![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কন্যা বাড়ির ইফতারি। হ্যাঁ, এর প্রচলন আমাদের এদিকে খুভ বেশি অর্থ্যাত স্বাভাবিক ব্যাপার। সহজ কথায়- কন্যার (বউ বা স্ত্রীর) বাপের বাড়ি থেকে জামাই(স্বামী বা বর) এর বাড়িতে ইফতার পাঠানো কে কইন্যা বাড়ির ইফতারি বলে পরিচয় করিয়ে দেয়া যায়। ‘ইফতার পাঠানো’ এই জন্য বললাম যে, এই ইফতার পাঠানো ব্যাপারটা কন্যা বাড়ির লোকজনদের একটা পবিত্র(?) দায়িত্ব থেকে যায়। না পাঠালে দায়িত্ব পালন হয়না। আমাদের এই সিলেট অঞ্চলে কন্যা বাড়ির ইফতারির সংস্কৃতি কবে থেকে শুরু বলতে পারছিনা, তবে বুজতে শেখার পর থেকে দেখছি এই ইফতারির প্রচলন। ইফতারির টেবিলে বসলে প্রায় দিনই আলাদা প্লেটে কিছু ইফতারি দেখতাম এবং এখনও দেখি। কোথা থেকে এসেছে জিগ্গেস করলে শুনতাম এবং শুনি পাশের বাড়ির বা ঘরের ‘অমুক’ ভাইয়ের শুশুর বাড়ি থেকে এসেছে।কিংবা ‘অমুক’ ভাবীর বাড়ি থেকে এসেছে। অর্থ্যাত বোঝাতে চাচ্ছি যে, এই ইফতারির প্রচলন আমাদের এ অঞ্চলে এতই স্বাভাবিক যে, আমরা অভ্যস্ত। বাংলা দেশের আর কোন অঞ্চলে এরকম ইফতারির প্রচলন আছে কিনা জানিনা- কিন্তু আমাদের এদিকে এটি যে একটি ভয়ংকর প্রথা তাতে বিন্দু মাত্র সন্দেহ নেই; অন্ততঃ আমার কাছে। সাধারনত বিয়ে হওয়ার পর শুশুর বাড়িতে প্রথম রমজানের ‘পহেলা ইফতারি’ কন্যা বাড়ি থেকে দেয়া হয়। অর্থ্যাত এটি ‘পয়লা রোজার ইসতারি’। ‘প্রকার’ একটু কম থাকে এবং অধিকাংশই বাড়িতে হাতের তৈরী। সন্দেশ, পিঠা সহ অনেক কিছু। এরপর কন্যা বাড়ির ইফতারি আসা শুরু হয় সাধারনত দশ রমজানের পর থেকে এবং চলে রমজানের ২০-২৫ তারিখ পর্যন্ত। আর এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য, নতুন কনের ১লা রমজানে দু’বার ইফতারি-রমজানের ১ম তারিখ এবং পরে মাজামাঝির দিকে আরেকবার, বড় ধরনের। ‘পুরনো কন্যাদের’ ক্ষেত্রে রমজানে একবারই সই। ব্যাপারটার মধ্যে সাধারন দৃষ্টিকোন থেকে সমস্যা বা দৃষ্টিকটু মনে হয়না। বরং একটা ‘ভালই’ মনে হয়। কন্যা পক্ষ্য থেকে ইফত্রি আসে, সে উপলক্ষে সঙ্গে আর চার পাঁচ জন আসেন, বরের বাড়িতে ‘ছোটখাট ইফতারির’ দাওয়াত পান প্রতিবেশীরা, একটা আত্বীয় সুলভ পরিবেশ তৈরী হয়। কিন্তু ব্যাপারটা একটু গভীর ভাবে দেখলে একটা খটকা লাগবেই। আমার যেমন লেগেছে। আমি পূর্বেই এটিকে একটি ‘ভয়ংকর প্রথা’ বলে উল্লেখ করেছি।শুনে তিক্ত হবে জানি এবং প্রায় সবার কাছেই আমি তিরস্কৃত হব; কেননা আমাদের এদিকের সবাই যে এই কন্যা বাড়ির ইফতারির ‘প্রথা’ বাচিঁয়ে রাখার সাথে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট। পরোক্ষ ব্যাপারটা না হয় এড়িয়ে গেলাম।