![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
..................বিশাল যন্ত্রণার অর্থ হচ্ছে বিশাল শুদ্ধতা ৷৷ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
মাইকেল মধুসূদন দত্তের চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী পর্ব-১
বাংলা সাহিত্যে সনেটের আদলে চতুর্দ্দশপদী কবিতার প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩)৷ তাঁর চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী পর্বান্তরে দেয়ার চেষ্টা করব সাথে কিছু অর্থও থাকবে ৷ উৎসাহীরা সবাই সাথে থাকবেন আশা করি ৷
১
উপক্রম
যথাবিধি বন্দি কবি, আনন্দে আসরে,
কহে, ষোড় করি কর, গৌড় সুভাজনে;
সেই আমি, ডুবি পূর্ব্বে ভারত-সাগরে১,
তুলিল যে তিলোত্তমা-মুকতা যৌবনে;
কবি-গুরু বাল্মীকির প্রসাদে তৎপরে,
গম্ভীরে বাজায়ে বীণা, গাইল, কেমনে,
নাশিলা সুমিত্রা-পুত্র, লঙ্কার সমরে,
দেব-দৈত্য-নরাতঙ্ক রক্ষেন্দ্র-নন্দনে২;
কল্পনা দূতীর সাথে ভ্রমি ব্রজ-ধামে
শুনিল যে গোপিনীর হাহাকার ধ্বনি,
(বিরহে বিহ্বলা বালা হারা হয়ে শ্যামে৩
বিরহে-লেখন পরে লিখিল লেখনী
যার,বীর জায়া-পক্ষে বীর পতি-গ্রামে৪
সেই আমি,শুন, যত গৌড়-চূড়ামণি!
২
ইতালী, বিখ্যাত দেশ, কাব্যের কানন,
বহুবিধ পিক যথা গায় মধুস্বরে,
সঙ্গীত-সুধার রস করি বরিষণ,
বসন্ত আমোদে মন পুরি নিরন্তরে;
সে দেশে জনম পূর্ব্বে করিলা গ্রহণ
ফ্রাঞ্চিস্কো পেতরাকা৫ কবি; বাক্ দেবীর বরে
বড়ই যশস্বী সাধু, কবি-কূল-ধন,
রসনা অমৃতে সিক্ত, স্বর্ণ বীণা করে ৷
কাব্যের খনিতে পেয়ে এই ক্ষুদ্র মণি,
স্বমন্দিরে প্রদানিলা বাণীর চরণে
কবীন্দ্র; প্রসন্নভাবে গ্রহিলা জননী
(মনোনীত বর দিয়া) এ উপকরণে ৷
ভারতে ভারতী-পদ উপযুক্ত গণি,
উপহার রূপে আজি অরপি রতনে ৷৷৬
৩
বঙ্গভাষা
হে বঙ্গ, ভান্ডারে তব বিবিধ রতন;
তা সবে, (অবোধ আমি) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচারি ৷
কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি!
অনিদ্রায়, অনাহারে সঁপি কায়, মনঃ,
মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি;
কেলিনু শৈবালে; ভুলি কমল-কানন !
স্বপ্নে তব কুললক্ষী কয়ে দিলা পরে
“ওরে বাছা মাতৃ-কোষে রতনের রাজি,
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে!”
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃ-ভাষা-রূপ খনি, পূর্ণ মণিজালে ৷৷
৪
কমলে কামিনী
কমলে কামিনী আমি হেরিনু স্বপনে
কালিদহে ৷ বসি বামা শতদল-দলে
(নিশীথে চন্দ্রিমা যথা সরসীর জলে
মনোহরা ৷) বাম করে সাপটি হেলনে
গজেশে, গ্রসিছে তারে উগরি সঘনে ৷
গুঞ্জরিছে অলিপুঞ্জ অন্ধ পরিমলে,
বহিছে দহের বারি মৃদু কলকলে ৷
কার না ভোলে রে মনঃ এ হেন ছলনে !
কবিতা-পঙ্কজ-রবি, শ্রীকবিকঙ্কণ,
ধন্য তুমি বঙ্গভূমে !৭ যশঃ-সুধাদানে
অমর করিলা তোমা অমরকারিণী
বাগ্দেবী ! ভোগিলা দুখ জীবনে, ব্রাহ্মণ,
এবে কে না পূজে তোমা, মজি তব গানে?
বঙ্গ-হৃদ-হ্র্রদে চন্ডী কমলে কামিনী ৷৷
৫
অন্নপূর্ণার ঝাঁপি
মোহিনী-রূপসী-বেশে ঝাঁপি কাঁখে করি,
পশিছেন, ভবানন্দ, দেখ তব ঘরে
অন্নদা!৮ বহিছে শূন্যে সঙ্গীত-লহরী,
অদৃশ্যে অপ্সরাচয় নাচিছে অম্বরে ৷
দেবীর প্রসাদে তোমা রাজপদে বরি,
রাজাসন, রাজছত্র, দিবেন সত্বরে
রাজলক্ষ্মী; ধন-স্রোতে তব ভাগ্যতরি
ভাসিবে অনেক দিন, জননীর বরে ৷
কিন্তু চিরস্থায়ী অর্থ নহে এ সংসারে;
চঞ্চলা ধনদা রমা, ধনও চঞ্চল;
তবু কি সংশয় তব জিজ্ঞাসি তোমারে ?
