নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কাউসার ইকবাল

সাংবাদিক ও লেখক

কাউসার ইকবাল

সাংবাদিক ও লেখক

কাউসার ইকবাল › বিস্তারিত পোস্টঃ

মুজিব-জিয়ার গল্প

২৮ শে এপ্রিল, ২০১৪ বিকাল ৩:১৭

মুজিব-জিয়ার গল্প

কাউসার ইকবাল

কর্মজীবনে ঢুকে গেলে বন্ধু-স্বজন অনেকের সঙ্গেই আর নিয়মিত দেখা হয় না। এলাকার যারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাদের কারো সঙ্গেও এক মাস ধরে দেখা হয়নিÑ এমন ঘটনার মুখোমুখিও হয়েছি কয়েকবার। আর প্রবাস জীবনযাপন করছে যারা, যেমন আমার বউয়ের বড় ভাই হার”নুর রশীদ মানিককে ৮ বছর পর দেখেছিÑ এমন ঘটনাও ঘটেছে। আবার বেকার থাকলে অনেকের সঙ্গেই দেখা হয়ে যায় রাস্তায় বেরোলে। সন্ধ্যায় হাঁটতে হাঁটতে এ ব¬ক বাদামতলী মোড়ে পৌঁছলে প্রথমে নাছির”ল মাওলা বাদল, এরপর কাজী আবদুজ জাহেরের সঙ্গে দেখা। তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পর দেশের রাজনীতি প্রসঙ্গে কথা উঠে গেল। এর মধ্যে কামর”ল ইসলাম, হাবিবুর রহমান বাবুল, আবদুল করিম ভুট্টু, রেজাউল করিম ভুট্টু, মহিউল ইসলাম বদর, দেলোয়ার হোসেন ভোলাও যোগ দিল আমাদের সঙ্গে। রেজাউল করিম ভুট্টু ছাড়া আর সবাই বিএনপির সমর্থক হিসেবে পরিচিত। রেজাউল করিম ভুট্টু আবার আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ সমর্থক। আমি নিজেও একসময় এলাকায় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। কিন্তু আদর্শকেই প্রাধান্য দেই বলে বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট সরকারের আমলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের জরিপের ফলাফলে বাংলাদেশ পর পর ৪ বার বিশ্বের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দুর্নীতিপ্রবণ দেশ বলে বিবেচিত হলে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপিকে ত্যাগ করি আমি। কারণ, বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলাম জিয়াউর রহমানের দেশপ্রেম ও সততার প্রতি আকৃষ্ট হয়েই। কিন্তু তার গড়া দল বিএনপিতে অসৎ লোকের পাল্ল¬া ভারী হয়ে উঠলে সেই দলে থাকার আর কোন যুক্তি থাকে না। তাই বিএনপিকে ত্যাগ করে অনেকদিন রাজনীতিবিমুখ ছিলাম। পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি গঠিত হলে ঘটনাচক্রে দলটির তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক সাদেক আহমদ খানের আহ্বানে এ দলে যোগ দেই। কিন্তু এ দলটিও বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটে যোগ দিলে আবার রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়েছি। কারণ, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট কিংবা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে আদর্শ রাজনৈতিক প্ল-াটফর্ম বলার উপায় নেই এখন। বড় দুটি দলের নেতৃত্বেই লুটপাটের রাজনীতি দেশে প্রতিষ্ঠিত আছে ১৯৯৭ সাল থেকে। এর আগেও যে দেশ দুর্নীতিমুক্ত ছিল, এমনটা মনে করার কোন কারণ নেই। তবে জিয়াউর রহমানের ১৯৭৬-১৯৮১, বিএনপির ১৯৯১-১৯৯৬ এবং ওয়ান/ইলেভেন সরকারের ২ বছর দুর্নীতি তুলনামূলক কম ছিলÑ এমনটা বলাই যায়। তবে যেহেতু বিগত বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারগুলোর আমলে দেশে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের মাত্রা বেড়ে গেছে, তাই সততার রাজনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সৎ ব্যক্তির নেতৃত্বে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গড়ে তোলা জর”রি মনে করি। আর নিজেকে সৎ মনে করি বলে ‘মানুষের দল’ বা ‘হিউম্যান পার্টি’ নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গড়ে তোলার উদ্যোগও নিয়েছিলাম একবার। কিন্তু আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ার জন্য ১৯৭১-এর মতো নিবেদিতপ্রাণ কর্মী একজনও খুঁজে পাইনি বলে সেই উদ্যোগ আগায়নি। এখনকার বেশিরভাগ তর”ণকেই দেখছি নিজের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়েই ব্যস্ত থাকতে। সমাজ বা রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন এখন গৌণ বিষয়। আর নিজে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পেছনে ছুটছি না বলে সবার কাছে অযোগ্য ব্যক্তি হয়ে আছি। সমাজ বা রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের জন্য তাই কোন উদ্যোগ গ্রহণের কথা বললে উল্টো হাসির পাত্র হয়ে যাই। সবাই প্রায় একই ভাষায় নসিহত করেÑ আগে নিজের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য চেষ্টা করো। আর্থিক উন্নতিটাই বর্তমানে মানুষের জীবনের উন্নতির নির্ণায়ক হিসেবে বিবেচিত হয়। আত্মিক বা আদর্শিক উন্নতিকে বড় করে দেখে না কেউ। তাইতো মিথ্যে আর অন্যায়ের দাপট সমাজে বেশি। আর মিথ্যের দাপট এতোটাই বেশি যে, সবচেয়ে বড় পাকিস্তানপন্থি যিনি ছিলেন ১৯৭১ সালে বাঙালিদের মধ্যে, তিনিই এখন সবচেয়ে বড় বাংলাদেশপন্থি বলে স্বীকৃতি পেয়ে গেছেন। সেই সঙ্গে ‘জাতির জনক’, ‘বঙ্গবন্ধু’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত হচ্ছেন। অথচ ১৯৭১ সালের মার্চে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেয়েছেন, তাদেরকে তিনি পাকিস্তানিদের কাছে উগ্রপন্থি বলে বর্ণনা করেছেন এবং পাকিস্তানের বিভাজন যাতে না ঘটে, সেজন্য তিনি তৎকালীন পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের অনুরোধ রেখেছিলেন; অথচ স্বাধীনতাকামী ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য যে চাপ ছিল, তা কৌশলে এড়িয়ে গেছেন। পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাদের লেখা বইয়ে এ ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাদের লেখা বইয়ের তথ্য এবং ২৫ মার্চ পর্যন্ত ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করলে এ বিষয়টাই পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, শেখ মুজিবুর রহমান কিছুতেই পাকিস্তান রাষ্ট্র ভাঙতে চাননি। কিন্তু এ দেশের বেশিরভাগ মানুষ শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ শুনে এই ভাষণটিকেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মনে করে। ইতিহাস সম্বন্ধে বাঙালিদের অজ্ঞতার কারণে বেশিরভাগ বাঙালিই এ বিষয়টা মাথায় আনতে চায় না যে, শেখ মুজিবুর রহমানের মুখ থেকে স্বাধীনতা প্রসঙ্গে কোন কথা বের হবার আগেই ১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরÑ বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘মুক্তি যদি পেতে চাওÑ বাঙালিরা এক হও’ ইত্যাদি স্লে¬াগান দিয়েছে এবং ২ মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ৩ মার্র্চে পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের সম্মেলনে ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণা’ সম্বলিত স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়েছে। ছাত্রদের এসব তৎপরতায় ২ মার্চ থেকে ৬ মার্চের মধ্যে দেশবাসী স্বাধীনতা লাভের জন্য এতোটাই উদ্দীপিত হয়ে উঠেছিল যে, ৭ মার্চের রেসকোর্স ময়দানের ভাষণের পূর্বে অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছিলÑ সারা দেশবাসীই চাচ্ছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হোক, কেবল শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি ও এই দলের নির্বাচিত পরিষদ সদস্যরাই চাচ্ছিলেন না যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হোক। শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের আগেই দশ লক্ষাধিক বাঙালি বর্শা-বল্লম যার যা আছে, তা হাতে নিয়ে রেসকোর্স ময়দানে হাজির হয়েছিল শেখ মুজিব কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা তথা যুদ্ধ শুর”র নির্দেশ পেয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের উদ্দেশ্যে। কিন্তু মুজিবের মুখ কেউ চেপে ধরে না থাকলেও তিনি বললেনÑ ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যার যা আছে তা-ই নিয়ে শত্র”র মোকাবেলা করবে।’ হুকুমটা তখনই তিনি দিলেন না কেন, এই প্রশ্নটা কেউ তুলতে যায় না। তখন তার হুকুম শুনে দশ লক্ষাধিক বাঙালি ক্যান্টনমেন্ট ছুটে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। সংগঠিত জনতা একসঙ্গে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের উদ্দেশ্যে ছুটলে তার যে ফল পাওয়া যেত, তার চেয়ে বিচ্ছিন্ন জনতার হেথা-হোথা বর্শা-বল্লম ধরার ফল অনেক কম। এ কথা বোঝার ক্ষমতা যে শেখ মুজিবুর রহমানের ছিল না, তা কিন্তু নয়। তিনি বুঝে-শুনেই সংগঠিত জনতাকে ক্যান্টনমেন্টের উদ্দেশ্যে ছুটে যাবার হুকুম দেন নাই। কারণ, এতে তার পাকিস্তানের ক্ষমতালাভের পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যেত। পাকিস্তানের ক্ষমতালাভের পথ যাতে চিরতরে বন্ধ হয়ে না যায়, সেজন্য বরং তিনি সুকৌশলে সংগঠিত জনতাকে তাদের সঙ্গে করে নিয়ে আসা বর্শা-বল্ল¬ম অব্যবহৃত রেখেই ক্যান্টনমেন্টের বিপরীত রাস্তা ধরিয়ে ফেরত পাঠালেন। শেখ মুজিবের এক নির্দেশেই ৭ মার্চ যেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতালাভের পথ অনেক সহজ হয়ে যেত, সেখানে পাাকিস্তানের ক্ষমতালাভের পথ খোলা রাখতে তিনি সংগঠিত জনতাকে নিষ্ক্রিয় করার বাসনা নিয়ে যে অপকৌশলে দশ লক্ষাধিক বাঙালিকে ক্যান্টনমেন্টের বিপরীত রাস্তা ধরালেন, তা স্বাধীনতাকামী সকল বাঙালির সাথে প্রতারণার শামিল। এই লোকগুলো ৭ মার্চই শেখ মুজিবের এক নির্দেশে হাসিমুখে সম্মুখ সমরে প্রাণ দিতে রাজী ছিল এবং সেদিন তাদের রক্তদান জাতির জন্য খুবই কার্যকরী হতো দ্র”ত স্বাধীনতালাভে। কিন্তু এই লোকগুলোকেইÑ বিশেষ করে এদের নেতৃত্বে থাকা ছাত্রদের ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র অবস্থায় অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করতে হলো, যার প্রভাব বরং নেতিবাচক হলো জাতির জন্য। ৭ মার্চের সংগঠিত জনতার শক্তির স্থলে ২৫ মার্চ রাতের আক্রমণের পর স্বাধীনতাকামীরাই অসহায় বোধ করে পালাতে শুর” করল এদিক-ওদিক। এদের অনেকেই অতিরিক্ত পাক বাহিনীর সৈন্যদের সম্মুখে পড়ে প্রাণ হারাল। আর অনেকে ভারতে পাড়ি দিয়ে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুর” করতে করতে ৫/৬ মাস সময় পেরিয়ে গেল। এতে সামগ্রিকভাবে দেশে থাকা বাঙালিদের প্রাণহানি ঘটল ব্যাপকভাবে এবং নারীদের সম্ভ্রমহানিও ঘটতে থাকল প্রচুর পরিমাণে। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতালাভে আন্তরিক হতেন এবং পাকিস্তানের ক্ষমতালোভ তার না থাকত, তবে ৭ মার্চই সংগঠিত জনতাকে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের নির্দেশ দিলে ২৫ হাজার পাকসেনাকে পরাভূত করা বাঙালিদের জন্য অনেক সহজসাধ্য হতো। সবচেয়ে বড় কথা হলোÑ ক্ষমতার লোভ না থাকলে তিনি পাকিস্তানিদের সঙ্গে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ১৬-২৫ মার্চ পর্যন্ত দর কষাকষি করতে যেতেন না। আর তার ক্ষমতার লোভের কারণেই ২৫ মার্চ পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকে বাঙালিদের স্বাধীনতার চেতনা দমিয়ে দেবার জন্য এদেশে পাক সেনা মোতায়েনের সুযোগ করে দিলেন। সেই সুযোগে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ পরবর্তী ১৮ দিনে আরো ৬৫ হাজার সৈন্য মজুত করল বাংলাদেশে এবং ২৫ মার্চ সন্ধ্যা থেকে বাঙালিদের স্বাধীনতার চেতনা গুঁড়িয়ে দিতে তৎপরতা চালাল। মুজিব তখনও স্বাধীনতার জন্য নেতৃত্ব দিতে অন্য আওয়ামী লীগ নেতাদের মতো গৃহত্যাগ না করে পাকিস্তানের ক্ষমতা লাভের পথ খোলা রাখতেই গৃহে থেকে গেলেন। আরো একটি বিষয়ে বাঙালিদের ভাবা দরকার যে, যুদ্ধের নিয়ম হচ্ছেÑ প্রধান শত্র”কে হাতের মুঠোয় পেলে তাকে হত্যা করা। