![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কোন কাম কাজ নাই তাই শুধু মানুষের সমালোচনা করি।
আসমা রনির ভাতের প্লেটে আরো এক চামচ ভাত তুলে দিতে দিতে জনিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–শিমুলের মামা মানে মন্ত্রীর পি এস ঐ ভদ্রলোকের সাথে কবে দেখা করা যাবে?
-আজ রাতে শিমুল সব কিছুর ব্যবস্থা করবে, আমরা খুব তারাতারিই দেখা করতে পারব মা, তুমি এতো টেনশন কর না।
-তারাতারি হলে তো ভালই হয়, আজ কত দিন হয়ে গেলো, কি খাচ্ছে না খাচ্ছে! বলেই ডুকরে কান্না শুরু করে দিল। আসমার কান্না দেখে কিছুটা উত্তেজিত ভাবে জনি রনিকে বলতে লাগলো
-কিরে ছোট! মা এত কান্না করে কেন? তুই একটু বল না কান্না থামাতে! আমরা খেতে বসেছি এখন কান্না করলে খেতে পারব?
-আম্মু তুমি এখন কান্নাকাটি বন্ধ কর, আমি বড় হয়ে আব্বুকে ছাড়িয়ে আনবো।
অনেক দরদ ভরা কণ্ঠে কথা গুলো বলার পর জনির মা আসমা একটু শক্ত হতে চেষ্টা করল।
সাত বছরের শিশু রনি তার মাকে এর থেকে বেশি কিইবা সান্তনা দিতে পারে? বাবার জেলে যাওয়াতে রনির মনে কতটুকুই বা দাগ কেটেছে? কতটুকুই সে বোঝে? অবুঝ এই শিশু হয়ত শুনেছে তার বাবা জেলে, জেল কি জিনিস তা বোঝার মত ক্ষমতা এখনো রনির হইনি।
পরদিন, কাকা ডাকা ভোর। সবেমাত্র সুর্য তার আলোর ডানা মেলতে শুরু করেছে। ঢাকা শহরের বড় অংশ এখনও ঘুমাচ্ছে। জীবিকার তাগিদে কেউ কেউ রাস্তায় বেড়িয়েছে, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই ঘুমিয়ে থাকায় কুসুম কোমল ভোরের আলো সহজেই ঘুমন্ত মানুষকে বঞ্চিত করতে পারছে।
এমন সময়েই হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় আসমার। এত সকালে বাসায় আসার মত কে আছে? এমন সব ভাবতে ভাবতে দরজায় এগিয়ে আসে আসমা। দরজা খুলেই আসমা অবাক!
সাইদ জেলে যাওয়ার পর সাইদের বাড়িতে খবর পাঠানো হয়েছিলে কিন্তু কারো তরফ থেকে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। সাইদের বড় ভাই জাবেদ এসে হাজির হয়েছে এতদিন পরে। সাইদের বাড়ির পক্ষ থেকে কোন প্রকার সাহায্য আসমা আশাও করেনি।
অনেকটা কাজুমাজু ভঙ্গিতে জাবেদ ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করেই সকলের কুশলাদি জিজ্ঞাসা করল। আসমার প্রতিউত্তরেই প্রত্যেকটা শব্দতেই জড়ানো ছিল চাপা ক্ষোভ। ক্ষোভের কারণটা জাবেদ বুঝতে পেরেছিল অথবা ইচ্ছা করেই কিছু বোঝেনি। এরই মধ্যে জনি ঘুম থেকে উঠে এসেছে, মলিন হাসি হেসে জাবেদ কে জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছো কাকু?
-এইতো আছিরে, তোর বাবার খবর পেয়েই আসলাম।
-এতদিন পরে আসলে?
জনি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, জাবেদ ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলতে লাগলো, বাড়িতে আমি একা মানুষ, কত কি আমাকেই দেখতে হয় আর তোর দাদির শরীর বড়ই খারাপ হচ্ছে দিন দিন। তোরা তো শহরে থাকিস বছরে দুইটা ঈদে গ্রামে যাওয়া আসা করিস ব্যাস তোদের দায়িত্ত শেষ।
এই মুহুর্তে আসমার কাছে এসব কথা খুবই বিরক্তকর লাগছিল, ক্ষোভ দমিয়ে রেখে জাবেদকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-ভাইজান এখন এসব কথা বাদ দেন আপনি অনেক দূর থেকে সারারাত জার্নি করে এসেছেন, এখন হাতমুখ ধুয়ে নেন আমি খাবার দিচ্ছি।
কিন্তু জনি চেচিয়ে উঠে জাবেদকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-আমরা শুধু দুই ঈদেই বাড়িতে যাই আর কোন দায়িত্ত পালন করি না! এই কথা তুমি কিভাবে বল কাকু? প্রতি মাসে আব্বু তোমাকে কত টাকা পাঠিয়েছে তোমার হিসেব আছে?
