![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমার কথা নয়, কথাগুেলা আমার কলেজের এ্যাডজুেটন্ট এর
রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের এ্যাডজুটেন্ট হিসেবে জয়েন করেছি কয়েক মাস হলো। এর আগে ছিলাম মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে। আমার এ পর্যন্ত চাকুরি জীবনে খুব অন্যরকম অভিজ্ঞতা। কাজের ধরন, পারিপার্শ্বিকতা আর অনেকখানি নস্টালজিয়া তো রয়েছেই।
সেদিন সকালে অফিসের সামনে দাড়িয়ে মোবাইলে কথা বলছিলাম হঠাৎ চোখ পড়ল একজনের উপর, হলুদ শার্ট পরনে, আমাদের বয়সী হবে। হাবভাবে মনে হল কলেজে ঢুকতে চায়। অফিসে বসে গার্ডকে দিয়ে ডেকে আনালাম। সামনাসামনি ভালো করে দেখেই মানুষটাকে চিনতে পারলাম ক্যাডেট কলেজে আমাদেরই সহপাঠী মিজান। SSC এর আগে মিজান জানি কেমন হয়ে গেল। কারো সাথে কথা বলতো না, পড়তো না, পড়তে বসলে কেমন করত, বলতো তার খুব বমী হচ্ছে, মাঝে মাঝে চিল্লা চিল্লি করত। ঝঝঈ পরীক্ষার আগে শারীরিক সমস্যার জন্য কলেজ আউট হওয়ার পর সেভাবে সরাসরি যোগাযোগ ছিলনা। মাঝে মাঝে এর ওর কাছে মিজানের কথা শুনেছিলাম, সেই পর্যন্তই। অনেকখানি খুশি এবং তার চেয়েও অনেক বেশি আশ্চর্য হলাম ওর অবস্থা দেখে। ভাঙ্গাচোরা বিদ্ধস্ত চেহারা, দৃষ্টি বিভ্রান্ত, কথা বলে বুঝলাম ওর চিন্তা ভাবনাও অসংগতি, ও এসেছে এ্যাডজুটেন্ট স্যারের সাথে দেখা করতে, যদিও সে আমাকে চিনতে পারছিলনা। তার ভাষ্য মতে সে একটা কলেজে পড়ায়, যেখানে তাকে মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে বেতন দেওয়ার কথা; কারণ সে পাঁচশো টাকা দিয়ে একটা ফর্ম ফিল আপ করেছে। কিন্তু তাকে বেতন দিচ্ছেনা। তাই সে এখানে এসেছে যদি কলেজ চাপ দিয়ে ওই কলেজ থেকে তার বেতনটা তুলে দেয়।
হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। মানসিক দিক দিয়ে মিজানের কিছু অসংগতির কথা শুনেছিলাম । সামনাসামনি দেখে কি করব ঠিক যেন বুঝে উঠতে পারছিলাম না । মিজান কলেজ থেকে বের হবার পরে মাস খানেক ঘরেই বসে ছিল। পরে বাসা থেকে ঝঝঈ পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আবার তাকে পড়াশোনা করার জন্য টাকা দিলে তার মানসিক অবস্থার অবনতি হয় এবং তার পরবর্তী ঠিকানা হয় পাবনা মানসিক হাসপাতাল। পাবনা মেন্টাল হসপিটালে ছিল বছর খানেক, আমাকে শরীর ভর্তি দাগ দেখাল “দোস্ত, দ্যাখ মেরে কী করছে…….”