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ শেখ মুজিবুর রহমানকে হাতের মুঠোয় পেয়েও হত্যা করেনি। বরং হত্যা করেছে ছাত্র-সৈনিকসহ সাধারণ বাঙালিদের। আর নিরাপত্তা দিয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারসহ ‘রাজাকার’ হিসেবে চিহ্নিত পাকিস্তানপন্থিদের পরিবারকে। এমনকি ঢাকা সেনানিবাসের সিএমএইচ-এ শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়-এর নিরাপদ জন্মের ব্যবস্থাও করেছিল। ৩৮/৪ বাংলাবাজার, ঢাকাস্থ বিদ্যাপ্রকাশ থেকে ২০০২ সালের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত ‘রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের কথা’ বইটির ৩০ নং পৃষ্ঠায় মুক্তিযোদ্ধা ইশতিয়াক আজিজ উলফাতের সাক্ষাৎকারে একথা উঠে এসেছে। অথচ, মৃত্যুর দুয়ারে পাকিস্তানি সেনারা প্রতিদিনই পাঠিয়েছে নিরীহ ও স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের। ‘রাজাকার’দের মতো পাকিস্তানপন্থি হিসেবে যদি শেখ মুজিবুর রহমান নিজেকে প্রমাণিত না করে থাকেন পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের কাছে এবং বাঙালিদের স্বাধীনতার চেতনা দমনে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকে বাংলাদেশে পাক সেনা মজুদে সহায়তা না করে থাকেন, তবে শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের প্রতি পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের এমন উদারতার অন্য কি কারণ থাকতে পারে? দৃশ্যতঃ শেখ মুজিবুর রহমানই তো ছিলেন পাকিস্তানিদের প্রধান শত্র”। প্রধান শত্র”র পরিবারের প্রতি উদারতা, আর অন্য বাঙালি পরিবারের প্রতি নির্মমতার রহস্য তবে কি? পাকিস্তানের ক্ষমতালাভের পথ খোলা রাখার জন্য বাঙালিদের স্বাধীনতার চেতনা দমাতে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকে যদি সমর্থন ও সহযোগিতা মুজিব না করতেন, তবে ২৫ মার্চ’১৯৭১ ইং রাত্রে মুজিবের পরিবারের ওপরই তো সর্বপ্রথম কামানের গোলা ছোড়ার কথা পাক সেনাদের। প্রধান শত্রর পরিবারকে নিরাপদ রেখে ছোট শত্র”দের হত্যা করার মতো মূর্খ তো পাকিস্তানি জান্তারা হবার কোন কারণই নেই। বাঙালিরা তাদের বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে এই বিষয়টি আজো বুঝতে পারেনি। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান একাত্তরের মার্চেই বুঝে গেছিলেন যে, পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর চেয়ে বড় দেশপ্রেমিক (পাকিস্তানপ্রেমিক) ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। মৃত্যুর ২ বছর আগে ২৯ মে ১৯৭৮ ইং তারিখে পাকিস্তানের লাহোর কোর্টে এক গোপন এফিডেভিটে (ক্রমিক নং-২৪৪/১৯৭৮) সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান একথা বলে যান। ১৯৮০ সালের আগস্ট মাসে ইয়াহিয়া খানের মৃত্যুর ২৫ বছর পর ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তান সরকার এফিডেভিটটি জনসমক্ষে প্রকাশ করে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক প্রতিচিত্র-এর ২৫ ফেব্র”য়ারি, ২০১১ ইং সংখ্যায় এফিডেভিটের চুম্বক অংশগুলি প্রকাশিত হয়। এফিডেভিটে ইয়াহিয়া বলেন যে, ‘শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর চেয়ে বড় দেশপ্রেমিক (পাকিস্তানপ্রেমিক) ছিলেন। ভুট্টো যেখানে ১৯৭০ সালের নির্বাচন থেকে শুর” করে সংসদ অধিবেশন তলব করা নিয়ে বারবার বাধা সৃষ্টি করেছেন, সেখানে শেখ মুজিব ছিলেন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ অনুসরণের পক্ষে। এফিডেভিটে ইয়াহিয়া আরো বলেন: ‘মুজিব নন, ভুট্টোই পাকিস্তান ভেঙেছেন। একাত্তরে ভুট্টো যেসব কথা বলেছেন, যে গোয়ার্তুমি করেছেনÑ পাকিস্তানের সংহতি বিনষ্টে নিঃসন্দেহে তা ছিল শেখ মুজিবের ৬ দফার তুলনায় অনেক বেশি আত্মঘাতী। তখন ক্ষমতালিপ্সায় ভুট্টো এতোটাই পাগল হয়ে উঠেছিলেন যে, এক পাকিস্তানে দুই প্রধানমন্ত্রী তত্ত্ব দাঁড় করাতেও তিনি জেদ ধরেছিলেন। তার উচ্চাভিলাষ এবং একরোখা ও কঠিন মনোভাবের কারণেই পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্্েরাহের আগুন জ্বলে উঠেছিল এবং বাঙালির মন বিষিয়ে তুলেছিল। আর এসব কারণেই পাকিস্তানের সংহতি ধরে রাখা যায়নি। পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে যায়।’ ইয়াহিয়া খান তার এফিডেভিটে আরো বলেন, পিপিপি চেয়ারম্যান ভুট্টো ১৯৭০ সালের অক্টোবরে নির্ধারিত নির্বাচন বাতিল করে ঘোষণা দেয়ার জন্যও জোরালো চাপ প্রয়োগ করেন। মূলত রাষ্ট্র ক্ষমতার শীর্ষ পদের জন্য ভুট্টোর সীমাহীন উচ্চাভিলাষ এবং এ ব্যাপারে কাউকে ন্যূনতম ছাড় দিতে রাজি না হওয়ার মানসিকতাই পাকিস্তানের সংহতি বিনষ্ট করেছে। নিজ স্বার্থ হাসিলে ভুট্টো সব ধরনের অপকৌশল প্রয়োগে ন্যূনতম দ্বিধা করেননি। তিনি চেয়েছিলেন নিরঙ্কুশ ক্ষমতা, পাকিস্তানের কর্তৃত্ব। যে কোন বিবেচনাতেই বলা যায়, নিঃসন্দেহে ভুট্টো ছিলেন একজন বড়মাপের ষড়যন্ত্রকারী। জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার দীর্ঘ এফিডেভিটের বড় অংশ জুড়েই এমন মন্তব্য করেছেন। পাকিস্তানের ক্রান্তিকালে মূল ভিলেইন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোকে। পাশাপাশি তারই নিয়ন্ত্রণাধীন সামরিক জান্তার বেশ ক’জন জেনারেলকেও দায়ী করেছেন পর্দার আড়ালে ভুট্টোর হয়ে ষড়যন্ত্র পাকানোর দায়ে। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের মতে, ১৯৭১ সালের জটিল পরিস্থিতিতে যখন জাতীয় সংহতি ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে, তখন রাজনীতির পাশা খেলায় ভুট্টোর কুটিল চাল যারপরনাই এক পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকেছে। পিপিপি চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে পাক প্রেসিডেন্ট বলেন যে, তিনি (ভুট্টো) ছিলেন চরম অ্যালকোহলিক। সবসময় হুইস্কিতে আসক্ত থাকতেন। এমনকি কোন জনসভায় যাবার আগেও কয়েক পেগ হুইস্কি পান করতে ভুলতেন না। (১৯৭০ সালের) নির্বাচনের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতেও জুলফিকার আলী ভুট্টো মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না। নির্ধারিত সময়ে পার্লামেন্ট সেশন বসার ক্ষেত্রেও তিনি বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। এ ব্যাপারে এফিডেভিটে বলা হয়েছে যে, মুজিব পাক প্রেসিডেন্টকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংসদ অধিবেশন ডাকার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। ২১ ফেব্র”য়ারির ভাষা শহীদ দিবসের পূর্বেই অধিবেশন অনুষ্ঠিত না হলে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করতে পারেÑ এমন আশঙ্কার কথা ইয়াহিয়াকে জানিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ প্রধান। অপরপক্ষে সংসদ অধিবেশন পিছিয়ে দেয়ার জন্য ক্রমাগত চাপ দিচ্ছিলেন পিপিপি চেয়ারম্যান। তিনি প্রেসিডেন্টকে বলেছিলেন, যদি এখনি সংসদ অধিবেশন ডাকা হয়, তাহলে মুজিব কোন সমঝোতায় যেতে চাইবেন না। তবে তারপরও তাকে (ভুট্টো) ঢাকায় আসার জন্য ইয়াহিয়া অনুরোধ করেছিলেন বলে এফিডেভিটে উল্লে¬খ করা হয়। কিন্তু পিপিপি চেয়ারম্যান ঢাকায় আসতে অস্বীকৃতি জানান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গভর্নরদের নিয়ে একটি বিশেষ বৈঠক আহ্বান করেন ইয়াহিয়া খান। সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এডমিরাল আহসান সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন যে, পরিস্থিতি খুবই জটিল এবং বাঙালিরা কোনভাবেই সংসদ অধিবেশন বাতিল করাটাকে মেনে নেবে না। তারপরও যদি এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তাহলে যেন একইসঙ্গে অধিবেশনের নতুন তারিখ জানিয়ে দেয়া হয় সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে। এডমিরাল আহসানের কথা গুর”ত্বের সঙ্গে নিলেও ভুট্টোর একরোখা মনোভাবের বিষয়টি উল্লে¬খ করে ইয়াহিয়া ওই বৈঠকে বলেন, এ অবস্থায় সংসদ অধিবেশন ডাকা হলে পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কোন সদস্য ঢাকায় যাবেন না। ফলে সংসদ সদস্যদের একটি বড় অংশ সংসদের বাইরে থেকে যাবে। সৃষ্টি হবে নতুন জটিলতার। তাই অধিবেশন বাতিল না করে কোন উপায় নেই। এফিডেভিটে ইয়াহিয়া খান আরো বলেন, ‘ভুট্টো যদি গোয়ার্তুমি ও একরোখা মনোভাব ত্যাগ করে ঢাকায় পার্লামেন্ট সেশনে যোগ দিতেন, তাহলে পূর্ব পাকিস্তানিরা পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক কিছুই অকপটে মেনে নিতেন। এতে এক পাকিস্তান না হোক, অন্তত একটি কনফেডারেশনের আওতায় থাকার ব্যাপারে আপত্তি তোলা হতো না। ওই সময় মুজিব অনেক অসত্য বলেছেন ঠিক, তবে ভুট্টো ছিলেন অতি চালাক। আমি বলব, অমসৃণ ত্বকবিশিষ্ট বিষাক্ত ব্যাঙ জাতীয় প্রাণী ছিলেন ভুট্টো।’ লাহোর হাইকোর্টে অ্যাডভোকেট মনজুর আহমাদ রানার মাধ্যমে ইয়াহিয়া খান তার এ এফিডেভিট করে যান। এতে রয়েছে ৫৭টি টাইপ করা পাতা। কোর্টে এফিডেভিটটি নথিভুক্ত করার আগে ২৯ মে ’৭৮ তারিখে রাওয়ালপিন্ডির বাড়িতে বসে ইয়াহিয়া প্রতিটি টাইপ করা পাতা পড়ে দেখেন এবং বেশ কিছু জায়গায় নিজ হাতে কিছু সংশোধন করে সবকিছু সত্য বলে স্বাক্ষর দেন। এফিডেভিটের প্রতিটি পাতাতেই তার অনুস্বাক্ষর রয়েছে। লাহোর কোর্টে এফিডেভিটের ক্রমিক নম্বর দেয়া হয় ২৪৪/১৯৭৮। এফিডেভিটে আরো বলা হয়, শেখ মুজিবকে জীবিত বা মৃত ধরে নিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছিলেন টিক্কা খান। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল টিক্কা খান নির্দেশ দিয়েছিলেনÑ ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুর” হলে শেখ মুজিবুর রহমানকে জীবিত অথবা মৃত, যেভাবেই হোক ধরে নিয়ে আসতে হবে। টিক্কা এই আদেশ দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের অজান্তে। যখন ইয়াহিয়া এ সম্পর্কে জানতে পারেন, তখনি তিনি মুজিবকে হত্যার যেকোন প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন ও তাকে জীবিত ধরে নিয়ে আসার জন্য নতুন আদেশ জারি করেন। অপারেশন সার্চলাইট সম্পর্কে এফিডেভিটে ইয়াহিয়া বলেন, কারো পরামর্শে বা ইন্ধনে নয়Ñ সম্পূর্ণ নিজ দায়িত্বে তিনি ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনার নির্দেশ প্রদান করেন। এছাড়া তার সামনে আর কোন বিকল্প পথ খোলা ছিল না। সে সময় পরিস্থিতি এমনি পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার জন্য সামরিক অ্যাকশন অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। পাক আর্মির এই পদক্ষেপকে পিপিপি চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো সাদরে সমর্থন করেছিলেন এবং শেখ মুজিবের গ্রেফতারে তাকে সেসময় বিশেষ উৎফুল্ল¬ হয়ে উঠতে দেখা গেছে। এদিকে জুলফিকার আলী ভুট্টো রাজনৈতিক অঙ্গনে অচলায়তন তৈরির মাধ্যমে সামরিক বাহিনীকে অ্যাকশনে যেতে ‘বাধ্য’ করার পর তার প্রতিদ্বন্দ্বী শেখ মুজিবুর রহমানকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলার জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন বলেও উল্লে¬খ করেন ইয়াহিয়া খান। এ প্রসঙ্গে তিনি এফিডেভিটে বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দি থাকাবস্থায় বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলেও তিনি শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন এই শর্তে যেÑ তিনি (মুজিব) ক্ষমাপ্রার্থী হবেন ও পাকিস্তানের প্রতি তার আনুগত্য প্রকাশ করবেন। এক্ষেত্রে কোন লিখিত হলফনামা ছাড়াই মুজিবকে মুক্তি দেয়ার ইচ্ছা ছিল ইয়াহিয়ার। অন্যদিকে ভুট্টো চেয়েছিলেন সামরিক আদালতে দোষী সাব্যস্ত করে শেখ মুজিবকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলাতে। ইরানের পাহলভী রাজবংশের ২৫০০তম জয়ন্তীতে যোগ দিতে ইয়াহিয়ার ইরান যাত্রার প্রাক্কালে ভুট্টো মুজিবকে শেষ করে দেয়ার পরামর্শ দেন। তার (ভুট্টো) যুক্তি ছিলÑ ইরানসহ অন্যান্য দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানরা মুজিবকে মুক্তি দেয়ার জন্য ইয়াহিয়ার উপর চাপ প্রয়োগ করতে পারেন। তাই সেখানে যাওয়ার আগেই মুজিবকে ফাঁসিতে ঝোলানো উচিত। এ ব্যাপারে এফিডেভিটে ইয়াহিয়া বলেন যে, ভুট্টোর প্ররোচনায় তিনি রাজি হননি। কারণ তিনি আইন নিজের হাতে তুলে নিতে চাননি, চেয়েছেন বিচারকার্য স্বচ্ছ হোক। অবশ্য শুধু সেবারই নয় আরো বেশ ক’বার ভুট্টো সামরিক আদালতের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত করে মুজিবকে হত্যার জন্য ইয়াহিয়াকে উপদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু জান্তা প্রধান পিপিপি চেয়ারম্যানের কথায় কর্ণপাত করেননি বলে দাবি করেন।

