![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মুজিবের প্রতিও জন্মুক তরুণ প্রজন্মের ঘৃণা
কাউসার ইকবাল
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের যথার্থ শাস্তি প্রদানের দাবিতে তরুণ প্রজন্ম শাহবাগের মোড় থেকে আন্দোলন শুরু করেছে। তবে তরুণরা বর্তমানে যাদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছে, তাদের কারো বিরুদ্ধে লাখো জনতাকে হত্যায় সহযোগিতার অভিযোগ নেই। কিন্তু যার বিরুদ্ধে ২১ লক্ষ ৬৬ হাজার ৬৬৭ জনকে হত্যায় সহযোগিতা করার এবং ১ লক্ষ ৪৪ হাজার ৪৪৪ জনকে ধর্ষণে সহযোগিতার অভিযোগ তোলা যাবে, সেই মুজিবকেও তরুণ প্রজন্মের ঘৃণা জানাবার এখনই সময়। তরুণ প্রজন্ম অঙ্ক এবং দর্শনে খুবই কার্যকরী জ্ঞান রাখে, এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকতে পারে না। বর্তমান আন্দোলনও এ কথারই প্রমাণ বহন করছে যে, তরুণরা বিচার বিভাগের বিচারক ও সরকারের চেয়েও ভালো জ্ঞান রাখে কোন অপরাধীকে কি শাস্তি প্রদান করতে হবে সে বিষয়ে। অতএব, তরুণ প্রজন্মের দরবারে একাত্তরের সবচেয়ে বড় মানবতাবিরোধী অপরাধী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে তার বিচারের দায়িত্ব তুলে দেয়া বিবেকের দায় মনে করছি।
মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামপন্থি জনগণ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল বলেই ইংরেজ সরকার ভারতের পরিবর্তে বাংলাদেশ অঞ্চলকে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করে পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিল। ভারতের রাজনৈতিক স্বার্থে পাকিস্তানের ভাঙনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্ম তাই ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলের অনেকে কামনা করেনি। তাদের এই কামনা না করা যদি অপরাধ হয়, তবে পাকিস্তানের শাসনক্ষমতার লোভে যিনি ২১ লক্ষ ৬৬ হাজার ৬৬৭ জনকে হত্যায় এবং ১ লক্ষ ৪৪ হাজার ৪৪৪ জনকে ধর্ষণে সহযোগিতা করেছিলেন, সেই মুজিবকে সবচেয়ে বড় মানবতাবিরোধী অপরাধী বলা যাবে না কেন?
১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বাংলাদেশ অঞ্চলে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য সংখ্যা ছিল মাত্র ২৫ হাজার। ১ মার্চ থেকেই ১৯৭১ সালের তরুণ প্রজন্ম তাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য চাপ দেয়া শুরু করেছিল। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল এবং ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ স্লোগান ছড়িয়ে দিচ্ছিল ছাত্র সমাজ। ৩ মার্চ পল্টনে ছাত্রলীগের সমাবেশে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেছিলেন শাজাহান সিরাজ। আর ৭ মার্চের সমাবেশে বাংলাদেশের স্পষ্ট স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য মুজিবের ওপর চাপ প্রয়োগ করে আসছিল তৎকালীন ছাত্র নেতৃত্ব। ৭ মার্চের সমাবেশে মুজিব তৎকালীন তরুণ প্রজন্মের দাবি মোতাবেক স্বাধীনতার স্পষ্ট ঘোষণা দিলে ২৫ হাজার পাক সেনাকে মোকাবেলা করতে প্রস্তুত ছিল তরুণরা তারুণ্যের শক্তিতে বর্শা-বল্লম হাতেই। এজন্য বর্শা-বল্লম হাতেই তারা রেসকোর্স ময়দানে হাজির হয়েছিল মুজিবের ঘোষণা শুনে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আক্রমণের মানসিকতা নিয়ে। কিন্তু মুজিব তরুণ প্রজন্মের প্রাণের দাবির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলেন পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা পাওয়ার লোভে এবং হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আলোচনার