![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সামহয়ারের আমি একজন নিয়মিত পাঠক। এই প্রথম কোন নিক খুলে লিখতে যাচ্ছি। সকলের সহযোগিতা কামনা করি।
পড়ন্ত বিকাল, ঝিরি ঝিরি বাতাসকে পাশ কাটিয়ে ধির পায়ে হাটছি বঙ্গোপ সাগরের পাড় ঘেঁষে তৈরী করা শহররক্ষা বাঁধের উপর দিয়ে। কোলাহল মুক্ত নির্জন এই এলাকাটা। মাছ ধরা জেলেদের তেমন একটা চোখে পড়ছে না। প্রথম বারের মত বেড়াতে এসেছি চট্রগ্রাম। একাকী আমি, চিন্তা নামাক ইন্দ্রিয় বেশ সচল বলেই মনে হচ্ছে। ভাবছি মানুষের কোন জীবনটা সবথেকে আনন্দের; বাল্য, শৈশব, কৈশোর, যৌবন, পৌড় না বৃদ্ধ?
উত্তর আমার জানা নাই, যখন বাল্য ছিলাম মা-বাবার চোখের মনি ছিলাম। মনে কোন চিন্তা ছিল না। যা দেখতাম তা-ই ভাল লাগত, লাল, নীল, বেগুনি সব রং। তেমন চাহিদা ছিল না মনে, প্লাষ্টিকের একটা গাড়ি কিনে দিলে মনের আনন্দে সুতলি বেঁধে টেনে নিয়ে বেড়াতাম। সময় হলে মা-ই মুখের কাছে খাবার নিয়ে পিছনে পিছনে ঘুরতো। মাকে চরকির মত ঘুরাতে বেশ মজা পেতাম। সে মজার স্বাধ ছিল এক রকম।
যখন শৈশবে পা রেখেছি, নানা ভাইয়ের হাত ধরে স্কুলে যেতাম। টিফিন পিরিয়ডে খেলার মাঠে দল বেধে গোল্লাছুট খেলতাম। কারনে অকারনে সহপাঠিদের সাথে ঝগড়া, মারামারি করতাম। আবার দু'একদিন পরেই মিশে যেতাম। স্কুল ছুটি হলে এক দৌড়ে বাড়ি, নাকে মুখে খেয়ে পাড়ার ছেলেদের নিয়ে হৈ-চৈ করে সন্ধা পার করতাম। হ্যারিকেনের টিম টিমে আলোয় স্কুলের পড়া শেষ করে কোন মতে খেয়ে ঘুমের কোলে নিজেকে সেঁপে দিতাম। এখন যে উঠানকে মনে হয় এক চিলতে জায়গা তখন মনে হত ষ্টেডিয়াম, বল খেলতাম দু'দলে ভাগ হয়ে। জগতের সকল চাওয়া পাওয়া হাসি আনন্দ তখন বিকালের খেলাধুলার মাঝেই ছিল সীমাবদ্ধ।
কৈশোরে ভাল মন্দ বুঝতে শিখলাম। ভালর থেকে মন্দের দিকে মন বেশী টানতো। রাতের আঁধারে গ্রামের কোন বাড়িতে ভি,সি,বি শো চললে তা দেখার জন্য মনটা উতলা হয়ে যেত। খাটের উপর কোলবালিশকে কাথা দিয়ে ঢেকে ঘরের সবাইকে বোকা বানিয়ে চুপে চুপে বের হয়ে যেতাম। স্কুলে মেয়েদের সাথে মশকরা করার হার বেড়ে যেতে লাগল। বিকালে বড়দের সাথে বল খেলাই ছিল তখনকার সব থেকে বড় বিনোদন।
