![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এপিটাফ এক নিঃশব্দ প্রচ্ছদে ঢাকা আছে আমার জীবনের উপন্যাস... খুঁজে নিও আমার অবর্তমানে... কোনো এক বর্তমানের মায়াবী রূপকথায়। আমার অদক্ষ কলমে... যদি পারো ভালোবেসো তাকে... ভালোবেসো সেই অদক্ষ প্রচেষ্টা কে, যে অকারণে লিখেছিল মানব শ্রাবণের ধারা.... অঝোর শ্রাবণে।।
ভিন্ন অবলোকনে বিভূতিভূষণ.....
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে বহুকাল ধরেই পাঠকসমাজে এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে, তিনি আদ্যন্ত রোমান্টিক, প্রকৃতিপ্রেমিক, স্মৃতিকাতর, ভাববাদী এবং অধ্যাত্মচেতনায় সমাচ্ছন্ন। সমালোচকদের কেউ কেউ অবশ্য তাঁর ব্যক্তিমানস ও শীল্পিসত্তার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সাহিত্যিক ভাবমূর্তিতে এসব প্রবণতার কোনো কোনোটিকে জীবনবিমুখতা এবং পলায়নপর মনোভঙ্গির প্রকাশ হিসেবেও চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। মোটকথা, যে অর্থে সাহিত্যিক তাঁর সমকাল এবং পারিপার্শ্বিক সমাজ-রাষ্ট্র, জাতিক-আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল সম্পর্কিত সচেতনতাবোধের পরিচয় ও নৈয়ায়িক অবস্থান তুলে ধরবেন বলে পাঠক-সমালোচক-গবেষকদের বিশেষ প্রত্যাশা থাকে, বিভূতিভূষণ ঠিক তেমন ভূমিকা পালন করেননি, এটাই তাঁর সম্পর্কে প্রতিষ্ঠিত অভিমত। কিন্তু ব্যাপারটি মোটেই এত সরল আর একরৈখিক নয়। সৃষ্টিশীল মানুষমাত্রই স্বতন্ত্র তার ভাবনা-চিন্তায়, লেখনিতে এবং ব্যক্তিত্বের আত্মপ্রকাশে। কাজেই, একজনের সঙ্গে অন্যজনের প্রতি তুলনার মানদণ্ড হিসেবে গড়পড়তা ধারণাকে আশ্রয় করা মোটেই যৌক্তিক, সমীচীন নয়। সাহিত্য সমালোচনার নিরিখে বিভূতিভূষণ সম্পর্কে গবেষক, সমালোচকরা মোটাদাগে যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন, তা তাঁর সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে আরোপিত বা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে প্রযুক্ত, এমনটি আমাদের অভিমত নয়। কিন্তু এটি তো ঠিক, তাঁর গল্পে, উপন্যাসে প্রায়শই বাংলার গ্রামীণ জনমানুষের যে অনাড়ম্বর, একঘেয়ে প্রাত্যহিক দিনযাপনের বর্ণনা ও স্মৃতিচারিতা, প্রকৃতিবিমুগ্ধতার পরিচয়, এমনকি অতি সাধারণ, তুচ্ছ, অনুল্লেখযোগ্য বিষয় ও ভাবনার প্রাধান্য থাকে, এসবের মধ্য দিয়ে আমরা এমন একজন সংবেদনশীল কথাশিল্পীকে আবিষ্কার করি, যিনি সমাজের তলদেশবর্তী প্রান্তজনের জীবনকথাকে রূপকথা-লোককথা-পরাণকথা বলার মতো আন্তরিকভাবে বলে যান! পাঠককে সম্মোহিত করার তাঁর এই যে ভঙ্গি, সাহিত্যিক বিবেচনা থেকে যাকে বলা চলে আখ্যান বয়ানের জাদুকরী রীতি, তা একেবারেই ভিন্ন। বাংলা সাহিত্যের অন্য কোনো কথাসাহিত্যিকের সঙ্গে এর মিল নেই। কাজেই তুলনার প্রশ্নটিও অবান্তর বটে! আর শুধু বাংলার গ্রামীণ জনপদই বা কেন, কলকাতা