![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কাউসার ইকবালের দর্শন
দার্শনিক হচ্ছেন তিনি, যিনি সত্য দেখেন তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে। এতে কোটি মানুষের চোখে সাদামাটাভাবে যা সত্য বলে মনে হয়, দার্শনিক তা যুক্তি দিয়ে মিথ্যে বলে প্রমাণ করে দেন। আমার দর্শন ‘মুক্তমত’ গ্রন্থ থেকে এখানে তুলে ধরা হলো:
১। জ্ঞানীরাই পাপমুক্ত থাকে, মূর্খরা পাপী হয়েই রয়।
২। পৃথিবীর প্রথম মানবের বংশধর হিসেবে মানুষেরা প্রত্যেকেই একে অপরের আত্মার আত্মীয়। কিন্তু কোটি কোটি বছর ধরে মানুষের জন্য ভীষণ পরিহাসের ব্যাপার হচ্ছে এই যে, মানুষেরা নিজেদেরকে মানুষ বলে পরিচয় দেয়ার সাহস রাখে না। হিন্দু, মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈনÑ এসব পরিচয়ের বৃত্তে আটকে আছে মানবজাতি।
৩। মানুষেরা বোঝার চেষ্টা করে না যে, নিজেদেরকে হিন্দু, মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন বলে পরিচিত করলে তারা মানবজাতির একাংশের প্রতিনিধি বলে বিবেচিত হন। কিন্তু নিজেদেরকে মানুষ বলে পরিচিত করে তারা গোটা মানবজাতির প্রতিনিধি হবার চেষ্টা করলে তা হতো আরো বেশি গৌরবের বিষয়। মানবতার কল্যাণের লক্ষ্যে তখন তারা আরো বেশি ভূমিকা রাখতে পারতেন।
৪। মানুষেরা বোঝার চেষ্টা করুক, হিন্দু, মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ ইত্যাদি স¤প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পশুদের মতো একে অপরের রক্ত ঝরানোর খেলায় মেতে থাকা মানুষের জন্য শোভনীয় নয়।
৫। মানুষেরা বোঝার চেষ্টা করুক যে, মানুষ হিসেবে জন্ম নিয়ে নিজেদেরকে ‘মানুষ’ বলে পরিচয় দেয়ার সাহস না করাটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় অধর্ম। আর ‘মানুষ’ বলে পরিচয় দেয়ার সাহস দেখানোটাই হচ্ছে প্রকৃত ধর্ম।
৬। সামর্থ্য থাকা সত্বেও যারা দুর্গত ও দরিদ্র মানুষের সাহায্যার্থে এগিয়ে যায় না, তারা অমানুষ।
৭। দুর্গত ও দরিদ্র মানুষের অসহায়ত্ব নিয়ে যারা রাজনীতি করে, তারা অমানুষ।
৮। মানুষের কান্না দেখে যাদের প্রাণ কাঁদে না, তারা অমানুষ।
৯। দুর্গত ও দরিদ্র মানুষের সাহায্যার্থে অর্থ ব্যয় না করে যারা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বা উৎসবে অর্থ ব্যয় করাকেই প্রাধান্য দেয় বেশি, তারা অমানুষ।
১০। দারিদ্র্য বিমোচনের নামে যারা দরিদ্রদের নিয়ে বাণিজ্য করে নিজেরাই ধনী হয়ে ওঠে, তারা অমানুষ।
১১। অর্থলোভ যাদের মধ্যে বেশি কাজ করে, তারা অমানুষ।
১২। ঈর্ষাবোধ যাদের অন্তরে বেশি কাজ করে, তারা অমানুষ।
১৩। যারা দরিদ্রদের প্রাপ্য অর্থ আত্মসাৎ করার চেষ্টা করে, তারা অমানুষ।
১৪। যারা ধর্ম নিয়ে মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ সৃষ্টির চেষ্টায় রত থাকে, তারা অমানুষ।
১৫। যারা রাজনীতি নিয়ে মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ সৃষ্টির চেষ্টায় রত আছে, তারা অমানুষ।
১৬। যারা মানুষের সাদা-কালো বর্ণ নিয়ে ভেদাভেদ সৃষ্টির চেষ্টায় রত থাকে, তারা অমানুষ।
১৭। যারা ঘুষ নেয় ও দেয়, তারা অমানুষ।
১৮। যারা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করে, তারা অমানুষ।
১৯। যারা অন্যের অর্থ-সম্পদ চুরি বা লুট বা কৌশলে কুক্ষিগত করার চেষ্টা করে, তারা অমানুষ।
২০। যারা অন্যের সম্পদ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে নষ্ট করার চেষ্টা করে, তারা অমানুষ।
২১। অন্যে অমানুষ হয়েছে বলে আমাকেও অমানুষ হতে হবেÑ এমন মনোবৃত্তি প্রত্যেকেরই পরিহার করে চলা উচিত।
২২। যারা অন্যের সংসার ভাঙার চেষ্টা করে, কিংবা কারো স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে জেনে-বুঝে পরকীয়া প্রেমে আবদ্ধ হতে চায়, তারা অমানুষ।
২৩। যে নারী বা পুরুষ তার অথবা অন্য কারো পারিবারিক শান্তি ও ঐক্য বিনষ্টে কূটকৌশল প্রয়োগ করে, তারা অমানুষ।
২৪। যারা যৌতুকের লোভে নারীর বা তার নিকটাত্মীয়দের ওপর শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন চালায়, তারা অমানুষ।
২৫। যারা কারো অজান্তে তার নগ্ন দেহের বা দেহাংশের চিত্র ক্যামেরা বা ভিডিও বা অন্য কোনো যন্ত্রে ধারণ করে, তারা অমানুষ।
২৬। যারা নারীর নগ্ন দেহ নিয়ে বাণিজ্য করে, তারা অমানুষ; আর যে নারীরা অর্থ লাভের আশায় স্বামী ছাড়া অন্য কোনো পুরুষকে নগ্ন দেহ বা দেহের উত্তেজক অংশ প্রদর্শন করে, তারাও অমানুষ।
২৭। যারা নারীকে দেহ ব্যবসায় নিয়োজিত করতে বাধ্য করে, তারা অমানুষ; আর যারা এমন কাজে সহায়তা করে কোনো না কোনোভাবে, তারাও অমানুষ; যে নারীরা নিজেদেরকে দেহ ব্যবসায় নিয়োজিত করে, তারাও অমানুষ।
২৮। যারা নারীকে ধর্ষণ করার বা নারীর সতীত্ব হরণের চেষ্টা করে, তারা অমানুষ; আর যারা নারীর সতীত্ব হরণে সহায়তা করে, তারাও অমানুষ; একইভাবে যে নারীরা যৌনাবেদনময়ী পোশাকে কিংবা প্রায় নগ্ন অবস্থায় ঘর হতে বের হয়, তারাও অমানুষ।
২৯। যারা নারীর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বা নারীকে কৌশলে ফাঁদে ফেলে তার দেহ ভোগ করতে সচেষ্ট হয়, তারাও অমানুষ।
৩০। যারা দেহ লাভের বিনিময়ে নারীকে অর্থ দিতে সম্মত থাকে, কিন্তু নারীর সাহায্যার্থে অর্থ খরচ করে না, তারা অমানুষ।
৩১। যারা ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, তারা অমানুষ। ব্যভিচারের ফলে জন্ম নেয়া শিশুকে যারা ত্যাগ করে, কিংবা হত্যা করে, তারাও অমানুষ।
৩২। যারা নারী বা পুরুষকে মিথ্যে আশা দিয়ে প্রেমের জালে আবদ্ধ করে ও পরে ধোঁকা দেয়, তারা অমানুষ।
৩৩। যারা নারী-পুরুষ তথা ছেলেমেয়ের প্রেমকে হত্যার চেষ্টা করে, তারা অমানুষ।
৩৪। যারা প্রেমে ব্যর্থ হয়ে প্রেমিক বা প্রেমিকার কোনো ধরনের ক্ষতি করার চেষ্টা করে, তারা অমানুষ।
৩৫। যারা মিথ্যাচারিতা বা চুক্তিভঙ্গের মাধ্যমে অপরকে ঠকায়, তারা অমানুষ।
৩৬। যারা অতি আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা করে, পরকল্যাণে ভাবে কম, তারা অমানুষ।
৩৭। যারা স্বীয় স্বার্থে অন্যদের অসহায় করে ফেলে, তারা অমানুষ।
৩৮। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা বা খেলাধুলা বা প্রেমঘটিত বিষয় ছাড়া যারা স্বীয় স্বার্থে অন্যের দুঃখ বাড়ায়, তারা অমানুষ।
৩৯। পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে সদস্যরা নিরপরাধ ব্যক্তিকে আটক করে অর্থের বিনিময়ে শাস্তি বা মুক্তির ব্যবস্থা করে দেয়, তারা অমানুষ।
৪০। পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে সদস্যরা অপরাধী ব্যক্তিকে আটক করে অর্থের বিনিময়ে মুক্তি দেয় বা তার মামলা হালকা করে দেখায়, তারা অমানুষ।
৪১। পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে সদস্যরা সাধারণ ডায়েরি লেখা বা সত্য প্রতিপাদন উপস্থাপন করা সহ তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য সাধারণের কাছে অর্থ দাবি করে, তারা অমানুষ।
