নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কাউসার ইকবাল

সাংবাদিক ও লেখক

কাউসার ইকবাল

সাংবাদিক ও লেখক

কাউসার ইকবাল › বিস্তারিত পোস্টঃ

স্বপ্নময় জীবন

২৮ শে এপ্রিল, ২০১৪ বিকাল ৩:৩৬

স্বপ্নময় জীবন

কাউসার ইকবাল

বক কি ধবধবে সাদার উদাহরণ হতে পারে? ঠিক বুঝতে পারছি না। অনেকদিন বক দেখা হয়নি। ৫/৬ মাস আগে একটা বক উড়ে এসে আমাদের ঘরের আঙিনার আম গাছটায় বসেছিল। তাকে ঠিক ধবধবে সাদা মনে হয়নি। এর আগে কবে যে বক দেখেছিলাম তাও ঠিক মনে করতে পারছি না। তবে হাঁ, ১৯৯৪ সালে সর্বশেষ সন্দ্বীপ গিয়েছিলাম। আজ থেকে ১৮ বছর আগের কথা। এখন ২০১২ সালের মধ্য অক্টোবর। ১৯৯৪ সালের মধ্য অক্টোবর কি নভেম্বরেই আমার সর্বশেষ সন্দ্বীপ যাওয়া। ১৮ বছর পেরিয়ে গেছে এর মধ্যে! অবাক লাগছে ভাবতে। খুব বেশি দরকার না পড়লে সন্দ্বীপ আর যাব নাÑ এই পণটা ১৮ বছর ধরে অটুট আছে। আর এই পণ অটুট থাকার কুফল হচ্ছেÑ ১৮ বছর ধরে ঝাঁকে ঝাঁকে বক দেখার সুযোগ হয়নি। সন্দ্বীপ গেলে ঝাঁকে ঝাঁকে বক দেখা ছাড়াও গাংচিলসহ নানা পাখি দেখার সুযোগ ঘটে। সদরঘাট থেকে স্টিমারে কিংবা সীতাকুণ্ড থেকে লঞ্চে চড়ে সন্দ্বীপ রওনা হলে গাংচিলেরা স্বাগত জানাতেই যেন উড়তে থাকে স্টিমার বা লঞ্চের গন্তব্যপথ ধরে। সন্দ্বীপ পৌঁছতেই ডাহুক, ঘুঘূ, মাছরাঙ্গা, কাঠঠোকরাসহ আরো অনেক পাখি চোখে পড়ে, যা শহুরে জীবনে সচরাচর দেখা যায় না। শহুরে জীবনে অভ্যস্ত সেই ছোটবেলা থেকেই। জন্মের পর ৯ মাস সন্দ্বীপ ছিলাম। সন্দ্বীপের কালাপানিয়া গ্রামের নজির আহমদ সওদাগরের বাড়িতে আমার জন্ম। সেটা অবশ্য আমার নানাবাড়ি। নানার নামেই বাড়ির নাম। সাধারণত সন্তান জন্ম দেবার সময়টাতে মেয়েরা তাদের বাপের বাড়ি থাকতে পছন্দ করে। বিশেষ করে মা বেঁচে থাকলে মায়ের সাহচর্যে গিয়ে ‘মা’ হওয়ার অনুভূতি নিতে পছন্দ বোধ হয় মেয়েদের। তাইতো গর্ভধারণের ৭/৮ মাস পূর্ণ হলেই মেয়েরা মায়ের কাছে ছুটে যেতে চায়। শ্বশুর-শাশুড়িরাও এতে খুব বেশি বাধা দিতে চায় না। অন্তত বউয়ের এই ইচ্ছেটা পূরণে তারা আন্তরিক থাকে। ব্যতিক্রম যে ঘটে না, তা অবশ্য নয়। আজকাল আধুনিকতার ছোঁয়ায় শিক্ষিতের হার বাড়লেও কেউ কেউ চায়Ñ পুত্রবধূ তাদের ঘরে থেকেই সন্তানের জন্ম দিক। পুত্রবধূ নিজ মায়ের কাছে থেকেই ‘মা’ হওয়ার অনুভূতি নিকÑ অন্তত প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রে হলেওÑ তা কোন কোন শ্বশুর-শাশুড়ির পছন্দ নয়। তারা তাদের বংশপ্রদীপকে নিজ গৃহেই বা নিজেদের তত্ত্বাবধানে হাসপাতালে জন্ম দেয়াতে আগ্রহী। আমার জন্মের সময় এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি মা শাহানারা বেগম কুসুমকে। তার মা শামসুন নুর-এর সাহচর্যে থেকেই তিনি আমাকে জন্ম দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, জন্মপরবর্তী ৯ মাসের প্রায় পুরোটা সময়ই আমার কেটেছে নানাবাড়িতে। এর অন্যতম প্রধান কারণ, আমার বাবা তখন পাকিস্তানে অবস্থান করছিলেন। সেনাবাহিনীতে চাকরির সুবাদে তার এই অবস্থান। এ কারণে আরো একটা বিষয় ঘটেছিল। আমার কাউসার নামকরণটা হয়েছিল জন্মের নয় মাস পর। বাবা মোস্তাফিজুর রহমান জন্মের নয় মাস পর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সন্দ্বীপ ফিরে একদিন কোরআন তেলাওয়াত করতে গিয়ে কোরআনের সুরা কাউসার পাঠ করে আমার নাম ঠিক করে ফেলেন। এর আগে আমার মেঝো মামা ডাক্তার গোলাম কিবরিয়া ‘ইকবাল’ নামে ডাকতেন আমাকে। তার দেখাদেখি বড় মামা ডাক্তার গোলাম মোস্তফা, সেজো মামা ফার্মাসিস্ট আবুল কাশেম এবং ছোট দুই মামা আবুল কালাম ও আবু ছাফাও আমাকে ইকবাল নামে ডাকতেন। বাবা ও মামাদের পছন্দের নামের মিশেলে আমার আসল নাম তাই ঠিক হয়Ñ কাউসার ইকবাল। কোরআনের সুরা কাউসার-এর সূত্র ধরে আমার নামকরণ হওয়ায় লেখক জীবনের শুরুতে তাই আমি আরবি ‘ছা’ হরফকে গুরুত্ব দিয়ে কাউছার ইকবাল নামেই প্রবন্ধ/নিবন্ধ ও বই লিখতে শুরু করি। এরপর ঔপন্যাসিক এবং দৈনিক ইনকিলাব-এর সিনিয়র সহকারী সম্পাদক ইউসুফ শরীফ-এর সঙ্গে পরিচয় ঘটলে তিনি আমাকে ‘ছ’ হরফের পরিবর্তে ‘স’ হরফ ব্যবহার করে কাউসার ইকবাল নামে লিখতে বলেন। সাপ্তাহিক ঊষার নিয়মিত কলাম লেখক আবদুল আউয়াল ঠাকুরও দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার সিনিয়র সহকারী সম্পাদক ছিলেন। মূলত তার কাছেই আমার যাতায়াত ছিল ইনকিলাব ভবনে। এক পর্যায়ে দুজনেই আমার নামের পেছনে পড়ে যান। বলতে থাকেনÑ ছাগলের ‘ছ’ দিয়ে কাউছার লিখলে তোমাকে দেখলেই মনে হয় ছাগল দেখছি। ছাগল দেখা থেকে তাদেরকে রেহাই দিতে শেষ পর্যন্ত ‘স’ ব্যবহার চূড়ান্ত করে কাউসার ইকবাল নামে লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছি। যদিও জাতীয় পরিচয়পত্রে আমার পুরো নাাম হিসেবে উলে¬খ আছেÑ মোহাম্মদ কাউসার ইকবাল। কাউসার ইকবাল নামের আগে মোহাম্মদ শব্দটি জুড়ে দিয়েছেন আমার স্কুলশিক্ষক পিযূষ কান্তি নাথ। ১৯৮১ সালে চট্টগ্রামের দক্ষিণ কাট্টলীস্থ পি. এইচ. আমীন একাডেমীতে পড়ার সময় এস.এস.সি পরীক্ষার জন্য রেজিস্ট্রেশনের ফরম পূরণকালে হিন্দুদের নামের আগে ‘শ্রী’ যুক্ত করার মতো তিনি আমার নামের আগে ‘মোহাম্মদ’ যুক্ত করে দিয়েছেন। আর আমার জন্ম তারিখ ২৩-০৮-১৯৬৭ এর স্থলে উনি বসিয়ে দিয়েছেন ০৯-০৯-১৯৬৮ ইং। আমার ছোট বোন শাহনাজ বেগম স্বপ্নাও এই স্কুলশিক্ষককে কখনো ভুলবে না। কারণ, তার নাম রেজিস্ট্রেশনের সময় তিনি তাকে ‘শাহনেওয়াজ বেগম’ বানিয়ে দিয়েছেন। এই স্কুলশিক্ষকের বদৌলতে সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেটে ‘মোহাম্মদ’ শব্দটি ঢুকে পড়ায় জাতীয় পরিচয়পত্রে এবং চাকরির ক্ষেত্রে জীবন-বৃত্তান্ত দিতে গিয়ে মোহাম্মদ কাউসার ইকবাল নামেই নিজের পরিচয় তুলে ধরতে হচ্ছে। আবার কাউসার ইকবাল মেহেদী নামেও কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছে আমার। কিন্তু পরিচিতদের সংখ্যাগরিষ্ঠই আমাকে চেনে কাউসার ইকবাল নামে। এই নামেই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা শ্রেয় মনে করেছি। কারণ, এই নামটিই ১৯৬৮ সালের মে মাসে আমার বাবা ও মামারা মিলে আসল নাম হিসেবে ঠিক করেছিল। সেবারই বাবা পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরার সময়ে মা-সহ আমাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে আমার শহুরে জীবনের শুরু। আমার ছোট ভাই শওকত ইকবাল, তার ছোট বোন শাহনাজ বেগম স্বপ্না এবং সবচেয়ে ছোট বোন ছালেহা আক্তার মিঞ্জুর জন্ম পাকিস্তানেই। ১৯৭৩ সালে যুদ্ধবন্দি সব বাঙালি সৈন্য ও তাদের পরিবারকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হলে ঢাকা সেনানিবাস এলাকায় শুরু হয় আমাদের নতুন জীবন। শহীদ রমিজউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর বাবা মিরপুর সেনানিবাসে বদলি হলে পল্লবী মডেল হাইস্কুলে ৮ম ও ৯ম শ্রেণীর লেখাপড়া চলে। ৯ম শ্রেণীর মাঝামাঝি সময়ে বাবা চট্টগ্রামে বদলি হলে হালিশহর হাউজিং এস্টেটের এ ব্লকে হয় আমাদের স্থায়ী ঠিকানা। বাবা-মা বছরে ২/৩ বার করে সন্দ্বীপ গেলেও আমি ও অন্য ভাই-বোনেরা সেই পথে হেঁটেছি খুব কমই। স্কুল ও কলেজজীবনে বছরে একবার করে গিয়ে প্রায় একমাস করে বেড়িয়েছি। কিন্তু কর্মজীবনে ঢোকার পর সন্দ্বীপ যাওয়া হয়নি তেমন। সর্বশেষ ১৯৯৪ সালে নানির অসুস্থতার কারণে মাকে নিয়ে তিনবার যেতে হয়েছিল। তিনবারই সীতাকুণ্ডের ফকিরহাট লঞ্চঘাটা দিয়ে যাওয়া-আসার সময়ে উভয় পাড়ে প্রায় দুই মাইল করে হাঁটা রাস্তার মধ্যে এক মাইল করে রাস্তা আবার প্রায় একফুট কাদায় ডোবা ছিল বলে কষ্টকর অভিজ্ঞতা লাভের কারণে চট্টগ্রাম ফিরে পণ করেছিলামÑ খুব বেশি দরকার না পড়লে আর সন্দ্বীপ যাব না। এরপর থেকে আর সন্দ্বীপ যেতে হয়নি বলে বককে ধবধবে সাদার উপমা দেয়া যায় কিনাÑ সেই বিষয়ে সংশয়ে ভুগছি।

বককে অন্য কোন লেখক বা ঔপন্যাসিক ধবধবে সাদার উপমা হিসেবে ব্যবহার করেছেন কিনা, তাও স্মরণ করতে পারছি না। কারণ, গল্প-উপন্যাসও দীর্ঘদিন ধরে পড়া হয় না। স্মরণশক্তিও এখন অনেক কমে গেছে। কিন্তু যে গল্প-উপন্যাস খুব একটা পড়েনি, লেখাপড়াও যার খুব বেশি নয়, তার মুখে বকের উপমা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে।

বককে ধবধবে সাদার উপমা হিসেবে ব্যবহার করেছে আমার ছোটভাই শওকত ইকবালের বউ আমেনা বেগম। বাবা তাকে টুপি ধুতে দিলে সে দুই মিনিটেই ধোয়া সম্পন্ন করে। বাবা তখন টুপির ময়লা পুরোপুরি সাফ হয়েছে কিনা, সেই বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলে আমেনা বেগম দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেÑ কিলা কয়! বকের মতো ধবধইব্বা সাদা হইছে।

আমেনা বেগম বর্তমানে শহুরে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠলেও সন্দ্বীপের আঞ্চলিক ভাষা পুরোপুরি ত্যাগ করতে পারেনি। এর কারণ, সে সন্দ্বীপের অন্য মহিলাদের সঙ্গে কথা বলাতেই অভ্যস্ত ছিল ছোটবেলা থেকে। আর আমার ছোট ভাইয়ের বউ হিসেবে আমাদের ঘরে আসার পর শাশুড়িকে পেয়েছে আধা সন্দ্বীপী, আধা শুদ্ধ বাংলা বলা কথার সঙ্গী হিসেবে। তাই তার কথায় আঞ্চলিকতা, শহুরে ঢঙ সবই থাকে। আমার বউ জাহানারা বেগম মনির ভাষা অবশ্য শহুরে। হাজারে ২/৩টি শব্দ থাকে চাঁদপুরের, য তার বাবা ও মায়ের কণ্ঠ ধরে ঢুকে পড়েছে তার শব্দতালিকায়। কিন্তু চট্টগ্রামের পোর্ট কলোনিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠার কারণে আঞ্চলিক ভাষার প্রভাব থেকে সে মুক্ত, যেমনটা মুক্ত আমি। সন্দ্বীপে জন্মালেও কথা ধরে আমাকে সন্দ্বীপী বলে চিনে নেবেÑ এমনটা হয়নি কখনোই। এমনকি দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম এলাকায় বাস করলেও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাও আমার শব্দ তালিকায় সেভাবে ঢোকেনি। হাট-বাজারে গেলে কেবল বিক্রেতার সঙ্গে প্রয়োজন অনুযায়ী মাঝে মাঝে কিছু শব্দ উচ্চারণ করি। কিন্তু শহুরে ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত হলেও কবি-লেখকদের ঝুলিতে সাহিত্যচর্চার জন্য যত শব্দ জমা থাকে, আমি ততটা রপ্ত করতে পারিনি। তাই খ্যাতি ও অর্থলাভের ক্ষেত্রেও স্বাভাবিকভাবেই পিছিয়ে আছি। তবে এগিয়ে যাওয়ার সাধনা অব্যাহত রাখতে চাই। কেননা, লেখালেখিটা এখন রক্তের সঙ্গেই মিশে গেছে। এমনকি হযরত মোহাম্মদ (সা.) ও হযরত ঈসা (আ.)ও আমাকে লেখক হিসেবে চেনেন। এক রাতের স্বপ্নে দুজনেই একসাথে আমার সামনে হাজির হলে আমি তাদেরকে লেখক হিসেবেই নিজের পরিচয় দিয়েছি এবং তারা আমাকে লেখালেখি চালিয়ে যেতেই উৎসাহ দিয়ে গেছেন। সঙ্গত কারণেই নিজেকে লেখক বলে পরিচিত করতেই গর্ববোধ করি। এরপর দার্শনিক সক্রেটিসও স্বপ্নে দর্শন দিয়ে জগত ও জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে আমাকে জ্ঞানদানের চেষ্টা করেছেন; যাতে লেখালেখিতে আমার আগ্রহ আরো বেড়েছে। সক্রেটিসকে স্বপ্নে দেখা সেই রাতের ঘটনা এখনো মনে পড়ে। ছোটপোলের অর্কিড আবাসিক এলাকার শ্বশুর বাড়ির বিছানায় শুয়ে আছি। বিছানায় ওঠার আগেই লক্ষ করেছিলাম, বারান্দায় ঝোলানো দরজার সাদা রঙের পর্দাটি শুকিয়ে গেলেও আমার স্ত্রী মনি তা ঘরে তোলেনি। আবার পর্দার নিচে ছোট টি-টেবিলটি রয়েছে। একটু দূর থেকে কেউ খেয়াল করলে চার পা-ওয়ালা ভূত বলে ভ্রম হতে পারে তার। স্ত্রী ও সন্তান বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি স্বর্গ ও নরক বিষয়ে সত্য কী, তা নিয়ে ভাবছিলাম। হঠাৎ শুনলাম ছেলে ভূ...ভূ...ভূ..বলে গোঙাচ্ছে। স্বপ্নে ভূত দেখছে, না বারান্দার সেই পর্দাকে ভূত মনে করে গোঙাচ্ছে, এটা বুঝতে আমি ছেলে অনাময়ের দিকে তাকাতেই দেখি সে মূর্চ্ছা গেছে। ছেলের এই দশা দেখে স্ত্রীর ওপর ভীষণ রাগ হলো। কিন্তু স্ত্রীকে না ডেকে বাথরুম থেকে পানি এনে ছেলের মুখে ছিটাব বলে মনোস্থির করে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে হতবাকÑ চোখের সামনে বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস দাঁড়িয়ে। ভূত দেখছি, না স্বপ্ন! বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না। কিছুদিন আগে দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকায় স্মরণীয় বরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে সক্রেটিসের ছবিসহ জীবনী ছেপেছিল। হুবহু সেই ব্যক্তি। না, চিনতে আমার মোটেই ভুল হচ্ছে না। কিন্তু সক্রেটিস এখানে কীভাবে, কোত্থেকে এলো? কী চায় সে আমার কাছে?

‘আমি তোমার কাছে কিছুই চাই না। তুমি স্বর্গ-নরকের সত্য সম্বন্ধে জানতে চাইছ। তাই আমি তোমাকে সত্য জানাতে এসেছি।’

আমাকে অবাক করে দিয়ে সক্রেটিস কথাগুলো বলল। সক্রেটিসের কথা শুনে মনে হলোÑ সত্যিইতো, আমি তো স্বর্গ-নরকের সত্য নিয়েই ভাবছিলাম। সক্রেটিস তা স্বর্গ থেকে জানল কী করে? আর এতো তাড়াতাড়ি স্বর্গ থেকে মর্ত্যইে বা এলো কী করে? আমিতো স্বর্গ-নরকের সত্য বিষয়ে ভাবছিলাম দু’মিনিট হয়তো হবে। দু’মিনিটেই স্বর্গ থেকে মর্ত্যে আসা যায়? আচ্ছা, সক্রেটিস যে স্বর্গ থেকেই এসেছে, তার নিশ্চয়তাই বা কী? সক্রেটিস তো ইসলাম ও খ্রিস্ট ধর্ম চালু হবার আগে দুনিয়ায় ছিল। তাহলে যেসব ধর্ম পালন করলে স্বর্গ পাওয়া যায়, তিনি তো সেসব কোনো ধর্মের অনুসারীই ছিলেন না। তাহলে সক্রেটিস স্বর্গ পাবে কেমন করে? নরক থেকেই কি তবে সক্রেটিস এসেছেন?

‘আমি স্বর্গ থেকেই এসেছি। তবে সেই স্বর্গের অবস্থান ঊর্ধ্বলোকে নয়, দুনিয়াতেই স্বর্গ-নরক বিদ্যমান। তোমরা যা জানো স্বর্গ-নরক বিষয়ে, তা সত্য নয়।’ আমাকে অবাক করে দিয়ে আবার কথাগুলো বলল সক্রেটিস। আমার মনের কথা সব পড়তে পারছেন তিনি। সেভাবেই তো কথা বলছেন। কিন্তু ঊর্ধ্বলোকে স্বর্গ-নরক বলে কিছু নেই, এ কথার সঙ্গে আমি একমত হতে পারলাম না। তাই সরাসরি তাঁকে প্রশ্ন করলামÑ ধর্মগুলো স্বর্গ-নরক বিষয়ে যা বলেছে, তা কি তবে সত্য নয়?

সক্রেটিস মুখ কঠিন করে দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, মানুষকে শান্তিপূর্ণ রাখার ৪টি উপায় আছেÑ এর একটা হচ্ছে লোভ দেখানো, আরেকটা ভয় দেখানো, তৃতীয় পথ হচ্ছে রূপকথাজাতীয় কাহিনী শুনিয়ে ভুলিয়ে রাখা এবং সবচেয়ে কঠিন পথটি হচ্ছে সত্য জানিয়ে সঠিক জ্ঞান দেয়া। ধর্মপ্রচারকেরা ৪টি পদ্ধতির মধ্যে সহজ তিনটি পদ্ধতিকেই প্রয়োগ করেছে, সত্য জানিয়ে জ্ঞান দিয়ে মানুষকে শান্তিপূর্ণ করার পথটিই বর্জন করেছে। যে কারণে মানুষ সত্য সম্বন্ধে অবগত হতে পারেনি। এখন সত্য সম্বন্ধে মানুষকে জানাতে যাওয়াও বিপদ। কারণ সত্য বললে দেখবে, পৃথিবীর ৫শ কোটি সর্প তোমাকে দংশন করতে উদ্যত হবে। এর এক সর্পের দংশন তোমার শরীর স্পর্শ করলে তুমি মৃতের তালিকায় চলে আসবে।

সক্রেটিসের কথা আমি ঠিক ধরতে না পেরে বললামÑ শহুরে জীবনে এক সর্পের দেখা পাওয়াই যায় না, ৫শ কোটি সর্প কীভাবে দেখব?

সক্রেটিস কিছুটা ভর্ৎসনার স্বরে বললেনÑ তোমার আশপাশে তোমার আকৃতির যাদের তুমি দেখতে পাও, এদের সামনে সত্য উচ্চারণ করলে দেখবেÑ এরা সবাই একেকটি সর্প। সত্য উচ্চারণ করায় আমাকে যেমন ‘সর্পের ছোবলে’ বিষময় যন্ত্রণা সয়ে মৃতের তালিকায় উঠে আসতে হয়েছে, তেমনি তুমি যদি সত্য উচ্চারণ করে বলো, কোনো ধর্মই মানুষকে সঠিক জ্ঞান দেয়নি, মিথ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একেকটি ধর্ম, তবে দেখবে দেড়শ কোটি মুসলিম সর্প, দেড়শ কোটি খ্রিস্টান সর্প, একশ কোটি হিন্দু সর্পসহ প্রায় ৫শ কোটি সর্প তোমাকে দংশন করতে উদ্যত হবে।

সক্রেটিসের কথা শেষ হতেই আমি বললামÑ কিন্তু ধর্মপ্রচারকরা মিথ্যের আশ্রয় কেন নিতে যাবেন? আপনি জীবদ্দশায় যেমন তখনকার ধর্মবিরোধী কথা বলেছিলেন, এখন এতযুগ পর দুনিয়ায় এসে এখনকার ধর্মবিরোধী কথা বলছেন। আপনি আমাকে উদাহরণ দিয়ে বলুন ধর্মসমূহের কোন কথাটা মিথ্যে।

সক্রেটিস কিছুটা ইতস্তত করে বললেন, তা শোনার ক্ষমতা অর্জন করতে তোমাকে তোমার অন্তরের ধর্মান্ধতামুক্ত হতে হবে। ধর্মান্ধতা নিয়ে সত্য জানা যায় না। একটু থেমে সক্রেটিস আবার বললেনÑ শোনো, যা সত্যÑ তা বিশ্বাস করার কথা বলতে হয় না। কারণ, তা প্রতিভাত। ‘দুধ সাদা’ একথা সত্য বলেই কাউকে এটা বলার দরকার নেই যে, ‘দুধ সাদা’ একথা বিশ্বাস করো। কিন্তু যা সত্য বলে প্রমাণিত নয়, তা-ই বিশ্বাস করতে শিক্ষা দিয়েছেন ধর্মপ্রচারকরা। একেকটা ধর্ম একেকটা রূপকথাজাতীয় কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। আর মানুষেরা বুদ্ধিগতভাবে এখনো ‘নাবালক’ রয়ে গেছে বলে রূপকথাজাতীয় কাহিনিÑ যেমন ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ পড়ে শিশু-কিশোররা যেমন প্রভাবিত হয়, তেমনি প্রকৃতির রূপকথাজাতীয় কাহিনির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে চলার শিক্ষা দিয়ে গেছেন ধর্মপ্রচারকরা। তবে ভালো করে অনুধাবন করার চেষ্টা করলে বুঝবে, মানুষের পরবর্তী জীবনের সুখ-শান্তি পাওয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে ধর্মপ্রচারকরা পৃথিবীতে ধর্ম প্রচার করেন নাই। মানুষের ইহলৌকিক জীবনের সুখ-শান্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই ধর্মপ্রচার করে গেছেন তারা, যাতে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়। বোমা মেরে মানুষ হত্যার জন্য ধর্মপ্রচারকরা ধর্ম প্রচার করেননি।

সক্রেটিস একটু থামলে আমি তার উদ্দেশে বললামÑ জগতে সত্য প্রতিষ্ঠায় আমি আপনার সহযোগিতা চাই। আপনি আমাকে বলুন, মানুষের পরবর্তী জীবনে সুখ-শান্তি লাভের বিষয়ে প্রকৃত সত্য তবে কী?

