নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আসুন উদারতা দিয়ে বিশ্ব জয় করি।

যুবায়ের বিন রিয়াজ

হাঁয় বন্ধু! আমি হাসিখুশি একজন তরুণ। হাসতে ও হাসাতে ভালোবাসি। লেখতে ভালোবাসি। ভালোবাসি মানুষের সেবা করতে।

যুবায়ের বিন রিয়াজ › বিস্তারিত পোস্টঃ

শামিম শিকদার!

২৫ শে অক্টোবর, ২০১৩ বিকাল ৪:৫৯



দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন : ২৫/১০/২০১৩

নাম : শামীম শিকদার

জন্ম : ২২ অক্টোবর, ১৯৫২

পেশা : ভাস্কর

শিক্ষাজীবন : বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, লন্ডনের স্যার জন স্কুল অব আর্টস ও কেনসিংটন অ্যান্ড চেলসি কলেজ।

কর্মজীবন : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ভাস্কর্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে ফ্রিল্যান্স ভাস্কর হিসেবে কাজ করছেন।



প্রদর্শনী : ১৯৭৫ সালে চারুকলা ইনস্টিটিউটে আমার প্রথম একক প্রদর্শনী হয়। ১৯৭৬ সালে লন্ডনের কমনওয়েলথ ইনস্টিটিউটে, ১৯৮২ সালে প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেল ও শিল্পকলা একাডেমিতে আমার ভাস্কর্যের প্রদর্শনী হয়। এ ছাড়া বেশ কিছু একক ও দলগত প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছি।



প্রকাশিত গ্রন্' :'Inner Truth of Sculpture; Sculpture Coming From Heaven and Inborn Fighter.....



শখ : ছবি আঁকা, জুডো, কারাতে, শুটিং, বাগান করা ও গাড়ি চালানো। এ ছাড়া কবিতা, সংগীত ও নাটকের ব্যাপারে আগ্রহ রয়েছে।



ব্যক্তিগত জীবন : স্বামী কবি জাকারিয়া চৌধুরী।



তাঁর একটি সাক্ষাৎকারঃ-

দ্য লিভিং লিজেন্ড

আপনার শৈশব-কৈশোর কোথায় কেটেছে।



আমার বাবা কৃষি অফিসার ছিলেন। পটুয়াখালীতে বাবা সরকারি যে বাসা পেয়েছিলেন তার নিচে ছিল অফিস, উপরে থাকার জায়গা। আমাদের বাড়ির কাছেই ছিল নদী। তখন আমার বয়স ছয়-সাত বছর হবে। আমরা অনেক ভাইবোন ছিলাম। নুরু ভাইকে [নুরুল হক শিকদার] দেখভালের দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। ছোটবেলায় মা আমাদের কাজ ভাগ করে দিতেন। একদিন বারান্দায় ছোট ভাইকে ঘুম পাড়িয়ে ছোট ছোট হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে খেলছি। আমাদের জালানায় ছিল চটের পর্দা। আমি ম্যাচ দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে খেলছিলাম। হঠাৎ চটের পর্দায় আগুন ধরে যায়। দাউ দাউ জ্বলছে। আমি দাঁড়াইয়া আগুন দেখছি। আগুনের বিভিন্ন রঙ। কত সুন্দর! আমার কিন্তু খেয়াল নেই, আমি কিংবা নুরু ভাই আগুনে পুড়ে যাব। চারদিকে চিৎকার। কে জানি আমার পেছনের চুল ধরে টেনে নিয়ে গেল। নুরু ভাইকেও নিল। মা আমাকে নিয়ে নদীর পানিতে অনেকক্ষণ চুবাল আর বলল, আর এসব করবি আমি বললাম আর করব না। সেদিন মানুষজন এসে আগুন নিভিয়ে ফেলেছিল। কোনো ক্ষতি হয়নি। ছোটবেলা থেকে আমার পরিবার আমাকে নেগলেট করত। পড়াশোনায় মন ছিল না। কেবল গল্পের বই পড়তে আমার ভালো লাগত।