তব বংশ-যশ-ঝাঁপি অন্নদামঙ্গল
যতনে রাখিবে বঙ্গ মনের ভান্ডারে,
রাখে যথা সুধামৃতে চন্দ্রের মন্ডলে ৷৷
৬
কাশীরাম দাস
চন্দ্রচুড়৯ জটাজালে আছিলা যেমতি
জহ্নবী,১০ ভারত-রস ঋষি দ্বৈপায়ন,
ঢালি সংস্কৃত-হ্র্রদে রাখিলা তেমতি;
তৃষ্ণায় আকুল বঙ্গ করিত রোদন ৷
কঠোরে গঙ্গায় পুজি ভগীরথ ব্রতী,
(সুধন্য তাপস ভবে, নর-কুল-ধন!)
সগর-বংশের যথা সাধিলা মুকতি,
পবিত্রিলা আনি মায়ে, এ তিন ভুবন;
সেই রূপে ভাষা-পথ খননি স্ববলে,
ভারত-রসের স্রোতঃ আনিয়াছ তুমি
জুড়াতে গৌড়ের তৃষা সে বিমল জলে !
নারিবে শোধিতে ধার কভু গৌড়ভূমি ৷
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান ৷
হে কাশি, কবীশদলে তুমি পূণ্যবান্ ৷৷
৭
কৃত্তিবাস
জনক জননী তব দিলা শুভ ক্ষণে
কৃত্তিবাস নাম তোমা! কীর্ত্তির বসতি
সতত তোমার নামে সুবঙ্গ-ভবনে,
কোকিলের কন্ঠে যথা স্বর, কবিপতি,
নয়নরঞ্জন-রূপ কুসুম যৌবনে,
রশ্মি মাণিকের দেহে! আপনি ভারতী,
বুঝি কয়ে দিলা নাম নিশার স্বপনে,
পূর্ব্ব-জনমের তব স্মরি হে ভকতি !
পবন-নন্দন হনু, লঙ্ঘি ভীমবলে
সাগর, ঢালিয়া যথা রাঘবের কানে
সীতার বারতা-রূপ সঙ্গীত-লহরী;১১
তেমতি, যশস্বি, তুমি সুবঙ্গ-মন্ডলে
গাও গো রামের নাম সুমধুর তানে,
কবি পিতা বাল্মীকিকে তপে তুষ্ট করি !
৮
জয়দেব
চল যাই জয়দেব. গোকুল-ভবনে
তব সঙ্গে, যথা রঙ্গে তমালের তলে
শিখিপুচ্ছ-চূড়া শিরে, পীত ধড় গলে
নাচে শ্যাম, বামে রাধা সৌদামিনী ঘনে!১২
না পাই যাদবে যদি, তুমি কুতুহলে
পুরিও নিকুঞ্জরাজী বেণুর স্বননে!
ভুলিবে গোকুল-কুল এ তোমার ছলে,
নাচিবে শিখিনী সুখে, গাবে পিকগণে,
বহিবে সমীর ধীরে সুস্বর-লহরী,
মৃদুতর কলকলে কালিন্দী আপনি
চলিবে! আনন্দে শুনি সে মধুর ধ্বনি,
ধৈরজ ধরি কি রবে; ব্রজের সুন্দরী ?
মাধবের রব, কবি, ও তব বদনে,
কে আছে ভারতে ভক্ত নাহি ভাবি মনে ?
৯
কালিদাস
কবিতা-নিকুঞ্জে তুমি পিককুল-পতি !
কার গো না মজে মনঃ ও মধুর স্বরে ?
শুনিয়াছি লোক-মুখে আপনি ভারতী,
সৃজি মায়াবলে সরঃ বনের ভিতরে,
নব নাগরীর বেশে তুষিলেন বরে
তোমায়;১৩ অমৃত রসে রসনা শিকতি,
আপনার স্বর্ণ বীণা অরপিল করে !
সত্য কি হে এ কাহিনী, কহ, মহামতি ?
মিথ্যা বা কি বলে বলি ! শৈলেন্দ্র-সদনে,
লভি জন্ম মন্দাকিনী (আনন্দ জগতে!)
নাশেন কলুষ যথা এ তিন ভুবনে;
সঙ্গীত-তরঙ্গ তব উথলি ভারতে
(পুন্যভূমি!) হে কবীন্দ্র, সূধা-বরিষণে,
দেশ-দেশান্তরে কর্ণ তোষে সেই মতে !
১০
মেঘদূত
কামী যক্ষ দগ্ধ, মেঘ, বিরহ-দহনে,
দূত-পদে বরি পূর্ব্বে, তোমায় সাধিল
বহিতে বারতা তার অলকা-ভবনে,
যেখানে বিরহে প্রিয়া ক্ষুণ্ন মনে ছিল ৷
কত যে মিনতি কথা কাতরে কহিল
তব, পদতলে সে, তা পড়ে কি হে মনে ?