যুদ্ধক্ষেত্রে কিংবা শক্রুতামূলক আচরণে প্রধান শক্রকে কখনো ছাড় দেয় না কেউই। কিন্তু ইয়াহিয়া খান বাঙালিদের নির্বিচারে হত্যা করার নির্দেশ দিলেও শেখ মুজিবুর রহমানকে রক্ষা করেছিলেন ভুট্টোর সকল প্রকার ষড়যন্ত্র থেকে। শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিদের প্রতি নয়Ñ বরং এক পাকিস্তানের অস্তিত্বের প্রতিই অধিক বিশ্বাসী, একথা বাঙালিরা অতি আবেগের কারণে না বুঝলেও ইয়াহিয়া খান ঠিকই বুঝে নিয়েছিলেন। তাই পাকিস্তানকে এক রাখার স্বার্থে তিনি মুজিবের মৃত্যু কামনা করেননি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ মুজিবের এই উচ্চারণ যে বাঙালিদের বোকা বানিয়ে পাকিস্তানকে অটুট রাখার এক কৌশল, তাও ইয়াহিয়া ভালো করেই বুঝেছিলেন। কারণ, সেদিন মুজিব ইচ্ছা করলেই পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করার ঘোষণা দিতে পারতেন। ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমাদের যার যা কিছু আছে, তা নিয়ে শক্রুর মোকাবেলা করবে’ মুজিবের এসব ঘোষণা যে স্রেফ রাজনৈতিক ভাওতাবাজির মাধ্যমে বাঙালিদের বোকা বানানোর চেষ্টা, তা বুঝতেও ইয়াহিয়া ভুল করেননি। কারণ, বাঙালির যার যা কিছু আছে, তা নিয়েই সেদিন বাঙালিরা রেসকোর্স ময়দানে হাজির হয়েছিল এবং মুজিবের হুকুম দেবার পথে কোন বাধা ছিল না। মুজিব সেদিন চাইলেই লাখো জনতাকে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করার হুকুম দিতে পারতেন এবং পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য সরাসরি অ্যাকশনে যেতে পারতেন। কিন্তু এক পাকিস্তানের প্রতি বিশ্বস্ত বলেই মুজিব তেমন পদক্ষেপ নেননি, একথা বুঝতে কোন অসুবিধা হয়নি ইয়াহিয়ার। তাই নিরীহ বাঙালিদের হত্যার জন্য তিনি অপারেশন সার্চলাইটের নির্দেশ দিলেও মুজিবের জীবন রক্ষার্থে তার চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। অতএব, একথা স্পষ্ট যে, বাঙালির মহাশক্রু ইয়াহিয়া খানের পরম বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রকৃতপক্ষে বাঙালিদের বন্ধু ছিলেন না। বরং ইয়াহিয়া খানকে বাঙালিদের হত্যায় সৈন্য মজুতের সুযোগ দিয়েছিলেন তিনি আলাপ-আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে। এতে করে প্রায় ৬৫ হাজার অতিরিক্ত সৈন্য মজুতের সুযোগ পেয়েছিল ইয়াহিয়া খান। আর ৩০ লক্ষ বাঙালি হত্যায় ও ২ লক্ষ নারীর সতীত্ব নষ্ট করায় ভূমিকা রাখতে পেরেছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা। ইয়াহিয়া খানকে এতো বাঙালি হত্যা ও বাঙালি মা-বোনের সম্ভ্রম নষ্ট করার সুযোগ তৈরি করে দিয়ে হলেও পাকিস্তানকে এক রাখার জন্য সকল আর্মি অপারেশনের ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য মুজিব ইয়াহিয়া খানের বন্ধু না হয়ে শত্র” হবেন কোন বিবেচনায়? তাইতো বন্ধুর প্রাণ রক্ষায় ইয়াহিয়া চেষ্টার কোন ত্র”টি করেননি। স্বদেশী জুলফিকার আলী ভুট্টোর সকল ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিয়ে মুজিবকে রক্ষা করেছিলেন ইয়াহিয়া। তাই মুজিবকে বাঙালিদের বন্ধু বা জাতির পিতা ভাবা বাঙালিদের বুদ্ধির দীনতা ছাড়া কিছু নয়। বাঙালিদের প্রকৃত বন্ধু আসলে ইয়াহিয়ার শত্র” সেই সময়ের ছাত্র-জনতা এবং এ জাতির পিতা-মাতাও সেই সময়ের দেশের ছাত্র-সৈনিক-জনতা। ছাত্র-সৈনিক-জনতা চেয়েছিল বলেই বাঙালিরা পাকিস্তানিদের যুদ্ধে পরাজিত করে দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে পেরেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসের এই বিশ্লে¬ষণ সবার সামনে তুলে ধরলে রেজাউল করিম ভুট্টু বললÑ আপনি কি বলতে চাচ্ছেন যে, এতোদিন ধরে আমরা মুক্তিযুদ্ধের ভুল ইতিহাস জেনে আসছি?