এর মধ্যে পরিবার ওর বিয়েও দিয়েছে, প্রায় বছর দেড়েকের একটা ছেলে আছে। বুঝলাম, ওর সাথে এই আমার শেষ দেখা নয় । জেনেশুনে এখন আর ওকে আর ওর মত চলে যেতে দেয়া সম্ভব নয়। ফোন নম্বর চাইলাম। ওর কোন ফোন নেই। মা’র নম্বর ওর মনে নেই। শেষে আমার নম্বর একটা কাগজে লিখে ওকে দিলাম । বললাম বাসায় গিয়ে খালাম্মার ফোন থেকে এই নম্বরে একটা কল দিতে। ভেতর থেকে তাগিদ অনুভব করছিলাম ওর মা’র সাথে কথা বলে সত্যিকার অবস্থাটা জানার, তারপর সেই পরিস্থিতিতে একটা ব্যবস্থা নেওয়ার। মিজান ফোন করবে বলে চলে গেল।
চার পাঁচ ঘন্টা হয়ে গেল । মিজানের ফোন তো আর আসে না। শেষমেষ অনেক ঝামেলা করে ওর মা’র নম্বরে যোগাযোগ করলাম। শুনলাম মিজান অনেক আগে বাসায় গিয়ে বসে আছে। ফোন করার কথা সে বিলকুল ভুলে গেছে। যাই হোক, খালাম্মার সাথে কথা বলে অনেক কিছু জানলাম । জানলাম, মিজান কোন কাজ করেনা। যা বলেছে সম্পূর্ণই ওর কল্পনা। ওটাই সে সত্যি বলে বিশ্বাস করে। ওর বাবা বেঁচে নেই । চার বোনের ও এক ভাই। চার জনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। একজনের ডিভোর্স হয়ে গেছে, এখন ওদের সাথেই থাকে । বাকী দুবোনের স্বামীরা মিজানদের যৎসামান্য জমিটুকু বন্দক রেখে টাকা নিয়ে চম্পট দিয়েছে। এখন খোজ খবরও নেয়না, টাকাও ফেরত দেয়না। অনেক বয়স হয়ে গেছে ওর মা’রও, ডিভোর্সি এক মেয়ে, মানসিক ভারসম্যহীন একমাত্র ছেলে, তার স্বল্পশিক্ষিত নিতান্তই কিশোরী স্ত্রী আর একটা দুগ্ধপোষ্য শিশু নিয়ে মিজানের বাবার পেনশনের মাত্র ৩,৭০০ টাকায় কতদূর কী করতে পারেন তা সহজেই অনুমেয়। মনটা বিষাদে ভরে গেল। আমাদেরই সহপাঠী ছিল এই মিজান । চারটা বছর একই সাথে খেলেছি, হেসেছি, পড়েছি, দুষ্টুমি করেছি, শাস্তি খেয়েছি। তারপর এক সময় যে যার জীবনের পথে পা বাড়িয়েছি। যে যেভাবে, যতটুকু পারি এগিয়ে গেছি। কিন্তু মিজান এগোতে পারেনি। নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে ও কেবলই গেছে। আজ আমরা স্ত্রী-সন্তান পরিবার নিয়ে মোটামুটি নিশ্চিত একটা জীবন যাপন করছি, মিজানের চারপাশে তখন কেবলই অন্ধকার। আমরা যখন সাফল্যের পথে পা বাড়িয়েছি, ওর জীবনটা তখন ব্যর্থতার অতলে তলিয়ে যাচ্ছে।
অথচ ওরও মোটামুটি সুস্থ একটা জীবন হতে পারত। সময়মত সঠিক চিকিৎসা পেলে ওর অস্বাভাবিকতা হয়ত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেত না। ও হয়ত মধ্যম মানের পড়াশোনা করে ছোটখাটো একটা কাজ করেও ওর মত জীবনটা গুছিয়ে নিতে পারত । কল্পনা আর বাস্তবের ভিন্নমুখী ঘাত-প্রতিঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেত না।