শহর ও এর পার্শ্ববর্তী মফস্বল, বিহার, পূর্ণিয়া, ভাগলপুর, লবটুলিয়া, সাঁওতাল পরগনার পটভূমিতে তিনি যেসব গল্প, উপন্যাস লিখেছেন, সেগুলোতে কি তাঁর সমকাল সচেতনতা, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চালচিত্র উপজীব্য হয়নি! আসলে তাঁর সঙ্গে অন্য শিল্পী-সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্মের প্রতিপাদ্য এবং তা রূপায়ণে যে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়, এর মূলে রয়েছে বিভূতিভূষণের জীবনভাবনা, পরিপার্শ্বকে অবলোকনের স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানুষ ও বিশ্বজগতের আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ক ব্যতিক্রমী উপলব্ধি। এমনকি তিনি যে যথেষ্ট বিজ্ঞানমনস্ক এবং সময়সচেতন কথাশিল্পী, এর পরিচয়ও বিভিন্নভাবে তাঁর কথাসাহিত্যে, আত্মজীবনীতে তথা দিনলিপিতে মুদ্রিত রয়েছে।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাসাহিত্যে এমন সব মানুষের সন্ধান হরহামেশাই মেলে, যাদের নেই বিশেষ স্বকীয়তা, মর্যাদাবোধ, শিক্ষালব্ধ সচেতনতা, এমনকি অন্যের কাছে নিজেকে আড়ম্বরপূর্ণভাবে উপস্থাপনের চতুর কৌশলাদি। তারা সমাজের হাড়হাভাতে, খেটেখাওয়া, কোনোমতে চেয়েচিন্তে অথবা দু-একবেলা উপোস করে দিন গুজরানে বাধ্য হতদরিদ্র মানুষ। এরচেয়ে কিছুটা ভালো অবস্থানে থাকা মানুষরাও তাঁর অনেক গল্প, উপন্যাসের মুখ্য ও প্রধান চরিত্র। কিন্তু তারা কোনোভাবেই প্রচলিত আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় শিক্ষিত, রুচিশীল, আত্মস্বার্থসচেতন, সুবিধাবাদী এবং চাকরিজীবী গড়পড়তা মধ্যবিত্তের অন্তর্গত নয়। এরা মোটাদাগে সমাজের প্রান্তবাসী মানুষ, যাদের ওপর নির্ভর করে টিকে থাকে সমাজের উপরিতলের বাসিন্দারা। স্মর্তব্য, বিভূতিভূষণ সনাতন হিন্দু পরিবারের সন্তান ছিলেন, ধর্মীয় পরিচয়ে যার অবস্থান ব্রাহ্মণ তথা চতুর্বর্ণের শীর্ষে। আবার শাসক ইংরেজদের প্রবর্তিত শিক্ষা গ্রহণ করেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ ডিগ্রি অর্জনের পরিণতিতে শিক্ষক হিসেবে চাকরি করেছেন। গ্রামীণ প্রতিবেশে জন্মগ্রহণ ও বড় হওয়ার অভিজ্ঞতা তাঁকে সুযোগ করে দিয়েছিল হিন্দু-মুসলমান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে পরিচিত হতে, তাদের জীবনের বিচিত্র বৃত্তান্ত জেনে-বুঝে নিতে। সবমিলিয়ে ধর্ম, শিক্ষা ও পারিবারিক ঐতিহ্যের সমবায়ে তিনি যে পারিপার্শ্বিক সমাজ, রাষ্ট্র ও মানুষের আন্তঃসম্পর্ককে নিবিড়ভাবে অবলোকন করেছিলেন, এ নিয়ে ভিন্নমত পোষণের সুযোগ নেই। কাজেই বিশ শতকের আশির দশকের শেষভাগে রণজিৎ গুহের নেতৃত্বে ভারতীয় নিম্নবর্গ সম্পর্কিত তাত্তি¡ক গোষ্ঠী যখন সমগ্র এশিয়া মহাদেশের অন্তবাসীদের প্রান্তিকতার স্বরূপকে নতুনভাবে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতে চান, আমরাও বিভূতিভূষণের কথাসাহিত্যে রূপায়িত প্রবঞ্চিত, অবহেলিত মানবগোষ্ঠীকে সাহিত্য সমালোচনা এবং সাবলটার্ন এ দুই জ্ঞানভাষ্যের ভিত্তিতে মূল্যায়নের সুযোগ পেয়ে যাই। কেননা, তাঁর কথাসাহিত্যে ভারতের অজস্র ধর্ম-বর্ণ, সম্প্রদায় ও জাতিতে বিদ্যমান ভেদাভেদ, বর্ণপ্রথার বাইরে অবস্থানরত অন্ত্যজ মানুষরা, এমনকি বিভিন্ন বয়স ও সামাজিক কাঠামোভুক্ত নারীরাও নির্বিবাদেই প্রান্তিকতার বৃত্তবলয়ভুক্ত হয়ে যায়। বিভূতিভূষণের গল্পে এসব প্রসঙ্গ বিশেষ অভিনিবেশ পেয়েছে। উপন্যাসগুলোর মধ্যে ‘পথের পাঁচালী-অপরাজিত’, ‘আরণ্যক’, ‘ইছামতী’, ‘অশনি সংকেত’, ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ প্রভৃতিকেও আমরা এ বিবেচনায় রাখতে পারি। বলে নেয়া ভালো, ‘প্রান্তিকতা’ শব্দটি সম্প্রসারিত অর্থে এতদূর ব্যাপ্ত এবং ব্যঞ্জনাধর্মী যে, একে কোনোভাবেই শুধু অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে গ্রহণ করা চলে না। বরং সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয়িত উচ্ছিষ্টের সঙ্গে পুঁজিবাদ সহযোগে যে অসমবিকশিত ভারতীয় সমাজ দিন দিন স্ফীত রূপ ধারণ করে চলেছে, তাতে প্রান্তিকতার নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হওয়া অসম্ভব নয়। অপরতাবোধের ভিত্তিতেই প্রান্তিকতার সংজ্ঞায়ন ঘটে, নির্ণীত হয় মানব সম্পর্কে বিদ্যমান ভেদাভেদের স্বরূপ। অপরতাবোধের ধারণা বহুদূর ব্যাপ্ত, যার সঙ্গে যোগ রয়েছে দর্শন, ধর্ম, সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসের, বিশেষভাবে রাজনীতি ও অর্থনীতির। শিক্ষা, জ্ঞান, মর্যাদা, আর্থিক সামর্থ্য এবং ধর্মীয়-সামাজিক অবস্থান, এমনকি লৈঙ্গিক এবং ভাষিক পরিমণ্ডলেও সবলের সঙ্গে দুর্বলের, সংখ্যাগুরুর সঙ্গে সংখ্যালঘুর, এমনকি একই জাতির অন্তর্গত ভিন্ন শেণিভুক্ত বাসিন্দাদের মধ্যে কেন্দ্র-প্রান্তমূলক যুগ্ম-বৈপরীত্যসূচক সম্পর্কের রূপায়ণ ঘটে। উদাহরণ দেয়া যাক।
‘পথের পাঁচালী-অপরাজিত’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র অপু। তার মা সর্বজয়া ব্রাহ্মণ হরিহর রায়ের স্ত্রী এবং গৃহকর্ত্রী। কাজেই সর্বজয়ার বাড়িতে পোষ্য ইন্দির ঠাকরুনের সঙ্গে তার যে সম্পর্ক এ উপন্যাসে রূপায়িত, সেখানেও সতত সক্রিয় থাকে অপরতাবোধ। অন্যের কাছে চেয়েচিন্তে, হাত পেতে চলতে অভ্যস্ত ইন্দির ঠাকরুনকে এ ব্যাপারে নিষেধ করা সত্ত্বেও সে সর্বজয়ার কথা অগ্রাহ্য করে। ফলে সর্বজয়া তার সঙ্গে রূঢ় আচরণ করেই ক্ষান্ত হয় না, সেই বৃদ্ধাকে বাড়ি থেকেও রীতিমতো বিতাড়িত করে। এর অন্তরালে সর্বজয়ার মনোভূমিতে শুধু সামাজিক মর্যাদাহানির আশঙ্কা ও অন্যের কাছে হেয় হওয়ার ভীতি সক্রিয় ছিল না, পাশাপাশি সেই অসহায় নারীর প্রতি অপরতাবোধও তার মনোলোকে দিনদিন প্রবল হয়ে উঠছিল। পালিতদের বড় মাচার তলে গোলার পাশে ধুঁকে ধুঁকে ইন্দির ঠাকরুনের মৃত্যুর খবর সর্বজয়া পেয়েছিল। কিন্তু সে তখন এ ঘটনার অন্তরালে সন্নিহিত মানবতার চূড়ান্ত অবমাননাকর দিকটি উপলব্ধি করতে পারেনি। কিন্তু অপু যখন কলকাতায় পড়ালেখার জন্য অন্যের বাড়িতে আশ্রিত এবং সর্বজয়া সেখানে এক ধনী পরিবারের রান্নাবান্নার দাসী, সেদিন সে বুঝতে পারে, ইন্দির ঠাকরুন তার সংসারে কতটা অসহায় ছিল।
