নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জয়দীপ চক্রবর্তী : পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। নেশায় লেখক। আকাশবানী কোলকাতায় সম্প্রচারিত হয়েছে তার লেখা নাটক। পেশাদারী থিয়েটার “অবেক্ষন” তার লেখা নাটককে বেছে নিয়েছে তাদের প্রযোজনা হিসেবে। তার কাহিনী চিত্রনেট্যে তৈরী সর্ট ফ্লিম, প্রচারিত হয়েছে ইউটিউব চ্যা

জয়দীপ চক্রবর্তী

জয়দীপ চক্রবর্তী › বিস্তারিত পোস্টঃ

ময়ূরাক্ষীর মৃত্যু রহস্য

২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ৯:৪৫


(১)
রবিবারের শীতের সকাল। স্বাভাবিক ভাবেই অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ একটু দেরীতেই ঘুম ভাঙল সরোজের। গতকাল রাতে একটা পার্টিতে গিয়েছিল ও। ওখানে তিন-চার পেগ মদ্যপান করে থাকায় বাড়ি এসে অচেতনের মত ঘুমিয়েছে ও। ঘুম ভেঙে পাশে ময়ূরাক্ষীকে শুয়ে থাকতে দেখে একটু অবাক হল সরোজে। সাধারণত ভোরে ওঠার অভ্যাস ময়ূরাক্ষীর। আর শুয়ে থাকার ভঙ্গীটাও স্বাভাবিক নয়। ওর গায়ের বালাপোশ সরিয়ে ওকে ডাকার জন্য গায়ে হাত দিতেই কেমন যেন মনে হল সরোজের। তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে দাদা মনোজকে ডাকতে নিচে নামল ও।
মনোজ হোমিওপ্যাথি ও আয়ুর্বেদীয় ডাক্তার। দোতলা বাড়ির একতলার একদিকটা ওর চেম্বার ও ওষুধ রাখা ও তৈরি করার জায়গা। আরেক দিকে ওদের বেডরুম। আর তার পাশে বাথরুম ও রান্নাঘর। দোতলায় তিনটি বেডরুম। একটিতে মনোজদের বাবা-মা, একটিতে সরোজ থাকে, এবং আরেকটি সরোজের দিদি, মনোজের বোন তনুজার ছিল। সেটা এখন ফাঁকাই থাকে। তনুজা এলে ঐ ঘরে থাকে। তবে গতকাল সকালেই তনুজা তার দশ বছরের মেয়ে অনুষ্কাকে নিয়ে ওর বাপের বাড়ি এসেছে। তাই বাড়ি এখন জম-জমাট।
মনোজ ভাল করে ময়ূরাক্ষীকে পরীক্ষা করে দেখল। না ও আর বেঁচে নেই। প্রাথমিক ভাবে হার্ট-ফেলই মনে হচ্ছে মনোজের। কিন্তু হঠাৎ করে এই হার্ট-ফেলের কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছে না ও। মৃত্যুটা বেশ অস্বাভাবিক বলেই মনে হচ্ছে ওর।
মনোজদের বাবা অবিনাশ মজুমদার খানিকক্ষণ আগে মর্নিং ওয়াক থেকে ফিরে নিজের ঘরে এসে, ট্র্যাক-স্যুট জ্যাকেট ছেড়ে পাজামা পাঞ্জাবী পরেছেন। আর গায়ে একটা চাদর জড়িয়েছেন। মনোজকে সরোজ ওপরে ডেকে আনায়, উনিও সরোজের ঘরে ঢুকে ওদের বিছানার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। মনোজ তখনো ময়ূরাক্ষীকে নানারকম ভাবে দেখে মৃত্যুর কারণ বোঝার চেষ্টা করছে।
- কিরে মনোজ, ময়ূরাক্ষীর কি হয়েছে?
এক্সপায়ার করে গেছে। তুমি দাঁড়াও। আমি ডঃ বিশ্বাসকে একটা ফোন করি। ওনার একটা ওপিনিয়ন নেওয়ার দরকার। কাউকে কোনও কিছু ধরতে বা বডিতে হাত দিতে দেবে না। আনন্যাচারাল ডেথ। পুলিশ কেস হতে পারে। কথাটা বলে মনোজ নিচে নেমে গেল।
সরোজ পাশের বাথরুমে ঢুকে চোখে-মুখে জল দিচ্ছে। খাটের সামনে, ড্রেসিং টেবিলের পাশে স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে আছেন অবিনাশ। বাড়ির মেয়েদের মধ্যে মনোজের বোন তনুজা এখনো বিছানা ছাড়েনি, মনোজের মা কাকলী রান্নাঘরে, আর মনোজের বউ সংযুক্তা একতলার টয়লেটে। সরোজ দোতলার টয়লেট থেকে বেড়িয়ে বাবার পাশে এসে দাঁড়াল।
- এ কি হয়ে গেল বাবা?
- সেটাই তো আমার প্রশ্ন। তুই রাতে কিছু টের পাসনি?
- না, কাল আমি যখন শুই তখন ও বাথরুমে। জানই তো ওর শোয়ার আগে অনেক রকম পর্ব থাকে। আমি কাল বেশ টায়ার্ড ছিলাম। টিউবের সুইচ অফ করে, নাইট ল্যাম্প জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। ও কখন বিছানায় এসেছে, টের পাইনি।
- কিন্তু দরজা ভেতর থেকে লক করা ছিল। বাইরের কেউ এসে কোনও কিছু করবে, সেরকম সম্ভাবনাও নেই। মনোজ, ডঃ বিশ্বাসকে ফোন করতে গেছে। তুই এখানে থাক। দেখিস কেউ এসে কোনও কিছুতে যেন হাত না দেয়। আমি আমার ঘরে গিয়ে, ময়ূরাক্ষীর বাড়িতে ফোন করি।
খবরটা সারা বাড়ি ছড়িয়ে পড়েছে। সবাই এসে ময়ূরাক্ষীর ঘরে ভিড় করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডঃ বিশ্বাস চলে এলেন। উনিও নানারকম ভাবে দেখে হার্ট ফেলিওরই বললেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই পাড়া-প্রতিবেশীরা এসে ভিড় করেছে। ময়ূরাক্ষীর বাবা, মা ও বোন খবর পাওয়া মাত্রই ছুটে এসেছে। একপ্রস্থ কান্নাকাটি, বাক-বিতন্ডা, একে অপরকে দোষারোপ ও নানারকম কথাবার্তা চলার পর ময়ূরাক্ষীর বাবা অম্লান সেন থানায় ডায়রি করতে গেলেন। থানার ও.সি প্রসেনজিৎ মণ্ডল ওনার পরিচিত। উনি ও.সিকে কেসটা একটু বিশেষ ভাবে দেখার অনুরোধ করলেন। আর বললেন, দরকার পড়লে প্রাইভেট ডিটেকটিভ নিয়োগ করতেও তার কোনও অসুবিধে নেই। প্রসেনজিত বাবু দুজন পুলিশ অফিসার সঙ্গে নিয়ে ময়ূরাক্ষীর বাড়ি গেলেন। সেখানে গিয়ে সব দেখে এক্স সি.বি.আই অফিসার অন্বেষণ করকে ফোন করলেন উনি।
সকালে উঠে প্রতিদিনের নিয়মিত কাজগুলো সেরে খবরের কাগজে চোখ রেখেছেন অন্বেষণ। এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠল।
- আরে প্রসেনজিত, সকাল সকাল আমাকে ফোন? সব ঠিক আছে তো?
- সব ঠিক থাকলে কি আর এই অসময়ে আপনার শরণাপন্ন হই? আমার এক বিশেষ পরিচিত বন্ধু কাম দাদা, অম্লান সেনের মেয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। ডাক্তার হার্ট ফেলিওর বলছেন। এতো অল্প বয়সী একটা মেয়ের হঠাৎ হার্ট ফেলিওর একটু অস্বাভাবিকই লাগছে। আমরাও কেউ ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছি না। অম্লান দা বলছেন, নিশ্চয়ই এর পিছনে কারো হাত বা ষড়যন্ত্র আছে। উনি প্রাইভেটলি ঘটনটার ইনভেস্টিগেশান করাতে চান। তাই আপনাকে ফোন করলাম। আপনি একবার এখানে আসতে পারবেন?
- আমি তেমন প্রাইভেট প্র্যাকটিস এখন আর করি না। বয়স হয়েছে তো। এখন আর অত ছোটাছুটি, পরিশ্রমের ধকল নিতে পারি না। গগনকে পাঠাচ্ছি। ও এখন ভালই কাজ-কর্ম করছে। রিসেন্টলি দুটো কেস বেশ দক্ষতার সাথে সল্ভ করেছে। তারপর কোনও পরামর্শ দরকার হলে আমি তো আছিই।
- ঠিক আছে। আমি আপনাকে অ্যাড্রেসটা টেক্সট করছি। আপনি ওনাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাঠান। উনি না আসা পর্যন্ত আমরা বডিতে হাত দিচ্ছি না।
(২)
অন্বেষণের ফোন পেয়েই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গগন ওর ভাইঝি তীর্থাকে নিয়ে অবিনাশ মজুমদারের বাড়ি পৌঁছল। ওখানে পৌঁছে নিজের পরিচয় দিতেই প্রসেনজিত মণ্ডল ও অম্লান সেন ওদের ঘিরে ধরল। প্রসেনজিত বলল, অন্বেষণ দা পাঠিয়েছে তো? ওনাকে আমি ফোন করেছিলাম। উনি অম্লান সেন, ময়ূরাক্ষী ওনারই মেয়ে। উনি এই কেসটা প্রাইভেট ইনভেস্টিগেশান করাতে চান। প্রসেনজিতের কথার রেশ টানলেন অম্লান বাবু।
- আপনি ভালো ভাবে তদন্ত করে, এই মৃত্যুর আসল কারণ বের করুন। খরচের জন্য ভাববেন না। যত টাকা লাগে আমি দেব। আমি দোষীর শাস্তি চাই। আমার মেয়ের হঠাৎ এইভাবে মৃত্যু হতেই পারে না। নিশ্চয়ই এর পিছনে কারো হাত আছে। ময়ূরাক্ষী ও সরোজের বিয়েটা যে হোক, তা এ বাড়ির অনেকেই চায়নি। নেহাৎ অবিনাশ বাবুর পছন্দ হয়েছিল, আর সরোজেরও এই বিয়েতে কোনও আপত্তি ছিল না, তাই বিয়েটা হয়েছিল। বাড়ির সবাই মিলে তো মেয়েটাকে কোণঠাসা করে রেখেছিল। প্রায়ই আমার ওখানে গিয়ে কান্না-কাটি করতো। আমাকে বিশেষ কিছু বলত না। তবু সবই আমি টের পেতাম। সরোজটাও শুনেছি যা নয়, তা বলত। একা অবিনাশ বাবু আর কত আগলে রাখবেন ওকে।
- আমার যথাসাধ্য আমি চেষ্টা করব। আশাকরি সত্যটা বেড়িয়ে আসবে। এখন এদিকটা একটু সামলে নি। দু-একদিনের মধ্যে আপনাদের ওখানে গিয়ে আরও ডিটেলে সব শুনবো।
- হ্যাঁ, ওর মা আর আমার ছোটো মেয়ে আরও ভালোভাবে সব বলতে পারবে। আর ঐদিন আমি আপনার অ্যাডভানস্ চেকটাও দিয়ে দেব।
সে হবে ক্ষণ। অম্লান বাবুর সাথে কথা বলে গগন ও তীর্থা ময়ূরাক্ষীর ঘরে ঢুকল। দুজনেই দুহাতে গ্লাভস পরে নিয়েছে। দরজা দিয়ে ঢুকলেই ডানদিকে স্টিলের আলমারি, আর বাঁদিকের দেওয়াল ঘেঁষে ড্রেসিং টেবিল। তার পাশে একটা ওয়ারড্রোব। দরজার সরাসরি ৬/৭-এর একটি খাট। তাতেই শুয়ে আছে ময়ূরাক্ষী।
তীর্থা, ভালো করে বডি আর চারপাশটার কটা ছবি তুলে নে তো। ভাইঝিকে ইন্সট্রাকশন দিয়ে, প্রথমে ময়ূরাক্ষীকে, তারপর সারা ঘর খুঁটিয়ে দেখল গগন। ময়ূরাক্ষীর বালিশের পাশে ওর মোবাইল রাখা ছিল। সেটাকে পকেটস্থ করে, ওয়ারড্রোব খুলে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো ও। বেশীরভাগ জামাকাপড়ই দলা পাকানো ও অগোছালো করে রাখা। আর তার অধিকাংশই ময়ূরাক্ষীর। সরোজের জামা-প্যান্ট এখানে নেই বললেই চলে। ওয়ারড্রোব বন্ধ করে, ড্রেসিং টেবিলে চোখ রাখল গগন। ড্রেসিং টেবিলের মধ্যে একটি তাক জুড়ে শুধু ওষুধ। হোমিওপ্যাথি ও অ্যালোপ্যাথির যুগল বন্দি। আর অপর দুটি তাকে রয়েছে নানা রকম কসমেটিক্স। সবকিছু ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে ময়ূরাক্ষীর ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখল গগনরা। মনোজের ল্যাবরেটরি, যেখানে মনোজ ওষুধ তৈরি ও স্টোর করে, সেখানেই একটু বেশি সময় দিল ওরা। দুটো বড় বড় আলমারিতে কাঁচের শিশি,বোতলে সারি সারি দিয়ে ওষুধ সাজানো রয়েছে। তার পাশে বড় বড় কাঁচের জারে রয়েছে বিভিন্ন কেমিক্যাল। কিছু গাছ-পালার শিকর, বাকরও রয়েছে টেবিলের ওপর। কিছু আবার আসে-পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। গগন এই ওষুধ নিয়েই নানারকম প্রশ্ন করল মনোজকে। তীর্থা, মনোজের অলক্ষ্যে মোবাইলে তার সব কথা রেকর্ড করতে লাগল।
- আপনি তো প্রথম ময়ূরাক্ষীকে পরীক্ষা করেন। কিভাবে ও মারা গেছে বলে আপনার ধারনা?