৪২। পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে সদস্যরা মানবিক ব্যাপারগুলো বুঝতে চায় না এবং নিরপরাধ ব্যক্তিদের সঙ্গেও বর্বর আচরণ করে, তারা অমানুষ।
৪৩। পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে সদস্যরা অর্থ বা অন্য যে কোনো ধরনের সুবিধা লাভের বিনিময়ে অপরাধীদের সহায়তা করে, তারা অমানুষ।
৪৪। পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে সদস্যরা রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, কিংবা যে কোনো ধরনের অন্যায় পথ অবলম্বন করে, তারা অমানুষ।
৪৫। যারা ক্ষমতার দাপটে অন্যায় কাজ করে, তারা অমানুষ।
৪৬। আইনজীবীদের মধ্যে যারা জেনে-বুঝে প্রকৃত অপরাধীর পক্ষে মামলা লড়ে, তারা অমানুষ।
৪৭। বিচারকদের মধ্যে যারা ভুক্তভোগীর প্রতি ন্যায়বিচার করে না, তারা অমানুষ।
৪৮। বিচারকদের মধ্যে যারা অর্থের বিনিময়ে অপরাধীকে জামিন প্রদান করে কিংবা মুক্তি দেয়, তারা অমানুষ।
৪৯। বিচারকদের মধ্যে যারা কারো পক্ষে পক্ষপাতিত্ব করে মামলার রায় দেয়, তারা অমানুষ।
৫০। যারা সেবামূলক উদ্দেশ্যের পরিবর্তে চিকিৎসার নামে বাণিজ্য করার আশায় হাসপাতাল/ক্লিনিক/প্যাথলজি খুলে রোগীদের ওপর জুলুম করছে, তারা অমানুষ।
৫১। যে চিকিৎসকেরা তার জীবন-জীবিকার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের অতিরিক্ত রোগীদের কাছ থেকে আদায় করে থাকে, তারা অমানুষ।
৫২। যে চিকিৎসকেরা প্যাথলজি থেকে কমিশন লাভের মাধ্যমে বাড়তি টাকা আয়ের আশায় রোগীর রোগ সম্বন্ধে বোঝার পরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে রোগীর চিকিৎসা ব্যয় বাড়িয়ে দেয়, তারা অমানুষ।
৫৩। যে চিকিৎসকেরা অপরাধীদের স্বার্থে ডাক্তারি রিপোর্ট দেয়, কিংবা সুস্থ মানুষকে পাগল বলে প্রতীয়মানের চেষ্টা করে, কিংবা চিকিৎসার নামে কারো ক্ষতি সাধনের চেষ্টা করে, তারা অমানুষ।
৫৪। হাসপাতাল/ক্লিনিকের যে কর্মকর্তা-কর্মচারী বা ডাক্তাররা দরিদ্র রোগীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে, কিংবা তাদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখে প্রাপ্য চিকিৎসা সেবা প্রদান থেকে বঞ্চিত করে, তারা অমানুষ।
৫৫। দরিদ্র ও অসহায় গুরুতর রোগীকে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা সেবা দেয়া থেকে বঞ্চিত করে যারা ধনবান রোগীর সেবায় বেশি ব্যস্ত হয়ে ওঠেÑ তার রোগ গুরুতর না হলেও, তারা অমানুষ।
৫৬। হাসপাতাল/ক্লিনিকের যে চিকিৎসক বা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রোগীদের জন্য বরাদ্দকৃত ওষুধ বা চিকিৎসা সরঞ্জাম বিক্রি করে অর্থ হাতিয়ে নেয় এবং রোগীদের যথার্থ চিকিৎসা সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত করে, তারা অমানুষ।
৫৭। হাসপাতাল/ক্লিনিকের যে পুরুষ চিকিৎসক বা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মহিলা রোগীর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তার শরীরের স্পর্শকাতর অঙ্গ স্পর্শ করার চেষ্টা করে, তারা অমানুষ; এছাড়া অন্য যে কোনো স্থানে যারা নারীর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তার শরীরের স্পর্শকাতর অংশ স্পর্শ করার চেষ্টা করে, তারাও অমানুষ।
৫৮। হাসপাতাল/ক্লিনিকের যেসব কর্মচারী বেতন পাওয়ার পরও রোগীদের প্রতি তাদের দায়িত্ব পালনের জন্য রোগীর অভিভাবকের কাছ থেকে অর্থ দাবি করে, তারা অমানুষ।
৫৯। হাসপাতাল/ক্লিনিকে যারা দালাল হিসেবে কাজ করে রোগীর অভিভাবকের কাছ থেকে নানা কৌশলে টাকা হাতিয়ে নিতে তৎপর থাকে, তারা অমানুষ।
৬০। দরিদ্র ও নিরুপায় রোগীদের যারা চিকিৎসা সেবা দিতে অস্বীকৃতি জানায়, তারা অমানুষ।
৬১। শিক্ষা প্রদান বিষয়ে যারা বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে এবং মেধা থাকা সত্ত্বেও বড় অংকের অর্থ না পেলে বিদ্যালয়/মহাবিদ্যালয়/বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র/ছাত্রী ভর্তি হবার সুযোগ দেয় না, তারা অমানুষ।
৬২। যে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট বা সমিতি করে সকল এলাকায় একই ধরনের মূল্য আদায়ে তৎপর হয়ে সাধারণ ব্যবসায়ী ও মানুষকে জিম্মি করে রাখে, তারা অমানুষ।
৬৩। যারা পণ্য মজুতের মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে, তারা অমানুষ।
৬৪। যারা খাদ্যদ্রব্যে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে মানুষের শারীরিক ও আর্থিক ক্ষতি সাধনে ভূমিকা রাখে, তারা অমানুষ।
৬৫। যারা পচনশীল দ্রব্য তাজা থাকা অবস্থায় যথামূল্যে বিক্রি না করে বেশি লাভে বিক্রির আশায় তা পচিয়ে নষ্ট করে, তারা অমানুষ।
৬৬। যে ব্যবসায়ীরা তার জীবন-জীবিকার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের অতিরিক্ত মানুষের কাছ থেকে আদায় করে থাকে, তারা অমানুষ।
৬৭। যারা পচা বা দুর্গন্ধযুক্ত বস্তু ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যের ঘরে বা ঘরের আঙিনায় ফেলে, তারা অমানুষ।
৬৮। গাড়ি ও বাড়িওয়ালাদের মধ্যে যারা তার জীবন-জীবিকার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের অতিরিক্ত মানুষের কাছ থেকে আদায় করে থাকে, তারা অমানুষ।
৬৯। যারা যাত্রীদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে যানবাহনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে বা এমন নিয়তে নানা কৌশলে যাত্রীদেরকে অতিরিক্ত ভাড়া প্রদানে বাধ্য করে, তারা অমানুষ। আর প্রশাসনের যারা এ ধরনের যানবাহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আঁতাত করে যানবাহন শ্রমিকদেরকে রাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকদের ওপর জুলুম করার সুযোগ দিয়ে জনসাধারণের পরিবহন ব্যয় বাড়িয়ে দেয় এবং জনগণের মানসিক অশান্তির কারণ হয়, এরাও অমানুষ। এ জাতীয় অমানুষদের শাস্তি দেয়ার জন্য রাষ্ট্রের সাধারণ জনগণের ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া অন্য কোন পথ খোলা নেই। জনতার শক্তিই এ জাতীয় অমানুষদের লোভ দমন করতে পারে।
৭০। মানুষ হত্যার উদ্দেশ্যে যারা অস্ত্র তৈরি করে, তারা অমানুষ; যারা সেই অস্ত্র নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করে, তারাও অমানুষ; আর যারা সেই অস্ত্র ব্যবহার করে মানুষের আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি সাধনের চেষ্টা করে, তারাও অমানুষ।
৭১। যারা আত্মহত্যা করেÑ কিংবা আত্মঘাতী বোমা হামলার মাধ্যমে অনেকের প্রাণহানি ঘটায় ও অনেককে পঙ্গু করে দেয়, তারা অমানুষ।