যৌবন, বড়ই কঠিন সময় মানব জীবনের জন্য। ভাল লাগা থেকে ভাল বাসার জন্ম হতে লাগল। গ্রামের আলেয়া, রহিমা, শাফিয়াদের মনে হত বিশ্ব সুন্দরী। এর মাঝেই ঘুরপাক খেত মন। বড়দের ছোখ এড়িয়ে কিছু করতে গেলেই ছোটদের চোখে ধরা পড়তাম। বিকালে খেলাধুলার ফাঁকে আড্ডার হার বাড়তে থাকল। সমবয়সী বন্ধুদের পছন্দের পাত্রীর গল্প শুনতে শুনতে দিন শেষ হয়ে যেত। কি ভাবে নিজেকে একটু স্মার্ট দেখায় তার চেষ্টায় সর্বদা ব্রত থাকতাম। পড়ার টেবিলের সামনে ঝুলিয়ে রাখতাম সালমান খাঁন, আমীর খাঁন, শাহরুখ খাঁন, জুহি মাধুরির ছবি। বাবা-মায়ের নানান অভিযোগ শুনতে শুনতে বাড়ি আর ভাল লাগত না। ভাল লাগত সহপাঠি বন্ধুর বাড়িতে আড্ডা মারা। ব্যর্থ প্রেমের রচনাটা এখান থেকেই শুরু হতো। কেউ বা আলোচিত সমালোচিত আবার কেউ বা ভদ্র সুবোধ বালক। মুক্ত আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়ানোর শখ যেন হাতছানি দিয়ে ডেকেই চলত। ঘর থেকে বের হলেই বন্ধু বান্ধবের দল পিল পিল করে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে একত্রিত হতাম। আজে বাজে কথা আর হাসির ফোয়ারা মুরব্বিদের স্থানচ্যুত করতে বেশী সময় নিত না। কেহ কেহ বিড়ি ফোঁকার হাতে খড়ি এখান থেকেই দিত। ভার্সিটিতে উঠে হারিয়ে যেত গ্রামের বাল্য বন্ধুর দল, পেয়ে গেলাম নতুন নতুন মুখ, পরিবেশ, বান্ধবী। গ্রামের সংকীর্নতা কেটে উঠতেই টের পেতাম এরই নাম স্বাধীনতা। মা-বাবা দুরে থাকলেও পড়া লেখায় ব্যস্ততা আর উচ্চশিক্ষিত বন্ধু বান্ধবীদের সাথে আড্ডা মনটাকে অনেক বড় করতে সাহায্য করত। স্কুল কলেজে যেখানে মেয়েদের সাথে পাশাপাশি দাঁড়াতে সংকোচ হতো সেখানে ভার্সিটিতে পাশাপাশি বসে উত্তপ্ত শরীরের উষ্ন ছোঁয়ায় ক্লাশ করতে বেশ ভালই লাগত। হয়তো ওদেরও ভাল লাগত ছেলে বন্ধুদের। ক্যাম্পাস ছেড়ে হলে চলত তুমুল আড্ডা আর রাজনৈতিক আলোচনা। নোটের আদান-প্রদান আর ভাল রেজাল্টের আকাঙ্খা পেয়ে বসত মনের কোনে। মাস গেলে বাবার পাঠানো গোনা টাকায় কোন মতে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হতো। ভ্রমনের নেশা এবং সময় থাকলেও টাকার জন্য তার পরিসমাপ্তি ঘটত। টিউশনি করে কিছু বাড়তি টাকা রোজগারের কথা সবাই ভাবে ঠিকই তবে কেউ সাফল্য পায় আর কেউ পায় না। এরই মাঝে হয়তো পছন্দের কেউ মনের মাঝে উঁকি দিতে থাকে। দুয়ে দুয়ে চার হলেই ক্যান্টিন বা নিরিবিলি কোথায় দেখা যায় সে সকল জুটিকে। কেউ বাধা দেয় না, কেউ টিপ্পনিও কাটে না। মানুষের মন যেন সম্প্রসারিত হয়ে যায় এই পরিবেশে। ছুটিতে গ্রামে গেলে শোনা যায় আলেয়া, রাবেয়াদের বিয়ে হয়ে গেছে। তাদের কথা ভাবলে তখন হাসি পায়। স্কুলের সহপাঠিরা কেউ কেউ চলে গেছে উল্টা রাস্তায়। কেউ বা বিয়ে করে অতি কষ্টে জীবন পার করছে।
