নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

asadeng

বুঝতে চাই

জগলুলআসাদ

i want to share

জগলুলআসাদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

বেকনের ‘মূর্তি’ অথবা চিন্তার চার প্রতিবন্ধকতা

১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সকাল ৯:১২

আধুনিক ইউরোপীয় দর্শনের প্রধান নির্মাতাদের একজন হচ্ছেন ফ্রান্সিস বেকন। বাংলাদেশের বিদ্যায়তনিক পরিমণ্ডলে তিনি অবশ্য তার ছোট,ঘন-সংহত,সরস,একিই সাথে পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও ব্যবহারিক দিকনির্দেশনাপূর্ণ প্রবন্ধের জন্য সমধিক পরিচিত । বেকন মধ্যযুগের ষোল-সতের শতকের ইংল্যান্ডের মানুষ । দৃষ্টিগ্রাহ্য ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জ্ঞান আহরণের যে পদ্ধতি তিনি বাতলে দিয়াছিলেন তা বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ও অন্যান্য অনুষদের গবেষণায় এখন স্বীকৃত । তাছাড়া,বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির পর্যালোচনা হাজির করার কারনে তিনি আধুনিক বিজ্ঞান দর্শনের প্রধান নির্মাতাও বটে । ১৬২০ সালে প্রকাশিত হয় তার সবচেয়ে প্রভাবশালী ও খ্য্যাতিসম্পন্ন গ্রন্থ “নোভাম অরগানাম”। এই গ্রন্থেরই একটি প্রবন্ধ ‘চার মূর্তি’ বা ‘ফোর আইডলস’ যেখানে তিনি স্বাধীন চিন্তা ও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে চারটি বড় প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করেছেন। এগুলোকে তিনি আখ্যা দিয়েছিলেন মূর্তি বা idol হিশেবে। তার মতে এ মূর্তিগুলো সত্যকে বিকৃত করে এবং বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ ও জ্ঞানের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ।

Idols of the tribe : মানুষ তার প্রজাতিগত বিশেষ বৈশিষ্টের কারনে নিজেকে বহির্জগতের একজন হিশেবেই দেখে । ফলে বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জনের জন্য জ্ঞেয় ও জ্ঞাতার মধ্যে যে দূরত্বের শর্ত সেটি প্রায়শই অনুপস্থিত থাকে । বেকনের মতে মানুষের মনের একটি স্বভাব হোল সাধারণীকরণ। এই প্রবণতাও মানুষকে সত্যিকার পর্যবেক্ষণ লব্ধ জ্ঞান থেকে বঞ্চিত করে । অপর্যাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তড়িঘড়ি করে একটি বিশেষ ঘটনাকে নির্বিশেষ করে ফেলার প্রবণতা এমন একটা ত্রুটি যেটি থেকে প্রায় কোন মানুষই মুক্ত নয় । তাছাড়া,বেকন মনে করেন,ব্যক্তির চৈতন্যকেই সব কিছুর পরিমাপক বানানোর রোম্যান্টিক প্রবণতা বৈজ্ঞানিক সত্য অনুসন্ধানের পথে বাধা । দৃশ্যমান জগতের মধ্যে একটা শৃঙ্খলা আবিস্কার করা আমাদের মনের বাসনা । মানুষের বুঝ(understanding) ত্রুটিপূর্ণ আয়নার মত। বাহ্যজগত এ আয়নায় ধরা পরলে মন তার মাধুরী দিয়ে তৈরী জগতের যে রূপ নির্মাণ করে তা হয় প্রায়শই হয় বিকৃত ,সত্যবিবর্জিত ও ত্রুটিপূর্ণ । অতিরঞ্জন ,বিকৃতি ও অপরিমিতি মানুষের স্বভাবগত । প্রজাতিগতভাবে মানুষের মধ্যে থাকা এই প্রবণতাগুলো সম্পর্কে সচেতনতা সত্য অন্বেষণের জরুরী শর্ত বলে বেকন মনে করেন।

Idols of the cave : বেকন গুহা মূর্তি বলতে বুঝিয়েছেন ব্যক্তির পক্ষপাত বা সংস্কারকে যেটি শিক্ষা,পরিবার বা অভ্যাস থেকে অর্জিত বা স্বার্থবুদ্ধি থেকে উৎপন্ন হয়ে কূপমণ্ডূকতায় পরিণত হয় । এই কূপমণ্ডূকতা ব্যক্তির সঠিক পর্যবেক্ষণ ও বৈজ্ঞানিক সত্য অর্জন বা আবিস্কারের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় । বিষয়বুদ্ধি,অহমিকা,স্বল্প অভিজ্ঞতা,চরিত্রগত কোন বিশেষ বৈশিষ্টয সত্যের পথে বস্তুনিষ্ঠ অনুসন্ধানে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।কোন বিশেষ ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও বিদ্যাবত্তায় অতিরিক্ত আস্থা,কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মতামতের প্রতি নিঃসংশয় ভরসা সত্য গ্রহন ও অনুসন্ধানে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। ব্যক্তি যখন তার স্বনির্মিত গুহায় অবস্থান করে তখন প্লেটোর গুহাবাসীর মত সে দেখে সত্যের ছায়া বা মরীচিকা,মিথ্যার মূর্তি বা অর্ধসত্য ।

