![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি রক্ত বন্যা দেখিনি কোথাও, দেখেছি চোখের কান্না। সে অশ্রু ফোটায় ম্লান হয়েছে হীরা, মতি, মণি, পান্না।
এক
হুটহাট করেই একদিন শিউলির বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। তার বয়স তখন ১৩ কি ১৪। হাটবারে যে দোকানে সামনে মোটা খাজনা দিয়ে শিউলির বাবা কাঁচামালের পসরা সাজায়, সেই দোকান মালিকের বড় ছেলের সাথে সম্বন্ধ। মনার হাটেই ছেলেদের বড় বড় দুইটা দোকান। জমিজমা যা আছে তার হিসেব নেই। শোনা যায় এককালে নাকি জমিদার ছিল।
যাক সে কথা, একটা কথা আছে, যতবড় সম্বন্ধ তত বেশি বাঞ্জানি*। বিয়ের খবর চাওর হওয়ার পরপর শুরু হল বিপদ। দুর দূরান্ত থেকে প্রতিদিনই লোকজন আসতে থাকল একটার পর একটা সংবাদ নিয়ে। ছেলের যত দোষ আছে, যত দোষ নেই সবই নিজ উদ্যোগে চলে আসতে লাগল বাড়ি বয়ে। বোধকরি মেয়ের বাড়িতে যতলোক এসেছে ছেলের বাড়ি গিয়েছে তার দ্বিগুণ।
এসব নিয়ে অবশ্য দু পক্ষের কাওকেই কোন গা করতে দেখা গেলনা।
শিউলির বাপ এক একটা খবর শুনে এসে বউয়ের কানে ফিসফিস করে বলে, পোলার এক পাও নাকি ল্যাংড়া?
বউ ধমকে উঠে, খবরদার পরকথায় কান দিবানা!
শিউলির বাবা মাথা নেড়ে বলে, আচ্ছা ঠিক আছে!
বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। একটা টুকরো জমি ছিল চাষের। তা বিক্রি করে দেয়া হয় বিয়ের জোগানের জন্য। জামাইয়ের বাড়ি বড়, সুতরাং তাদের আপ্যায়নটাও সেইমত হওয়া চায়।
দুই
শিউলির নিজের বিয়ে নিয়ে তেমন মাথা ব্যথা নেই। বাড়িতে অনেকদিন পর সব আত্মীয় স্বজনরা এসেছে।গমগম করছে বাড়িটা। বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার পর থেকেই অবশ্য ওর বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ। তাই সমবয়সী মামাতো, কাকাতো ভাইবোনদের নিয়েই সে ব্যস্ত। তাদের উঠুনের বড়ই কিভাবে দুপুরে ভুতের ছায়া পড়ে, কোন পুকুরে সরলা কমলা দুই বোন একসাথে ডুবে মরেছিল এইসব আশ্চর্য সব গল্প সে তার ভাইবোনদের বাড়িতে বেধে রাখতে চেষ্টা করে।
শিউলিদের বাড়ির পাশে যে ছোট করে ঝাউবনটা, তার মাঝ দিয়ে চলে গেছে একটা পায়ে হাটার পথ। সে পথে খানিকটা হাঁটলেই নদীর ঘাট। সেখানে ভাইবোনদের নিয়ে যাওয়ার কথা সেইই প্রথম বলেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওরই আর যাওয়া হলোনা।
সবাই হুটোপুটি করে সাতার কেটে ফিরল নদী থেকে। চোখের পানি, নাকের পানি এক করেও সে মায়ের মন গলাতে পারেনি। বাবাকে অবশ্য বলে কয়ে মায়ের কাছে পাঠানো হয়েছিল, মায়ের ধমকে ওনি আর কিছু বলার সাহসই পেলেননা।
শেষ চেষ্টা হিসেবে সে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিল। ভেবেছিল এইবার বুঝি মা রাজি হবেই। কিন্তু উলটো পিঠে দু ঘা দিয়ে যখন মা মুখে ভাত গুজে দিলেন সে আশাও আর ধুপে টিকলনা।
তিন
বড় বড় তিনটা নাও নিয়ে বরযাত্রীরা এসেছিল। সেই নাওয়ের যেটা রঙ করে সাজানো, সেই নাওয়েই শিউলিকে তোলা হল। আগেই শোনা গিয়েছিল ওর বরের একটা পা একটু খুড়া, কিন্তু বিয়ের দিন দেখা গেল খুড়া তো বটেই, তার মুখ দিয়ে পড়ে ক্রমাগত লালা। পুরো অনুষ্ঠানেই একজন লোক রুমাল দিয়ে বারবার তার মুখ মুছে দিচ্ছে। তাও অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে দেখা গেল লোকটার বুক ভেসে গেছে লালায়।
আসরের ওয়াক্তের সময় নৌকা ছাড়া হয়েছিল। সে নৌকা যখন শিউলির শশুর বাড়ির ঘাটে ভিড়ল ততক্ষণে মাগরিবের আজান পড়েছে। বাড়ির ঘাটে হারিকেন কুপি নিয়ে দাঁড়ানো মহিলাদের জট। শিউলি এক কদম আগায় আর অমনি দু তিনজন কুপি নিয়ে চলে আসে একদম তার মুখের কাছে। ভিড়ের ভেতর থেকে কে যেন আফসোস করে, এমন পোলার এমন বউ! আহা, মাইয়াডার লাগি মায়া লাগে।
শিউলির শশুরের কানে আসতেই ধমকে উঠেন তিনি, এই থামো তোমরা। এত বেশি কথা কিসের!