সক্রেটিস আমার প্রশ্নের জবাবে বলতে শুরু করলেনÑ মানুষের মৃত্যুর পর আলোকদেহÑ যে দেহটাকে মানুষ ঘুমের ভেতর স্বপ্নে দেখে থাকে, যেমন আমার যে শরীরটা তুমি এখন দেখছÑ এই শরীরটা একটা অনির্দিষ্টকাল পর্যন্তÑ হতে পারে তা অনন্তকাল, এ জগতেই ঘোরাফেরা করে। জগতেই স্বর্গসুখ কিংবা নরকযাতনায় ভোগে। কেউ কেউ আবার মৃত্যুর পর মানবদেহেই বসবাস করতে পছন্দ করলে এক শরীরের বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়ে আরো উন্নত ও শান্তিময় জীবনের আশায় আরেক শরীরে প্রবেশ করে। হয়তো কোনো নবজাতকের শরীরে কিংবা তার পরিচিত কোনো প্রিয় মানুষের শরীরে, কিংবা আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ায় যেখানে সুখ-শান্তি আছে বলে বিশ্বাস করেÑ সেখানে কারো শরীরে প্রবেশ করতে চায়, কিন্তু অতীতের শরীরটাতে মানুষ কিছুতেই ফিরে যেতে চায় না। তাইতো মৃতরা কখনো জীবিত হয় না। পার্থিব মৃত্যুর পরে আরো উন্নত জীবন লাভের একটা লোভ মানুষকে পেয়ে বসে। কিন্তু যারা পৃথিবীতে মানুষের জন্য দুঃখ উৎপাদন করেÑ মানুষকে নানাভাবে কষ্ট দেয়, নতুন শরীর নির্বাচন করতে গিয়ে দেখা যায় তারা এমন শরীরে প্রবেশ করেছে, যে শরীরে তাদেরকে আগের জীবনে অন্যদের ভোগানোর প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় নিজে ভুগে। মোদ্দাকথায়, ঊর্ধ্বলোকে স্বর্গ-নরক বলে কিছু নেই। পৃথিবীতেই মানুষ যখন সুখে থাকেÑ তা মানবদেহে হোক কিংবা আলোকদেহে, তখন সে স্বর্গে থাকে। আর যখন সে দুখে থাকেÑ তা মানবদেহে হোক কিংবা আলোকদেহে, তখন সে নরকযাতনা ভোগ করে। অতএব, পরবর্তী জীবনে অন্য শরীরে গিয়ে যারা সুখ-শান্তি পেতে চায়, তাদের উচিত পৃথিবীটাকেই স্বর্গে পরিণত করার চেষ্টা করা। পৃথিবী স্বর্গে পরিণত হলে বর্তমান দেহ থেকে মুক্তি পেয়ে আত্মা পরবর্তীতে যে দেহেই আশ্রয় নেবে, সেখানে স্বর্গসুখ খুঁজে পাবে। আর পৃথিবীকে যারা নরকে পরিণত করে, তারা বর্তমান দেহ থেকে মুক্তি পেয়ে এমন দেহ বেছে নেবে, যেখানে তাকে নরকযাতনাই ভোগ করতে হবে। স্বর্গ ও নরকের বিষয়ে এটাই হচ্ছে সত্য। এরচেয়ে বড় সত্য আর কিছু নেই। আর পৃথিবীতে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে যে কথাটা সত্যÑ তা হচ্ছে এই যে, মানুষের শরীরে বিষ ধরানো পিঁপড়া থেকে শুরু করে যত হিংস্র ও ক্ষতিকর প্রাণী দেখা যায়Ñ তার যত বিনাশ করতে পারবে মানুষেরা, ততই তারা নিরুদ্বিগ্ন থাকবে ও শান্তি খুঁজে পাবে। বর্তমানে মানুষেরা নিরীহ মুরগি, ছাগল, গরু হত্যা করছে, আর হিংস্র বাঘ-সিংহকে রক্ষা করছে বন্য প্রাণী সংরক্ষণের নামে। এতে করে ‘নিরীহের গলা কর্তন আর হিংস্রের স্বার্থ সংরক্ষণ’ এমন একটা রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে পৃথিবীতে। আর এ রীতিটাই বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। তোমাদের শরীরের প্রয়োজনীয় আমিষের চাহিদা মেটাতে তোমরা মুরগির ডিম, আর গরু-ছাগলের দুগ্ধ শরীরে গ্রহণ করো এবং মাংস খেতে চাইলে হিংস্র প্রাণীদের বিনাশ করেই খাও। তবেই ‘হিংস্রদের বিনাশ, আর নিরীহের স্বার্থ সংরক্ষণ’ এমন রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিশ্বে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। নিরীহ প্রাণীদের স্বার্থ সংরক্ষণের শিক্ষা যতদিন না পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হবে, ততদিন পর্যন্ত মানুষের মধ্যে যারা নিরীহÑ তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়টিও নিশ্চিত হবে না। মানুষের মানসিকতা পরিবর্তনটাই সবচেয়ে আগে দরকার। নাহলে নিরীহদের ওপর হিংস্রদের জুলুম চলতেই থাকবে।

কথাগুলো বলেই সক্রেটিস অদৃশ্য হলেন।

সক্রেটিস বিদায় নিতেই আমার ঘুমও ভেঙে গেল।

স্বর্গ-নরক বিষয়ে আরেক রাতের স্বপ্নে যা দেখলাম, তার সাথে আবার সক্রেটিসের দেয়া জ্ঞানের মিল রয়েছে। সেই রাতের স্বপ্নে দেখলাম যে, বেহেস্তের বাগনে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বাগানের পাশেই বিশাল অট্টালিকা। আকর্ষণীয় ডিজাইনের বাড়িটিতে শতাধিক কক্ষ। প্রতিটি কক্ষের জানালায় একজন করে সুন্দরীর মুখ। মন বললÑ এরা সবাই বেহেস্তের হুর। এদের মধ্য থেকেই একজন হুর নেমে আসছে বাগানে। কাছে আসতেই বোঝা গেলÑ খুবই সুন্দর মুখ। আমার হাত ধরে হাঁটতে লাগল সে পাশে পাশে। হাঁটতে হাঁটতে গন্ধম গাছের সম্মুখে পৌঁছলাম আমরা দুজন। আমি গাছে উঠে গন্ধম ফল পেরে আনার পর দুজনেই খেলাম। এরপর চোখ মেলে তাকিয়ে থাকলাম একে অপরের দিকে। গাছের লতাপাতা খুঁজছি না। গাছের লতাপাতা কেন খুঁজতে যাব? আমরা একে অপরের জন্যই সৃষ্ট। একে অপরকে দু চোখ ভরে দেখার আছে অধিকার। একে অপরের বাহুতে হারাবার আছে অধিকার। আমরা একে অপরের বাহুবন্ধনে জড়ালাম। শরীরের সঙ্গে শরীরের স্পর্শের অনুভূতিতে আন্দোলিত হতে থাকলাম। তখনই ঘটতে লাগল অদ্ভুত ঘটনা। বাগানের পাশের অট্টালিকার একেক হুর বাগানে নেমে আসতে লাগল এবং সঙ্গিনীর শরীরের সাথে মিশে যেতে থাকল। আমার শরীরের অনুভূতি তাদের একেকজনের শরীরে সঞ্চারিত হচ্ছে একে একে। তাদের একেকজনের স্পর্শের অনুভূতিও আমার শরীরে সঞ্চারিত হচ্ছে একে একে। সঙ্গিনীর মুখাবয়বে একে একে ভেসে উঠছে কারিনা কাপুরের মুখাবয়বের মতো মুখ, ক্যাটরিনা কাইফের মুখাবয়বের মতো মুখ, প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার মুখাবয়বের মতো মুখ, ঐশ্বরিয়া রাইয়ের মুখাবয়বের মতো মুখ, দীপিকা পাডুকোনের মুখাবয়বের মতো মুখ, রানি মুখার্জির মুখাবয়বের মতো মুখ, মাধুরী দিক্ষিতের মুখাবয়বের মতো মুখ, মনিষা কৈরালার মুখাবয়বের মতো মুখ, শ্রী দেবীর মুখাবয়বের মতো মুখ, পূর্ণিমার মুখাবয়বের মতো মুখ, কুসুম শিকদারের মুখাবয়বের মতো মুখ, মোনালিসার মুখাবয়বের মতো মুখ, প্রভার মুখাবয়বের মতো মুখ, সাকিরার মুখাবয়বের মতো মুখ, ক্রিস্টেন স্টুয়ার্টের মুখাবয়বের মতো মুখ, ব্রিটনি স্পিয়ার্স-এর মুখাবয়বের মতো মুখ, শারাপোভার মুখাবয়বের মতো মুখ, আনা কুর্ণিকোভার মুখাবয়বের মতো মুখ, সানিয়া মির্জার মুখাবয়বের মতো মুখÑ এমন পার্থিব একেক শ্রেষ্ঠ সুন্দরীর মুখাবয়বের মতো মুখ আমার সঙ্গিনীর মুখে ভেসে উঠছে। সঙ্গে সঙ্গে তাদের শরীরটাও আমার বাহুবন্ধনে জড়িয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত ঘটনা। শতাধিক হুরের শরীরের স্পর্শে আমি আন্দোলিত, রোমাঞ্চিত, পুলকিত ও শিহরিত। মধুর মধুর শিহরণের চূড়ান্ত অনুভূতিতে ঘুম যখন ভাঙল, মোবাইল ফোনের বাটন টিপে দেখিÑ রাত মোটে ৩টা ৪৮ মিনিট। বিছানায় নেই স্ত্রীও। গতকাল দিনের বেলাতেই ছেলে অনাময়সহ তার বাপের বাড়ি গেছে শ্যালক বেলালের বিয়ের জন্য হুর খুঁজতে। একমাস পর ওমান থেকে বেলালের দেশে ফেরার কথা। কোন এক হুরের সঙ্গে তার বিয়ের পালা এবার।

































দুই



মেয়েরা সাধারণত অস্থির প্রকৃতির হয়। আমার শ্যালক বেলাল হোসেনকে বিয়ে করানোর জন্য দুটো মেয়ে পছন্দ করে রাখা হয়েছে। রোববার শালী ফারজানা আক্তার লাকীর বাসায় তার স্বামী মঞ্জুর কাদের মঞ্জুর পছন্দের পাত্রীকে দেখানোর এবং সোমবার মঞ্জুর ভাই আজমের পছন্দের এক পাত্রীর বাসায় পাত্র-পাত্রীর সম্মুখ সাক্ষাতের দিনক্ষণও ঠিক। তারপরও জে ব্লকে বাবু নামক আরেক নারী ঘটকের বাসায় যাবার জন্য মনি সন্ধ্যা থেকেই পীড়াপীড়ি করছে। দুদিন হলো বেলাল ওমান থেকে এসেছে। এবারে তার বাংলাদেশে আসার প্রধান উদ্দেশ্য বিয়ে করে যাওয়া। আর তাকে বিয়ে করানোর জন্য মনির আগ্রহটাই যেন বেশি। আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে, রবি ও সোমবার যে দুটি মেয়েকে দেখানোর কথা রয়েছে, আগে তাদের দেখিয়ে তার ফলাফল বোঝ। তারপর না হয় অন্য মেয়েকে দেখার চিন্তা করা যাবে। কিন্তু মনিকে তা বোঝানো গেল না। রাতে ভাত খাবার পর আমরা প্রতিদিনকার মতো ১০/১৫ মিনিট হাঁটার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হলে মনি জে ব্ল¬কের দিকেই হাঁটা শুরু করল। আমি লুঙ্গি ও হাফ-হাতা গেঞ্জি পরে আছি এ ব্লকের মধ্যে হাঁটব, এ কারণে। কিন্তু মনি ওই পোশাকেই আমাকে জে ব্ল¬ক নিয়ে চলল। বললÑ তুমি রাস্তায় হাঁটবে ৫/৭ মিনিট, আমি এর মধ্যেই ঘটককে একটা মেয়ে দেখার কথা বলে চলে আসব। কথামতো মনি নারী ঘটকের বাসায় ঢোকার পরে আমি রাস্তায় হাঁটতে থাকলাম। কিন্তু তার ৫/৭ মিনিট ১ ঘণ্টাতেও ফুরাল না। আর আমিও সাথে করে মোবাইল ফোন নিয়ে বের হইনি বলে তাকে তাগাদা দিতে পারছিলাম না। আবার লুঙ্গি পরা বলে দরজায় টোকা দিতেও বিব্রতবোধ করছিলাম।

বউয়ের এই স্বভাবটি ইদানীং আমার কাছে খুবই বিরক্তিকর ঠেকছে। কোথাও গিয়ে বসলে যেন চেয়ারের সাথে ফেভিকলের আঠা লাগিয়ে বসে। সহজে উঠতে চায় না। আর বাপের বাড়ি গেলে তো তিনদিনেও ফেরার নাম নেয় না। মোবাইলে ফেরার তাগাদা দিলেও তার যখন মর্জি হয়, তখনই ফিরে আসে। ইদানীং কথায় কথায় তর্ক করার প্রবণতাও বেড়ে গেছে। সেইসঙ্গে এমন আক্রমণাত্মক কথা বলতে পারঙ্গম হয়ে উঠেছে যে, তাকে এখন নিঃসঙ্কোচে ‘শেখ হাসিনার খালতো বোন’ বলে স্বীকৃতি দেয়া যায়। আর তার এই আক্রমণাত্মক কথার মুখোমুখি বেশি হতে হয় বেকার জীবনে পড়লে। চাকরি না থাকলে কিংবা পরিস্থিতির কারণে ছেড়ে দিলে বেকার সময়টায় মনি মাঝে মাঝে এমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে যে, আমি জগতের সবচেয়ে অযোগ্য লোক। তখন খোটা দিয়ে এমনভাবে আক্রমণ করে কথা বলেছে যে, মেজাজ সপ্তমে চড়েছে। এভাবে একবার টেলিভিশন, একবার ভিসিডি ও একবার শো-কেসের আয়না ভাঙিয়ে তারপর সে চুপ করেছে। সেই তিনবারই টেলিভিশন, ভিসিডি, শো-কেসের আয়নার মতো সংসারটাও ভাঙতে ভাঙতে টিকে গেছে। আর আমার নসিবটাও এমন যে, প্রায় প্রতি বছরই ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আজহার সময়ে অন্যরা যেখানে ঈদ বোনাসসহ প্রতি মাসের আয়ের দ্বিগুণ অর্থের মালিক হয়, সেখানে আমাকে অর্থশূন্য অবস্থায় দিন কাটাতে হয় চাকরি না থাকার কারণে। সূর্য পুবে উদিত হয়ে পশ্চিমে অস্ত যায়Ñ এই প্রাকৃতিক নিয়মের মতোই প্রতিবছর ঈদের আগে চাকরি না থাকাটা যেন আমার জীবনের নিয়ম হয়ে গেছে। আর চাকরি যখন থাকে না, তখন হাতে টাকা-পয়সা না থাকলে কি হবে, কলম দিয়ে লেখা ঝরতে থাকে। বেকার সময়টা কোনভাবে কাজে লাগাতে হবে তো! কলমই তাই হয়ে পড়ে আমার বেকার জীবনের প্রধান সঙ্গী।

পুরো এক ঘণ্টা ১০ মিনিট মহিলা ঘটকের বাসায় কাটিয়ে মনি অবশেষে সেই ঘর থেকে বের হয়ে এলো। তাকে দেখেই আমি এতোক্ষণ ধরে প্রতীক্ষার বিরক্তি প্রকাশ করতে বললামÑ ৫ মিনিটে যে কথা শেষ করা যায়, তা বলতে ঘণ্টা পার করলে কেন? তোমার এই বদভ্যাস যায় না কেন?

আমার প্রশ্নের জবাবে সে উল্টো আক্রমণ করে বসলÑ তুমি রিকশাওয়ালাদের মতো আচরণ করছ কেন? আমি তোমার সাথে যাব না। তুমি আগে আগে যাও, আমি পেছনে পেছনে আসছি। এই বলে সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ল।

মেজাজ না কমে আরো চড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু রাস্তায় আছি বলে মেজাজটা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললামÑ হাঁটো। মেজাজ আর খারাপ করো না।

আমার কথা শেষ হলে মনি হাঁটতে লাগল। তবে রাস্তা পেরিয়ে অন্য পাশে চলে গেল সে। জে ব্ল¬কে যাওয়ার সময় পরিচিত যারা দেখল যে, আমরা দুজন হাসিমুখে কথা বলতে বলতে হাঁটছি, তারাই ফেরার সময় লক্ষ করলÑ গোমরা মুখে আমরা একজন রাস্তার এপাড়ে. আরেকজন অন্যপাড়ে।

















তিন



সূর্যাস্ত অনেকদিন খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখা হয়নি অনাময়ের। শুধু অনাময়ের কেন, আমারও দেখা হয়নি। তাই অনাময় সাগড়পাড়ে যে মেলা বসেছে, যাকে হিন্দু সম্প্রদায়ের ‘বারণী স্নান’ সংক্রান্ত মেলা বলা হয়, সেখানে যাওয়ার জন্য আবদার জানালে না করলাম না। তবে ওকে বললাম, তোমাকে কিন্তু হাঁটিয়ে নেব। রিকশায় যাওয়ার মতো অতো টাকা নাই। ও তাতে আপত্তি জানাল না। হেঁটে যেতেই প্রস্তুত সে। মেলায় পৌঁছে কিছু খেলনা কিনবেÑ এটাই তার লক্ষ্য। আর আমার লক্ষ্য ওকে সূর্যাস্তের সৌন্দর্য দেখানো। বিশেষ করে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখার অনুভূতি অসাধারণ। আর সাগরপাড়ে অজ¯্র ঢেউয়ের মাঝে কমলা রঙের থালা হয়ে সূর্যের পানিতে ডুবে যাওয়ার দৃশ্য এক কথায় অপূর্ব। এমন দৃশ্য দেখার জন্য হাজার হাজার টাকা খরচ করে অনেকেই কক্সবাজার ছুটে যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে। অথচ পঞ্চাশ টাকা খরচ করলে হালিশহর এ ব্ল¬ক থেকে সাগরপাড়ে গিয়ে এমন দৃশ্য উপভোগ করা যায় যেকোন দিন। কিন্তু কর্মজীবনে থাকলে তখন সময় বের করা কঠিন হয়ে পড়ে। আবার বেকার জীবনে থাকলে ৫০ টাকা খরচ করার মানসিকতা থাকে না। তার চেয়ে বড় কথা, টাকা-পয়সার সমস্যাটা দীর্ঘদিন থেকে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। কেননা, চাই বা না চাই, বছরে ২/৩ মাস বেকার জীবন কাটাতে হয়। আর এ সময়ে পকেটে থাকা টাকা খরচ হয়ে এরপর ঋণের টাকায় দিন কাটতে থাকে। কোনভাবে চাকরি একটা ফের জুটলে ঋণের টাকা পুরো পরিশোধের আগেই দেখা যায়, চাকরিটা চলে গেছে বা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছি। অদ্ভুত এক নিয়তির শৃঙ্খলে যেন আবদ্ধ আমি। এমনই এক বেকার জীবনে অনাময়ের আবদার মেলায় যাবার জন্য। পকেটে টাকা না থাকলেও ছেলের আবদার সব সময় ফেলে দেয়া যায় না। আর মেলায় যাবার আবদার মানে তাকে কিছু কিনে দেবার টাকাও থাকতে হবে। পকেটে টাকা ছিল মাত্র পঞ্চাশ। সেই টাকা থেকে বিশ টাকা রিকশা ভাড়া দিলে খেলনা কেনা যাবে না পছন্দমতো। তাই যাবার সময় হেঁটে যাওয়ার জন্যই ছেলেকে রাজী করালাম। অনাময়ের বয়স মাত্র ১২। ক্লাস ফাইভে পড়ে সে। তাকে ২ মাইল রাস্তা হাঁটিয়ে নিচ্ছিÑ একটা অপরাধবোধ মনে জাগতে চাইল। কিন্তু অপরাধবোধকে মনে বাসা বাঁধতে দিলাম না। হাঁটুক। হাঁটার অভ্যাসটা গড়–ক। এমনিতে তো ক্রিকেট খেলতে গিয়ে দিনে যতটা দৌড়াদৌড়ি করে তা ৩ মাইলের কম নয়। তবে বেড়ানোর সময় বাচ্চারা রিকশা বা টেক্সিতেই চড়তে চায়। রিকশায় চড়িয়ে নিলেই তার আনন্দটা বেশি হতো। তবে হেঁটেও তার আনন্দের কমতি নেই। বেশ উদ্দীপনা নিয়েই সে হাঁটছে। আর হাঁটার মাঝে মনে কোন প্রশ্ন জাগলে তৎক্ষণাৎই তার উত্তর পেতে চাইছে।

Ñ আব্বু, সাগরপাড়ে মেলা বছরে কয়বার হয়?

Ñ একবারই তো হয় জানি।

Ñ আর বেশি কেন হয় না?

Ñ তাতো জানি না।

Ñ আচ্ছা আব্বু, ঢাকায় যেমন বৈশাখী মেলা হয়, চিটাগাঙে তেমন মেলা হয় না?

Ñ হয় তো। লালদীঘী পাড়ে জব্বারের বলি খেলা উপলক্ষে মেলা হয়। গত বছর তোমাকে ওই মেলা থেকে ক্রিকেট ব্যাট কিনে দিলাম না!

Ñ কিন্ত ওই মেলা তো ঢাকার বৈশাখী মেলার মতো না। ঢাকার মেলায় কতো আনন্দ, কতো বাজনা, গান! আমার খুব মজা লেগেছে। ঢাকার মেলায় আমাকে আবার নিবা!

Ñ দেখি! যদি ঢাকায় আবার চাকরি পাই, তবে সামনের বছরে তোমাকে আবার ঢাকার বৈশাখী মেলায় নেয়ার চেষ্টা করব। নাহলে ডি.সি হিলে নিয়ে যাব। ডি. সি. হিলেও গান-বাজনায় নতুন বছর বরণ করে নেয়া হয়। ঢাকার মতো অতো জমজমাট না হলেও ডি. সি. হিলের মেলায় আনন্দ কম হয় না।

অনাময় কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে যায়। হয়তো সে ঢাকার বৈশাখী মেলার স্মৃতিচারণ করছে। ৫ বছর যখন তার বয়স, তখন আমার চাকরি ছিল ঢাকায়। দৈনিক সমাচার-এ স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করতাম। মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে সাবলেট হিসাবে এক রুম ভাড়া নিয়ে থাকতাম। ঢাকায় ওকে নিয়ে বেশি বেড়ানোর সুযোগ না পেলেও প্রতি বছর বইমেলাতে ৩/৪ বার, বৈশাখী মেলাতে একবার এবং সম্ভব হলে শিশু পার্কও বেড়িয়েছি। এক বছর বয়সী থাকতেই ওকে ঢাকায় নিয়ে গিয়েছিলাম স্ত্রী মনিসহ। তখন অবশ্য চাকরি করতাম সাপ্তাহিক ঊষায়। আমার সাংবাদিকতা জীবনের শুরু সাপ্তাহিক ঊষা থেকেই। পত্রিকাটির সম্পাদক মারুফ কামাল খান এবং সহকারী সম্পাদক আমিরুল ইসলাম কাগজীর হাতেই ১৯৯৯ সালে আমার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। অবশ্য পত্রিকাটির প্রকাশক এম. তারিকউল্ল¬াহ শিকদারের সৌজন্যেই সাংবাদিকতা পেশায় ঢোকা। সাংবাদিকতা পেশায় ঢোকার আগেই অবশ্য ১৯৯৮ সালের মধ্যে আমার ৩টি বই প্রকাশিত হয়ে গিয়েছিল। এরমধ্যে ১৯৯১ সালের বইমেলাতে প্রকাশিত হয়েছিল ‘জনতার জিয়া’; ১৯৯৬ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত হয়েছিল ‘নারী ভালবাসা ও জীবনের কথা’ এবং ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হয়েছিল ‘শাসক মুজিব ও শাসক জিয়া’ বইটি। এম. তারিক উল¬াহ শিকদারই ছিলেন এই বইটির প্রকাশক। জিয়া গবেষণা কেন্দ্রের সদস্য সচিব ছিলেন তিনি। তার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় লেখালেখির সূত্র ধরেই। ১৯৮৭ সালে জিয়া গবেষণা কেন্দ্র থেকে দেশব্যাপী এক রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। আমি তাতে ‘দেশ গঠনে জিয়া’ বিষয়ক রচনায় দ্বিতীয় পুরস্কার পেলে ১৯৮৭ সালের ৫ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টি.এস.সি-তে আয়োজিত পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করি। ওই অনুষ্ঠানেই এম তারিকউল্ল¬াহ শিকদারের সঙ্গে পরিচিত হবার পর জিয়া গবেষণা কেন্দ্রের চট্টগ্রাম শাখার আহ্বায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন শুরু করেছিলাম। নাছিরুল মাওলা বাদল ছিল সেই আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব। চট্টগ্রামের হালিশহর সুপার মার্কেটে জিয়া গবেষণা কেন্দ্র, চট্টগ্রাম শাখার আয়োজনে সভায় অংশ নিতে ১৯৮৮ সালে এম. তারিকউল্ল¬াহ শিকদার হালিশহরেও এসেছিলেন। এভাবেই তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্র ধরে তিনি সাপ্তাহিক ঊষা প্রকাশের উদ্যোগ নিলে সাংবাদিকতা পেশাতে ঢোকার সুযোগ হয়ে যায় আমার। আর সেই সুবাদে অনাময়ের সুযোগ হয় ঢাকার বৈশাখী মেলা দেখার। তবে অনাময় যে মেলায় আবার যাবার জন্য আবদার জানাচ্ছে, সেই মেলা যে অনেকের জন্য বেদনার কারণও হতে পারেÑ তার সাক্ষিতো দেশের অনেকেই। ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে রমনার বটমূলে অনেকের মৃত্যু ঘটেছে ঢাকার এমনই এক বৈশাখী মেলাতে; যা কাম্য নয়। সমর্থনযোগ্যও নয়। এসব বোমাবাজি কেবল এ কথারই সাক্ষ্য দেয় যে, মানুষ কতো অমানুষ হয়ে আছে ধর্মের অপব্যাখ্যার শিকার হয়ে। ধর্ম কখনোই কাউকে অমানুষ হবার শিক্ষা দেয় না। এমনকি কোন দেশের সংস্কৃতিচর্চার বিরোধীও নয় ধর্ম। ১৯৮৯ সালের ২১ আগস্ট আমি সৌদি আরব গিয়েছিলাম। ২ বছর ৪ মাস তখন সৌদি আরবে কেটেছে কর্মজীবন। কর্মজীবনের সূত্র ধরে ৮/১০টি বিয়ের অনুষ্ঠান দেখেছি। বিয়ের অনুষ্ঠানে আনন্দ প্রকাশ করতে গিয়ে মুসলিম নারীদের উলুধ্বনি দিতে এবং পুরুষদের ঢাক-ঢোল বাজাতেও দেখেছি। অথচ, বাংলাদেশ এবং ইন্ডিয়াতে উলুধ্বনি দেয়া হিন্দু সংস্কৃতির অংশ। আর সৌদি আরবের মহিলারা বিয়েতে উলুধ্বনি দেয়ায় এ কথাই প্রমাণিত যে, নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনুসরণে ধর্মের কোন বাধা নেই। যারা এতে বাধা প্রদান করতে চায়, তারা ধর্মমূর্খ। ধর্মমূর্খদের ধর্মজ্ঞানী করে তুলতে সকলের সচেষ্ট হওয়া দরকার। তবে যারা মানুষ হত্যায় জড়িত, মৃত্যুদণ্ডই তাদের প্রাপ্য।

Ñ আব্বু, ডি. সি. হিল কোথায়?

