![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নাবালগেরা এবার সাবালগ হোক
কাউসার ইকবাল
ধর্মগ্রন্থসমূহে মানুষের জন্য যেসব আদেশ-উপদেশ লিপিবদ্ধ আছে, তাতে বলা যায় স্রষ্টার দৃষ্টিতে মানুষ আজো ‘মেধাগত নাবালগ’। নাবালগদের যেমন জ্ঞান দিতে হয় কোন বিষয়ে কি করা উচিত আর কি করা অনুচিত, স্রষ্টাকেও এসব বিষয়ে মানুষকে জ্ঞান দেয়ার জন্য নাবালগদের মধ্যে উত্তম কিছু সত্তা সনাক্ত করে তাদের দ্বারা মেধাগত অধম নাবালগদের জ্ঞান দিতে হয়েছে। আর এই প্রক্রিয়ায় স্রষ্টার বাছাইকৃত সর্বশেষ ‘মেধাগত উত্তম নাবালগ’ হচ্ছে রাসুল মোহাম্মদ (যার জন্য শান্তি কামনা করতে বলে দেয়া হয়েছে ‘অধম মেধাগত নাবালগদের’)। তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে এই যে, অধম মেধাগত নাবালগরা মোহাম্মদের নাম শোনামাত্র তার জন্য শান্তি কামনা করলেও পৃথিবীতে জীবন্ত পাড়া-প্রতিবেশীসহ নিজ দেশের লোকদেরও শান্তি হারাম করতে ব্যস্ত। বাংলাদেশের আলোকেই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, মোহাম্মদের অনুসারী বলে নিজের পরিচয় দানকারী আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় পার্টি, ইসলামপন্থি অন্য দলগুলোর নেতা-কর্মী-সমর্থক সকলেই দেশের সাধারণ মানুষের শান্তি কি করে হারাম করা যায়, সেই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত আছে বছরের পর বছর ধরে। আর বিশ্ব প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, ফিলিস্তিনসহ অনেক রাষ্ট্রেই তার অনুসারী বলে দাবিদারেরা সেসব এলাকার লোকদের শান্তি হারাম করে চলেছে।
মুসলিমদের মধ্যে যেমন ‘মেধাগত নাবালগের অভাব নেই, তেমনি এর পূর্ববর্তী সকল ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেও নাবালগের ছড়াছড়ি আমরা দেখেছি ও দেখছি। যেমন বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল একত্রীকরণে সবচেয়ে বড় প্রভাবক ছিল হিন্দুইজম ও মুসলিমইজম। সম্পূর্ণ বাংলা এক রাষ্ট্র হোকÑ সংকীর্ণ চিন্তার রাজনীতিবিদেরা তা চায় নাই বলেই হিন্দুইজম ও মুসলিমইজমকে উস্কে দিয়ে বাঙালিদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে রাখা হয়েছিল অতীতকাল থেকেই। সেই প্রেক্ষিতে এই এলাকার ৯০ শতাংশ মুসলমান হিন্দুইজমে প্রভাবিত ভারতীয় বাঙালিদের সঙ্গে এক রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বসবাস করতে চায়নি বলেই ১৯৪৭ সালে বাঙালিদের এক রাষ্ট্র গড়ার চিন্তা না করে বরং দূরবর্তী পাঞ্জাবি-সিন্ধিদের সাথে এক রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল বলে ১৯৭১ সালে ইসলাম ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো ‘জয় বাংলা’ বা ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদী’ স্লোগানে আকৃষ্ট না হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। কারণ, তাদের দৃষ্টিতে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয়দের দ্বারা মুসলিম জাতীয়তাবাদী পাকিস্তানকে ভাঙনের ষড়যন্ত্র। আজো সেই দৃষ্টিভঙ্গি মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে সক্রিয় বলে তারা ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের বিপক্ষে। একথা মেধাগত অধম নাবালগরা বুঝতে অক্ষম বলেই তারা বারবার বিভাজনটা উস্কে দিয়ে মন্দির ভাংচুরসহ রক্তপাত ঘটাতে ভূমিকা রেখে চলেছে। আর এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই ১৯৭১ সালে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের পরাজয় যাতে না ঘটে, সেজন্য সক্রিয় ছিল মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা। এটা করে তারা যদি ভুল করে থাকে, তবে তো মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে ইসলাম ধর্মই ত্যাগ করা উচিত ছিল প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী বাঙালিদের। কেননা, তারা নিজেদের ইসলাম ধর্মের লোক বলে দাবি করলেও হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয়দের নেতৃত্বে ও সহযোগিতায় মুসলিম জাতীয়তাবাদী পাকিস্তানি শক্তিকে পরাজিত করেছিল। এজন্য তারা ইসলাম ধর্মের অধিকারী বলে নিজের পরিচয় দেয়ার অধিকার কার্যত রাখে না। কেননা, রাসুল মোহাম্মদ ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের একের অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে, এমন কোন নির্দেশনা মুসলিমদের জন্য রেখে যাননি। কেবল অন্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গেই যুদ্ধের অনুমোদন দিয়ে গেছেন; তাও আত্মরক্ষার্থে। তাই যারা নিজেদেরকে ইসলাম ধর্মের অনুসারী বলে দাবি করেন, আবার অন্য মুসলিমের সঙ্গে বিরোধিতায় লিপ্ত হন রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলে, এরা নিজেদেরকে ‘মুসলিম’ দাবি করার অধিকার রাখে না। কিন্তু ‘মেধাগত অধম নাবালগ’ বলেই তাদের তা বোঝার ক্ষমতা নেই। তারা একদিকে নিজেদেরকে ইসলাম ধর্মের অনুসারী বলে দাবি করে, আবার অন্যদিকে যারা ইসলামী জাতীয়তাবাদের রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিল, তাদের একাত্তর সালের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলে রাষ্ট্রে বিভাজনের রাজনীতিকে উস্কে দিয়ে হিংসা-হানাহানির ক্ষেত্র বাড়িয়ে রাষ্ট্রের মানুষের শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে চলেছে এবং এজন্য অনেকের প্রাণহানির কারণও হচ্ছে। ইসলামী জাতীয়তাবাদ যদি তাদের পছন্দ না হয়ে থাকে, তবে নিজেরাও ইসলাম ধর্মকে আঁকড়ে থাকবে কেন তারা? আর ইসলাম নিয়ে রাজনীতিইবা করবেন কেন? মাথায় হিজাব পরে তাদের নেত্রী জনগণের সামনে নিজের ইসলামি পরিচয় কেন তুলে ধরবেন? রাসুল মোহাম্মদ যখন ইসলামভিত্তিক রাজনীতি করে রাষ্ট্রশাসন করেছে এবং অস্ত্র হাতে যুদ্ধও করেছে, সেহেতু ১৯৭১ সালে ইসলামভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখাকে অনেকে ধর্মীয় দায়িত্ব বলে মনে করেছে। এ কারণে যে বর্বরতা হয়েছে, সেজন্য ইসলামভিত্তিক জাতীয়তাবাদীদের যদি দোষারোপ করা হয়, সেই দোষ তাদের ওপরও ততটা বর্তাবে। কারণ, তারাও নিজেদের ইসলাম ধর্মের লোক বলে দাবি করে।
আর যদি বাঙালি জাতীয়তাবাদকেই প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান তারা তুলে থাকে, তবে এই স্লোগানকে পূর্ণতা দিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা ছাড়া তো বিকল্প কিছু নেই। ১৯৭১ সালে যদি ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্লোগান তুলত বাঙালি তরুণরা এবং সেই লক্ষ্যেই যদি ইন্ডিয়ান সরকার ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ প্রতিষ্ঠায় বাঙালিদের সহযোগিতা করত, তবে এটা প্রমাণিত হতো যে, ভৌগলিক জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠায় ইন্ডিয়ান সরকার এ অঞ্চলের বাঙালিদের সহযোগিতা করছে। কিন্তু ইন্ডিয়ান সরকার যেহেতু ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকেই প্রতিষ্ঠা করতে এ অঞ্চলের বাঙালিদের সহযোগিতা করেছে এবং ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ ইন্ডিয়ান কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গানকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছে, সেহেতু