Idols of the market place: জিজ্ঞাসা ও অনুসন্ধানবিহীন বাজার চলতি ধারনায় আস্থা-বিশবাস সত্যের প্রতিবন্ধক। কিছু কিছু ধারণাকে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার কারণে প্রায়শই প্রশ্নহীন রাখা হয় । ভাষার প্রশ্ন নিয়ে এসে শব্দ ,অর্থ ও চিন্তার মধ্যকার সম্পর্কের কিছু ইশারা দেন বেকন । এটা প্রচলিত বিশ্বাস যে,মানুস তার চিন্তাকে রূপায়িত করে ভাষায় । ফলে,ভাষা প্রায়শই হয়ে উঠে চিন্তার বিকল্প।মূল অর্থের দিকে নজর না দিয়ে ভাষার যথেচ্ছ ব্যবহার আমাদের বোঝাবুঝি ও চিন্তাকে অস্পস্ট করে তোলে ।ভাষার মধ্য দিয়ে ঘটনা বদলে যায়। গুজব বা রটনা সত্যের চেহারা নেয় । সামাজিক যোগাযোগ, সঙ্গ ও মেলামেশার ফলে অনেক ধারণার বিস্তৃতি ও প্রতিষ্ঠা ঘটে সমাজে ও ব্যক্তি মনে।

Idols of the Theatre: সমাজে শেকড় গেড়ে বসে থাকা নানা ধরনের ভ্রান্ত দার্শনিক চিন্তার প্রবল উপস্থিতি সুষ্ঠু ও বৈজ্ঞানিক চিন্তার পথে বাধা । ভ্রান্ত চিন্তা বা বিশ্বাস যা সমাজে যুক্তি ও দর্শন নামে বিদ্যমান আছে সেগুলোকে বেকন idols of the theatre বলেছেন । আভিধানিকভাবে Theatre মানে গ্যালারীযুক্ত কক্ষ,যেখানে বক্তৃতা বা বিজ্ঞান বিষয়ক আলচনা হয় ।পূর্ববর্তী দার্শনিকদের ভাবনাকে বেকনের কাছে মঞ্চে পরিবেশিত নাটকের মতই মনে হয়েছে । থিয়েটার দেখে মানুষ আনন্দিত হয়, প্রভাবিতও হয় যদিও মানুষ মঞ্চ নাটককে সত্য ও বাস্তব বলে মেনে নেয়না। idols of the theatre কে বেকন তিনটি ভাগে ভাগ করেছেনঃ ক। সফিস্টিকাল খ।এম্পিরিকাল গ।সুপারিস্টিসাস । ক) এরিস্টটলের syllogistic বা নৈয়ায়িক যুক্তির প্রতাপ ও প্রাবল্যকে বেকন আক্রমণ করেছেন এবং induction বা আরোহী পদ্ধতিকে তুলনামূলকভাবে ভালো বিকল্প মনে করেছেন ।অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষামূলক প্রমান ব্যাতিরেকেই চাতুর্যমূলক যুক্তি নির্ভরতা প্রাকৃতিক ঘটনাপুঞ্জির বৈজ্ঞানিক সত্য আবিস্কারের প্রতিবন্ধক। খ)স্বল্প পরীক্ষানিরীক্ষার ভিত্তিতে কোন সিস্টেম আবিস্কার করা এবং অন্য সকল ঘটনাকে তার সাথে সংগতিপূর্ণ দেখানোর চেস্টা করে থাকেন কিছু দার্শনিক । এই এম্পেরিকাল ভ্রান্তি সঠিক চিন্তার পথে বিঘ্ন ।গ) অনেকেই তাদের দর্শনকে ধর্ম ও প্রথার সাথে মিলিয়ে উপস্থাপন করেন। অনেকেই এতদূর পর্যন্ত যান যে ,তারা বিজ্ঞানের উৎস অনুসন্ধান করেন ধর্মে । সংস্কারকেই দর্শন হিসেবে উপস্থাপন করা সঠিক চিন্তার পথে সবচেয়ে বড় ভ্রান্তি বলে মনে করেন বেকন ।

এভাবে বেকন তার সময়ের বুদ্ধিবৃত্তিক ভ্রান্তিকে চারটি শিরোনামে চার মূর্তি হিশেবে উল্লেখ করেছেন।বেকনের কাছে এই মূর্তি কোন প্রতীক বা সিম্বল নয়, বরঞ্চ এগুলো মনের বদ্ধমূল প্রবণতা(Fixation)। এই মূর্তিগুলোকে প্রশ্ন করে,সচেতন থেকে ও ভেঙ্গে সঠিক ও বৈজ্ঞানিক চিন্তার দিকে অগ্রসর হতে হবে বলে বেকন মনে করেন। যদিও পরীক্ষণ ও প্রত্যক্ষ প্রমাণ নির্ভর ইউরপীয় বিজ্ঞানের চরিত্র নির্মাণে বেকনের দায় আছে, আছে Bertrand Russel উল্লেখিত বেকনের নানা স্ববিরোধীতাও ।

তবুও বলা যায় , বেকন আমাদের ধরিয়ে দিয়েছেন আমাদের চিন্তার নানা বাঁকের ঠিকুজি ।এইসব মূর্তি থেকে মানুষের মনকে মুক্ত করে অভিজ্ঞতা ভিত্তিক বিশ্লেষণ ও স্বাধীন চিন্তার পথকে প্রশস্ত করার কথা বলেছেন বেকন ।বেকন আমাদের চিন্তার পথে প্রতিবন্ধক চার মূর্তির কথা বলেই ক্ষান্ত হননি, সমাধানের পথও বাতলে দিয়েছেন । সেটি হোল , মূর্তিগুলোর গ্রাহ্যতাকে নিরন্তর প্রশ্নের মধ্যে রাখা। বাংলাদেশেও মানুষের চিন্তা ভাবনা কতগুলো অপরীক্ষিত ধারণার শৃঙ্খলে আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা রয়েছে । আমাদের ইতিহাসে দণ্ডায়মান নানা ‘মূর্তি’কে প্রশ্ন করেই আমাদের এগুতে হবে সামনে ।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.