ছেলের মুখে এমন কথা শুনে আসমা চমকে উঠল এবং জাবেদ যেন আকাশ থেকে ধাম করে মাটিতে পড়ে গেল। মনে মনে আসমা খুশি হলেও তা তার চেহারায় প্রকাশ পেল না এবং তার ছেলের এমন আচরণ আসমার নিকট খোদ বেয়াদবিই মনে হল। ধমক দিয়ে জনিকে থামিয়ে দিয়ে বলল
-জনি! অনেক বেয়াদবি শিখে গিয়েছিস, তোর বাবা সামনে থাকলে এইসব কথা বলার সাহস করতে পারতি?
সবাই চুপ হয়ে গেল, জনি উঠে তার ঘরে চলে গেল।
কিছুক্ষন বাদেই চা-রুটি সমেত একটি প্লেট নিয়ে জাভেদের সামনে হাজির হল আসমা।
-ভাইজান খেয়ে নেন, তারপর রেস্ট করেন।
আড়চোখে রুটির প্লেটের দিকে তাকিয়ে একটু যেন থমকে গেলেন জাভেদ। এর আগেও অনেকবার সে এই বাসায় এসেছে, অনেকদিন করে থেকেছেও বটে। কিন্তু এমন খাবার কখনো সে এই বাসায় দেখেনি। এই সংসারে দৈনতা এসে ভর করেছে জাভেদ তা এইমাত্র টের পেল।
স্কুলে যাওয়ার সময় হয়নি অথচ স্কুলের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল জনি। জনির চাচার উপস্থিতি এই বিরক্তির কারন তাই সময়ের আগেই বেরিয়ে আসা। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় জনি তার বাবা সাইদকে ভীষণ ভাবে মিস করে। আগে সাইদ অফিসে যাওয়ার পথে জনিকে স্কুলের সামনে ড্রপ করে যেত, পথিমধ্যে নানান বিষয়ে পিতা-পুত্রের আলাপ হত, রাজনীতি, অর্থনিতী, সামাজিক অবস্থা, সমসাময়িক বিষয়বস্তু সবকিছুই তাদের আলোচনায় উঠে আসতো। সাইদের সাথে জনির সম্পর্কের মাপকাঠি ছিল ঠিক ঘনিষ্ট বন্ধুর মত।
শ্যামলী আসতেই চট করে রাস্তা পাড় হয়ে রিকশা করে মোহাম্মদপুর বাবর রোডের এক বিলাশবহুল ফ্লাটে শিমুলের বাসায় চলে এল জনি। মাত্র গোসল শেষ করে স্কুলের জন্য তৈরি হচ্ছিল শিমুল, জনিকে দেখে একটু অবাক হল বৈকি তারপরও মুচকি হেসে জনিকে বলল
-চল নাস্তা শেষ করে তারপর বের হই।
মুখ গম্ভীর করে জনি উত্তর দিল
-নাস্তা করে এসেছি, তুই তারাতারি শেষ করে চল যাই।
-বেশি কথা বলিস না আম্মুর ঝাড়ি খাওয়ার আগে নাস্তা খেতে চল।
একথা বলেই শিমুল জনির হাত ধরে ডাইনিং টেবিলে নিয়ে গেল। খেতে খেতে শিমুলের মা জনিকে কিছুটা সান্তনা দিতে চেষ্টা করলেন। শিমুলের মা শিরিন আহমেদ, বেজায় ভাল মানুষ। বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ কিন্তু চেহারায় এখনো বয়সের ছাপ লাগেনি। অনেক সতেজ চেহারা, ধনী হলে যা হয় আরকি! ধনাঢ্য লোকের অবয়বে সবসময়ই একটু আলাদা ধরনের উজ্জলতা থাকে। বয়সের ভার অথবা ছাপ কোনটাই সহজে ছুতে পারে না। এই ভদ্রমহিলার প্রতি অন্যরকম শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে জনির। ভদ্রমহিলার ব্যাবহার খুব অমায়িক।
আড়ষ্ট ভাবে খাওয়া শেষ করল জনি। খাওয়া শেষ হতেই শিরিন কে উদ্দেশ্য করে বলল
-আন্টি আমরা খুব তারাতারি আপনার ভাইয়ের সাথে দেখা করতে চাচ্ছি। মা খুব ভেঙ্গে পরেছে।
নরম গলায় শিরিন বলল
-কোন চিন্তা কর না, আমি গতকাল রাতে শিমুলের ছোট মামা মানে সেলিম ভাই এর সাথে টেলিফোনে কথা বলে রেখেছি। তুমি একটু দাড়াও আমি আসছি বলেই শিরিন ড্রইং রুমে গিয়ে টেলিফোনের পাশে রাখা ডায়েরি থেকে একটা পৃষ্ঠা ছিড়ে জনিকে দিল।
জনি কাগজটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগলো, ধানমন্ডি এলাকার একটা ঠিকানা ও একটা ফোন নাম্বার লিখা আছে।
-এখানে যে অ্যাড্রেসটা আছে ওটা আমার ভাইয়ের অফিসের অ্যাড্রেস। তোমাদের কথা বলা আছে তোমরা আগামিকাল বিকেল চারটায় ঐ অফিসে গিয়ে সেলিমের সাথে দেখা করবে। ওখানে গিয়ে আমার কথা বললে কেমন?