তীব্র অপরাধবোধে জর্জরিত হলাম । জানি না কেন, নিজের ভাল থাকা, নিজের আরামদায়ক উষ্ণতার পারিবারিক জীবনের কথা ভেবে মিজানের জন্য অদ্ভুত কষ্ট হচ্ছিল। কেবলই মনে হচ্ছিল ওর জন্য কি কিছুই করা যায়না? আমরা সবাই মিলে কি পারি না মিজানের অনিশ্চিত জীবনে সামান্য হলেও নিশ্চয়তা দিতে? যে জীবন কল্পনা আর বিভ্রান্তির অভিঘাতে ব্যর্থ হয়ে গেছে, তার রাশ কিছুটা টেনে ধরতে? মিজান আমাদের সহপাঠী ছিল। আজ ওর অবস্থা যা-ই হোক না কেন, সে একজন ক্যাডেট ছিল- এই পরিচয় সে আমৃত্যু বহন করবে। ঠিক আমাদের মতনই। আর সেজন্যই ওর প্রতি, ওর নিষ্পাপ ছেলেটার প্রতি দায় আমরা অস্বীকার করতে পারিনা। আমাদের অস্তিত্ব আর পরিচয়ের ভীষণ গর্বের একটা যায়গায় আমরা যে এক।
কয়েক দিন পেরিয়ে গেছে। মিজানের কথা অনেক মানুষকে জানিয়েছি। সাড়াও পেয়োছি প্রচুর। মনে বিশ্বাস ছিল, এরকমটাই হবে। ওকে নিয়ে গিয়েছিলাম রাজশাহী, মনোচিকিৎসক দেখাতে। বাসা থেকে ওকে নিয়ে আসার সময় ওর ছেলেটাকে দেখলাম । এত অসম্ভব হাসিখুশি আর ফুটফুটে বাচ্চাটা! দেখে আবার সেই পুরনো মন খারাপটা ফিরে এল। বাচ্চাটার জীবনটাও কি ব্যর্থ হয়ে যাবে? না । এখন আমি জানি, আমরা আছি। আমরা অনেকেই আছি। অন্ততঃ কিছু নিরাপত্তা আমরা ওদের অবশ্যই দিতে পারব।
পুরনো কাগজপত্র দেখে এবং মিজানকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডাক্তার মিশ্র অভিমত দিলেন । ২০০৯ সালের পরে কোন ডাক্তার বা ওষুধপত্রের সংস্পর্শে মিজান আসেনি ওর মূল ওষুধ ছিল একটা ইনজেকশন, মাসিক ভিত্তিতে । সেটাও গত পাঁচ বছরে ও নেয়নি। কিংবা নিতে পারেনি। সে যাই হোক। সুখের কথা এই যে এত অনিয়ম সত্ত্বেও মিজান এখনো খুব হিং¯্র হয়ে ওঠেনি। অথচ ওর অবস্থায় সেটাই হওয়ার কথা। কারণ, ডাক্তারের মতে, মিজান একজন ক্রনিক সিজোফ্রেনিক । পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ওর আর অবশিষ্ট নেই। কিন্তু, আগে কখনও হিং¯্র হয়ে উঠলেও এখন সে মোটামুটি স্বাভাবিক মানুষের মত । সৌভাগ্যক্রমে। নতুন করে ওষুধপত্র ও ইনজেকশন দেয়া হল মাসিক হিসেবে সেগুলো ওকে কিনে দিলাম। এখন থেকে যতদিন আমি এখানে আছি, সানন্দেই দায়িত্বটা পালন করে যাব। মনে এখন অনেক সাহস আমার। সবাই যে আছে মিজানের জন্য কিছু করতে। যে যার সামর্থ্যমত এগিয়ে এসেছে, আরও আসবে। তো যা বলছিলাম ।