- পরিষ্কার ভাবে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তবে সাংঘাতিক কোনও বিষ প্রয়োগের ফলে এই মৃত্যু হয়েছে বলেই আমার ধারনা। কিন্তু ওদের রুমের দরজা তো বন্ধ ছিল। বাইরে থেকে কেউ এসে কিছু করবে, তাও সম্ভব নয়। আর সরোজ কাল সম্পূর্ণ মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফিরেছে। ঐ অবস্থায় ওর পক্ষেও ময়ূরাক্ষীর কোনও ক্ষতি করা সম্ভব নয়।
- আপনার ভাই আর ভাই-বউয়ের সম্পর্ক কেমন ছিল?
- খুব একটা ভাল ছিল না। ঝগড়াঝাঁটি প্রায়ই লেগে থাকত। আর ইদানীং যে ব্যাপারটা নিয়ে ওদের মধ্যে ঝগড়া লেগে থাকত, সেটা একটা খুব সেনসিটিভ ইস্যু।
- কি রকম শুনি।
- ময়ূরাক্ষী মাস দুয়েকের প্রেগন্যান্ট ছিল। আর সরোজের বক্তব্য, সেই বাচ্চার বাবা নাকি সে নয়। বেশ কয়েক মাস যাবদ ওদের মধ্যে নাকি কোনও শারীরিক সম্পর্ক ছিলই না। আর এই নিয়ে ওদের মধ্যে যত অশান্তি।
- তা ময়ূরাক্ষীর স্বভাব চরিত্র কেমন ছিল?
- স্বভাব চরিত্র বলতে, খুব যে ধোয়া তুলসী পাতা ছিল ও, তা নয়। তবে ওর সাথে অন্য কারো শারীরিক সম্পর্ক ছিল কিনা, সে আমি বলতে পারব না।
- আচ্ছা, ময়ূরাক্ষীর ঘরে অনেক রকম ওষুধ দেখলাম। সবগুলোই কি আপনার প্রেসক্রিপশন?
- হোমিওপ্যাথি ওষুধ গুলো আমারই দেওয়া। তবে এখন ওর প্রেগনেন্সির জন্য গাইনোকলোজিস্টের অ্যাডভাইস অনুসারে কিছু আলোপ্যাথি ওষুধ খাচ্ছে ও।
- আমার সাথে একটু ময়ূরাক্ষীর ঘরে যাবেন? ওষুধ গুলোর কোনটা কি জন্য খায় যদি বলেন!
- চলুন। তবে ট্যাবলেট, ক্যাপস্যুলগুলোর গুনাগুণ কতটা বলতে পারব জানিনা। তবে হোমিওপ্যাথি ওষুধ সম্পর্কে যা জানতে চান বলতে পারি।
কথা বলতে বলতে ওরা ময়ূরাক্ষীর ঘরে চলে এলো। আর্নিকা ৩০, অ্যাগনাস কাস্ট ৩০, অ্যাকোনাইটাইনের শিশি গুলো পর পর রাখা রয়েছে ড্রেসিং টেবিলের একটা তাকে। বেশীর ভাগ ওষুধই গগনের চেনা। আচ্ছা, এটা কিসের জন্য খায়? অ্যাগনাস কাস্ট ৩০-এর শিশিটি দেখিয়ে গগনের প্রশ্ন।
এটা মেয়েদের ব্রেস্ট ডেভেলপের জন্য ব্যাবহার করা হয়। ও একটু ফিগার কনসাস ছিল। আর ব্রেস্ট গুলো তেমন ডেভেলপ ছিল না। তাই আমাকে ওর এই প্রবলেমের কথা বললে আমি ওকে এটা টানা পনেরো দিন, দিনে তিন বার, দু ফোঁটা করে খেতে বলেছিলাম। কথা বলতে বলতে অ্যাকোনাইটাইনের শিশির দিকে চোখ গেল মনোজের। আরে এটা তো দু দিন আগে ওকে ভর্তি এক শিশি দিলাম। এর মধ্যে এত বড় একটা শিশি প্রায় খালি হল কি করে?
- আচ্ছা, এটা যদি কেউ এক বারে পুরো শিশি খেয়ে নেয়, তার কি কিছু ক্ষতি হবে?
- ক্ষতি মানে! মারাত্মক ক্ষতি হবে। একদম কনসেনট্রেট অবস্থায় রয়েছে এটা। জলের সাথে মিশিয়ে ডায়ালুট ফর্মে খেতে হয়। তাও দু ফোঁটার বেশী নয়। এরকম কনসেনট্রেট অবস্থায়, মাত্রাতিরিক্ত খেলে মৃত্যু অবধারিত। আমি কাউকে ওষুধ দেওয়ার সময় তার ডোজ সম্পর্কে সতর্ক করে দি। তবে কি ময়ূরাক্ষী এটা খেয়েই সুইসাইড করল?
- সে তো সময় বলবে। এখন অন্যান্য সবার সাথে কথা বলি। আর রিপোর্ট গুলো সব আসুক। তারপর প্রয়োজন বুঝে আবার আরেক দিন নয় আপনার সাথে বসে যাব। আপাতত আপনারা কেউই এলাকা ছেড়ে কোথাও যাবেন না। আর আমার একটা কার্ড রাখুন। এর মধ্যে আপনার চোখে যদি সন্দেহ জনক কিছু পড়ে, অবশ্যই আমাকে জানাবেন।
- নিশ্চয়ই। আমি সব রকম ভাবে আপনাকে সহযোগিতা করব। আর আপনি যতবার খুশি আমার সাথে বসুন, যত খুশি প্রশ্ন করুন, আমার কোনও আপত্তি নেই। তবে আপনি যদি আমাকে দোষী ভাবেন, তবে ভুল করবেন।
- দেখুন, ভুল কি ঠিক, সে তো সময় বলবে। তবে প্রাথমিক অবস্থায় কেউই সন্দেহের বাইরে নয়।
মনোজের সাথে কথা বলে সরোজের কাছে গেল গগন ও তীর্থা।
- আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।
- এখুনি? একটু পরে করলে হয় না? মেন্টালি ভীষণ আপসেট আছি।
- না, বেশী কিছু জানার নেই আমার। শুধু কাল রাতে কি ঘটেছিল, সেটা যদি বলেন।
- কাল আমি একটা পার্টিতে গিয়েছিলাম। ড্রিঙ্ক করে এসেছিলাম। বাড়ি ফিরে মরার মত ঘুমিয়েছি। আর আমি যখন শুই তখন ময়ূরাক্ষী বাথরুমে। প্রতিদিন শোয়ার আগে ও ভালো করে গা হাত-পা ধোয়। তারপর চলে ওর রূপচর্চা। আমি কাল টিউব নিভিয়ে, নাইট ল্যাম্প জ্বালিয়ে শুয়েছি, আর ঘুমিয়ে পড়েছি। ও কখন বিছানায় এসেছে টের পাইনি।
- আপনি যখন শুয়েছিলেন, তখন কটা বাজে?
- একদম সঠিক ভাবে বলা মুশকিল। এই সাড়ে এগারোটা বারোটা হবে।
- আচ্ছা, আপনাদের মধ্যে কি কোনও মনোমালিন্য, বিবাদ কিছু চলছিল?
- একদমই না। আমাদের একটি সন্তান আসছিল, আর সেই নিয়ে আমরা বেশ আনন্দেই ছিলাম।
- ঠিক আছে, আজ এইটুকুই থাক। পরে ডিটেলে কথা হবে। তবে আপাতত আপনারা কেউই এলাকা ছেড়ে কোথাও যাবেন না।
সরোজের সাথে কথা বলে গগন চোখ বন্ধ করে, গভীর ভাবে কি যেন একটা ভাবছে। ঠিক এমন সময় একটি মহিলা কণ্ঠস্বর ওর ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটাল। গগন চোখ খুলে দেখল, ২৫-২৬ বছরের একটি মেয়ে। বেশ কান্নাকাটির ফলে চোখ লাল। গালে চোখের জলের দাগ আছে।
- আমি মীনাক্ষী, ময়ূরাক্ষীর বোন। আপনাকে আমার অনেক কিছু বলার আছে। কিন্তু এখানে সেসব বলা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না।
- এখন কিছু বলার দরকার নেই। তোমার বাবার সাথে আমার কথা হয়েছে। দু-একদিনের মধ্যেই আমি তোমাদের বাড়ি যাবো। তখন ডিটেলে সব শুনবো। তুমি বরং সব গুলো পয়েন্ট সংক্ষেপে নোট ডাউন করে রেখ। সব সময় সব কথা তো মনে পড়ে না। আর তোমার ফোন নম্বরটা তুমি তীর্থাকে দিয়ে রাখো। আমি তোমাদের ওখানে যাওয়ার আগে তোমাকে জানিয়ে দেব, আর বাড়ির ডাইরেকশনটা নিয়ে নেব।
মীনাক্ষী, গগনের কথার সম্মতি জানিয়ে, তীর্থার সাথে মোবাইল নম্বর বিনিময় করে নিলো।
গগন প্রসেনজিত মণ্ডলকে বডি ও ময়ূরাক্ষীর ব্যবহৃত যাবতীয় কসমেটিক্স, ড্রেস, ওষুধ, জলের বোতল, জলের গ্লাস, সব কিছু ফরেনসিকে পাঠাতে বলল। আর ময়ূরাক্ষীর দেহ ফরেনসিকের জন্য বের করা হল। কয়েকজন পুলিশ ও কনস্টেবল মিলে শব-বাহী গাড়িতে বডি তুলল। ময়ূরাক্ষীর ব্যবহৃত ওষুধ, প্রসাধনী, জলের গ্লাস, জলের বোতল প্রভৃতি প্রসেনজিত হাতে গ্লাভস পরে, বেশ সাবধানে একটি ব্যাগে ঢোকাল। আর ব্যাগটা নিজের কাছেই রাখল।
ময়ূরাক্ষীর দেহ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলে, গগন ও তীর্থা অবিনাশ মজুমদারের ঘরে ঢুকল। প্রথম কয়েক মুহূর্ত কোনও কথা না বলে, সারা ঘরটা দুজনে মিলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। দরজা দিয়ে ঢুকলেই চোখে পড়ে একটা সোফা, আর তার পাশে আলমারি। আলমারিটি যে দুটো দেওয়ালের সংযোগ স্থলে রয়েছে, তার বিপরীত দিকে রয়েছে একটি খাট। খাটের পাশে একটা টেবিল, যাতে একটি টেলিফোন, আর টুকিটাকি কিছু জিনিষ ও ওষুধ-পত্র রয়েছে। কাঁচের পাল্লা দেওয়া দেওয়াল আলমারিও রয়েছে ঘরের একপাশে। কাকলী অনেকক্ষণ গগনদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওদের বসতে বললেন। গগন ও তীর্থা সোফায় বসল। অবিনাশ বাবু খাটের ওপর বসে, রুমাল দিয়ে চশমাটা মুছতে, মুছতে বললেন,
- ময়ূরাক্ষীকে নিজের মেয়ের মতই দেখতাম। মূলত আমার পছন্দতেই ও এই বাড়ির বৌ হয়ে এসেছিল। তাই আমার থেকে ও একটু প্রশ্রয়ই পেত। বাড়ির সবাই ওর দোষ দেখলেও, আমি ওর মধ্যে কোনও দোষই দেখতাম না। ওর মৃত্যুটা আমি কোনভাবেই মেনে নিতে পারছি না।
- ময়ূরাক্ষীকে আপনার পছন্দ হয় কিভাবে?
- ময়ূরাক্ষীকে আমি প্রথম দেখি আমার এক বন্ধু সৌগতর মেয়ের বিয়েতে। সৌগত আর আমি একই কলেজের অধ্যপক ছিলাম। ওর সাবজেক্ট ফিজিক্স, আর আমার বোটানি। ময়ূরাক্ষী ছিল সৌগতর মেয়ের বন্ধু।
- আচ্ছা, হঠাৎ এরকম একটা মৃত্যু, কি মনে হয় আপনার?
- দ্যাখো, ঘর ভেতর থেকে লক করা ছিল। বাইরে থেকে কারো পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। তাই প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে, হয় ময়ূরাক্ষী আত্মহত্যা করেছে, অথবা সরোজ ওকে মার্ডার করেছে। তবে সরোজ কাল যে অবস্থায় বাড়ি ফিরে ছিল, তাতে মনে হয় না ওর পক্ষে কিছু করা সম্ভব হবে।
- আচ্ছা, ময়ূরাক্ষী যদি মাঝরাতে বাথরুমে গিয়ে থাকে, আর সে সুযোগে যদি বাইরের কেউ ওকে কিছু করে থাকে ...
- সেটা হতে পারে। তবে আমি তো ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাই। তাই কোনও কিছুই টের পাইনি।
- বৌদি, আপনি কিছু টের পেয়েছেন?
- না, তেমন তো কিছু টের পাইনি। মাঝরাতে ওরা কেউ বাথরুমে গিয়েছিল বলে মনে হয় না।
- গেলেও ওর পক্ষে কিছু টের পাওয়া সম্ভব নয়। এমনিতেই ও কানে একটু কমই শোনে। তার ওপর আমাদের ঘরের দরজাও তো বন্ধ থাকে।
অবিনাশের কথা শুনে গগন তার কপালে ভাঁজ ফেলে, কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, আচ্ছা বৌদি, কাল সারাদিন ময়ূরাক্ষী কি বাড়িতেই ছিল?