ছেলেবেলার কোনো স্মৃতি আপনার মনে দাগ কেটে আছে



ছোটবেলায় আমার অনেক স্মৃতি আছে। আমাদের সবার বড় ভাই ছিল বাদশা আলম শিকদার। সিরাজ শিকদার আর আমি ছিলাম পিঠাপিঠি। সিরাজ ভাইও তখন ছোট। স্কুলে পড়ে। আমরা মাঝে মাঝে চকলেট খেতে কিংবা ঘুড়ি উড়ানোর জন্য ম্থার কাছে পয়সা চাইতাম। পয়সা না দিলে সিরাজ ভাই টিনের চালের ওপর উঠে লাফাইত। কখনো হয়তো দুই-পাঁচ টাকা দিত; তাই দিয়ে আমরা ঘুড়ি উড়াতাম, মাঞ্জা মারতাম। পটুয়াখালী তিন বছর থাকার পর আমরা চলে যাই বরিশালের উজিরপুর। আমি তেমন পড়তাম না, ঘুরে বেড়াতাম। অধিকাংশ হিন্দু পরিবার বাস করত। হিন্দু ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমরা ঘুরে বেড়াতাম। আমরা যে বিল্ডিংয়ে থাকতাম ওই বাড়ির ছাদের কার্নিশের চারদিকজুড়ে ছোট ছোট অনেক ভাস্কর্য ছিল, সেগুলো আমার ভালো লাগত। আমাদের বাড়ির পাশে বিশাল নদী ছিল। ওই নদীতে আমরা সাঁতার কাটতাম। উজিরপুরে প্রচুর জঙ্গল ছিল। জঙ্গলে গিয়ে ফড়িং ধরা, আর পাখি শিকার ছিল নেশার মতো। গাছে চড়ে নারিকেল ও বেল পাড়তাম। সিরাজ ভাই আর আমি একদিন ঘুরতে গিয়ে দাঁড়াশ সাপের তাড়া খেয়েছিলাম। ওই সময় একটি পাখি শিকার করে বাড়িতে খাঁচায় বন্দী করি। এর পর দুজনেরই ভয়ানক জ্বর এলো। ভাইয়া বলল, দাঁড়াশ সাপের দৌড়ানি আর পাখি ধরা দুই মিলে জ্বর আসছে। পরে পাখিটি ছেড়ে দিলাম। সবচেয়ে মজা পেতাম সাপ ধরে। গাছের ডালে যে সবুজ সাপ থাকে ওর লেজ ধরে ঘুরাইতাম। বেহুলা লখিন্দরের বাসরঘর নিয়ে আমাদের আগ্রহ ছিল। এ জন্য প্রচুর সাপ মেরেছি। মনে পড়ে, একদিন এক হিন্দুবাড়িতে গোখরা সাপ ছোট্ট বাচ্চার সঙ্গে খেলছিল। বাচ্চাটিকে সে কামড়ায় না। ওরা আমাকে সাপটি ধরার জন্য ডাক দেয়। আমি গিয়ে সাপটা মারি। আমি পাঠশালায় পড়লেও পড়াশোনা কখনো আমার ভালো লাগত না। পাঠশালার টিচার মেয়েদের জামা তুলে পেছনে বেত দিয়ে পিটাইত। ওই পাঠশালায় ডিসির মেয়ে পড়ত আমাদের সঙ্গে। সে ছিল একটু হাবাগোবা। পড়া পারত না। একদিন ওকে বললাম, তুই এক কাজ কর, তোর বাসায় ছেঁড়া প্যান্ট না থাকলে কাঁচি দিয়ে কেটে ওই প্যান্ট পরে স্কুলে আসবি। আমার কথামতো ও স্কুলে এলো। প্রথমেই ওর ডাক পড়ল। টিচার ওকে পিটাইতে গিয়েই দেখল, প্যান্ট ছেঁড়া; তারপর থেকে মেয়েদের পেটানো বন্ধ। পটুয়াখালী জুবলি স্কুলে সার্কাস হতো। রাতে বাড়ি থেকে পালিয়ে সার্কাস দেখতে যেতাম। অনেক সময় সার্কাসের মাঠে চেয়ারে ঘুমিয়ে পড়তাম। সকালে বাসায় ফিরে দেখতাম আমাকে পেটানোর জন্য বাবা-মা অপেক্ষা করছেন। বাবা বলত আসো, আসো। আমি বলতাম, তোমরা ভেতরে যাও নতুবা বাড়ি ঢুকব না। পরে আমি রেলিং বেয়ে দোতলার বারান্দায় গিয়ে ঘুমাতাম।