অনাময়ের প্রশ্নে ভাবনায় ছেদ পড়ে। ওর জিজ্ঞাসার জবাবে বলি, গত বছর তোমাকে যে মেলায় নিয়ে গিয়েছিলাম, তার কাছাকাছি। ১৫/২০ মিনিটের হাঁটা পথ।

অনাময় আবার প্রশ্ন ছোড়েÑ আমরা এখন যে মেলায় যাচ্ছি, তা আর কত দূরে? লক্ষ করে দেখলামÑ আরো ১০ মিনিটের মতো পথ হাঁটা বাকী রয়েছে। তাই তাকে বললামÑ আরো ১০ মিনিট হাঁটতে হবে। এরপর প্রশ্ন করলামÑ তোমার কি হাঁটতে কষ্ট লাগছে? রিকশা নেব?

অনাময় বললÑ লাগবে না। মেলায় পৌঁছতে আর কত সময় লাগবে, তা বুঝতে জিজ্ঞেস করেছি।

আমি স্বাভাবিক গলাতেই বললামÑ আর বেশিক্ষণ না।

১০ মিনিট পর আমরা মেলা প্রাঙ্গণে পৌঁছলাম। সূর্য ডুবতে তখনো অনেক সময় বাকী। তাই ওকে স্টল ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলাম। সে বিভিন্ন স্টলের খেলনা দেখতে থাকল। তবে দামি কোন খেলনার জন্য বায়না ধরল না। তার জন্য আমি ৫০ টাকা বরাদ্দ রাখলেও সে মাত্র ১০ টাকা দামের কাঠ দিয়ে তৈরি গাড়ি, যাতে ঢোল বাজার ব্যবস্থাও আছে, সুতা দিয়ে টেনে চালানোর সময়ে, তা কিনে সন্তুষ্ট থাকল।

সূর্য ডোবার সময় হয়ে এলে ওকে সাগরপাড়ে দাঁড় করিয়ে হাতে থাকা মোবাইলের ক্যামেরায় কিছু ছবি তুললাম। আমার ছবিও ওকে দিয়ে তোলালাম। এরপর পশ্চিমাকাশের মেঘগুলোকে কমলার রঙে রাঙিয়ে একটা বড় আকারের কমলাকে সাগরের মাঝে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখলাম দুজনে।

ফেরার পথে ভাগিনা ইশমাম ও ভাগ্নী সুবাহ্্র জন্য আরো দুটি খেলনা গাড়ি কিনে নিলাম ২০ টাকা দিয়ে। আরো ৩ ভাগিনা আছে আমার। স্বপ্নার ছেলে নাহিয়ান রহমান, সাফিয়ান রহমান ও আরিয়ান রহমান। তাদের জন্য আরো ৩টি খেলনা গাড়ি কিনতে পারলে ভালো হতো। টাকা নাই বলে তা করা যায়নি। তবে তাদের বাবা মাহমুদুর রহমান প্রত্যেকের জন্য চাহিদা অনুযায়ী খেলনা কিনে দিতে পারে, পক্ষান্তরে সুবাহ-ইশমামদের বাবা ছানাউল্ল¬াহ শামীম আবুধাবি থাকে বলে তাদের চাহিদা অনুযায়ী তাৎক্ষণিক কিছু কিনে দিতে পারে নাÑ এই চিন্তা থেকে এই দুই ভাগ্নে-ভাগ্নীর জন্য দুটি খেলনা নেয়া। ছোট ভাই শওকতের ছেলে ইবরাহিম মোহাম্মদ ইকবাল সুস্ময় ও মাহাথির ইকবাল তন্ময় অবশ্য বাবা-মার সাথে মেলায় এসে ঘুরে গেছে এবং চাহিদা মোতাবেক খেলনা নিয়ে গেছে। কাজেই তাদের জন্য খেলনা কিনতে না পারায় খারাপ লাগছে না।

বেড়ি বাঁধের ওপর তৈরি করা বন্দর থেকে ঢাকামুখী রাস্তা অতিক্রম করে এলে হালিশহরমুখী টেম্পো পেলাম। তাতে চড়ে হালিশহরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। পকেটে থাকা ১০ টাকা দিয়ে ভাড়া মেটালাম। আর ১০ টাকা খরচ করেছিলাম বাদাম খেতে। সব মিলিয়ে ৫০ টাকা খরচে মেলা ঘোরা হলো বাপ-বেটার।

















চার



সাগরপাড়ের মেলায় আকাশে মেঘখণ্ড ভেসে বেড়ানোর দৃশ্য দেখার ফলশ্র“তিতেই বোধ করি সেই দিবাগত রাতের শেষ প্রহরে খ্রিস্ট ধর্ম প্রবর্তক ঈসা নবী (আ.)কে স্বপ্নে কমলা রঙের পোশাকে পৃথিবীতে নেমে আসতে দেখলাম। আকাশ থেকে নেমে এলেন তিনি। আর আমার মুখোমুখি হতেই ঘুম ভেঙে গেল। তবে পরের রাতেও আবার তিনি স্বপ্নে দেখা দিলেন। এই স্বপ্নে আকাশ থেকে তার নেমে আসার ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুতভাবে ঘটল। প্রথমে মনে হলো আকাশ থেকে সাদা একখণ্ড মেঘ নেমে আসছে হুবহু মানবদেহের রূপ ধরে। কিন্তু ভূমিতে নামার আগেই মেঘখণ্ড বৃষ্টিতে পরিণত হয়ে গেল। আর তিনি রয়ে গেলেন আলোকখণ্ডের অধিকারী হয়ে; যেন এক আলোকমানব। তবে আরো অদ্ভুত ব্যাপার হলো, তিনি আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, তুমিতো পৃথিবীর মানুষের শান্তি নিয়ে ভাবো। তাই আমি স্বর্গ থেকে নেমে এসেছি তোমাকে সহযোগিতা করার জন্য।

আমি তার এমন কথায় জিজ্ঞেস করলামÑ আপনি কে?

তিনি বললেনÑ আকাশ থেকে যার নেমে আসার কথা ছিল, আমি সে।

আমি বললামÑ কিন্তু তার তো রক্ত-মাংসের দেহে পৃথিবীতে নেমে আসার কথা।

তিনি বললেনÑ যারা স্বর্গলাভ করে তারা এমন আলোকদেহের অধিকারী হয়ে যায় এবং পরবর্তী জীবন তাদের আলোকদেহেই কাটে। আর আলোকদেহেরই আকাশে ওঠার বা আকাশ থেকে নামার ক্ষমতা থাকে। রক্ত-মাংসের দেহের আকাশে ওঠার বা আকাশ থেকে নামার কোন ক্ষমতা থাকে না। তেমন ক্ষমতা থাকলে তো আমাকে যখন সৈন্যরা ধরতে এসেছিল, আমি তখন ঊড়ে তাদের নাগালের বাইরে চলে যেতাম। তাহলে তারা আমাকে যন্ত্রণার মুখোমুখি করতে পারতো না।

আমি বললাম, আপনার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু আপনি কিভাবে আমাকে সহযোগিতা করতে পারেন?

আলোকমানব বললেন, সেটা সময়মতোই তোমাকে জানাব।

আমি তখন আমার বেকার জীবনের প্রসঙ্গ টেনে বললামÑ আপনি কি জানেন যে, আমি প্রচণ্ড অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্য দিয়ে দিনযাপন করছি! ২ মাস ধরে আমার কোন চাকরি নেই। আর এজন্য পিতা-মাতা-ভাই-বোন আমাকে জগতের সবচেয়ে অযোগ্য লোক ভাবে।

আলোকমানব বললেন, হাঁ জানি। তবে এটা কোন সমস্যাই না।

আমি অবাক হয়ে বললামÑ কি বলছেন এসব! এটা কোন সমস্যাই না!

আলোকমানব দৃঢ়তার সঙ্গেই বললেনÑ হাঁ। এটা কোন সমস্যাই না। কারণ, তোমার পরিবারের সদস্যদের জীবিকার ব্যবস্থা আছে। তোমাদের বাসস্থানের ব্যবস্থা আছে। পরিধানের জন্য যথেষ্ট কাপড় আছে। চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থও আছে। টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেল উপভোগের মাধ্যমে বিনোদনের ব্যবস্থাও আছে। ছেলেকে সাধারণভাবে শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থাও আছে। তাহলে বলো, তোমার অভাবটা কোথায়? তুমি তো মৌলিক চাহিদার সবকিছুই ভোগ করছ। কি করছ না?

আমি সরল স্বীকারোক্তিসূচক মাথা নাড়িয়ে বললামÑ কিন্তু আমার পিতা চায় না আমি উনার সম্পদ থেকে জীবিকা নির্বাহ করি। উনার কথা হচ্ছে, অন্যদের ছেলেরা মাসে ৪০/৫০ হাজার টাকা রোজগার করছে, আমিও তেমনটা করি। অন্যদের ছেলেরা যেমন আর্থিক যোগ্যতায় ৩/৪ তলা ভবন তৈরি করছে, আমিও তেমন করে আমাদের সেমিপাকা তথা টিনের চালের একতলা ঘরকে ৩/৪ তলা ভবনে রূপান্তর করি। অন্যরা যেভাবে এয়ারকন্ডিশনড রুমে বসবাস করছে, আমিও তেমনি তাকে এয়ারকন্ডিশনড রুমে বসবাসের ব্যবস্থা করে দেই। আমার স্ত্রী চায়, অন্য অভিভাবকেরা যেভাবে তাদের সন্তানকে অধিক অর্থব্যয়ে ভালো স্কুলে লেখাপড়া করায়, তেমনি আমিও সেই প্রতিযোগিতায় নামার জন্য অর্থ রোজগার করি। স্ত্রীকে প্রতি মাসে একসেট ভালো থ্রি পিস কিনে দেই। তাদের এমন চাওয়াগুলো আমি পূরণ করতে পারছি না বলে তারা আমাকে জগতের সবচেয়ে অযোগ্য লোক বলে ভাবছে। এ থেকে আমি মুক্তি পাব কি করে?

আলোকমানব বললেনÑ তাদের কোন কথাই গায়ে না মেখে।

Ñ গায়ে না মাখার মতো অবস্থা তো থাকে না। অনবরত কথায় কথায় মানসিক চাপ তৈরি করছে তারা।

Ñ তাদের এমন চাপ তৈরি করার কারণ হলো, তারা বোঝে না মানুষের জীবনের লক্ষ্য কি হওয়া উচিত। অর্থই মানুষকে শান্তি দেয়, একথাও পূর্ণ সত্য নয়। অনেক অর্থশালী নানা অশান্তিতে জীবনযাপন করছে। আর পৃথিবীতে অন্যের জীবনের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দেখে ঈর্ষান্বিত হলে নিজের মানসিক অশান্তিই বাড়ে। পৃথিবীতে অনেকক্ষেত্রে ভণ্ড, প্রতারক, জুলুমবাজরাই অর্থশালী হয়। আপাত দৃষ্টিতে তাদেরকে সুখী বলেও মনে হয়। কিন্তু এটা একটা ভ্রম। তাদের চেয়ে অনেক কম অর্থ-সম্পদের অধিকারীরাও জগতে শান্তির সাথে বসবাস করছে। আর শান্তির সাথে বসবাস করার মধ্যেই রয়েছে জীবনের স্বার্থকতা। তোমার পরিবারের কল্যাণের চাবিকাঠি তোমার পিতার কাছে রয়েছে। সেই সুবাদে তুমি নির্ভার সাংসারিক দায়িত্বপালন থেকে। এ সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে তুমি জগতের মানুষের কল্যাণে ভূমিকা রাখতে পারো। ভেবে দেখো, সাংসারিক দায়িত্ব পালনে তোমার মতো এতো নির্ভার কিন্তু তোমার অন্য বন্ধুরাও নেই। তারা সবাই সাংসারিক দায়িত্ব পালনে অর্থ রোজগারের পেরেশানিতে রয়েছে। তোমার কিন্তু সেই পেরেশানিটা অন্য অনেকের তুলনায় অনেক কম। যতটুকু পেরেশানি এক্ষেত্রে তোমার রয়েছে, তা ধর্তব্য নয়। তুমি এ পেরেশানি মাথায় না নিয়ে মানুষকে মনুষ্যত্বের পূর্ণ শিক্ষা প্রদানে সচেষ্ট হও। এ কাজে আমি তোমাকে পূর্ণ সহযোগিতা করব।

Ñ বলুন তবে আপনি কিভাবে আমাকে সহযোগিতা করতে পারেন?

Ñ তুমি যখন কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে, তার ভুল-শুদ্ধ-করণীয়-অকরণীয় বিষয়ে আমি তোমাকে জানাব, যদি তুমি আমার সহযোগিতা চাও।

Ñ বেশ! তাহলে এখন থেকে অমানুষের লেজ কেটে দিয়ে তাদেরকে যথার্থ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার শিক্ষা প্রদানে আমি পূর্ণ সচেষ্ট থাকব। মানুষ যথার্থ মানুষ হোকÑ অমানুষের মতো চিন্তা ও কাজ থেকে বিরত থাকুকÑ এমন পৃথিবী আমিও দেখতে চাই।

Ñ হাঁ। এমন কাজেই নিজেকে নিয়োজিত রাখো।

Ñ কিন্তু আমি কিভাবে এ কাজ করতে পারি?

Ñ বই লিখে। বই-ই মানুষকে সর্বকালে শিক্ষাদানের উত্তম উপায়।

Ñ কিন্তু বর্তমান আধুনিক যুগে সবাই টেলিভিশন কিংবা ইন্টারনেটে ডুবে আছে। বই পড়ার সময় ও ধৈর্য মানুষের এখন কোথায়!

Ñ তারপরও বই-ই মানুষকে শিক্ষাদান ও মানুষের শিক্ষালাভের উত্তম অবলম্বন।

Ñ কিন্তু বইয়ে মানুষকে শিক্ষা দিলেই মানুষ তা গ্রহণ করবে বলে মনে হয় না।

Ñ এমন কথা কেন বলছ?

Ñ মানুষের মধ্যে মুসলিমরা কোরআন-হাদিস থেকে যা শিখছে, তাকেই মনুষ্যত্বের উত্তম শিক্ষা বলে ভাবছে। হিন্দুরা বেদ পড়ে যা শিখছে, তাকেই মনুষ্যত্বের উত্তম শিক্ষা বলে ভাবছে। খ্রিস্টানরা বাইবেল পড়ে যা শিখছে, তাকেই মনুষ্যত্বের উত্তম শিক্ষা বলে ভাবছে। বৌদ্ধরা ত্রিপিটক পড়ে যা শিখছে, তাকেই মনুষ্যত্বের উত্তম শিক্ষা বলে ভাবছে। কিন্তু সকল সম্প্রদায়ের লোক অন্য ধর্ম সম্প্রদায়ের লোক থেকে নিজেকে কিছুটা হলেও আলাদা করে রাখছে। বিভাজনের একটা দেয়াল প্রতিটা সম্প্রদায়ের লোকের মধ্যেই যদি বিরাজিত থাকে, তবে মনুষ্য ধর্ম এতে অক্ষুণœ থাকল কোথায়? আবার বিভাজনের মাত্রা একটু বেড়ে গেলে তো এক সম্প্রদায়ের লোকেরা অন্য সম্প্রদায়ের লোকের রক্ত ঝরাতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। আবার রাজনীতি বা স্বার্থগত দ্বন্দ্বের কারণেও রক্তপাত ঘটছে প্রতিদিন। মানুষ হিং¯্র পশুর ন্যায় রক্ত ঝরাচ্ছে একে অন্যের। প্রচলিত ধর্মশিক্ষা দিয়ে তো পৃথিবীর মানুষেরা শান্তিপূর্ণ পৃথিবী গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু প্রচলিত ধর্মের বাইরে নতুন কোন ধর্মশিক্ষা প্রচারের চেষ্টা করলেও তা মানুষেরা গ্রহণ করবে না। কারণ, সকল সম্প্রদায়ের লোকই বিশ্বাস করে যে, আর কোন ধর্মশিক্ষা মানুষের জন্য আসবে না।

আলোকমানব এ কথার প্রতিবাদ জানিয়ে বললেনÑ শিক্ষার কোন শেষ নেই। মানুষেরা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মহামানবদের অনুসারী হলে জগতে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হতো। কিন্তু শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মহামানবদের অনুসৃত নীতিতে জীবনযাপন করছে না তাদের অনুসারী বলে দাবিদাররাই। অথচ তারা নিজেদেরকে মহামানবদের এমনই অন্ধ অনুসারী বলে জাহির করে যে, তাদের বিন্দুমাত্র সমালোচনা সইতে রাজী নয়। কিন্তু কাজে তাদের অধিকাংশই মহামানবদের বিরুদ্ধাচারী। যে কারণে জগতে শান্তির পরিবর্তে অশান্তির মাত্রাই বেড়ে যাচ্ছে। আর যখনই পৃথিবীতে অন্যায় ও জুলুম বেড়ে যায়, তখনই মনুষ্যত্বের শিক্ষা প্রচারে কাউকে না কাউকে দায়িত্ব নিতে হয়। আমি চাই, এ দায়িত্বটা তুমি নাও। ‘মানুষ হওয়াই মানুষের ধর্ম’ এই শিক্ষা প্রচারের মাধ্যমে মানুষকে ‘মানুষ’ নামের একই সম্প্রদায়ে সমবেত হতে আহ্বান জানিয়ে যাও তুমি। মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করে যাও যেÑ হিন্দু, মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ ইত্যাদি স¤প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পশুদের মতো একে অপরের রক্ত ঝরানোর খেলায় মেতে থাকা মানুষের জন্য শোভনীয় নয়। পৃথিবীর প্রথম মানবের বংশধর হিসেবে মানুষেরা প্রত্যেকেই একে অপরের আত্মার আত্মীয়। অতএব, হিন্দুত্ববোধ, মুসলমানিত্ববোধ, ইহুদিত্ববোধ, ক্রিশ্চিয়ানত্ববোধ, বৌদ্ধত্ববোধ, জৈনত্ববোধ ত্যাগ করে মনুষ্যত্ববোধে বলীয়ান হওয়ার শিক্ষা দিয়ে যাও মানুষকে। বিভেদ ও দলাদলি প্রভাবক ‘স¤প্রদায়গত পরিচয়ের’ বৃত্ত ভেঙে ‘মানুষ পরিচয়ে’ মানুষের কাতারে দলে দলে শামিল করার চেষ্টা করো সকলকেÑ যে পরিচয়টা মানুষের আসল পরিচয়। মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করো যে, মানুষ হিসেবে জন্ম নিয়ে নিজেকে ‘মানুষ’ বলে পরিচয় দেয়ার সাহস না করাটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় অধর্ম। আর ‘মানুষ’ বলে পরিচয় দেয়ার সাহস দেখানোটাই হচ্ছে প্রকৃত ধর্ম। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ভেদাভেদের কারণে মানুষ হত্যা বন্ধ ও অপরের প্রতি বিদ্বেষ পোষণের মনোভাব ত্যাগ করার শিক্ষা দিয়ে যাও। আজ আমি আবার আকাশে উঠে যাচ্ছি। তুমি স্মরণ করলে আবার পৃথিবীতে নেমে আসব। এই বলে আলোকমানব আকাশে উঠে গেলেন হাতের ইশারায় বিদায় নিয়ে। তার পর পরই আমার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙার পর শুয়ে শুয়েই ভাবছিলামÑ ঈসা (আ.) স্বপ্নে যে বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে গেছেন, তা বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন হবে। কিন্তু এ কঠিন কাজটিই আমি যাতে করি, সেজন্য উৎসাহ দিতে আরেক রাতে হযরত মোহাম্মদ (সা.)ও আমাকে স্বপ্নে দেখা দিলেন। সেই রাতের স্বপ্নের ঘটনাও আজো স্পষ্ট মনে আছে। হযরত মোহাম্মদ (সা.) আমার তুলনায় বেশ লম্বা এবং তাকে দেখতে বেশ সুন্দর লাগছিল। তিনি আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেনÑ ‘বর্তমান পৃথিবীর বেশিরভাগ মুসলিমই স্বার্থান্ধ ও নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। আর এদের হাত ও মুখ থেকে মানবজাতি নিরাপদ নয় বলে এরা কেউই আমার খাঁটি অনুসারী নয়। আপনি মানুষকে মনুষ্যত্বের শিক্ষা দিন।’

আমি হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর সামনেই দাঁড়িয়ে আছিÑ এমনটা বিশ্বাস করলেও তিনি বাংলায় কথা বলাতে কিছুটা সন্দিহান হয়ে পড়ি। হযরত মোহাম্মদের (সা.) ভাষা তো আরবি। তিনি বাংলা বলছেন কি করে?

আমার মনের কথা পড়ে নিয়ে হযরত মোহাম্মদ (সা.) বললেনÑ আমি এখন আলোকদেহে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াতে পারি। যেকোন অঞ্চলে কিছুদিন ঘুরে বেড়ালে সেই অঞ্চলের ভাষা শিখে নিতে পারি। অতএব, বাংলায় আপনার সাথে কথা বলাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তাছাড়া, আমি যে ভাষাতে কথা বললে আপনি বুঝবেন, সেই ভাষাতেই তো আমাকে কথা বলতে হবে। আমি তো তাদের মতো মূর্খ নইÑ যারা আরবি না বুঝেও আরবিতে কোরআন তেলাওয়াত করে যায় এবং নামাজ পড়ে ও পড়ায়। আমি আমার আরব এলাকার উম্মতদেরকে কোরআন পাঠ করার জন্য বলে এসেছি। অন্য ভাষাভাষি উম্মতেরা সেই নির্দেশমতো কোরআন পাঠ করতে হলে তাদের বোধগম্য ভাষাতেই অনুদিত কোরআন পাঠ করতে হবে। কোরআন পাঠ করে কোরআনে স্রষ্টা মানুষের উদ্দেশে কি কি বলেছেন, তা অনুধাবন করতে না পারলে, কোরআন পাঠের মূল্য কি? বাংলাদেশ এবং এ রকম যেসব দেশের লোকেরা আরবি না বুঝেই আরবিতে কোরআন তেলাওয়াত করছে, তারা তো নিজেদের মূর্খ স¤প্রদায় বলে প্রমাণ করছে।

হযরত মোহাম্মদের (সা.) মুখ থেকে এমন কথা শুনে আমি একটু অবাক হয়ে বললামÑ এমন কথা কেন বলছেন?