আমি তার কথার প্রেক্ষিতে বললামÑ নিরপেক্ষভাবে এখনো সঠিক ইতিহাস কেউ তুলে আনেনি। তাই সঠিক ইতিহাস দেশের খুব কম মানুষই জানে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আ.স.ম. আব্দুর রবও ১৯৯৮ সালের ১০ ডিসেম্বর বন্দরনগরী চট্টগ্রামের আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ‘মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলা’য় স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতির নেতৃত্ব দিয়েছিল ছাত্রসমাজ। পুরো জাতি তখন দিক-নির্দেশনার জন্য তাকিয়ে থাকতো ডাকসু-র দিকে।’ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির কথা উলে¬খ করে রব সেই আলোচনা সভায় আরো বলেনÑ ‘স্বাধীনতার ২৬ বছরে অনেক ইতিহাস লেখা হয়েছে, অনেক বই রচিত হয়েছে, কিন্তু সেসব বইতে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায় না। অতএব, তোমরা যা জান তা যে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস নয়, সে বিষয়ে আ.স.ম আব্দুর রবও একজন সাক্ষী। তবে আ.স.ম. আব্দুর রবও হয়তো জানেন নাÑ এমন বিষয়ও পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাদের রচিত পাকিস্তানের ভাঙনবিষয়ক বইয়ে উঠে এসেছে।

কাজী আবদুজ জাহের, দেলোয়ার হোসেন ভোলা, কামর”ল ইসলাম, আবদুল করিম ভুট্টু, হাবিবুর রহমান বাবুল, মহিউল ইসলাম বদর এরাও আমাদের কথা শুনছিল। জাহের বললÑ আপনি তো লেখালেখি করেন। আপনার মতে সঠিক ইতিহাস তবে কি?

আমি স্বাভাবিক গলাতেই বললামÑ দেখো, শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ টেপ রেকর্ডারে সারা দেশজুড়ে বাজিয়ে আওয়ামী লীগ প্রমাণ করতে চাইছে, মুজিবের আহ্বানেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু একজন পাকিস্তানি মেজর তার লেখা বইতে ৭ মার্চের আগের যে ইতিহাস তুলে ধরেছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে মুজিব ২৮ ফেব্র”য়ারি সন্ধ্যা থেকে ৬ মার্চ দিবাগত রাত ২টার মধ্যে ৩ বার গ্রেপ্তার হতে চেয়েছিলেন, যাতে তাকে ৭ মার্চের মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে না হয়।

রেজাউল করিম তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ জানিয়ে বললÑ না। এমনটা কিছুতেই হতে পারে না। বঙ্গবন্ধু এমন কাজ করতেই পারেন না।

আমি বললামÑ তাহলে তোমাকে দালিলিক প্রমাণ দেখাচ্ছি। আমার পকেটে তখন পাকিস্তানি মেজর সিদ্দিক সালেকীর (গধলড়ৎ ঝরফফরয়ব ঝধষবয়ঁব) লেখা ডরঃহবংং ঃড় ঝঁৎৎবহফবৎ গ্রন্থের গঁলরন ঞধশবং ঙাবৎ প্রবন্ধটির ফটোকপি ছিল। ঢাকায় সাপ্তাহিক ঊষায় কাজ করার সময় ২ নং সেক্টরে যুদ্ধ করা ৪র্থ বেঙ্গলের একজন সৈনিক এম. শফিকুল ইসলাম আমাকে এমন কিছু তথ্য দিয়েছিল, যাতে ইতিহাসের অনেক অজানা বিষয় রয়েছে। প্রায় ১২ বছর পর আমি ‘মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ও বাংলাদেশের রাজনীতি’ শিরোনামে একটি বই লেখা শুর” করলে সেই তথ্যগুলি পড়তে শুর” করি। যেহেতু তার দেয়া তথ্যগুলির বেশিরভাগই পাকিস্তানি ও ইন্ডিয়ার সামরিক ব্যক্তিদের লেখা এবং ইংরেজিতে ছাপা বইয়ে প্রকাশিত, সেহেতু অনুবাদের সুবিধার্থে আমি একেকটি আর্টিকেল পকেটে রেখে যখন সময় পাই, কিছু কিছু অনুবাদ করছিলাম। আজ আবার পকেটে এমন আর্টিকেলের পাশাপাশি হাতে আরো কিছু তথ্যসমৃদ্ধ বই নিয়ে বের হয়েছিলাম। যার একটির নাম শাসক মুজিব ও শাসক জিয়া। ১৯৯৮ সালে বইটি জিয়া গবেষণা কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। এ বইটি হাতে দেখেই বাদল রাজনীতি প্রসঙ্গে আলাপ শুর” করেছিল, যে আলাপ এখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গড়িয়েছে। পাকিস্তানি মেজর সিদ্দিক সালেকী (গধলড়ৎ ঝরফফরয়ব ঝধষবয়ঁব) তার লেখা ডরঃহবংং ঃড় ঝঁৎৎবহফবৎ গ্রন্থের ৪৩ নং পৃষ্ঠায় যা লিখেছেন, তার সারমর্ম বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়: ২৮ ফেব্র”য়ারি সন্ধ্যা ৭টায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকাস্থ গভর্নমেন্ট হাউসে উপস্থিত হতে আহ্বান জানান গভর্নর আহসান। শেখ মুজিব সেখানে উপস্থিত হলে আহসান তাকে জানান যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, আমার পক্ষে দলের উগ্রপন্থি অংশকে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন। যদি মার্চ মাসের মধ্যেই নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হয়, তবে আমি পরিস্থিতি সামাল দিতে পারব। যদি এটা এপ্রিলে নেয়া হয়, তবে পরিস্থিতি সামলানো খুবই কঠিন হবে। আর যদি অনির্দিষ্টকালের জন্য অ্যাসেম্বলি মুলতবী রাখা হয়, তবে পরিস্থিতি সামাল দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। এরপর গভর্নমেন্ট হাউস ত্যাগের আগে মুজিব মেজর জেনারেল ফরমানকে বলেন, “ও ধস নবঃবিবহ ঃড়ি ভরৎবং. ও রিষষ নব শরষষবফ বরঃযবৎ নু ঃযব অৎসু ড়ৎ বীঃৎবসরংঃ বষবসবহঃং রহ সু ঢ়ধৎঃু. ডযু ফড়হ’ঃ ুড়ঁ ধৎৎবংঃ সব? ঔঁংঃ মরাব সব ধ ৎরহম ধহফ ও রিষষ পড়সব ড়াবৎ.” (আমি দুই আগুনের মাঝে আছি। আমি হয় সৈনিক নয় আমার দলের উগ্রপন্থি অংশের হাতে মারা যেতে পারি। কেন আমাকে তুমি গ্রেপ্তার করছ না? আমাকে হাতকরা পড়াও এবং তাতেই আমি উতরে যাব।