চার
মস্ত বড় বাড়ি শিউলির শশুরের। শিউলি যে ঘরে ছোটবেলা থেকে মানুষ হয়েছে সে টিন শেডের ঘরটাতে সব মিলিয়ে তিনটা খুপরির মত ঘর ছিল। বৃষ্টির দিনে ভাঙ্গা টিনের চাল গড়িয়ে মেঝেতে পড়তো বৃষ্টির ছাট। যেখানে যেখানে বেশি পানি পড়তো সেখানে হাড়ি দিয়ে মেঝেকে পানির হাত থেকে বাঁচাতে হতো।
আর সেই তুলনায় এই বাড়িটা রাজ প্রাসাদের চেয়ে কম কিছু নয়। তিন চারদিন হয়ে গেছে এই বাড়িতে সে এসেছে, এখনও সে হিসেবই করে উঠতে পারেনি এই বাড়ি ঠিক কয়টা ঘর আছে। ইতোমধ্যেই ঘর সংসারের কাজ এক আধটু শেখা শুরু করেছে সে। রান্নাঘরে বাড়ির বউ ঝিদের সাথে থেকে তদারকি করা কিংবা শাশুড়ির জন্য পান ছেঁচে দেয়ার কাজ সে ভালোই গুছিয়ে নিতে শুরু করেছে।
শিউলির বরটা একটু হ্যাবলা। জন্ম থেকে বা পাটা ডান পা থেকে একটু ছোট, তাই যখন হাটে তখন একটু বেকে চলে। মুখ দিয়ে এখনও বাচ্চাদের মত লালা পড়ে। আগে খুব ঘেন্না লাগল শিউলির। এখন সেইই একটু পর পর আচল দিয়ে মুখ দেয়। আগে যখন মুখ মুছতে যেত তখন মাথা নিচু করে বসে থাকত,ইদানীং কাছে গেলেই হাত জড়িয়ে ধরে। সহজে ছাড়ানো যায়না হাত। জোর করে ছাড়াতে গেলেই বাচ্চা ছেলেদের মত চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।
শিউলির রান্নার কাজ করার সময় একটু পরপর দরজায় গিয়ে ডাকতে থাকে, বউ খুব গরম লাগছে, একটু বাতাস দিয়া যাও!
বাড়ির অন্য বউরা ঠাট্টা করে বলে, যা শিঊ! তোর বরকে ঠাণ্ডা করে আয়।
হাসির রোল উঠে রান্না করে। ওর মুখ লজ্জায় লাল হয়ে যায়।
রাতে বরের বুকে মাথা গুজে ফিসফিস করে বলে, রান্নাঘরে ডাকতে আসো, আমার খুব লজ্জা করে!
শিউলির আরো শক্ত করে বুকে চেপে ধরে বর বলে, কি করব বউ, তোমারে খালি দেখতে ইচ্ছা করে!
শিউলি তেমনি ফিসফিস করে বলে, ক্যান দেখতে ইচ্ছা করে!
বর কেমন যেন উদাস হয়ে যায়। খানিকটা সময় চুপ করে থাকে।
তার সময় একসময় বলে, তোমার লগে আমার পিরিত, হেই কারণে দেখতে ইচ্ছা করে।
পিরিতের কথার শিউলির খুব হাসি পায়। সে খিল খিল করে হেসে উঠে।
আহারে আমার পিরিতের নাগর!