৭২। ধর্ম ও রাজনীতির ভিন্নমতের কারণে যারা মানুষ হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করে কিংবা বর্বর হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্যে যারা মানুষের ওপর বোমা বা অন্য যে কোনো ধরনের মারণাস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়, তারা অমানুষ; যারা এমনতরো হামলাকে সমর্থন করে, তারাও অমানুষ।
৭৩। যারা অন্যকে অশ¬ীল ভাষা প্রয়োগ করে গালি দেয়, তারা অমানুষ।
৭৪। যারা শ্রমের অতি মজুরি দাবি করে, তারা অমানুষ।
৭৫। যারা শ্রমিকের যথার্থ পারিশ্রমিক যথাসময়ে পরিশোধ করে না, তারা অমানুষ।
৭৬। যারা শ্রমিকের পাওনা পরিশোধের চেয়ে আভিজাত্য প্রতিষ্ঠা বা রক্ষায় হজ্ব করা কিংবা যাকাত দেয়া কিংবা যে কোনো ধরনের ধর্মীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠানে অর্থ খরচ করাকেই প্রাধান্য দেয়, তারা অমানুষ।
৭৭। যারা শিশুদের ভালোবাসে না, তারা অমানুষ।
৭৮। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যারা অপরের পাওনা পরিশোধ না করে মানুষকে ভোগায়, তারা অমানুষ।
৭৯। ধনবানদের মধ্যে যারা সমাজের তথা বিশ্বের দারিদ্র্য বিমোচনে নিজ নিজ সাধ্য অনুযায়ী যথাযথ ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট হয় না, তারা অমানুষ।
৮০। যারা অধূমপায়ীদের সম্মুখে ধূমপান করে, তারা অমানুষ।
৮১। যারা ক্ষতিকর নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ বা নেশাজাতীয় দ্রব্যের ব্যবসা করে, তারা অমানুষ।
৮২। জীবিকা নির্বাহের জন্য অন্য উপায় থাকার পরও যারা অল্প পরিশ্রমে অধিক আয় করার আশায় ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত হয়, তারা অমানুষ।
৮৩। যারা বিবেকহীন ও অসুস্থ মস্তিষ্কের লোকদের বিবেকবান মানুষে পরিণত করতে সচেষ্ট হয় না, তারা অমানুষ।
৮৪। যারা সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয় না, তারা অমানুষ।
৮৫। খেলাধুলার মাঠেও যারা কোনো খেলোয়াড়ের শারীরিক এমনই ক্ষতির চেষ্টা করেÑ যাতে সে গুরুতর আহত হয় কিংবা তার খেলোয়াড়ি জীবনই নষ্ট হয়ে যায়, তারা অমানুষ।
৮৬। বর্বরতা প্রদর্শিত হয়Ñ এমন খেলাধুলায় যারা অংশগ্রহণ করে এবং এমন খেলাধুলার আয়োজন যারা করে, তারা অমানুষ।
৮৭। বিক্রি হয়ে যাওয়া জিনিস যারা হস্তান্তরের আগেই বাড়তি অর্থের লোভে অন্যের কাছে বিক্রি করে দেয়, কিংবা কৌশলে সেই জিনিসটা বদলে মন্দ অনুরূপ কিছু ক্রেতাকে বুঝিয়ে দেয় বা দিতে চেষ্টা করে, তারা অমানুষ।
৮৮। যারা মানুষের সঙ্গে যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াইÑ কিংবা তুচ্ছ কারণে চরম দুর্ব্যবহার করে, তারা অমানুষ।
৮৯। যারা যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ ছাড়াইÑ কিংবা তুচ্ছ কারণে শ্রমিক ছাঁটাই করে, তারা অমানুষ।
৯০। যারা অকস্মাৎ শ্রমিক ছাঁটাই করে, কিন্তু শ্রমিককে কিছুদিনের ভরণ-পোষণের মতো অর্থ প্রদান করে না, তারা অমানুষ।
৯১। যারা মুখে মধু অন্তরে বিষ নিয়ে মানুষের সঙ্গে শক্রুতামূলক আচরণ করে, তারা অমানুষ।
৯২। জ্ঞান প্রদান সংক্রান্ত বিষয় ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে যারা জেনে-বুঝে অপরের জন্য দুঃখ সৃষ্টি করে, তারা অমানুষ।
৯৩। যারা মানুষের সঙ্গে প্রতারণা ও ভণ্ডামিসহ বিভিন্নভাবে মানুষকে ঠকায় ও ভোগায়, তারা অমানুষ; যারা অন্যের আমানত খেয়ানত করে, তারাও অমানুষ।
৯৪। যারা কাউকে আত্মহত্যা করার মতো পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয়, তারা অমানুষ।
৯৫। দারিদ্র্যের চাপে মা তার সন্তানকে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয় যে সমাজে, সে সমাজের ধনবান প্রত্যেকেই অমানুষ।
৯৬। যারা অপ্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় করে, তারা অমানুষ।
৯৭। যারা উপযুক্ত কারণ ছাড়াই কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকে এবং দায়িত্ব পালন না করেই সেই সময়গুলোকে কর্মক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করে বেতন-ভাতা গ্রহণ করে, তারা অমানুষ।
৯৮। যারা মানবকল্যাণে নিজেদের মেধা, শ্রম ও অর্থ সাধ্যানুযায়ী কাজে লাগায় না, তারা অমানুষ।
৯৯। যারা কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাউকে বিয়ে দেয়, তারা অমানুষ; একইভাবে কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে যারা তাকে কৌশল খাটিয়ে কিংবা জোরপূর্বক বিয়ে করতে বাধ্য করার চেষ্টা করে, তারাও অমানুষ।
১০০। যারা মানুষের সুখ-শান্তি নষ্ট করতে কু-বুদ্ধি ও কু-চিন্তায় নিজেদের ব্যস্ত রাখে, তারা অমানুষ।
১০১। যারা মানুষের প্রতি সহায়তামূলক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে না এবং মানুষকে সাধ্য অনুযায়ী সহায়তা করতে সচেষ্ট হয় না, তারা অমানুষ।
১০২। যারা মিথ্যা তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত করে স্বীয় বা গোষ্ঠী স্বার্থ হাসিলে কাজ করে, তারা অমানুষ।
১০৩। যারা জেনে-শুনে সত্য গোপন করে, কিংবা সত্যকে চাপা দিতে তৎপর থাকে, তারা অমানুষ।
১০৪। যারা মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা বীমা ব্যবসার ফাঁক-ফোঁকর তথা ক্ষতিকর দিকগুলো মানুষকে না জানিয়ে অর্থনৈতিকভাবে কেবল নিজে লাভবান হতে গিয়ে অন্যকে ভবিষ্যতে ক্ষতির মুখোমুখি করে দেয়, তারা অমানুষ।
১০৫। মানুষকে মানুষ হতে হবে নৈতিক দায়বদ্ধতায়Ñ বেহেশতের লোভ কিংবা দোজখের ভয়ে নয়। তাহলেই কেবল একজন মানুষ নিজেকে যথার্থ মেধাসম্পন্ন মানুষ বলে দাবি করতে পারে। আর যে বেহেশতের লোভ কিংবা দোজখের ভয়ে সৎ পথে চলে, তার বুদ্ধি তো ৫/৬ বছর বয়সী সেই শিশুর মতো, যাকে চকলেট বা খেলনা গাড়ির লোভ দেখিয়ে কিংবা ভূত-পেতœী বা বেতের আঘাতের ভয় দেখানোর মাধ্যমে দুষ্টুমি থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে অভিভাবকেরা। পরিণত বয়সের মানুষকে যদি এমন করে লোভ ও ভয় দেখানোর মাধ্যমে সৎ পথে চলা বা নৈতিকতার শিক্ষা দিতে হয়, তবে তো তা তার বুদ্ধিশূন্যতাকেই প্রকট আকারে উপস্থাপন করে।
১০৬। ধর্মগুলো মানুষকে নৈতিকতা শেখানোর জন্য যেমন চেষ্টা করেছে, তেমনি স্বীয় ধর্মের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে উগ্রপন্থা অবলম্বনের শিক্ষাও দিয়েছে। যে কারণে ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠী পর্যায়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যুদ্ধ-বিগ্রহও কম ঘটেনি পৃথিবীতে এবং এ জাতীয় ঘটনা ঘটেই চলেছে। কিন্তু মানুষেরা যদি স্বীয় নৈতিকতাবোধকে জাগ্রত করে চলত পৃথিবীতে, তবে এ জাতীয় ঘটনাগুলো এড়িয়ে চলতে পারত।
১০৭। ধর্মীয় নির্দেশ মোতাবেক ধর্মাচারকে মানুষ বেশি প্রাধান্য দেয়াতে সর্বযুগেই একশ্রেণীর লোক তা নিয়ে অতি বাণিজ্যে মেতে উঠেছে। এছাড়া মানুষের নিত্যদিনকার প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী নিয়েও অতিবাণিজ্য চলেছে ও চলছে হরদম। ধর্মীয় নির্দেশ এ থেকে মানুষকে নিবৃত্ত রাখতে পারেনি। এ থেকেই প্রমাণিত যে, মানুষের নিজস্ব নীতিবোধ জাগ্রত না হলে ধর্মীয় নির্দেশে মানুষ আসলে যথার্থ বিবেকসম্পন্ন মানুষ হতে পারে না। তাইতো অতি মুনাফার প্রবণতা থেকে ধর্মীয় নির্দেশ পালনকারীদের অতীতেও নিবৃত্ত করা যায়নি, বর্তমানেও যাচ্ছে না।