একই বইয়ের ৪৭ নং পৃষ্ঠায় উলে¬খ করা হয়েছে যে, ৬ বাঙালির মৃত্যুর প্রেক্ষিতে ২ মার্চ বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠানো শেখ মুজিবের ৪ পৃষ্ঠার লিখিত বিবৃতি যা প্রায় একই সময়ে মার্শাল ল’ হেড কোয়ার্টার্স-এ পৌঁছে, তা ছাপার অনুমতি না দিলে মুজিব পরদিন আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে পারেÑ এমন বিবেচনায় বিবৃতিটি প্রত্যাহার বা এতে ব্যবহৃত আগুনঝরা শব্দের তীব্রতা কমানোর জন্য অনুরোধ জানাতে জেনারেল ইয়াকুব শেখ মুজিবকে রাত সাড়ে এগারটায় ফোন করলে মুজিব অনেক বিতর্কের পর বলেন যে, “ও পধহ হড়ঃ ঃড়হব রঃ ফড়হি. ও ধস ঁহফবৎ ঢ়ৎবংংঁৎব. ণড়ঁ’ফ নবঃঃবৎ পড়সব ধহফ ধৎৎবংঃ সব. ওঃ রিষষ ংড়ষাব সু ঢ়ৎড়নষবস.” [আমি এর (বিবৃতিতে ব্যবহৃত শব্দের) তীব্রতা কমাতে পারব না। আমি চাপে আছি। ভালো হয় তুমি আসো এবং আমাকে গ্রেপ্তার করো। এতে আমার সমস্যার সমাধান হবে।] একই বইয়ের ৫২ নং পৃষ্ঠায় এ. ড. ঈযধঁফযৎু লিখিত ঞযব খধংঃ উধুং ড়ভ টহরঃবফ চধশরংঃধহ গ্রন্থের ১৫৩ নং পৃষ্ঠার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে: ৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছেন, তাকে এ বিষয়ে বোঝাতে যে, এমন কোন পদক্ষেপ যেন তিনি গ্রহণ না করেন, যেখান থেকে ফেরত আসার পথ থাকবে না। এরপর ৬ মার্চ প্রায় মধ্যরাতে শেখ মুজিবের জন্য একটা টেলিপ্রিন্টার ম্যাসেজ পাঠান ইয়াহিয়া খান ঢাকার মার্শাল ল’ হেড কোয়ার্টার্স-এ। লেখক মেজর সিদ্দিক সালেকী তখন হেড কোয়ার্টার্স-এ কর্মরত থাকায় তৎক্ষণাৎই ম্যাসেজটি পড়েন। পরে তার স্মৃতি থেকে ডায়েরিতে টুকে নেন ম্যাসেজের কথা। ম্যাসেজটি ছিল এ রকম: চষবধংব ফড় হড়ঃ ঃধশব ধহু যধংঃু ফবপরংরড়হ. ও রিষষ ংড়ড়হ পড়সব ঃড় উধপপধ ধহফ ফরংপঁংং ঃযব ফবঃধরষং রিঃয ুড়ঁ. ও ধংংঁৎব ুড়ঁ ঃযধঃ ুড়ঁৎ ধংঢ়রৎধঃরড়হং ধহফ পড়সসরঃসবহঃং ঃড় ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব পধহ নব ভঁষষু যড়হড়ঁৎবফ. ও যধাব ধ ংপযবসব রহ সরহফ যিরপয রিষষ সড়ৎব ঃযধহ ংধঃরংভু ুড়ঁৎ ঝরী চড়রহঃং. ও ঁৎমব ুড়ঁ হড়ঃ ঃড় ঃধশব ধ যধংঃু ফবপরংরড়হ. (অনুগ্রহ করে দ্র”ত কোন সিদ্ধান্ত নেবেন না। আমি শিগগিরই ঢাকা আসব এবং আপনার সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ করব। আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, আপনার উচ্চাকাক্সক্ষা এবং জনগণকে দেয়া ওয়াদার প্রতি পূর্ণ সম্মান জানাতে পারব। আমার মনে একটা পরিকল্পনা আছে, যা আপনার ছয় দফার চেয়ে অধিক সন্তোষজনক হবে। আমি আপনাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি, দ্র”ত কোন সিদ্ধান্ত নেবেন না।) ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের হেড কোয়ার্টার থেকে একজন ব্রিগেডিয়ার ব্যক্তিগতভাবে ম্যাসেজটি শেখ মুজিবের ধানমণ্ডীর বাসায় নিয়ে যান। একই দিন শেখ মুজিবের জন্য কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করার পথও খুলে দিয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান। ৬ মার্চই তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে, আগামী ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। এর প্রেক্ষিতে ৭ মার্চের রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে মুজিব প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ইচ্ছা পূরণ করেছিলেন, কিন্তু রেসকোর্স ময়দানে সমবেত দশ লক্ষাধিক বাঙালির মূল ইচ্ছা (স্বাধীনতার ঘোষণা) পূরণ করেননি। ৭ মার্চের সভায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য ছাত্রনেতাদের তরফ থেকে বিশাল চাপ থাকলেও শেখ মুজিব কৌশলে সেই চাপ এড়িয়ে যান। স্বাধীনতা ঘোষণার ব্যাপারে ছাত্রদের চাপ প্রসঙ্গে মযহার”ল ইসলাম তার লেখা ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ গ্রন্থের ৭৩৯ নং পৃষ্ঠায় যা লিখেছেন, তাও সকলকে দেখালাম। এতে উলে¬খ আছেÑ “৭ই মার্চের বক্তৃতা সম্পর্কে আমার নিজের কিছু অভিজ্ঞতা আছে। ৬ই মার্চ সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত্রি পর্যন্ত আমি বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডীস্থ বাসভবনে উপস্থিত ছিলাম। ছাত্রদের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর ওপর স্বাধীনতা ঘোষণার এক বিরাট চাপ এসেছিল। এক সময় বঙ্গবন্ধু হাসতে হাসতে ঠাট্টাচ্ছলে আমাকে বললেন: ‘অধ্যাপক, আপনার এই গুণধর ছাত্রদের সামলান। এদের নিয়ে আমি আর পারছি না।’ তিনি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন প্রখ্যাত সংগ্রামী ছাত্রনেতা আবদুর রউফ এবং আরো কয়েকজনকে। রউফ তখন নির্বাচিত পরিষদ সদস্য। সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন প্রাক্তন ছাত্র ছিল। আমি আবদুর রউফ এবং আরো কয়েকজন ছাত্রনেতাকে নিয়ে নিকটস্থ সাংহাই চীনা রেস্তোরাঁয় গেলাম এবং সেখানে আহারের সময় তাদের সাথে সুদীর্ঘ আলোচনায় তারা সবাই সম্মত হলো যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আগামীকল্য অর্থাৎ, ৭ই মার্চ তারিখে ঘোষণা করা হবে কি না হবে তা’ সম্পূর্ণভাবে বঙ্গবন্ধুর ওপর ছেড়ে দেয়া হোক। রাত্রি প্রায় বারোটার দিকে ছাত্রনেতাদের সাথে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সামনে গিয়ে আমাদের আলোচনার ফলাফল তাকে জানানো হলো। তিনি আনন্দে গদগদ হয়ে আমাকে ও ছাত্রনেতাদের জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেন।” ছাত্রনেতাদের তরফ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টি শেখ মুজিবুর রহমানের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেয়া হলেও ৭ মার্চে তাকে যেন রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেয়া না লাগে, সেই চেষ্টাতেও কোন ত্র”টি করেননি মুজিব। ৬ মার্চ গভীর রাত ২টায় গুপ্ত সংবাদসহ মুজিব তার ২ জন প্রতিনিধি পাঠান ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের জিওসি’র বাসায়। মেজর সিদ্দিক সালেকীর ডরঃহবংং ঃড় ঝঁৎৎবহফবৎ গ্রন্থের ৫৩ নং পৃষ্ঠায় এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে: ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের জিওসি রাত ২টায় ঘুম থেকে জাগেন তার ইন্টেলিজেন্স অফিসার দ্বারা। ইন্টেলিজেন্স অফিসারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ২ জন প্রতিনিধি ছিল। মুজিবের গুপ্ত সংবাদ নিয়ে আসা প্রতিনিধি জিওসিকে বলেন: ‘ঝযবরশয ঝধযরন রং ঁহফবৎ রসসবহংব ঢ়ৎবংংঁৎব ভৎড়স বীঃৎবসরংঃং. ঞযবু ধৎব ভড়ৎপরহম যরস ঃড় সধশব ঃযব ট.উ.ও. ঐব ফড়বংহ’ঃ ভরহফ বহড়ঁময ংঃৎবহমঃয ঃড় ৎবভঁংব ঃযবস. ঐব ংঁমমবংঃং ঃযধঃ যব নব ঃধশবহ রহঃড় সরষরঃধৎু পঁংঃড়ফু.’ (শেখ সাহেব উগ্রপন্থিদের দ্বারা বিশাল চাপে আছেন। তারা তাকে পূর্ব পাকিস্তানের একপক্ষীয় স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য চাপ দিচ্ছে। তিনি তাদের প্রত্যাখ্যান করার মতো শক্ত যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেন না। তাই তিনি পরামর্শ দিয়েছেন, তাকে সেনা তত্ত্বাবধানে নেয়ার।) জবাবে জিওসি বলেন, ‘ও ধস ংঁৎব ধ ঢ়ড়ঢ়ঁষধৎ ষবধফবৎ ষরশব গঁলরন শহড়ংি যড়ি ঃড় ৎবংরংঃ ংঁপয ঢ়ৎবংংঁৎব. ঐব পধহ হড়ঃ নব সধফব ঃড় ধপঃ ধমধরহংঃ যরং রিষষ. ঞবষষ যরস ও রিষষ নব ঃযবৎব (ধঃ ঃযব জধসহধ জধপব ঈড়ঁৎংব) ঃড় ংধাব যরস ভৎড়স ঃযব ৎিধঃয ড়ভ ঃযব বীঃৎবসরংঃং. ইঁঃ ঃবষষ যরস ঃড়ড় ঃযধঃ, রভ যব ঃধষশং ধমধরহংঃ ঃযব রহঃবমৎরঃু ড়ভ চধশরংঃধহ, ও রিষষ সঁংঃবৎ ধষষ ও পধহ- ঃধহশং, ধৎঃরষষবৎু ধহফ সধপযরহব-মঁহং- ঃড় শরষষ ধষষ ঃযব ঃৎধরঃড়ৎং ধহফ রভ হবপবংংধৎু, ৎধুব উধপপধ ঃড় ঃযব মৎড়ঁহফ. ঞযবৎব রিষষ নব হড় ড়হব ঃড় ৎঁষব, ঃযবৎব রিষষ নব হড়ঃযরহম ঃড় ৎঁষব. (আমি নিশ্চিত, মুজিবের মতো একজন জনপ্রিয় নেতা জানে কিভাবে এমন চাপ প্রতিরোধ করতে হয়। তিনি তার ইচ্ছার বির”দ্ধে ভূমিকা রাখতে পারেন না। তাকে বোলো, আমি সেখানে থাকব (রমনা রেসকোর্স-এ), উগ্রপন্থিদের ক্রোধ থেকে তাকে রক্ষার জন্য। কিন্তু তাকে এটাও বোলো যে, যদি সে পাকিস্তানের অখণ্ডতার বির”দ্ধে কোন কথা বলে, আমি প্রচুর পরিমাণে ট্যাঙ্ক, কামান, মেশিন গান সমবেত করব সকল দেশদ্রোহীকে হত্যা করতে এবং যদি প্রয়োজন হয়, ঢাকাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেব। ঢাকায় কেউ থাকবে না শাসন করার মতো। ঢাকায় কিছুই থাকবে না শাসন করার মতো।) শেখ মুজিবুর রহমান জিওসি’র এমন হুমকিতে ভয় পাওয়ার পাত্র নয়। বরং, দশ লক্ষাধিক লোককে সেদিন ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের হুকুম দিলে জিওসিসহ পাকিস্তানিরাই মাটির সাথে মিশে যেতে পারত। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ভাঙতে চাননি বলে এবং তিনি পাকিস্তানের দুই অংশেরই শাসনক্ষমতা চেয়েছিলেন বলে একাংশের ক্ষমতালাভের বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যান। আর দুই অংশের শাসনক্ষমতা লাভের উদ্দেশ্যে ১৬ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া খানসহ পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনাও চালিয়েছিলেন। এরপর ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে ২৫ মার্চ বাঙালি নিধন শুর” হলে শেখ মুজিব স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে বাঙালিদের পাশে না থেকে ২৮ ফেব্র”য়ারি থেকে ৬ মার্চের গভীর রাত পর্যন্ত তাকে গ্রেপ্তারের যে দাবি জানিয়ে আসছিলেন পাকিস্তানি জেনারেলদের কাছে, সেই ইচ্ছাটাই পূরণের সুযোগ করে দিলেন পাক সেনাদের। কারণ, মুজিবের বিবেচনাতে ছিলÑ এতেই তার সমস্যার সমাধান সম্ভব। উগ্রপন্থিদের স্বাধীনতার বাসনা পাক সেনারা দমিয়ে দিলে পাকিস্তানের ক্ষমতালাভের পথতো তার খোলা থাকছেই! এ কারণে ২৫ মার্চের ক্র্যাক-ডাউনের পর আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীনতা ঘোষণার ছোট্ট একটি খসড়া তৈরি করে টেপ-রেকর্ডারে ধারণ করার জন্য তা শেখ মুজিবুর রহমানকে পড়তে দিলে শেখ মুজিব খসড়াটি পড়ে নির”ত্তর থাকেন এবং এড়িয়ে যান। তাজউদ্দীন আহমদ ঘোষণাটি দিতে অনুরোধ জানালে শেখ মুজিবুর রহমান উত্তর দেনÑ ‘এটা আমার বির”দ্ধে একটা দলিল হয়ে থাকবে। এর জন্য পাকিস্তানিরা আমাকে দেশদ্রোহের অভিযোগে বিচার করতে পারবে।’ স্বাধীনতা ঘোষণার ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমানের এ বক্তব্যও প্রমাণ করে যে, তিনি বাংলাদেশ স্বাধীনে বা পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার ব্যাপারে আন্তরিক ছিলেন না। লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজীও তার লেখা ঞযব ইবঃৎধুধষ ড়ভ ঊধংঃ চধশরংঃধহ গ্রন্থের ৯৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন: দগঁলরন যধফ হড়ঃ উবপষধৎবফ ঁহরষধঃবৎধষ রহফবঢ়বহফবহপব ড়ৎ ধিমবফ ধ ধিৎ.’ [মুজিব একপক্ষীয় (পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের) স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি কিংবা যুদ্ধ চালানোর কথাও বলেননি। অতএব, শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহানায়ক বা জাতির পিতা বলে বিবেচনা করা যায় না। বরং তাকে ‘বঙ্গশত্র”’, ‘জাতির হন্তারক’ এ জাতীয় বিশেষণে ভূষিত করা দরকার সঠিক ইতিহাস চর্চার স্বার্থে। আর একাত্তরের নিবেদিতপ্রাণ ছাত্রলীগের সদস্যসহ নিরীহ বাঙালিদের হত্যার জন্য যারা এখন মুজিবের ভাষণকে পুঁজি করে রাজনীতি করছে, এদেরকেও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত।