না, খাওয়া, দাওয়ার পর সেজে-গুজে কোথায় যেন বেড়িয়েছিল ও। যাওয়ার আগে একবার আমাদের ঘরেও এসেছিল। কিন্তু কেন এসেছিল ঠিক মনে পড়ছে না।
কেন আবার, ও বাড়ি থেকে বেরোবে, তার পারমিশন নিতে এসেছিল। কাকলীর অসম্পূর্ণ উত্তর সম্পূর্ণ করল অবিনাশ।
পারমিশন নিতে এসে ছিল না ছাই। খুব জোর ও যে বেরোবে, সেটা জানাতে এসেছিল। নিজের যখন যা মনে হত, তাই করত। যখন তখন যেখানে খুশি চলে যেত। কোনও কোনও সময় তো কিছু জানানোর প্রয়োজনও মনে করত না। একটু রাগের সঙ্গেই কথাগুলো বললেন কাকলী।
আহা, ওরকম বলছ কেন? আমাকে কিন্তু প্রায় সময়ই জানিয়ে যেত ও। আবার ময়ূরাক্ষীর দোষ ঢাকার চেষ্টা করল অবিনাশ।
কেউ কি কাল ওর সাথে দেখা করতে এসেছিল? কাকলী র দিকে তাকিয়েই প্রশ্নটা করল গগন।
সে তো প্রায় রোজই কেউ না কেউ ওর কাছে আসে, আর দরজা বন্ধ করে গল্প গুজব, হাসি-ঠাট্টা চলতেই থাকে। কথায় কথায় দরজা বন্ধ করার কি আছে, জানিনা বাপু। কাল সকালেও তো কার সাথে যেন বেশ আড্ডা মারছিল। কে এসেছিল কাল সকালে যেন? আমাদের বেশ পরিচিত লোকই। না নামটা এখন মনে পড়ছে না।
এটাই আমার স্ত্রীর সমস্যা। বড্ড ভুলো মন। থেকে থেকেই সব ভুলে যায়, আর কথা বলতে বলতে খেই হারিয়ে ফেলে।
ঠিক আছে, আমি আমার ফোন নম্বর রেখে যাচ্ছি। আপনার যখনি নামটা মনে পড়বে, বা অন্য কিছুও যদি মনে পড়ে, আমাকে তক্ষুনি ফোন করে জানাবেন। আপনাদের আমার আর কোনও প্রশ্ন করার নেই। তবে এলাকা ছেড়ে আপাতত কোথাও যাবেন না।
গগন ওর পার্স থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড অবিনাশ বাবুর হাতে ধরিয়ে ওনাদের ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে তনুজার ঘরে ঢুকল। তনুজা জামা-কাপড় গোছাচ্ছিল। গগনদের দেখা মাত্র, “আসুন, আসুন” বলে খাটের এক পাশটা ফাঁকা করে দিল ও। গগন এক নজরে ঘরটা একবার দেখে নিয়ে, ওর প্রশ্ন শুরু করল। আর তীর্থাও মোবাইলে রেকর্ডার অন করে সবার অলক্ষ্যে, সব কথা রেকর্ডিং করতে লাগল।
- আপনি কবে এসেছেন?
- কাল সকালে।
- একা?
- না, আমার হাজব্যান্ড দিয়ে গেছে।
- আপনার হাজব্যান্ড কি করেন?
- ও প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার। একটি অ্যাড এজেন্সির সাথে যুক্ত আছে। আবার ফ্রিলান্স ফটোগ্রাফিও করে।
- ময়ূরাক্ষী সম্পর্কে যদি কিছু বলেন।
- কি আর বলব? ওর তো চরিত্রের কোনও ঠিক ঠিকানা নেই। পুরুষ মানুষ দেখলেই হল। আমার হাজব্যান্ডকে দেখলে তো সারাক্ষণ জোকের মত সেটে থাকতো। “পলাশ দা, আমার কয়েকটা ছবি তুলে দাও, আমার একটা পোর্ট ফোলিও বানিয়ে দাও।” ভীষণ গায়ে পড়া স্বভাব। ওকে যখন আমরা দেখতে গিয়েছিলাম, তখনই আমার আর মায়ের খুব একটা সুবিধের মনে হয়নি। চাল-চলন, আদব কায়দা, জামা-কাপড় পরা, কোনও কিছুই ঠিক- ঠাক নয়। বাবার জোরাজুরিতেই বিয়েটা হয়েছে। আর এ বাড়ি এসে বাবার আশকারাতেই ও আরও বার বেড়ে ছিল।
- আপনার পাশের রুমটাই তো ময়ূরাক্ষীর। রাতে কোনও শব্দ পেয়েছেন?
- না, তেমন কিছু টের পাইনি। আর আমি ঘুমোলে সাধারনত কিছু টেরও পাই না।
- হুম, বুঝলাম। আচ্ছা, এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল, পলাশ বাবু এলেন না?
- ওকে আমি সকালেই সব জানিয়েছি। একটা ফটো স্যুটে রয়েছে। কাজটা শেষ করেই এখানে চলে আসবে।
- ঠিক আছে, আমরা এখানে থাকতে থাকতে চলে এলে তো ভালো। নইলে আমাকে অবশ্যই একটা ফোন করতে বলবেন।
গগন ওর একটা ভিজিটিং কার্ড তনুজার হাতে ধরিয়ে, নিচে নেমে এসে মনোজের বেডরুমে ঢুকল। সংযুক্তা ওদের দেখে দুটো চেয়ার টেনে বসতে দিয়ে বলল,
- আপনারাই তো এই কেসটার ইনভেসটিগেশন করছেন?
- হ্যাঁ, আপনার হাজবেন্ডের সাথে কথা হয়েছে। ভাবলাম আপনার সাথেও দু-চারটে কথা বলে যাই।
- নিশ্চয়ই। বলুন কি জানতে চান?
- ময়ূরাক্ষীর এরকম একটা মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে গেল, এই সম্পর্কে যদি কিছু বলেন।
- দেখুন মৃত্যুটা মর্মান্তিক হলেও, আমি বলব এতে আমাদের পরিবারের ভালোই হয়েছে। এই একটা মেয়ের জন্য আমাদের পরিবারে সবসময় অশান্তি লেগেই থাকত।
- কিরকম? একটু ডিটেলে বলবেন?
- সে তো অনেক কথা। তার আগে একটু চা হয়ে যাক? সকাল থেকে তো আপনাদের কম ধকল যাচ্ছে না। চা খেলে এনার্জি পাবেন।
চারপাশটা একটু দেখে নিয়ে গগন বলল, তা হলে মন্দ হত না।
- আপনারা একটু বসুন। আমি এখুনি চা নিয়ে আসছি। সংযুক্তা ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলে গগনের চোখ খাটের একপাশে বসে মনোজ-সংযুক্তার নয় বছরের ছেলের দিকে গেল। সে তখন মায়ের মোবাইল নিয়ে একমনে গেম খেলছে। গগন এবার তাকে ডেকে প্রশ্ন শুরু করল।
তোমার নাম কি?
উৎকর্ষ। মোবাইলে চোখ রেখেই সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল ও।
তোমার কাকীমা, তোমার বাবার কাছে খুব আসতো, না?
কে কাকীমনি? হ্যাঁ, খুব আসত। আসবে না? বাবা যে মিষ্টি ওষুধ দেয়। আর সব ডক্টর আঙ্কেলরা তো তেঁতো ওষুধ দেয়। মোবাইল থেকে এবারে চোখ সরিয়েছে উৎকর্ষ।
তোমার বাবা বুঝি শুধু মিষ্টি ওষুধ দেয়!
দেয় তো। আবার কোনও কোনও ওষুধ হাতে, পিঠে লাগিয়েও দেয়। শুধু কাকীমনিকেই না, আমার ব্যথা হলে আমাকেও বাবা ওষুধ লাগিয়ে দেয়।
আঙ্কেলদের সাথে কি কথা হচ্ছে? চা নিয়ে ঢুকল সংযুক্তা।
এই একটু গল্প-গুজব করছিলাম। কথা বলতে বলতেই চায়ের কাপ হাতে তুলে নিলো গগন। উৎকর্ষ আবার মোবাইলে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। চায়ে চুমুক দিয়ে আবার প্রসঙ্গ তুলল গগন। হ্যাঁ, তারপর যে কথা হচ্ছিল। ময়ূরাক্ষীর আচার আচরণে কি কোনও সমস্যা ছিল?
- ভীষণ গায়ে পড়া। আমার স্বামী তো সম্পর্কে ওর ভাশুর হয়। কিন্তু ওর সাথে ময়ূরাক্ষী এমন আচরণ করত যে, বাইরের কেউ দেখলে ভাববে যে ও মনোজের স্ত্রী বা গার্ল ফ্রেন্ড। ও এসব করার সাহস পেতো আমার শ্বশুর মশাইয়ের জন্য। উনি ওকে কোনদিন কিছুই বলতেন না। সব কিছু জেনেও যেন কিছুই জানেন না, এমন একটা ভাব করে থাকতেন। আর আমরা কিছু বললে উল্টো আমাদেরই চুপ করাতেন।
- বুঝলাম। আচ্ছা কাল সারাদিন কি মনোজ বাবু বাড়িতেই ছিল?
- সকাল থেকে তো অন্যান্য দিনের মত চেম্বার আর পেসেন্ট নিয়েই ছিল। দুপুরের পর মার্কেটে গিয়েছিল কয়েকটা ওষুধ কিনতে। তারপর কোলকাতার চেম্বার সেরে রাতে ফিরেছে।
- এরমধ্যে কি ময়ূরাক্ষীর সাথে কোনও কথা-বার্তা হয়েছে?
- একবার কি কারণে যেন দোতলায় উঠেছিল মনোজ। তবে ময়ূরাক্ষীর ঘরে গিয়েছিল কিনা বলতে পারবো না।
- আচ্ছা, পলাশ বাবুর সাথে ময়ূরাক্ষীর কি তেমন কোনও সম্পর্ক ছিল?
- ময়ূরাক্ষীর স্বভাবই ছিল গায়ে পড়া গোছের। পুরুষ মানুষ দেখলেই হল। আর পলাশও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে এর বেশী কিছু ছিল কিনা, তা আমি বলতে পারব না।
ঠিক আছে। আজ এই পর্যন্তই থাক। প্রয়োজনে পড়ে কথা হবে। তেমন কিছু তথ্য পেলে জানাতে ভুলবেন না। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে কাপ নামিয়ে রেখে, একটা ভিজিটিং কার্ড সংযুক্তার হাতে ধরিয়ে ওদের ঘর থেকে বের হল গগনরা। বেরোতে না বেরোতেই গগনের মোবাইল বেজে উঠল।
- গগন বাবু, তনুজা বলছি। আমার হাজব্যান্ড এই মাত্র এসে পৌঁছেছে। ও এলে ফোন করতে বলেছিলেন, তাই করলাম।
- খুব ভালো করেছেন। আমি এখনো আপনাদের বাড়িতেই আছি। উনি কি একটু নিচে আসতে পারবেন? ওনার সাথে একটা দুটো কথা বলেই বেরোব। এমনিতেই অনেক বেলা হয়েছে। উপরে উঠলে আরও দেরী হয়ে যাবে।
- ঠিক আছে, দাঁড়ান। ও নামছে।
পলাশ নামলে, প্রাথমিক পরিচয় সেরে, সরাসরি প্রসঙ্গে ঢুকল গগন।
- ময়ূরাক্ষীর সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?
- বিশেষ কিছু নয়। দেখা হলেই আমাকে ওর ছবি তুলে দিতে বলত। সময় থাকলে দিতাম। একটা পোর্ট-ফলিও বানিয়ে দিয়েছিলাম। এই পর্যন্তই।
- তা, আপনার তোলা ওর কয়েকটা ছবি কি দেখতে পারি?
- নিজের কাছে তো রাখি না। দিনে হাজার হাজার ছবি তুলি। এতো ছবি তো রাখা সম্ভব নয়। পেন-ড্রাইভ বা হোয়াটস-অ্যাপে ওকে ছবি গুলো দিয়ে, ক্যামেরা থেকে ডিলিট করে দিয়েছি।
ওকে। আর বিশেষ কিছু প্রশ্ন নেই আমার। পরে প্রয়োজন পড়লে জানাবো। এখন আমরা আসি। আপাতত আপনি এলাকা ছেড়ে কোথাও যাবেন না।
অনেক তথ্য ও মনে অনেক প্রশ্ন নিয়ে অবিনাশ মজুমদারে বাড়ি থেকে বের হল গগন ও তীর্থা।
(৩)
সন্ধ্যের দিকে ফরেনসিক সার্জেন্ট অনীক মিত্রের ল্যাবে গেল গগন। তীর্থাও সঙ্গে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু গগন ওকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার দিয়ে, একাই ল্যাবে চলে এসেছে। গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হল ময়ূরাক্ষীর মোবাইলটার লক খুলে সেখান থেকে কোনও ইনফরমেশন পাওয়া যায় কিনা, সেটা দেখা। লক খোলার জন্য অবশ্য ওকে ওর এক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার দাদার সাহায্য নিতে হবে।
গগনকে দেখা মাত্রই অনীক বলল, বেশ গোলমেলে কেস বলে মনে হচ্ছে এটা। বডিতে কোনও ক্ষত চিহ্ন নেই। স্টম্যাকে কোনও পয়েজন নেই। দেহের কোথাও অন্য কারো ফিঙ্গার প্রিন্ট নেই। এটা যদি মার্ডার কেস হয়, তবে খুনিকে বাহবা দিতে হয়।
গগন বলল, ভিক্টিমের ভাসুর মনোজ মজুমদার একজন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। উনি বলছিলেন যে, উনি ভিক্টিমকে যে অ্যাকোনাইটাইনের শিশিটা দিয়েছিল, তা এক দিনেই প্রায় খালি হয়ে গেছে। আচ্ছা, ওটা যদি একবারে কেউ খেয়ে নেয়, তাহলেও তো এই রকম মৃত্যু হতে পারে?
- হতে পারে। কিন্তু এতোটা অ্যাকোনাইটাইন পেটে গেলে, স্টম্যাকে তার নাম গন্ধ পাওয়া যাবে না?