পশ্চিম বঙ্গসহ পুরো সোনার বাংলাকে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত করতে দাবি জানানো উচিত ছিল স্বাধীনতাপরবর্তী সরকারের ইন্ডিয়ান সরকারের কাছে। এই দাবিটা তখনই জোরালো করা দরকার ছিল যে, ব্রিটিশরা যেমন করে ১৯৪৭ সালে বিনা যুদ্ধে ভারতের রাষ্ট্র পরিচালনার ভার ভারতীয়দের কাছে হস্তান্তর করেছিল, তদ্রুপ ভারত সরকার বিনা যুদ্ধে বাংলার বাকি অংশটুকু পরিচালনার দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের হাতে হস্তান্তর করুক। কেননা, পুরো সোনার বাংলাকে নিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র গড়ে না উঠলে ‘বাংলাদেশ’ নামকরণটাও তো যথার্থ হয় না। ভারত সরকার যেটুকু বাংলাকে স্বাধীন করতে সহযোগিতা করেছে, তাকে তো ‘অর্ধ বাংলাদেশ’ নামকরণ করাটাই যৌক্তিক। আর ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটাও তো ততদিন পর্যন্ত পূর্ণ হবে না, যতদিন পর্যন্ত পুরো সোনার বাংলা এক দেশের অন্তর্ভুক্ত না হবে। অনেকদিন পর ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের যথার্থ কিছু উত্তরসূরির সাক্ষাৎ পাওয়া গেল শাহবাগে। কিন্তু তারাও ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে পূর্ণতা দিতে ‘বাঙালি বাঙালি ভাই ভাই, সকল বাঙালির ঐক্য চাই’; ‘বাঙালি বাঙালি ভাই ভাই, এক দেশেই থাকতে চাই’; ‘বাঙালি বাঙালি ভাই ভাই, ধর্ম নিয়ে বিভেদ নাই’ এমন কোন স্লোগান না তুলে ইসলামি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীদের সঙ্গেই বিবাদে লিপ্ত হয়েছে। অন্য অংশের বাঙালিদের তারা তো এটা বোঝাতে তৎপর নেই যে, বাঙালিরা যতদিন পর্যন্ত ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’কে কেন্দ্র করে এক রাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে না উঠবে, ততদিন পর্যন্ত তারা পৃথিবীতে মীরাক্কেল-আক্কেল চ্যালেঞ্জার-এর সবচেয়ে বড় জোকস বনে থাকবে। কেননা, অর্ধেক বাঙালিকে বাইরে রেখেই বাংলা নামে দেশ; আর সেই দেশের জাতীয় সঙ্গীত আবার সম্পূর্ণ বাংলাকে কেন্দ্র করেÑ এমন হাস্যকর বিষয় পৃথিবীর আর কোন জাতির ক্ষেত্রে ঘটছে বলে উদাহরণ নেই। অতএব, ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে পূর্ণতা দিতে তোমরা সকলেই বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হতে ভারত সরকারের কাছে দাবি জানাও। এমন দাবি তো প্রগতিশীলরা রাখছে না।
প্রগতিবাদীরা বিজ্ঞানে বিশ্বাসী। আর প্রাণিবিজ্ঞানী ডারউইন বলে গেছেন, বানর প্রজাতি বিবর্তনের মাধ্যমেই মানুষের সৃষ্টি। অর্থাৎ, বিজ্ঞানের ভাষায় মানুষের অতীত হচ্ছে জানোয়ারমুখী। আর মানুষের মধ্যে অতীতমুখী চর্চা যখন বেশি চলে, তখন মানুষ জানোয়ারের মতোই আচরণ করে থাকে এজন্যই নিশ্চয়। বর্তমান বাংলাদেশেও তারই প্রতিফলন যেন দেখা যাচ্ছে। অতীতমুখী প্রবণতায় মহিষ-গণ্ডারের লড়াই-ই চলছে যেন দেশজুড়ে। বানর প্রজাতি বিবর্তিত হয়ে কেহ ‘মেধাগত মহিষ’ আর কেহ ‘মেধাগত গণ্ডার’ হয়েছে, এমন কথাই বাংলাদেশের বাস্তবতায় পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর কারণও মূলত ‘মেধাগত নাবালগত্ব’।
সকল তরুণের উদ্দেশেই যে কথাটি বলতে চাই তার সারমর্ম হচ্ছে, তারুণ্যের বিভাজন যে কোন জাতির জন্যই আত্মঘাতী। আর তারুণ্যের ঐক্যই একটা জাতির প্রাণশক্তি। বাংলাদেশিদের প্রাণশক্তি হরণের চেষ্টা বহু পূর্ব থেকেই বিদেশিরা করে আসছে। তাই নাবালগত্ব পরিহার করে মেধাগত সাবালগ হবার সময় এসেছে। তরুণদের মেধাগত সাবালগত্বের ওপরই নির্ভর করবে বাংলাদেশের মানুষের শান্তি।
©somewhere in net ltd.