হযরত মোহাম্মদ (সা.) জবাবে বললেনÑ একে তো না বুঝেই কোরআন তেলাওয়াত করছে মুসলমানরা, তার ওপর এখন দেখছি মুসলিমদের আশি শতাংশই নানাভাবে মানুষকে ঠকাচ্ছে, মানুষের ওপর জুলুম করছে, অন্যায় করছে, আবার নামাজও পড়ছে। অনেকে আবার আমার প্রতি বেশি প্রেম দেখাতে মোবাইলে রিং টোন বা ওয়েলকাম টিউন সেট করেছেÑ ‘ও মদিনার বুলবুলি, তোমার নামের ফুল তুলি’, আর কর্মক্ষেত্রে আমার শিক্ষার বিপরীত কাজ করছে। অধীনস্থ কর্মচারীদের নানাভাবে ভোগাচ্ছে। শ্রমিকদেরকে ন্যায্য পারিশ্রমিক দিচ্ছে না। যে পারিশ্রমিক দিচ্ছে, তা পরিশোধ করতেও আরেক মাসের ১৬/১৭ তারিখ পার করছে। কেউ কেউ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী এবং পরিবহন ভাড়া, ঘর ভাড়া এমন বেশি করে আদায় করছেÑ যাতে মানুষের ওপর জুলুম করা হচ্ছে বহুগুণে-বহুমাত্রায়। আবার শেয়ার ব্যবসা, বীমা ব্যবসা, মাল্টিলেভেল মার্কেটিংয়ের নামে মানুষের সঙ্গে প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড হামেশাই চালিয়ে যাচ্ছে অনেকে। আরব এলাকায় যারা অর্থশালী আছে, তারা আবার আফ্রিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের দরিদ্রদের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন না করে একের পর এক বিবাহ করছে বা নারী সম্ভোগে ব্যস্ত আছে নানা কৌশলে। এরা সবাই আবার নামাজও আদায় করছেÑ অনেকে নিয়মিত না হলেও। এদের এসব নামাজে স্রষ্টা সন্তুষ্ট হচ্ছেন না। কারণ, মানুষকে যথার্থ মানুষ বানানোর শিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যেই নামাজের বিধান চালু করা হয়েছে। মানুষ যদি সব ধরনের পাপ কাজেই লিপ্ত থাকে, তবে নামাজ পড়ে ফায়দা কি? মানুষ স্রষ্টার নির্দেশ অমান্য করে অমানুষের মতো কাজ করবে, আর নামাজ পড়ার ক্ষেত্রেই কেবল স্রষ্টার নির্দেশ মানবে, এমন নামাজ দিয়ে তো সমাজের ক্ষতি ছাড়া মঙ্গল হচ্ছে না। অতএব, এমন নামাজের কোন মূল্যই নাই স্রষ্টার কাছে। ইদানীং আবার মসজিদে, মাজারে বোমা মেরে মানুষ হত্যাকাণ্ড চলছে। মুসলমানদের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ এতো কমে গেছে যে, আমি রীতিমতো ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ মুসলিমদের বেশির ভাগেরই ওপর। এক মণ দুধের মধ্যে ছাগলের ২ টুকরো মল পড়লে সব দুধ যেমন নষ্ট হয়ে যায়Ñ খাবার অনুপযোগী হয়ে পড়ে, তেমনি ইসলাম ধর্মকে নষ্ট করে ফেলেছে আমার মূর্খ অনুসারীরা। ইসলাম ধর্মকে তারা শান্তির বদলে অশান্তির ধর্ম বানিয়ে ফেলেছে। অতএব, মানুষের শান্তির জন্য আপনি যেভাবে মনুষ্যত্বের শিক্ষা প্রচার করতে চান, সেভাবেই করুন। মানুষের প্রতি, মানবজাতির প্রতি দায়িত্ব পালন শুরু করুন।

হযরত মোহাম্মদের (সা.) কথা শেষ হতেই আমার মধ্যে কেমন করে যেন একটা আত্মবিশ্বাস জেগে গেল যে, ইনিই হযরত মোহাম্মদ (সা.) এবং তিনি যা বলছেন, তার সবই সত্য। তার কথামতো মানুষকে মানুষ হবার শিক্ষা দিয়ে গড়ে তোলাই তো আমার প্রধান কাজ। এ দায়িত্ব আমাকে পালন করতেই হবে। মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ‘মানুষ হওয়াই মানুষের ধর্ম’Ñ এই শিক্ষাটা সকলের প্রজ্ঞায় প্রবেশ করাতে হবে। এই উপলদ্ধি আমার প্রজ্ঞায় জাগ্রত হতেই আমি হযরত মোহাম্মদের (সা.) সঙ্গে করমর্দন করলাম। তার হাতের পাতা আমার দুই হাতের পাতার মধ্যে ধরে প্রতিজ্ঞা করার ভঙ্গিতে বললামÑ ‘আপনাকে আমি কথা দিলাম, মনুষ্যত্বের শিক্ষা আমি পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেব।’

আমার কথা শেষ হতেই হযরত মোহাম্মদ (সা.) বিদায় নিলেন। সেইসঙ্গে আমার ঘুমও ভেঙে গেল। কিন্তু ঘুম ভাঙার পরও হাতে হযরত মোহাম্মদের (সা.) হস্তস্পর্শের অনুভূতি রয়েই গেল অনেকক্ষণ ধরে। আর ‘মানুষ হওয়াই মানুষের ধর্ম’Ñ এই শিক্ষাটা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার প্রতিজ্ঞার কথা আমার ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনায় এমনভাবে সক্রিয় রয়ে গেল যে, শেষ পর্যন্ত হযরত মোহাম্মদের (সা.) পরামর্শ মোতাবেক মানুষের জন্য যথার্থ ধর্মশিক্ষা কি হওয়া উচিত তা নিয়ে ভাবতে শুরু করি। আমি বিশ্বাস করি, মানুষকে মানুষ হতে হবে নৈতিক দায়বদ্ধতায়Ñ বেহেশতের লোভ কিংবা দোজখের ভয়ে নয়। তাহলেই কেবল একজন মানুষ নিজেকে যথার্থ মানুষ বলে দাবি করতে পারে। আর যে বেহেশতের লোভ কিংবা দোজখের ভয়ে সৎ পথে চলে, সে যথার্থ মানুষ বলে বিবেচিত হতে পারে না। কেননা, সে বেহেশতের লোভ কিংবা দোজখের ভয় দ্বারা প্রভাবিত, নিজস্ব নীতিবোধ দ্বারা প্রভাবিত নয়। আর যে নিজস্ব নীতিবোধ দ্বারা প্রভাবিত নয়, সেতো নীতিবোধশূন্য ব্যক্তিÑ ধর্মীয় গুরুর বা স্বধর্মের কারো অন্যায় নির্দেশে তার দ্বারা মানুষ হত্যাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডও সংঘটিত হতে পারে, যেমনটা ঘটছে এখন ইসলামি জঙ্গিদের দ্বারা। এছাড়া আরো একটি বিষয় বর্তমানে লক্ষণীয়Ñ ধর্মগুলো মানুষকে নৈতিকতা শেখানোর জন্য অতীতে যতটুকু অবদান রেখেছে, তার চেয়েও বেশি নীতিবোধশূন্য ও বিবেকশূন্য করে দিচ্ছে এখন। রোজা এলে দ্রব্যমূল্য কমার পরিবর্তে বেড়ে যায়। কোরবানি এলে পশুর দামসহ রান্নার নানা উপকরণের দামও বেড়ে যায়। হজ্ব বা তীর্থযাত্রাজাতীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যাতায়াতের জন্য পরিবহন ভাড়া বেড়ে যায়। ঈদ এলে পোশাকের দাম বেড়ে যায়। ধর্মাচারকে মানুষ বেশি প্রাধান্য দেয়াতে একশ্রেণীর লোক তা নিয়ে অতি বাণিজ্যে মেতে উঠেছে। এছাড়া মানুষের নিত্যদিনকার প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী নিয়েও বাণিজ্য চলছে হরদম। লবণ ব্যবসায়ী সমিতি, মাছ ব্যবসায়ী সমিতি, মাংস ব্যবসায়ী সমিতি, চাল ব্যবসায়ী সমিতি, চিনি ব্যবসায়ী সমিতি, কাগজ ব্যবসায়ী সমিতি, পোশাক বিক্রেতা ব্যবসায়ী সমিতির ছত্রছায়ায় সিন্ডিকেট করে অতি মুনাফা আদায়ের প্রবণতা সর্বত্রই কমবেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এমনকি বাস, টেক্সি, টেম্পু. রিকশা, অটো রিকশা মালিক ও চালক সমিতির ছত্রছায়ায় বেশি ভাড়া আদায়ের ঘটনাও ঘটছে অহরহ। মানুষের নিত্যদিনের জীবিকা অর্জন ও প্রয়োজনীয় অর্থের চেয়ে অতি মাত্রায় অর্থ রোজগারের প্রবণতা আজ সমাজের সর্বস্তরে পরিলক্ষিত হচ্ছে। পণ্য উৎপাদন ও বিক্রি করে পঞ্চাশ থেকে শতভাগÑ এমনকি দুইশতভাগ মুনাফা করার প্রবণতাও পরিলক্ষিত হচ্ছে। শতভাগ মুনাফা করে মানুষের ওপর জুলুম যারা করছেন, তারা আড়াই শতাংশ অর্থ জাকাত দিলে তাতে ধর্মের কতটুকু মূল্যায়ন করা হয়? ধর্ম কি বলে যে, শতভাগ মুনাফা করে আড়াই শতাংশ অর্থ জাকাত দিলে সকল জুলুম জায়েজ হয়ে যায়? নিশ্চয়ই ধর্ম এটা অনুমোদন করে না। অতি মুনাফা না করার জন্য ধর্মে স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু বর্তমান যুগে মানুষের লোভ-লালসা সীমাহীন হয়ে পড়েছে। যথার্থ ধর্মশিক্ষা মানুষ অন্তরে ও মস্তিষ্কে ধারণ করছে না। যে কারণে নৈতিকতাহীন হয়ে পড়েছে বর্তমান সমাজ। ক্ষেত্রবিশেষে আজ আস্তিকদের চেয়ে নাস্তিকদের নৈতিকতাবোধ অনেক মজবুত। এটা কি নবীদের অযোগ্যতা? নাকি আল্ল¬াহ বা ঈশ্বর তথা স্রষ্টার ব্যর্থতা? নাকি নবীদের উম্মতদের ধর্মকে অনুধাবনের ব্যর্থতার পরিণাম? স্বীয় নীতিবোধকে জাগ্রত করে যথার্থ মানুষ হওয়ার সাধনা নাস্তিকরা যেভাবে করছে, নবীদের উম্মতদের মধ্যে তেমন ব্রত বা সাধনা করার বিষয়টি তুলনামূলক কমই পরিলক্ষিত হয়। নবীদের উম্মতরা তাহলে নিজেদেরকে নাস্তিকদের চেয়ে উত্তম বলে দাবি করবেন কোন যুক্তিতে? নবীদের উম্মতদেরকে স্রষ্টা তাঁর অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়ে স্রষ্টার প্রতি অন্তরে ভয় রেখে সৎ কর্ম করার তাগিদ দিয়েছেন। আর যারা সৎ কর্ম করবে না, তাদেরকে দোজখের শক্তিশালী আগুন দ্বারা শাস্তি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে যে, আস্তিকরা অনেকেই স্রষ্টার এই মূল নির্দেশ না মেনে জুলুম, অন্যায় করে স্রষ্টাকে বৃদ্ধাঙ্গুলিই দেখিয়ে চলেছেন। আবার ধর্মাচার পালন করে তারা স্রষ্টার বাধ্যÑ এমনটা প্রমাণের চেষ্টা করছেন। এটা মূর্খতারই নামান্তর। নীতিবোধ তথা মনুষ্যত্ববোধ যাদের মধ্যে নেইÑ গীতা, বেদ, ইঞ্জিল, তাওরাত, যবুর, কোরআন পড়া তাদের জন্য অর্থহীন। এসব গ্রন্থ পড়ে নিজেদের নীতিবোধকে যদি তারা মজবুত ও উন্নত করতে ব্যর্থ হয়, তবে তাদের এ রকম ধর্মশিক্ষার মূল্য কী? ইহুদি, খ্রিস্টান, হিন্দু, মুসলিমসহ আস্তিকদের এটা ভেবে দেখার বিষয় বৈকি; যদিও আস্তিকরা এসব ভেবে দেখার চিন্তাও করে না। বস্তুবাদী চিন্তা নিয়েই আজ বেশি ব্যস্ত আস্তিকরা। এ রকম আস্তিকদের চেয়ে নীতিবোধসম্পন্ন নাস্তিকরা অনেক উত্তম মানুষ। মানুষের যদি এই বিবেকবোধ না থাকে যেÑ কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায়; কী কাজ করা উচিত, কী কাজ করা অনুচিত; তবে সে নিজেকে মানুষ বলে দাবি করার যোগ্যতা রাখে কোথায়? আজ ধর্মীয় নির্দেশের ধোয়া তুলে নিরীহ মানুষ হত্যাযজ্ঞ চলছে। ধর্ম অমানুষ বা বর্বরদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলা সমর্থন করলেও নিরীহ মানুষ হত্যাযজ্ঞ সমর্থন করে না। জেহাদের নামে যারা নিরীহ মানুষকে বোমার আঘাতে হত্যার চেষ্টা করছে, শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দলের সদস্যদের যারা হত্যার চেষ্টা করেছে, তারা কোনো বিচারেই ধর্মীয় নির্দেশ পালনকারী নয়। এ জাতীয় জেহাদীরা বরং ধর্মের শত্র“, মানবতার শত্র“। স্রষ্টার বিচারেও পরবর্তী জীবনে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হবে তারা। নিরীহ ব্যক্তিদের হত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা পরবর্তী জীবনে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হবেÑ এটাই ধর্মের মূলকথা। অমানুষ কোনো ধর্মীয় বিচারেই যথার্থ ধার্মিক নয়। কেবল মানুষই ধর্মীয় বিচারে যথার্থ ধার্মিক। অতএব, নিজস্ব নীতিবোধকে জাগ্রত করে মানুষ হওয়ার সাধনা করাই মানুষের জন্য উত্তম। মানুষেরা বুঝতে চাইলে বুঝতে পারবে যে, বেহেশতের লোভ ও দোজখের ভয়ে মানুষ হওয়ার চেয়ে নিজস্ব নীতিবোধ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যারা মানুষ হয়, তাদের চেয়ে উত্তম মানুষ অন্যরা হতে পারে না। আর মানুষ হওয়াই মানুষের জন্য যথার্থ শিক্ষা। অমানুষ হওয়ার শিক্ষা কুশিক্ষা ছাড়া কিছু নয়।

মানুষের জন্য ধর্মীয় মূলশিক্ষা অবশ্যই হতে হবেÑ ‘মানুষ হওয়াই মানুষের ধর্ম, অমানুষ হওয়া পশুর কর্ম। মানুষ হলে তার জন্য পরবর্তী জীবনে শান্তিময় জীবন লাভ নিশ্চিত, অমানুষ হলে তাকে অবশ্যই যন্ত্রণাময় জীবনই ভোগ করতে হবে পরবর্তীকালে।’ সে কারণে অমানুষ হওয়া থেকে রেহাই পেতে সকল ধরনের পাপ কাজ এড়িয়ে চলবে উত্তম ধর্মানুসারীরা। আর অন্যের দ্বারা ‘অমানুষ’ বিবেচিত হতে হয়Ñ এমন সকল কাজ এড়িয়ে চলবে সব সময়। পাপী না হওয়াই পরবর্তী জীবনে শান্তিলাভের প্রধান শর্তÑ এ কথাটি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে নিয়ে সকল প্রকার পাপের পথ পরিহার করে চলবে উত্তম ধর্মানুসারীরা। আর যারা পাপী হবার মানসিকতা পরিহার করে চলবে, তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ধার্মিক অন্য ধর্মানুসারীরা কিছুতেই হতে পারে না। এজন্য যেকোনো মূল্যে নিজেকে সৎ ও চরিত্রবান রাখার এবং মানবকল্যাণে কাজ করে যাবার চিন্তাটা সব সময়ই মনের মধ্যে ও মাথায় রাখবে উত্তম ধর্মানুসারীরা। এ শিক্ষাটি সব সময়ই নিজেদের মস্তিষ্কে ধারণ করবে যে, যারা মানুষকে বিভিন্নভাবে ঠকায় ও ভোগায়, তারা পরবর্তী জীবনে সুখ-শান্তি পাবে না এবং ইহজীবনেও তারা অমানুষ বলেই বিবেচিত হবে। পরবর্তী জীবনে সুখ-শান্তি পাবার দাবিদার হবার জন্য কখনোই মানুষকে ঠকাতে ও ভোগাতে সচেষ্ট হবে না উত্তম ধর্মানুসারীরা। উত্তম ধর্মানুসারীরা সৎ ও পরোপকারী হওয়ার পাশাপাশি অপরের ক্ষতি করা থেকে নিজেদেরকে যেকোনো মূল্যে বিরত রাখতে সচেষ্ট থাকবে সব সময়। স্বার্থবাদিতা, হিংসা-হানাহানি, জুলুম, অন্যের সম্পদ জবরদখল, ব্যভিচার, নারী বা শিশু ধর্ষণ, পরকীয়া প্রেম, মানুষের সঙ্গে প্রতারণার মাধ্যমে নিজের সুখ-শান্তি-ভোগ-বিলাস নিশ্চিত করতে কখনোই সচেষ্ট হবে না উত্তম মানুষ হতে আগ্রহীরা। উত্তম ধর্মের অনুসারীরা এই জ্ঞানও রাখবে যেÑ জনসেবার চেয়ে বাণিজ্যিক মনমানসিকতা নিয়ে রোগীদের ওপর জুলুম করে যে ডাক্তার, সে অমানুষের কাতারভুক্ত এবং নিজেকে ধার্মিক বলে দাবি করার যোগ্যতা তার নেই; যে রিকশাচালক বা টেক্সিচালক বা পরিবহন ব্যবসায়ী বা ঘরের মালিক মানুষের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে, সে অমানুষের কাতারভুক্ত এবং নিজেকে ধার্মিক বলে দাবি করার যোগ্যতা তার নেই; যে ছেলে বা পুরুষ একাধিক মেয়ে বা নারীর সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে কিংবা প্রতারণা করে, সে অমানুষের কাতারভুক্ত এবং নিজেকে ধার্মিক বলে দাবি করার যোগ্যতা তার নেই; যে পুরুষ বা নারী ব্যভিচারে লিপ্ত হচ্ছে, সে অমানুষের কাতারভুক্ত এবং নিজেকে ধার্মিক বলে দাবি করার যোগ্যতা তার নেই; যে পুলিশ বা বিচারক নিরপরাধ ব্যক্তিকে আসামি করে তাকে ভোগাচ্ছে, সে অমানুষের কাতারভুক্ত এবং নিজেকে ধার্মিক বলে দাবি করার যোগ্যতা তার নেই; যে রাজনীতিবিদ স্বীয় বা দলীয় স্বার্থে অন্যের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করে, সে অমানুষের কাতারভুক্ত এবং নিজেকে ধার্মিক বলে দাবি করার যোগ্যতা তার নেই; যে ব্যক্তি বা শিক্ষক জ্ঞান প্রদান বিষয়েও অতি বাণিজ্য করে, সে অমানুষের কাতারভুক্ত এবং নিজেকে ধার্মিক বলে দাবি করার যোগ্যতা তার নেই। উত্তম ধর্মের অনুসারীরা এই জ্ঞানও রাখবে যে, পাপী বা অমানুষ কখনোই উত্তম ধর্মের অনুসারী বলে বিবেচিত হবে না। কেবল পুণ্যবান ও যথার্থ মানুষই উত্তম ধর্মের অনুসারী বলে বিবেচিত হবে। সংসারের কর্তা মারা গেলে সম্পত্তির বণ্টন করে পরিবারের সদস্যরা পৃথক হয়ে যাওয়া উত্তম ধর্ম সমর্থন করে না। তবে বিশেষ কারণে সম্পত্তির বণ্টন যদি করতেই হয় তবে ভাইবোনের মধ্যে কার কতটুকু পাওয়া উচিত বা দরকার, তা সমঝোতার সাথে বণ্টন করলেই ভালো। সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে কাউকে ঠকালে কিংবা কারো ওপর জুলুম করলে সে তো তার পরবর্তী জীবনের শান্তিকে অনিশ্চিত করে দেবে। উত্তম ধর্মের অনুসারীরা বুঝবে যে, মানুষের জন্য কোনো আইনের প্রয়োজন হয় নাÑ অমানুষের জন্যই আইনের প্রয়োজন হয়। উত্তম ধর্মের অনুসারীরা আইনের ওপর ভিত্তি না করে মনুষ্যত্ববোধের ওপর ভিত্তি করেই জীবনযাপন করবে। উত্তম ধর্মের অনুসারীরা বুঝবে যে, মানুষের প্রাণ স্রষ্টার কাছে এবং তার প্রিয়জনের কাছেও খুবই মূল্যবান। অতএব, ধর্ম নিয়ে বাক-বিতণ্ডা করা বা ধর্মের নামে কাউকে হত্যা করা অমানুষেরই কাজ। এমন অমানুষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে সে আর উত্তম ধর্মের অনুসারী বলে বিবেচিত হবে না। আর যারা উত্তম ধর্মের অনুসারী বলে বিবেচিত হবে না স্রষ্টার কাছে, তাদের পরবর্তী জীবনে সুখ-শান্তি প্রাপ্তি অনিশ্চিত। মোদ্দাকথায়Ñ নীতিই ধর্ম, দুর্নীতি অধর্ম; সততাই ধর্ম, অসততা অধর্ম; সত্যবাদিতাই ধর্ম, মিথ্যেবাদিতা অধর্ম; নির্লোভ থাকাই ধর্ম, লোলুপতা অধর্ম; অপরের কল্যাণ করাই ধর্ম, স্বার্থবাদিতা বা কারো ক্ষতি করার চেষ্টা অধর্ম; সুবিচার করাই ধর্ম, অবিচার বা কারো প্রতি জুলুম করা অধর্ম; ন্যায়পরায়ণতাই ধর্ম, অন্যায় করা অধর্ম; চরিত্রবান থাকাই ধর্ম, ধর্ষণ-ব্যভিচার করা অধর্ম; অল্প মুনাফা করাই ধর্ম, অতি মুনাফা করার চেষ্টা অধর্ম; যানবাহন ও বাসাবাড়ির ভাড়া ন্যায়সঙ্গতভাবে নেয়াই ধর্ম, বেশি নেয়ার চেষ্টা করা অধর্ম; ধূমপান-গাঁজা সেবন-মদ্য পান থেকে বিরত থাকাই ধর্ম, এসব বদভ্যাস অধর্ম; ইত্যাদি শিক্ষাগুলো গ্রহণ করে নিয়ে যারা স্বীয় আত্মাকে সার্বিকভাবে বিশুদ্ধ আত্মায় পরিণত করতে সক্ষম হবে এবং রক্তপাতমুক্ত শান্তিপূর্ণ পৃথিবী গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখবে, তারাই উত্তম ধর্মের অনুসারী বলে বিবেচিত হবে। আর এদেরকে পরবর্তী জীবনে সর্বাপেক্ষা শান্তিময় আবাসস্থল লাভের ব্যাপারে কোনোপ্রকার দুশ্চিন্তা করতে হবে না।



























