নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

প্রাগঐতিহাসিক ধারাভাষ্যকার শ্রদ্ধেয় \"চৌঃ জাফর উল্লাহ শরাফতের\" সাথে আমার নামের মিল ছাড়া, কাছে বা দুরের কোণ সম্পর্ক নেই।

চৌধুরী জাফর উল্লাহ শরাফত

সাধারণ মানুষ

চৌধুরী জাফর উল্লাহ শরাফত › বিস্তারিত পোস্টঃ

৭১ এর মেধাবী প্রজন্ম, ২০১৮ তে কথা কয়

০৩ রা মে, ২০১৮ দুপুর ১২:০২

১৯৫১ সালের ২৯ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালী উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের এক গৃহবধূর গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ করে এক ছেলে শিশু। ধিরে ধিরে আরামে আয়েশে বেড়ে ওঠে সে।
১৯৬৮ সালে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন।
পাকিস্তান শিক্ষা বোর্ড থেকে মেধাতালিকায় তৃতীয় স্থান অর্জন ।
এর পর ঢাকা কলেজ থেকে এন্ট্রান্স পাশ।
আই.এস.সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর ১৯৭১‌ সালের মার্চ মাসে ছেলেটি ভর্তি হয় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমান বুয়েট)। সে ছিলো তুখোড় মেধাবী। এক মিনিট সময়ও নষ্ট করতো না। বুয়েটে চান্স পাওয়ার পর কিছুদিনের বিরতি ছিল। সেই সময়টাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ক্লাস করে, বিশেষ অনুমতি নিয়ে। অথচ সে ছিলো ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র।
ইতিমধ্যে আমেরিকার ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে তার ভর্তি সম্পন্ন হয়। সেপ্টেম্বর ’৭১ থেকে ক্লাস শুরু হওয়ার কথা ছিল।কিন্তু ২৬ শে মার্চের পরে দেশে শুরু হয় যুদ্ধ। যে কোণ মায়ের জন্য তখন চিন্তার বিষয় ছিল তার সন্তানের নিরাপত্তা । আর তার বেলায় তো ঠিক হয়ে আছে নিশ্চিত আমেরিকা। সুতরাং কোণ মতে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পার করতে পারলেই উড়াল। কিন্তু বাদ সাধল ছেলের বিবেক। দেশের এই বিপদে পালাবে সে?!

“এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার শ্রেস্ঠ সময় তার”----- তামাম যুব সমাজ যুদ্ধে যোগ দিতে বাড়ি থেকে একে একে পালাতে থাকে। কিন্তু ছেলেটি গো ধরে, পালিয়ে যাবে না, মা বাবা কে বলে, অনুমতি নিয়ে তারপর যুদ্ধে যাবে।

আমেরিকায় ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়তে যাওয়ার পরিবর্তে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার বিষয়ে মাকে রাজি করায় এই বলে, ‘আম্মা, দেশের এই রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও, আমি হয়তো যাব শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তাহলে আমার বিবেক চিরকালের মতো অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা থেকে হয়তো বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইঞ্জিনিয়ার হব; কিন্তু বিবেকের ভ্রূকুটির সামনে কোনো দিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না। তুমি কি তাই চাও, আম্মা?’।
তুখড় তার্কিক ছিল ছেলেটি, সাধা সিধা মা পারবে কিভাবে তর্কে? বাধ্য হয়ে সন্তানকে বললেন, ‘যাহ, তোকে দেশের জন্য কুরবানি করে দিলাম।’
“কুরবানি” শব্দ টা তিনি কেন বললেন? এই বলার জন্য বাকি জিবন তিনি আফসোস করে গেলেন আল্লাহ্‌র কাছে।
১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল মাকে অবশেষে রাজি করিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ছেলেটি। সেক্টর-২ এর অধীনে মেলাঘরে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ফিরে আসে ঢাকায়, ক্র্যাক প্লাটুনে যোগ দেয়। ক্র্যাক প্লাটুন হল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণ পরিচালনাকারী একটি সংগঠন। একের পর এক অপারেশন চালাতে থাকে পুরো নগর জুড়ে।

মাকে বলতো, ‘আমাদের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল খালেদ মোশাররফ কী বলেন, জান? তিনি বলেন, “কোনো স্বাধীন দেশ জীবিত গেরিলা চায় না; চায় রক্তাক্ত শহীদ।” অতএব মামনি, আমরা সবাই শহীদ হয়ে যাব, এই কথা ভেবে মনকে তৈরি করেই এসেছি”।

শিউরে উঠত মায়ের মন। মনে মনে ভাবতেন, কেন তার সন্তানকেই যেতে হবে যুদ্ধে? তার সন্তান তো পারত আমেরিকায় গিয়ে উন্নত জীবনের আলোয় আলোকিত হতে। আর কি কেউ নেই যুদ্ধ করার?!! তার মত মেধবি ছেলে কেন যাবে যুদ্ধে?!!!