- মৃত্যুটা ঠিক কোন সময়ে হয়েছে বলে মনে হয়?
- রাত দুটো থেকে চারটের মধ্যে।
- তাহলে তো আত্মহত্যা করার চান্স কম। ময়ূরাক্ষী নিশ্চয় মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে আত্মহত্যা করবে না। আচ্ছা ভিক্টিমের ব্যবহৃত কোনও কসমেটিক্স, ড্রেস, জলের বোতল, জলের গ্লাস, প্রভৃতির মধ্যে কি কিছু পাওয়া গেল?
- না, ওগুলোতেও ভিন্টিমের ছাড়া, আর কারো কারেন্ট ফিঙ্গার প্রিন্ট নেই। বলছি আমি না হয় আরেক বার ভালোভাবে সবকিছু দেখছি। আর তুমিও ইনভেস্টিগেশন চালিয়ে যাও। দ্যাখো, নতুন কিছু তথ্য বেড়িয়ে আসে কি না।
অনীক মিত্রের কথার সম্মতি জানিয়ে, ওখান থেকে বেড়িয়ে আসে গগন। বাড়ি পৌঁছে দেখে তীর্থা ময়ূরাক্ষীর মোবাইলের লক খুলে, হোয়াটস-অ্যাপে পলাশের পাঠানো ছবি দেখছে।
গগনকে দ্যাখা মাত্র তীর্থা বলল, কাকাই দ্যাখো পলাশ, ময়ূরাক্ষীর কত ছবি তুলেছে! কথাটা বলেই ময়ূরাক্ষীর একটা পেছন ফেরা ছবি দেখে, হঠাৎ চুপ করে গেল তীর্থা।
কিরে, হঠাৎ চুপ করে গেলি?
এই ছবিটা কোথায় যেন দেখেছি।
কোথায় আবার দেখবি? ময়ূরাক্ষী কি প্রফেশনাল মডেল, যে ওর ছবি কোথাও দেখবি?
আমি যখন দেখেছি বলেছি, তখন নিশ্চয়ই দেখেছি। মনে পড়েছে কোথায় দেখেছি। দাঁড়াও, আনছি। ময়ূরাক্ষীর ফোনটা গগনের হাতে ধরিয়ে, তীর্থা ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।
গগন ফোন হাতে নিয়ে ময়ূরাক্ষী ও পলাশের হোয়াটস-অ্যাপ চ্যাট পড়তে লাগল। কয়েকটা চ্যাট পড়েই গগন বুঝতে পারল যে, ময়ূরাক্ষী কাল বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পলাশের সাথেই দেখা করেছে। আরও সব মেসেজ পড়তে পড়তে, একটা মেসেজ পড়ে রীতিমত চমকে উঠল গগন। ময়ূরাক্ষী ব্ল্যাক-মেল করার হুমকি দিয়েছে পলাশকে।
ময়ূরাক্ষী লিখেছে, তুমি যদি তোমার কথামত আমাকে মডেলিং-এর কাজটা না দাও, তবে কিন্তু আমি তোমার সব খবর ফাঁস করে দেব। তোমার সব ফোন কল রেকর্ডিং করা আছে, সব মেসেজ সেভ করা আছে আমার ল্যাপটপে। আর ছবি গুলো তো আছেই।
মেসেজটা পড়েই কল রেকর্ডিংগুলো খোঁজার চেষ্টা করতে লাগল গগন। কিন্তু সে সময় তীর্থা চলে আশায়, সে কাজে ব্যাঘাত ঘটল।
এই দ্যাখো কাকাই, ছবি দুটো মিলিয়ে দ্যাখো। একটা ফিমেল ফ্যাশন ম্যাগাজিনের একটা পাতা খুলে গগনকে দেখায় তীর্থা।
গগন দেখল তীর্থার কথাটা সত্যি। একটি ডিজাইনার ব্লাউজ আর্টিকেলে ময়ূরাক্ষীকে মডেল হিসেবে ব্যবহার করেছে পলাশ। অথচ ময়ূরাক্ষীর নাম গন্ধও কোথাও নেই। টাকা পয়সা দেওয়া দূরে থাক, খবরটা ময়ূরাক্ষীকে জানায়নি পর্যন্ত পলাশ। জানালে ও পলাশকে ঐ রকম মেসেজ লিখত না।
- থ্যাংকস। তুই দারুণ একটা ইনফরমেশন দিলি আমাকে। মোবাইলটা আমার কাছে থাক। আমি একটু ঘেঁটে দেখি।
- ফরেনসিক রিপোর্ট কি বলছে কাকাই?
- তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু পাওয়া যায় নি। তবে মৃত্যুর টাইমটা বড় অদ্ভুত। রাত দুটোর থেকে চারটের মধ্যে। তাই আত্মহত্য করার চান্স কম।
- তবে?
- যে কেউই খুনি হতে পার। মনে হচ্ছে ময়ূরাক্ষী মাঝরাতে বাথরুম যাওয়ার জন্য উঠেছিল। আর তখনই ওকে কিছু করা হয়। যাক সে কথা। কালকে কি তোর কলেজ আছে?
- সে আছে। তবে তেমন ইমপর্ট্যান্ট কোনও ক্লাস নেই। তুমি বললে ডুব মেরে দেব।
- না ডুব মারতে হবে না। তুই যথা সময়ে কলেজ চলে যাবি। আমি তোকে ওখান থেকে পিক আপ করে নেব।
- সে তো বুঝলাম। কিন্তু যাব কোথায়, সেটা তো বল?
ময়ূরাক্ষীর বাপের বাড়িতে। দেখি রহস্যের কোনও চাবি ওখানে পাওয়া যায় কি না।
(৪)
পরদিন সকালটা ময়ূরাক্ষীর মোবাইল ঘেঁটে, আর গতকালের জিজ্ঞাসাবাদের রেকর্ডিং শুনেই কাটিয়ে দিল গগন। বেশ কিছু তথ্য এখন গগনের ভাণ্ডারে। ময়ূরাক্ষীর গর্ভের সন্তান যে সরোজের নয়, সে ব্যাপারে গগন এখন নিশ্চিত। তবুও প্রসেনজিৎ মণ্ডলকে বলে মনোজ, সরোজ, পলাশদের ব্লাড স্যাম্পল আর বাড়ির সকলের ফিঙ্গার প্রিন্ট কালেক্ট করে, সেগুলো অনীক মিত্রের ল্যাবে পাঠিয়েছে গগন। বেলার দিকে কেসের কিছু সুরাহা হয়েছে কিনা জানতে অন্বেষণ ফোন করেছিল গগনকে। খুব একটা আশার কথা গগন ওনাকে শোনাতে না পারলেও দু-চারদিনের মধ্যে কিছু একটা পজিটিভ ফিডব্যাক যে ও অন্বেষণকে দিতে পারবে, সেটা নিশ্চিত করেছে গগন।
লাঞ্চ সেরে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে তীর্থাকে ওর কলেজ থেকে তুলে, বিকেল বিকেল ময়ূরাক্ষীর বাপের বাড়িতে পৌঁছল গগন। আগে থেকে ফোন করে জানানো ছিল। মীনাক্ষী যেভাবে ডায়রেকশন দিয়েছিল, তাতে বাড়ি খুঁজে বার করতে কোনও অসুবিধে হয়নি ওদের। বড় রাস্তার ওপরেই দোতালা বাড়ি মীনাক্ষীদের। তবুও বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিল মীনাক্ষী।
যাওয়া মাত্রই একটা চেক গগনের হাতে ধরালেন অম্লান সেন।
আরে, এতো তাড়াহুড়োর কি আছে? আমি তো কিছুক্ষণ আছি এখানে।
না, চেকটা আপনাকে কাজটা শুরু করানোর সময়েই দেওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু কাল যে পরিস্থিতিতে আমরা ছিলাম, চেকটা দেওয়া সম্ভব হয়নি। তা তেমন কিছু কি জানা গেল?
অপরাধী কে, তা এখনো বুঝতে পারিনি। তবে অনেক রকম ইনফরমেশান কালেক্ট করেছি। তা দিয়ে হয়তো খুব শীঘ্রই আমারা কোনও ডিসিশনে আসতে পারব। আচ্ছা কোনও কারণে কি ময়ূরাক্ষী আত্মহত্যা করতে পারে?
অসম্ভব। মৃত্যুর আগের দিন রাতেই আমার সাথে কথা হয়েছে। বেশ হ্যাপি মুডে ছিল ও। অনেক দিন পর ওকে খুশি দেখে বেশ ভালো লেগেছিল। ভেবে ছিলাম মেয়েটার কষ্ট বুঝি দূর হয়েছে। এবারে একটু সুখের মুখ দেখবে ও।
আগের দিন রাতে যে আপনার সাথে ওর কথা হয়েছে সেটা আমি জানি। ওর ফোনের কল লিস্টে দেখেছি। আসলে অ্যাকোনাইটাইনের শিশিটা এক দিনে শেষ হয়েছে। আর ওতে ময়ূরাক্ষী ছাড়া আর কারো ফিঙ্গার প্রিন্ট নেই। তাই প্রাথমিক ভাবে আত্মহত্যা বলেই মনে হচ্ছে এটা।
উঁহু, এর মধ্যে অন্য কোনও রহস্য নিশ্চয়ই আছে। আবারও আমি বলছি, ময়ূরাক্ষী আত্মহত্যা করতেই পারে না।
কাউকে কি সন্ধেহ হয় আপনার?
আমার তো অবিনাশ বাবু ছাড়া ঐ বাড়ির সবাইকেই সন্ধেহ হয়। উনি ছাড়া কেউ ওকে সহ্য করতে পারত না। সবাই মিলে প্ল্যান করেও করতে পারে কাজটা।
ওকে, এবারে আমরা মীনাক্ষীর সাথে সেপারেটলি কথা বলতে চাই।
নো প্রবলেম। মীনাক্ষী, তুমি ওনাদের তোমার ঘরে নিয়ে যাও।
চা চলবে তো? অম্লান সেনের স্ত্রী অর্পিতা এসে সৌজন্য মুলক প্রশ্ন করলেন গগনদের।
আপনি একদম আমাদের জন্য ব্যস্ত হবে না। আমার তেমন নেশা নেই চায়ের। আর বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়ই এক কাপ খেয়ে এসেছি। আর তীর্থা তো চা খায় না বললেই চলে।
গগনের কথার কোনও উত্তর দিল না অর্পিতা। মীনাক্ষী, বাবার কথামত দোতালায় ওর ঘরে গগনদের নিয়ে গেল।
- কাল তুমি বলছিলে যে, তোমার আমাকে অনেক কিছু বলার আছে। মনে যা আছে, সবকিছু এখন বলতে পারো আমাকে।
- বলার তো অনেক কিছুই আছে। কিন্তু সেগুলো কিভাবে বলব ভাবছি। আর আপনি আমার চেয়ে অনেক বড়। তাই কথাগুলো আপনাকে বলা ঠিক হবে কিনা, সেটাও বুঝতে পারছি না।
- তোমার কখনও গাইনোকোলজিক্যাল সমস্যা হয়েছে?
- হঠাৎ এই প্রশ্ন?
- কারন তো একটা আছেই। বলই না কখনো কোনও সমস্যা হয়েছে?
- সে হয়েছে, আবার ডাক্তার দেখিয়ে সেরেও গেছে।
- ডাক্তারকে তোমার সমস্যাগুলো বলতে, অসুবিধে হয়নি?
- একটু যে হেজিটেশান হয়নি, তা নয়। তবে না বললে তো রোগটা সারবে না।
- এক্সাক্টলি। তুমি যদি চাও, তোমার দিদিকে যে বা যারা এইভাবে খুন করেছে, তাদের শাস্তি হোক, তবে তোমাকে সব কিছু খুলে বলতে হবে। দিদির ব্যাপারে যা জানো, সব কিছু। কোনও কিছু গোপন কোরো না। কারণ তোমার কোন কথায় কোন রহস্যের সমাধান হবে, তা তুমি ধারনাও করতে পারবে না।
আরে কোনও হেজিটেট কোরও না। আমার কাকাই মাই ডিয়ার। আমি তো কাকাইকে আমার সব কিছু শেয়ার করি। আমার খুব পার্সোনাল কথাও কাকাই জানে। মীনাক্ষীকে ভরসা জোগাতে অনেকক্ষণ পড়ে মুখ খোলে তীর্থা।
ওদের কথায় ভরসা পেয়ে, মনের সব দ্বিধা কাটিয়ে ময়ূরাক্ষীর কথা বলতে শুরু করে মীনাক্ষী।
- বরাবরই আমার দিদির শারীরিক উত্তেজনা বা চাহিদাটা একটু বেশী। বিয়ের আগে অনেক রাতই ও প্রায় জেগে কাটিয়েছে। আমাকে বলত, মিনু আঙ্গুলে আর কাজ হচ্ছে না। হাতের আঙুল কি আর ছেলেদের ওটার সাবস্টিটিউট হয়? বিয়েটা তাড়াতাড়ি করেই ফেলতে হবে। বাবা সম্ভবত ওর গতিবিধি দেখে, কিছুটা আঁচ করেছিল। তাই খুব একটা দেরি না করে, ওর বিয়েটা দিয়ে দিয়েছিল।
কিন্তু বিয়ের পরও ময়ূরাক্ষীর সমস্যা সমাধান হল না। তাই তো? মীনাক্ষী তার কথায় একটু পজ্ দেওয়ায়, গগন তার ধারনা পোষণ করল।
- মিটবে কি করে? সরোজ দা, মানুষ হিসেবে ভীষণই ভাল। কোনও জটিলতা, কুটিলতা নেই। একদম সিধে সাদা টাইপের। কিন্তু ওর একটাই সমস্যা। সেক্সের সময় বেশীক্ষণ স্টে করতে পারে না। দিদি বলত, সরোজের সাথে সেক্স করার থেকে, না করা ভাল। শুরুর আগেই শেষ। শুধু-শুধু শরীর গরম করে কষ্ট পাওয়া। তাই শেষের দিকে জাম্বুর সাথে সেক্স করা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল দিদি।
তাহলে তোমার দিদি, কার সন্তানের মা হতে চলেছিল, তা তোমার জানা আছে? উত্তর জানা প্রশ্নই মীনাক্ষীকে করল গগন।
- সম্ভবত পলাশ দা। কারণ ওর সাথেই দিদি সবচেয়ে ক্লোজ ছিল। আর দিদিকে অনেক রকম স্বপ্নও দেখিয়ে ছিল ও। দিদি তো মৃত্যুর আগের দিনও পলাশদার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। আমাকে ঐদিন সকালে ফোন করে বলল, জানিস মিনু, পলাশ আজ আমাকে ওদের অ্যাড এজেন্সির ক্রিয়েটিভ ডিরেকটরের সাথে মিট করাবে।
- যাই হোক, তোমার দিদি কি মডেলিং প্রফেশনে যুক্ত হতে চেয়েছিল?
