![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি রক্ত বন্যা দেখিনি কোথাও, দেখেছি চোখের কান্না। সে অশ্রু ফোটায় ম্লান হয়েছে হীরা, মতি, মণি, পান্না।
বিধ্বস্ত অবস্থা !
ভাঙাচোরা দোকানপাট। রাস্তাঘাট ,ব্রীজ ,এখানে ওখানে আশেপাশের বাড়ি ঘরে বয়ে যাওয়া তান্ডবের স্পষ্ট চিহ্ন। ফাকা ফাকা চারদিক। নিশ্চুপ ,নিরব। যেন কোন এক বিরল এলাকা। রাস্তাঘাটে বেরোলে নাকে বাতাসের সাথে উড়ে আসে বিদঘুটে গন্ধ। আজকাল সয়ে এসব আমার। এ কমাসে যেন ভেঙে আমার নতুন করে গড়ে দিয়েছে আমায় কেউ।
আগে ভাত খেতে বসে মরা চাল দেখলে সে ভাত আর খেতাম না। আর এখন ! মোটা চালের ভাত একগাদা পাথরসহ গিলে খাই। মাঝে মাঝে হয়তো কোন একটা তৃষ্ণার্ত মাছি উড়ে আসে ডালে পড়ে। আমি না দেখার ভান করে খেয়ে ফেলি। ভাবি ,অন্তত বিনা খরচে একটা দানা তো বেশি জুটলো।
হাত একবারেই খালি। শেষবার টুনির অমন সাধের কানের দুলদুটো জমা দিয়ে কয়েককেজি চাল ,ডালের জোগার করার গিয়েছে।
আমি নিতে চাইছিলাম না দুলদুটো।
মা বললেন , মানুষই যখন নেই ,দুল দিয়ে কি হবে ?
আমার ভেতরটা কেমন হুহু করে উঠেছিল ।
আমাদের বড় ঘরটার সামনে নারকেল গাছের পাশ ঘেসে যে সরু রাস্তাটা চলে গেছে ,তার পাশে একটা বাগান করেছিল টুনি। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বেড়া দিয়েছিল তাতে। টুনি মারা যাবার পর আর সেটার দিকে কারও খেয়ালের ফুরসুত্ই মেলেনি। সেদিন বাজার থেতে ফেরার সময় দেখলাম ওর স্বাদের জবা ,বেলি আর গোলাপের চারাটা কেমন ঝিমিয়ে আছে। পাতাগুলোতে পোকায় ধরেছে। সবুজ রং মিলিয়ে এখন সেখানে খয়েরির আভাস জানান দিচ্ছে ,আমরা আর বেশিদিন বেঁচে নেই।
গোলাপের চারাটা আমিই এনে দিয়েছিলাম টুনিকে। ভার্সিটির বন্ধু সুমন্তের বাড়ি গিয়েছিলাম সেবার।
সেখান থেকেই এনেছিলাম।
টুনিকে দিয়ে বলেছিলাম , বাগানে লাগাস। দেখবি কেমন ফুল ধরে।
সে চারা দেখে টুনির সেকি আনন্দ। খন্তে নিয়ে তখুনি বাগানে ছুট।
তারপর থেকে রোজ তিনবেলা পানি দিত আর প্রতিবারই মুখ গোমরা করে আমাকে এসে জানাত ,
: দাদা ,গাছতো শুকিয়ে যাচ্ছে। পাতাগুলো কেমন নুয়ে পড়েছে ।
একবার আমি হেসে বলেছিলাম ,
: গাছের মালিক অমন গোমরা মুখ করে থাকলে গাছ হাসবে কি করে ? কাল থেকে গাছে পানি দেয়ার সময় মুখটা হাসি হাসি করে নিস। দেখবি ঠিক তাজা হয়ে উঠবে চারাটা ।
নিতান্তই ঠাট্টা করে বলা। কিন্তু টুনি যে সেটাকে সত্য বলেই ধরেছে সেটা জানলাম পরদিন।
পুবঘরে জানালার পাশে পড়ার টেবিলে বসে পড়াগুলো রিভিশন দিচ্ছিলাম।ভার্সিটি খোলার পরই পরিক্ষা।
আম্মা এসে বললেন ,
:টুনির কি হয়েছে বলতো ?