১০৮। পার্থিব জীবনের ধন-দৌলত মৃত্যুর পর সন্তানদের কাজে লাগে ঠিকই, কিন্তু অন্যের ওপর জুলুম করে আয়ের পাপ করা প্রজ্ঞাসম্মত কাজ নয়।
১০৯। শতভাগ মুনাফা করে মানুষের ওপর জুলুম যারা করছেন, তারা আড়াই শতাংশ অর্থ জাকাত দিলে, কিংবা কিছু অর্থ দান-খয়রাত করলে বা সামাজিক প্রতিষ্ঠানে অনুদান দিলে বা রাষ্ট্র কর্তৃক ধার্যকৃত কর যথার্থভাবে দিলে তার অর্থ আয় রাষ্ট্র ও ধর্মীয় দৃষ্টিতে এবং সমাজের অনেকের কাছে বৈধতা পেলেও নৈতিকতার মাণদণ্ডে তাকে বিবেকসম্পন্ন মানুষ বা মনুষ্যত্ববোধসম্পন্ন মানুষ বলা যায় না কিছুতেই। আর নিজস্ব নীতিবোধকে জাগ্রত করতে না পারলে এ কথার মর্মার্থ বোঝাও সম্ভব নয় তাদের পক্ষে।
১১০। নিজস্ব নীতিবোধ যাদের মধ্যে জাগে না, গীতা-বেদ-ইঞ্জিল-তাওরাত-যবুর-কোরআন পড়েও তারা যথার্থ মানুষ হতে পারে না। বর্তমান পৃথিবীই তার জ্বলন্ত স্বাক্ষী। মানুষের যদি এই বিবেকবোধ না থাকে যেÑ কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায়; কী কাজ করা উচিত, কী কাজ করা অনুচিত; তবে সে নিজেকে মানুষ বলে দাবি করার যোগ্যতা রাখে কোথায়? তাছাড়া অমানুষ কোনো ধর্মীয় বিচারেই যথার্থ ধার্মিক নয়। কেবল ‘মানুষ’ই ধর্মীয় বিচারে যথার্থ ধার্মিক।
১১১। নিজস্ব নীতিবোধকে জাগ্রত করে ‘মানুষ’ হওয়ার সাধনা করাই মানুষের জন্য উত্তম। মানুষেরা বুঝতে চাইলে বুঝতে পারবে যে, বেহেস্তের লোভ ও দোজখের ভয়ে মানুষ হওয়ার চেয়ে নিজস্ব নীতিবোধ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যারা ‘মানুষ’ হয়, তাদের চেয়ে উত্তম মানুষ অন্যরা হতে পারে না। আর ‘মানুষ’ হওয়াই মানুষের জন্য যথার্থ শিক্ষা। অমানুষ হওয়ার শিক্ষা কু-শিক্ষা ছাড়া কিছু নয়। কু-শিক্ষা বর্জন করে ‘মানুষ’ হওয়ার শিক্ষাই গ্রহণ করুক মানুষেরা।
১১২। ‘মানুষ’ হওয়াই মানুষের ধর্ম, অমানুষ হওয়া পশুর কর্ম। একথা যারা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে নিয়ে চলে, তাদের চেয়ে বড় ধার্মিক অন্য কেউ হতে পারে না।
১১৩। নিরীহ ও শান্তিপ্রিয় মানুষ হত্যা করা মারাত্মক পাপ।
১১৪। অহিংসা, মানুষকে ক্ষমা করা ও মানবসেবাই পরম ধর্ম।
১১৫। অমানুষকে ঘৃণা করা ও তাকে তার প্রাপ্য শাস্তির মুখোমুখি করাই মানুষের জন্য শান্তিপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করতে সহায়তা করেÑ এমন মনোবৃত্তি প্রত্যেকেরই অন্তরে লালন করা উচিত।
১১৬। যারা অন্যের সঙ্গে প্রতারণা করার চেষ্টা করে, তারা অমানুষ।
১১৭। যথার্থ ধার্মিক ও ‘মানুষ’ চিনতে স্রষ্টা কোনো ভুল করবেন নাÑ এমন বিশ্বাসই যৌক্তিক। আর যথার্থ ধার্মিক ও ‘মানুষ’ হতে হবে স্রষ্টার সন্তুষ্টির জন্য, মানুষের সন্তুষ্টি কিংবা লোক-দেখানোর জন্য নয়।
১১৮। পশুদের চেয়ে মানুষ উত্তম ও বিবেকসম্পন্ন প্রাণীÑ এটা প্রমাণের জন্যই বিভিন্ন পশুর অনুসৃত হিংস্রতা ও অশ¬ীলতার পথ বর্জন করে চলা উচিত মানুষের।
১১৯। হিংস্রতা ও অশ¬ীলতা প্রসারের চিন্তা করলে বর্তমান ও আগামীর মানবসন্তানেরা এতে আক্রান্ত হবে; কিন্তু হিংস্রতা ও অশ¬ীলতার পথ বন্ধ করলে তারাই তার সুফল ভোগ করবেÑ এ চিন্তাটা সবার মাথাতেই লালন করা উচিত।
১২০। বর্তমানে যেসব রাষ্ট্রের মানুষেরা অধিক অর্থ-সম্পদের মালিক, তাদের উচিত মারণাস্ত্র তৈরির পেছনে অর্থব্যয় না করে পৃথিবীর সকল দেশের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত জনগণের কল্যাণে অর্থব্যয় করা। এ কথাতো অস্বীকার করার কোনো উপায়ই নেই যে, মানুষ যখন ইহলোক ত্যাগ করে তখন তার আলোকদেহ (ঘুমন্ত অবস্থায় দেহটিকে মানুষ বিভিন্ন স্থানে যেতে দেখে)-সমেত মানবাত্মা অন্য এক জীবন শুরু করে। মাটিতে চাপা পড়ে কিংবা আগুনে পুড়ে এ আলোকদেহ নষ্ট হয় না। যে কারণে মৃত ব্যক্তিকে আমরা স্বপ্নে দেখে থাকি। অতএব, এ আলোকদেহসমেত মানবাত্মার পরবর্তী জীবন শান্তিময় করতে চাইলে প্রত্যেকেরই উচিত ইহজীবনে মানবজাতির শান্তিপূর্ণ বসবাস নিশ্চিত করতে যার যা করণীয়, তা করতে সচেষ্ট থাকা।
১২১। পৃথিবীকে মারণাস্ত্রমুক্ত করে প্রত্যেক দেশেই প্রত্যেক মানুষের অবাধ যাতায়াতের সুযোগ সৃষ্টি করা।
১২২। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবাখাতে বাণিজ্যে অতি মুনাফা লাভের মনমানসিকতা পরিহার করা উচিত মানুষের।
১২৩। কোনো মানুষের আর্থিক, শারীরিক ও মর্যাদাগত নিরাপত্তার ব্যাপারে কোনো প্রকার হুমকি সৃষ্টির চেষ্টা করা উচিত নয় কারোরই।
১২৪। শান্ত জীব নয়Ñ বরং হিংস্র জীবকেই হত্যা বা জবাই করে ভক্ষণে সবাইকে উৎসাহিত করা উচিত, যাতে জগত হতে হিংস্রতার মাত্রা দিন দিন কমানো যায় এবং হিংস্র জীবজন্তুর অনিষ্ট থেকে নিরীহ পশু ও মানবজাতিকে রক্ষা করা সম্ভবপর হয়।
১২৫। ক্ষুদ্র অপরাধীকে ক্ষমা করা এবং বড় অপরাধীকে সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে বিচারের আওতায় আনা উচিত। ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে ও চেষ্টায় কাউকে শাস্তি দেয়ার বিষয়টি যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলা ভালো। কেননা, এটা হিংস্রতা ছড়াতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
১২৬। কর্মজীবীকে তার যথার্থ পারিশ্রমিক দ্রুত বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা উচিত প্রত্যেকেরই।
১২৭। সামর্থ্য থাকলে ঋণ করা টাকা ঋণদাতাকে দ্রুত পরিশোধ করা উচিত।
১২৮। অর্থ ও ক্ষমতার দম্ভে মানুষের সঙ্গে অমানবিক আচরণ পরিহার করা এবং মানুষকে সাদা-কালো, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান-ইহুদি-মুসলিম, আস্তিক-নাস্তিকÑ এভাবে প্রভেদ না করে মানুষ হিসেবেই মূল্যায়ন ও সেবা করা উচিত।
১২৯। অক্ষম ব্যক্তির প্রতি যথাসম্ভব সাহায্যের হাত প্রসারিত করা এবং তার প্রতি সহানুভূতি বজায় রাখা উচিত মানুষের।
১৩০। অর্থ-সম্পদের প্রতি অতি লোভ পরিহার করে চলা উচিত মানুষেরÑ যাতে করে নিজের অজান্তেও অন্যের জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতা বা জটিলতার সৃষ্টি না হয়, সেই বিষয়ে দায়মুক্ত থাকা যায়।
১৩১। কোনো ভুল হয়ে গেলে তা স্বীকার করে নিয়ে তার মাশুল দেয়ার চেষ্টা করা উচিত। মাশুল দিতে অক্ষম হলে ক্ষতিগ্রস্তের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়া ভালো। কিন্তু প্রতাপ দেখিয়ে বা প্রভাব খাটিয়ে সেই ভুল ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা অমানুষেরই পরিচয়Ñ এই জ্ঞান মস্তিষ্কে ধারণ করে চলা দরকার প্রত্যেকের।