বিভূতিভূষণের বিভিন্ন গল্পেও নর-নারীর প্রান্তিকতার বৈচিত্র্যময় বৃত্তান্ত উপস্থিত। তাঁর কালজয়ী গল্প ‘পুঁই মাচা’তে সহায়হরি চাটুজ্যে ব্রাহ্মণ হলেও গ্রামবাসীর কাছে ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে মর্যাদার অধিকারী নয়। বরং দরিদ্র ব্রাহ্মণ হিসেবে সে অনেকেরই করুণার পাত্র। কেননা সাংসারিক ব্যয়ভার নির্বাহে সে উদাসীন। অথচ প্রয়োজন মেটাতে সে যখন-তখন মানুষের কাছে হাত পাতে, কখনো বা গোপনেই অন্যের জমির ফল-পাকুড়, খাদ্যসামগ্রী নিয়ে আসে। এ কারণে তাকে চূড়ান্তভাবে অপমানিত হতে হয় বড় মেয়ে ক্ষেন্তির শ্বশুরবাড়ির মানুষজনের কাছে। প্রতিশ্রæতি অনুযায়ী যৌতুক দিতে না পারায় তাদের, এমনকি স্বামীরও অবহেলায় ক্ষেন্তি বসন্তে আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করে। অথচ তার দুরবস্থার খবর সহায়হরিকে জানানো হয়নি। কাজেই ধর্মীয় মানদণ্ডে ব্রাহ্মণ হলেও আর্থিক বিবেচনায় দরিদ্র বিধায় সহায়হরি ও তার পরিবারকে এভাবে প্রান্তিক অবস্থানে অবনমিত হতে হয়। ‘হারুণ আল রসিদের বিপদ’ গল্পে বাঙালি মুসলমান কৃষক পরিবারের ছেলে সন্তানের ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণের স্বরূপ ব্যঙ্গাত্মকভাবে উপস্থাপিত, যেখানে স্কুলের হিন্দু শিক্ষককে বিভিন্ন সামগ্রী ঘুষ দিয়ে সে ও তার বন্ধু ইতিহাসের ক্লাসে বেত্রাঘাত থেকে রক্ষা পায়। স্কুল পরিদর্শকের কাছে সে নিজের অর্জিত ইতিহাসবিদ্যার যে পরিচয় দেয়, তাতেই ফুটে ওঠে বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানের ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণের প্রকৃত অবস্থা। ‘ফকির’ গল্পে ইচু মণ্ডলের মতো প্রান্তিক মুসলমান কৃষকের বিচিত্র জীবনাভিজ্ঞতার পরিণতিতে অর্জিত অধ্যাত্ম্যভাবনায় প্রতিফলিত হয়েছে বৈষয়িক স্বার্থ ও সাংসারিক বুদ্ধিকে অতিক্রম করে স্রষ্টা এবং তার সৃষ্টি তথা মানুষের প্রতি সহিষ্ণু, উদারনৈতিক মনোভঙ্গি পোষণের আগ্রহ।
বিভূতিভূষণের প্রথম পর্যায়ে লেখা গল্পগুলোর মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য ‘উমারানী’ ও ‘মৌরিফুল’। বিবাহিতা নারী শ্বশুরবাড়িতে শারীরিক, মানসিকভাবে নির্যাতিত হওয়ার পরিণতিতে অকালে মৃত্যুবরণে যে বাধ্য হয়, ভিন্ন ভিন্ন আখ্যানযোগে এ বিষয়টিকে উপজীব্য করা হয়েছে। লক্ষণীয়, উমারানীর প্রতি তার স্বামীর অমনোযোগ, উপেক্ষা, ভালোবাসাহীন, দায়িত্বশূন্য যান্ত্রিক আর ‘মৌরিফুল’ গল্পে সুশীলার