নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এপিটাফ এক নিঃশব্দ প্রচ্ছদে ঢাকা আছে আমার জীবনের উপন্যাস... খুঁজে নিও আমার অবর্তমানে... কোনো এক বর্তমানের মায়াবী রূপকথায়। আমার অদক্ষ কলমে... যদি পারো ভালোবেসো তাকে... ভালোবেসো সেই অদক্ষ প্রচেষ্টা কে, যে অকারণে লিখেছিল মানব শ্রাবণের ধারা.... অঝোর শ্রাবণে।।
'পুতুল নাচের ইতিকথা'- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
মানুষের জীবনটা একটা রঙ্গমঞ্চ।
সেই মঞ্চে পুতুলনাচের পাত্র হয় মানুষ। কিন্তু কে নাচায়? মানুষ কি জানে, তাকে পুতুলের মতো করে নাচাচ্ছে অন্য কেউ? জানলেও কি সে বাঁধন ছিঁড়তে চায়? নাকি জীবনপথের রঙ্গমঞ্চে পুতুলনাচের পুতুল হয়েই কাটিয়ে দিতে হয় তাকে? মানবজীবনরূপী এই রঙ্গমঞ্চের পুতুলনাচ খেলার গল্প বলেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার পুতুলনাচের ইতিকথায়।
শুরু এবং শেষ দুই যায়গাতেই মৃত্যু!
অভাবনীয়, নাটকীয় মৃত্যু। শেষের মৃত্যু পাঠকের বোধের বাইরে ছিল। কিছুক্ষন আগেও পাঠকের বোঝার উপায় ছিল না। সেনদিদি মারা যাচ্ছেন। মারা গেলেন, পাঠক তার জন্য কাঁদলো না। সহানুভূতি, অনুকম্পা কিছুই না। প্রচন্ড সুন্দরী সেনদিদির কুৎসিত চেহারা নিয়ে মৃত্যু হলো।
তার মতো চোখ ধাঁধানো রূপসী কোলকাতা সহ এ তল্লাটে শশী দেখেনি। চোখ ধাঁধানো সুন্দরী এক চোখ হারিয়ে বড় কুৎসিত চেহারা করে ফেললেন। বসন্ত হয়েছিল তার। যামিনী কবিরাজের স্ত্রী। স্বামীর চিকিৎসায় ভরসা নাই। শশী পুরো দায়িত্ব নিয়ে অসম্ভব যত্ন দিয়ে চিকিৎসা করেছে। বসন্ত সেরেছে, ভয়ানক দাগগুলো চেহারায় খোদাই হয়ে আছে। সাথে একটা চোখ গর্তে। বসন্ত সেখানেও ছোবল দিয়েছে। সন্দেহের তীর শশীর প্রতি,চিকিৎসা ঠিকভাবে করেছে তো।
গল্প এগিয়েছে শশীকে ঘিরে। কোলকাতায় পড়াশুনা করা ডাক্তার। গ্রামেই ডাক্তারি করছে। গাওদিয়া গ্রাম। কাছের সদর বলতে, ঐ দূরের বাজিতপুর। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ফ্রয়েডিয় ভাবধারায় প্রভাবিত ছিলেন। পরবর্তিতে হয়েছেন কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য, আমৃত্যু তাই ছিলেন।
পুতুল নাচের ইতিকথা লেখার অনেক পরে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে সরাসরি যোগ দেন। তবে তাঁর নিজের মাঝে এর ভিত ঠিকই ছিল। প্রেম ভালবাসার ক্ষেত্রে, পিতাপুত্রের মতোবিরোধে; সামাজিক অবকাঠামো পরিচয়ে, সব যায়গায় শ্রেণী সংগ্রাম স্পষ্ট। ভালবাসাবাসি বিচার বিবেচনা হীন, ভাদাভেদহীন, অসম। কোন ভাবেই যোগসাজশ হয় না যেথায়।
কিন্তু, লেখনী এমনই মজবুত, সব আলাদা মুক্ত দানা গুলো যেন; নিপূণ হাতে গাঁথা মালা হয়েছে। লেখকের কৃতিত্ব এখানে। রাজনৈতিক দর্শনের কাছে লেখকের শিল্পসত্ত্বা হারিয়ে যায় নি। গল্পের চমৎকারিত্বে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। পুতুল নাচের ইতিকথায় – কোথাও পুতুলনাচের কথা নেই। যাত্রাপালার পুতুলগুলো সুন্দর নেচে যায়। আড়াল থেকে সুতা ধরে কেউ নাচায়। সুতা কারো দৃষ্টিতে আসে না, আড়ালে থাকা ব্যক্তিকেও না। সমাজে বাস করা মানুষ গুলো যেন তাই। নিজের ইচ্ছেয় সে কিছুই করতে পারছে না।
