নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মনো মোর মেঘের সংগে!

জিন্নুরাইন

আমি গান লিখি আপনার সুখে তুমি কেন আসি দাঁড়াও সুমুখে?

জিন্নুরাইন › বিস্তারিত পোস্টঃ

জলিংগেন, জার্মানী থেকে ফিরে

০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ২:৪৯

মানুষের জীবন বড়ই বৈচিত্র্যময়। নদী মাতৃক বাংলাদেশের এক প্রান্তে কর্নফুলী নদী জন্মেছিল লুসাই পাহাড় শিখরে, তারপর প্রচণ্ড জলরাশির স্রোত দিনে দিনে চড়াই উৎরাই পার হয়ে একে বেঁকে অবশেষে এসে জীবন বিসর্জন দিয়েছে বংগোপসাগের। সেই বিসর্জনের মোহনার নাম “আনোয়ারা” আর সেই মোহনায় এক মহেন্দ্রক্ষনে জন্ম নিয়ে ধীরে ধীরে জীবন স্রোতের বানে কোথা থেকে কোথায় যে চলেছি সেটা নিয়ন্ত্রণ করা বড়ই দুঃসাধ্য।



১৯৬৬ সালে সিলেট আম্বরখানা পাঠশালায় পঞ্চম শ্রেণিতে পাঠরত অবস্থায় গড়ে উঠা সম্পর্ক ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে। সহপাঠী হিসাবে পরিচিতি, সেই থেকে সহগামী, সহযোগী, পরামর্শিক, সাহায্যকারী, সমালোচক ঐ সকল স্তর পেরিয়ে বন্ধুত্ব। জাপানী কাঞ্জীতে বন্ধুত্ব হচ্ছে “তমদাচী”, “শিতাশিমী তমদাচী” ভালো বন্ধুত্ব আর “শিনইউ” হচ্ছে সবচেয়ে ভালো বন্ধু। শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য, যৌবন পেরিয়ে বার্ধক্য আজ নিকটবর্তী, কিন্তু আমাদের সেই বন্ধুত্ব আজো অটুট আছে আর সেই বন্ধুত্বের সুবাদে আজ আমি এসেছি জার্মানির জলিংগেন শহরে জানিনা আমাদের এই বন্ধুত্ব কি “তমদাচী” নাকি “শিতাশিমী” নাকি “শিনইউ”।



ডেভিড থরু বলেন, “বন্ধুত্বের ভাষা শব্দ দিয়ে নয় বরং অভিপ্রায়ের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়”। ভালো বন্ধুত্ত্বের জন্য চাই বিশ্বস্ততা, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, প্রশংসা আর আকাঙ্ক্ষা। তাই হলুদ গোলাপ বিশ্বস্ততার প্রতীক, ফ্রিসিয়া হচ্ছে বিশ্বাস, লাল কারমেশন হচ্ছে শ্রদ্ধা ও প্রশংসার , আনুগত্যের প্রতীক হচ্ছে ডেইজি, আর আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হচ্ছে আইরিস ফুল।



বিশ্বখ্যাত দার্শনিক ও পণ্ডিত সক্রেটিস এর নিকট এক পরিচিত ব্যাক্তি একদিন এসে বললেন, “জানেন নাকি আপনার বন্ধু সম্পর্কে একটুক্ষণ আগে কি জানতে পারলাম?” সক্রেটিস বললেন, “এক মিনিট; আমার বন্ধু সম্পর্কে কিছু বলার আগে আমি চাই যে আপনি একটি ছোট্ট পরীক্ষা দিন, এটাকে বলা হয় ট্রিপল ফিল্টার টেস্ট!”

“ট্রিপল ফিল্টার টেস্ট?”

সক্রেটিস বললেন, “ঠিক বলেছেন, প্রথম ফিলটার হচ্ছে সত্যতা! আপনি যা শুনেছেন তার সত্যতা কি আগে যাচাই করে নিয়েছেন?”

ভদ্রলোক বললেন, “না তা করিনি, আসলে আমি ব্যাপারটা সম্পর্কে শুনলাম মাত্র”

“ওঃ তাহলে আপনি যা বলবেন সেটা সত্য কি মিথ্যা তা আপনি জানেন না, তাই? কোন অসুবিধা নেই, চলেন আমরা দ্বিতীয় ফিল্টার করে দেখি। দ্বিতীয় ফিল্টার হচ্ছে, ভালোত্ব। আপনি আমার বন্ধু সম্পর্কে যা বলবেন তা নিশ্চয়ই কিছু একটা ভালো হবে, তাইনা?”