আমার কথা শেষ হলে রেজাউল করিম ভুট্টু কোন প্রতিক্রিয়া জানাল না। তবে আবদুল করিম ভুট্টু বললÑ ইতিহাসের এই কথাগুলো তো আমরা আসলেই জানতাম না। বেশিরভাগ বাঙালিই জানে না। মিথ্যের সঙ্গেইতো ৪১ বছর ধরে বসবাস করছি আমরা।

আমি তখন বললামÑ আরো অনেক কিছুই আমরা জানি না। আমাদের দেশটা ১৯৭১ সালে মূলত স্বাধীন হয়েছে ভারত সরকার পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করতে চেয়েছিল বলেই। ইন্ডিয়ার রাজনৈতিক সুবিধার জন্যই তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সব ধরনের পরিকল্পনা কাজে লাগিয়েছে। এমনকি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি যেন ইন্ডিয়ান সরকারের পরিকল্পনা ও পরামর্শমতোই চলে, সেজন্য মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে চুক্তিও স্বাক্ষর করে রাখে তারা। শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে ফিরে এ চুক্তি মানেননি। কারণ, তিনি মূলত ইন্ডিয়ানপন্থি ছিলেন না, তিনি ছিলেন পাকিস্তানপন্থি। তাই ইন্ডিয়ার খবরদারি মেনে নেয়ার মানসিকতা তার ছিল না। আর ইন্ডিয়ার খবরদারি মেনে না নেয়ার মানসিকতা থেকেই তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে বললেন দ্র”ত ইন্ডিয়ার সৈন্যদের বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহার করতে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তার মৃত্যুর পর সৈয়দ নজর”ল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, মনসুর আলী, এম কামার”জ্জামানÑ এদেরকে ক্ষমতায় বসিয়ে ১৯৭১ সালে এদের সঙ্গে করা চুক্তির বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের একটা চেষ্টা ভারত সরকার চালাতে চাইলে তা টের পেয়ে কর্নেল (অব.) ফার”ক এবং কর্নেল (অব.) রশীদরা জেলখানাতেই তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করে। ৪ নেতাকে জেলখানাতেই হত্যার মাধ্যমে ইন্ডিয়ার একটি মহাপকিল্পনা নষ্ট হয়ে গেলে ইন্ডিয়া এরপর জাসদকে ক্ষমতায় বসিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে নিতে চেয়েছিল। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ কর্তৃক অন্তরীণ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার নামে তাকে হত্যা করে হলেও জাসদকে ক্ষমতায় বসাতে চেয়েছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’। কিন্তু জিয়াউর রহমান ইন্ডিয়ার সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিতে পেরেছিল বলেই আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব একটা শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে জাসদ ক্ষমতা দখল করলে যা সম্ভব হতো না। কারণ, জাসদ ১৯৭৫ সালের ৮ নভেম্বর ‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই, সুবেদারের ওপর অফিসার নাই’ এই স্লে¬াগান তুলে ১২ জন আর্মি অফিসারকে হত্যা করেছিল। জাসদেরই সৈনিক শাখা ‘বিপ¬বী সৈনিক সংস্থা’ নামে জিয়াসহ অন্য অফিসারদের হত্যা করে ভারতীয় ফর্মুলায় গণসেনাবাহিনী নামে একটি সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে চেয়েছিল, যাতে এদেশের সামরিক শক্তি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত না পায়। জিয়া এ সময় ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত সেনাসদরে অবর”দ্ধ ছিলেন কর্নেল (অব.) তাহেরের নিয়ন্ত্রণাধীন সৈনিকদের দ্বারা। এরপর দেশের অন্যান্য স্থান হতে ঢাকায় জিয়ার অনুগত সৈন্যসংখ্যা বাড়িয়ে তিনি ‘র’ এর পরিকল্পনা নস্যাৎ করেন। যে কারণে ‘র’ ক্ষিপ্ত হয়ে বারবার জিয়াকে হত্যার চেষ্টা করে এবং ১৯৮১ সালের ৩০ মে ‘র’ এর ঢাকা অংশের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অংশের দ্বারা জিয়াকে হত্যা করতে সমর্থ হয়। কিন্তু ততদিনে এদেশের মানুষের মনে বাংলাদেশি চেতনা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায় এবং সামরিক বাহিনীও প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রনীতিও ততদিনে সুদৃঢ় হয়ে যায়। তাই বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক নেতা হিসেবে জিয়াউর রহমানের অবস্থানকে সবার ওপরেই রাখি আমি।

আমার কথা থামলে রেজাউল করিম ভুট্টু বললÑ আপনিতো দেখছি ৭ নভেম্বরের ইতিহাসও উল্টে দিচ্ছেন। আমরাতো জানি, কর্নেল (অব.) তাহের জিয়ার প্রাণ রক্ষা করেছিলেন, আর জিয়া কর্নেল (অব.) তাহেরের সঙ্গে বেইমানি করে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন।