১৩২। দুর্নীতি করে কিংবা বখশিস চেয়ে অন্যকে বিব্রত করার চেয়ে বেতন বা পারিশ্রমিকের অর্থ দিয়েই জীবিকা নির্বাহে সচেষ্ট হওয়া এবং তাতেই সন্তুষ্ট থাকা উচিত মানুষের।
১৩৩। কারো প্রতি অবিচার না করা এবং অবিচার হতে না দেয়া, আর সুবিচার পেতে মানুষকে সহায়তা করাই মানবধর্ম।
১৩৪। জেনে-শুনে-বুঝে কারো কোনো প্রকার ক্ষতি করার চেষ্টা না করাই মানুষের জন্য যথার্থ ধর্মীয় কাজ।
১৩৫। জনসমক্ষে ধূমপান করলে অন্যকে দুর্গন্ধের মাধ্যমে ভোগানো ছাড়াও বিভিন্ন রোগ-ব্যাধির মুখোমুখি করে দেয়া হয়Ñ এই বোধ মস্তিষ্কে ধারণ করে অন্যের জন্য সমস্যা সৃষ্টি থেকে নিজেকে বিরত রাখতে সচেতন থাকা উচিত প্রত্যেকেরই।
১৩৬। পরিবার ও সমাজে যতটা সম্ভব সমঝোতার মাধ্যমে চলার চেষ্টা করা এবং কেউ যাতে সমস্যায় না পড়ে, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা উচিত প্রত্যেকের।
১৩৭। মানুষের মধ্যে কেউই যেহেতু চায় না যে, তার বোন কিংবা স্ত্রী বা মেয়ের সঙ্গে কেউ ব্যভিচারে লিপ্ত হোক অথবা তাদের কাউকে ধর্ষণ করুক, অতএব প্রত্যেকেরই উচিত ব্যভিচারমুক্ত ও ধর্ষণমুক্ত সমাজ নির্মাণে নিজেকেই প্রথমে শুদ্ধ করাÑ যাতে তার দ্বারা এমন কাজ কখনো সংঘটিত না হয়। প্রত্যেক পুরুষ অন্যের বোন বা স্ত্রী বা মেয়ের সতীত্ব নষ্ট না করার ব্যাপারে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকলে তার নিজের বোন বা স্ত্রী বা মেয়ের জন্য নিরাপত্তামূলক একটা সমাজ নির্মাণ হয়ে যাবে। আগামীর এমন বিশুদ্ধ সমাজ নির্মাণের দায়িত্বটা আজকের পুরুষদের ওপরই বর্তায়Ñ পুরুষেরা এমন মনোবৃত্তি ধারণ করে চললে সমাজের নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়া সম্ভব।
১৩৮। কোনো নারী যদি ধর্ষণের শিকার হয়েই যায় কিংবা অভাবের তাড়নায় বা কারো দ্বারা প্রলোভিত হয়ে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, তবে সে কারণে তাকে শাস্তি না দিয়ে বরং যে পুরুষটি তার সতীত্ব নষ্ট করতে ভূমিকা রেখেছে, তাকেই শাস্তির আওতায় আনতে ভূমিকা রাখা উচিত সমাজপতিদের।
১৩৯। কাউকে চরিত্রগত অপবাদ দিয়ে শাস্তির মুখোমুখি করে হত্যা কিংবা আত্মহত্যা করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি না করার ব্যাপারে সচেতন থাকা উচিত সমাজপতিদের।
১৪০। অতি কঠোরতা সমাজে কিংবা পরিবারে শান্তি নষ্টের কারণ হয়Ñ এ কথাটি মনে রেখে যতোটা সম্ভব সহনশীল মনোভাব নিয়ে জীবনযাপন করা উচিত মানুষের।
১৪১। সুর ও সঙ্গীত মানুষের সুস্থতার অন্যতম নিয়ামকÑ এ কথাটি মনে রেখে পরিবারের লোকদের সুর ও সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি করা এবং কারো সঙ্গীতপ্রেমে বাধা সৃষ্টি না করাই উচিত মানুষের।
১৪২। মানুষের মূল হচ্ছে প্রথম মানব ও প্রথম মানবী। তাদের দুজনকে যে যেই নামেই ডাকুক না কেন, একথা অস্বীকার করার কোনো উপায়ই নেই যে, তারাই মানবজাতির মূল। তাদের বংশধর মানবজাতি বর্তমানে বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত হয়ে গেলেও মনুষ্যত্ববোধসম্পন্নরাই প্রথম মানব ও প্রথম মানবীর যথার্থ উত্তরসুরী, এ কথাই আমরা ধরে নিতে পারি। বাকিরা অমানুষ গোত্রীয়Ñ তথা মানবজাতির কলঙ্ক। এদেরকে না বলা যাবে যথার্থ ধার্মিক, না বলা যায় ‘মানুষ’।
১৪৩। বর্তমান পৃথিবীতে এমন লোক ভরপুরÑ যারা কিনা অধূমপায়ীদের সম্মুখে ধূমপান থেকে শুরু করে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কিংবা শেয়ার বা বীমা ব্যবসা, কিংবা দারিদ্র্য বিমোচনের নামে এনজিও-জাতীয় প্রতিষ্ঠান খুলে অন্যের অর্থ ও শ্রম শোষণের মাধ্যমে নিজেরা লাভবান হবার কূট-কৌশলের দ্বারা এবং অন্যকে প্রতারণাসহ মানুষের জন্য নানা ক্ষতিকর কাজে লিপ্ত। একইসাথে অনাচার, ব্যভিচার, অবিচার, জুলুম-নির্যাতন ইত্যাদি অপরাধের সঙ্গেও নিজেদের সম্পৃক্ত করে রেখেছে। এরা কেবল ধর্মাচার পালন করে বলে নিজেদেরকে উত্তম ধর্মের অনুসারী ও ‘মানুষ’ ভাবেÑ যা রীতিমতো হাস্যকর।
১৪৪। যেহেতু স্রষ্টা অসাধু ও অবিচারক নয় বলেই আমাদের বিশ্বাস এবং স্রষ্টা মানুষকে তার পার্থিব জীবনের যথার্থ কর্মফলই দেবেন বলে আমরা মনে করি, সেহেতু মানবজাতির অন্তর্ভুক্ত সকলকে এই জ্ঞানটিই নিজেদের মস্তিষ্কে ধারণ করতে হবে যে, পরবর্তী জীবনে সুখ-শান্তি পাবার দাবিদার হবার জন্য কখনোই কোনো মানুষকে ঠকাতে ও ভোগাতে সচেষ্ট হওয়া যাবে না এবং স্বার্থবাদিতা, হিংসা-হানাহানি, জুলুম, অন্যের সম্পদ জবরদখল, ব্যভিচার, নারী বা শিশু ধর্ষণ, পরকীয়া প্রেম, মানুষের সঙ্গে প্রতারণার মাধ্যমে নিজের সুখ-শান্তি-ভোগ-বিলাস নিশ্চিত করা যাবে না। বরং মানবজাতির কল্যাণে সাধ্য অনুযায়ী ভূমিকা পালনে সচেষ্ট থাকতে হবে।
১৪৫। জনসেবার চেয়ে বাণিজ্যিক মন-মানসিকতা নিয়ে রোগীদের ওপর জুলুম করে যে ডাক্তার, সে অমানুষের কাতারভুক্ত এবং নিজেকে ধার্মিক বলে দাবি করার যোগ্যতা তার নেই।
১৪৬। যে রিকশা বা টেক্সিচালক, পরিবহন ব্যবসায়ী, ঘরের মালিক মানুষের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে, সে অমানুষের কাতারভুক্ত এবং নিজেকে ধার্মিক বলে দাবি করার যোগ্যতা তার নেই।
১৪৭। যে ছেলে বা পুরুষ একাধিক মেয়ে বা নারীর সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে কিংবা প্রতারণা করে, সে অমানুষের কাতারভুক্ত এবং নিজেকে ধার্মিক বলে দাবি করার যোগ্যতা তার নেই।
১৪৮। যে পুরুষ বা নারী ব্যভিচারে লিপ্ত হচ্ছে, সে অমানুষের কাতারভুক্ত এবং নিজেকে ধার্মিক বলে দাবি করার যোগ্যতা তার নেই।
১৪৯। যে পুলিশ বা বিচারক নিরপরাধ ব্যক্তিকে আসামি করে তাকে ভোগাচ্ছে, সে অমানুষের কাতারভুক্ত এবং নিজেকে ধার্মিক বলে দাবি করার যোগ্যতা তার নেই।
১৫০। যে রাজনীতিবিদ স্বীয় বা দলীয় স্বার্থে অন্যের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করে, সে অমানুষের কাতারভুক্ত এবং নিজেকে ধার্মিক বলে দাবি করার যোগ্যতা তার নেই। আনুষ্ঠানিক ধর্মাচার দিয়ে সে পৃথিবীতে অনেককে বোকা বানাতে পারলেও স্রষ্টার বিচারে তাকে ভুগতে হবেই।
১৫১। যে ব্যক্তি পৃথিবীতে ধর্মের নামে মানুষে-মানুষে হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ায় ও ভেদাভেদ সৃষ্টি করে চলে, সে-ও অমানুষের কাতারভুক্ত এবং নিজেকে ধার্মিক বলে দাবি করার যোগ্যতা তার নেই।
১৫২। মানুষের জন্য মূলশিক্ষা তো এটাই যে, ‘মানুষ’ হওয়াই মানুষের ধর্ম, অমানুষ হওয়া পশুর কর্ম। মানুষ হলে তার জন্য পরবর্তী জীবনে শান্তিময় জীবনলাভ নিশ্চিত, অমানুষ হলে তাকে অবশ্যই যন্ত্রণাময় জীবনই ভোগ করতে হবে পরবর্তীকালে। সে কারণে অমানুষ হওয়া থেকে রেহাই পেতে সকল ধরনের পাপ কাজ এড়িয়ে চলা উচিত মানুষেরÑ যারা অন্তত নিজেদেরকে ধার্মিক ও ‘মানুষ’ বলে দাবি করতে চায়।