ভদ্রলোক বললেন, “আসলে ঠিক ভালো ব্যাপারে না”

সক্রেটিস বললেন, “ওঃ আপনি আমার বন্ধু সম্পর্কে খারাপ কিছু একটা বলতে চাচ্ছেন আর সেটা কি সত্য নাকি মিথ্যা তা আপনি জানেন না তাইনা? কোন অসুবিধা নেই চলুন আমরা তৃতীয় ফিল্টার দেখি! তৃতীয় ফিল্টার পাশ করলেই চলবে! তৃতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি যা বলবেন তা নিশ্চয়ই আমাদের জন্য উপকারী হবে, তাইনা?”

ভদ্রলোক বললেন, “সেটাও না”

সক্রেটিস তখন বললেন, “আপনি যা বলতে যাচ্ছেন সেটা যদি সত্য না হয়, ভালো না হয় আর উপকারীও না হয় তাহলে সেটা বলার কি আদৌ কোন প্রয়োজন আছে?”

ভদ্রলোক লজ্জিত হয়ে বিদায় নিলেন। তাই সবাইকে বলি, বন্ধু, সুহৃদ কিংবা আত্নীয়দের সম্পর্কে কিছু শোনার আগে ট্রিপল ফিল্টার টেস্ট করে নিন।



ডাবলিন থেকে রায়ান এয়ারের প্লেনে চড়ে কলন-বন আসতে লাগে দুই ঘণ্টা। এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন পার হয়ে বাইরে আসতেই দেখা গেল বন্ধু সাকী এপল এর টেবলেট হাতে আর বগলে একটা আতেল ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে আসছেন। আবেগের প্রথম প্রকাশে বুক মিলান ত হল, কিন্তু তাকে দেখে মনে হল আমারও বয়স হয়েছে যথেষ্ঠ। যদিও কাল রং করা ঘন চুল আর গোঁফ জোড়া তাকে যথেষ্ট তারুণ্যের মাত্রা দিয়েছে কিন্তু সারা মাথা ব্যাপী বিরাট টাক আর সাদা দাড়ি আমাকে যে বার্ধক্যের সৌন্দর্য্য দিয়েছে যা আমার মনের কোথাও কোন ছাপ রাখেনি সেটা ভেবে বড়ই আশ্চর্য্য হলাম।



সাকীর সাথে সামনা সামনি দেখা হল ৩ বছর পর কিন্তু ফেইসবুক আর টেলিফোনের সুবাদে প্রায় প্রতিদিন যোগাযোগের কারণে কখনো সেটা মনে হয়নি। আজ দেখা হওয়ার পর এটা উপলব্ধি হল যে আমাদের বয়স হয়েছে আর আমরা একে অপরকে দেখছি বেশ কিছুদিন পর। কলন আর বন শহরের মাঝামাঝি অবস্থানের কারণেই বিমান বন্দরের নাম কলন-বন। আমি প্রায়শই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঘোরাফেরা করি বিভিন্ন কারনে কিন্তু খুব কম বিমানবন্দরে পাসপোর্ট দেখানোর প্রয়োজন হয়। কলন-বন এর একটা ব্যাতিক্রম, ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা ভালভাবে দেখেই আমাকে আতিথেয়তা দেখালেন। মনে একটু খটকাই লাগল ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন হওয়ার সুবাদে একবার ইউরোপের কোন একটা দেশে ঢুকে পড়লে সাধারণত আর পাসপোর্ট দেখানোর প্রয়োজন হয়না কিন্তু জার্মানী বলে কথা, ওদের রক্ত নীল আর আমাদের চামড়া কালো। অবশ্য সবারই পাসপোর্ট দেখা হচ্ছিল আন্তরিকতার সাথে।



সাকীর গাড়িতে উঠলাম, আনকোরা নূতন গাড়ি শব্দ নেই বললেই চলে টয়োটা আউরিস ব্যাটারি ও পেট্রোল দুটোতেই চলে। সেই গাড়িতে করে আমাদের পথচলা শুরু হল মাত্র, আর সেই সাথে গল্প। সাকী জানালেন, আজ থেকে ৩৫ বছর আগে প্রথম যখন জার্মানী এসেছিলেন তখন ছিলেন বয়সে তরুণ।



