নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এপিটাফ এক নিঃশব্দ প্রচ্ছদে ঢাকা আছে আমার জীবনের উপন্যাস... খুঁজে নিও আমার অবর্তমানে... কোনো এক বর্তমানের মায়াবী রূপকথায়। আমার অদক্ষ কলমে... যদি পারো ভালোবেসো তাকে... ভালোবেসো সেই অদক্ষ প্রচেষ্টা কে, যে অকারণে লিখেছিল মানব শ্রাবণের ধারা.... অঝোর শ্রাবণে।।
ফিল ওকস.....
আমার দুই ছেলেই মোটামুটি ভালো গিটারিস্ট। ছোট জন ভালো গায়ও। কয়েক বছর আগে ছোট ছেলেকে গাইতে শুনি - 'শো মি দ্য প্রিজন.....' গানটা। আমার খুব ভালো লাগে, তাই সিংগার ও সং রাইটার সম্পর্কে জানতে চাই। ওর মুখেই শুনি 'ফিল ওকস' (Phil Ochs) নামের শিল্পীর অনেক অজানা কথা। তারপর থেকে ইউটিউবে তাঁর গান শুনি এবং ইন্টারনেটে শিল্পী সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারি।
ষাটের দশকে আমেরিকায় একঝাক সং রাইটার উঠে এসেছিলেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত নাম বব ডিলান, সেইসময়ের কাউন্টার কালচারের আইকন। একই সময় ডিলানের সমসাময়িক আরও অনেকজন সংরাইটার ছিলেন যারা ভালো কাজ করেছিলেন। কিন্তু, ডিলানের মতন খ্যাতির শীর্ষে আর কেউ উঠতে পারেননি। ডিলান প্রতিবাদী গান দিয়ে কেরিয়ার শুরু করলেও, এক সময় নিজেকে বদলে ফেলেন। কিন্তু, বব ডিলানের সমসাময়িক একজন সং রাইটার ছিলেন যিনি গোটা জীবন লিখে গেছেন প্রতিবাদী গান। যিনি কমার্শিয়াল সাকসেসের পেছনে না ছুটে যখনই সমাজের জন্য কিছু করার সুযোগ পেয়েছেন, আঁকড়ে ধরেছেন সেই সুযোগ। উনি নিজেকে বলতেন 'সিঙ্গিং জারনালিস্ট'। ২০১৩ সালে নিউইয়র্কে একটি কনসার্টে পঞ্চাশ হাজার দর্শক শ্রোতাদের সামনে প্রবীণ সং রাইটার Neil Young ঘোষণা করেন ''এই পৃথিবীর অন্যতম সেরা 'সং রাইটার, কবি' ফিল ওকস"।
ষাটের দশকে বিখ্যাত সংরাইটাররা জড়ো হয়েছিলেন গ্রিনিচ ভিলেজে। সবার মুখে 'গ্যাসলাইট' ক্যাফের নাম। সমাজের আঘাত সৃষ্টিশীল মানুষের মধ্যে থেকে বার করে এনেছিল অসাধারণ কবিতা, গান, নাটক, ছবি। এল্ভিস প্রেসলিকে গুরু ভাবতেন যিনি সেই ফিল ওকস স্বপ্ন দেখলেন সং রাইটার হবেন। খবরের কাগজের মধ্যে উনি খুঁজে বেড়াতেন গান লেখার রসদ। উনি বলতেন - 'অল দ্য নিউজ ফিট টু সিং'। সিভিল রাইটস মুভমেন্ট, লেবার বিদ্রোহ, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ফিল ওকস লিখেছেন একের পর এক গান। নিউপোর্ট ফোক ফেস্টিভালে পারফর্ম করলেন বব ডিলান ও ফিল ওকস ছাড়াও অনেকে। কিন্তু বিখ্যাত হলেন বব ডিলান। ওক ফিলস বললেন - ''আমি বেস্ট সং রাইটার হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু, ডিলানের গান শোনার পর আমি সেকেন্ড বেস্ট হতে চাই''।
ফিল ওকসের প্রথম দিকের অ্যালবামগুলি বেশ জনপ্রিয় হয়। শুধু একটি অ্যাকুস্টিক গিটার নিয়ে গাওয়া "Too many martyrs", “I ain’t marching anymore” গানগুলি সেইসময় ছিল খুবই প্রাসঙ্গিক। মানুষের মুখে মুখে ফিরতে থাকে এসব গান। উনি লিখেছেন খনি শ্রমিকদের জন্য গান । “I ain’t marching anymore” গানটি যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের অ্যানদেম হয়ে ওঠে । ফিল লিখলেন - "Love Me, I'm a Liberal"। জোন বায়েজ গাইলেন ফিল ওকসের লেখা বিখ্যাত গান "There but for Fortune"। ফিল গান গাইছিলেন কিন্তু কমার্শিয়াল সাকসেস পাচ্ছিলেন না সেভাবে। খ্যাতিও সেভাবে পাননি। তখন বব ডিলান সুপার স্টার। অনেকেই মনে করেন ডিলান ফিল ওকসকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতেন। ডিলান একবার ফিলকে তার লিমুজিন গাড়ি থেকে নেমে যেতে বলেন। ডিলান সেদিন ফিল ওকসকে বলে ছিলেন - " তুমি ফোক সংরাইটার নও, তুমি সাংবাদিক"!