নামে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত আরো ৬৫ হাজার পাক সেনা বাংলাদেশে ঢোকাবার সুযোগ করে দিলেন। এতে করে বাংলাদেশে ৯০ হাজার পাকিস্তানি সেনা মজুত হলো। আর ৩০ লক্ষ বাঙালি হত্যা ও ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানিতে এই অতিরিক্ত ৬৫ হাজার সেনার দ্বারা আনুপাতিক হারে ২১ লক্ষ ৬৬ হাজার ৬৬৭ জনকে হত্যায় সহযোগিতা করার এবং ১ লক্ষ ৪৪ হাজার ৪৪৪ জনকে ধর্ষণে সহযোগিতার অভিযোগ তোলা যাবে মুজিবের বিরুদ্ধে। মুজিব কিছুতেই এই অভিযোগ থেকে পরিত্রাণ পেতে পারেন না।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করলে এ বিষয়টাই পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, শেখ মুজিবুর রহমান কিছুতেই পাকিস্তান রাষ্ট্র ভাঙতে চাননি। কিন্তু এ দেশের বেশিরভাগ মানুষ শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ শুনে এই ভাষণটিকেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মনে করে। ইতিহাস সম্বন্ধে বাঙালিদের অজ্ঞতার কারণে বেশিরভাগ বাঙালিই এ বিষয়টা মাথায় আনতে চায় না যে, শেখ মুজিবুর রহমানের মুখ থেকে স্বাধীনতা প্রসঙ্গে কোন কথা বের হবার আগেই ১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘মুক্তি যদি পেতে চাও, বাঙালিরা এক হও’ ইত্যাদি স্লোগান দিয়েছে এবং ২ মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ৩ মার্র্চে পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের সম্মেলনে ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণা’ সম্বলিত স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়েছে। ছাত্রদের এসব তৎপরতায় ২ মার্চ থেকে ৬ মার্চের মধ্যে দেশবাসী স্বাধীনতা লাভের জন্য এতোটাই উদ্দীপিত হয়ে উঠেছিল যে, ৭ মার্চের রেসকোর্স ময়দানের ভাষণের পূর্বে অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছিলÑ সারা দেশবাসীই চাচ্ছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হোক, কেবল শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি ও এই দলের নির্বাচিত পরিষদ সদস্যরাই চাচ্ছিলেন না যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হোক। শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের আগেই দশ লক্ষাধিক বাঙালি বর্শা-বল্লম যার যা আছে তা হাতে নিয়ে রেসকোর্স ময়দানে হাজির হয়েছিল শেখ মুজিব কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা তথা যুদ্ধ শুরুর নির্দেশ পেয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের উদ্দেশ্যে। কিন্তু মুজিবের মুখ কেউ চেপে ধরে না থাকলেও তিনি বললেনÑ ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যার যা আছে তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করবে।’ হুকুমটা তখনই তিনি দিলেন না কেন, এই প্রশ্নটা কেউ তুলতে যায় না। তখন তার হুকুম শুনে দশ লক্ষাধিক বাঙালি ক্যান্টনমেন্ট ছুটে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। সংগঠিত জনতা একসঙ্গে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের উদ্দেশ্যে ছুটলে তার যে ফল পাওয়া যেত, তার চেয়ে বিচ্ছিন্ন জনতার হেথা-হোথা বর্শা-বল্লম ধরার ফল অনেক কম। এ কথা বোঝার ক্ষমতা যে শেখ মুজিবুর রহমানের ছিল না, তা কিন্তু নয়। তিনি বুঝে-শুনেই সংগঠিত জনতাকে ক্যান্টনমেন্টের উদ্দেশ্যে ছুটে যাবার হুকুম দেন নাই। কারণ, এতে তার পাকিস্তানের ক্ষমতালাভের পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যেত। পাকিস্তানের ক্ষমতালাভের পথ যাতে চিরতরে বন্ধ হয়ে না যায়, সেজন্য বরং তিনি সুকৌশলে সংগঠিত জনতাকে তাদের