আপনি কখনো ভেবেছিলেন ভাস্কর বা শিল্পী হবেন



ছোটবেলায় বাবার চাকরি সূত্রে আমরা পটুয়াখালী ও বরিশালে ছিলাম। নদীতে খেলতে গিয়ে বালুর ভাস্কর্য তৈরি করতাম। জেলেরা লাঠিগেড়ে জাল ফেলে যেত। আমি, সিরাজ ভাই, শংকরসহ কয়েকজন মিলে রাত ৩টার দিকে বড় বড় গলদা, ইলিশ ধরে পুড়িয়ে খেতাম। আমি যখন বরিশাল সদর স্কুলে পড়ি, তখন একদিন ড্রয়িং টিচার আম আঁকতে বলল। আমি আম এঁকে দিলাম। তারপর টিচার বললেন, 'এখন থেকে শামীম তোমাদের ড্রয়িং ক্লাস নেবে। ও চমৎকার আঁকে।' এর পর থেকে আমি ব্লাকবোর্ডে ড্রয়িং করে দিতাম, ছাত্ররা তা কপি করত। তখন আমার মধ্যে শিল্পী হওয়ার প্রেরণা জাগে। আমরা একটি কবিতা বের করেছিলাম, 'ড্রয়িং মাস্টারের নাক/ড্রিল মাস্টারের টাক/ঊষাদির খোঁপা/শোভাদির চোপা।' তারা খুব স্মার্ট ছিলেন। ঊষাদি, শোভাদি মহৎ ছিলেন, দুজনই বিয়ে করেননি। আমার পরিবার কখনো আমাকে সাপোর্ট দেয়নি বরং সকাল-বিকাল তিনবেলা আমাকে পিটাইত। বাবা আমাকে একবার অংক করতে দেন, আমি তো অংক পারি না, তিনি এমন জোরে এক লাথি দিল, আমি উল্টে পড়ে গেলাম।