পাঁচ



চাকরি-বাকরি লেখালেখির পথে একটা বড় বাধাই বলতে হবে। ভোরে ঘুম থেকে উঠে অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়া, এরপর যানবাহনে চড়ার প্রতিযোগিতায় নেমে সময়মতো কর্মস্থলে পৌঁছানো, তারপর সারাদিনÑ কখনো কখনো রাতের ৮/৯ টা পর্যন্ত নানা কাজের চাপ সামলে ঘরে ফিরে লেখার সুযোগ কোথায়? সরকারি চাকরিজীবীদের অবশ্য অনেক অবসর থাকে। তাই বোধ হয়, হাসনাত আবদুল হাইসহ সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে যাদের লেখালেখির নেশা আছে, তারা বেশ এগিয়ে গেছেন ব যাচ্ছেন। কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির ওপরই জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে বলে নেশা থাকলেও লেখালেখিটা সেভাবে হয়ে ওঠে না। সারাদিনের ঝক্কি-ঝামেলা শেষে কলম ধরার ইচ্ছাটা আর জাগে না। সম্ভবত এ কারণেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তুলনায় কাজী নজরুল ইসলাম লেখালেখিতে অনেকটাই পিছিয়ে ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় তাকে জীবিকা নিয়ে সেভাবে ভাবতে হতে না, যেভাবে কাজী নজরুল ইসলামকে ভাবতে হয়েছে। এজন্য সংখ্যাগত দিক থেকে হলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তুলনায় কাজী নজরুল ইসলাম লেখালেখিতে অনেক পিছিয়ে গেছেন। আমি কাজী নজরুল ইসলামের তুলনায় শব্দচয়ন ও বাক্যগঠনে খুবই দুর্বল। তবে দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহভাবÑ এই দু কারণে কাজী নজরুল ইসলামের চেয়ে অনেক বেশি পেশায় কাজ করতে হয়েছে আমাকে। বছরে দু-চারবার পেশাবদল করার ঘটনা ঘটেছে ২৩ বছরের কর্মজীবনে বহুবার। আর বেকার সময়ও কেটেছে সেই সূত্র ধরে বছরে অন্তত ৪০/৫০ দিন করে। আমার লেখালেখি মূলত এই ৪০/৫০ দিনের মধ্যেই কিছু প্রবন্ধ/নিবন্ধ/গল্প/উপন্যাস যখন যা লিখতে মন চায়। এ রকমই এক বেকার জীবনের ৪৭তম দিনের ঘটনা। দিনটি হচ্ছে ২০১২ সালের ১৬ নভেম্বর। এ দিনের সকলটা শুরু হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের প্রথম টেস্টের চতুর্থ দিনের খেলা উপভোগের মাধ্যমে। মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত এ টেস্টের ১ম ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের করা ৪ উইকেটে ৫২৭ রানের পর বাংলাদেশ দল ব্যাটিং শুরু করে তৃতীয় দিন শেষে ৬ উইকেটে ৪৫৫ রান করেছিল। চতুর্থ দিনে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আগের করা ৪৮৮ রান ডিঙ্গিয়ে এক পর্যায়ে ৫০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করার পর ৫৫৬ রানে গিয়ে থামে বাংলাদেশের ইনিংস। এতে বাংলাদেশ ২৯ রানের লিড পায় ১ম ইনিংসে। তবে এই আনন্দের মাঝেও মনটাতে একটা কষ্ট, কিছু আফসোস জমে গেল নাসির হোসেনের জন্য। মাত্র ৪ রানের জন্য সেঞ্চুরি মিস করেছেন তিনি। ৯৬ রানে পৌঁছানোর পর টিনো বেস্টের বলে ¯ি¬পে ক্রিস গেইলের তালুবন্দি হয়ে যবনিকা ঘটে নাসির হোসেনের ইনিংসের। ধারাভাষ্যকার আতাহার আলীর এ সময়ের উচ্চারণÑ ‘আই ফেল্ট ভেরি সরি ফর হিম’ আমার হৃদয়ের দুঃখবোধকে যেন আরো বাড়িয়ে দিল। কিন্তু নাসির হোসেনের দুঃখটা এ সময়ে নিশ্চয় দেশের সবার চেয়ে বেশি ছিল। মাত্র ৪ রানের জন্য জীবনের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিটা হলো না! সেই দুঃখটা তিনি তার প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি না পাওয়া পর্যন্ত অন্তরে বয়ে বেড়াবেন, এটা নিশ্চিত। তবে মিরপুর টেস্টের চতুর্থ দিনশেষে অনেক দর্শকের মন থেকে সেই দুঃখবোধ কমে গিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের ২য় ইনিংসে বাংলাদেশি বোলাররা ৬ উইকেট শিকার করে নেয়ায়। যদিও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইতিমধ্যে কিয়েরন পাওয়েলের টানা ২য় সেঞ্চুরিতে ২১৫ রানের লিড পেয়ে গিয়েছিল। ৫ম দিনে দ্রুত ৪ উইকেট তুলে নিতে পারলে বাংলাদেশের সামনে টেস্ট জয়ের সুযোগও চলে আসতে পারেÑ এমন একটা সম্ভাবনা ও আশার কথা যখন ভাবছিলাম, তখনই বন্ধু কামরুল ইসলামের ফোন এলো। তার ফোন পেয়ে ঘর থেকে বের হলাম। রাত ১১টার বাসে চড়ে সে ঢাকা যাবে কর্মস্থলে। তাই পরিচিতজনদের সাথে দেখা করে একমাসের জন্য বিদায় নেয়ার অভিপ্রায়ে আমাকে সঙ্গী হিসেবে তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য আহ্বান রেখেছিল সে। তার সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বেশ কিছু সময় বাইরে কাটিয়ে রাত প্রায় সাড়ে ৮টার সময় ঘরে ফিরে এলাম। চট্টগ্রামের হালিশহর হাউজিং এস্টেটের এ ব্লকে পৈত্রিক ঘরে বসবাস আমার। আজকের মতো ঘরের বাইরে আর কাজ নেই, এবার লিখতে বসবÑ এমনটা ভেবে ঘরের দরজায় পা রাখতেই কানে এলো সামনের ঘর থেকে মহিলাদের চিৎকারÑ সাপ! সাপ! সাপ ঢুকেছে ঘরে। মহিলাদের একজন এ সময় গলা চড়িয়ে বললÑ ঘরে কোন পুরুষ নেই সাপ মারার জন্য, কেউ কি আসবেন! মহিলার এমন আওয়াজে তাদের সহায়তার জন্য এগিয়ে যাওয়া উচিত বলে মনে করলাম। ঘরের গেটে পৌঁছতেই পাশের সেলুন থেকে ক্ষৌরকার নেপাল শীলও ঢুকল। কিন্তু কার্তিক পূজার মাসে সাপ মারা ঠিক হবে নাÑ এমন মন্তব্য করে তিনি পিছিয়ে গেলেন। আমি তখন ঘরের সামনের বাগান থেকে প্রায় দেড় ফুট লম্বা একটা কাঠ কুড়িয়ে নিলাম। ওটা দিয়ে সাপের ওপর চড়াও হতে মনস্থির করলাম। য বিষাক্ত, যার দ্বারা কোন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা আছে, তাকে বাঁচিয়ে রাখাটা নির্বুদ্ধিতাÑ এমনই আমার জীবনদর্শন। মানুষের জন্য ক্ষতিকর পিঁপড়া-মশা থেকে শুরু করে বিষাক্ত সাপ কাউকেই রেহাই দেয়ার পক্ষপাতী নই আমি। এজন্যই সন্ত্রাসীর সঙ্গে পুলিশের বন্দুকযুদ্ধে বা র‌্যাবের ক্রশফায়ারে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী নির্মূল করার অভিযানকে পুরোপুরি সমর্থন করি আমি। যাদেরকে প্রচলিত আইনের বিচারে যথার্থ শাস্তি দেয়ার উপায় থাকে নাÑ তাদের বিরুদ্ধে সাহস করে কেউ সাক্ষ্য দিতে চায় না বলে, এমন অপরাধীদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে কৌশলেই নির্মূল করুকÑ তা মানবতার বিবেচনায় অত্যাবশ্যকীয়। এমন বিষধর প্রাণীদের বাঁচিয়ে রাখার পক্ষপাতী নই আমি। কারো দেহ হিং¯্র পশুদেহে রূপ নিলে রাষ্ট্রের উচিত তাকে কোরবানি দেয়াÑ এমনটাই আমার ব্যক্তিগত মত। কোন বিষধর প্রাণীকেই বাঁচিয়ে রাখার পক্ষপাতী নই আমি। কিন্তু কাঠের লাঠি হাতে যে সাপকে মারতে এগিয়ে গেলাম, তাকে মারার কোন উপায় দেখছি না। কারণ, সাপটি কক্ষের ভেতরে। আর কক্ষটি ভেতর থেকে আটকানো। আর বন্ধ কক্ষের ভেতরে এক নারী সর্পদংশনের ভয়ে কাঁদছে। খেয়াল করে দেখলাম কক্ষের জানালা খোলা। তাই জানালা দিয়ে ভেতরের অবস্থা পর্যবেক্ষণের চেষ্টা করলাম। দেখলামÑ ১৯/২০ বছর বয়সী এক তরুণী জড়োশড়ো হয়ে একটা খাটের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। ভয়ে সে এতটাই জ্ঞানহারা যে, খাটের ওপরে উঠতে পর্যন্ত ভুলে গেছে। আমি তাকে কিছুটা সাহসী করে তুলতে তার দিকে আমার হাতে থাকা লাঠিটা বাড়িয়ে দিলাম। সে একটু এগিয়ে যে নেবে, সেই সাহসও করছিল না। আমি তখন বললামÑ লাঠিটা ধরুন, সাপ আপনার দিকে এগিয়ে এলে লাঠি দিয়ে মারতে পারবেন। সে এবার এককদম এগিয়ে এসে লাঠিটা আমার হাত থেকে নিল। আমি এরপর জিজ্ঞেস করলামÑ সাপটা এখন কোথায় আছে? সে বললÑ দরজার সামনে একটা কাপড় আছে তার নিচে।

আমি বললাম কাপড়ের নিচে যেহেতু আছে, সেহেতু সাহস করে কাপড়ের ওপরে জোরে একটা বাড়ি মারতে পারবেন।

মেয়েটি ভয়ে যেন আঁৎকে উঠলÑ না ...

আমি বললাম, তাহলে আপনি পেছনে সরে বিছানায় উঠে বসুন। আমি একে বের করার কিছু একটা বুদ্ধি করছি। আমার মাথায় তখনই এলোÑ কার্বলিক এসিড ঘরে রাখলে সাপ সাধারণত সেই ঘরে ঢোকে না। অতএব, কার্বলিক এসিড নিয়ে এলে সাপটি তার অবস্থান থেকে অন্যত্র সরে যাবার চেষ্টা করবে। তখন যদি সাপটি ঘরের বাইরে আসে, তাকে মারা সহজ হবে। এই চিন্তা মাথায় এলে আমি জানালার বাইরে থাকা দুই মহিলাকে বললামÑ আপনারা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে উনাকে সাহস জোগান, আমি আসছি। এই বলে আমি দ্রুত ফার্মেসিতে গিয়ে কার্বলিক এসিড চাইলাম। বিক্রেতা চঐঊঘঙখ নামে কার্বলিক এসিডের একটা শিশি দিল। ৫০ টাকা পরিশোধ করে তার কাছ থেকে মাটিতে পড়ে থাকা একটা সুতলী চেয়ে নিলাম। ফার্মেসি থেকে ফেরার পথে বোতলের মুখের কাছে সুতলী ভালো করে বেঁধে নিলাম, যাতে জানালার লোহার শিকের সাথে বোতলটি বেঁধে দিতে পারি। সাপ থাকা সেই কক্ষের কাছে ফিরতে ফিরতে দেখি আশপাশের ভাড়াটিয়াদের মধ্যে বেশ কিছু শিশু-কিশোর বাহিরে থাকা দুই মহিলার সাথে মিলিত হয়ে ভেতরের মহিলাকে দেখছে। দুই কিশোর ইতিমধ্যে কাঠের আরো ২টি লাঠি খুঁজে নিয়েছে। আমি কক্ষের কাছে গিয়ে মহিলাদের শিশুসহ মূল গেটের বাইরে যেতে বললাম। কক্ষের মহিলাকে বললাম, আপনি পেছনে সরে বিছানায় উঠে বসুন। বোতলের মুখ খোলার সাথে সাথে সাপটি যেকোন দিকে যেতে পারে। আপনি ভেতর থেকে শুধু লক্ষ রাখবেন সাপটি কোনদিকে যায়। লাঠি হাতে থাকা দুই কিশোরকে দরজার দুইপাশে নজর রাখার কথা বলে বোতলটি জানালার লোহার শিকের সাথে বেঁধেই বোতলের মুখ খুলে দিলাম। এরপর মহিলাকে জিজ্ঞেস করলামÑ সাপটি কোনদিকে যাচ্ছে? মহিলা জবাবে বললÑ সাপতো আগের জায়গায় নাই। একটু আগেও কাপড়ের নিচে সাপের শরীর দেখা যাচ্ছিল, এখন দেখছি না। মহিলা সম্ভবত বোতলের মুখ খোলার সময় আমার হাতের দিকেই তাকিয়েছিল, এই ফাঁকে সাপ গায়েব! দরজার নিচে কিছু অংশ ফাঁকা আছে, যাতে করে পাপস হিসেবে ব্যবহৃত কাপড়টিকে এবার আমি নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করলাম বাহির থেকে। কিন্তু সাপের অস্তিত্ব দেখা গেল না। মহিলাকে তাই বললামÑ এবার আপনি দরজা খুলুন, আমরা ভেতরে গিয়ে সাপ খুঁজি। মহিলা এবার সাহস করে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। এরপর মোবাইলে থাকা টর্চ জ্বালিয়ে দরজার নিচে ছায়া পড়া জায়গায় ভাল করে লক্ষ করে দেখলাম দুটো ছোট গর্ত দেখা যাচ্ছে। সাপটি কার্বলিক এসিডের গন্ধ পেয়ে দ্রুত কোন গর্তে ঢুকে যেতে পারেÑ এমন চিন্তায় বাহিরে থাকা মহিলাকে বললামÑ তাড়াতাড়ি চুলায় পানি ফুটান। ফুটন্ত গরম পানি এ দুই গর্তে ঢাললে সাপ বেরিয়ে আসবে। এই ফর্মুলা কাজে লাগিয়ে শেষ পর্যন্ত সাপটিকে বের করে তার মৃত্যু নিশ্চিত করি আমি। ইতিমধ্যে কক্ষে আটকা পড়া সেই মহিলার স্বামী ঘরে ফিরে সাপটি দেখে বললÑ এটাতো ঘরপরী সাপ। এই সাপ সাধারণত আঘাত না পেলে কাউকে কামড়ায় না। প্রায় ঘরেই এই সাপ থাকে। এটা মানুষের জীবনের জন্য ততটা ঝুঁকিপূর্ণ না। তার হাবভাব এমন যে, এই সাপটা না মারলেও চলত। কিন্তু যে সাপ মহিলাদের কাছে ভীষণ আতঙ্কের কারণ, সেই সাপকে বাঁচিয়ে রাখার মতো কোন যুক্তি খুঁজে পাই না আমি। নারী-পুরুষ যে কারোরই শান্তিপূর্ণ জীবনের ক্ষেত্রে যা অন্তরায় এবং আতঙ্ক ছড়ায়, হোক তা তেলাপোকাÑ তাকে নির্মূল করে দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজÑ এমনটাই আমার দর্শন। ‘জীবহত্যা মহাপাপ’ এমন দর্শন সমর্থন এবং মাসের বিচার করে সাপসহ ক্ষতিকর প্রাণীদের রেহাই দেয়ার পক্ষপাতী নই আমি। মানুষের জন্য ক্ষতিকর প্রাণী নির্মূল হলেই নারী-পুরুষ সকলের জীবন নিরুদ্বেগে কাটবেÑ এই শিক্ষাটাই গ্রহণীয় বলে মনে করি আমি। এতেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কমে আসবে দুনিয়ায়। দায়িত্ববানদের এ বিষয়ে দায়িত্বসচেতন হওয়া বাঞ্ছনীয়।

যেমনটা আগের দিন ভেবেছিলাম, পরদিন ঠিক তা-ই ঘটল। সোহাগ গাজী দ্রুত ৪ উইকেট তুলে নিলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২৭৩ রানে অলআউট হলোা এবং বাংলাদেশের টেস্ট জয়ের জন্য লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়াল ৭৬ ওভারে ২৪৫ রান। কিন্তু ২য় ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোলারদের সঙ্গে যুদ্ধে পারল না বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানেরা। হেরে গেল টেস্টে। খুলনায় অনুষ্ঠিত ২য় টেস্টেও আবুল হোসেন রাজুর অভিষেক ম্যাচে দশম ব্যাটসম্যান হিসেবে নেমে সেঞ্চুরি করার রেকর্ডের পরও বাংলাদেশ ম্যাচ হেরে যায়। তবে খুলনায় অনুষ্ঠিত প্রথম ২ ওয়ানডে ম্যাচ জিতে ঢাকায় ফিরে পর পর দু ম্যাচ হারলেও শেষ ম্যাচটি জিতে নিয়ে দেশের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সিরিজ জয়ের স্বাদ পেল বাংলাদেশ দল। এরপর টি-টোয়েন্টির একমাত্র ম্যাচটি হারলেও ক্রিকেটাররা বাংলাদেশি দর্শকদের বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে বেশ আনন্দ উপহার দিয়েছেন। কিন্তু এই বিজয়ের মাসেই পুরান ঢাকার জজ কোর্টের সামনে প্রকাশ্যে দিবালোকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সদস্যরা বিশ্বজিৎ দাসকে যেভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছে, তাতে মুসলিমরা সীমালঙ্ঘন করছে বলে ঈসা (আ.) স্বপ্নে যে দায়িত্ব পালনের আহ্বান আমাকে জানিয়েছেন, সেই বিষয়ে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় কি? মনুষ্যত্বের শিক্ষা প্রচার করা তো প্রতিটি সচেতন মানুষেরই দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালন না করলে তাকে তো যথার্থ মানুষ বলা যাবে না।

