একরকমের ভাবনা ঠিক করে, অন্যভাবে চলতে থাকে। কুসুমের বাবার মুখে শুনতে পাই- “সংসারে মানুষ চায় এক হয় আরেক। চিরকাল এমনি দেখে আসছি ডাক্তারবাবু। পুতুল বই তো নই আমরা একজন আড়ালে বসে খেলাচ্ছেন।”
কুসুম শশীর মনের মানুষ। বন্ধু নিতাইয়ের স্ত্রী। শশী গ্রামের ধনী ঘরের সন্তান। উচ্চশিক্ষিত শহুরে মনোভাবের। শহরে ফিরে যেতে চায়। উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাবার চিন্তা করে।
অথচ সে কেবলই বাঁধা পরে যায়, গাওদিয়া গ্রামে। শশীর বন্ধু কুমুদ সৃষ্টিছাড়া। জীবনটাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে। বর্তমানের স্থিরতা নেই, আগামীর ভাবনা নেই। হুট করে গ্রাম্য মেয়ে মোতিকে বিয়ে করে শহরে চলে যায়। সব দ্বৈত চরিত্রের সমাহার। নিজের সাথে নিজের অস্তিত্বের যুদ্ধ। মানুষের চিন্তা আর বাস্তব একেবারে ভিন্ন ধারায় চলে। কল্পনার রঙিন ফানুস চুপসে যায়। সাদামাটা জীবনে যাকে কাছে পায়, তাকে নিয়েই বাঁচতে চায়।
গল্পের উল্লেখযোগ্য চরিত্র যাদব পন্ডিত এবং তাঁর স্ত্রী। অচেনা ভীনগাঁয়ের মানুষ। যোগসাধন করে অসাধ্য কিছু করে ফেলতে পারেন বলে জনশ্রুতি। আসেপাশের সকল গাঁয়ে তার প্রভাব। শশীকে বিশেষ স্নেহের দৃষ্টিতে দেখেন। আগাম ঘোষনা দিয়ে কোন এক রথের দিনে মারা গেলেন। আত্মহত্যা!! তাঁর স্ত্রী পাগল দিদি সহ। মৃত্যুর পরে জানা গেল প্রচুর সম্পত্তি। সেসব উইল করে গেছেন শশীর নামে। গ্রামে হাসপাতাল তৈরির লক্ষ্যে।হাসপাতালে তার নামডাক হয়।
কাজের হাঙ্গামা, বিদেশ যাওয়ার আর ফুরসত হয় না। শশী আটকা পরে যায় গ্রামেই। শশীর বাবা গোপাল নিষ্ঠুর প্রকৃতির বিচারবিবেচনা হীন মানুষ। লোকে বলে, মানুষের গলায় ছুরি ধরে পয়সা আদায় করে। এই লোক সব ছেড়ে, শেষে তীর্থে চলে গেলো। অদ্ভুতরে যেন সব। প্রথম যে মৃত্যু। পাঠক কোনভাবেই বুঝে উঠতে পারে নি। মৃত্যুর বর্ণনা এসেছে নাটকীয়ভাবে। মৃত্যুজন – পরাণ, মোতির বাবা, কুসুমের শশুর হারু ঘোষ।মোতির বিয়ের জন্য ছেলে দেখতে গিয়ে, বাড়ি ফিরছিলেন।– “খালের ধারে প্রকাণ্ড বটগাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়া হারু ঘোষ দাঁড়াইয়া ছিল। আকাশের দেবতা তাহার দিকে সেইখানে চাহিয়া কটাক্ষ করিলেন।”
এও যেন এক পরিহাস! শেষ পর্যন্ত যাদবই যেন শশীর জীবনে পুতুলনাচের নিয়ন্ত্রক হিসেবে আবির্ভূত হয়। জীবনরূপী এই পুতুলনাচকে বরণ করে নিতে হয় শশীকে। পুতুলের সুতো ছেঁড়া আর তার হয় না। উপন্যাসটির শেষে শশীর আপাত এই পরিণতি দেখে পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগবে নিজের জীবন নিয়েও- জগৎসংসারে আমরা সবাই যে এক পুতুলনাচের চক্করে বাঁধা পড়েছি। এ থেকে মুক্তির কি কোনো উপায় নেই?
পূনশ্চঃ আমার বুকসেলফে এবং হাতের কাছে দেশী বিদেশী অনেক আনকোড়া বই। কিন্তু পড়া হয়না। হাত বাড়িয়ে আবারও পড়ি ধূলো জমে থাকা মানিক বাবুর পুতুল নাচের ইতিকথা! সেই কলেজ লাইফ থেকে অদ্যাবধি অসংখ্যবার পড়েছি-তবুও আরো বেশী পড়তে ইচ্ছে করে।
১১ ই মার্চ, ২০২১ দুপুর ২:১৬
জুল ভার্ন বলেছেন: একমত।
©somewhere in net ltd.
১| ১১ ই মার্চ, ২০২১ দুপুর ১:৫৫
রাজীব নুর বলেছেন: চমৎকার একটা বই।
রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা থেকেও এই বই অনেক ভালো।