- হ্যাঁ, আর পলাশদা ওকে ঐরকম স্বপ্নই দেখিয়ে ছিল।
- তোমার দিদির সাথে তো মনোজ বাবুরও বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল শুনেছি।
- তা ছিল। তবে উনি একটু ভীতু প্রকৃতির। দিদি ওকে নানা রকম ইঙ্গিত দিলেও, উনি ওনার বৌ-এর ভয়ে বেশী কিছু করতে পারতেন না। ওনার সাথে দিদির কোনও ফিজিক্যাল রিলেশন ছিল বলে তো মনে হয় না।
- আমারও মনে হয় না। আচ্ছা, তোমার দিদি কি পুরুষ মানুষ দেখলেই এরকম ইঙ্গিত, ইশারা করতো।
- সবাইকে দেখে না করলেও, ওর যাকে মনে ধরত, বা যাকে দিয়ে ওর কোনও স্বার্থ সিদ্ধি হবে বলে ও মনে করত, তাকে যেভাবেই হোক কাছে পাওয়ার চেষ্টা করত ও।
- তোমার দিদির এরকম মনের মত পুরুষ সঙ্গী কয়জন ছিল বলতে পারবে?
- সব তো বলতে পারবো না। তবে ওর এক স্কুল ফ্রেন্ড প্রদীপকে এই বাড়িতে ডেকে ফিজিক্যাল রিলেশনের অফার দিয়েছিল বলে শুনেছি।
- সেটা কি ওর বিয়ের আগে, না পরে?
বিয়ের পরে। বেশী দিন আগের ঘটনা নয়। বছর খানেক হবে। বাড়িতে সেদিন কেউ ছিল না। সেই সুযোগটাই দিদি নিতে চেয়েছিল।
সেদিন এক্সাক্টলি কি ঘটেছিল, একটু ডিটেলে বলবে?
দেখুন বেশী ডিটেলে তো আমি জানি না। তবে যেটুকু শুনেছি, প্রদীপ সেদিন দিদিকে রিফিউজ করেছে।
এই ঘটনাটাও কি তুমি তোমার দিদির মুখে শুনেছ?
না, ও এই ব্যাপারে আমাকে কিচ্ছু বলেনি। আমাকে প্রদীপ বলেছে। ওর সাথে আমার একটা সম্পর্ক রয়েছে। তবে এই সব কারণে আমাদের রিলেশনের মধ্যেও একটু সমস্যা হয়েছে।
প্রদীপের ফোন নম্বরটা দিতে পারবে?
কেন, আপনি ওকেও জিজ্ঞাসাবাদ করবেন নাকি? দেখুন ও এমনিতেই একটু প্রবলেমে আছে। তার ওপর আপনি যদি এসব নিয়ে জেরা করেন তবে তো আমাদের রিলেশনে আরও সমস্যা তৈরি হবে।
ভয় নেই। আমি এমন কিছু করব না, যাতে তোমার কোনও সমস্যা হয়। বরং আমি ওর সাথে কথা বললে তোমাদের মধ্যে যেটুকু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, তাও মিটে যেতে পারে।
আপনাকে ভরসা করে নম্বরটা দিচ্ছি। একটু দেখবেন যাতে আমাকে কোনও সমস্যায় পড়তে না হয়।
মীনাক্ষীর থেকে প্রদীপের ফোন নম্বরটি নিয়ে মোবাইলে সেভ করে ওকে আবার একটা প্রশ্ন করল গগন। এই প্রদীপ ছেলেটি বাই প্রফেশন কি করে?
একটি রেপুটেড এয়ার কন্ডিশন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিতে সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ারের পদে আছে।
আর তেমন কিছু জানার নেই। আজ তবে তাহলে আমরা চলি।
গগন ও তীর্থা দোতলা থেকে নিচে নেমে এলো। নিচে এসে অম্লান সেন ও তার স্ত্রীর সাথে দেখা করে, আরও একবার তাদের মেয়ের খুনিকে ধরে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে, ঐ বাড়ি থেকে বের হল ওরা।
(৫)
মীনাক্ষীদের ওখান থেকে বাড়ি ফিরেই প্রদীপকে ফোন করল গগন। নিজের পরিচয় দিয়ে আগামী কাল প্রদীপের সাথে দেখা করতে চাইল ও। প্রদীপ, গগনের পরিচয় ও দেখা করার উদ্দেশ্য শুনে বলল,
কাল তো বেহালায় অনেকগুলো কাষ্টমারের বাড়ি এ.সি সার্ভিসিং আছে। সারাদিন ওখানেই কেটে যাবে। আর বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হবে আমার।
আমি যদি তোমার সুবিধে মত জায়গায়, তোমার সুবিধে মত সময়ে কাল তোমার সাথে দেখা করি, তাহলে কোনও অসুবিধে হবে?
না, তাহলে তো খুব সুবিধে হয়। আপনি তবে কাল দুপুরের দিকে আমাকে একটা ফোন করুন। কোনও রেস্টুরেন্টে মিট করে, লাঞ্চ করতে করতে আপনার সাথে কথা বলে নেওয়া যাবে ক্ষণ।
প্রদীপের কথায় সম্মতি জানিয়ে ফোন রাখল গগন।
পরদিন সকালে তীর্থাকে ডেকে ওর ফোন থেকে মীনাক্ষীর সাথে কথা-বার্তার রেকর্ডিংটা শুনে নিলো গগন। তারপরে বলল, ময়ূরাক্ষীর মৃত্যুটা যে ওর সেক্সুয়াল ডিমান্ডের জন্যই হয়েছে, তা পরিষ্কার। কিন্তু অপরাধীর কাছে পৌঁছনোর রাস্তাটা এখনো পরিষ্কার হয়নি। তীর্থা, তুই একটা সাস্পেক্ট লিস্ট তৈরি কর তো।
সাস্পেক্ট লিস্ট? কিসের বেসিসে তৈরি করব ওটা?
এই কেসটা তো তুই প্রথম থেকেই দেখছিস। তোর যাকে যাকে সন্দেহ হয়, তার একটা লিস্ট তৈরি কর। তারপর ইনভেস্টিগেশন যত এগোবে, এক এক করে নাম বাদ পড়বে সে লিস্ট থেকে।
আমার তো মজুমদার বাড়ির সবাইকেই সন্দেহ হয়।
আর বাড়ির বাইরে? মীনাক্ষী, প্রদীপ এদের সন্দেহ হয় না?
ঠিক সেই সময়ে গগনের মোবাইল বেজে ওঠায়, ওদের আলোচনায় ব্যাঘাত ঘটল। অনীক মিত্রের ফোন।
- বলুন অনীক দা, নতুন কিছু ইনফরমেশন পাওয়া গেল?
- ডি.এন.এ টেস্ট করে দেখলাম তোমার সন্দেহই ঠিক। ময়ূরাক্ষীর সন্তানের বাবা পলাশই। আর একটু বইপত্র ও ইন্টার-নেট ঘেঁটে যেটা বুঝলাম, অ্যাকোনাইটাইন কেন, হোমিওপ্যাথি এরকম অনেক ওষুধই আছে, যা দিয়ে মানুষ খুন করা যায়। আর সেজন্য সেই ওষুধ যে ভিক্টিমকে খাওয়াতেই হবে, এমন কোনও কথা নেই। ভিক্টিমের শরীরে ইনজেক্ট করলে বা মাখিয়ে দিলেও চলবে। আর এইসব ওষুধ একটা সার্টেন টাইমের পর বডি অ্যাবজর্ব করে নেয়। তাই ফরেনসিক টেস্টেও কিছু বোঝার উপায় নেই।
- আর খুনি যদি গ্লাভস ব্যবহার করে ভিক্টিমের গায়ে ওষুধটা মাখায়, তবে ফিঙ্গার প্রিন্ট পাওয়ার চান্সও থাকে না।
- একদম ঠিক কথা। আর এই কেসে সরোজের এটা করার স্কোপ সবচেয়ে বেশী।
- হ্যাঁ, তবে অন্য কেউ যে করতে পারে না তা নয়। ধরুন ময়ূরাক্ষী মাঝরাতে উঠে বাথরুমে গেছে। আর খুনি সেই সময়েই আক্রমন করেছে।
- সে তো হতেই পারে। কোনও কিছুই অসম্ভব নয়।
- তবে সরোজের কথার সাথে অন্য সবার কথার অনেক পার্থক্য রয়েছে। ওকেও ভালো করে জেরা করতে হবে। নার্কো অ্যানালিসিস করতে পারলে ভালো হোতো, কিন্তু তার তো হ্যাপা অনেক।
- একদম ঠিক। তুমি বরং ভালো করে জেরা কর। তবে শুধু সরোজকে নয়। সরোজ, মনোজ, পলাশ তিনজনকেই একটু ভালো করে জেরা করার দরকার।
- হ্যাঁ, ঐ তিনজনকে আগে জেরা করি। তারপর দরকার বুঝে সবাইকেই আরেকবার জিজ্ঞাসা-বাদ করা যাবে। আজ তবে রাখলাম।
গগন ফোন রাখা মাত্রই তীর্থা প্রশ্ন করে উঠল, নার্কো অ্যানালিসিস টেস্ট কি কাকাই?
- সে বলতে গেলে তো, অনেক কিছু বলতে হয়। এক কথায় বলতে গেলে এই টেস্টের সাহায্যে কাউকে কোনও প্রশ্ন করলে, সে সাধারণত সঠিক উত্তরই দেয়।
- আরও একটু পরিষ্কার করে বল না।
- দ্যাখ কাউকে যদি মিথ্যে কথা বলতে হয়, তবে তার চিন্তা ও কল্পনাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বলতে হবে। কিন্তু এই টেস্ট যার ওপর করা হয়, তার শরীরে সোডিয়াম পেন্টোথ্যাল বা ঐ ধরনের এমন কিছু ওষুধ ইঞ্জেক্ট করা হয়, যাতে ঐ ব্যক্তি অর্ধ অচেতন হয়ে পড়ে। ফলে ঐ অবস্থায় তার পক্ষে মিথ্যে বলাটা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই ঐভাবে জেরা করলে অনেক সঠিক তথ্য উঠে আসে।
- ও বুঝলাম। তা আমরা প্রদীপকে মিট করতে কখন যাচ্ছি?
- আমরা নয়। আমি একা যাচ্ছি ওর সাথে কথা বলতে। তোর শুধু শুধু কলেজ কামাই করার কোনও দরকার নেই।
কথাগুলো বলে, তীর্থার উত্তরের জন্য কোনও অপেক্ষা না করে ঘর থেকে বেড়িয়ে বারান্দায় এসে একটা সিগারেট ধরাল গগন। মস্তিষ্কে ধোঁয়া দিয়ে এই কেসের নানা দিক ভাবতে লাগল ও।
অনেকটা ড্রাইভ করে, কথামত দুপুর দুটো নাগাদ বেহালার একটি রেস্টুরেন্টে প্রদীপের সাথে মিট করল গগন। লাঞ্চ সেরেই বাড়ি থেকে বেড়িয়েছিল ও। প্রদীপ ওর লাঞ্চের অর্ডার দিয়ে একটা নিরিবিলি টেবিল বেছে নিলো। আর লাঞ্চ সারতে সারতে গগনের প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকল ও।
- ময়ূরাক্ষীর সাথে পরিচয় কিভাবে?
- ও আমার স্কুল লাইফের বন্ধু। ওর সাথে ইলেভেন টুয়েলভে একসাথে কোচিং পড়েছি। সেই সময়ে ওদের বাড়িতে আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিল।
- আর মীনাক্ষীর সাথে?
- মীনাক্ষীর সাথে আলাদা করে পরিচয়ের কিছু ছিল না। ময়ূরাক্ষীর বাড়িতে গেলে ওর সাথে টুক-টাক কথা-বার্তা হতো। তবে মাঝখানে অনেকদিন ওদের সাথে কোনও যোগাযোগ ছিল না। ময়ূরাক্ষীর বিয়ে হয়ে গেল। এরপর ফেসবুক, হোয়াটস-অ্যাপের দৌলতে ওদের সাথে আবার যোগাযোগ হয়। আর হোয়াটস-অ্যাপে চ্যাট করতে করতে মীনাক্ষীর সাথে অল্প দিনের মধ্যেই একটা রিলেশনশিপ তৈরি হয়।
- এবার ময়ূরাক্ষী সম্পর্কে কিছু বল।
- ময়ূরাক্ষীর শারীরিক চাহিদাটা একটু বেশী ছিল। ওর সাথে কোচিং-এ পড়ার সময়েও আমি এর আভাস পেয়েছি। কিন্তু ওর বিয়ের পর যেন সেটা অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল।
- কিরকম?