১৯৭১ সালের ২৯ অগাস্ট রাতে ছেলেটি সহ বাসায় উপস্থিত সকল পুরুষদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। পাকিস্তানী সেনাদের গরিলা হাইড এর এই বাসা টি দেখিয়ে দেয় এক মিলিশিয়া কমান্ডার। আটক অবস্থায় নির্মম নির্যাতন করা হয় ছেলেটি সহ গ্রেফতারকৃত অন্যান্য গেরিলাদের উপর। আটকের একদিন পরেই ছেলেটি নিখোঁজ হয়। ধারণা করা হয় পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলে।
ইয়াহিয়া খান ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিলে অনেক আত্মীয় তাঁর জন্য আবেদন করতে বলেন। কিন্তু যে বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ধরা পড়েছে তার ছেলে, তাদের কাছেই ক্ষমা চাইতে দেশপ্রেমিক মা রাজি ছিলেন না। ক্ষমা চাননি। ছেলের মুখও আর দেখেতে পান নি। ছেলের লাশ ও পান নি।
যুদ্ধ শেষ।চুপ চাপ ছিলেন মা।
ছেলের সৃতি মনে করে করেই দিন কাটাচ্ছিলেন।
কিন্তু বেশি দিন চুপ থাকতে পারলেন না।
যখন দেখলেন, সেই মিলিশিয়া কমান্ডার এবং তার দল বলেরা রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসে গেছে।ভেংচি কেটে কেটে বলছে, “বাংলাদেশে কোণ যুদ্ধাপরাধী নেই।”
যখন দেখলেন লাল সবুজ কাপড়ের টুকরা পত পত করে ওড়ে ওদের গাড়ীর ভি আই পি দন্ডে।
যখন দেখলেন ওরা বলছে ১৯৭১ সালে ভাইয়ে ভাইয়ে গোলমাল হয়েছিলো।
যখন দেখলেন বাংলাদেশের ইতিহাস লিখা হচ্ছে, তার ছেলের নাম ছাড়া।
যখন দেখলেন বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে পড়ানো হচ্ছে, “গোলাম আযম, ইসলামী আন্দলনের নেতা, ভাষা আন্দলনে উনার অবদান অপরিসীম”।
কিভাবে সহ্য করবেন?
তার সন্তান, তার মেধাবী সন্তান, প্রাণটা দিয়েছিলো কি মিলিশিয়া কমান্ডারদের জন্য নিরাপদ আবাস গড়ে দিতে?
তাই মা শুরু করলেন আন্দোলন । তার সন্তানের হত্যার জন্য দায়ী সেই মিলিশিয়া কমান্ডারের বিচারের দাবীতে আন্দোলন।
হায়রে মা। বুড়ির আস্পর্ধা দেখুন। ক্ষমতায় তখন মিলিশিয়া কমান্ডাররা। দেশে থেকে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন ?!!!!!!
দিলো মায়ের নামে মামলা ঠুকে।
কিসের মামলা?!!
দেশদ্রোহ মামলা।
শহীদের মা দেশদ্রোহী !!!!!!!
টক বগিয়ে ফুটে উঠেছিল সেদিন ছেলের জীবিত সহযোদ্ধাদের শরীরের রক্ত।
হাহাকার করে কেদে ছিল হয়ত শহীদ ছেলের আত্বা।
নড়ে চড়ে উঠেছিলো হয়ত কোণ গুপ্ত যায়গায় আজও লুকিয়ে থাকা ছেলের শরীরের কঙ্কাল।

সাথে আরও কত কত অপবাদ। ভারতের দালাল, নাস্তিক, মুরতাদ ইত্যাদি ইত্যাদি।
মা কিন্তু থামেন নি।
চালিয়ে গেছেন আন্দোলন। সাথে জুটেছিল আরও অনেকে। ঘাতক দালাল নির্মুলের ব্যানারে।
অবশেষে ২৬ জুন ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টায় মিশিগানের ডেট্টয়েট নগরীর সাইনাই হাসপাতালের বেডে ৬৫ বছর বয়সে মা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

আজ সেই মায়ের জন্ম বার্সিকি।
মায়ের নাম, জাহানারা ইমাম।

ছেলেটির নামঃ শহীদ শফি ইমাম রুমী

মিলিশিয়া কমান্ডারটির নামঃ আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ। তিনি ছিলেন, বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ ও সাবেক মিলিশিয়া কমান্ডার যিনি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাধারণ সচিব ছিলেন। ২০১৩ সালের ১৭ই জুলাই, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ-এর বিরুদ্ধে গণহত্যা, বুদ্ধিজীবি হত্যার পরিকল্পনা, রুমী হত্যা ও নির্যাতন ইত্যাদিসহ মোট উত্থাপিত ৭টি অভিযোগের মধ্যে ৫টিতে দোষী প্রমানিত হয়। এর মাঝে দুটি অভিযোগে তাকে মৃত্যুদন্ড আদেশ দেয়া হয়।

শহীদ জননীর রুহের মাগফেরাত কামনা করছি।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.