কেনেডির মৃত্যু ফিল ওকসকে আঘাত দিয়েছিল। আঘাত দিয়েছিল মারটিন লুথার কিং এর মৃত্যুও। ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে ফিল গাইলেন 'ওয়ার ইজ ওভার'। গানের মধ্যে দিয়ে ফিল সেই ফ্যান্টাসির জগতের সন্ধান দিতে চাইলেন যেখানে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। ফিল কোনভাবেই নাম করতে পারছিলেন না। এই কষ্ট ভেতরে ভেতরে তাঁকে যন্ত্রণা দিতো। দীর্ঘদিন ধরেই ফিল ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ছিলেন। ফিল ওকসের কণ্ঠ ছিল অসামান্য। সেইসময়ের সং রাইটারদের মধ্যে এতো ভালো কণ্ঠ ছিল বিরল। অনেক প্রটেস্ট সং লিখলেও, ফিল লিখেছেন Changes, When I’m Gone এর মতন অন্যধারার গান। 'Changes' গানটি ফিল ওকসের এক অসামান্য সৃষ্টি। অসামান্য সুর আর ফিল ওকসের মায়াময় কণ্ঠের যাদুতে এই গান অন্যমাত্রা পেয়েছে।
যত দিন যাচ্ছিল মদ্যপান বাড়ছিল ফিল ওকসের। ডিপ্রেশন আরও শেষ করে দিচ্ছিলো ফিলকে। নিজেকে একসময় বললেন - ''পৃথিবীর সব বিপ্লবেই একজন করে ক্লাউন থাকে, আমি হলাম সেই ক্লাউন''। ষাটের দশকের একদম শেষে এল্ভিস প্রেসলির মতন সোনালি স্যুট পরে পারফর্ম করলেন ফিল। দর্শকরা মেনে নিতে পারলো না একজন প্রটেস্ট সংরাইটারের এই অনুকরণ পাগলামি। এটাই হয়তো ছিল ফিল ওকসের ফেম পাবার শেষ চেষ্টা। ফিল ওকস মনে করতেন, তার হয়তো মৃত্যু হয়ে গেছে, তিনি জাস্ট ছায়া হয়ে বেঁচে আছেন! ফিল ওকসের লেখা When I’m gone গানে মৃত্যুচেতনার আভাস মেলে। আবার I've had her, she's nothing গানটি হয়তো সুইসাইডকে উদ্দেশ্য করে লেখা। ফিল তার ভাইকে বলেন, মৃত্যুর আগে তিনি এই পৃথিবীটা ভালো করে দেখতে চান। তখন ফিলের বয়স ত্রিশের একটু বেশী। তাহলে এখনই হঠাৎ মৃত্যুর কথা!