- আমি একদিন ওদের বাড়িতে মীনাক্ষীকে একটা গিফট দিতে গিয়েছিলাম। ময়ূরাক্ষী তখন কয়েকদিনের জন্য ওর এই বাড়িতে এসেছিল। আমি গিয়ে দেখি ময়ূরাক্ষী বাড়িতে একা। জিজ্ঞাসা করে জানলাম যে ওদের কোনও রিলেটিভ মারা যাওয়ায়, মীনাক্ষী ওর বাবা-মার সাথে ওখানে গিয়েছে। আমি ময়ূরাক্ষীর হাতে মীনাক্ষীর গিফটটা দিয়ে ওখান থেকে চলে আসতে চাইলে ও বলল,
- এখনি কি যাবি? একা বাড়িতে বোর লাগছে। একটু বস না। আমার বোনকে পেয়ে এই পুরনো বন্ধুকে ভুলে গেলি?
- তোকে ভুলতে পারি? তোর জন্যই তো মীনাক্ষীর সঙ্গে আমার পরিচয়। ও আমার জীবনে আসার পর আমার লাইফটা একদম বদলে গেছে। এখন প্রতিটা কাজেই আলাদা আনন্দ পাই।
- ও বুঝি তোকে সব রকম আনন্দই দিয়ে দিয়েছে?
- তুই কি বলতে চাইছিস বলত?
- এইটুকু বুঝতে পারছিস না? বলছি বিবাহিত জীবনের সব আনন্দ কি তুই এখনি পেয়ে গিয়েছিস?
- না আমাদের মধ্যে সেসব কিছু এখনি হয়নি। আর বিয়ের আগে সেসব হোক তা আমি চাইও না।
- সেকি রে, তুই এখনো ভার্জিন আছিস? মেয়েদের “ভৌগলিক দ্বীপ” দর্শন হয়নি?
- ছবি বা মুভিতে দর্শন হয়েছে। সামনা-সামনি হয়নি।
- ছবি, মুভির কথা ছাড়। সামনা-সামনি দেখবি?
- বললাম তো আমি বিয়ের আগে মীনাক্ষীর সাথে এসব কিছু করবো না।
- আরে মীনাক্ষী না, আমি দেখাবো। দেখবি? বাড়ি ফাঁকা আছে, কেউ জানতেও পারবে না।
- নারে, আমি তোর সাথে ওসব করতে পারবো না। আমি এখন চলি রে।
সেদিন কোনোরকমে ওখান থেকে পালিয়ে বেঁচেছিলাম। তারপর থেকে ও বাড়িতে যাওয়ার দরকার হলে আগে জেনে নিতাম ময়ূরাক্ষী এসেছে কিনা। আর ময়ূরাক্ষী ঐ বাড়ি এলে আমি ও বাড়ির ধারে কাছেও যেতাম না।
প্রদীপ এতোটাই আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েছিল যে, হাতে একমুঠো ভাত নিয়ে কেবলই কথা বলে চলেছিল। ক্ষণিকের জন্য ক্ষিদে তৃষ্ণা যেন সব লোপ পেয়ে গিয়েছিল।
আরে ভাতের থালা তো একই ভাবে পড়ে রইল। আগে খাওয়া শেষ কর। বাকী কথা তারপর হবে। কথা বলতে বলতেই গগনের ফোন বেজে উঠল। প্রদীপকে “রেস্টুরেন্টের বাইরে আছি” বলে বাইরে এসে ফোন ধরল গগন।
- হ্যালো, আমি মজুমদার বাড়ি থেকে অবিনাশ মজুমদারের স্ত্রী কাকলী বলছি।
- হ্যাঁ, বলুন বৌদি। কোনও কিছু মনে পড়ল?
- পড়েছে। আর সেই জন্যই তো ফোন করলাম। ঘটনার দিন সকালে পলাশ তনুজা আর অনুষ্কাকে এই বাড়িতে পৌঁছে দিতে এসেছিল। আর ময়ূরাক্ষী সেদিন পলাশকে ওর ঘরে ডেকে নিয়ে ওর সাথে জমিয়ে আড্ডা মেরেছিল।
- হ্যাঁ, আমি সেটা গেস করে ছিলাম। আর কিছু মনে পড়ল?
- ময়ূরাক্ষী সেদিন শুধুই বাড়ি থেকে বেরোনোর পারমিশন নিতে আসেনি আমাদের ঘরে। খবরের কাগজ দিতে এসেছিল।
- খবরের কাগজ? আপনি নিজের চোখে দেখেছেন তো?
- না, আমি তখন রান্নাঘরে ছিলাম। ওখান থেকে শুনলাম আমার হাজব্যান্ড ওকে বলল, টেবিলের ওপরে রেখে যাও। আজ সকালে কথাটা মনে পড়তেই ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। ও বলল, খবরের কাগজ।
- ওকে। আর কিছু মনে পড়ল? বা আজ কালের মধ্যে কারো চাল-চলন কথা-বার্তার মধ্যে তেমন কিছু লক্ষ্য করলেন?
- না গো, তেমন কিছু তো চোখে পড়েনি। তবে আমার স্বামী ময়ূরাক্ষীর মৃত্যুর পর কেমন চুপ-চাপ হয়ে গেছে। আর কাল সন্ধ্যে থেকে আমিও একটু ডিস্টার্ব আছি।
- কেন? আপনার আবার কি হল?
- আমার কানের দুল জোড়া খুঁজে পাচ্ছি না। ওটা আমার শাশুড়ি মায়ের স্মৃতি। আমার কর্তা জানলে আর রক্ষে থাকবে না। তাছাড়া সোনা হারানো অমঙ্গলের লক্ষ্মণ। ঘরেই কোথাও পড়েছে, এটা নিশ্চিত। কাল দুপুরে তোমার দাদার নেমন্তন্ন আছে, ওর এক বন্ধুর বাড়িতে। ও যেতে চাইছিল না। আমিই জোর করে পাঠাচ্ছি। একটু বাড়ির বাইরে বেড়িয়ে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দু-চারটে কথা বললে মনটা হালকা হবে। আর ও কাল বেরোলে ঠিক করেছি কাঠ বা কলের মিস্ত্রী কাউকে ডাকিয়ে খাট আলমারি সোফা সব সরিয়ে, কাজের মেয়েটাকে দিয়ে খোঁজাবো। আশাকরি পেয়ে যাবো।
- অবশ্যই পাবেন। ঘরেই যখন আছে, তখন ভালো করে খুঁজলেই পাওয়া যাবে। আজ সন্ধ্যে নাগাদ আপনাদের বাড়ি যেতে পারি। গেলে কথা হবে।
ফোন রেখে একটা সিগারেট ধরাল গগন। এমন সময় প্রদীপ খাওয়া শেষ করে বিল মিটিয়ে গগনের সামনে এসে দাঁড়াল।
- সিগারেট চলবে তো?
- না হলেও চলে। তবে খাওয়ার পর হলে মন্দ হয় না।
গগন প্রদীপকে একটা সিগারেট দিয়ে, সেটা ধরাতে সাহায্য করল। তারপর নিজের সিগারেটে একটা টান দিয়ে বলল, ঐ ঘটনার পর তোমার সাথে আর ময়ূরাক্ষীর দেখা বা কথা কিছু হয়নি?
হ্যাঁ, হয়েছে। ঐ ঘটনার বেশ কয়েক মাস পরে একদিন আমি ডাঃ মনোজ মজুমদারের ঘরে ওনার এসি সারভিসিং করতে গিয়েছি। ওটা যে ময়ূরাক্ষীর শ্বশুর বাড়ি, তা আমি জানতাম না। জানলে অন্য কাউকে পাঠাতাম। আমি ডাক্তারবাবুর ঘরে কাজ করছি, এমন সময় ময়ূরাক্ষী এসে বলল, আমার ঘরের এ.সি টাও একটু ডিস্টার্ব করছে। আপনার এখানে হয়ে গেলে একটু ওপরে আসবেন? এমন ভাবে ও কথাটা বলল, যেন আমাকে চেনেই না। ইচ্ছে না থাকলেও নিচের ঘরে কাজ সেরে, আমাকে ওপরে ময়ূরাক্ষীর ঘরে যেতেই হল।
ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি সমস্যা হয়েছে বল? এমন ভাবে কথা বলছিস, যেন আমাকে চিনিসই না!
একটু দ্যাখ না, একদম ঠাণ্ডা হচ্ছে না।
আমি দরজাটা আলতো করে বন্ধ করে এ.সিটা চালালাম। দেখলাম সব ঠিকই আছে। বললাম, কিরে, প্রবলেম তো কিছু দেখছি না। ভালোই তো ঠাণ্ডা হচ্ছে ঘর।
প্রবলেম টা এ.সিতে নয়। আমার শরীরে। খালি গরম হয়ে যাচ্ছে। একটু ঠাণ্ডা করে দে না।
আমি এসির প্রবলেম সল্ভ করতে এসেছি। তোর শরীর ঠাণ্ডা করতে আমি পারবো না।
কেন রে? তোর কি কোনো শারীরিক সমস্যা আছে? মেয়ে দেখলে উত্তেজনা হয় না? তাহলে তো তোর সাথে আমার বোনের বিয়ে দিলে, ওরও আমার মত অবস্থা হবে। কথাটা বলেই একটু ঝুঁকে, নাইটিটা একটু টেনে, বুকটা অনেকটা উন্মুক্ত করে বলল, এগুলো দেখেও কি তোর শরীরে কোনও উত্তেজনা হচ্ছে না?
ঠিক সেই সময় ওর শ্বশুর মশাই, ওনার ঘরের এ.সির রিমোট সেটিং-এর প্রবলেম হওয়ায়, আমাকে তা বলতে এসেছিলেন। ঘরে ঢুকে ময়ূরাক্ষীকে ওই ভাবে দেখে উনি বেশ অস্বস্তিতে পরলেন। ময়ূরাক্ষী তৎক্ষণাৎ নিজেকে ঠিক করে নিলো। উনি সংক্ষেপে ওনার সমস্যার কথা বলে ঘর থেকে বেরলেন। আমিও ওনার পেছন পেছন ওনার ঘরে গেলাম। আর ওনার এ.সির রিমোট সেটিং ঠিক করে ঐ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলাম।
এক নাগাড়ে অনেকক্ষণ কথা বলে, প্রদীপ একটু থামল। গগন সিগারেটে লাস্ট টান দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, এই ঘটনাটা মীনাক্ষী জানে?
না, ওদের বাড়ির ঘটনাটা ওকে বললেও, এটা আর ওর সাথে শেয়ার করিনি। কিন্তু ময়ূরাক্ষী ওর বাবার কাছে আমার সম্পর্কে উল্টোপাল্টা কিছু বলে আমাদের রিলেশনে একটু সমস্যা তৈরি করে ছিল।
ওকে, অনেক কথা হল। তোমার এই ইনফরমেশন গুলো, আমার ইনভেস্টিগেশনে অনেক সুবিধে করবে। তোমাকে আর আটকাবো না। তুমি তোমার কাজে যেতে পারো।
প্রদীপ গগনের থেকে বিদায় নিয়ে বাইকে স্টার্ট দিল। আর গগনও গাড়ি স্টার্ট দিয়ে নিজের গন্তব্য স্থলের দিকে এগোল।
(৬)
সন্ধ্যের পরে তীর্থাকে নিয়ে মজুমদার বাড়ি গেল গগন। ওর যাওয়ার কথা সরোজ, মনোজ ও পলাশকে জানিয়ে, ওদের থাকতে বলেছিল গগন। গগনরা ও বাড়ি পৌঁছে দেখে মনোজ বাড়িতেই আছে। সরোজও সময় মতো চলে এসেছে। পলাশের আসতে একটু দেরী হল। তবে দুই ভাই-এর সাথে কথা বলতে বলতে পলাশও চলে এলো। তিনজনের সঙ্গে আলাদা আলাদা ভাবে কথা বলে, নানা রকম ভাবে ওদের জেরা করে অনেক কিছু পরিষ্কার হলেও, অনেক অজানা তথ্য জানা হলেও, মুল লক্ষ্যে তবুও যেন পৌঁছনো গেল না। অপরাধী খুব কাছ দিয়ে ঘোরা-ফেরা করছে, কিন্তু তার কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব হয়ে উঠছে না গগনদের।
মনোজ বলল, আমি তো যা বলার আগেই বলে দিয়েছি। নতুন কিছু আমার বলার নেই। ময়ূরাক্ষীর একটু ওভার সেক্সুয়াল অ্যাকটিভিটি ছিল। আমাকেও কয়েক বার অ্যাপ্রোচ করেছিল। কিন্তু আমি ওর সাথে কখনও ফিজিক্যাল রিলেশনে জড়াই নি। রুচি ও সৌজন্য বোধে বেধেছে। গগন একটু চেপে ধরায়, এবং নানা ভাবে ক্রস কোশ্চেন করায়, মনোজ বাধ্য হয়ে যে কথা গুলো বলল তা হল,
- আগেই বলেছি ময়ূরাক্ষী একটু ফিগার কনসাস্ ছিল। আর ওর ব্রেস্ট গুলো তেমন ডেভেলপ ছিল না। তাই আমাকে ওর এই প্রবলেমের কথা বললে, আমি অ্যাগনাস কাস্ট ৩০ খেতে আর প্রতিদিন রাতে ভেসলিন দিয়ে ব্রেস্ট ম্যাসেজ করতে বলেছিলাম। আর কিভাবে ম্যাসেজ করতে হবে, তা অনেক ভাবে আমি ওকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কিছুতেই ও সেটা বুঝতে পারছিল না। আর আমাকে ম্যাসেজ করে দেখিয়ে দিতে বলেছিল। ওর রিকোয়েস্টে আমি ওর ব্রেস্টে ভেসলিন দিয়ে ম্যাসেজ করে ওকে কিভাবে ম্যাসেজ করতে হয় দেখাতে বাধ্য হয়েছিলাম।
- হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার হয়ে আপনি ভেসলিন অ্যাডভাইস করলেন?