মনের মাঝে জন্ম নেয় প্রতিষ্ঠিত হবার বাসনা। ভার্সিটির পড়াশুনা শেষ হবার পরেই শুরু হয় জীবন সংগ্রাম। মা-বাবার কাছ থেকে টাকা চাওয়াটা তখন অনেকটা প্রেষ্টিজ হয়ে যায়। টিউশনি বা পার্ট টাইম চাকরীর খোঁজে যখন মরিয়া ঠিক তখই হয়তো খবর আসে প্রেমিকের বিয়ে ঠিক হতে চলেছে। হয়তো উপায়ান্ত না পেয়ে বিয়ে করে সংসারী জীবনে পা রাখা। বাস্তবাতার কালো থাবার জীবনটাকে তছনছ করা।
পৌড় মানে কয়েকটা ছেলে মেয়ের বাবা, মুখে বয়সের ছাপ। হারিয়ে যাওয়া যৌবন আর বৃদ্ধের হাতছানি। সেই সাথে বাবা হওয়ার দায়িত্ব, স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব, অফিসের দায়িত্ব, বৃদ্ধ বাবা মায়ের দায়িত্ব, ছোট ভাই বোনের দায়িত্ব, পাড়া প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব, আত্মীয় স্বজনের প্রতি দায়িত্ব। সব দায়িত্ব যেনে একে একে হাজির। দায়িত্বের সাথে আড্ডা মারতে মারতে জীবনটা কখনে ঝুঁকে পড়ে বৃদ্ধের কোলে তাহার কোন হিসাব নাই। টাকা আছে কিন্তু ঘোরার সময় নাই। যখন মন চাইত নিত্য নতুন ড্রেস পরে সহপাঠিদের সাথে হাজির হওয়া তখন ছিল আর্থিক অসংগতি। আর এখন নিজের জন্য কিছু কেনার শখ নাই, বাচ্চাদের শখই নিজের শখ। ওদের আনন্দ দেখলে নিজের মনে আনন্দ। টাইম মতো ঘরে ফেরা, বাজার করা, বাবা মায়ের খোঁজ নেওয়া, ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়া, মেয়েকে কোচিং থেকে আনার মাঝেই সীমাবদ্ধ এ সময়।
যেভাবে জীবন শুরু হয়েছিল বিছানায় মল মূত্র ত্যাগ, বাবা মায়ের হাত ধরে হাটা, মুখে তুলে খাওয়ানো, আবোল তাবোল বলা মূল্যহীণ পৌড় জীবন। এ যেন পানি চক্র, যেখান থেকে শুরু সেখানেই শেষ। ফিরতে হবে সবাইকে কাঁদিয়ে যেখান থেকে এসেছি সেখানে। চোখের কোনে রাজ্যের হতাশা আর কিছু স্মৃতি যা পিছনে ফেলে আসব অনেক অনেক বছর আগে। মনে পড়বে আজকের মাকে যিনি নিজ হাতে গোসল করিয়ে দিতেন, খাওয়ায়ে দিতেন, মাথায় তেল দিয়ে দিতেন, অসুখ হলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতেন। তখনকার মনে থাকবে না কোন আনন্দ। সারা জীবন যা করেছি চোখের কোণে ভেসে উঠবে। যত পাপ, যত পূণ্যি তার হিসাব নিজেই করতে পরব। সত্যিকারের আনন্দ তখন হবে যখন দেখব পাপের চেয়ে পূণ্যিই বেশি করেছি।
অনেক কথা ভেবে ফেলেছি এই নির্জন পরিবেশে। দুরে আযানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ফিরতে হবে নামাজের জন্য।
©somewhere in net ltd.