ছয়



কর্মজীবনে ঢুকে গেলে বন্ধু-স্বজন অনেকের সঙ্গেই আর নিয়মিত দেখা হয় না। এলাকার যারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাদের কারো সঙ্গেও এক মাস ধরে দেখা হয়নিÑ এমন ঘটনার মুখোমুখিও হয়েছি কয়েকবার। আর প্রবাস জীবনযাপন করছে যারা, যেমন আমার বউয়ের বড় ভাই হারুনুর রশীদ মানিককে ৮ বছর পর দেখেছিÑ এমন ঘটনাও ঘটেছে। আবার বেকার থাকলে অনেকের সঙ্গেই দেখা হয়ে যায় রাস্তায় বেরোলে। সন্ধ্যায় হাঁটতে হাঁটতে এ ব¬ক বাদামতলী মোড়ে পৌঁছলে প্রথমে নাছিরুল মাওলা বাদল, এরপর কাজী আবদুজ জাহেরের সঙ্গে দেখা। তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পর দেশের রাজনীতি প্রসঙ্গে কথা উঠে গেল। এর মধ্যে কামরুল ইসলাম, হাবিবুর রহমান বাবুল, আবদুল করিম ভুট্টু, রেজাউল করিম ভুট্টু, মহিউল ইসলাম বদর, দেলোয়ার হোসেন ভোলাও যোগ দিল আমাদের সঙ্গে। রেজাউল করিম ভুট্টু ছাড়া আর সবাই বিএনপির সমর্থক হিসেবে পরিচিত। রেজাউল করিম ভুট্টু আবার আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ সমর্থক। আমি নিজেও একসময় এলাকায় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। কিন্তু আদর্শকেই প্রাধান্য দেই বলে বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট সরকারের আমলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের জরিপের ফলাফলে বাংলাদেশ পর পর ৪ বার বিশ্বের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দুর্নীতিপ্রবণ দেশ বলে বিবেচিত হলে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপিকে ত্যাগ করি আমি। কারণ, বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলাম জিয়াউর রহমানের দেশপ্রেম ও সততার প্রতি আকৃষ্ট হয়েই। কিন্তু তার গড়া দল বিএনপিতে অসৎ লোকের পাল্ল¬া ভারী হয়ে উঠলে সেই দলে থাকার আর কোন যুক্তি থাকে না। তাই বিএনপিকে ত্যাগ করে অনেকদিন রাজনীতিবিমুখ ছিলাম। পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি গঠিত হলে ঘটনাচক্রে দলটির তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক সাদেক আহমদ খানের আহ্বানে এ দলে যোগ দেই। কিন্তু এ দলটিও বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটে যোগ দিলে আবার রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়েছি। কারণ, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট কিংবা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে আদর্শ রাজনৈতিক প্ল¬াটফর্ম বলার উপায় নেই এখন। বড় দুটি দলের নেতৃত্বেই লুটপাটের রাজনীতি দেশে প্রতিষ্ঠিত আছে ১৯৯৭ সাল থেকে। এর আগেও যে দেশ দুর্নীতিমুক্ত ছিল, এমনটা মনে করার কোন কারণ নেই। তবে জিয়াউর রহমানের ১৯৭৬-১৯৮১, বিএনপির ১৯৯১-১৯৯৬ এবং ওয়ান/ইলেভেন সরকারের ২ বছর দুর্নীতি তুলনামূলক কম ছিলÑ এমনটা বলাই যায়। তবে যেহেতু বিগত বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারগুলোর আমলে দেশে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের মাত্রা বেড়ে গেছে, তাই সততার রাজনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সৎ ব্যক্তির নেতৃত্বে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গড়ে তোলা জরুরি মনে করি। আর নিজেকে সৎ মনে করি বলে ‘মানুষের দল’ বা ‘হিউম্যান পার্টি’ নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গড়ে তোলার উদ্যোগও নিয়েছিলাম একবার। কিন্তু আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ার জন্য ১৯৭১-এর মতো নিবেদিতপ্রাণ কর্মী একজনও খুঁজে পাইনি বলে সেই উদ্যোগ আগায়নি। এখনকার বেশিরভাগ তরুণকেই দেখছি নিজের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়েই ব্যস্ত থাকতে। সমাজ বা রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন এখন গৌণ বিষয়। আর নিজে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পেছনে ছুটছি না বলে সবার কাছে অযোগ্য ব্যক্তি হয়ে আছি। সমাজ বা রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের জন্য তাই কোন উদ্যোগ গ্রহণের কথা বললে উল্টো হাসির পাত্র হয়ে যাই। সবাই প্রায় একই ভাষায় নসিহত করেÑ আগে নিজের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য চেষ্টা করো। আর্থিক উন্নতিটাই বর্তমানে মানুষের জীবনের উন্নতির নির্ণায়ক হিসেবে বিবেচিত হয়। আত্মিক বা আদর্শিক উন্নতিকে বড় করে দেখে না কেউ। তাইতো মিথ্যে আর অন্যায়ের দাপট সমাজে বেশি। আর মিথ্যের দাপট এতোটাই বেশি যে, সবচেয়ে বড় পাকিস্তানপন্থি যিনি ছিলেন ১৯৭১ সালে বাঙালিদের মধ্যে, তিনিই এখন সবচেয়ে বড় বাংলাদেশপন্থি বলে স্বীকৃতি পেয়ে গেছেন। সেই সঙ্গে ‘জাতির জনক’, ‘বঙ্গবন্ধু’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত হচ্ছেন। অথচ ১৯৭১ সালের মার্চে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেয়েছেন, তাদেরকে তিনি পাকিস্তানিদের কাছে উগ্রপন্থি বলে বর্ণনা করেছেন এবং পাকিস্তানের বিভাজন যাতে না ঘটে, সেজন্য তিনি তৎকালীন পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের অনুরোধ রেখেছিলেন; অথচ স্বাধীনতাকামী ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য যে চাপ ছিল, তা কৌশলে এড়িয়ে গেছেন। পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাদের লেখা বইয়ে এ ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাদের লেখা বইয়ের তথ্য এবং ২৫ মার্চ পর্যন্ত ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করলে এ বিষয়টাই পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, শেখ মুজিবুর রহমান কিছুতেই পাকিস্তান রাষ্ট্র ভাঙতে চাননি। কিন্তু এ দেশের বেশিরভাগ মানুষ শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ শুনে এই ভাষণটিকেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মনে করে। ইতিহাস সম্বন্ধে বাঙালিদের অজ্ঞতার কারণে বেশিরভাগ বাঙালিই এ বিষয়টা মাথায় আনতে চায় না যে, শেখ মুজিবুর রহমানের মুখ থেকে স্বাধীনতা প্রসঙ্গে কোন কথা বের হবার আগেই ১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরÑ বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘মুক্তি যদি পেতে চাওÑ বাঙালিরা এক হও’ ইত্যাদি স্লে¬াগান দিয়েছে এবং ২ মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ৩ মার্র্চে পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের সম্মেলনে ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণা’ সম্বলিত স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়েছে। ছাত্রদের এসব তৎপরতায় ২ মার্চ থেকে ৬ মার্চের মধ্যে দেশবাসী স্বাধীনতা লাভের জন্য এতোটাই উদ্দীপিত হয়ে উঠেছিল যে, ৭ মার্চের রেসকোর্স ময়দানের ভাষণের পূর্বে অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছিলÑ সারা দেশবাসীই চাচ্ছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হোক, কেবল শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি ও এই দলের নির্বাচিত পরিষদ সদস্যরাই চাচ্ছিলেন না যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হোক। শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের আগেই দশ লক্ষাধিক বাঙালি বর্শা-বল্লম যার যা আছে, তা হাতে নিয়ে রেসকোর্স ময়দানে হাজির হয়েছিল শেখ মুজিব কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা তথা যুদ্ধ শুরুর নির্দেশ পেয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের উদ্দেশ্যে। কিন্তু মুজিবের মুখ কেউ চেপে ধরে না থাকলেও তিনি বললেনÑ ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যার যা আছে তা-ই নিয়ে শত্র“র মোকাবেলা করবে।’ হুকুমটা তখনই তিনি দিলেন না কেন, এই প্রশ্নটা কেউ তুলতে যায় না। তখন তার হুকুম শুনে দশ লক্ষাধিক বাঙালি ক্যান্টনমেন্ট ছুটে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। সংগঠিত জনতা একসঙ্গে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের উদ্দেশ্যে ছুটলে তার যে ফল পাওয়া যেত, তার চেয়ে বিচ্ছিন্ন জনতার হেথা-হোথা বর্শা-বল্লম ধরার ফল অনেক কম। এ কথা বোঝার ক্ষমতা যে শেখ মুজিবুর রহমানের ছিল না, তা কিন্তু নয়। তিনি বুঝে-শুনেই সংগঠিত জনতাকে ক্যান্টনমেন্টের উদ্দেশ্যে ছুটে যাবার হুকুম দেন নাই। কারণ, এতে তার পাকিস্তানের ক্ষমতালাভের পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যেত। পাকিস্তানের ক্ষমতালাভের পথ যাতে চিরতরে বন্ধ হয়ে না যায়, সেজন্য বরং তিনি সুকৌশলে সংগঠিত জনতাকে তাদের সঙ্গে করে নিয়ে আসা বর্শা-বল্ল¬ম অব্যবহৃত রেখেই ক্যান্টনমেন্টের বিপরীত রাস্তা ধরিয়ে ফেরত পাঠালেন। শেখ মুজিবের এক নির্দেশেই ৭ মার্চ যেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতালাভের পথ অনেক সহজ হয়ে যেত, সেখানে পাাকিস্তানের ক্ষমতালাভের পথ খোলা রাখতে তিনি সংগঠিত জনতাকে নিষ্ক্রিয় করার বাসনা নিয়ে যে অপকৌশলে দশ লক্ষাধিক বাঙালিকে ক্যান্টনমেন্টের বিপরীত রাস্তা ধরালেন, তা স্বাধীনতাকামী সকল বাঙালির সাথে প্রতারণার শামিল। এই লোকগুলো ৭ মার্চই শেখ মুজিবের এক নির্দেশে হাসিমুখে সম্মুখ সমরে প্রাণ দিতে রাজী ছিল এবং সেদিন তাদের রক্তদান জাতির জন্য খুবই কার্যকরী হতো দ্রুত স্বাধীনতালাভে। কিন্তু এই লোকগুলোকেইÑ বিশেষ করে এদের নেতৃত্বে থাকা ছাত্রদের ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র অবস্থায় অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করতে হলো, যার প্রভাব বরং নেতিবাচক হলো জাতির জন্য। ৭ মার্চের সংগঠিত জনতার শক্তির স্থলে ২৫ মার্চ রাতের আক্রমণের পর স্বাধীনতাকামীরাই অসহায় বোধ করে পালাতে শুরু করল এদিক-ওদিক। এদের অনেকেই অতিরিক্ত পাক বাহিনীর সৈন্যদের সম্মুখে পড়ে প্রাণ হারাল। আর অনেকে ভারতে পাড়ি দিয়ে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করতে করতে ৫/৬ মাস সময় পেরিয়ে গেল। এতে সামগ্রিকভাবে দেশে থাকা বাঙালিদের প্রাণহানি ঘটল ব্যাপকভাবে এবং নারীদের সম্ভ্রমহানিও ঘটতে থাকল প্রচুর পরিমাণে। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতালাভে আন্তরিক হতেন এবং পাকিস্তানের ক্ষমতালোভ তার না থাকত, তবে ৭ মার্চই সংগঠিত জনতাকে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের নির্দেশ দিলে ২৫ হাজার পাকসেনাকে পরাভূত করা বাঙালিদের জন্য অনেক সহজসাধ্য হতো। সবচেয়ে বড় কথা হলোÑ ক্ষমতার লোভ না থাকলে তিনি পাকিস্তানিদের সঙ্গে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ১৬-২৫ মার্চ পর্যন্ত দর কষাকষি করতে যেতেন না। আর তার ক্ষমতার লোভের কারণেই ২৫ মার্চ পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকে বাঙালিদের স্বাধীনতার চেতনা দমিয়ে দেবার জন্য এদেশে পাক সেনা মোতায়েনের সুযোগ করে দিলেন। সেই সুযোগে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ পরবর্তী ১৮ দিনে আরো ৬৫ হাজার সৈন্য মজুত করল বাংলাদেশে এবং ২৫ মার্চ সন্ধ্যা থেকে বাঙালিদের স্বাধীনতার চেতনা গুঁড়িয়ে দিতে তৎপরতা চালাল। মুজিব তখনও স্বাধীনতার জন্য নেতৃত্ব দিতে অন্য আওয়ামী লীগ নেতাদের মতো গৃহত্যাগ না করে পাকিস্তানের ক্ষমতা লাভের পথ খোলা রাখতেই গৃহে থেকে গেলেন। আরো একটি বিষয়ে বাঙালিদের ভাবা দরকার যে, যুদ্ধের নিয়ম হচ্ছেÑ প্রধান শত্র“কে হাতের মুঠোয় পেলে তাকে হত্যা করা। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ শেখ মুজিবুর রহমানকে হাতের মুঠোয় পেয়েও হত্যা করেনি। বরং হত্যা করেছে ছাত্র-সৈনিকসহ সাধারণ বাঙালিদের। আর নিরাপত্তা দিয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারসহ ‘রাজাকার’ হিসেবে চিহ্নিত পাকিস্তানপন্থিদের পরিবারকে। এমনকি ঢাকা সেনানিবাসের সিএমএইচ-এ শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়-এর নিরাপদ জন্মের ব্যবস্থাও করেছিল। ৩৮/৪ বাংলাবাজার, ঢাকাস্থ বিদ্যাপ্রকাশ থেকে ২০০২ সালের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত ‘রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের কথা’ বইটির ৩০ নং পৃষ্ঠায় মুক্তিযোদ্ধা ইশতিয়াক আজিজ উলফাতের সাক্ষাৎকারে একথা উঠে এসেছে। অথচ, মৃত্যুর দুয়ারে পাকিস্তানি সেনারা প্রতিদিনই পাঠিয়েছে নিরীহ ও স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের। ‘রাজাকার’দের মতো পাকিস্তানপন্থি হিসেবে যদি শেখ মুজিবুর রহমান নিজেকে প্রমাণিত না করে থাকেন পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের কাছে এবং বাঙালিদের স্বাধীনতার চেতনা দমনে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকে বাংলাদেশে পাক সেনা মজুদে সহায়তা না করে থাকেন, তবে শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের প্রতি পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের এমন উদারতার অন্য কি কারণ থাকতে পারে? দৃশ্যতঃ শেখ মুজিবুর রহমানই তো ছিলেন পাকিস্তানিদের প্রধান শত্র“। প্রধান শত্র“র পরিবারের প্রতি উদারতা, আর অন্য বাঙালি পরিবারের প্রতি নির্মমতার রহস্য তবে কি? পাকিস্তানের ক্ষমতালাভের পথ খোলা রাখার জন্য বাঙালিদের স্বাধীনতার চেতনা দমাতে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকে যদি সমর্থন ও সহযোগিতা মুজিব না করতেন, তবে ২৫ মার্চ’১৯৭১ ইং রাত্রে মুজিবের পরিবারের ওপরই তো সর্বপ্রথম কামানের গোলা ছোড়ার কথা পাক সেনাদের। প্রধান শত্রর পরিবারকে নিরাপদ রেখে ছোট শত্র“দের হত্যা করার মতো মূর্খ তো পাকিস্তানি জান্তারা হবার কোন কারণই নেই। বাঙালিরা তাদের বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে এই বিষয়টি আজো বুঝতে পারেনি। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান একাত্তরের মার্চেই বুঝে গেছিলেন যে, পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর চেয়ে বড় দেশপ্রেমিক (পাকিস্তানপ্রেমিক) ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। মৃত্যুর ২ বছর আগে ২৯ মে ১৯৭৮ ইং তারিখে পাকিস্তানের লাহোর কোর্টে এক গোপন এফিডেভিটে (ক্রমিক নং-২৪৪/১৯৭৮) সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান একথা বলে যান। ১৯৮০ সালের আগস্ট মাসে ইয়াহিয়া খানের মৃত্যুর ২৫ বছর পর ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তান সরকার এফিডেভিটটি জনসমক্ষে প্রকাশ করে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক প্রতিচিত্র-এর ২৫ ফেব্র“য়ারি, ২০১১ ইং সংখ্যায় এফিডেভিটের চুম্বক অংশগুলি প্রকাশিত হয়। এফিডেভিটে ইয়াহিয়া বলেন যে, ‘শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর চেয়ে বড় দেশপ্রেমিক (পাকিস্তানপ্রেমিক) ছিলেন। ভুট্টো যেখানে ১৯৭০ সালের নির্বাচন থেকে শুরু করে সংসদ অধিবেশন তলব করা নিয়ে বারবার বাধা সৃষ্টি করেছেন, সেখানে শেখ মুজিব ছিলেন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ অনুসরণের পক্ষে। এফিডেভিটে ইয়াহিয়া আরো বলেন: ‘মুজিব নন, ভুট্টোই পাকিস্তান ভেঙেছেন। একাত্তরে ভুট্টো যেসব কথা বলেছেন, যে গোয়ার্তুমি করেছেনÑ পাকিস্তানের সংহতি বিনষ্টে নিঃসন্দেহে তা ছিল শেখ মুজিবের ৬ দফার তুলনায় অনেক বেশি আত্মঘাতী। তখন ক্ষমতালিপ্সায় ভুট্টো এতোটাই পাগল হয়ে উঠেছিলেন যে, এক পাকিস্তানে দুই প্রধানমন্ত্রী তত্ত্ব দাঁড় করাতেও তিনি জেদ ধরেছিলেন। তার উচ্চাভিলাষ এবং একরোখা ও কঠিন মনোভাবের কারণেই পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্্েরাহের আগুন জ্বলে উঠেছিল এবং বাঙালির মন বিষিয়ে তুলেছিল। আর এসব কারণেই পাকিস্তানের সংহতি ধরে রাখা যায়নি। পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে যায়।’ ইয়াহিয়া খান তার এফিডেভিটে আরো বলেন, পিপিপি চেয়ারম্যান ভুট্টো ১৯৭০ সালের অক্টোবরে নির্ধারিত নির্বাচন বাতিল করে ঘোষণা দেয়ার জন্যও জোরালো চাপ প্রয়োগ করেন। মূলত রাষ্ট্র ক্ষমতার শীর্ষ পদের জন্য ভুট্টোর সীমাহীন উচ্চাভিলাষ এবং এ ব্যাপারে কাউকে ন্যূনতম ছাড় দিতে রাজি না হওয়ার মানসিকতাই পাকিস্তানের সংহতি বিনষ্ট করেছে। নিজ স্বার্থ হাসিলে ভুট্টো সব ধরনের অপকৌশল প্রয়োগে ন্যূনতম দ্বিধা করেননি। তিনি চেয়েছিলেন নিরঙ্কুশ ক্ষমতা, পাকিস্তানের কর্তৃত্ব। যে কোন বিবেচনাতেই বলা যায়, নিঃসন্দেহে ভুট্টো ছিলেন একজন বড়মাপের ষড়যন্ত্রকারী। জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার দীর্ঘ এফিডেভিটের বড় অংশ জুড়েই এমন মন্তব্য করেছেন। পাকিস্তানের ক্রান্তিকালে মূল ভিলেইন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোকে। পাশাপাশি তারই নিয়ন্ত্রণাধীন সামরিক জান্তার বেশ ক’জন জেনারেলকেও দায়ী করেছেন পর্দার আড়ালে ভুট্টোর হয়ে ষড়যন্ত্র পাকানোর দায়ে। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের মতে, ১৯৭১ সালের জটিল পরিস্থিতিতে যখন জাতীয় সংহতি ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে, তখন রাজনীতির পাশা খেলায় ভুট্টোর কুটিল চাল যারপরনাই এক পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকেছে। পিপিপি চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে পাক প্রেসিডেন্ট বলেন যে, তিনি (ভুট্টো) ছিলেন চরম অ্যালকোহলিক। সবসময় হুইস্কিতে আসক্ত থাকতেন। এমনকি কোন জনসভায় যাবার আগেও কয়েক পেগ হুইস্কি পান করতে ভুলতেন না। (১৯৭০ সালের) নির্বাচনের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতেও জুলফিকার আলী ভুট্টো মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না। নির্ধারিত সময়ে পার্লামেন্ট সেশন বসার ক্ষেত্রেও তিনি বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। এ ব্যাপারে এফিডেভিটে বলা হয়েছে যে, মুজিব পাক প্রেসিডেন্টকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংসদ অধিবেশন ডাকার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। ২১ ফেব্র“য়ারির ভাষা শহীদ দিবসের পূর্বেই অধিবেশন অনুষ্ঠিত না হলে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করতে পারেÑ এমন আশঙ্কার কথা ইয়াহিয়াকে জানিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ প্রধান। অপরপক্ষে সংসদ অধিবেশন পিছিয়ে দেয়ার জন্য ক্রমাগত চাপ দিচ্ছিলেন পিপিপি চেয়ারম্যান। তিনি প্রেসিডেন্টকে বলেছিলেন, যদি এখনি সংসদ অধিবেশন ডাকা হয়, তাহলে মুজিব কোন সমঝোতায় যেতে চাইবেন না। তবে তারপরও তাকে (ভুট্টো) ঢাকায় আসার জন্য ইয়াহিয়া অনুরোধ করেছিলেন বলে এফিডেভিটে উল্লে¬খ করা হয়। কিন্তু পিপিপি চেয়ারম্যান ঢাকায় আসতে অস্বীকৃতি জানান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গভর্নরদের নিয়ে একটি বিশেষ বৈঠক আহ্বান করেন ইয়াহিয়া খান। সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এডমিরাল আহসান সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন যে, পরিস্থিতি খুবই জটিল এবং বাঙালিরা কোনভাবেই সংসদ অধিবেশন বাতিল করাটাকে মেনে নেবে না। তারপরও যদি এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তাহলে যেন একইসঙ্গে অধিবেশনের নতুন তারিখ জানিয়ে দেয়া হয় সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে। এডমিরাল আহসানের কথা গুরুত্বের সঙ্গে নিলেও ভুট্টোর একরোখা মনোভাবের বিষয়টি উল্লে¬খ করে ইয়াহিয়া ওই বৈঠকে বলেন, এ অবস্থায় সংসদ অধিবেশন ডাকা হলে পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কোন সদস্য ঢাকায় যাবেন না। ফলে সংসদ সদস্যদের একটি বড় অংশ সংসদের বাইরে থেকে যাবে। সৃষ্টি হবে নতুন জটিলতার। তাই অধিবেশন বাতিল না করে কোন উপায় নেই। এফিডেভিটে ইয়াহিয়া খান আরো বলেন, ‘ভুট্টো যদি গোয়ার্তুমি ও একরোখা মনোভাব ত্যাগ করে ঢাকায় পার্লামেন্ট সেশনে যোগ দিতেন, তাহলে পূর্ব পাকিস্তানিরা পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক কিছুই অকপটে মেনে নিতেন। এতে এক পাকিস্তান না হোক, অন্তত একটি কনফেডারেশনের আওতায় থাকার ব্যাপারে আপত্তি তোলা হতো না। ওই সময় মুজিব অনেক অসত্য বলেছেন ঠিক, তবে ভুট্টো ছিলেন অতি চালাক। আমি বলব, অমসৃণ ত্বকবিশিষ্ট বিষাক্ত ব্যাঙ জাতীয় প্রাণী ছিলেন ভুট্টো।’ লাহোর হাইকোর্টে অ্যাডভোকেট মনজুর আহমাদ রানার মাধ্যমে ইয়াহিয়া খান তার এ এফিডেভিট করে যান। এতে রয়েছে ৫৭টি টাইপ করা পাতা। কোর্টে এফিডেভিটটি নথিভুক্ত করার আগে ২৯ মে ’৭৮ তারিখে রাওয়ালপিন্ডির বাড়িতে বসে ইয়াহিয়া প্রতিটি টাইপ করা পাতা পড়ে দেখেন এবং বেশ কিছু জায়গায় নিজ হাতে কিছু সংশোধন করে সবকিছু সত্য বলে স্বাক্ষর দেন। এফিডেভিটের প্রতিটি পাতাতেই তার অনুস্বাক্ষর রয়েছে। লাহোর কোর্টে এফিডেভিটের ক্রমিক নম্বর দেয়া হয় ২৪৪/১৯৭৮। এফিডেভিটে আরো বলা হয়, শেখ মুজিবকে জীবিত বা মৃত ধরে নিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছিলেন টিক্কা খান। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল টিক্কা খান নির্দেশ দিয়েছিলেনÑ ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুরু হলে শেখ মুজিবুর রহমানকে জীবিত অথবা মৃত, যেভাবেই হোক ধরে নিয়ে আসতে হবে। টিক্কা এই আদেশ দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের অজান্তে। যখন ইয়াহিয়া এ সম্পর্কে জানতে পারেন, তখনি তিনি মুজিবকে হত্যার যেকোন প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন ও তাকে জীবিত ধরে নিয়ে আসার জন্য নতুন আদেশ জারি করেন। অপারেশন সার্চলাইট সম্পর্কে এফিডেভিটে ইয়াহিয়া বলেন, কারো পরামর্শে বা ইন্ধনে নয়Ñ সম্পূর্ণ নিজ দায়িত্বে তিনি ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনার নির্দেশ প্রদান করেন। এছাড়া তার সামনে আর কোন বিকল্প পথ খোলা ছিল না। সে সময় পরিস্থিতি এমনি পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার জন্য সামরিক অ্যাকশন অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। পাক আর্মির এই পদক্ষেপকে পিপিপি চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো সাদরে সমর্থন করেছিলেন এবং শেখ মুজিবের গ্রেফতারে তাকে সেসময় বিশেষ উৎফুল¬ হয়ে উঠতে দেখা গেছে। এদিকে জুলফিকার আলী ভুট্টো রাজনৈতিক অঙ্গনে অচলায়তন তৈরির মাধ্যমে সামরিক বাহিনীকে অ্যাকশনে যেতে ‘বাধ্য’ করার পর তার প্রতিদ্বন্দ্বী শেখ মুজিবুর রহমানকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলার জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন বলেও উল্লে¬খ করেন ইয়াহিয়া খান। এ প্রসঙ্গে তিনি এফিডেভিটে বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দি থাকাবস্থায় বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলেও তিনি শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন এই শর্তে যেÑ তিনি (মুজিব) ক্ষমাপ্রার্থী হবেন ও পাকিস্তানের প্রতি তার আনুগত্য প্রকাশ করবেন। এক্ষেত্রে কোন লিখিত হলফনামা ছাড়াই মুজিবকে মুক্তি দেয়ার ইচ্ছা ছিল ইয়াহিয়ার। অন্যদিকে ভুট্টো চেয়েছিলেন সামরিক আদালতে দোষী সাব্যস্ত করে শেখ মুজিবকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলাতে। ইরানের পাহলভী রাজবংশের ২৫০০তম জয়ন্তীতে যোগ দিতে ইয়াহিয়ার ইরান যাত্রার প্রাক্কালে ভুট্টো মুজিবকে শেষ করে দেয়ার পরামর্শ দেন। তার (ভুট্টো) যুক্তি ছিলÑ ইরানসহ অন্যান্য দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানরা মুজিবকে মুক্তি দেয়ার জন্য ইয়াহিয়ার উপর চাপ প্রয়োগ করতে পারেন। তাই সেখানে যাওয়ার আগেই মুজিবকে ফাঁসিতে ঝোলানো উচিত। এ ব্যাপারে এফিডেভিটে ইয়াহিয়া বলেন যে, ভুট্টোর প্ররোচনায় তিনি রাজি হননি। কারণ তিনি আইন নিজের হাতে তুলে নিতে চাননি, চেয়েছেন বিচারকার্য স্বচ্ছ হোক। অবশ্য শুধু সেবারই নয় আরো বেশ ক’বার ভুট্টো সামরিক আদালতের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত করে মুজিবকে হত্যার জন্য ইয়াহিয়াকে উপদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু জান্তা প্রধান পিপিপি চেয়ারম্যানের কথায় কর্ণপাত করেননি বলে দাবি করেন।

যুদ্ধক্ষেত্রে কিংবা শক্রুতামূলক আচরণে প্রধান শক্রকে কখনো ছাড় দেয় না কেউই। কিন্তু ইয়াহিয়া খান বাঙালিদের নির্বিচারে হত্যা করার নির্দেশ দিলেও শেখ মুজিবুর রহমানকে রক্ষা করেছিলেন ভুট্টোর সকল প্রকার ষড়যন্ত্র থেকে। শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিদের প্রতি নয়Ñ বরং এক পাকিস্তানের অস্তিত্বের প্রতিই অধিক বিশ্বাসী, একথা বাঙালিরা অতি আবেগের কারণে না বুঝলেও ইয়াহিয়া খান ঠিকই বুঝে নিয়েছিলেন। তাই পাকিস্তানকে এক রাখার স্বার্থে তিনি মুজিবের মৃত্যু কামনা করেননি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ মুজিবের এই উচ্চারণ যে বাঙালিদের বোকা বানিয়ে পাকিস্তানকে অটুট রাখার এক কৌশল, তাও ইয়াহিয়া ভালো করেই বুঝেছিলেন। কারণ, সেদিন মুজিব ইচ্ছা করলেই পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করার ঘোষণা দিতে পারতেন। ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমাদের যার যা কিছু আছে, তা নিয়ে শক্রুর মোকাবেলা করবে’ মুজিবের এসব ঘোষণা যে স্রেফ রাজনৈতিক ভাওতাবাজির মাধ্যমে বাঙালিদের বোকা বানানোর চেষ্টা, তা বুঝতেও ইয়াহিয়া ভুল করেননি। কারণ, বাঙালির যার যা কিছু আছে, তা নিয়েই সেদিন বাঙালিরা রেসকোর্স ময়দানে হাজির হয়েছিল এবং মুজিবের হুকুম দেবার পথে কোন বাধা ছিল না। মুজিব সেদিন চাইলেই লাখো জনতাকে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করার হুকুম দিতে পারতেন এবং পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য সরাসরি অ্যাকশনে যেতে পারতেন। কিন্তু এক পাকিস্তানের প্রতি বিশ্বস্ত বলেই মুজিব তেমন পদক্ষেপ নেননি, একথা বুঝতে কোন অসুবিধা হয়নি ইয়াহিয়ার। তাই নিরীহ বাঙালিদের হত্যার জন্য তিনি অপারেশন সার্চলাইটের নির্দেশ দিলেও মুজিবের জীবন রক্ষার্থে তার চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। অতএব, একথা স্পষ্ট যে, বাঙালির মহাশক্রু ইয়াহিয়া খানের পরম বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রকৃতপক্ষে বাঙালিদের বন্ধু ছিলেন না। বরং ইয়াহিয়া খানকে বাঙালিদের হত্যায় সৈন্য মজুতের সুযোগ দিয়েছিলেন তিনি আলাপ-আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে। এতে করে প্রায় ৬৫ হাজার অতিরিক্ত সৈন্য মজুতের সুযোগ পেয়েছিল ইয়াহিয়া খান। আর ৩০ লক্ষ বাঙালি হত্যায় ও ২ লক্ষ নারীর সতীত্ব নষ্ট করায় ভূমিকা রাখতে পেরেছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা। ইয়াহিয়া খানকে এতো বাঙালি হত্যা ও বাঙালি মা-বোনের সম্ভ্রম নষ্ট করার সুযোগ তৈরি করে দিয়ে হলেও পাকিস্তানকে এক রাখার জন্য সকল আর্মি অপারেশনের ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য মুজিব ইয়াহিয়া খানের বন্ধু না হয়ে শত্র“ হবেন কোন বিবেচনায়? তাইতো বন্ধুর প্রাণ রক্ষায় ইয়াহিয়া চেষ্টার কোন ত্র“টি করেননি। স্বদেশী জুলফিকার আলী ভুট্টোর সকল ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিয়ে মুজিবকে রক্ষা করেছিলেন ইয়াহিয়া। তাই মুজিবকে বাঙালিদের বন্ধু বা জাতির পিতা ভাবা বাঙালিদের বুদ্ধির দীনতা ছাড়া কিছু নয়। বাঙালিদের প্রকৃত বন্ধু আসলে ইয়াহিয়ার শত্র“ সেই সময়ের ছাত্র-জনতা এবং এ জাতির পিতা-মাতাও সেই সময়ের দেশের ছাত্র-সৈনিক-জনতা। ছাত্র-সৈনিক-জনতা চেয়েছিল বলেই বাঙালিরা পাকিস্তানিদের যুদ্ধে পরাজিত করে দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে পেরেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসের এই বিশ্লে¬ষণ সবার সামনে তুলে ধরলে রেজাউল করিম ভুট্টু বললÑ আপনি কি বলতে চাচ্ছেন যে, এতোদিন ধরে আমরা মুক্তিযুদ্ধের ভুল ইতিহাস জেনে আসছি?

আমি তার কথার প্রেক্ষিতে বললামÑ নিরপেক্ষভাবে এখনো সঠিক ইতিহাস কেউ তুলে আনেনি। তাই সঠিক ইতিহাস দেশের খুব কম মানুষই জানে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আ.স.ম. আব্দুর রবও ১৯৯৮ সালের ১০ ডিসেম্বর বন্দরনগরী চট্টগ্রামের আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ‘মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলা’য় স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতির নেতৃত্ব দিয়েছিল ছাত্রসমাজ। পুরো জাতি তখন দিক-নির্দেশনার জন্য তাকিয়ে থাকতো ডাকসু-র দিকে।’ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির কথা উলে¬খ করে রব সেই আলোচনা সভায় আরো বলেনÑ ‘স্বাধীনতার ২৬ বছরে অনেক ইতিহাস লেখা হয়েছে, অনেক বই রচিত হয়েছে, কিন্তু সেসব বইতে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায় না। অতএব, তোমরা যা জান তা যে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস নয়, সে বিষয়ে আ.স.ম আব্দুর রবও একজন সাক্ষী। তবে আ.স.ম. আব্দুর রবও হয়তো জানেন নাÑ এমন বিষয়ও পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাদের রচিত পাকিস্তানের ভাঙনবিষয়ক বইয়ে উঠে এসেছে।

কাজী আবদুজ জাহের, দেলোয়ার হোসেন ভোলা, কামরুল ইসলাম, আবদুল করিম ভুট্টু, হাবিবুর রহমান বাবুল, মহিউল ইসলাম বদর এরাও আমাদের কথা শুনছিল। জাহের বললÑ আপনি তো লেখালেখি করেন। আপনার মতে সঠিক ইতিহাস তবে কি?