: কেন ,কি হয়েছে ?
আমি অবাক হয়ে বললাম ।
আম্মা মুখ গোমরা করে বললেন ,
: বাগানে দাড়িয়ে পেত্নির মত হি হি করে হাসছে !
তাঁর কথা শুনে আমি দম ফাটিয়ে হেসে উঠলাম। ওনি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। হয়তো ভাবলেন , সবাই পাগল হয়ে গেছি !
টুনির সে হাসিমুখ দেখে হোক আর প্রাকৃতির নিয়মেই হোক পরদিন টুনি এসে জানাল গোলাপের চারাটা জেগে উঠেছে। দুটো ছোট ছোট কচিপাতাও বেরিয়েছে। আমি জোর করে নিয়ে আঙুল দিয়ে সদ্য বেরোনো কচিপাতাদুটো দেখিয়ে হি হি করে হাসতে হাসতে বলল ,
: কি সুন্দর না দাদা ?
গাছের কচি পাতা নয় টুনির আনন্দ মাখা মুখটা দেখে মাথা ঝাকিয়ে বলেছিলাম ,
: হু ..খুব সুন্দর !
সেই টুনিই আজ মিলিয়ে গেছে।
ডুমরোর চরে স্কুল ঘরে পাক বাহিনীর ক্যাম্পে ছিল সেদিন আমাদের অপারেশন। ভোরে ঘাঁটিতে ফিরে এসে প্রথম নুরুনুদ্দিনের কাছ থেকে পেয়েছিলাম খবরটা। রাত দেড়টায় আমাদের বাড়িতে দরজা ভেঙে ঢুকে বাবার মাথা বরাবর গুলি করে টুনিকে তুলে নিয়ে গেছে। আম্মাকে বন্দুকের বাট দিয়ে বারি দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলে রেখে গিয়েছে।
এরপরও আরও কয়েকজনের কাছ থেকে খবরটা পেয়েছি। বিমূর্ষ হয়েছি কিন্তু বিঃশ্বাস হয়নি।
স্বাধীনতার পর একগোছা চুল দাড়ি গজানো জংলীর মত মুখ আর ঘুমহীন লাল টকটকে মুখ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
বড় ঘরটা দেখতে পেলাম না। হয়তো পুড়িয়ে দিয়েছে। তারপাশে আমার পড়ার ঘরটা অক্ষত আছে। আম্মা সে ঘরের সামনে বসেই মালঞ্চার শাক বাছছিলেন।
আমাকে দেখে অবাক হয়ে তাকালেন। চোখে কৌতুহল। ঠোটদুটো তিরতির করে কাপছে আম্মার। কান্নার পুর্বলক্ষন।
আমি নির্লিপ্ত স্বরে বললাম , কেমন আছো আম্মা ?
আম্মা ঢুকরে কেঁদে উঠলেন।
শত কান্না ,শত মৃত্যু আর রক্ত নিয়ে হলি খেলে আসা আমার পাথর চোখদুটোও কেন জানি ভিজে উঠলো।
আমার চোখদুটো চলে গেল দরজার দিকে। মনে হলো এখুনি হয়তো টুনি দৌড়ে বেরোবে সে দরজা দিয়ে।
আব্বা ,কে এলো । বলে তার তার জীর্ণশীর্ণ দাগপড়া কাচের মোটা ফ্রেমের চশমাটা পাঞ্জাবির খুটে ঘসে চোখে পড়ে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলবেন ,
: যুদ্ধশেষ করে এলি ?
তারা কেউই আসেনি সেদিন।
আম্মা এ কমাসে বেশ বুড়িয়ে গেছেন। চামড়াগুলো ঢিলে হয়ে দলে গিয়েছে। চোখের নিচে কালি জমে পুরো হয়ে আছে।
প্রায়ই রাতে চিত্কার করে উঠেন ।
আমি বলি , কি হয়েছে আম্মা ?
: শুনতে পাচ্ছিস ?