এবার আমার ‘ভয়ংকর প্রথার’ ব্যাখ্যা দিচ্ছি। এই ‘প্রথাকে’ মন্দ বা ভয়ংকর বলতাম না, যদিনা ইফতারির আদান প্রদান উভয় পক্ষ থেকে হত এবং সেটা হত ইচ্ছানুযায়ী;সামাজিক প্রথায় দায় বদ্ধতা থেকে নয়। এখানে একটি ব্যাপারও উল্লেখ করতে হয় যে, প্রথা ও সংস্কৃতি সমাজের আনুকুল্য পেয়েই প্রসারিত হয়, বিকশিত হয়। তাই সমাজ যদি থাকে অশিক্ষায়, অন্ধকারে, সুবিধাভোগীদের প্রতিনিধিত্ব, তবে সে সমাজের প্রথা বা সংস্কৃতি কি হবে সহজেই অনুমেয়। একটি প্রথা চালু আছে বলেই তাকে চালু রাখতে হবে, তার তো কোন বুদ্ধী জ্ঞান সম্যত কারন বাছে বলে তো মনে করি না। তার উপর সে প্রথা ভাল কি মন্দ সেটিও কি আমরা দেখব না? তবে আর আমাদের উন্নতিটা কোথায়? টাকা পয়সায়? সেটাতো বাড়ছেই। কিন্তু মন মানসিকতায়, চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটছে কৈ? যদি ঘটতই তবে ইফতারির এ প্রথা আরো আগেই সীমিত হত। কিন্তু বর্তমানে এ প্রথার প্রসার বারছে বৈ কমছে না। এখানে আরেকটি ব্যাপার উল্লেখ করি যে, আমার এ লেখার উদ্দেশ্য ‘ইফতারির সংস্কৃতিকে’ অবগ্গা করা নয় বরং এই সংস্কৃতির মধ্যে আন্তরিকতা আর উচ্চ মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো। ভেবে দেখুন ১ম রোজায় কন্যা বাড়ি থেকে আসে কেন? উত্তর হয়ত এমন যে, ‘এতদিন বাবার বাড়ি ছিল- আর এখন বিয়ে হয়ে গেছে, ইফতারি নতুন মেয়ের জামাই ও মেয়েকে রেখে কেমন করে খাই? তো সে জন্য ইফতারি বাপের বাড়ি থেকে কন্যার জন্য ইফতারি আসে। অবশ্য ইফতারিটা আসে সবার জন্যই এবং পরিবারের সবাই খেয়েও উদ্ধৃত থাকে অনেক’। যদি এই হয় ১ম রোজার হাকিকত্, তো আমার কথা হচ্ছে, একটু ভিন্ন। যদি, এতদিন বাপের বাড়ি ছিল, হঠাত নতুন পরিবেশে ইফতারি করবে, তো আমাদের তো উচিত কন্যাকে তার বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া।সারা জীবনতো শুশুর বাড়িতেই ইফতারি করবে, এই রমজানে ১ম ইফতারি বাপের বাড়ি করলে ক্ষতি কি? এখানে কি আমরা উচ্চ দৃষ্টিভঙ্গী দেখাতে পারিনা? বুঝতে পারছি এ যুক্তি শুনে অনেকেই চোখ লাল করছেন এবং বলছেন ‘ কি, নতুন বউকে ১ম রোজায় ইফতারির জন্য বাপের বাড়ি পাঠাব? মাথায় ভূত চেপেছে নাকি? কোথায় নতুন বউকে নিয়ে পরিবারের সবাই ইফতারি করব, আর কিনা বলা হচ্ছে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেব? একদম ‘হক কথা’। ঝামেলা আছে। নতুন বউ নিয়ে ইফতারি যদি করবেনই, তবে কন্যা বাড়ির ইফতারি দিয়ে কেন? নিজেদের ইফতারি দিয়ে করেন না কেন? নতুন বউয়ের মুখে ১ম ইফতারি নিজের না হয়ে বউয়ের বাপের বাড়ির ইফতারি! এটা লজ্জার কথা। আত্ব সম্মানের বারোটা বাজানোর মত ব্যাপার