ফেরার পথে ওকে বাসায় নামিয়ে দিলাম । ওর মা’র সাথে আলাপ হলো। আমরা ভেবেছিলাম ওর জন্য ছোট খাট দোকান-টোকান করে দিলে সেটা ওরা দেখেশুনে চালাতে পারবে কিনা তেমন আগ্রহ দেখলাম না। স্বাভাবিকই মনে হলো। তেমন শক্ত হাতে ধরে রাখতে না পারলে এসব ভেসে যেতে সময় লাগেনা। এদিকে মিজানের স্ত্রীর বয়স, পড়াশোনা কোনটাই তার ছোটখাট একটা কাজ জুটিয়ে দেওয়ার জন্যও যথেষ্ট নয়। এই বিপর্যস্ত, দিশেহারা পরিবারটির উপর দায়িত্ব না দিয়ে মিজানের আর ওর বাচ্চার ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে হবে। আমাদের সকলের অল্প-অল্প কন্ট্রিবিউশন হয়তো মিজানের পরিবারের জন্য নতুন আশার দরজা খুলে দিবে।
সেদিনের মত চলে এসেছিলাম । এবার আর প্রথম দিনের মত খারাপ লাগেনি। বাইরে এসে পিতা-পুত্রের হাত নেড়ে বিদায় জানানোর দৃশ্য এখনও চোখে ভাসে। মনে পড়ে রংবেরংয়ের চকলেটগুলো পেয়ে বাচ্চাটার হাসিমাখা মুখ । তখন আমি মন দিয়ে বিশ্বাস করি, ওই হাসি যেন দীর্ঘস্থায়ী হয়। সেজন্য আর একটু স্বাচ্ছন্দ্য আর নিরাপত্তার ব্যবস্থা আমরা করতে পারব। কাজ ইতোমধ্যে শুরুও হয়ে গেছে।
আমাদের নিজেদের, পরিচিত স্বজনদের বছরে ধার্য যাকাতটুকু নিয়েই বা আমরা এগিয়ে আসি না কেন? প্রত্যেকটা প্রাপ্তিই ওদের জন্য অমূল্য এই মূহুর্তে। ৩৭০০ টাকায় ওদের মাস চলে, ভাবা যায়? অনেক দেরী হয়ে গেছে, আর একদম সময় নষ্ট করা যাবেনা। আমাদের একসময়ের সহপাঠী বন্ধু মিজানকে এই করুণ, মানবেতর জীবন থেকে বের করে কিছুটা উন্নত জীবন দেয়ার এই প্রচেষ্টা সফল করতে পারব না আমরা সবাই মিলে? নিশ্চয়ই পারব। মিজানের মা বলেছিলেন ও নাকি প্রায়ই কলেজের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে। আমার ভেতরটা নড়ে উঠেছিল শুনে। কে জানে মিজান কি ভাবে। আলো আঁধারি ঘেরা ওর ওই অসুস্থ জগতে এখনও কলেজটাকে ও ভোলেনি। আমরা জানি এখন, যে ও আর কখনোই পুরোপুরি সুস্থ্য হবেনা। তাতে কি? যতদিন আছে, ততদিন যেন সে স্ত্রী সন্তান নিয়ে মোটামুটি ভালো থাকে। এটুকু চেষ্টাতো আমরা করতেই পারি, তাই না ?
সাহায্য করার জন্য যোগাযোগ করুন ঃ
খন্দকার মোবাশ্শির হায়দার
এ্যাডজুটেন্ট
রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ
মোবাইল নং- ০১৭৬৯০১১২৩১
আমাদের মিজান এবং একটি মানবিক আবেদন] ইতোমধ্যে আপনারা অনেকেই আমার ব্যাংক হিসাব নম্বর জানতে চেয়েছেন। আমার ব্যাংক হিসাব নম্বর নিম্নরূপ ঃ
খন্দকার মোবাশ্শির হায়দার
সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর ঃ ৩৪০৪১৭০৮
সোনালী ব্যাংক লিঃ
রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ শাখা
সারদা, রাজশাহী
bKash হিসাব নম্বর : 01716661666
[link|http://www.cadetcollegeblog.com/ovi1696/45502|
©somewhere in net ltd.
১|
২৪ শে জুন, ২০১৪ বিকাল ৪:৩২
সুমাইয়া আলো বলেছেন: সমবেদনা