জানি আমি, তুষ্ট হয়ে তার সে সাধনে
প্রদানিলা তুমি তারে যা কিছু যাচিল;
তেঁই গো প্রবাসে আজি এই ভিক্ষা করি;
দাসের বারতা লয়ে যাও শীঘ্রগতি
বিরাজে, হে মেঘরাজ, যথা সে যুবতী,
অধীর এ হিয়া হায়, যার রূপ স্মরি !
কুসুমের কানে স্বনে মলয় যেমতি
মৃদু নাদে, কয়ো তারে, এ বিরহে মরি!
১১
গরুড়ের বেগে, মেঘ, উড় শুভক্ষণে ৷
সাগরের জলে সুখে দেখিবে, সুমতি,
ইন্দ্র-ধনূঃ-চূড়া শিরে ও শ্যাম মুরতি,
ব্রজে যথা ব্রজরাজ যমুনা-দর্পণে
হেরেন বরাঙ্গ যাহে মজি ব্রজঙ্গনে
দেয় জলাঞ্জলি লাজে ! যদি রোধে গতি
তোমার, পর্ব্বত-বৃন্দ, মন্দ্রি ভীম স্বনে
বারি-ধারা-রূপে বাণে বিঁধো, মেঘপতি.
তা সকলে, বীর তুমি; কারে ডর রণে ?
এ দূর গমনে যদি হও ক্লান্ত কভু,
খগেন্দ্র১৪ উপেন্দ্র১৫-সম,তুমি সে বাহনে!
কৌস্ত্তভের রূপে পরো তড়িত-রতনে ৷৷
১২
“বউ কথা কও”
কি দুখে, হে পাখি, তুমি শাখার উপরে
বসি, বউ কথা কও, কও এ কাননে ?
মানিনী ভামিনী১৭ কি হে, ভামের গুমরে,
পাখা-রূপ ঘোমটায় ঢেকেছে বদনে ?
তেঁই সাধ তারে তুমি মিনতি-বচনে ?
তেঁই হে এ কথাগুলি কহাছ কাতরে ?
বড়ই কৌতুক, পাখি, জনমে এ মনে
নর-নারী-রঙ্গ কি হে বিহঙ্গিনী করে ?
সত্য যদি, তবে গুন, দিতেছি যুকতি;
(শিখাইব শিখেছি যা ঠেকি এ কু-দায়ে)
পবনের বেগে যাও যথায় যুবতী;
“ক্ষম, প্রিয়ে” এই বলি পড় গিয়া পায়ে ৷
কভু দাস, কভু প্রভু, শুন, ক্ষুণ্নমতি,
প্রেম-রাজ্যে রাজাসন থাকে এ উপায়ে ৷৷
সূত্রঃ ইন্টারনেট,
মধুসূদন কাব্য সমগ্র-বাংলা একাডেমী,
মধুসূদন রচনাবলী-সম্পাদনা সব্যসাচী রায়,কলিকাতা
টীকা
১৷ মহাসাগরকে সাগরেরে সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে ৷
২, ৩, ৪ ৷ মেঘনাথবধ কাব্য ব্রজঙ্গনা কাব্য ও বীরাঙ্গনা কাব্যের কথা উল্লেখ করেছেন কবি ৷
৫৷ ফ্রান্সকো পের্ত্রার্কা (১৩০৪-১৩৭৪) প্রথম সনেট রচয়িতা ৷
৬৷ বাঙ্গালী কবি মধুসূদন প্রথম সনেট বা চতুর্দ্দশপদী কবিতা রচনা করে ইতালীর কবিকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন ৷কবি কবিতাটি রচনা করেছিলেন ফরাসিদেশের ভরসেলস নগরে ৷
৭৷ কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী অন্যতম বাঙ্গালী কবি ৷ তার রচিত মঙ্লকাব্য কবিকঙ্কন-চন্ডীতে যে কমলে কামিনী চিত্র অঙ্কিত হয়েছে মধুসূদন তার সনেটে উপকরণরূপে গ্রহণ করেছেন ৷
৮৷ রায়গুণাকর কবি ভারতচন্দ্র রায় অন্নদামঙ্গল কাব্য রচয়িতা ৷ ইনি অষ্টাদশ শতকের বাঙ্গালী কবি ৷
৯৷ চন্দ্র চূড়ায় যায় মহাদেব ৷
১০৷ গঙ্গার অপর নাম ৷ ভগীরথের গঙ্গা আনয়নের পৌরণিক বৃত্তান্ত ৷
১১৷ অশোককাননে বন্দিনী সীতার বার্তা এনেছিল হনুমান ৷
১২৷ মেঘের কোলে বিদ্যুতের নৃত্য ৷
১৩৷ কালিদাসের কবিত্বলাভ বিষয়ে প্রচলিত কিম্বদন্তীর প্রসঙ্গ ৷
১৪৷ পক্ষীদের রাজা গরুড় ৷
১৫৷ বিষ্ণু ৷
১৬৷ বিষ্ণুর বক্ষস্থিত মণি ৷
১৭৷ কোপনস্বভাবা রমণী ৷
(চলবে)
©somewhere in net ltd.