আমি এ পর্যায়ে বললামÑ বামপন্থি নেতা হায়দার আকবর খান রনোর দেয়া তথ্য দিয়েই তাহলে তোমার প্রশ্নের জবাব দেই। হায়দার আকবর খান রনোর লেখা ‘১৯৭৫ সালের নভেম্বর, দেশ কাঁপানো সেই পাঁচ দিন’ শীর্ষক প্রবন্ধটি ১৯৯২ সালের নভেম্বর সংখ্যায় মাসিক অনুসরণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেই প্রবন্ধে রনো লিখেছেন যে, ৬ নভেম্বর গভীর রাতে বিপ¬বী সৈনিক সংস্থার যে বৈঠক হয়েছিল তাতে সেনাবাহিনীতে অফিসারদের আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্ব ধক্ষংস করে দিয়ে সাধারণ সিপাহীদের গণতান্ত্রিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার এবং সেনাবাহিনীকে গণসেনাবাহিনীতে রূপান্তরের দৃঢ় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু জিয়া যে তাদের এই বৈপ্ল¬বিক পরিবর্তন মেনে নেবেন না, এ ব্যাপারে সকলেই সন্দেহ পোষণ করছিল। তাই উপস্থিত সদস্যদের মধ্যে কোন কোন সদস্য জিয়াকে মেরে ফেলার প্রস্তাব করে। কিন্তু তাতে পরিস্থিতি তাদের বিপরীতে চলে যাবে ভেবে তাহের এই প্রস্তাবে আপত্তি জানায়। বরং জিয়াকে বিপ্ল¬বী সৈনিক সংস্থার হেড কোয়ার্টারে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন এবং বলেনÑ জিয়ার প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন সৈন্যদের বিপক্ষে ঠেলে দেয়া হবে আত্মঘাতী। বিশেষ সংকটজনক পরিস্থিতির সুযোগ নিতে হলে জিয়াকে পক্ষে ও সঙ্গে নিতে হবে। কিন্তু জিয়া যদি সেনাবাহিনীকে গণসেনাবাহিনীতে রূপান্তরের বৈপ¬বিক পরিবর্তন মেনে না নেন তবে জিয়ার বির”দ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হবে, তা বৈঠকে স্থির হয়নি এবং সম্ভবত সে সিদ্ধান্ত তাহের ও জাসদ নেতাদের মনেই লুকিয়ে ছিল, যা প্রকাশ পায় ৮ নভেম্বর। বিপ্ল¬বের পরিকল্পনা অনুযায়ী সবকিছু ঠিকঠাকমতো এগুচ্ছিল। কিন্তু সাধারণ সৈনিকদের কারণে কর্নেল (অব.) তাহেরের অনুসারীরা জিয়াকে বিপ¬বী সৈনিক সংস্থার হেড কোয়ার্টারে আনতে ব্যর্থ হয়। সাধারণ সৈনিকরা জিয়াউর রহমানকে পুনরায় অন্তরীণ করার পরিকল্পনা সম্বন্ধে কিছুই জানতো না। তারা জানতো যে, জিয়াকে মুক্ত করার জন্যই এ বিপ¬ব। কাজেই তারা জিয়াকে মুক্ত করে তাদের নেতার আসনে বসিয়ে কাঁধে করে নিয়ে রাস্তায় বের হয়ে এলো এবং স্লে¬াগান দিতে থাকলÑ ‘নারায়ে তাকবীর, আল্ল¬াহু আকবর, সিপাহী বিপ্ল¬ব জিন্দাবাদ, জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ’। স্লে¬াগান দিতে দিতে তারা জিয়াকে টু ফিল্ড আর্টিলারীতে নিয়ে যায়। ওদিকে একদল বিপ্ল¬বী সৈনিক সংস্থার কর্মী তাহেরকে গিয়ে এ সংবাদ জানালে তাহের রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে গোঙাতে থাকে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জিয়াকে অন্তরীণ করা ছিল একটি অনিবার্য দাবি। তাহের হাল না ছেড়ে জিয়াকে নবতর কৌশলে অন্তরীণ করার চেষ্টা করে। সুবেদার সারোয়ারকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়। সুবেদার সারোয়ার জিয়াউর রহমানকে গিয়ে বলেনÑ স্যার, কর্নেল তাহের আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। তার নেতৃত্বেই বিপ্লব হয়েছে। আপনি মুক্ত হয়েছেন। চলুন স্যার, দেখা করে আসবেন। জিয়া তার উপস্থিত বুদ্ধি ও দূরদর্শিতাকে কাজে লাগিয়ে তাহেরকে তার কাছে নিয়ে আসতে বললে কর্নেল (অব.) তাহেরের এ পরিকল্পনাও ব্যর্থ হয়। কিন্তু তখনও তাহের হাল ছাড়েননি। এবার জিয়াকে রেডিওতে ভাষণ দেবার নাম করে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে শহরে এনে অন্তরীণ করার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু কর্নেল আমিনুল হক বীর উত্তম ও কিছু উচ্চপদস্থ অফিসারের কারণে তাদের এ পরিকল্পনাও ব্যর্থ হয়। ৭ নভেম্বর যে অভ্যুত্থানটি সংঘটিত হয়েছিল, তাতে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং তার দুজন সঙ্গী নিহত হওয়া ছাড়া তেমন কোন হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু ৮ নভেম্বর জিয়াকে উৎখাতের প্রচেষ্টায় কর্নেল (অব.) তাহের জিয়া ও জিয়াপন্থি অফিসারদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিলে তাহেরপন্থি সৈনিকেরা ‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই, সুবেদারের ওপর অফিসার নাই’ ‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই’ ইত্যাদি স্লে¬াগান তুলে ক্যান্টনমেন্টে ছড়িয়ে পড়ে এবং অরাজকতা সৃষ্টি করে। তাহেরপন্থিরা অফিসার্স কোয়ার্টারে হামলা চালায়। অফিসারদের ব্যাজ কেড়ে নেয়। অফিসারদের বিতাড়িত করতে থাকে। এদিন তারা ১২ জন সেনা অফিসারকে হত্যা করে। এসব কাজের জন্য তারা বিপ্ল¬বী গণবাহিনীর সদস্যদেরও সেনানিবাসে নিয়ে আসে। ব্রিটিশ সাংবাদিক এ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস তার ‘বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ’ গ্রন্থের ১২৫ নং পৃষ্ঠায় ৮ নভেম্বর এবং এর পরবর্তী পরিস্থিতি সম্বন্ধে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেনÑ ‘ঢাকা সেনানিবাসের সেনা সদর অবরোধাধীন একটা ক্ষুদ্র দুর্গের রূপ ধারণ করে। জিয়া এবং তার সেনাসদরে কর্মরত লোকজনকে ৭দিন ধরে ওই অফিসের ভেতরেই নাওয়া-খাওয়া এবং ঘুমানোর কাজ সেরে নিতে হয়। সুবিধার জন্য তারা এ কাজ করেননি, করেছিলেন বাধ্য হয়ে। সেনা সদরের নিরাপত্তার জন্য জেনারেল জিয়া যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ৭ম, ৯ম, ১১তম ও ১২তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডো দলকে অতি দ্র”তগতিতে ঢাকায় পৌঁছনোর ব্যবস্থা করেন। ৯ তারিখের মধ্যেই ওই কমান্ডো দলগুলোকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। তাদেরকে সেনা সদরের আশেপাশে রাখার ব্যবস্থা করা হলো। এতে করে জাসদের ক্রমাগত হুমকির মোকাবিলায় আর্মি হেড কোয়ার্টার যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ইতিমধ্যেই জেনারেল জিয়া সেনাবাহিনীর বেতন বৃদ্ধি, বাসস্থান, পোশাকের প্রয়োজনীয় কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণসহ অবমাননাকর ব্যাটম্যান প্রথা বাতিল করার ঘোষণা প্রদান করেন। এতে সেনাবাহিনীর জোয়ানদের মধ্যে যথেষ্ট স্বস্তি ফিরে আসে এবং বিপ্ল¬বীভাব কেটে যেতে থাকে। এছাড়া জেনারেল জিয়া ওই সময়ে রেডিও এবং টিভিতে ভাষণের মাধ্যমে স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র থেকে সতর্ক থাকার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে পরিস্থিতি নিজের আয়ত্বে আনার প্রয়াস পান। জাসদ ৮ নভেম্বর জিয়ার বির”দ্ধে যে বিদ্রোহ শুর” করে, তার ধারাবাহিকতায় ২৩ নভেম্বর সারা দেশে সর্বাত্মক অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ২৩ নভেম্বরই রব, জলিল, হাসানুল হক ইনু এবং ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ গ্রেপ্তার হন। ২৪ নভেম্বর সৈনিক সংস্থার যে গোপন সভার কথা ছিল, সেখান থেকে তাহের এবং বিপ্ল¬বী সৈনিক সংস্থার উপস্থিত সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়। এভাবেই জিয়া পরিস্থিতিকে নিজের আয়ত্বে নিয়ে আসেন এবং সেনাবাহিনীতে পূর্বের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করেন। এরপর ৭ নভেম্বর বিচারপতি সায়েমকে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধানদের উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক করে যে সরকার গঠিত হয়েছিল, সেই সরকারকে উৎখাতের প্রচেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত করে সামরিক আদালতের বিচারে কর্নেল (অব.) তাহেরকে ১৭ জুলাই, ১৯৭৬ সালে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ জারি করা হয়। প্রেসিডেন্টের কাছে তার ক্ষমার আবেদন ২০ জুলাই নাকচ করা হলে ২১ জুলাই ভোরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়।’

একটু থেমে আমি আবার বললামÑ এবার তোমরাই বলো, হায়দার আকবর খান রনো এবং এ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের লেখায় পঁচাত্তরের নভেম্বরের যে ইতিহাস উঠে এসেছে, তাতে জিয়ার দোষ বেশি? নাকি কর্নেল (অব.) তাহেরের? যদি কর্নেল (অব.) তাহের তার পরিকল্পনায় সফল হতেন, তবে বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক সেনাবাহিনী বলে কিছুই থাকতো না এবং ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমানসহ আরো কিছু দেশপ্রেমিক সামরিক কর্মকর্তার মৃত্যু ঘটে ভারত নিয়ন্ত্রিত সরকার এবং তাদের পলিসি মোতাবেক গণসেনাবাহিনী গঠিত হতো। এতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে থাকত সেই ১৯৭৫ সাল থেকেই। জিয়া ইন্ডিয়ান সরকারের সেই পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিয়ে কি ভুল করেছিলেন?

