাগানো হবে আমাকে,আর তঁখনই জন্ম হবে আমার লাল রং হিসাবে।মনে পড়ে পারস্যের এক অন্ধ চারুশিল্পীর মনের ছোঁয়ায় আঁকা ঘোড়ার জিনের লাল চামড়ার জিনে আমার রংটা দিচ্ছিল এক নতুন শিল্পী,দুজন অন্ধ শিল্পীর তঁর্ক হচ্ছিল সে সময়,‘আমাদের সারাটা জীবন চলে গেল ছবি আঁকতে আঁকতে,যদিও অন্ধ আমরা,কিন্ত লাল রংটার চেহারা,অনুভুতি কি জানা নাই আমাদের’,
বললো অন্ধ শিল্পী যার হাতে আঁকা ঘোড়ার ছবিটা।‘কিন্ত আমি যদি জন্ম থেকেই অন্ধ হতাম,তবে আমার অজানাতেই ঢেলে দিতাম লাল রংএর চেহারাটা না জেনেই,অনেকটা যে ভাবে ঐ কমবয়সী ছেলেটা ছবিতে ঘোড়ার লাল রং ঢেলে যাচ্ছে’।

০০০০০০০০০

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১:১১

রাজীব নুর বলেছেন: এই উপন্যাসটি কি আপনি অনুবাদ করেছেন?

২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ রাত ১:২১

ইল্লু বলেছেন: হ্যা,চেষ্টা করা

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.