সঙ্গে করে নিয়ে আসা বর্শা-বল্লম অব্যবহৃত রেখেই ক্যান্টনমেন্টের বিপরীত রাস্তা ধরিয়ে ফেরত পাঠালেন। শেখ মুজিবের এক নির্দেশেই ৭ মার্চ যেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতালাভের পথ অনেক সহজ হয়ে যেত, সেখানে পাাকিস্তানের ক্ষমতালাভের পথ খোলা রাখতে তিনি সংগঠিত জনতাকে নিষ্ক্রিয় করার বাসনা নিয়ে যে অপকৌশলে দশ লক্ষাধিক বাঙালিকে ক্যান্টনমেন্টের বিপরীত রাস্তা ধরালেন, তা স্বাধীনতাকামী সকল বাঙালির সাথে প্রতারণার শামিল। এই লোকগুলো ৭ মার্চই শেখ মুজিবের এক নির্দেশে হাসিমুখে সম্মুখ সমরে প্রাণ দিতে রাজী ছিল এবং সেদিন তাদের রক্তদান জাতির জন্য খুবই কার্যকরী হতো দ্রুত স্বাধীনতালাভে। কিন্তু এই লোকগুলোকেই, বিশেষ করে এদের নেতৃত্বে থাকা ছাত্রদের ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র অবস্থায় অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করতে হলো, যার প্রভাব বরং নেতিবাচক হলো জাতির জন্য। ৭ মার্চের সংগঠিত জনতার শক্তির স্থলে ২৫ মার্চ রাতের আক্রমণের পর স্বাধীনতাকামীরাই অসহায় বোধ করে পালাতে শুরু করল এদিক-ওদিক। এদের অনেকেই অতিরিক্ত পাক বাহিনীর সৈন্যদের সম্মুখে পড়ে প্রাণ হারাল। আর অনেকে ভারতে পাড়ি দিয়ে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করতে করতে ৫/৬ মাস সময় পেরিয়ে গেল। এতে সামগ্রিকভাবে দেশে থাকা বাঙালিদের প্রাণহানি ঘটল ব্যাপকভাবে এবং নারীদের সম্ভ্রমহানিও ঘটতে থাকল প্রচুর পরিমাণে। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতালাভে আন্তরিক হতেন এবং পাকিস্তানের ক্ষমতালোভ তার না থাকত, তবে ৭ মার্চই সংগঠিত জনতাকে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের নির্দেশ দিলে ২৫ হাজার পাকসেনাকে পরাভূত করা বাঙালিদের জন্য অনেক সহজসাধ্য হতো। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ক্ষমতার লোভ না থাকলে তিনি পাকিস্তানিদের সঙ্গে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ১৬-২৫ মার্চ পর্যন্ত দর কষাকষি করতে যেতেন না। আর তার ক্ষমতার লোভের কারণেই ২৫ মার্চ পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকে বাঙালিদের স্বাধীনতার চেতনা দমিয়ে দেবার জন্য এদেশে পাক সেনা মোতায়েনের সুযোগ করে দিলেন। সেই সুযোগে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ পরবর্তী ১৮ দিনে আরো ৬৫ হাজার সৈন্য মজুত করল বাংলাদেশে এবং ২৫ মার্চ সন্ধ্যা থেকে বাঙালিদের স্বাধীনতার চেতনা গুঁড়িয়ে দিতে তৎপরতা চালাল। মুজিব তখনও স্বাধীনতার জন্য নেতৃত্ব দিতে অন্য আওয়ামী লীগ নেতাদের মতো গৃহত্যাগ না করে পাকিস্তানের ক্ষমতা লাভের পথ খোলা রাখতেই গৃহে থেকে গেলেন। আরো একটি বিষয়ে বাঙালিদের ভাবা দরকার যে, যুদ্ধের নিয়ম হচ্ছে, প্রধান শত্রুকে হাতের মুঠোয় পেলে তাকে হত্যা করা। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ শেখ মুজিবুর রহমানকে হাতের মুঠোয় পেয়েও হত্যা করেনি। বরং হত্যা করেছে ছাত্র-সৈনিকসহ সাধারণ বাঙালিদের। আর নিরাপত্তা দিয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারসহ ‘রাজাকার’ হিসেবে চিহ্নিত পাকিস্তানপন্থিদের পরিবারকে। এমনকি ঢাকা সেনানিবাসের সিএমএইচ-এ শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়-এর নিরাপদ জন্মের ব্যবস্থাও করেছিল। ৩৮/৪ বাংলাবাজার, ঢাকাস্থ বিদ্যাপ্রকাশ থেকে ২০০২ সালের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত ‘রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের কথা’ বইটির ৩০ নং পৃষ্ঠায় মুক্তিযোদ্ধা ইশতিয়াক আজিজ উলফাতের সাক্ষাৎকারে একথা উঠে