আমরা যখন এইচ এস সি পরীক্ষা দেই তার কিছুদিন আগে তার পিতা অসুস্থ হয়ে সিলেট হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। আমি আর জসীম তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। তিনি আমাদের বলেছিলেন যে তিনি সাকীর মধ্যে তার লালিত স্বপ্নের প্রতিফলন দেখতে চান। তাই তিনি তাকে একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে প্রস্ফুটিত দেখতে চান। ছাত্র হিসাবে সাকী আমাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তাই তখনকার সমাজের সাধারণ আকাঙ্ক্ষার ব্যাতিক্রম ছিল তার পিতা জনাব শফিকুল হক চৌধুরী সাহেবের স্বপ্ন; চিন্তা ভাবনা ছিল অত্যন্ত উচ্চ, তাই তার সন্তানকে তিনি শিক্ষিত সমাজ তৈরির কারিগর হিসাবে দেখতে চেয়েছিলেন। ভাগ্যের পরিহাস সেই রোগ থেকে তিনি আর আরোগ্য লাভ করতে পারেন নি।



পিতার অকাল মৃত্যুর কারণে জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসাবে ৯ ভাই বোনের এক বিরাট পরিবারের সকল দায়িত্ব নেমে আসে সেদিনের সেই তরুণ সাকীর কাঁধে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ইতি দিয়ে পিতার চাকুরীস্থল সিলেট আদালতে তিনি তার কর্মজীবন শুরু করেন। একদিকে বাংলাদেশের অস্থির রাজনৈতিক অবস্থা আর অন্যদিকে অর্থনৈতিক দুরবস্থা সব মিলিয়ে এক অসুস্থ সময় পার করেন তখন। ভাবতে থাকেন ভাগ্যোন্নয়নের কথা আর তারি ফাঁকে সুযোগ আসে জার্মানী চলে আসার। চাচাত ভাইয়ের প্রস্তাবে চাচীর সহগামী হয়ে পাড়ি জমান জার্মানীর জলিংগেন শহরে।



জার্মানীতে এসে চাচাত ভাইয়ের বাসায় কয়েক দিন অবস্থানের পর চাচাত ভাইয়ের সুবাদে অন্য এক শহরে বাসস্থান হয় আর শুরু হয় জীবনের নূতন সংগ্রাম। প্রথম কাজ করেন এক হোটেলে তারপর মেকডনাল্ড নামক ফাস্ট ফুডের দোকানে। এর পরই যোগ দেন ব্লেড ইন্ডাস্ট্রিতে। ব্লেড ইন্ডাস্ট্রিতে যোগ দেবার পর উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ পান আর তখন ডিপ্লোমা টেকনিকা পড়েন সাকী, ডিপ্লোমা টেকনিকা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের ডিপ্লোমা ইঞ্জিন্যারিং এর সমকক্ষ, যদিও এর মান জার্মানীর আলোকে ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক; তারপর আবার সেই ব্লেড ইন্ডাস্ট্রি যেখানে আজো তিনি দক্ষতা ও সুনামের সাথে কাজ করছেন।



প্রথম হতাশা আর সংগ্রামের জীবনে কিছুদিন দেশে পরিবারের সাথে কোন যোগাযোগ না রাখলেও অর্থ পাঠাতে ব্যাত্যয় ঘটান নি। ইতিমধ্যে পরিচয় হয় জার্মানী কন্যা এনেটের সাথে, এই পরিচয় সূত্রে পরিণয়। খুব অমায়িক, নম্র, ভদ্র আর সজ্জন বন্ধু পত্নী এনেটে। ১৯৮৯ সালে প্রথম বাংলাদেশে গেলেন, আর সেবারই আমি আর ফারহানা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। শৈশবের বন্ধু সাকী আর তদীয় পত্নী এনেটে আমাদের বিবাহের কয়েকটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন তাই মনে ছিল কি যে আনন্দ।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:২০

দীঘল গঁাােয়র েছেল বলেছেন: মানুষের জীবন বড়ই বৈচিত্র্যময়। পড়ে ভাল লাগল।

২| ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ৮:০১

অপূর্ণ রায়হান বলেছেন: আপনার জন্য শুভকামনা রইল ভ্রাতা।।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.