আমি স্বাভাবিক গলাতেই বললামÑ দেখো, শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ টেপ রেকর্ডারে সারা দেশজুড়ে বাজিয়ে আওয়ামী লীগ প্রমাণ করতে চাইছে, মুজিবের আহ্বানেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু একজন পাকিস্তানি মেজর তার লেখা বইতে ৭ মার্চের আগের যে ইতিহাস তুলে ধরেছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে মুজিব ২৮ ফেব্র“য়ারি সন্ধ্যা থেকে ৬ মার্চ দিবাগত রাত ২টার মধ্যে ৩ বার গ্রেপ্তার হতে চেয়েছিলেন, যাতে তাকে ৭ মার্চের মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে না হয়।

রেজাউল করিম তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ জানিয়ে বললÑ না। এমনটা কিছুতেই হতে পারে না। বঙ্গবন্ধু এমন কাজ করতেই পারেন না।

আমি বললামÑ তাহলে তোমাকে দালিলিক প্রমাণ দেখাচ্ছি। আমার পকেটে তখন পাকিস্তানি মেজর সিদ্দিক সালেকীর (গধলড়ৎ ঝরফফরয়ব ঝধষবয়ঁব) লেখা ডরঃহবংং ঃড় ঝঁৎৎবহফবৎ গ্রন্থের গঁলরন ঞধশবং ঙাবৎ প্রবন্ধটির ফটোকপি ছিল। ঢাকায় সাপ্তাহিক ঊষায় কাজ করার সময় ২ নং সেক্টরে যুদ্ধ করা ৪র্থ বেঙ্গলের একজন সৈনিক এম. শফিকুল ইসলাম আমাকে এমন কিছু তথ্য দিয়েছিল, যাতে ইতিহাসের অনেক অজানা বিষয় রয়েছে। প্রায় ১২ বছর পর আমি ‘মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ও বাংলাদেশের রাজনীতি’ শিরোনামে একটি বই লেখা শুরু করলে সেই তথ্যগুলি পড়তে শুরু করি। যেহেতু তার দেয়া তথ্যগুলির বেশিরভাগই পাকিস্তানি ও ইন্ডিয়ার সামরিক ব্যক্তিদের লেখা এবং ইংরেজিতে ছাপা বইয়ে প্রকাশিত, সেহেতু অনুবাদের সুবিধার্থে আমি একেকটি আর্টিকেল পকেটে রেখে যখন সময় পাই, কিছু কিছু অনুবাদ করছিলাম। আজ আবার পকেটে এমন আর্টিকেলের পাশাপাশি হাতে আরো কিছু তথ্যসমৃদ্ধ বই নিয়ে বের হয়েছিলাম। যার একটির নাম শাসক মুজিব ও শাসক জিয়া। ১৯৯৮ সালে বইটি জিয়া গবেষণা কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। এ বইটি হাতে দেখেই বাদল রাজনীতি প্রসঙ্গে আলাপ শুরু করেছিল, যে আলাপ এখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গড়িয়েছে। পাকিস্তানি মেজর সিদ্দিক সালেকী (গধলড়ৎ ঝরফফরয়ব ঝধষবয়ঁব) তার লেখা ডরঃহবংং ঃড় ঝঁৎৎবহফবৎ গ্রন্থের ৪৩ নং পৃষ্ঠায় যা লিখেছেন, তার সারমর্ম বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়: ২৮ ফেব্র“য়ারি সন্ধ্যা ৭টায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকাস্থ গভর্নমেন্ট হাউসে উপস্থিত হতে আহ্বান জানান গভর্নর আহসান। শেখ মুজিব সেখানে উপস্থিত হলে আহসান তাকে জানান যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, আমার পক্ষে দলের উগ্রপন্থি অংশকে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন। যদি মার্চ মাসের মধ্যেই নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হয়, তবে আমি পরিস্থিতি সামাল দিতে পারব। যদি এটা এপ্রিলে নেয়া হয়, তবে পরিস্থিতি সামলানো খুবই কঠিন হবে। আর যদি অনির্দিষ্টকালের জন্য অ্যাসেম্বলি মুলতবী রাখা হয়, তবে পরিস্থিতি সামাল দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। এরপর গভর্নমেন্ট হাউস ত্যাগের আগে মুজিব মেজর জেনারেল ফরমানকে বলেন, “ও ধস নবঃবিবহ ঃড়ি ভরৎবং. ও রিষষ নব শরষষবফ বরঃযবৎ নু ঃযব অৎসু ড়ৎ বীঃৎবসরংঃ বষবসবহঃং রহ সু ঢ়ধৎঃু. ডযু ফড়হ’ঃ ুড়ঁ ধৎৎবংঃ সব? ঔঁংঃ মরাব সব ধ ৎরহম ধহফ ও রিষষ পড়সব ড়াবৎ.” (আমি দুই আগুনের মাঝে আছি। আমি হয় সৈনিক নয় আমার দলের উগ্রপন্থি অংশের হাতে মারা যেতে পারি। কেন আমাকে তুমি গ্রেপ্তার করছ না? আমাকে হাতকরা পড়াও এবং তাতেই আমি উতরে যাব।

একই বইয়ের ৪৭ নং পৃষ্ঠায় উলে¬খ করা হয়েছে যে, ৬ বাঙালির মৃত্যুর প্রেক্ষিতে ২ মার্চ বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠানো শেখ মুজিবের ৪ পৃষ্ঠার লিখিত বিবৃতি যা প্রায় একই সময়ে মার্শাল ল’ হেড কোয়ার্টার্স-এ পৌঁছে, তা ছাপার অনুমতি না দিলে মুজিব পরদিন আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে পারেÑ এমন বিবেচনায় বিবৃতিটি প্রত্যাহার বা এতে ব্যবহৃত আগুনঝরা শব্দের তীব্রতা কমানোর জন্য অনুরোধ জানাতে জেনারেল ইয়াকুব শেখ মুজিবকে রাত সাড়ে এগারটায় ফোন করলে মুজিব অনেক বিতর্কের পর বলেন যে, “ও পধহ হড়ঃ ঃড়হব রঃ ফড়হি. ও ধস ঁহফবৎ ঢ়ৎবংংঁৎব. ণড়ঁ’ফ নবঃঃবৎ পড়সব ধহফ ধৎৎবংঃ সব. ওঃ রিষষ ংড়ষাব সু ঢ়ৎড়নষবস.” [আমি এর (বিবৃতিতে ব্যবহৃত শব্দের) তীব্রতা কমাতে পারব না। আমি চাপে আছি। ভালো হয় তুমি আসো এবং আমাকে গ্রেপ্তার করো। এতে আমার সমস্যার সমাধান হবে।] একই বইয়ের ৫২ নং পৃষ্ঠায় এ. ড. ঈযধঁফযৎু লিখিত ঞযব খধংঃ উধুং ড়ভ টহরঃবফ চধশরংঃধহ গ্রন্থের ১৫৩ নং পৃষ্ঠার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে: ৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছেন, তাকে এ বিষয়ে বোঝাতে যে, এমন কোন পদক্ষেপ যেন তিনি গ্রহণ না করেন, যেখান থেকে ফেরত আসার পথ থাকবে না। এরপর ৬ মার্চ প্রায় মধ্যরাতে শেখ মুজিবের জন্য একটা টেলিপ্রিন্টার ম্যাসেজ পাঠান ইয়াহিয়া খান ঢাকার মার্শাল ল’ হেড কোয়ার্টার্স-এ। লেখক মেজর সিদ্দিক সালেকী তখন হেড কোয়ার্টার্স-এ কর্মরত থাকায় তৎক্ষণাৎই ম্যাসেজটি পড়েন। পরে তার স্মৃতি থেকে ডায়েরিতে টুকে নেন ম্যাসেজের কথা। ম্যাসেজটি ছিল এ রকম: চষবধংব ফড় হড়ঃ ঃধশব ধহু যধংঃু ফবপরংরড়হ. ও রিষষ ংড়ড়হ পড়সব ঃড় উধপপধ ধহফ ফরংপঁংং ঃযব ফবঃধরষং রিঃয ুড়ঁ. ও ধংংঁৎব ুড়ঁ ঃযধঃ ুড়ঁৎ ধংঢ়রৎধঃরড়হং ধহফ পড়সসরঃসবহঃং ঃড় ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব পধহ নব ভঁষষু যড়হড়ঁৎবফ. ও যধাব ধ ংপযবসব রহ সরহফ যিরপয রিষষ সড়ৎব ঃযধহ ংধঃরংভু ুড়ঁৎ ঝরী চড়রহঃং. ও ঁৎমব ুড়ঁ হড়ঃ ঃড় ঃধশব ধ যধংঃু ফবপরংরড়হ. (অনুগ্রহ করে দ্রুত কোন সিদ্ধান্ত নেবেন না। আমি শিগগিরই ঢাকা আসব এবং আপনার সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ করব। আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, আপনার উচ্চাকাক্সক্ষা এবং জনগণকে দেয়া ওয়াদার প্রতি পূর্ণ সম্মান জানাতে পারব। আমার মনে একটা পরিকল্পনা আছে, যা আপনার ছয় দফার চেয়ে অধিক সন্তোষজনক হবে। আমি আপনাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি, দ্রুত কোন সিদ্ধান্ত নেবেন না।) ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের হেড কোয়ার্টার থেকে একজন ব্রিগেডিয়ার ব্যক্তিগতভাবে ম্যাসেজটি শেখ মুজিবের ধানমণ্ডীর বাসায় নিয়ে যান। একই দিন শেখ মুজিবের জন্য কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করার পথও খুলে দিয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান। ৬ মার্চই তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে, আগামী ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। এর প্রেক্ষিতে ৭ মার্চের রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে মুজিব প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ইচ্ছা পূরণ করেছিলেন, কিন্তু রেসকোর্স ময়দানে সমবেত দশ লক্ষাধিক বাঙালির মূল ইচ্ছা (স্বাধীনতার ঘোষণা) পূরণ করেননি। ৭ মার্চের সভায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য ছাত্রনেতাদের তরফ থেকে বিশাল চাপ থাকলেও শেখ মুজিব কৌশলে সেই চাপ এড়িয়ে যান। স্বাধীনতা ঘোষণার ব্যাপারে ছাত্রদের চাপ প্রসঙ্গে মযহারুল ইসলাম তার লেখা ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ গ্রন্থের ৭৩৯ নং পৃষ্ঠায় যা লিখেছেন, তাও সকলকে দেখালাম। এতে উলে¬খ আছেÑ “৭ই মার্চের বক্তৃতা সম্পর্কে আমার নিজের কিছু অভিজ্ঞতা আছে। ৬ই মার্চ সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত্রি পর্যন্ত আমি বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডীস্থ বাসভবনে উপস্থিত ছিলাম। ছাত্রদের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর ওপর স্বাধীনতা ঘোষণার এক বিরাট চাপ এসেছিল। এক সময় বঙ্গবন্ধু হাসতে হাসতে ঠাট্টাচ্ছলে আমাকে বললেন: ‘অধ্যাপক, আপনার এই গুণধর ছাত্রদের সামলান। এদের নিয়ে আমি আর পারছি না।’ তিনি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন প্রখ্যাত সংগ্রামী ছাত্রনেতা আবদুর রউফ এবং আরো কয়েকজনকে। রউফ তখন নির্বাচিত পরিষদ সদস্য। সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন প্রাক্তন ছাত্র ছিল। আমি আবদুর রউফ এবং আরো কয়েকজন ছাত্রনেতাকে নিয়ে নিকটস্থ সাংহাই চীনা রেস্তোরাঁয় গেলাম এবং সেখানে আহারের সময় তাদের সাথে সুদীর্ঘ আলোচনায় তারা সবাই সম্মত হলো যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আগামীকল্য অর্থাৎ, ৭ই মার্চ তারিখে ঘোষণা করা হবে কি না হবে তা’ সম্পূর্ণভাবে বঙ্গবন্ধুর ওপর ছেড়ে দেয়া হোক। রাত্রি প্রায় বারোটার দিকে ছাত্রনেতাদের সাথে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সামনে গিয়ে আমাদের আলোচনার ফলাফল তাকে জানানো হলো। তিনি আনন্দে গদগদ হয়ে আমাকে ও ছাত্রনেতাদের জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেন।” ছাত্রনেতাদের তরফ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টি শেখ মুজিবুর রহমানের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেয়া হলেও ৭ মার্চে তাকে যেন রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেয়া না লাগে, সেই চেষ্টাতেও কোন ত্র“টি করেননি মুজিব। ৬ মার্চ গভীর রাত ২টায় গুপ্ত সংবাদসহ মুজিব তার ২ জন প্রতিনিধি পাঠান ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের জিওসি’র বাসায়। মেজর সিদ্দিক সালেকীর ডরঃহবংং ঃড় ঝঁৎৎবহফবৎ গ্রন্থের ৫৩ নং পৃষ্ঠায় এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে: ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের জিওসি রাত ২টায় ঘুম থেকে জাগেন তার ইন্টেলিজেন্স অফিসার দ্বারা। ইন্টেলিজেন্স অফিসারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ২ জন প্রতিনিধি ছিল। মুজিবের গুপ্ত সংবাদ নিয়ে আসা প্রতিনিধি জিওসিকে বলেন: ‘ঝযবরশয ঝধযরন রং ঁহফবৎ রসসবহংব ঢ়ৎবংংঁৎব ভৎড়স বীঃৎবসরংঃং. ঞযবু ধৎব ভড়ৎপরহম যরস ঃড় সধশব ঃযব ট.উ.ও. ঐব ফড়বংহ’ঃ ভরহফ বহড়ঁময ংঃৎবহমঃয ঃড় ৎবভঁংব ঃযবস. ঐব ংঁমমবংঃং ঃযধঃ যব নব ঃধশবহ রহঃড় সরষরঃধৎু পঁংঃড়ফু.’ (শেখ সাহেব উগ্রপন্থিদের দ্বারা বিশাল চাপে আছেন। তারা তাকে পূর্ব পাকিস্তানের একপক্ষীয় স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য চাপ দিচ্ছে। তিনি তাদের প্রত্যাখ্যান করার মতো শক্ত যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেন না। তাই তিনি পরামর্শ দিয়েছেন, তাকে সেনা তত্ত্বাবধানে নেয়ার।) জবাবে জিওসি বলেন, ‘ও ধস ংঁৎব ধ ঢ়ড়ঢ়ঁষধৎ ষবধফবৎ ষরশব গঁলরন শহড়ংি যড়ি ঃড় ৎবংরংঃ ংঁপয ঢ়ৎবংংঁৎব. ঐব পধহ হড়ঃ নব সধফব ঃড় ধপঃ ধমধরহংঃ যরং রিষষ. ঞবষষ যরস ও রিষষ নব ঃযবৎব (ধঃ ঃযব জধসহধ জধপব ঈড়ঁৎংব) ঃড় ংধাব যরস ভৎড়স ঃযব ৎিধঃয ড়ভ ঃযব বীঃৎবসরংঃং. ইঁঃ ঃবষষ যরস ঃড়ড় ঃযধঃ, রভ যব ঃধষশং ধমধরহংঃ ঃযব রহঃবমৎরঃু ড়ভ চধশরংঃধহ, ও রিষষ সঁংঃবৎ ধষষ ও পধহ- ঃধহশং, ধৎঃরষষবৎু ধহফ সধপযরহব-মঁহং- ঃড় শরষষ ধষষ ঃযব ঃৎধরঃড়ৎং ধহফ রভ হবপবংংধৎু, ৎধুব উধপপধ ঃড় ঃযব মৎড়ঁহফ. ঞযবৎব রিষষ নব হড় ড়হব ঃড় ৎঁষব, ঃযবৎব রিষষ নব হড়ঃযরহম ঃড় ৎঁষব. (আমি নিশ্চিত, মুজিবের মতো একজন জনপ্রিয় নেতা জানে কিভাবে এমন চাপ প্রতিরোধ করতে হয়। তিনি তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখতে পারেন না। তাকে বোলো, আমি সেখানে থাকব (রমনা রেসকোর্স-এ), উগ্রপন্থিদের ক্রোধ থেকে তাকে রক্ষার জন্য। কিন্তু তাকে এটাও বোলো যে, যদি সে পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে কোন কথা বলে, আমি প্রচুর পরিমাণে ট্যাঙ্ক, কামান, মেশিন গান সমবেত করব সকল দেশদ্রোহীকে হত্যা করতে এবং যদি প্রয়োজন হয়, ঢাকাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেব। ঢাকায় কেউ থাকবে না শাসন করার মতো। ঢাকায় কিছুই থাকবে না শাসন করার মতো।) শেখ মুজিবুর রহমান জিওসি’র এমন হুমকিতে ভয় পাওয়ার পাত্র নয়। বরং, দশ লক্ষাধিক লোককে সেদিন ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের হুকুম দিলে জিওসিসহ পাকিস্তানিরাই মাটির সাথে মিশে যেতে পারত। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ভাঙতে চাননি বলে এবং তিনি পাকিস্তানের দুই অংশেরই শাসনক্ষমতা চেয়েছিলেন বলে একাংশের ক্ষমতালাভের বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যান। আর দুই অংশের শাসনক্ষমতা লাভের উদ্দেশ্যে ১৬ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া খানসহ পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনাও চালিয়েছিলেন। এরপর ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে ২৫ মার্চ বাঙালি নিধন শুরু হলে শেখ মুজিব স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে বাঙালিদের পাশে না থেকে ২৮ ফেব্র“য়ারি থেকে ৬ মার্চের গভীর রাত পর্যন্ত তাকে গ্রেপ্তারের যে দাবি জানিয়ে আসছিলেন পাকিস্তানি জেনারেলদের কাছে, সেই ইচ্ছাটাই পূরণের সুযোগ করে দিলেন পাক সেনাদের। কারণ, মুজিবের বিবেচনাতে ছিলÑ এতেই তার সমস্যার সমাধান সম্ভব। উগ্রপন্থিদের স্বাধীনতার বাসনা পাক সেনারা দমিয়ে দিলে পাকিস্তানের ক্ষমতালাভের পথতো তার খোলা থাকছেই! এ কারণে ২৫ মার্চের ক্র্যাক-ডাউনের পর আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীনতা ঘোষণার ছোট্ট একটি খসড়া তৈরি করে টেপ-রেকর্ডারে ধারণ করার জন্য তা শেখ মুজিবুর রহমানকে পড়তে দিলে শেখ মুজিব খসড়াটি পড়ে নিরুত্তর থাকেন এবং এড়িয়ে যান। তাজউদ্দীন আহমদ ঘোষণাটি দিতে অনুরোধ জানালে শেখ মুজিবুর রহমান উত্তর দেনÑ ‘এটা আমার বিরুদ্ধে একটা দলিল হয়ে থাকবে। এর জন্য পাকিস্তানিরা আমাকে দেশদ্রোহের অভিযোগে বিচার করতে পারবে।’ স্বাধীনতা ঘোষণার ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমানের এ বক্তব্যও প্রমাণ করে যে, তিনি বাংলাদেশ স্বাধীনে বা পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার ব্যাপারে আন্তরিক ছিলেন না। লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজীও তার লেখা ঞযব ইবঃৎধুধষ ড়ভ ঊধংঃ চধশরংঃধহ গ্রন্থের ৯৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন: দগঁলরন যধফ হড়ঃ উবপষধৎবফ ঁহরষধঃবৎধষ রহফবঢ়বহফবহপব ড়ৎ ধিমবফ ধ ধিৎ.’ [মুজিব একপক্ষীয় (পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের) স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি কিংবা যুদ্ধ চালানোর কথাও বলেননি। অতএব, শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহানায়ক বা জাতির পিতা বলে বিবেচনা করা যায় না। বরং তাকে ‘বঙ্গশত্র“’, ‘জাতির হন্তারক’ এ জাতীয় বিশেষণে ভূষিত করা দরকার সঠিক ইতিহাস চর্চার স্বার্থে। আর একাত্তরের নিবেদিতপ্রাণ ছাত্রলীগের সদস্যসহ নিরীহ বাঙালিদের হত্যার জন্য যারা এখন মুজিবের ভাষণকে পুঁজি করে রাজনীতি করছে, এদেরকেও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত।

আমার কথা শেষ হলে রেজাউল করিম ভুট্টু কোন প্রতিক্রিয়া জানাল না। তবে আবদুল করিম ভুট্টু বললÑ ইতিহাসের এই কথাগুলো তো আমরা আসলেই জানতাম না। বেশিরভাগ বাঙালিই জানে না। মিথ্যের সঙ্গেইতো ৪১ বছর ধরে বসবাস করছি আমরা।

আমি তখন বললামÑ আরো অনেক কিছুই আমরা জানি না। আমাদের দেশটা ১৯৭১ সালে মূলত স্বাধীন হয়েছে ভারত সরকার পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করতে চেয়েছিল বলেই। ইন্ডিয়ার রাজনৈতিক সুবিধার জন্যই তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সব ধরনের পরিকল্পনা কাজে লাগিয়েছে। এমনকি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি যেন ইন্ডিয়ান সরকারের পরিকল্পনা ও পরামর্শমতোই চলে, সেজন্য মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে চুক্তিও স্বাক্ষর করে রাখে তারা। শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে ফিরে এ চুক্তি মানেননি। কারণ, তিনি মূলত ইন্ডিয়ানপন্থি ছিলেন না, তিনি ছিলেন পাকিস্তানপন্থি। তাই ইন্ডিয়ার খবরদারি মেনে নেয়ার মানসিকতা তার ছিল না। আর ইন্ডিয়ার খবরদারি মেনে না নেয়ার মানসিকতা থেকেই তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে বললেন দ্রুত ইন্ডিয়ার সৈন্যদের বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহার করতে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তার মৃত্যুর পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, মনসুর আলী, এম কামারুজ্জামানÑ এদেরকে ক্ষমতায় বসিয়ে ১৯৭১ সালে এদের সঙ্গে করা চুক্তির বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের একটা চেষ্টা ভারত সরকার চালাতে চাইলে তা টের পেয়ে কর্নেল (অব.) ফারুক এবং কর্নেল (অব.) রশীদরা জেলখানাতেই তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করে। ৪ নেতাকে জেলখানাতেই হত্যার মাধ্যমে ইন্ডিয়ার একটি মহাপকিল্পনা নষ্ট হয়ে গেলে ইন্ডিয়া এরপর জাসদকে ক্ষমতায় বসিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে নিতে চেয়েছিল। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ কর্তৃক অন্তরীণ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার নামে তাকে হত্যা করে হলেও জাসদকে ক্ষমতায় বসাতে চেয়েছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’। কিন্তু জিয়াউর রহমান ইন্ডিয়ার সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিতে পেরেছিল বলেই আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব একটা শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে জাসদ ক্ষমতা দখল করলে যা সম্ভব হতো না। কারণ, জাসদ ১৯৭৫ সালের ৮ নভেম্বর ‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই, সুবেদারের ওপর অফিসার নাই’ এই স্লে¬াগান তুলে ১২ জন আর্মি অফিসারকে হত্যা করেছিল। জাসদেরই সৈনিক শাখা ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ নামে জিয়াসহ অন্য অফিসারদের হত্যা করে ভারতীয় ফর্মুলায় গণসেনাবাহিনী নামে একটি সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে চেয়েছিল, যাতে এদেশের সামরিক শক্তি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত না পায়। জিয়া এ সময় ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত সেনাসদরে অবরুদ্ধ ছিলেন কর্নেল (অব.) তাহেরের নিয়ন্ত্রণাধীন সৈনিকদের দ্বারা। এরপর দেশের অন্যান্য স্থান হতে ঢাকায় জিয়ার অনুগত সৈন্যসংখ্যা বাড়িয়ে তিনি ‘র’ এর পরিকল্পনা নস্যাৎ করেন। যে কারণে ‘র’ ক্ষিপ্ত হয়ে বারবার জিয়াকে হত্যার চেষ্টা করে এবং ১৯৮১ সালের ৩০ মে ‘র’ এর ঢাকা অংশের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অংশের দ্বারা জিয়াকে হত্যা করতে সমর্থ হয়। কিন্তু ততদিনে এদেশের মানুষের মনে বাংলাদেশি চেতনা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায় এবং সামরিক বাহিনীও প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রনীতিও ততদিনে সুদৃঢ় হয়ে যায়। তাই বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক নেতা হিসেবে জিয়াউর রহমানের অবস্থানকে সবার ওপরেই রাখি আমি।

আমার কথা থামলে রেজাউল করিম ভুট্টু বললÑ আপনিতো দেখছি ৭ নভেম্বরের ইতিহাসও উল্টে দিচ্ছেন। আমরাতো জানি, কর্নেল (অব.) তাহের জিয়ার প্রাণ রক্ষা করেছিলেন, আর জিয়া কর্নেল (অব.) তাহেরের সঙ্গে বেইমানি করে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন।