এসেছে। অথচ, মৃত্যুর দুয়ারে পাকিস্তানি সেনারা প্রতিদিনই পাঠিয়েছে নিরীহ ও স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের। ‘রাজাকার’দের মতো পাকিস্তানপন্থি হিসেবে যদি শেখ মুজিবুর রহমান নিজেকে প্রমাণিত না করে থাকেন পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের কাছে এবং বাঙালিদের স্বাধীনতার চেতনা দমনে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকে বাংলাদেশে পাক সেনা মজুদে সহায়তা না করে থাকেন, তবে শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের প্রতি পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের এমন উদারতার অন্য কি কারণ থাকতে পারে? দৃশ্যতঃ শেখ মুজিবুর রহমানই তো ছিলেন পাকিস্তানিদের প্রধান শত্রু। প্রধান শত্রুর পরিবারের প্রতি উদারতা, আর অন্য বাঙালি পরিবারের প্রতি নির্মমতার রহস্য তবে কি? পাকিস্তানের ক্ষমতালাভের পথ খোলা রাখার জন্য বাঙালিদের স্বাধীনতার চেতনা দমাতে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকে যদি সমর্থন ও সহযোগিতা মুজিব না করতেন, তবে ২৫ মার্চ’১৯৭১ ইং রাত্রে মুজিবের পরিবারের ওপরই তো সর্বপ্রথম কামানের গোলা ছোড়ার কথা পাক সেনাদের। প্রধান শত্রুর পরিবারকে নিরাপদ রেখে ছোট শত্রুদের হত্যা করার মতো মূর্খ তো পাকিস্তানি জান্তারা হবার কোন কারণই নেই। বাঙালিরা তাদের বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে এই বিষয়টি আজো বুঝতে পারেনি। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান একাত্তরের মার্চেই বুঝে গেছিলেন যে, পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর চেয়ে বড় দেশপ্রেমিক (পাকিস্তানপ্রেমিক) ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। মৃত্যুর ২ বছর আগে ২৯ মে ১৯৭৮ ইং তারিখে পাকিস্তানের লাহোর কোর্টে এক গোপন এফিডেভিটে (ক্রমিক নং-২৪৪/১৯৭৮) সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান এ কথা বলে যান। ১৯৮০ সালের আগস্ট মাসে ইয়াহিয়া খানের মৃত্যুর ২৫ বছর পর ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তান সরকার এফিডেভিটটি জনসমক্ষে প্রকাশ করে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক প্রতিচিত্র-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১১ ইং সংখ্যায় এফিডেভিটের চুম্বক অংশগুলি ছাপা হয়। এফিডেভিটে ইয়াহিয়া বলেন যে, ‘শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর চেয়ে বড় দেশপ্রেমিক (পাকিস্তানপ্রেমিক) ছিলেন। ভুট্টো যেখানে ১৯৭০ সালের নির্বাচন থেকে শুরু করে সংসদ অধিবেশন তলব করা নিয়ে বারবার বাধা সৃষ্টি করেছেন, সেখানে শেখ মুজিব ছিলেন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ অনুসরণের পক্ষে। এফিডেভিটে ইয়াহিয়া আরো বলেন: ‘মুজিব নন, ভুট্টোই পাকিস্তান ভেঙেছেন। একাত্তরে ভুট্টো যেসব কথা বলেছেন, যে গোয়ার্তুমি করেছেনÑ পাকিস্তানের সংহতি বিনষ্টে নিঃসন্দেহে তা ছিল শেখ মুজিবের ৬ দফার তুলনায় অনেক বেশি আত্মঘাতী। তখন ক্ষমতালিপ্সায় ভুট্টো এতোটাই পাগল হয়ে উঠেছিলেন যে, এক পাকিস্তানে দুই প্রধানমন্ত্রী তত্ত্ব দাঁড় করাতেও তিনি জেদ ধরেছিলেন। তার উচ্চাভিলাষ এবং একরোখা ও কঠিন মনোভাবের কারণেই পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্্েরাহের আগুন জ্বলে উঠেছিল এবং বাঙালির মন বিষিয়ে তুলেছিল। আর এসব কারণেই পাকিস্তানের সংহতি ধরে রাখা যায়নি। পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে যায়।’