আম্মা ফিসফিস করে বলেন। আমি কান পাতি। রাতের নিরব নিঃস্তব্দতা ছাপিয়ে আমার কানে কোন শব্দই আসেনা ।
: কই ? কিছুই তো শুনতে পাচ্ছিনা !
: মিলিটারীর বুটের শব্দ। ওরা আবার আসছে!
আম্মার গলায় ভয়।
: তুমি ভুল শুনছ আম্মা। মিলিটারীরা চলে গেছে। ওদের তাড়িয়ে দিয়েছি ,ওরা আর আসবেনা।
: সব মিথ্যা ! তুই মিথ্যে বলছিস আমায়। ওর যায়নি ,শিয়ালের মত গর্তে লুকিয়ে আছে ।সুযোগ পেলেই বেরোবে আবার !
আম্মার গলা কেঁপে উঠে। শেষটায় একটু ভেজা গলা। আমি জোর করে আম্মাকে বিছানায় শুইয়ে দেই। ছেড়া ন্যাতা কাঁথাটা টেনে দিই গায়ে।
: ঘুমোও আম্মা । আমি সত্যি বলছি ,ওরা আর আসবেনা ।
আম্মা যেন আমার কথা বিঃশ্বাস করে পারেন না। কাঁথার নিচে শুয়ে আনমনে বিরবির করেন।
কিছু করার নেই। বাতাসে এখনও পচা লাশের গন্ধ। সারাদিন আমি এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াই।
ফেলে রাখা ঘরগুলোতে আবার দুএকজন করে মানুষ ফিরতে শুরু করেছে। কোনটাতে নতুন ,কোনটায় পুরনো।
তারপাশে এখনও কেমন খাঁ খাঁ ,হাহাকার। কেন জানি এখনও ঠিক স্বাধীন বলে মনে হচ্ছেনা নিজেকে। হাটতে হাটতে বাজার চলে এলাম।মানুষ গিজগিজে বাজারটা আজ একেবারেই নিরব। অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ। মালিক নেই। কেউ পালিয়েছে ,কেউ গুলি খেয়ে মরেছে।
দুদিন হল নাজিমুদ্দিন ভারত থেকে ফিরে তার পুরনো চা ষ্টলটা ঝেরেমুছে আবার চালু করেছে।
একটা টেবিলে দেখলাম রতন ,কবির ,মুকুলরা বসে কি যেন ফিসফিস করছে।
আমি ঢুকে পড়লাম ।
আমাকে দেখে বলল ,
: খবর শুনেছিস ?
: কিসের ?
ওরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।
রতনের কপাল কুচকে যায়। সে গলা নামিয়ে কানের কাছে প্রায় ফিসফিস করে বলে ,
: মতিন মিয়া ফিরে এসেছে !
আমি আতকে উঠি।
: মতিন । মতি রাজকার ?
ওরা মাথা নাড়ে। আমি কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাই।
: গাঁয়ের মানুষ কিছু বলেনি ?
কবির মুখ বিকৃত করে বলে , কিছু বলবে কি ? উল্টো ওর সাথে দল পাকাচ্ছে !
: শুনেছি ব্যাটা আড়তদার নুরুর সাথে হাত পাকিয়েছে। লুট করে আনা টাকা পয়সা আর গয়নার ভাগ দিয়েছে তাঁকে ! যে তার দলে যোগ দিচ্ছে তাকে চাল ডাল দিচ্ছে !
: মাগনা!
কবিরের সাথে গলা মেলায় মনু।
আমি বলি ,তাই বলে গাঁয়ের মানুষ ..
: যাবেই তো !
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই খেকিয়ে উঠে হাসু।
: না খেয়ে মরবে নাকি ? কাল যখন আমার ঘরের চাল ডালের ভাড় ফুরিয়ে যাবে আমাকেও হয়তো ভিড়তে হবে মতিনের দলে !তোদেরও! সবাইকেই !
আমার গলা শুকিয়ে আসে। তবে কি আম্মার কথাই ঠিক? ওরা যায়নি ,গর্তে লুকিয়েছিল। এখন আবার বেরোতে শুরু করেছে !
সমাপ্ত
©somewhere in net ltd.