কাজী জাহের তখন বললÑ পঁচাত্তরের নভেম্বরে এবং পরবর্তীতেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জিয়ার এমন কার্যকরী ভূমিকার কথা তো আমরা জানতাম না। মিডিয়ার অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে জিয়াকেই দোষী মনে করতাম।

আমি বললামÑ এজন্যই ইতিহাস সম্বন্ধে জানতে পক্ষ-বিপক্ষ, দেশি-বিদেশি অনেক লেখকের লেখা পড়ে এবং পাশাপাশি নিজের বিবেককে কাজে লাগিয়ে সত্য বোঝার চেষ্টা করতে হয়।

রেজাউল করিম এবার বললÑ কিন্তু জিয়াউর রহমান যে এদেশে রাজাকারদের প্রতিষ্ঠা করেছে, সে বিষয়টাতো অস্বীকার করা যাবে না।

আমি বললামÑ ঠিক বলেছ, এ বিষয়টা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও কেন রাজাকারদের দেশে প্রতিষ্ঠিত করতে গেলেন, তার কারণ খুঁজে দেখতে চেয়েছ কখনো?

রেজাউল করিম বললÑ কারণ যা-ই থাক, তিনি রাজাকারদের দেশে প্রতিষ্ঠিত করে ভুল করেছেন।

আমি বললামÑ কারণ যা-ই থাক বললে তো হবে না। কারণটা কি, তাও বিবেচনায় আনতে হবে।

হাবিবুর রহমান বললেনÑ কারণটা কি বলো দেখি, আমি জানতে চাই।

আমি তখন বললামÑ শেখ মুজিবুর রহমান যে ক্ষমতায় থাকাকালে ভাষণ দিতে গিয়ে আক্ষেপ করে বলতেনÑ সব দেশ পায় সোনার খনি, আর আমি পেয়েছি চোরের খনি; সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির জন্য ৮ কোটি কম্বল এসেছে, আমার কম্বল কইÑ এ জাতীয় কথাগুলো কি শুনেছেন?

হাবিবুর রহমান বললেনÑ হাঁ শুনেছি।

আমি বললামÑ এই চোরের খনির চোর বা দুর্নীতিবাজ-লুটেরা কারা ছিল, সে সম্বন্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর বিদেশি পত্রিকাগুলোতে অনেক লেখা ছাপা হয়েছে। এর মধ্যে লন্ডন থেকে প্রকাশিত সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ১৯৭৫ সালের ১৭ আগস্ট প্রকাশিত অমিত রায়ের লেখা ‘শাসনতন্ত্র সংশোধনের ফলে’ নিবন্ধটি পড়ে দেখো। এই নিবন্ধে অমিত রায় উল্লে¬খ করেছেনÑ “সেনাবাহিনীকে মজুতদার ও চোরাকারবারী খুঁজে বের করার জন্য নিয়োগ করা হলো। কিন্তু তাদের অনুসন্ধানের ফলে যখন স্বয়ং মুজিবের ঘনিষ্ঠজনেরা জড়িত বলে প্রমাণিত হতে লাগল তখন তাড়াতাড়ি সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে পাঠিয়ে সবকিছু ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হলো। মুজিবের এসব ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের একজন হলেন গাজী গোলাম মোস্তফা, ‘যিনি বাংলাদেশের বড় চোর’ বলে কুখ্যাত। দুনিয়ার মানুষ দুঃস্থজনের জন্য রেডক্রসের মাধ্যমে উলে¬খযোগ্য সাহায্য-সামগ্রী পাঠিয়েছে, আর বাংলাদেশ রেডক্রসের প্রধান হিসেবে গাজী গোলাম মোস্তফা এসব আত্মসাৎ করে ব্যক্তিগত ধন-সম্পদ বানিয়েছেন। মোস্তফাকে রেশন বণ্টন কমিটিরও প্রধান বানানো হয়েছিল। রেশন দোকানের মালিকেরা তারই প্রত্যক্ষ মদদ নিয়ে রেশনের খাদ্য-সামগ্রী কালোবাজারে বিক্রি করে দু’হাতে টাকা লুটেছে এবং এ কালো টাকার মোটা অংশ তারা নজরানা হিসাবে মোস্তফার পকেটে তুলে দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ঢাকা ইমপ্র”ভমেন্ট কমিটির প্রধান এবং পরিত্যক্ত সম্পত্তি বোর্ডের সদস্য হিসাবেও তিনি খালি জমি ও বাড়ি বিলি-বন্দোবস্তও নিয়ন্ত্রণ করেছেন। এসবের বিনিময়ে তিনি ঘুষ নিয়েছেন দু’হাতে। উপরন্তু ঢাকা নগর আওয়ামী লীগের প্রধান হিসাবে ঢাকা মিউনিসিপলিটির উপরও তিনি কর্তৃত্ব খাটিয়েছেন। মুজিবের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসাবে তিনি ছিলেন আইনের ঊর্ধ্বে। ব্যাংক-এ ডাকাতি করে ডাকাতরা পালিয়ে যাচ্ছিল, পুলিশ গুলি ছুঁড়ল। দেখা গেল স্বয়ং মুজিবের বড় ছেলে কামাল আহতদের মধ্যে অন্যতম। স¤প্রতি সারাদেশে ১৫৩টি পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং শুধুমাত্র ৪টি পত্রিকা চালু রাখা হয়েছে। এ ৪টি পত্রিকার একটি হলো মুজিবের ভাগিনা শেখ ফজলুল হক মণির মালিকানাধীন ‘বাংলাদেশ টাইমস’। বিগত চার বছরে শেখ মুজিবের আপন ভাই শেখ আবু নাসের যতবার ঢাকা থেকে স্বীয় আদি ব্যবসা কেন্দ্র খুলনায় গিয়েছেন, তার বেশিবার লন্ডনে এসেছেন। স¤প্রতি আওয়ামী লীগের সম্পাদক জিল্ল¬ুর রহমান লন্ডনে বেড়াতে আসেন। ফেরার সময়ে তিনি ২৩টি বড় বড় বাক্স বোঝাই করে সওদা নিয়ে গেছেন।” তাহলে দেখেন, সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকায় চোরের খনির চোর হিসাবে যাদের দিকে আঙ্গুল তোলা হয়েছে, তাদেরকে আওয়ামী লীগ অতীতে যেভাবে প্রশ্রয় দিয়েছে, বর্তমানেও একইভাবে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে। চোরের খনির চোর বলে আঙ্গুল তোলা লোককে শেখ হাসিনার সরকার দেশের রাষ্ট্রপতি পদেও বসিয়েছে, আর শেখ আবু নাসেরের নামে খুলনা স্টেডিয়ামের নামকরণ করে তাকেও সম্মানিত করা হচ্ছে। জিয়াউর রহমান এ জাতীয় চোরের খনির চোর বলে আঙ্গুল তোলা লোককে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করতে চাননি, আবার ইন্ডিয়ান সরকারের ক্রীড়নকে পরিণত হবেÑ এমন লোকদেরও তিনি রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করতে চাননি। তাই এ্যান্টি-ইন্ডিয়ান এবং সৎ রাজনীতিবিদ খুঁজতে গিয়ে শাহ আজিজুর রহমানকে দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদে বসিয়েছিলেন। রাজাকার বলে তাকে গাল দেয়া গেলেও তার হাতে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব যেমন হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা ছিল না, তেমনি সৎ ছিলেন বলে তার দ্বারা দেশে দুর্নীতি বেড়ে যাবার কোন কারণও ঘটেনি। এভাবেই রাজাকারদের দেশে প্রতিষ্ঠিত করে সৎ রাজনীতি এবং এ্যান্টি-ইন্ডিয়ান রাজনীতিকে শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন জিয়া, যাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ভবিষ্যতে হুমকির মুখে না পড়ে। এজন্য জিয়ার দোষ যতটা, দেশের মঙ্গলের চিন্তাটা তার চেয়ে অনেক বড় ছিল বলে এটাই বলতে হবে যে, পরিস্থিতির চাপে তিনি মুক্তিযোদ্ধা হয়েও রাজাকারদের দেশের রাজনীতিতে টেনে আনতে বাধ্য হয়েছিলেন। এজন্য জিয়ার দোষ যতটা, তার চেয়ে অনেক বেশি দোষী ছিলেন চোরের খনির চোর এবং ভারতের স্বার্থ দেখা রাজনীতিবিদেরা। যারা এখনো সুযোগ পেলে দেশের চেয়ে ভারতের স্বার্থেই কাজ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। আর এদেরকেই কেবল তুমি জিয়ার সমালোচনা করতে দেখবে। কিন্তু ইতিহাস সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান যদি তোমার থাকে, তবে তুমি বুঝবে যেÑ জিয়ার চেয়ে বড় দেশপ্রেমিক এদেশে কেউ ছিল না। আমি বর্তমানে বিএনপির রাজনীতি করি না। ‘মানুষের দল’ নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। অর্থনৈতিক কারণে তা করতে না পারলে নিজেকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার সিদ্ধান্তই নিয়েছি। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসের যে সত্য আমার চোখে ধরা পড়েছে, তাতে জিয়াউর রহমানকেই বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে সবচেয়ে দেশপ্রেমিক বলে মনে করি আমি।

আমি থামলে কামর”ল বললÑ আমরা তো এতোদিন ধরে অনেক বিষয়ে অজ্ঞ ছিলাম। মিথ্যেকে সত্য জেনেছি, আর প্রকৃত সত্য খুঁজে দেখার চেষ্টাও করিনি। আজ কথায় কথায় অনেক কিছুই জানলাম।

আমি তখন বললামÑ শুধু তোমরা কেন, বিএনপির সিনিয়র নেতারাও এই ইতিহাস সম্বন্ধে অবগত নয়। এমনকি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াও এসব ইতিহাস পুরোপুরি জানেন না। এজন্যই তো বিএনপি নেতারা বা তাদের সমর্থকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও তাদের সমর্থিত মিডিয়ার অপপ্রচারের জবাব দিতে পারে না।



মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.