যুদ্ধক্ষেত্রে কিংবা শক্রুতামূলক আচরণে প্রধান শক্রকে কখনো ছাড় দেয় না কেউই। কিন্তু ইয়াহিয়া খান বাঙালিদের নির্বিচারে হত্যা করার নির্দেশ দিলেও শেখ মুজিবুর রহমানকে রক্ষা করেছিলেন ভুট্টোর সকল প্রকার ষড়যন্ত্র থেকে। শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিদের প্রতি নয়Ñ বরং এক পাকিস্তানের অস্তিত্বের প্রতিই অধিক বিশ্বাসী, একথা বাঙালিরা অতি আবেগের কারণে না বুঝলেও ইয়াহিয়া খান ঠিকই বুঝে নিয়েছিলেন। তাই পাকিস্তানকে এক রাখার স্বার্থে তিনি মুজিবের মৃত্যু কামনা করেননি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ মুজিবের এই উচ্চারণ যে বাঙালিদের বোকা বানিয়ে পাকিস্তানকে অটুট রাখার এক কৌশল, তাও ইয়াহিয়া ভালো করেই বুঝেছিলেন। কারণ, সেদিন মুজিব ইচ্ছা করলেই পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করার ঘোষণা দিতে পারতেন। ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমাদের যার যা কিছু আছে, তা নিয়ে শক্রুর মোকাবেলা করবে’ মুজিবের এসব ঘোষণা যে স্রেফ রাজনৈতিক ভাওতাবাজির মাধ্যমে বাঙালিদের বোকা বানানোর চেষ্টা, তা বুঝতেও ইয়াহিয়া ভুল করেননি। কারণ, বাঙালির যার যা কিছু আছে, তা নিয়েই সেদিন বাঙালিরা রেসকোর্স ময়দানে হাজির হয়েছিল এবং মুজিবের হুকুম দেবার পথে কোন বাধা ছিল না। মুজিব সেদিন চাইলেই লাখো জনতাকে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করার হুকুম দিতে পারতেন এবং পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য সরাসরি অ্যাকশনে যেতে পারতেন। কিন্তু এক পাকিস্তানের প্রতি বিশ্বস্ত বলেই মুজিব তেমন পদক্ষেপ নেননি, একথা বুঝতে কোন অসুবিধা হয়নি ইয়াহিয়ার। তাই নিরীহ বাঙালিদের হত্যার জন্য তিনি অপারেশন সার্চলাইটের নির্দেশ দিলেও মুজিবের জীবন রক্ষার্থে তার চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। অতএব, একথা স্পষ্ট যে, বাঙালির মহাশক্রু ইয়াহিয়া খানের পরম বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রকৃতপক্ষে বাঙালিদের বন্ধু ছিলেন না। বরং ইয়াহিয়া খানকে বাঙালিদের হত্যায় সৈন্য মজুতের সুযোগ দিয়েছিলেন তিনি আলাপ-আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে। এতে করে প্রায় ৬৫ হাজার অতিরিক্ত সৈন্য মজুতের সুযোগ পেয়েছিল ইয়াহিয়া খান। তাই মুজিবকে বাঙালিদের বন্ধু বা জাতির পিতা ভাবা বাঙালিদের বুদ্ধির দীনতা ছাড়া কিছু নয়। বাঙালিদের প্রকৃত বন্ধু আসলে ইয়াহিয়ার শত্রু সেই সময়ের ছাত্র-জনতা এবং এ জাতির পিতা-মাতাও সেই সময়ের দেশের ছাত্র-সৈনিক-জনতা। ছাত্র-সৈনিক-জনতা চেয়েছিল বলেই বাঙালিরা পাকিস্তানিদের যুদ্ধে পরাজিত করে দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে পেরেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস এ কথাই বলে।
এদেশের জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছে। ক্ষমতার লোভে পাকিস্তানি শোষকদের প্রেতাত্মা হয়ে মুজিব এদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিহত লাখ লাখ মানুষের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা কি করেনি? তাহলে মুজিব ও তার সঙ্গে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার নামে এদেশে পাক সেনা মজুতের সুযোগ দেবার অপরাধে ড. কামালসহ অন্য আওয়ামী লীগ নেতারাও কি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় থেকে রক্ষা পেতে পারেন? তরুণ প্রজন্মের কাছে এর বিচারের ভার ছেড়ে দিলাম। বিচার যদি করতেই হয়, তবে একাত্তরের তরুণ প্রজন্মের যথার্থ উত্তরসূরী হিসেবে পূর্ব প্রজন্মের প্রতি অন্যায় ও অবিচারের তথা বিশ্বাসঘাতকতার বিচার যথার্থভাবেই করুক আজকের প্রজন্ম।
©somewhere in net ltd.