১৫৩। পাপী না হওয়াই পরবর্তী জীবনে শান্তিলাভের প্রধান শর্তÑ এ কথাটি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে নিয়ে সকল প্রকার পাপের পথ পরিহার করে চলে যারা, তারাই পৃথিবীতে যথার্থ ধার্মিকÑ কোনো বিশেষ ধর্মগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হোক বা না হোক, কিংবা কোনো ধর্মাচার পালন করুক বা না করুক। কেননা, স্রষ্টা বলে যে সত্তার অস্তিত্ব বিশ্বাস করা যায়, তাঁকে বিভিন্ন ধর্ম স¤প্রদায় বিভিন্ন নাম দিলেও এবং তাঁর সন্তুষ্টির জন্য বিভিন্ন ধরনের ধর্মাচারে লিপ্ত হলেও যেহেতু মানবজাতির সর্বগ্রাহ্য স্রষ্টার কোনো নাম বা রূপ আমাদের জানা নাই, সেহেতু এটা ধরে নেয়া মানুষের জন্য উত্তম যে, স্রষ্টার প্রকৃত নাম ও প্রকৃত রূপ যা-ই হোক না কেন, তাঁর বিবেচনায় তিনিই ধার্মিক ও ‘মানুষ’ হবেনÑ যিনি যেকোনো মূল্যে নিজেকে সৎ ও চরিত্রবান রাখবেন এবং মানবকল্যাণে কাজ করে যাবেন; পাশাপাশি সকল প্রকার পাপ ও অন্যের অনিষ্ট করার চিন্তা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখবেন।
১৫৪। গৌতম বুদ্ধের মতো আমিও পৃথিবীতে নতুন এক স¤প্রদায় গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখিÑ যে স¤প্রদায়ের লোকেরা নিজেদেরকে যথার্থ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে এবং হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদি, জৈন, শিখ ইত্যাদি পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে ‘মানুষ’ পরিচয়েই নিজেকে পরিচিত করবে। কোন অমানুষ এই স¤প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হবে না। এই ধর্মের নাম মূলধর্ম। এই স¤প্রদায়ের নাম মূলধর্মী। আর এই স¤প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থের নাম মূলগ্রন্থ। অন্ধবিশ্বাস নয়, সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকেই স্রষ্টাকে শ্রদ্ধা জানাবে মূলধর্মীরা।
১৫৫। একটা বয়সে মানুষের বুদ্ধির ঘাটতি থাকে। তাই সেই বয়সে অভিভাবকের বুদ্ধি ও পরামর্শে এবং তার প্রতি অনুগত থেকে চলার প্রয়োজন হয়। কিন্তু পরিণত বয়সে উপনীত হলে মানুষের নিজের ভালো-মন্দ নিজেকেই বুঝতে হয়। পরিণত বয়সে এসে যদি অভিভাবকের বুদ্ধি বা পরামর্শে চলতে হয়, তবে তাতে নিজের বুদ্ধির দীনতা প্রকাশ পায়। পরিণত বয়সে এসে মানুষের কিছুতেই অন্যের চিন্তায় বা বুদ্ধিতে চলা উচিত নয়। কারণ, এতে নিজের সত্তা যথাযথভাবে বিকশিত হয় না বা হতে পারে না।
১৫৬। মানুষ তার বিবেককে কাজে লাগিয়ে এমন অনেক কিছু জগতে আবিষ্কার করেছে, যা কোনো নবী কিংবা দেব-দেবী বা স্বর্গীয় দূতের মাধ্যমে মানুষ পায়নি। মর্ত্যরে মানুষই তার প্রয়োজনে স্বীয় বিবেককে কাজে লাগিয়ে মানুষের আরাম-আয়েশের জন্য বিদ্যুৎ, বিদ্যুৎচালিত পাখা-শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র-বাতি-কম্পিউটার-ওয়াশিং মেশিন-লিফট-কাপড় ইস্ত্রি করার যন্ত্র, গাড়ি, রেলগাড়ি, উড়োজাহাজ, জলজাহাজ বা স্টিমার, লঞ্চ, সাবমেরিন, যুদ্ধজাহাজ, পণ্য পরিবহন বিমান, হেলিকপ্টার, মোবাইল ফোন, টেলিভিশন, সিনেমা, ভিসিডি, রেডিও, স্যাটেলাইট চ্যানেল, এক্স-রে মেশিনসহ চিকিৎসার জন্য নানা রকম সরঞ্জাম আবিষ্কার ও তার ব্যবহার করে চলেছে। অর্থাৎ গীতা-সংহিতা, কোরআন-বাইবেলে যেসব বিষয়ে মানুষকে কোনো শিক্ষা দেয়া হয়নি, মানুষ যদি সেইসব নিজেদের প্রয়োজনে আবিষ্কার বা তৈরি করে নিতে পারে, তবে জীবনযাপনের অন্যান্য প্রয়োজনেও মানুষকে গীতা-সংহিতা, কোরআন-বাইবেলের দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন নেই।
১৫৭। ‘আমাকে ভালোভাবে সৎ হয়ে জীবনযাপন করতে হবে এবং কারো ক্ষতি না করে মানুষের কল্যাণের চেষ্টা করতে হবেÑ’ একথা নবী বা অবতারদের শিখিয়ে দিতে হবে কেন? আমার নিজের বুদ্ধি নেই তা বোঝার জন্য? যদি এই বুদ্ধি আমার না থাকে, তবে কি আমি বিবেকসম্পন্ন মানুষ বলে নিজেকে দাবি করতে পারি? যদি না পারি, তবে আমার সঙ্গে ৫/৬ বছর বয়সী শিশুর বুদ্ধির তফাত কোথায়? আর আমি বিবেকসম্পন্ন মানুষ হলে এবং আমার দ্বারা কারো কোনো ক্ষতি না হলে পরবর্তী জীবনে আমাকে শান্তিময় আবাসস্থলে বসবাসের সুযোগ না দিলে তো তাতে স্রষ্টার বিবেকের দীনতা প্রকাশ পাবে।
১৫৮। মানুষ তার বিবেককে কাজে লাগালে মনুষ্যত্ববোধসম্পন্ন হয়ে ওঠার জন্য মানুষকে কোনো গ্রন্থেরই সাহায্য নেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু বিবেককে কাজে না লাগালেই মানুষকে বিভিন্ন গ্রন্থের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হয়। আর এই নির্ভরশীলতার ভালো-মন্দ দুটো দিকই আছে। যেহেতু মানুষ নিজের বিবেকের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে গ্রন্থের ওপর নির্ভরশীল হতে যায়, সেহেতু বাইবেল পাঠ করে মানুষের চিন্তা-চেতনা একরকম হয়ে যায়, গীতা-সংহিতা পাঠ করে চিন্তা-চেতনা আরেক রকম হয়ে যায়, কোরআন পাঠ করে চিন্তা-চেতনা অন্য রূপ পায়। এভাবে গ্রন্থ পাঠে মানুষের চিন্তা-চেতনা গ্রন্থিত চিন্তা-চেতনার অনুরূপ হয়ে যায়। মানুষের নিজস্ব বিবেক জাগ্রত করার শক্তি সেক্ষেত্রে হারিয়ে যায়। মানুষ গীতা-সংহিতার চিন্তায় গোঁড়া হিন্দু হওয়ার অনুপ্রেরণা পায়, কিংবা বাইবেলের চিন্তায় ডুবে গোঁড়া খ্রিস্টান হবার অনুপ্রেরণা পায়, কিংবা কোরআনের চিন্তায় ডুবে গোঁড়া মুসলমান হবার অনুপ্রেরণা পায়। কিন্তু এরা যথার্থ মানুষ হবার অনুপ্রেরণা পায় না; মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি, হিন্দু ইত্যাদি পরিচয়ের বৃত্তে নিজেকে আটকে ফেলে এবং এদের চিন্তা-ভাবনা স্বীয় ধর্মীয় জ্ঞানের আলোকেই আবর্তিত হয়। আর মানবপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবার পরিবর্তে এরা গোষ্ঠীপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয় বেশি এবং গোত্রে-গোত্রে বিভাজন টেনে মানুষে-মানুষে দূরত্ব বজায় রেখে চলে। যে কারণে পৃথিবীতে ভ্রাতৃত্ববোধের পরিবর্তে দ্বন্দ্বভাব বেশি বিরাজিতÑ বিশেষতঃ ভিন্ন ভিন্ন স¤প্রদায়ের ক্ষেত্রে। কিন্তু মানুষ যদি গীতা-সংহিতা, বাইবেল, কোরআন থেকে চিন্তা-চেতনা ধারণ করতে না গিয়ে স্বীয় বিবেককে কাজে লাগিয়ে মানবতার কল্যাণে কাজ করতে এগিয়ে আসে, তবে গোষ্ঠী-গোত্র-স¤প্রদায়, সাদা-কালো বর্ণভেদ এসব থেকে মানুষের ভাবনা অনেক উন্নত ও পরিণত হবে।
১৫৯। আমি সৎ ও পরোপকারী হলে আমাকে আমার পরবর্তী জীবনের সুখ-শান্তির জন্য ব্যতিব্যস্ত হতে হবে কেন? সেই মাথাব্যথা তো স্রষ্টা নামে যার অস্তিত্ব মানুষ বিশ্বাস করে তাঁর। তিনি যেহেতু বুদ্ধির দীনতায় ভোগেন না বলেই মানুষের বিশ্বাস, সেহেতু আমি কারো ক্ষতি না করলে তিনি আমার কোনো ক্ষতিই করতে পারেন না। আর আমি যদি পৃথিবীতে মানুষের ওপর জুলুম করি, তবে তাঁর বরাবরে আমি যতই প্রার্থনা জানাই ও প্রশংসাবাক্য উচ্চারণ করি না কেনÑ তাঁর কোনো সাধ্যই থাকবে না আমাকে ক্ষমা করার। কেননা, তাহলে আমি যার ওপর জুলুম করেছি, তিনিও তার ওপর জুলুম করার অন্যায় করবেনÑ যা তিনি করতে পারেন না। অতএব, আমাকে আমার পার্থিব ও পারলৌকিক জীবনের শান্তির জন্য নিজের মেধা খাটিয়েই জীবনযাপন করতে হবে। অন্যের কথায় বা পরামর্শে জীবনযাপন করতে গেলে আমার দ্বারা ভুল কাজই বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকবেÑ এই চিন্তাধারা প্রতিটি মানুষের মনেই লালন করে নিজস্ব বুদ্ধির প্রভাবেই জীবনযাপন করা উচিত প্রত্যেকের। আর এ কথাও মানুষকে বুঝতে হবে যে, স্রষ্টা প্রতিটি মানুষের অন্তরের ভাষা পড়ার ক্ষমতা রাখেন বলেই তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশে আনুষ্ঠানিকতার কোন প্রয়োজন নেই।