আমি এ পর্যায়ে বললামÑ বামপন্থি নেতা হায়দার আকবর খান রনোর দেয়া তথ্য দিয়েই তাহলে তোমার প্রশ্নের জবাব দেই। হায়দার আকবর খান রনোর লেখা ‘১৯৭৫ সালের নভেম্বর, দেশ কাঁপানো সেই পাঁচ দিন’ শীর্ষক প্রবন্ধটি ১৯৯২ সালের নভেম্বর সংখ্যায় মাসিক অনুসরণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেই প্রবন্ধে রনো লিখেছেন যে, ৬ নভেম্বর গভীর রাতে বিপ্ল¬বী সৈনিক সংস্থার যে বৈঠক হয়েছিল তাতে সেনাবাহিনীতে অফিসারদের আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্ব ধক্ষংস করে দিয়ে সাধারণ সিপাহীদের গণতান্ত্রিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার এবং সেনাবাহিনীকে গণসেনাবাহিনীতে রূপান্তরের দৃঢ় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু জিয়া যে তাদের এই বৈপ¬বিক পরিবর্তন মেনে নেবেন না, এ ব্যাপারে সকলেই সন্দেহ পোষণ করছিল। তাই উপস্থিত সদস্যদের মধ্যে কোন কোন সদস্য জিয়াকে মেরে ফেলার প্রস্তাব করে। কিন্তু তাতে পরিস্থিতি তাদের বিপরীতে চলে যাবে ভেবে তাহের এই প্রস্তাবে আপত্তি জানায়। বরং জিয়াকে বিপ¬বী সৈনিক সংস্থার হেড কোয়ার্টারে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন এবং বলেনÑ জিয়ার প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন সৈন্যদের বিপক্ষে ঠেলে দেয়া হবে আত্মঘাতী। বিশেষ সংকটজনক পরিস্থিতির সুযোগ নিতে হলে জিয়াকে পক্ষে ও সঙ্গে নিতে হবে। কিন্তু জিয়া যদি সেনাবাহিনীকে গণসেনাবাহিনীতে রূপান্তরের বৈপ¬বিক পরিবর্তন মেনে না নেন তবে জিয়ার বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হবে, তা বৈঠকে স্থির হয়নি এবং সম্ভবত সে সিদ্ধান্ত তাহের ও জাসদ নেতাদের মনেই লুকিয়ে ছিল, যা প্রকাশ পায় ৮ নভেম্বর। বিপ¬বের পরিকল্পনা অনুযায়ী সবকিছু ঠিকঠাকমতো এগুচ্ছিল। কিন্তু সাধারণ সৈনিকদের কারণে কর্নেল (অব.) তাহেরের অনুসারীরা জিয়াকে বিপ¬বী সৈনিক সংস্থার হেড কোয়ার্টারে আনতে ব্যর্থ হয়। সাধারণ সৈনিকরা জিয়াউর রহমানকে পুনরায় অন্তরীণ করার পরিকল্পনা সম্বন্ধে কিছুই জানতো না। তারা জানতো যে, জিয়াকে মুক্ত করার জন্যই এ বিপ¬ব। কাজেই তারা জিয়াকে মুক্ত করে তাদের নেতার আসনে বসিয়ে কাঁধে করে নিয়ে রাস্তায় বের হয়ে এলো এবং স্লে¬াগান দিতে থাকলÑ ‘নারায়ে তাকবীর, আল্ল¬াহু আকবর, সিপাহী বিপ্ল¬ব জিন্দাবাদ, জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ’। স্লে¬াগান দিতে দিতে তারা জিয়াকে টু ফিল্ড আর্টিলারীতে নিয়ে যায়। ওদিকে একদল বিপ্ল¬বী সৈনিক সংস্থার কর্মী তাহেরকে গিয়ে এ সংবাদ জানালে তাহের রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে গোঙাতে থাকে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জিয়াকে অন্তরীণ করা ছিল একটি অনিবার্য দাবি। তাহের হাল না ছেড়ে জিয়াকে নবতর কৌশলে অন্তরীণ করার চেষ্টা করে। সুবেদার সারোয়ারকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়। সুবেদার সারোয়ার জিয়াউর রহমানকে গিয়ে বলেনÑ স্যার, কর্নেল তাহের আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। তার নেতৃত্বেই বিপ্লব হয়েছে। আপনি মুক্ত হয়েছেন। চলুন স্যার, দেখা করে আসবেন। জিয়া তার উপস্থিত বুদ্ধি ও দূরদর্শিতাকে কাজে লাগিয়ে তাহেরকে তার কাছে নিয়ে আসতে বললে কর্নেল (অব.) তাহেরের এ পরিকল্পনাও ব্যর্থ হয়। কিন্তু তখনও তাহের হাল ছাড়েননি। এবার জিয়াকে রেডিওতে ভাষণ দেবার নাম করে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে শহরে এনে অন্তরীণ করার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু কর্নেল আমিনুল হক বীর উত্তম ও কিছু উচ্চপদস্থ অফিসারের কারণে তাদের এ পরিকল্পনাও ব্যর্থ হয়। ৭ নভেম্বর যে অভ্যুত্থানটি সংঘটিত হয়েছিল, তাতে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং তার দুজন সঙ্গী নিহত হওয়া ছাড়া তেমন কোন হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু ৮ নভেম্বর জিয়াকে উৎখাতের প্রচেষ্টায় কর্নেল (অব.) তাহের জিয়া ও জিয়াপন্থি অফিসারদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিলে তাহেরপন্থি সৈনিকেরা ‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই, সুবেদারের ওপর অফিসার নাই’ ‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই’ ইত্যাদি স্লে¬াগান তুলে ক্যান্টনমেন্টে ছড়িয়ে পড়ে এবং অরাজকতা সৃষ্টি করে। তাহেরপন্থিরা অফিসার্স কোয়ার্টারে হামলা চালায়। অফিসারদের ব্যাজ কেড়ে নেয়। অফিসারদের বিতাড়িত করতে থাকে। এদিন তারা ১২ জন সেনা অফিসারকে হত্যা করে। এসব কাজের জন্য তারা বিপ্ল¬বী গণবাহিনীর সদস্যদেরও সেনানিবাসে নিয়ে আসে। ব্রিটিশ সাংবাদিক এ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস তার ‘বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ’ গ্রন্থের ১২৫ নং পৃষ্ঠায় ৮ নভেম্বর এবং এর পরবর্তী পরিস্থিতি সম্বন্ধে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেনÑ ‘ঢাকা সেনানিবাসের সেনা সদর অবরোধাধীন একটা ক্ষুদ্র দুর্গের রূপ ধারণ করে। জিয়া এবং তার সেনাসদরে কর্মরত লোকজনকে ৭দিন ধরে ওই অফিসের ভেতরেই নাওয়া-খাওয়া এবং ঘুমানোর কাজ সেরে নিতে হয়। সুবিধার জন্য তারা এ কাজ করেননি, করেছিলেন বাধ্য হয়ে। সেনা সদরের নিরাপত্তার জন্য জেনারেল জিয়া যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ৭ম, ৯ম, ১১তম ও ১২তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডো দলকে অতি দ্রুতগতিতে ঢাকায় পৌঁছনোর ব্যবস্থা করেন। ৯ তারিখের মধ্যেই ওই কমান্ডো দলগুলোকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। তাদেরকে সেনা সদরের আশেপাশে রাখার ব্যবস্থা করা হলো। এতে করে জাসদের ক্রমাগত হুমকির মোকাবিলায় আর্মি হেড কোয়ার্টার যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ইতিমধ্যেই জেনারেল জিয়া সেনাবাহিনীর বেতন বৃদ্ধি, বাসস্থান, পোশাকের প্রয়োজনীয় কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণসহ অবমাননাকর ব্যাটম্যান প্রথা বাতিল করার ঘোষণা প্রদান করেন। এতে সেনাবাহিনীর জোয়ানদের মধ্যে যথেষ্ট স্বস্তি ফিরে আসে এবং বিপ্ল¬বীভাব কেটে যেতে থাকে। এছাড়া জেনারেল জিয়া ওই সময়ে রেডিও এবং টিভিতে ভাষণের মাধ্যমে স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র থেকে সতর্ক থাকার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে পরিস্থিতি নিজের আয়ত্বে আনার প্রয়াস পান। জাসদ ৮ নভেম্বর জিয়ার বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ শুরু করে, তার ধারাবাহিকতায় ২৩ নভেম্বর সারা দেশে সর্বাত্মক অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ২৩ নভেম্বরই রব, জলিল, হাসানুল হক ইনু এবং ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ গ্রেপ্তার হন। ২৪ নভেম্বর সৈনিক সংস্থার যে গোপন সভার কথা ছিল, সেখান থেকে তাহের এবং বিপ্ল¬বী সৈনিক সংস্থার উপস্থিত সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়। এভাবেই জিয়া পরিস্থিতিকে নিজের আয়ত্বে নিয়ে আসেন এবং সেনাবাহিনীতে পূর্বের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করেন। এরপর ৭ নভেম্বর বিচারপতি সায়েমকে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধানদের উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক করে যে সরকার গঠিত হয়েছিল, সেই সরকারকে উৎখাতের প্রচেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত করে সামরিক আদালতের বিচারে কর্নেল (অব.) তাহেরকে ১৭ জুলাই, ১৯৭৬ সালে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ জারি করা হয়। প্রেসিডেন্টের কাছে তার ক্ষমার আবেদন ২০ জুলাই নাকচ করা হলে ২১ জুলাই ভোরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়।’

একটু থেমে আমি আবার বললামÑ এবার তোমরাই বলো, হায়দার আকবর খান রনো এবং এ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের লেখায় পঁচাত্তরের নভেম্বরের যে ইতিহাস উঠে এসেছে, তাতে জিয়ার দোষ বেশি? নাকি কর্নেল (অব.) তাহেরের? যদি কর্নেল (অব.) তাহের তার পরিকল্পনায় সফল হতেন, তবে বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক সেনাবাহিনী বলে কিছুই থাকতো না এবং ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমানসহ আরো কিছু দেশপ্রেমিক সামরিক কর্মকর্তার মৃত্যু ঘটে ভারত নিয়ন্ত্রিত সরকার এবং তাদের পলিসি মোতাবেক গণসেনাবাহিনী গঠিত হতো। এতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে থাকত সেই ১৯৭৫ সাল থেকেই। জিয়া ইন্ডিয়ান সরকারের সেই পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিয়ে কি ভুল করেছিলেন?

কাজী জাহের তখন বললÑ পঁচাত্তরের নভেম্বরে এবং পরবর্তীতেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জিয়ার এমন কার্যকরী ভূমিকার কথা তো আমরা জানতাম না। মিডিয়ার অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে জিয়াকেই দোষী মনে করতাম।

আমি বললামÑ এজন্যই ইতিহাস সম্বন্ধে জানতে পক্ষ-বিপক্ষ, দেশি-বিদেশি অনেক লেখকের লেখা পড়ে এবং পাশাপাশি নিজের বিবেককে কাজে লাগিয়ে সত্য বোঝার চেষ্টা করতে হয়।

রেজাউল করিম এবার বললÑ কিন্তু জিয়াউর রহমান যে এদেশে রাজাকারদের প্রতিষ্ঠা করেছে, সে বিষয়টাতো অস্বীকার করা যাবে না।

আমি বললামÑ ঠিক বলেছ, এ বিষয়টা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও কেন রাজাকারদের দেশে প্রতিষ্ঠিত করতে গেলেন, তার কারণ খুঁজে দেখতে চেয়েছ কখনো?

রেজাউল করিম বললÑ কারণ যা-ই থাক, তিনি রাজাকারদের দেশে প্রতিষ্ঠিত করে ভুল করেছেন।

আমি বললামÑ কারণ যা-ই থাক বললে তো হবে না। কারণটা কি, তাও বিবেচনায় আনতে হবে।

হাবিবুর রহমান বললেনÑ কারণটা কি বলো দেখি, আমি জানতে চাই।

আমি তখন বললামÑ শেখ মুজিবুর রহমান যে ক্ষমতায় থাকাকালে ভাষণ দিতে গিয়ে আক্ষেপ করে বলতেনÑ সব দেশ পায় সোনার খনি, আর আমি পেয়েছি চোরের খনি; সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির জন্য ৮ কোটি কম্বল এসেছে, আমার কম্বল কইÑ এ জাতীয় কথাগুলো কি শুনেছেন?

হাবিবুর রহমান বললেনÑ হাঁ শুনেছি।

আমি বললামÑ এই চোরের খনির চোর বা দুর্নীতিবাজ-লুটেরা কারা ছিল, সে সম্বন্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর বিদেশি পত্রিকাগুলোতে অনেক লেখা ছাপা হয়েছে। এর মধ্যে লন্ডন থেকে প্রকাশিত সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ১৯৭৫ সালের ১৭ আগস্ট প্রকাশিত অমিত রায়ের লেখা ‘শাসনতন্ত্র সংশোধনের ফলে’ নিবন্ধটি পড়ে দেখো। এই নিবন্ধে অমিত রায় উল্লে¬খ করেছেনÑ “সেনাবাহিনীকে মজুতদার ও চোরাকারবারী খুঁজে বের করার জন্য নিয়োগ করা হলো। কিন্তু তাদের অনুসন্ধানের ফলে যখন স্বয়ং মুজিবের ঘনিষ্ঠজনেরা জড়িত বলে প্রমাণিত হতে লাগল তখন তাড়াতাড়ি সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে পাঠিয়ে সবকিছু ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হলো। মুজিবের এসব ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের একজন হলেন গাজী গোলাম মোস্তফা, ‘যিনি বাংলাদেশের বড় চোর’ বলে কুখ্যাত। দুনিয়ার মানুষ দুঃস্থজনের জন্য রেডক্রসের মাধ্যমে উলে¬খযোগ্য সাহায্য-সামগ্রী পাঠিয়েছে, আর বাংলাদেশ রেডক্রসের প্রধান হিসেবে গাজী গোলাম মোস্তফা এসব আত্মসাৎ করে ব্যক্তিগত ধন-সম্পদ বানিয়েছেন। মোস্তফাকে রেশন বণ্টন কমিটিরও প্রধান বানানো হয়েছিল। রেশন দোকানের মালিকেরা তারই প্রত্যক্ষ মদদ নিয়ে রেশনের খাদ্য-সামগ্রী কালোবাজারে বিক্রি করে দু’হাতে টাকা লুটেছে এবং এ কালো টাকার মোটা অংশ তারা নজরানা হিসাবে মোস্তফার পকেটে তুলে দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ঢাকা ইমপ্র“ভমেন্ট কমিটির প্রধান এবং পরিত্যক্ত সম্পত্তি বোর্ডের সদস্য হিসাবেও তিনি খালি জমি ও বাড়ি বিলি-বন্দোবস্তও নিয়ন্ত্রণ করেছেন। এসবের বিনিময়ে তিনি ঘুষ নিয়েছেন দু’হাতে। উপরন্তু ঢাকা নগর আওয়ামী লীগের প্রধান হিসাবে ঢাকা মিউনিসিপলিটির উপরও তিনি কর্তৃত্ব খাটিয়েছেন। মুজিবের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসাবে তিনি ছিলেন আইনের ঊর্ধ্বে। ব্যাংক-এ ডাকাতি করে ডাকাতরা পালিয়ে যাচ্ছিল, পুলিশ গুলি ছুঁড়ল। দেখা গেল স্বয়ং মুজিবের বড় ছেলে কামাল আহতদের মধ্যে অন্যতম। স¤প্রতি সারাদেশে ১৫৩টি পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং শুধুমাত্র ৪টি পত্রিকা চালু রাখা হয়েছে। এ ৪টি পত্রিকার একটি হলো মুজিবের ভাগিনা শেখ ফজলুল হক মণির মালিকানাধীন ‘বাংলাদেশ টাইমস’। বিগত চার বছরে শেখ মুজিবের আপন ভাই শেখ আবু নাসের যতবার ঢাকা থেকে স্বীয় আদি ব্যবসা কেন্দ্র খুলনায় গিয়েছেন, তার বেশিবার লন্ডনে এসেছেন। স¤প্রতি আওয়ামী লীগের সম্পাদক জিল্ল¬ুর রহমান লন্ডনে বেড়াতে আসেন। ফেরার সময়ে তিনি ২৩টি বড় বড় বাক্স বোঝাই করে সওদা নিয়ে গেছেন।” তাহলে দেখেন, সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকায় চোরের খনির চোর হিসাবে যাদের দিকে আঙ্গুল তোলা হয়েছে, তাদেরকে আওয়ামী লীগ অতীতে যেভাবে প্রশ্রয় দিয়েছে, বর্তমানেও একইভাবে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে। চোরের খনির চোর বলে আঙ্গুল তোলা লোককে শেখ হাসিনার সরকার দেশের রাষ্ট্রপতি পদেও বসিয়েছে, আর শেখ আবু নাসেরের নামে খুলনা স্টেডিয়ামের নামকরণ করে তাকেও সম্মানিত করা হচ্ছে। জিয়াউর রহমান এ জাতীয় চোরের খনির চোর বলে আঙ্গুল তোলা লোককে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করতে চাননি, আবার ইন্ডিয়ান সরকারের ক্রীড়নকে পরিণত হবেÑ এমন লোকদেরও তিনি রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করতে চাননি। তাই এ্যান্টি-ইন্ডিয়ান এবং সৎ রাজনীতিবিদ খুঁজতে গিয়ে শাহ আজিজুর রহমানকে দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদে বসিয়েছিলেন। রাজাকার বলে তাকে গাল দেয়া গেলেও তার হাতে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব যেমন হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা ছিল না, তেমনি সৎ ছিলেন বলে তার দ্বারা দেশে দুর্নীতি বেড়ে যাবার কোন কারণও ঘটেনি। এভাবেই রাজাকারদের দেশে প্রতিষ্ঠিত করে সৎ রাজনীতি এবং এ্যান্টি-ইন্ডিয়ান রাজনীতিকে শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন জিয়া, যাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ভবিষ্যতে হুমকির মুখে না পড়ে। এজন্য জিয়ার দোষ যতটা, দেশের মঙ্গলের চিন্তাটা তার চেয়ে অনেক বড় ছিল বলে এটাই বলতে হবে যে, পরিস্থিতির চাপে তিনি মুক্তিযোদ্ধা হয়েও রাজাকারদের দেশের রাজনীতিতে টেনে আনতে বাধ্য হয়েছিলেন। এজন্য জিয়ার দোষ যতটা, তার চেয়ে অনেক বেশি দোষী ছিলেন চোরের খনির চোর এবং ভারতের স্বার্থ দেখা রাজনীতিবিদেরা। যারা এখনো সুযোগ পেলে দেশের চেয়ে ভারতের স্বার্থেই কাজ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। আর এদেরকেই কেবল তুমি জিয়ার সমালোচনা করতে দেখবে। কিন্তু ইতিহাস সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান যদি তোমার থাকে, তবে তুমি বুঝবে যেÑ জিয়ার চেয়ে বড় দেশপ্রেমিক এদেশে কেউ ছিল না। আমি বর্তমানে বিএনপির রাজনীতি করি না। ‘মানুষের দল’ নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। অর্থনৈতিক কারণে তা করতে না পারলে আ. ব. ম. মোস্তাফা আমীনের নেতৃত্বে ফরওয়ার্ড পার্টির রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারি। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসের যে সত্য আমার চোখে ধরা পড়েছে, তাতে জিয়াউর রহমানকেই বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে সবচেয়ে দেশপ্রেমিক বলে মনে করি আমি।

আমি থামলে কামরুল বললÑ আমরা তো এতোদিন ধরে অনেক বিষয়ে অজ্ঞ ছিলাম। মিথ্যেকে সত্য জেনেছি, আর প্রকৃত সত্য খুঁজে দেখার চেষ্টাও করিনি। আজ কথায় কথায় অনেক কিছুই জানলাম।

আমি তখন বললামÑ শুধু তোমরা কেন, বিএনপির সিনিয়র নেতারাও এই ইতিহাস সম্বন্ধে অবগত নয়। এমনকি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াও এসব ইতিহাস পুরোপুরি জানেন না। এজন্যই তো বিএনপি নেতারা বা তাদের সমর্থকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও তাদের সমর্থিত মিডিয়ার অপপ্রচারের জবাব দিতে পারে না।



















































সাত



বেলাল হোসেনের বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হয়েছে। ২ মাসে ৩১টা পাত্রী দেখা শেষে উত্তর কাট্টলী গ্রামের দারোগা বাড়ির নিয়াজ চৌধুরী ও রোকসানা রাজিয়ার মেয়ে ঈশিতা রাজিয়ার সঙ্গে ১০ জানুয়ারি ২০১৩-তে তাদের আকদ্ সম্পন্ন হয়। আর ১৬ জানুয়ারি ২০১৩-তে তাদের বিবাহোত্তর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কনেকে বেলালদের ঘরে আনার দিনক্ষণ ঠিক হয়। স্বপ্নময় জীবনের শুরু করবে তারা এদিন। ৩ জানুয়ারি ২০১৩-তে পাত্রীপক্ষ বেলালদের বাসায় এলে উভয় পক্ষের সম্মতিতে কমিউনিটি সেন্টার বরাদ্দ পাওয়াসাপেক্ষে ১৫-১৭ জানুয়ারির মধ্যে বিয়ের অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এরপর আমি ও ঈশিতার মামা গিয়াসউদ্দিন মিলে ১৬ জানুয়ারি কমিউনিটি সেন্টার বুকিং দিলে সেইদিনই তাদের বিবাহোত্তর অনুষ্ঠানের তারিখ হিসেবে চূড়ান্ত হয়। ৪ জানুয়ারি আবার ঈশিতাদের বাড়ি গিয়ে বিয়ের ফর্দ চূড়ান্ত করা হয়। এদিন বেলালের বাবা আব্দুল হালিম গাজী, ভাই গোলাম মোস্তফা মিলন, ভাবী সুরমা বেগম, ফুফাতো ভাই শাহীনূর, চাচাতো ভাই আজাদ, আমি ও মনি গিয়ে ঈশিতাকে আংটি পরানোর কাজটা সারি। আর আমাদের পক্ষের পুরুষদের সাথে কন্যাপক্ষের ঈশিতার জ্যেঠা হাসান চৌধুরী, হাসান চৌধুরীর ছেলে জহির উদ্দিন বাবলু, হাসান চৌধুরীর মেয়ের জামাই কুতুব উদ্দিন টিটু, তার বাবা আমির আহমদ, ঈশিতার চাচা সেলিম চৌধুরী, ইনতেখাব আলম, মোহাম্মদ হোসেন, ঈশিতার মামা বাহার উদ্দিন, ফুফাতো ভাই এনামসহ স্থানীয় সমাজকল্যাণ সংঘের সদস্যরা মিলে বিয়ের ফর্দ চূড়ান্ত করে। এরপর ১০ জানুয়ারি তাদের আক্দ্-এর দিন ঠিক করা হয়। আক্দ্ অনুষ্ঠানের দিন অন্যদের সঙ্গে বেলালের ছোট বোন তাসলিমা আক্তার আঁখির ইংল্যান্ডপ্রবাসী স্বামী আলী আশরাফ শিপনও উপস্থিত হয়েছিল। মেয়ে দেখার পর এই বিয়ের আলাপচারিতার মধ্যে ১০ দিন কেটেছে আমাদের। মেয়েকে প্রথম দেখেছি আমরা ২৫ ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে। সেদিন বেলালের মা বানেজা বেগম, বোন শারমিন আক্তার নার্গিস, মনি ও ফারজানা আক্তার লাকী, লাকীর স্বামী মঞ্জুর কাদের মঞ্জু, তাদের দুই সন্তান অথৈ ও ফারহান এবং মেয়ের পক্ষে ঘটক ছাড়াও মেয়ের মামা বাহারউদ্দিন, চাচী মিসেস সেলিম চৌধুরী ও এক ভাবী উপস্থিত ছিল। সেদিনই মেয়ের মামা বাহারউদ্দিনের মোবাইল নাম্বার নিয়ে নিয়েছিলাম আমি। এরপর তার মাধ্যমে ঈশিতার চাচা সেলিম চৌধুরীর স্ত্রী হাসিনা বেগমের মোবাইল নাম্বার পেলে চাচীর সঙ্গে আলাপ করে ২৬ ডিসেম্বরই আমরা মেয়েদের বাড়ি দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করি এবং সেই মোতাবেক উত্তর কাট্টলী যাই। ঈশিতাদের অর্থনৈতিক অবস্থা যে খুব ভালো নয়, তা সেদিনই বোঝা যায় ঘরের আসবাবপত্র দেখে। তবে তাদের বাড়ির প্রাকৃতিক পরিবেশ বিশেষভাবে সুরমা বেগম ও আমাকে মোহিত করেছিল। আর সেইসূত্র ধরে সম্পর্কটা এগিয়ে নিতে আমি বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম। সেদিনই ঈশিতার পক্ষের লোকদের ২৮ ডিসেম্বর বেলালদের বাসা পরিদর্শনের দাওয়াত দিয়ে আসি। কিন্তু বেলালের বড় ভাই গোলাম মোস্তফা মিলন অফিসের কাজে মংলা গেলে সে কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায় ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত। তার ফেরার পরেই ৩ জানুয়ারি পাত্রীপক্ষ বেলালদের বাসায় এসে বিয়ের প্রাথমিক দিনক্ষণ ঠিক করে। মনি এ উপলক্ষে ২৫ ডিসেম্বর অনাময়সহ বাপের বাড়ি যাওয়ার পর বিয়ে পর্যন্ত সেখানেই থেকে যেতে মনোস্থির করেছিল। কিন্তু ২৭ ডিসেম্বর ২০১২-তে প্রাইমারি স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করা হলে দেখা গেল অনাময় জিপিএ ৫.০০ পেয়ে পাস করেছে। দক্ষিণ কাট্টলী প্রাণহরি মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল। মনিকে অনাময়ের পাসের খবর জানালে সে আবার ছুটে আসে হালিশহরে। মনির বড় ভাইয়ের ছেলে মামুনুর রশীদ রিয়াদও একই পরীক্ষায় জিপিএ ৫.০০ পেয়ে পাস করেছে। সে অংশগ্রহণ করেছিল খুলশীর রেডিয়েন্ট স্কুল এন্ড কলেজ থেকে। ফলে মনিদের বাপের বাড়ির সবাই খুব খুশি। আমাদের পরিবারের সবাইও খুশি। তবে সবার খুশি আরো বেড়ে যায় বেলালের বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হওয়ায়। কারণ, তার ওমান যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে।



মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.