- ভেসলিন ও এমনিতেই শোয়ার সময় মুখে, হাতে মাখতো। তাই আমি আর নতুন কোনো ওষুধ না দিয়ে, ভেসলিন দিয়েই ম্যাসেজ করতে বলেছিলাম।
- ওকে, আপনি এখন যেতে পারেন।
মনোজের পর সরোজকে নিয়ে বসল গগন। ওকে একটু জেরা করতেই ও আগের দিন যে মিথ্যে বলেছিল, তা স্বীকার করে নিলো। আর বলল,
- আমার সাথে যৌন সঙ্গে ময়ূরাক্ষী একদমই খুশি ছিল না। আর আমি অনেক চেষ্টা করেও খুশি করতে পারিনি। বেশ কয়েক মাস যাবদ ও আমার সাথে যৌন সম্পর্ক বন্ধ করে দিয়েছিল। তাই ওর প্রেগনেন্সির খবরে আমি খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম। বেশ রাগও হয়েছিল। আমাদের মধ্যে এই নিয়ে প্রায়ই ঝগড়া বিবাদ লেগে থাকত। এইসব কারণে আমি মানসিক অবসাদে ভুগতাম। আরও খারাপ লাগতো বাবা ওর পক্ষ হয়ে কথা বলত বলে। এই ঘটনার দিন কয়েক আগে একদিন বাবা আমাকে বলেছিল, মেয়েটা সবসময় মুখ ভার করে থাকে। দেখে ভালো লাগে না। ছুটির দিনে ওকে নিয়ে একটু ঘুরে আসতে পারিস তো। শুনে আমার বেশ খারাপ লেগেছিল। আমি যে সবসময় মানসিক অবসাদে ভুগছি, সে নিয়ে বাবার কোনও মাথা ব্যথা নেই। যত সহানুভূতি ময়ূরাক্ষী ওপর। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় আমি একটা অফিস পার্টিতে ছিলাম। হঠাৎ ওর ফোন এলো। আমি ওর কথা কিছু শুনতে না পেয়ে বাইরে বেড়িয়ে এলাম। ও বলল,
- তুমি যখন এই সন্তানকে মেনে নিতে পারছ না, তখন আমি আর এই সন্তান রাখবো না। আমি অ্যাবোরশন করিয়ে নিচ্ছি।
- ভ্রূণ-হত্যা আমি কখনোই সাপোর্ট করি না। তবে যে সন্তান আমার নয়, তার সম্পর্কে কোনও ডিসিশন নেওয়াও আমার এক্তিয়ারে পড়ে না। তুমি যা বুঝবে তাই করবে।
- ভ্রূণ-হত্যা কি আমি এমনি এমনি করতে চাইছি? মেয়েদের কাছে মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়া যে কত আনন্দের, তা তুমি কি বুঝবে? কিন্তু কি পরিচয়ে ও জন্ম নেবে বল? যে সন্তান গর্ভে আসাতেই এতো অশান্তি হচ্ছে, সে জন্মালে যে কি হবে তা তো বোঝাই যাচ্ছে।
- আমি তোমার এই সন্তানকে মেনে নিতে রাজি আছি। ও আমার পরিচয়েই বড় হবে। ওর প্রকৃত বাবা কে, তা আমি জানতেও চাই না। তুমি শুধু আমাকে একটু ভালোবাসা আর শান্তি দিও। রোজ রোজ এই অশান্তি আমি আর নিতে পারছি না।
- অশান্তি আমারও ভালো লাগে না। আর তোমাকে আমি ভীষণই ভালোবাসি। তবে রাতে বিছানায় শুয়ে কি যে আমার হয়! যাক, অ্যাবোরশনটা তাহলে আর করাচ্ছি না।
বেশ খুশি মনে ফোন রাখল ময়ূরাক্ষী। আমারও মনটা আনন্দে ভরে গেল। তাই পরদিন ভোরেই ওর মৃত্যুটাকে আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। আর আপনাকে সেদিন এইজন্যই ঐ মিথ্যে গুলো বলেছিলাম।
পলাশ প্রথমটায় এটা সেটা বলে অনেক কথা আড়াল করতে চাইলেও, গগনের জেরা আর ক্রস কোশ্চেনে ও সত্যিটা বলতে বাধ্য হল। শেষ পর্যন্ত পলাশ যা বলল,
- হ্যাঁ, ময়ূরাক্ষীর সাথে আমার শারীরিক সম্পর্ক ছিল। আমার সন্তানই ওর গর্ভে ছিল। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি ওকে খুন করিনি। ও মডেলিং করতে চেয়েছিল। আমি ওর কথামত ওকে একটা পোর্টফোলিও বানিয়ে দিয়েছিলাম। ওকে না জানিয়েই ওর একটা ছবি একটা ফিমেল ফ্যাশন ম্যাগাজিনে দিয়েছিলাম। ওর মৃত্যুর আগের দিন বিকেলে ওর সাথে দেখা করে, আমি ওকে এই খবরটা বলি। আর কিছু টাকাও ওকে দিয়েছিলাম। তারপর সেদিন ওকে নিয়ে আমাদের অ্যাড এজেন্সির ক্রিয়েটিভের সাথে মিট করিয়েছিলাম। উনি ওকে দেখে, আর ওর সাথে আলাপ পরিচয় সেরে বলেছিলেন,
- ইউ আর টু অ্যাট্রাক্টিভ। তোমাকে নিয়ে কাজ করতে আমাদের কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু তুমি তো এখন প্রেগন্যান্ট। এ অবস্থায় তোমার সাথে কাজ করি কি করে?
- আমি যদি অ্যাবোরসন করিয়ে নেই?
- সে করলে তোমাকে কাস্ট করতে আমাদের কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু এ কাজের জন্য অ্যাবোরসন করাবে?
- দাঁড়ান, আমি একটা ফোন করে, আপনাকে আমার ফাইনাল ডিসিশন জানাচ্ছি।
ময়ূরাক্ষী একটু আড়ালে গিয়ে একটা ফোন করে। তারপর ওনাকে জানায় যে ও অ্যাবোরসন করাবে না। ডেলিভারির কিছুদিন পর ও যোগাযোগ করবে। তখন যদি সম্ভব হয় ওকে যেন সিলেক্ট করা হয়।
আমরা তারপর ওখান থেকে বেড়িয়ে আসি। আমি ওকে বাড়ির কাছে পৌঁছে দিয়ে আমার কাজে চলে যাই।
তিন জনের সাথে কথা বলে বেশ রাত হয়ে যাওয়ায়, গগনের আর কাউকে কোনও জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় হয় নি।
গগনের গাড়িতে বসে বাড়ি ফিরতে ফিরতে তীর্থা বলল, এতক্ষণে বোঝা গেল যে ময়ূরাক্ষীর আগের দিন রাতের হ্যাপি মুডের কারণ কি।
আর কিছু কি বুঝতে পারলি? বাড়ি গিয়ে তোর ঐ সন্দেহভাজনের লিস্ট থেকে কয়েকটা নাম কেটে দিস। তা কোন কোন নাম কাটতে হবে কিছু বুঝতে পারছিস?
মনোজ আর সরোজের নামটা কেটেই দেওয়া যায়। তবে পলাশকে এখনো আমার একটু গোলমেলেই মনে হচ্ছে।
হু, একটা অঙ্ক কিছুতেই মেলাতে পারছি না। ভাবছি কাল সকালে একবার অন্বেষণ-দার সাথে দেখা করতে যাব। দেখি ওনার সাজেশনে কিছু কাজ হয় কি না। তুইও কাল আমার সাথে চল। আমার গুরুর সাথে সাক্ষাতটা সেরেই নে।
তীর্থা একটা খুশি খুশি লুক দিয়ে নিজের সম্মতি প্রকাশ করল।
(৭)
অন্বেষণ সবিস্তারে গগন ও তীর্থার থেকে সমস্ত ঘটনা, আর রেকর্ডিং গুলো শোনার পর বললেন, আমার তিনটে ব্যাপারে খটকা লাগছে। এক, ময়ূরাক্ষীর সেদিন বেরোনোর আগে অবিনাশকে খবরের কাগজ দিতে যাওয়া। দুই, একদিনে অ্যাকোনাইটাইনের শিশি শেষ। আর তিন, ময়ূরাক্ষীর মৃত্যুর ঠিক আগে ওর ওপর পলাশের এতটা সদয় হওয়া।
এতো “চন্দ্রবিন্দুর চ, বেড়ালের তালব্য শ, আর রুমালের মা” হয়ে গেল। গগনের মুখে মৃদু হাসি।
ব্যাপারটা মোটেও হাসির নয়। ভেবে দ্যাখ, ময়ূরাক্ষী ওর স্বপ্ন পূরণ করতে বেরোচ্ছে। তার ওপর তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে। সেই সময়ে ময়ূরাক্ষী, অবিনাশদের ঘরে খবরের কাগজ দিতে যাবে কেন? এটা অস্বাভাবিক নয়?
হ্যাঁ, ব্যাপারটা একটু অস্বাভাবিক বটেই।
সেকেন্ডলি, অ্যাকোনাইটাইনের শিশি একদিনের মধ্যে প্রায় খালি। যেখানে বোঝাই যাচ্ছে ময়ূরাক্ষী আত্মহত্যা করেনি। অথচ অ্যাকোনাইটাইনের শিশিতে ময়ূরাক্ষী ছাড়া কারো ফিঙ্গার প্রিন্ট নেই। এটাও কি স্বাভাবিক?
এই খটকাটা আমারও লেগেছে। তবে কোনও উত্তর খুঁজে পাইনি।
আর যে পলাশ, নানা ভাবে ময়ূরাক্ষীকে ব্যবহার করেছে। ময়ূরাক্ষীকে না জানিয়ে ওর ছবি ম্যাগাজিনে দিয়েছে। ওকে পারিশ্রমিক দেওয়া দূরে থাক, ম্যাগাজিনে ওর নাম পর্যন্ত ছাপেনি। সে পলাশ হঠাৎ ময়ূরাক্ষীর মৃত্যুর ঠিক আগে, ওকে না দেওয়া টাকা দিয়ে দিল? অ্যাড এজেন্সির ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টরের সাথে মিট করাল? ব্যাপারটা কেমন নাটকীয় লাগছে না?
অন্বেষণ দা, আপনি একদম ঠিক। দাঁড়ান একটু ভাবি। দেখি এর মধ্যে কোনও কানেকশন বের করা যায় কিনা? গগন একটু দূরে রাখা একটা চেয়ারে চলে গিয়ে একমনে ভাবতে লাগল।
তীর্থা, অন্বেষণকে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা জেঠু, ময়ূরাক্ষীর এই অতিরিক্ত শারীরিক চাহিদাই কি ওর মৃত্যুর কারণ?
খুব সম্ভবত সেটাই কারণ। তবে আমি ওর এরকম আচরণের মধ্যে দোষের কিছু দেখি না।
কি বলছেন জেঠু, পুরুষ দেখলেই এরকম হামলে পড়ে, তার যৌন সঙ্গী হতে চাওয়া দোষের নয়?
আচ্ছা কারো যদি বেশী খাওয়ার অভ্যাস থাকে, ক্ষিদে পেট থাকলে খাওয়ার দেখলেই যদি সে হামলে পড়ে, সেটা কি আমরা দোষের দেখি? যদি কেউ একটু বেশী ঘুম কাতুরে হয়, তাকেও আমরা দোষী সাব্যস্ত করি না। তাহলে যদি কারো সেক্সের চাহিদা বেশী থাকে, তবে কেন তা দোষের হবে? ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ঘুমের মত এটাও একটা বায়োলজিক্যাল নীড। ভেবে দ্যাখো সরোজ যদি ময়ূরাক্ষীর মিনিমাম নীডটাও পূর্ণ করতে পারতো, ও কি বাইরের কারো কাছে যেতো? মেয়েদের এরকম সমস্যা থাকলে আমরা তাকে নানা ভাবে দোষারোপ করি। এসব কারণে ডিভোর্স হতেও আমি শুনেছি। আর স্ত্রীর কোনও সমস্যা না থাকলেও অনেক পুরুষরা অন্য নারী আসক্ত হয়ে পড়ে। সেটাও সমাজ মেনে নেয়। কিন্তু উল্টোটা ঘটলে সমাজে ছিঃ ছিঃ রব ওঠে।
সরোজ বলেছে যে, ওর সাধ্য মত চেষ্টা করেছে।
বাজে কথা। ও কী চেষ্টা করেছে? ওর এই সমস্যাটা নিয়ে, কোনও ডাক্তারের সাথে আলোচনা করেছে কখনও? প্রপার ট্রিটমেন্ট করিয়েছে? নিজের অক্ষমতা ঢাকতে স্ত্রীকে কি বেশী সময় দিয়েছে? উল্টো স্ত্রী অন্য পুরুষের সঙ্গিনী হলে, তাকে দোষারোপ করতেও ছাড়েনি।
কথাটা আপনি ঠিকই বলেছেন জেঠু। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও সমাজের চোখে নারী পুরুষ সমান হয়ে উঠল না।
গগন হঠাৎ লাফিয়ে উঠে বলল, পেয়েছি অন্বেষণ দা। আপনার তিনটে ডাউটের মধ্যে একটা লিঙ্ক খুঁজে পেয়েছি। আমাকে এখুনি একটা মজুমদার বাড়িতে ফোন করতে হবে। বলেই পকেট থেকে মোবাইল বের করে রিং করে গগন।
অনেকক্ষণ রিং হওয়ার পর ফোন ধরল তনুজা।
- আমি গগন বলছি। অবিনাশ বাবু বা ওনার স্ত্রী আছেন?
- না বাবা একটু বেড়িয়েছেন। আর মা বাথরুমে গিয়েছেন।
- ও, সেই জন্যই ফোন ধরতে একটু দেরী হল?
- হ্যাঁ, আমি পাশের ঘরে ছিলাম। তাছাড়া এই ঘরটা বেশ অগোছালো হয়ে আছে। ঘরে ঢুকেও তাই ফোন ধরতে একটু সমস্যা হচ্ছিল।
- অগোছালো কেন?