নয়কি? কিন্তু আমরা নির্বিকার। আমরা অন্যের কাছ থেকে প্রাপ্তির আশায় নিজেদের আত্বসম্মান বোধ খুইয়ে ফেলি। কেন, আমরা কি পারিনা বরং কন্যার পিতা মাতা আর ভাই বোনদের একসাথে ইফতারি করার দাওয়াত দিতে? হ্যাঁ, আসে সবাই, কিন্তু আসে ‘দায় মিটাতে’, বিয়াই-বিয়াইনকে ইফতারি করাতে। নিজেরা খেতে পারি, অন্যদের খাওয়াতে পরিনা- এটা অবশ্যই উন্নত মানসিকতা নয়। ব্যাপারটা ভাবার অনুরোধ রইল। এবার অরেকটু গভীর দৃষ্টি দিয়ে লেখাট শেষ করব। আমাদের প্রথা সর্বস্ব জীবনের ক্ষেত্র উন্নত জীবন বোধ নেই বলেই আমরা এখনো পুরনো প্রথা ধরে রাখছি; সে প্রথা যতই অস্বাভাবিক আর খারাপ হুউক না কেন।এই যে কন্যা বাড়ি থেকে ইফতারি আসার প্রথা কবে শুরু, তার সঠিক সময় সাল জানা না থাকলেও কিন্তু আমরা এটাকে ধরে রাখছি, এটা বাস্তব সত্য। অথচ এ প্রথার অন্ধকার দিকটা আমরা দেখছিনা। অনেক ক্ষেত্রে যে এ প্রথা জুলুমের পর্যায়ে চলে যায়, সে বিষয়টা ভেবে দেখিনা। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় ( কন্যার পিতা কিংবা কন্যা বাড়ির আত্বীয় স্বজনরা, বরের পিতা তথা আত্বীয়তায়) মেয়ের বিবাহ থেকে শুরূ করে সকল অবস্থায় মেয়ের বাবা তথা মেয়ের বাড়ির লোকদেরই যেন সকল দায়বদ্বতা। মেয়েকে শুশুর বাড়ি পাঠিয়ে সে দায়বদ্ধতা যেন আর বাড়ে। সকল ক্ষেত্রে মেয়ের শুশুর বাড়ির লোকদের খুশি করে চলতে হয়। সামাজিকভাবে এই দৃষ্টি ভঙ্গীর পেছনে কি কাজ করে সেটি বিশ্লষন করা আমার এখানে উদ্দেশ্য নয়, তবে এটি বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, এটি ‘জেন্ডার বৈষম্যের’ একটি ফলাফল। এবার বলতে যাচ্ছি এই কন্যা বাড়ির ইফতারি প্রথার ভীষন কালো দিকটার কথা। এই আকালের দিনে একজন চাকরীজীবি পিতার জন্য এ প্রথা রক্ষা করা কতযে কঠিন সে ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। একদিকে জিনিসপত্রের আকাশচুম্বী মূল্য, অন্যদিকে সীমাবদ্ধ আয়। অসামাঞ্জস্যশীল এ দুটি অবস্থায় একজন পিতা কতটাযে অসহায় তা কল্পনাও করা যায়না। মেয়ের বাড়িতে ইফতার পাঠানোর নিজের ইচ্ছা যতট না তারও বেশী প্রথা রক্ষা করার বাধ্যবাদকতা। কেননা তা না হলে কথিত সামাজিক ইজ্জত থাকেনা, মেয়ের শুশুর বাড়ির লোকদের কাছে মূখ দেখানো যায়না। মেয়েকে শুনতে হয় খুচানো কথা। তাই বাধ্য হন পিতা যে কোন ভাবে এ প্রথা রক্ষায়। সীমিত আয়ের পিতা ও চাকরীজীবি পিতা তথা পরিবারের অবস্থা তখন কি দাড়ায়, সেটা বলবার নয়, উপলব্দীর বিষয়। তাই সে সকল পিতা অনেক ক্ষেত্রে ঋন করে হলেও মেয়ের বাড়ি ইফতার পাঠান।