ওই ঘটনার পর আপনি তো বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন।



হ্যাঁ, ওই ঘটনার পর বাড়ি থেকে পালানোর পরিকল্পনা করি। ছোটবেলায় মেয়েদের পোশাক আমার ভালো লাগত না। আমাকে সালোয়ার-কামিজ বানাইয়া দিত। তা কেটে আমি প্যান্ট বানাইতাম। এক সময় আমাকে গ্রামে পাঠিয়ে দিল। ফরিদপুরে আমার দাদার বাড়ি। সেখানে আমার পোশাক কেউ পছন্দ করত না। দাদা আমাকে রাখলেন না। এর পর পাঠিয়ে দিলেন খালার বাসায়। খালু ছিল চেয়ারম্যান। তারা অন্যদের মাছ-মাংস খাওয়াত আর আমাকে দিত মরিচ ভর্তা, লাল শাকের ভর্তা ইত্যাদি। আমি ভীষণ কষ্ট পেতাম। কিন্তু খালাত ভাইরা ভালো ছিল। একদিন ওদের বললাম, দেখ তোর মা তো শয়তান, আমাকে খেতে দেয় না। তোদের এখানে আমি থাকব না, তোরা আমাকে একটু হেল্প কর। ওরাই আমাকে পালাতে সহযোগিতা করে। আমাকে নৌকা ভাড়া করে এক চাঁদনি রাতে চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেয়। ওখান থেকে আমি হেঁটে চট্টগ্রামে গিয়ে জঙ্গলের মধ্যে এক বাড়িতে আশ্রয় নেই। ওই বাড়িওয়ালাকে বললাম, ছবি আঁকি এ জন্য বাড়িতে আমাকে পেটায়। তাই পালিয়ে আসছি। তিনি বুঝতে পেরেছেন। আমাকে তারা ভাত খেতে দিল। ওদের কোনো বাচ্চা ছিল না। পরদিন সকালে তিনি বেশ কতগুলো কলম, পেনসিল, কাগজ নিয়ে এসে আমাকে টেস্ট লাইন, কার্ভ লাইন দিতে বলল। আমি দিলাম। তিনি আমাকে টেস্ট করলেন, মিথ্যা বলছি কিনা। তার স্ত্রীর মানসিক সমস্যা ছিল। তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। তাকে আমি বললাম, তুমি যদি আমাকে ছবি আঁকতে দাও, তাহলে তোমাদের আমি বাবা-মা ডাকব। তার বাড়িতে আমি চার মাস ছিলাম। পরে আব্বা আমাকে বাড়িতে নিয়ে আসে। এর মধ্যে আব্বা নরসিংদীর রায়পুরায় বদলি হয়ে গেলেন। সেখানে আমাকে স্কুলে ভর্তি করাতে গেলেন। আমি তো কিছু পারি না। আমার বয়স অনুযায়ী ক্লাস সেভেনে আমার পড়ার কথা। কিন্তু হেডস্যার তো কিছুতেই আমাকে নিতে চাইলেন না। আমি তাকে বললাম, আমাকে ভর্তি করে নিন, না পারলে আমি চলে যাব। এর পর দিন-রাত পড়াশোনা করে আমি ক্লাস এইটে ফার্স্ট হয়ে গেলাম। হেডস্যার তো ভীষণ খুশি। রায়পুরা হাতেম আলী স্কুলে আমি, সুলতানা কামাল [শেখ জামালের স্ত্রী], হাসনা, ইশরাত, সাবিহা আমরা খুব ভালো খেলাধুলা করতাম। তখন থেকে সাইকেল চালাতাম। ওই স্কুলে এক ছাত্র ব্লাকবোর্ডে আমার উল্কি আঁকে। তারপর তাকে ভীষণ পিটিয়ে ধানখেতে ফেলে দেই। ওখানে প্রায়ই মারধর হতো। ওই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করি।



আপনি তো বুলবুল ললিতকলা একাডেমির ছাত্র ছিলেন।



বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতেই আমার শুরু। আমার শিক্ষক ছিলেন ফরাসি ভাস্কর মিস্টার সিভিস্কি। তার অধীনে ভাস্কর্যের ওপর বাফা থেকে ১৯৬৫-১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিন বছরের একটি কোর্স সম্পন্ন করি। সিভিস্কি আমাকে ফ্রান্সে নিয়ে যেতে চাইছিল কিন্তু আমি যায়নি। কিছু দিন তেজগাঁও পলিটেকনিক্যালে পড়ি। সেখানে এক টিচারের সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়। সিরাজ তখন টেকনাফে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায়। তিনি টেকনাফে যাওয়ার আগে আমাকে চারুকলায় আমিনুল ইসলাম স্যারের কাছে নিয়ে যান ভর্তি করানোর জন্য। তখন সেশন শেষ হয়ে যায়। পরের বছর ভর্তি পরীক্ষায় আমি প্রথম হয়ে চারুকলায় ভর্তি হই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে [বর্তমান চারুকলা অনুষদ] পাস করার পর লন্ডনে স্যার জন স্কুল অব আর্টস ও কেনসিংটন অ্যান্ড চেলসি কলেজে আমি পড়াশোনা করি। ১৯৭৬ সালে দেশে ফিরে ফ্রিল্যান্স ভাস্কর হিসেবে কাজ করতে থাকি।



মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেন কখন



সিরাজ ভাই তো ছাত্র ইউনিয়ন করত। সেই সূত্রে আমিও ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ওদের মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিতাম। পোস্টার করে দিতাম। আমি ১৯৬৯ সালে চারুকলায় ভর্তি হই। আমি চারুকলায় পড়াকালীন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। তখন স্বাধীনতার পক্ষে যা কিছু হতো সবকিছুতেই অংশগ্রহণ করতাম। আমি জুডো-কারাত শিখি, মারধর করি এখানে-সেখানে, সবাই আমাকে তখন 'শামীম ভাই' বলত। ঊনসত্তরের আন্দোলন, পরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলাম। মনে পড়ে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের দিন আমি একেবারে মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে তার ভাষণ শুনেছিলাম। মওলানা ভাসানীর মিটিংয়েও আমি অংশ নিয়েছি। বিভিন্ন পোস্টার নিয়ে চারুকলা থেকে আমরাই প্রথম মিছিল বের করি। পাকিস্তানিরা চারুকলাতেই প্রথম আক্রমণ করে। আমাদের শাহনেওয়াজ হলেও আক্রমণ করে। এর মধ্যে পাকিস্তান আর্মি আমাদের খিলগাঁওয়ের বাসা কয়েকবার রেট করেছে সিরাজ ভাইয়ের জন্য। আমাদের বাড়িটা ওদের টার্গেট ছিল। তা ছাড়া সিরাজ ভাইয়ের জীবিত অথবা মৃত্যু ধরিয়ে দিতে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। আমি তো ওই সময় শাহনেওয়াজ হলে প্রায় সময় ব্যায়াম করতাম, খেতাম। বেণুসহ আমাদের অনেক বন্ধু সেখানে থাকত।



২৫ মার্চের ক্রাকডাউনের কথা বলুন।



২৫ মার্চ রাতের ভয়াবহতার পর সকালে চারুকলা থেকে প্রথম মিছিলটি বের করি আমরাই। এর পর সাইকেল নিয়ে বের হই পরিচিতজনদের সতর্ক করতে। আমি গিয়েছিলাম মহাখালীতে রঞ্জনের বাসায়। ও তেমন রাজনীতি বুঝত না। ওকে বললাম, তুই ভাগ। খুব সম্ভব আজকে রাতে ক্রাকডাউন হবে। আমাদের আর্টিস্টদের ওপর হামলা হবে আগে। তুই ভাগ। আমি সন্ধ্যার দিকে সাইকেল নিয়ে ফার্মগেটে আসি। তখন অলরেডি বিহারিরা বাঙালিদের ওপর হামলা শুরু করে দিয়েছে। চোখের সামনে ওরা রামদা নিয়ে কোপাচ্ছে। বাঙালি পোলাপান এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। আমি সাইকেল নিয়ে দ্রুত নিউমার্কেটে এসে সাইকেলটি রেখে বাসায় চলে যাই। আমাদের আগ থেকে কালো পোশাক বানানো ছিল। ওই পোশাক পরে যার যার অস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। রাজারবাগ পৌঁছানোর পর দেখি গোলাগুলি। এর মধ্যে শান্তি কমিটি হয়ে গেছে। ওরা আমাদের নামের তালিকা করে। আমরা বন্ধুবান্ধবরা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাই। পার্টি থেকে শেরাটন হোটেল উড়িয়ে দেওয়া, পেস্নন হাইজ্যাক করার দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে। সেটা সম্ভব হয়নি। যতটুকু পেরেছি, করেছি।



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন কবে



আমি ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেই। ১৯৮৬ সালে সহকারী অধ্যাপকের দায়িত্ব লাভ করি। ১৯৯৩ সালে সহযোগী অধ্যাপক, ১৯৯৯ সালে অধ্যাপক হই।