- মার একটা কানের দুল হারিয়ে গিয়েছিল। তাই দুজন মিস্ত্রী মিলে খাট, আলমারি সরিয়েছে।
- তা দুল পাওয়া গেল?
- দুল তো পাওয়াই গেছে। সঙ্গে আরও অনেক কিছু পাওয়া গেছে।
- কি কি পাওয়া গেল?
- একটা চিরুনি, দুটো পেন, একটা ভেসলিনের কৌটো, একটা টেবলেটের পাতা, চুলের ক্লিপ, টুকটাক আরও অনেক কিছু।
- ঠিক আছে। ঘর যেমন আছে, তেমনই যেন থাকে। আমি এখুনি আসছি। আমি না যাওয়া পর্যন্ত কোনও কিছু সরানো বা পরিষ্কার করার দরকার নেই।
ফোন রেখে গগন বলল, অন্বেষণ দা আপনার গ্লাভস জোড়া দিন তো। বাড়ি গিয়ে আমারটা নিতে গেলে দেরী হয়ে যাবে।
অন্বেষণ, ওনার গ্লাভস জোড়া দিলে, গগন ওটা নিয়ে তীর্থাকে সঙ্গে নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মজুমদার বাড়ি পৌঁছল। ওখানে পৌঁছে দোতালায় উঠতে উঠতেই গ্লাভস দুটো হাতে পড়ে নিলো ও। দোতালায় উঠে গগনরা সোজা অবিনাশদের ঘরে ঢুকল। কাকলী তখন স্নান ও ঠাকুর ঘরের কাজ সেরে অনেকদিন পর খুঁজে পাওয়া ভেসলিনের কৌটো হাতে নিয়ে মাখতে যাচ্ছেন। কৌটো বেশ বড় মাপের। ঠিক এরকম একটাই ময়ূরাক্ষীর ঘরে পাওয়া গিয়েছিল। গগন ওনার হাত থেকে ছোঁ মেরে কৌটোটা নিয়ে নিলো। তারপর ঘরটা একটু ভালো করে দেখে, কারো প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলো। আর বেড়িয়ে আসার সময় বলে এলো, আমি সন্ধ্যে নাগাদ আসবো। সবাই যেন অবশ্যই থাকে।
ওখান থেকে বেড়িয়ে অনীক মিত্রের ল্যাবে গিয়ে ভেসলিনের কৌটোটা দিল গগন। আর বলল টেস্ট হয়ে গেলেই যেন উনি রিপোর্টটা গগনকে ফোন করে জানায়। ওখানে যাওয়া বা ফেরার পথে তীর্থার কোনও প্রশ্নের উত্তর দিল না গগন। শুধু বলল, মীনাক্ষীদের বাড়িতে একটা ফোন করে দে। ওরা যেন সবাই সন্ধ্যার সময় মজুমদার বাড়িতে পৌঁছে যায়।
(৮)
কথামত সন্ধ্যা নাগাদ সকলেই মজুমদার বাড়িতে জমায়েত হয়েছে। প্রসেনজিত মণ্ডল ও তার দুই সাকরেদ নিয়ে এসে হাজির। অবিনাশ মজুমদার একটু আগেই তার বন্ধুর বাড়ি নিমন্ত্রণ খেয়ে ফিরেছেন। বাড়ি ফিরে এতো লোকের সমাগম দেখে তিনি অবাক হয়ে গেছেন। গগন আসার সময় অন্বেষণকে ওনার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে এসেছে।
গগন প্রথমে পলাশের উদ্দেশ্যে বলল, পলাশ বাবু আপনি যে হঠাৎ ময়ূরাক্ষীর মৃত্যুর ঠিক আগে, ওকে ওর প্রাপ্য টাকা দিয়ে দিলেন, অ্যাড এজেন্সির ক্রিয়েটিভ ডিরেকটরের সাথে মিট করালেন, এটা কি আপনার বুদ্ধিতেই করেছেন? নাকি কারো কথায় এ কাজ করেছেন। একদম কিছু লোকাবার চেষ্টা করবেন না। সত্যি বললে আপনার কোনও ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
পলাশ বলল, না ওগুলো আমি ঠিক আমার ইচ্ছেতে করিনি। ময়ূরাক্ষীর ব্ল্যাক-মেলের হুমকি, আর শ্বশুর মশাই-এর রিকোয়েস্টে ওগুলো করতে বাধ্য হয়েছিলাম।
ময়ূরাক্ষীর হুমকিটা অনুমান করতে পারছি। অবিনাশ বাবুর রিকোয়েস্টটা কি ছিল?
উনি আমাকে বলেছিলেন, ময়ূরাক্ষীর মুখটা সবসময় ভার হয়ে থাকে। সরোজ ওকে একদম সময় দেয় না। ও অন্তঃসত্ত্বা। এই সময় ওকে আমি একটু হাসিখুশি দেখতে চাই। তুমি আমার থেকে যা টাকা লাগে নিয়ে যাও। ওকে নিয়ে একটু বের হও।
তা, এই কথা আমাকে আগে বলেন নি কেন পলাশ বাবু?
আসলে ময়ূরাক্ষীকে খুশি করার ক্রেডিটটা আমি একাই নিতে চেয়েছিলাম। যাতে আমার দোষ গুলো সব কেটে যায়।
অবিনাশ বাবু, আপনি ময়ূরাক্ষীকে একটু বেশীই স্নেহ করতেন। তাই না?
তা তো করতামই। তাইতো ওর মুখ ভার থাকলে আমার সহ্য হত না।
তা সেদিন ময়ূরাক্ষী বেরোনোর আগে আপনার ঘরে এসেছিল কেন?
কেন আবার? বেরোবার আগে অনুমতি চাইতে এসেছিল।
তাই কি? নাকি কোনও কিছু দিতে এসেছিল।
ও হ্যাঁ। খবরের কাগজ দিতে এসেছিল।
মিথ্যে কথা। আপনি চেয়েছিলেন বলে অ্যাকোনাইটাইনের শিশিটা দিতে এসেছিল।
আমার ঘরেই অ্যাকোনাইটাইন রয়েছে। আমি আবার ওর কাছে চাইতে যাবো কেন?
আপনার ঘরের অ্যাকোনাইটে তো আর ময়ূরাক্ষীর হাতের ছাপ নেই। আর সেই জন্যই ময়ূরাক্ষী শিশিটা নিজে হাতে না নিয়ে টেবিলে রাখতে বলেছিলেন।
দেখুন আপনি কি বলছেন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আর এর সাথে ময়ূরাক্ষীর মৃত্যুর কি সম্পর্ক আছে?
সম্পর্ক তো নিশ্চয়ই আছে। আপনি বোটানির প্রফেসর ছিলেন। তাই অ্যাকোনিটাম গাছটি যে সাংঘাতিক বিষাক্ত, সেটা আপনার ভালো ভাবেই জানা আছে। সেই জন্য এটাকেই আপনি খুনের অস্ত্র হিসেবে বেছে নিলেন। আপনি হাতে রুমাল বেধে ঐ অ্যাকোনাইটাইন, ভেসলিনের সাথে মিশিয়েছেন। তারপর হাতে রুমাল বেধেই সেটা ময়ূরাক্ষীর ঘরে রেখে, ওর ঘরের ভেসলিনটা নিজের ঘরে নিয়ে এসে লুকিয়ে ফেলেন। আর সেই কাজটা যেন আপনি নির্বিঘ্নে করতে পারেন সেইজন্য, সরোজকে বলে ওকে বাড়ি থেকে বের করতে চেয়ে ছিলেন। কিন্তু সরোজ রাজি না হওয়ায়, পলাশকে বলে ময়ূরাক্ষীর বাইরে বেরোনোর ব্যবস্থা করেন। প্রতিদিন রাত্রেই যে ময়ূরাক্ষী হাতে, মুখে, বুকে ভেসলিন মেখে শুতো, তা আপনার জানা ছিল। আপনার প্ল্যান মাফিকই কাজ হল। ঘরের আবছা আলোতে ময়ূরাক্ষী প্রতিদিনের অভ্যাস মত ভেসলিন গায়ে মাখল। অ্যাকোনাইটাইন ওর শরীরে অত্যধিক পরিমাণে যাওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই ও প্রাণ হারাল। আর একটা সার্টেন টাইমের পর হিউম্যান বডি অ্যাকোনাইটাইন অ্যাবর্জব করে নেয়। তাই ময়না তদন্তেও কোনও কিছু বোঝা গেল না। সকাল বেলায় মনোজ যখন ময়ূরাক্ষীকে দেখে ডঃ বিশ্বাসকে ডাকতে যায়, সরোজ তখন টয়লেটে। আপনি সেই সুযোগে হাতে রুমাল বেধে অ্যাকোনাইটাইনের প্রায় খালি শিশিটা, যেটাতে ময়ূরাক্ষীর ফিঙ্গার প্রিন্ট রয়েছে, তা ওর ওষুধের শিশির পাশে রেখে দেন। আর ভেসলিনের কৌটো, যেটা ময়ূরাক্ষীর ঘরে ছিল, সেটা যথা স্থানে রেখে, আপনার অ্যাকোনাইটাইন মাখানো কৌটোটা ওখান থেকে সরিয়ে আপনার গায়ের চাদরের ভেতরে নিয়ে এসে, আপনার ঘরের খাট ও দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে ফেলে দেন। ফাঁকটা এতোই ছোটো যে কারো হাত ঢোকানো সম্ভব নয়। আর আপনার খাটটাও নড়ানো সহজ নয়। আমরা সারা বাড়ি ভাল ভাবে পর্যবেক্ষন করলেও ওটা নজরে আসে নি। আপনার স্ত্রীর কানের দুল না হারালে ওটা হয়তো আমাদের হাতে পড়তোই না।
কি সব মন বানানো আষাঢ়ে গল্প বলছেন! এসব প্রমাণ করতে পারবেন?
অবশ্যই পারবো। আপনার খাটের পাশ থেকে যে ভেসলিনের কৌটো পাওয়া গেছে, তাতে অ্যাকোনাইটাইন পরিমাণ অত্যধিক। আর তাতে ময়ূরাক্ষী, আপনার আর আপনার স্ত্রীর হাতের ছাপ পাওয়া গেছে। আপনি জানেন, ঐ ভেসলিনের কৌটো থেকে আপনার স্ত্রী ভেসলিন মাখতে যাচ্ছিলেন। আমি যদি সময় মত ওখানে না পৌঁছতাম, আপনার স্ত্রীর অবস্থাও ময়ূরাক্ষীর মতোই হত।
সেকি তুমি ঐ ভেসলিন গায়ে মাখছিলে? রীতিমত আঁতকে উঠে কাকলী কে ধমকে উঠলেন অবিনাশ।
ওতে যদি কিছুই না থাকবে, আপনি এতো আঁতকে উঠছেন কেন? এই বয়সে এরকম একটা জঘন্য অপরাধ কেন করতে গেলেন? বেশ রুক্ষ ভাবে কথাটা বলল গগন।
কি করবো? ময়ূরাক্ষীর ব্যভিচার যে আর সহ্য হচ্ছিল না। আমার জামাইয়ের সাথে শারীরিক সম্পর্ক, আমার বড় ছেলের সাথে ঢলাঢলি, এমন কি এ.সি সারাতে আসা লোককেও ও শারীরিক প্রলোভন দেখিয়ে উত্তপ্ত করতে চেষ্টা করেছে। ওকে নিয়ে আমার বাড়িতে অশান্তির শেষ নেই। ওর জন্য আমার মেয়ে জামাইয়ের মধ্যে ঝগড়া, মনোমালিন্য লেগেই আছে। ওকে নিয়ে আমার বড় ছেলে ও বৌমার মধ্যে অশান্তির শেষ নেই। ওকে বিয়ে করে আমার ছোটো ছেলেটা মানসিক অবসাদে ভুগছে। ওর আচরণ, চাল-চলন, পোশাক পরার ধরন, কথাবার্তা কোনও কিছুই আমার স্ত্রীর পছন্দ নয়। তাই ওকে নিয়ে আমার স্ত্রীর সঙ্গে আমার ঝগড়া ঝাটি মত-বিরোধ প্রায়শই লেগে থাকতো। সবার অপছন্দ স্বত্বেও ময়ূরাক্ষীকে আমি এই ঘরের বৌ করে আনি। তাই ওর বিরুদ্ধে সব অভিযোগ গালি-গালাজ আমাকেই শুনতে হোতো। আর এই সবকিছুর জন্য আমি সর্বক্ষণ একটা অপরাধ বোধে ভুগতাম। তবু কোনদিন ময়ূরাক্ষীকে মুখ ফুটে কিছু বলিনি। কিন্তু এক সময়ে সহ্যের বাঁধ ভেঙে গেল। ঠিক করলাম ওকে পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দেবো।
এবার যে আপনাকে থানায় যেতে হবে অবিনাশ বাবু।
হ্যাঁ, চলুন। তার আগে কি এক মিনিট সময় পাওয়া যাবে? আমি একটু তৈরি হয়ে নিতাম।
বেশ নিন। তবে বেশী দেরী করবেন না।
অবিনাশ বাবু ওনার ঘরে ঢোকার মিনিট খানেকের মধ্যেই একটা মেঝেতে কেউ পড়ে যাওয়ার আওয়াজ হল। সবাই ছুটে গিয়ে দেখলেন অবিনাশ বাবু মেঝেতে পড়ে আছেন। হাতে আকোনাইটের শিশি। সম্পূর্ণ আকোনাইটটাই মুখে ঢেলে দিয়েছেন অবিনাশ বাবু।
বাবা তুমি একি করলে? মনোজ ও সরোজ ছুটে গেল বাবার কাছে।
চিরকাল মাথা উঁচু করে বেঁচেছি। জেলের ভাত আমার সহ্য হবে নারে। আমি চললাম। তোদের মাকে দেখিস। কথাগুলো কোনোরকমে বলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন অবিনাশ মজুমদার।ঘর শুদ্ধ লোক আরো একটা মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে, স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
সমাপ্ত

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.