স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ির শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার- দুইয়ের পরিণতি ত্বরান্বিত করেছিল তাদের সামাজিক ভূমিকা। তদানীন্তন গড়পরতা বাঙালি সমাজে অশিক্ষিত, স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির ওপর নির্ভরশীল গৃহবধূর ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদা, অধিকার লাভের দাবি কখনোই স্বীকৃতি পেত না। সুশীলার ক্ষেত্রে শুধু তার শ্বশুরবাড়ির মানুষরাই নয়, এমনকি গ্রামের প্রতিবেশীরাও বিরুদ্ধ অবস্থান নিয়েছিল। কেননা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, সামাজিক অনুশাসন ও পুরুষতান্ত্রিক রক্ষণশীল মানসিকতার সমন্বিত রূপটি নারীর স্বকীয়তা ও ব্যক্তিত্বকে কখনোই স্বীকৃতি দেয়নি বরং তার মৃত্যু ত্বরান্বিত করে সেই ইচ্ছাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করেছে। ‘বিপদ’ গল্পের হাজু, ‘হিঙের কচুরি’ গল্পের কুসুম এবং ‘গিরিবালা’ গল্পের গিরিবালা- এ তিন পতিতা নারী চরিত্রের রূপায়ণে প্রকাশিত হয়েছে এদের প্রতি লেখকের পূর্ণ মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির অন্তরঙ্গ পরিচয়। জীবিকার তাগিদে দেহকে ভোগী পুরুষের কাছে সমর্পণে বাধ্য হলেও অন্তরে লালিত উদারতা, দয়া, সৌহার্দ্য এবং অন্যের প্রতি মমতাই যে তাদের পারিপার্শ্বিক সমাজে দিনযাপন সূত্রে সঞ্চিত গøানি ও ক্লেদাক্ততার ঊর্ধ্বে অধিষ্ঠিত করে, তা এসব গল্পের কেন্দ্রীয় ভাবসত্য। আদিবাসীদের প্রান্তিকতাও বিভূতিভূষণের নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ধরা পড়েছে। ‘কালচিতি’ ও ‘কয়লাভাটা’ গল্পে এর দৃষ্টান্ত রয়েছে।
প্রচলিত দৃষ্টিকোণ থেকে কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে মূল্যায়নের বিশেষ সমস্যা হলো, তিনি যে অন্য সাহিত্যিকদের মতো নন, তা সহজেই বোঝা গেলেও তাঁর স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত করতে গিয়ে ঝুঁকি তৈরি হয়। ফলে মোটাদাগে তাঁর গল্প, উপন্যাসে প্রতিফলিত জীবনভাবনা ও মানবস্বভাব সম্পর্কিত গড়পড়তা ধারণার বাইরে গিয়ে তাঁকে অনুধাবনের সুযোগ থাকে না। অথচ বিভূতিভূষণের কথাসাহিত্য যে ইয়োরোপীয় মডেলের গল্প, উপন্যাস লেখার রীতিকে অগ্রাহ্য করে রীতিমতো দৈশিক আবহ, সুর ও ভঙ্গিযোগে বাংলার লোককথা-রূপকথা-পরাণকথায় বিবৃত আখ্যান উপস্থাপনের অন্তরঙ্গ এবং একান্ত নিজস্ব রীতিকে অনুসরণ করেছে কথকতার ঢঙে, তা আমরা লক্ষ করি না। কাজেই কথাসাহিত্যে উপজীব্য ভারতীয় উপমহাদেশের অন্তর্গত বাঙালি প্রান্তিক জনসমাজের বৃত্তান্ত এবং এর প্রকাশভঙ্গি মিলিয়ে পাঠ করলে এভাবেই এক নতুন বিভূতিভূষণের প্রতিমূর্তি আমাদের চেতনালোকে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যিনি প্রকৃত অর্থেই প্রান্তজনের অন্তরঙ্গ, বিশ্বস্ত কথাকার।
©somewhere in net ltd.