১৬০। পৃথিবীতে এ যাবৎ যত ধর্মশিক্ষা এসেছে তার সারমর্ম বের করলে যেকথা স্পষ্ট হয় তা হচ্ছে, মানুষের জন্য মূল ধর্মীয় শিক্ষা হলোÑ নীতিই ধর্ম, দুর্নীতি অধর্ম; সততাই ধর্ম, অসততা অধর্ম; সত্যবাদিতাই ধর্ম, মিথ্যেবাদিতা অধর্ম; নির্লোভ থাকাই ধর্ম, লোলুপতা অধর্ম; অপরের কল্যাণ করাই ধর্ম, স্বার্থবাদিতা বা কারো ক্ষতি করার চেষ্টা অধর্ম; সুবিচার করাই ধর্ম, অবিচার বা কারো প্রতি জুলুম করা অধর্ম; ন্যায়পরায়ণতাই ধর্ম, অন্যায় করা অধর্ম; চরিত্রবান থাকাই ধর্ম, ধর্ষণ-ব্যভিচার করা অধর্ম; অল্প মুনাফা করাই ধর্ম, অতি মুনাফা করার চেষ্টা অধর্ম; যানবাহন ও বাসা-বাড়ির ভাড়া ন্যায়সঙ্গতভাবে নেয়াই ধর্ম, বেশি নেয়ার চেষ্টা করা অধর্ম; ধূমপান-গাঁজা সেবন-মদ্য পান থেকে বিরত থাকাই ধর্ম, এসব বদভ্যাস অধর্ম; ইত্যাদি শিক্ষাগুলো গ্রহণ করে নিয়ে যারা স্বীয় আত্মাকে সার্বিকভাবে বিশুদ্ধ আত্মায় পরিণত করতে সক্ষম হবেন এবং রক্তপাতমুক্ত শান্তিপূর্ণ পৃথিবী গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখবেন, তারাই স্রষ্টার বিবেচনায় সর্বোত্তম ধার্মিক বলে বিবেচিত হবেন। আর এদেরকে পরবর্তী জীবনে সর্বাপেক্ষা শান্তিময় আবাসস্থল লাভের ব্যাপারে কোনোপ্রকার দুশ্চিন্তা করতে হবে না।
১৬১। ধর্ম স¤প্রদায় প্রতিষ্ঠাতার বন্দনা করে গেলে এবং তার নির্দেশিত ধর্মাচারগুলো পালন করলেই পরবর্তী জীবনে সুখ-শান্তি প্রাপ্তির সম্ভাবনা উজ্জ্বলÑ এমন বিশ্বাসে অনেক দুর্নীতিবাজ, ব্যভিচারী, মানুষের সঙ্গে প্রতারণাকারী, মানুষের ওপর জুলুমকারী, শৎ, চাঁদাবাজ, কসাই মার্কা ব্যবসায়ী (সিন্ডিকেট বা মজুতদারীর মাধ্যমে অতি মুুনাফা করা ব্যবসায়ী), ধুরন্দর রাজনীতিবিদ, ডাকাত, খুনি, সন্ত্রাসের গডফাদার শ্রেণীর লোকেরা হজ্ব করে, রোজা রেখে, নামাজ পড়ে কিংবা পূজা দিয়ে, যাকাত দিয়ে নিজেদের ধার্মিক ভাবে এবেং বেহেস্তপ্রাপ্তির আশাও করে। কিন্তু ধর্মীয় মূল শিক্ষা পরিত্যাগকারী এসব লোক কোনোভাবেই পরবর্তী জীবনে সুখ-শান্তি পেতে পারে না। কেননা, তাহলে এদের দ্বারা ভুক্তভোগীদের প্রতি স্রষ্টার অবিচার করা হবে, যা স্রষ্টা করতে পারেন না।
১৬২। মানুষের মধ্যে তারাই যথার্থ ধার্মিক ও জ্ঞানীÑ যারা এই জ্ঞান রাখে যে, নিজ যোগ্যতাতে যদি পরবর্তী জীবনে সুখ-শান্তি লাভের দাবিদার হওয়া না যায়, তবে অন্যের সুপারিশে সুখ-শান্তি পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে দাঁড়ায়; তাই অন্যের সুপারিশ লাভের ঝুঁকি না নিয়ে নিজে সৎ ও পরোপকারী হওয়ার পাশাপাশি অপরের ক্ষতি করা থেকে নিজেকে যেকোনো মূল্যে বিরত রাখতে সচেষ্ট থাকতে হবে এবং স্বার্থবাদিতা, হিংসা-হানাহানি, জুলুম, অন্যের সম্পদ জবরদখল, ব্যভিচার, নারী বা শিশু ধর্ষণ, পরকীয়া প্রেম, মানুষের সঙ্গে প্রতারণার মাধ্যমে নিজের সুখ-শান্তি, ভোগ-বিলাস নিশ্চিত করতে কখনোই সচেষ্ট হওয়া যাবে না। যাদের মধ্যে এই জ্ঞান নেই, তারা নিজেরা পাপকর্ম করে এবং অন্যকেও পাপকর্মে উৎসাহিত করে।
১৬৩। পৃথিবীর প্রত্যেক স্থান, প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত, প্রতিটি মাস পবিত্র এবং যেকোনো স্থানে যেকোনো সময়ে বা দিনে বা রাতে স্রষ্টাকে স্মরণ করলে স্রষ্টা তা শোনার ও বোঝার ক্ষমতা রাখেন।
১৬৪। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি ও মারামারি করা জ্ঞানীদের কাজ নয়। ধর্ম যদি প্রেম বা বন্ধুত্বের মধ্যে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়, তবে তা উত্তম ধর্ম নয়Ñ এ কথা জ্ঞানীদের বুঝতে হবে। জ্ঞানীদের আরো বুঝতে হবে যে, মানুষের প্রাণ স্রষ্টার কাছে এবং তার প্রিয়জনের কাছেও খুবই মূল্যবান। অতএব, ধর্ম নিয়ে বাক-বিতণ্ডা করা বা ধর্মের নামে কাউকে হত্যা করা অমানুষেরই কাজ। এমন অমানুষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে তার পরবর্তী জীবনে সুখ-শান্তি প্রাপ্তি অনিশ্চিত। ধর্ম নিয়ে বিভেদ না বাড়িয়ে মানুষে-মানুষে মহামিলনের শিক্ষা প্রদান করাই যথার্থ মানুষের কাজ।
১৬৫। যেহেতু স্রষ্টা বিষয়ে সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য কোনো সিদ্ধান্তে মানুষেরা পৌঁছতে পারেনি কোটি কোটি বছরের সাধনার পরও, সেহেতু স্রষ্টাকে নিয়ে কোনো ধারণা বা বিশ্বাসে না যাওয়াই মানুষের জন্য মঙ্গলজনক। কেননা, স্রষ্টাকে নিয়ে বিভিন্ন বিশ্বাসই মানুষকে বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত করে রেখেছে এবং এই নানান রকম বিশ্বাস পৃথিবীতে মানুষের রক্তপাতের কারণও হচ্ছে।
১৬৬। বাস্তবে আমরা দেখতে পাই যে, মানুষের মধ্যে যারা নিজ যোগ্যতাতে এগিয়ে যাচ্ছে, তারাই সফল হচ্ছে। এক্ষেত্রে ধর্ম-বর্ণের কোনো পক্ষপাত ঘটছে না। অর্থাৎ স্রষ্টার কোনো পক্ষপাত নেই কারো ক্ষেত্রেই। যার যার যোগ্যতা অনুযায়ী স্ব স্ব ক্ষেত্রে সে এগিয়ে যাচ্ছে। অতএব, মানুষের একথা বোঝা উচিত যে, স্রষ্টা মানুষে-মানুষে কোনো ভেদাভেদ করেন না। বিভিন্ন ধর্ম প্রবক্তা স্রষ্টা বিষয়ে বিভিন্ন রকম তথ্য দিয়ে মানুষে-মানুষে বিভাজনের যে দেয়াল তৈরি করে দিয়ে গেছেন পৃথিবীতে, স্রষ্টা এসবের অনেক ঊর্ধ্বে। স্রষ্টাকে বিভাজনের ভেতরে ফেলে, কিংবা মানুষে-মানুষে যে বিভাজন পৃথিবীতে তৈরি হয়ে রয়েছে, তার জন্য স্রষ্টাকে দায়ী করে মানুষেরা বরং পাপ করে চলেছে। স্রষ্টার অস্তিত্ব যারা বিশ্বাস করেনÑ তাদের উচিত স্রষ্টাকে সকল প্রকার বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা। আর স্রষ্টাকে সকল প্রকার বিতর্কের ঊর্ধ্বে তখনই কেবল রাখা সম্ভবÑ যখন মানুষেরা কেউ স্রষ্টাকে ‘আল¬াহ’, কেউ ‘ঈশ্বর’, কেউ ‘খোদা’, কেউ ‘ভগবান’ বলে ডাকা হতে বিরত থাকবেন এবং তাকে শ্রদ্ধা জানাতে একেক রকমের ধর্মাচার পালন বন্ধ করবেন।
১৬৭। আস্তিকদের মধ্যে যদি কেউ এমনটা বিশ্বাস করেন যে, স্রষ্টা পার্থিব জীবনের ক্ষেত্রে কোনো স¤প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাত না করলেও পরবর্তী জীবনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট এক স¤প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাত করবেন, তবে সেটা কি তার ভুল বিশ্বাস নয়? স্রষ্টার ধর্ম যেহেতু পক্ষপাতের ঊর্ধ্বে থাকা, সেহেতু মানুষের পরবর্তী জীবনের ক্ষেত্রেও তিনি পক্ষপাত কেন করতে যাবেন?