একদা ফিল ওকসের সঙ্গে পরিচয় হয় চিলির বিখ্যাত প্রটেস্ট সংরাইটার ভিক্টর হারার। তখন চিলি উত্তাল। ফিলের মনে হয় ভিক্টর হারাই একজন সং রাইটারের আসল কাজটি করছেন। দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। কিন্তু, চিলির পরিস্থিতি খুব দ্রুত খারাপ হতে শুরু করে। গ্রেপ্তার হন ভিক্টর হারা। বিরাট স্টেডিয়ামে অন্যান্য বন্দীদের সঙ্গে আনা হয় ভিক্টর হারাকে। সেখানে একজন সেনা অফিসার ভিক্টর হারার দুটি হাত একটি টেবিলে রেখে বন্দুকের বাঁট দিয়ে আঙুলগুলি ভেঙে দেয়। তারপর অশ্রাব্য গালাগাল দিয়ে ভিক্টর হারাকে বলে - ''যাও এবার গিটার বাজিয়ে প্রতিবাদী গান গাও দেখি''। শারীরিক নির্যাতনে আহত ভিক্টর হারা সারা শরীর রক্তে ভেজা। তিনি উঠে দাঁড়ালেন, স্টেডিয়ামে উপস্থিত মানুষদের উদ্দেশ্যে রক্তে ভেজা দুই হাত তুলে বললেন - ''আসুন বন্ধুরা আমরা সবাই মিলে সালভাদোর অ্যালিয়েনদের দলের গানটি গাই''। স্টেডিয়ামে উপস্থিত মানুষেরা যোগ দেয় সেই গানে। তারপর সৈন্যরা পেছন থেকে গুলি করে ভিক্টর হারাকে। ৪৪ টি বুলেটের ক্ষত ছিল ভিক্টর হারার শরীরে। এই ঘটনার পর চিলির বিপ্লবীদের জন্য একটি কনসার্ট আয়োজন করেন ফিল ওকস। সেখানে বব ডিলান এসে গান গেয়েছিলেন। কিছুদিন পর দক্ষিণ আফ্রিকায় ফিল ওকস একদল ডাকাতের কবলে পড়েন। ডাকাতদের আক্রমণে ফিলের ভোকাল কর্ডে আঘাত লাগে। ফলে, আগের মতন আর গাইতে পারতেন না। নিজের ভয়েস হারিয়ে আরও ডিপ্রেশনে চলে যান ফিল। উনি মনে করতেন এই ঘটনা আসলে সিআইএ করিয়েছে।
ভিয়েতনামের যুদ্ধ শেষ হয়।
ফিল ওকস যে ফ্যান্টাসির আভাস দিয়েছিলেন তার গান 'ওয়ার ইজ ওভার' এ , সেটি বাস্তবে পরিণত হয়। কিন্তু , ততদিনে ফিল ভেতরে ভেতরে একেবারে শেষ হয়ে গেছেন। মদ্যপান লাগামছাড়া, যাকে তাকে যা খুশি বলে দিচ্ছেন, জীবন ছন্নছাড়া। চলে গেলেন নিজের বোনের বাড়ি। সেখানে পিয়ানো বাজিয়ে অনেকবার গাইলেন তার 'জেমস ডিন অফ ইন্ডিয়ানা' গানটি। নিজের একাধিক বন্ধুকে বলেছিলেন, তার বেঁচে থাকার অনীহার কথা। নীল ইয়াং ছিলেন সেই বন্ধুদের একজন। নিজের ভাইকে একদিন ফিল বলছিলেন - ''আমি নিজেকে শেষ করে দিতে চাই''। ভাই মজা করে উত্তর দিয়েছিলেন - ''তুমি তাহলে খাওয়া ছেড়ে দাও, এমনিই মরে যাবে''। ফিল হো হো করে হেসে ওঠেন। খেতে খুবই ভালবাসতেন ফিল। নিজের ভাইয়ের সঙ্গে এই কথোপকথনের পরের সপ্তাহে আত্মহত্যা করেন ফিল ওকস। তখন ফিলের বয়স মাত্র ৩৫ বছর। মৃত্যুর কিছুদিন আগে যেসব বন্ধুদের ফিল বলেছিলেন তার সম্ভাব্য মৃত্যুর কথা, তারা সকলেই আক্ষেপ করেন, যদি তারা যদি আটকাতে পারতেন এই অসামান্য প্রতিভার আত্মহত্যা! Tom Paxton লিখেছেন ফিল কে নিয়ে অপূর্ব একটি গান।
পরে যখন ফিল ওকসের গান 'When I’m gone’ শুনেছি। ফিল হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন মৃত্যু তার পিছু নিয়েছে । তাই তিনি শেষ গান লিখেছিলেন -
‘And you won't find me singing'
on this song when I'm gone,
So I guess I'll have to do it while I'm here’.
©somewhere in net ltd.