(কিংবা পাঠাতে বাধ্য হন)। কিচ্ছা কিন্তু এখানে শেষ নয়। এরপরও যে পিতার দায়িত্ব(?) থেকে যায়। সেটি হচ্ছে বেশি করে ইফতার পাঠানোর দায়িত্ব। ইফতারির আইটেম সংখ্যা বেশি হতে হবে, অন্যথায় কথাতো থেকেই যায়। আরেকটি খুভ দুঃখজনক ব্যাপার উল্লেক না করে পারছিনা। যদি কন্যা পক্ষের অর্থনৈতিক অবস্থা বর পক্ষের মত না হয়, তখন কিন্তু দেখা দেয় মেয়ের শুশুর বাড়ির সামাজিক মর্যাদা হানির শংকা। বিয়েতো হয়ে গিয়েছেই, পারিবারিক অবস্থা সমান নয়,কিন্তু এই ইফতারির ক্ষেত্রেও যদি ‘চোখে লাগার মত’ অবস্থা হয়,তবে ইজ্জত থাকে কোথায়? তাই মেয়ের শুশুর অনেক ক্ষেত্রে নিজে টাকা দিয়ে ইফতারি কিনে দেন এবং এ ইফতারি ‘কন্যা বাড়ি’ থেকে এসেছে বলে চালিয়ে দেয়া হয়। আবার এও হয়, কন্যার বাপের বাড়ির লোকের কাছে টাকা দিয়ে দেয়া হয়, যাতে সময় মত ‘কন্যা বাড়ির ইফতারি’ চলে আসে শুশুর বাড়ি। আমাদের এই দিকে ‘লন্ডনীদের উপদ্রব’ বেশি বলে এই রকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে। ‘লন্ডনীরা’ তাদের ‘লন্ডনীগিরী’ দেখাতে গিয়ে কি যে করেন, তা নিজ চুক্ষে অবলোকন না করলে বিশ্বাস করার নয়। কন্যা বাড়ি থেকে ইফতারি আসবে, তাই সে উপলক্ষে সারা গ্রামে দাওয়াত দেয়া হয়। গরু জবাই হয়। আর কন্যা বাড়ির লোকেরা বাধ্য হন গ্রাম সম মানুষকে ইফতারি করাতে। ‘লন্ডনীদের’ জন্য ব্যাপারটা ‘হাওয়া’ হলেও আমাদের মত ‘দেশীদের’ ক্ষেত্রে বাতাস চুপসে যে যেতে হয় কখনো কখনো, তার খবর অনেকেই জানেন না। এসব বিষয় প্রকাশেরও না। তাই অনিচ্ছায় হলেও ঘটনা ঘটছে, ঘটনার জন্ম দিচ্ছে আর প্রথা হিসেবে ব্যাপারটি কারো কারো জন্য জুলুমের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। আমার এ লেখা অগোছাল মানি, কিন্তু আমি যে ব্যাপারটা বুঝাতে চাচ্ছি, জানিনা, তা বুঝাতে উঠতে পেরেছি কিনা? সংক্ষেপে বললে যা হয়, সেটি হচ্ছে- এই কন্যা বাড়ির ইফতারির প্রথাটি সংস্কৃতি হিসেবে ভালো হত, যখন সমভাবে আদান প্রদান হত, কিন্তু এটিকে শুধু কন্যা বাড়ির লোকদের জন্য পালনীয় প্রথা হিসেবে নেয়া-কখনই গ্রহনযোগ্য নয়। তাই এ ব্যাপারে চিন্তাশীল ব্যাক্তিগন একটু ভাবার জন্য সময় দেবেন, সামাজিকভাবে এটিকে সুন্দর রুপ দেবার চেষ্টা করবেন কিংবা একে বিলোপ করার উদ্যোগ নেবেন-এটিই বিনিত অনুরোধ। আর একটি কথা- যারা সময়ের শেষ পর্যায়ে, বাবা-শুশুরের পর্যায়ে চলে গেছেন, তাদের প্রতি আমার কোন অনুরোধ নেই, কিন্তু যারা বর কিংবা বর হওয়ার পথে, কাদের কাছে অনুরোধ এ ইফতারি প্রথাকে অস্বীকার করুন, একে অপপ্রথা হিসেবে দেখুন এবং আগামী প্রজন্মের কাছে এ অপপ্রথা বিলোপ কারীদের একজন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করুন।
©somewhere in net ltd.