যে কারণে আমি মিথ্যা কথা ছাড়তে পারি না

২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১০ দুপুর ১২:৫৬

আমি অনেকবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি মিথ্যা কথা বলব না। মিথ্যা কথা বলা মিথ্যুক আর লেখকদের কাজ। যে একটা দুইটা কিংবা অনেক মিথ্যা কথা বলে তাকে মিথ্যুক বলা হয়। সে একই সঙ্গে হাজার হাজার সত্য কথা বললেও তাকে সত্যবাদী বলা হয় না। আবার যে একটা দুইটা বই বা পত্রিকার সংবাদ কিংবা অন্য কিছু পাঠ করে তাকে পাঠক বলা গেলেও, যে একটা দুইটা বাজারের ফর্দ লেখে তাকে আমরা লেখক বলতে চাই না। লেখক বলতে আমরা যাদের চিনি তারা বেশিরভাগ সময়ই সত্য মিথ্যা মিলিয়ে এক খানা কাহিনী লেখে (অনেকে অবশ্য নির্জ্জলা সত্য ঘটনাও লেখে )। মিথ্যাকে জায়েজ করার জন্য তারা তো কল্প কাহিনী নামের আলাদা ধারাই খুলে বসেছে। বাবা, আমার মিথ্যাগুলোও তো কল্পনা প্রসূত। তবে আমার মিথ্যাকে কেন কল্পকাহিনী বলে সমাদর করা হয় না, তা বুঝি না। তাই ঠিক করেছি আর মিথ্যা বলব না। আসলে এমন ঠিক আমি প্রায়ই করি। আমার বন্ধু মহলে অবশ্য আমাকে কেউ মিথ্যুক বলে না। তাই বলে তারা যে আমাকে সত্যবাদী ডাকে তা কিন্তু নয়। আমি অবশ্য আশাও করি না। একদিনে অসংখ্য মিথ্যা কথা বলি আমি, তবে এমনভাবে যাতে কেউ টের না পায়। যেমন গেল শুক্রবারের ঘটনাটা বলি, জুম্মার নামায পড়তে গেছি। শুরু হয়েছে চরম ঝড় বৃষ্টি। মুহুর্মুহু বাজ পড়ে আমাকেই সন্ত্রস্ত করে দিচ্ছিল আর আমার স্ত্রী তো কোন ছাড়। নামায পড়ার সময় মোবাইল সাইলেন্ট করা ছিল। নামায শেষ করে দেখি অসংখ্য মিসড কল। ফোন দিলাম ন্যান্সিকে- আমার স্ত্রী কে। ফোন ধরেই সে চিৎকার জুড়ে দিল ‘তাড়াতাড়ি আস আমাদের বাসার সামনের তিনতলার কাছে গ্যাসের লাইনে আগুন ধরেছে। সবাই ছুটাছুটি করছে। পোলাপান চিল্লাচিল্লি করে বলছে সবাইকে নিচে নামতে। তাড়াতাড়ি আস।’ আমার মাথার ঠিক নাই। আমার প্রেম, আমার ভালবাসা এখন বিপদগ্রস্ত। সে আতঙ্কিত। ছুটলাম মসজিদ থেকে। সে এক দুর্যোগের দিন। ঝড় বাদল দেখে ভয় পেলে প্রেমিকের চলে না, স্বামীদের চলে না। মসজিদ থেকে বের হয়ে দেখি হাসপাতালের কোনায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি হুইসেল বাজিয়ে চলছে। আসলে চলছে না, থেমে আছে। ওরা বোধ হয় রাস্তা চিনছে না। আমিও তো শিওর না তিনতলার কোন দিকে আগুন লেগেছে। আসলে আদৌ তিনতলার কাছে কি না কে জানে? এ সব দুর্ঘটনার খবর গুলো তো খুবই বিকৃত হয়। তারপরও ফায়ার সার্ভিসকে গালি দিতে ছাড়লাম না। শালা ভোদাইয়ের দল কোন রাস্তায় ঢুকছে! কিন্তু আমিও যে আগ বাড়িয়ে গেলাম তাদের পথ চেনাতে তা অবশ্য নয়। ছুটলাম তিন তলার দিকে। আগে অবস্থা বুঝতে হবে তারপর প্রয়োজন বোধে স্ত্রীকে নিয়ে নিরাপদ জায়গায় চলে যেতে হবে। দৌড়ে চলে এলাম তিন তলার কাছে। হ্যা আগুন লেগেছে। সত্যিই অনেক আগুন। আকাশের দিকে উঠছে শুধূ রাক্ষসটা। সবাই চিৎকার চেচামেচি করছে। ওখানে দাড়িয়ে থাকা মহল্লার এক ছোট ভাইকে পাঠালাম- যা দেখ ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি হাসপাতালের কোনায় দাড়িয়ে আছে রাস্তা চিনছে না। সে ছুটে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি নিয়ে হাজির হল। এ অগ্নি কর্মীরা খুবই তৎপর। এর মধ্যে বউ আবার ফোন করেছে। আমি বেশ গম্ভীর স্বরে বললাম - ‘চিন্তা করো না, ভয়ের কোন কারণ নেই, সিচুয়েশন আন্ডার কন্ট্রোল।’ এ সিচুয়েশন আন্ডার কন্ট্রোল বলার সময় বেশ দামী দামী মনে হচ্ছিল নিজেকে।



কিন্তু এখানে আমার বীরত্ব কই! ফায়ার সার্ভিস এসেছে, ওরা আগুন নিভিয়েছে। দ্যা গ্রেট হিরো অব দ্যা নেশন। কিন্তু আমি? আমি কোথায়? স্ত্রীর সামনে বীর সাজার কোন সুযোগই তো পাচিছ না। না মিথ্যুকের জন্য কোন কিছুই অসাধ্য নয়, স্ত্রীকে বেশ আয়েশ করে বললাম ‌‌'ব্যাটারা ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিয়েছে কিন্তু কোথায় আগুনটা লেগেছে ঠিকমত তার লোকেশনটাও দিতে পারে নি। তুমি ফোন দিলা, আমি বের হয়ে দেখি হাসপাতালের কোনায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি দাড়িয়ে আছে। গেলাম তাদের কাছে। ওরা বললো ভাই আগুন লাগছে কিন্তু কোন জায়গায় বুঝতেছি না। আমি বললাম চলেন আমার সঙ্গে। তার পর নিয়ে আসলাম। বুঝলা আগুন দেখলে, বিপদ দেখলে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। যে ফোন করছে সে ঠিকমত ঠিকানাটা বললে আগুন আরও আগেই নিভত।’ ঝড় বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি গিলতে গিলতে মিথ্যা গল্প ফেদে বীর হয়ে স্ত্রীর সামনে বেশ তৃপ্তির ঢেকুর তুলি।



এর পর আবার সিদ্ধান্ত নেই কেন আর মিথ্যা কথা বলব? আর মিথ্যা কথা বলব না। তারপর আবার মিথ্যা বলেছি। সে গল্প পরে একদিন করা যাবে।

৬ টি +৩/-০