পাঁচ
বৈশাখ মাসের এক দুপুরে শিউলির বাপ আসে তাকে নায়র নিতে। মেলা পার্বণের দিন, মেয়েকে তার বাপের বাড়ি না নিয়ে গেলে চলেনা।
বাবার অবস্থা আগে থেকেই তেমন ভালো ছিলনা, শিউলির বিয়ের সময় জমিটা বিক্রির পর থেকে শুরু হয় আরো হাতটান। এদিকে মেয়েকে নিতেও তো আর খালি হাতে আসা যায়না।
শেষে দুধেল গাইটা বেঁচে তবেই এলো মেয়েকে নিয়ে যেতে।
নায়রের কথায় শিউলির শশুর অমত করলেন না। কিন্তু গো ধরে রইল ওর বর। সেও যেতে চায় সাথে। কিন্তু নায়রের সময় তো আর বরের যাওয়া চলেনা। নায়রের নিয়মই এই যে মেয়ের বাপ এসে নিয়ে যাবে, তারপর দিন সাতেক পর বর গিয়ে শশুরবাড়ি দাওয়াত খেয়ে বউকে নিয়ে আসবে।
এই নিয়ম যে খুব বড় তা নয়, বড় কথা হচ্ছে মেয়ে বাড়িতে গিয়ে দিন সাতেক থাকবে। সাথে করে জামাই গেলে সাত তাকে আপ্যায়নের সামর্থ্য শিউলির বাবার নেই।
বাড়ির সকলে যতই শিউলির বরকে বুঝাতে চেষ্টা করে, ততই সে আরো শক্ত করে বউয়ের হাত ধরে বলে, আমিও যামু তোমার লগে, আমারেও নিয়া যাও।
শেষে অনেক কষ্টে শাশুড়ি এসে ভুলিয়ে ভালিয়ে ছেলেকে অন্য রুমে নিয়ে গেলে তবেই ওরা বেরোতে পারে ঘর থেকে।
শিউলিরা যখন নৌকায় উঠল তখন বিকেল হয়ে এসেছে প্রায়। মাঝি সবে নৌকা ছেড়েছে সবে। ছইয়ের ভেতর থেকে শিউলি দেখে নদীর ঘাটে এসে দাঁড়িয়েছে কে যেন। দৌড়ে হাঁপাচ্ছে লোকটা। হাত নেড়ে চীৎকার করে বলতে থাকে, বউ তোমারে আমি কয়দিন পরই নিতে আসব। বড় নাও নিয়া আসব।
শিউলির ইচ্ছা করে সেও চীৎকার করে বলে, আইচ্ছা আইসো, তাড়াতাড়ি আইসো।
নৌকা উজান বেয়ে চলছে ধীর গতিতে। যতক্ষণ পর্যন্ত দেখা যায় ঘাটের দিকে তাকিয়ে থাকে ও। লোকটা এখনও ঠাই দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।
ছয়
সেদিন সকাল থেকেই ঢল বৃষ্টি। দুপুর থেকে শুরু হল ঝড়। বাতাসের তাণ্ডবে গাছগুলো পাগলের মতো নাচতে শুরু করল। শিউলিদের উঠোনে একটা আম গাছ ছিল। বিয়ের আগে একটু বাতাস আসলেই শিউলি ছুটতো সেখানে আম কুড়াতে। সেই গাছটা হঠাৎ করাৎ করে ভেঙ্গে পড়ল অসহায়ের মত। পাশের ঘর থেকে মা উচ্চস্বরে দোয়া দরুদ পড়তে শুরু করলেন। বাবা ঘরে নেই। তিনি গিয়েছিলেন হাটে। ঝড় বাদলে বোধহয় সেখানেই আটকে গেছেন।
বিকেল গড়িয়ে যখন সন্ধ্যা নামি নামি করছে তখন ঝড়ের প্রকট অনেকটাই কমে আসে। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসে পরিবেশ। বিধ্বস্ত গাছপালা এ ওর গায়ে হেলান দিয়ে কোন রকমে যেন দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ করে একটা কোলাহল ভেসে আসে দুর থেকে। সন্ধ্যার আধারে শিউলি বেশ কয়েকজন মানুষের একটা দল তাদের বাড়িতে প্রবেশ করে। বাবাকেও দেখা যায় তাদের মধ্যে। কেমন যেন বিমূর্ষ হয়ে আছেন তিনি। শিউলির বুকটা কেমন ধক করে উঠে। দ্রুত পায়ে ঘর চেড়ে উঠোনে চলে আসে সে। মানুষের ভিড়টা থেকে কে যেন বলে উঠে, নৌকা ডুবছে!
শিউলি দাঁড়ায়না কোথাও। ধীরপায়ে সে বাড়ির আওতা পেরিয়ে বাইরে চলে আসে। সামনে ঝাঊবনটা আঁধারে ঘিরে আছে। ভেতর থেকে তখনও টুকটাক কথা ভেসে আসে, বিরাট নৌকা। একবারে উল্টে গেছে। একজনও বাইচ্যা নাই।
শিউলির কানে অবশ্য সেসব কথার কিছুই পৌছোয়না। তার চোখ ঝাঊবনটার দিকে। অন্ধকারে ওখানে এসে কে যেন দাঁড়িয়েছে। লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে যেন বলছে, বউ তোমারে নিতে আইলাম। তোমারে না দেইখা থাকতে পারিনা!
২| ১৭ ই জানুয়ারি, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৩৪
পলাতক মুর্গ বলেছেন: অসাধারণ একটা মন উদাস করা গল্প।
১৮ ই জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ৮:৫২
মোঃ জাবেদ ভুঁইয়া বলেছেন: পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ ।
©somewhere in net ltd.
১|
২৭ শে মে, ২০১৭ রাত ১২:৪৬
আখেনাটেন বলেছেন: বেশ গুছিয়ে গল্প বেঁধেছেন।
ভালো লাগল পড়ে।+++++++