জনি মাথা নাড়ল, শিরিন আরো বলল –কি হয় না হয় আমাকে জানিও।
বাসা থেকে বিদায় নিয়ে শিমুল ও জনি স্কুলের গেটে আসতেই শান্তনুর দেখা পেল। শান্তনু এগিয়ে এসে ওদেরকে বলল, দোস্ত ক্লাশ শুরু হতে এখনও আধা ঘন্টা বাকি চল চা খেয়ে আসি। জনির কোন ইচ্ছাই নেই শান্তনুর সাথে চা খেতে যাওয়ার। শান্তনুর চা খেতে যাওয়ার উদ্দেশ্যই হল সিগারেট খাওয়া। শান্তনু ছেলেটা খুবই ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। সাহিত্যের প্রতি অগাধ ভালবাসা রয়েছে শান্তনুর, রবীন্দ্রনাথের বেশির ভাগ বই-ই পড়া আছে ওর। ক্লাশ নাইনে থাকতেও খুব নম্র ভদ্র ছিল ছেলেটা, ক্লাশ টেনে উঠার পর থেকেই কেমন যেন পরিবর্তনের ছোয়া লেগেছে ওর গায়ে। শান্তনুর সাথে এর আগে দুদিন সিগারেট টেনেছে জনি সাথে শিমুলও ছিল। কিন্তু এখন শান্তনুর সাথে যেতে একটুও ভাল লাগছিল না তাই জনি বলল,
-দোস্ত এই গরমে এমনিই ভাল লাগছে না তার ওপরে আবার যদি গরম চা খাই তাহলে অসুস্থ হয়ে যাব।
-দুর বোকা চা খেয়ে কেউ অসুস্থ হয় কখনও শুনেছিস? চল চল, বলেই শান্তনু ওদের কাধের ওপর দিয়ে নিয়ে যেতে চাইল।
শিমুল শান্তনুর হাত কাধের থেকে নামিয়ে ওর সামনে প্রতিবাদের ভঙ্গিতে দাড়িয়ে বলল
-দোস্ত তোর চা খাওয়া দরকার তুই যা চা খেয়ে আয় আমরা এখন যাচ্ছি না।
শিমুলের প্রতিবাদকে গায়ে না মাখিয়ে শান্তুনু বলল
-তোরা ভেবেছিস আমার সাথে গেলেই আমি তোদের সিগারেট খেতে বলব? তোরা কি জানিস? পৃথিবীর ম্যাক্সিমাম বিখ্যাত মানুষ ধূমপান করত! সত্যজিৎ রায়ের একটা পোট্রেট আছলে বুজলি, যেটাতে বিশাল এক চুরুট মুখে পুরে রেখেছেন সত্যজিৎ বাবু।
অনেকটা বিরক্ত হয়ে জনি শান্তনুর পিঠে হাত চাপড়ে বলল
-দোস্ত, অযথা ভুল বুঝিস কেন? তোকে বলিনি তোর সাথে গেলেই তুই সিগারেট খেতে বলিস, এখন ভাল লাগছে না তাই যাচ্ছি না, ব্যাস। কোন মনিষী কি করল না করল তা শুনতে চাচ্ছি না।
-ঠিক আছে আমি একাই যাব। কিন্তু দোস্ত এই কথা তো স্বীকার করিস যে যারাই বিখ্যাত মানুষ তারাই কিন্তু ধূমপান করে। নিরেট দভ্রলোক জীবনে কিছুই করতে পারে না।
-তুই কি এই জন্যই ধূমপান করিস? বলেই তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল শিমুল।
একদিন বিখ্যাত তো হয়েও যেতেপারি
১ম পর্ব
©somewhere in net ltd.