যুদ্ধের পর অর্চনা চৌধুরী আপনার সহযোগিতা চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন।



হ্যাঁ। যুদ্ধের পরপরই রাজশাহীর সারদা ক্যাডেট কলেজের এক শিক্ষকের স্ত্রী খুকুর [শিক্ষক নিহত হন যুদ্ধে] ওপর নেমে আসে অকথ্য নির্যাতন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ছেলেরাই তখন তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেয়। খুকুর তিন বাচ্চা তখন পাবনায় শাশুড়ির কাছে থাকত। মেয়েটিকে আটকে রাখা হয়েছে ক্যাম্পাসে। তখন ডাক পড়ে আমার। ঢাকা থেকে ওখানে পৌঁছানোর পর ব্যারিকেড দিল ছাত্ররা। একজনকে এমনভাবে পিটাইলাম যে, ওরা পিছু হটল। খুকুকে উদ্ধার করে নিয়ে যাই রংপুরে। কিন্তু সে আমার সঙ্গে ঢাকায় আসতে চায়। নিয়ে আসি সঙ্গে করে, বাচ্চাদের রেখে আসি খুকুর মায়ের কাছে। এনে ঢাকায় একটি হোস্টেলে তুলি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলে তার টাকার ব্যবস্থা করি। বঙ্গবন্ধু খুকুকে ২০ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছিলেন। খুকুর অনুরোধে সেই টাকা নিয়ে কিছু কাপড়চোপড় কিনতে যাই নিউমার্কেটে। সেখানে নেমে আসে আরও বিপদ। কিছু ছেলে আমাদের পিছু নেয়। খুকুকে একটা দোকানে নিরাপদে রেখে একাই তাদের মোকাবিলা করি। রাতে হোস্টেলে ফেরার পর প্রভোস্ট বিচার নিয়ে আসেন, 'এই শামীম, তুমি বেটাছেলেদের সঙ্গে মারামারি কর' আমি বলি, আপনি তো মাইর খাইয়া আসেন, আমি দিয়া আইছি। আপনি নারী সমাজের কলংক। নারী বলেই অত্যাচার করবে তার ওপর। এইটা তো হতে পারে না। এভাবে অনেকেরই আমি সহযোগিতা করেছি, বাঁচিয়েছি।



আপনার ভাই সিরাজ শিকদার সম্পর্কে বিশেষ কোনো স্মৃতি মনে পড়ে



একবার পরীক্ষার আগের দিন রাতে সিরাজ ভাই আমাকে বলল, শামীম আগামীকাল পরীক্ষা, কোনো প্রস্তুতি নেই, কী করা যায় ভাইয়াকে বললাম, চল একটা বুদ্ধি করি। উনি নিজেই আবার বললেন, তুই মাঞ্জা বানা। আমরা তখন রাত জেগে গাব, কাচের গুড়া, ময়দা, বালু ইত্যাদি মিশিয়ে মাঞ্জা বানালাম। বাবা-মা বললেন, কী করছ তোরা আমি বললাম, একটা কাজ করি। ওই রাতে স্কুলের জানালা খুলে সব বেঞ্চিতে মাঞ্জা লাগাইয়া দিলাম, যাতে কেউ পরীক্ষা না দিতে পারে। পরদিন সিরাজ ভাই যথারীতি পরীক্ষা দিতে গেল। সবাই বেঞ্চিতে বসার সঙ্গে সঙ্গে জামা-কাপড়ে মাঞ্জা লেগে গেল। এর পর ১০ দিন স্কুল ছুটি দিয়ে দিল। এর মধ্যে ভাইয়া পরীক্ষার যাবতীয় পড়া কমপিস্নট করে ফেলল। ভাইয়া আবার করত কি, পড়া শেষ হলে পাতা ছিঁড়ে ফেলে দিত। আব্বা ওকে জিজ্ঞাসা করত, কি রে তুই বইয়ের পাতা ছিঁড়ে ফেলে দিস কেন উনি বলতেন ওটা আমার মাইন্ডে চলে গেছে আর বইয়ের দরকার নেই। সে পরীক্ষা দিয়ে ফার্স্ট হলো। একবার নদীতে সাঁতার দিতে গিয়ে কুমিরে তাড়া করে। পরে ওসি সাহেবকে খবর দিলে তিনি গুলি করে কুমিরটি মেরে ফেলেন। তারপর আর নদীতে সাঁতার কাটি না।



বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কীভাবে চেনাজানা হয়।



মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সবাই দেখা করতে পারত। এখনকার মতো এত ধরাবাধা নিয়ম ছিল না। তিনি আমাকে মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী হিসেবে চিনতেন। তার সঙ্গে বসে বসে আমরা এক ধরনের আড্ডা মারতাম। গ্রামের লোকের মতো তিনি সবার কথা শুনত, হাসত, তামাশা করত। তার স্মরণশক্তি ছিল সাংঘাতিক। আমাকে ডাকত পাগলি। খুব আদর করত আমাকে। তিনি অত্যন্ত আন্তরিক মানুষ ছিলেন। দুপুরে ক্লাস শেষে বঙ্গভবনে গিয়ে লাঞ্চ করতাম। চিকন চালের ভাত খেতে মজা লাগত।



বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আর কোনো স্মৃতি আছে



১৯৭৪ সালে আমি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য করেছিলাম, যা আজো বিখ্যাত শিল্পকর্ম হিসেবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছে। ১৯৭৫ সালে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে আমি লন্ডন যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সঙ্গে ছিল আমার স্বামী জাকারিয়া চৌধুরী [জ্যাক]। ওই দিন কেবিনেট মিটিং। তিনি আমাদের দেখে কেবিনেট মিটিং স্থগিত করে দিলেন। আমরা তার সঙ্গে কথা বলছি এমন সময় বঙ্গবন্ধুর অনুমতি ছাড়াই এক ভদ্রলোক তার রুমে প্রবেশ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে কক্ষটিতে নীরবতা নেমে এলো। বঙ্গবন্ধু নিজে চুপ হয়ে গেলেন। প্রায় আধা ঘণ্টা লোকটি দাঁড়িয়ে, আমরা কেউ কথা বলতে পারছিলাম না। আমি ভেতরে ভেতরে তামাশা দেখছিলাম। বুঝে নিলাম এখানে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, বঙ্গবন্ধু, আমরা এখন তাহলে যাই। হয়তো কিছু সমস্যা আছে! আপনি একটু ঠিক থাকেন, এই বলে আমরা চলে এলাম। তার পরের দিন আমি বিদেশ চলে যাই। আমি ওই সময় থাই অ্যাম্বাসেডরের পিতার ভাস্কর্য তৈরি করেছিলাম। তিনি আমাকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের টিকিট দিয়েছিলেন। থাইল্যান্ডে চার-পাঁচ দিন ছিলাম। সেখান থেকে গেলাম ইতালি, পরে রোম, স্পেনসহ বিভিন্ন দেশে যাওয়ার কথা। কয়েক দিন ঘোরাঘুরি করলাম, একদিন ভোরে বাড়ির গৃহভৃত্য এসে বলছে, মামি, বাংলাদেশে সব শেষ, বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলছে। আমি তো চুপ মেরে গেলাম। এটা কেমনে হয়! জ্যাক বলল, আমি লন্ডন যাব। আমরা লন্ডন চলে গেলাম।



বহুদিন পর দেশে এলেন, নতুন কী কাজ করছেন



আমার এখন অনেক কাজ বাকি। মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্গবন্ধু আমাদের সমাজকে আলোকিত করেছেন। তাদের আলো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রসার ঘটাতে চাই। আর সে উদ্দেশ্য নিয়ে ইস্কাটনে জাতীয় ভাস্কর্য গ্যালারি নির্মাণ করেছি।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.