১৬৮। স্র্ষ্টার অস্তিত্ব যারা বিশ্বাস করেনÑ ‘স্রষ্টার প্রতি অন্তরে শ্রদ্ধা পোষণ করলেই তিনি তা বোঝার ক্ষমতা রাখেন’Ñ এই বিশ্বাসও তাদের থাকা উচিত। এই বিশ্বাস অন্তরে ধারণ করতে পারলে ধর্মাচারের মাধ্যমে স্রষ্টাকে বিভাজনের মধ্যে ফেলার যে পাপ বর্তমানে মানুষেরা করছে, তা থেকে তাদের মুক্তি পাওয়া সম্ভব। পাশাপাশি মানুষে-মানুষে বিভাজনের যে দেয়াল তৈরি হয়ে গেছে পৃথিবীতে, তা ভেঙে ফেলা সহজ হবে মানুষের পক্ষে।
১৬৯। স্রষ্টা বা পরমাত্মা সম্বন্ধে সর্বজনীন স্বীকৃত কোনো ধারণা বা জ্ঞানে মানুষ কোটি কোটি বছরের সাধনার পরও পৌঁছতে সক্ষম না হলেও এ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছা সম্ভব যে, বিশ্বাত্মা তথা প্রকৃতি পরমাত্মারই অংশ। প্রকৃতি থেকেই শক্তি নিয়ে মানবসহ জীবজন্তুর সৃষ্টি, বেড়ে ওঠা ও প্রকৃতিতেই মিশে যাওয়া নিশ্চিত হয়। অতএব, প্রকৃতির যতœ নেয়ার মাধ্যমেই স্রষ্টার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারে মানুষেরা। এতে করে স্রষ্টার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সর্বজনীন এক মাধ্যম যেমন খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে, তেমনি প্রকৃতির যতœ নিলে তা মানুষের কল্যাণে অপরিসীম অবদান রাখবে। স্রষ্টা প্রকৃতির মধ্যেই তার শক্তির অধিকাংশ নিহিত রেখেছেনÑ এমনটা ধরে নিয়ে আমরা স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জানাতে পারি অন্তর থেকে, প্রকৃতির বিশালতার দিকে তাকিয়ে।
১৭০। পৃথিবীতে মানবজাতির মধ্যে কোনো বিভাজন টানতে হলে সেই বিভাজনটা হওয়া উচিত কেবল মানুষ ও অমানুষের। মানুষের দলভুক্ত বলে কেবল তারাই বিবেচ্য হবেনÑ যারা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে সংগ্রাম করেন; আর যারা অসত্য ও অন্যায়ের সঙ্গে আছেনÑ তারা তো অমানুষের দলভুক্তই।
১৭১। রেফারি বা আম্পায়ারের কোনো পক্ষ সমর্থনের সুযোগ নেই। রেফারি বা আম্পায়ার যদি কোনো এক পক্ষকে সমর্থন করেন, তবে তিনি আর নিরপেক্ষ বা সুবিচারক বলে বিবেচিত হওয়ার সুযোগ রাখেন না। কেননা, এতে করে অপর পক্ষের প্রতি তিনি অবিচার করে ফেলেন। তাই যিনি যথার্থই নিরপেক্ষ বা সুবিচারক রেফারি বা আম্পায়ার হতে চান, তার কোনো এক পক্ষকে সমর্থন করার এবং সেই পক্ষকে সহযোগিতা বা সাহায্য করার কোনোই সুযোগ নেই। একইভাবে ধর্মগ্রন্থসমূহের বর্ণনামতে, স্রষ্টা পৃথিবীতে মানুষ ও ইবলিস বা শয়তানের মধ্যে প্রতিযোগিতা লাগিয়ে রেখেছেনÑ এই বক্তব্য সত্য হলে তো স্রষ্টার মানুষ কিংবা ইবলিস কারো পক্ষ সমর্থন এবং কাউকে সাহায্য-সহযোগিতা করার বিষয়টি সত্য হতে পারে না। এমনটা করলে তো স্রষ্টার নিরপেক্ষ চরিত্র ক্ষুণœ হবে। আর স্রষ্টা ইবলিসের বিরুদ্ধে মানবজাতিকে সাহায্য-সহযোগিতা করে যাচ্ছেনÑ এমন কথা সত্য হলে তো স্রষ্টা যে মানুষকে মেধা বা বুদ্ধি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, তা মানুষ কতোটা কাজে লাগাতে পারছেÑ সেই পরীক্ষা থেকে স্রষ্টা নিজেই বঞ্চিত হবেন।
১৭২। আমি যদি পৃথিবীতে জন্ম না নিতাম, তবে এ পৃথিবী সম্বন্ধে আমার কিছুই জানার সুযোগ হতো না। পৃথিবীতে যারা জন্ম নিয়েছেÑ মানুষ কিংবা প্রাণী, তারা সবাই নিজের মতো করে জীবনযাপন করে যেতো। আমার জন্ম না হলেও এ পৃথিবী ও পৃথিবীতে বসবাসরত সকল প্রাণী ও গাছপালার অস্তিত্ব তো থাকতোই। কিন্তু আমি যে জন্ম নিয়েছিÑ এর সকল কৃতিত্ব আমার পিতা-মাতার। আমার পিতা-মাতা না চাইলে আমার জন্ম সম্ভব হতো না। এর চেয়ে বড় সত্য আর নেই। এর চেয়ে বড় সত্য খুঁজতে গিয়ে মানুষ এ যাবৎ কেবল বিভ্রান্তই হয়েছে। এই বিভ্রান্তি থেকে বাঁচার উপায় কেবল একটাইÑ আর তা হচ্ছে, আমার পিতা-মাতার জন্ম হয়েছে তাদের পিতা-মাতার কৃতিত্বে এবং পুরো মানবজাতির জন্ম হয়েছে একইভাবে মানবপিতা ও মানবমাতার কৃতিত্বেÑ এই সত্যটাকে গ্রহণ করে নেয়া। এই সত্যটাকে গ্রহণ করে নিয়ে মানুষের উচিত তার জন্মের জন্য কাউকে কৃতিত্ব দিতে হলে, কিংবা কাউকে এজন্য শ্রদ্ধা জানাতে চাইলে মানবপিতা ও মানবমাতাকেই সর্বপ্রথম শ্রদ্ধা জানানো। আর যেহেতু আমরা আমাদের জ্ঞান থেকেই দেখতে পাই যে, পিতা-মাতাই মানুষের সবচেয়ে বড় লালন ও পালনকর্তা, সেহেতু এ কথাই আমাদের বুঝে নেয়া উত্তম যে, মানবপিতা ও মানবমাতাই তাদের বংশধরের লালন-পালনের উপযোগী করে এ পৃথিবী গড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন।
১৭৩। মানবপিতা ও মানবমাতা মানবের বংশ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত না নিলে যেহেতু কারোরই পৃথিবীতে আসা সম্ভব হতো না, সেহেতু মানবপিতা ও মানবমাতাই মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং সর্বোচ্চ প্রশংসিত স্থান তাদেরই প্রাপ্য। প্রতিটি মানুষেরই তাদেরকে এই সম্মান দেয়া উচিত এবং মানবপিতা ও মানবমাতাকে কেন্দ্র করেই মানবজাতির ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা উচিত সকল মানুষের। পৃথিবীতে মানুষের মধ্যে সুখ-শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে মানবপিতা ও মানবমাতাকে কেন্দ্র করেই একতার ভিত্তি গড়ে তোলা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই মানুষের সামনে।
১৭৪। পৃথিবীতে যারা অমানুষÑ তারা রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে নিরীহ মানুষ হত্যা করছে। কেউই পৃথিবীতে চিরকাল বেঁচে থাকতে পারবে না বুঝেও মানুষেরা ৬০/৭০ বছরের প্রভাব-প্রতিপত্তিময় জীবনের জন্য নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে, যা রীতিমতো পশুত্বেরই পরিচায়ক। যুদ্ধের নামে বা রাজনৈতিক স্বার্থে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাঁধিয়ে রাখা এসব লোকের জন্যই পৃথিবীতে মানুষের জীবনযাপন অশান্তিময় হয়ে রয়েছে।
১৭৫। যারা নারী (শিশু, কিশোরী, তরুণী) ধর্ষণ করে অপরাধ চাপা দেয়ার জন্য তাকে হত্যা করে, এ জাতীয় পশুদের প্রত্যেকের লিঙ্গ ও কনুইয়ের ওপর কাঁধের কাছ থেকে দুই হাত কেটে দিয়ে মানবসমাজেই এদের বাঁচিয়ে রাখা দরকারÑ যাতে অন্য কেউ ভবিষ্যতে পশু হয়ে উঠতে সাহস না পায়, তার জন্য শাস্তির নিদর্শনস্বরূপ। ধর্ষণের জন্যও একই শাস্তি প্রযোজ্য হওয়া উচিত।
১৭৬। সামাজিক-অর্থনৈতিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে ২০০ টাকা ঋণ পরিশোধ করতে না পারার কারণে মানুষ হত্যা, কিশোরী-তরুণী তথা নারীকে ধর্ষণ করে অপরাধ চাপা দেয়ার জন্য হত্যা, জমির আল নির্ধারণ সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে মানুষ হত্যা, অপহরণ বা জিম্মি করে মানুষ হত্যাÑ এ রকম কতো কারণে যে পৃথিবীতে মানুষ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে চলেছে, তা বলে শেষ করা যাবে না। আর এসব হত্যাকাণ্ড মানুষের পশুত্ববোধকেই বড় করে ফুটিয়ে তোলে, যেন ‘মানুষই হচ্ছে প্রকৃতির সর্বশ্রেষ্ঠ জানোয়ার’।
১৭৭। মানুষের মধ্যে যারা ‘প্রকৃতির সর্বশ্রেষ্ঠ জানোয়ার’ হিসেবে নিজেকে অধিষ্ঠিত করে যাওয়ার জন্য মানুষ হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন, তাদের তো এই উপলদ্ধি জাগে না যে, কোনো কারণে সে নিজে এমন হত্যাকাণ্ডের শিকার হলে তার স্বজনরা যেমন দুঃখ-কষ্টে ভুগবেন, তেমন যাতনায় তিনি অন্যকে ভোগাতে যাবেন কেন? এই বোধ যাদের নেই তাদের ধরে ধরে চিড়িয়াখানায় বা জঙ্গলে বাঘ-সিংহের সঙ্গে জীবনযাপনের ব্যবস্থা করা গেলেই যথার্থ হতো। পশুশ্রেণির স্থান পশুসমাজে হলেই ভালো মানাতো। মানবসমাজে এ জাতীয় পশুদের অবস্থান মানবজাতির জন্য লজ্জাজনক।
১৭৮। মানুষের মধ্যে একশ্রেণির লোভের কোনো শেষ নেই। আর এদের অতি লোভী প্রবণতার জন্য ভোগান্তি পোহাতে হয় অনেককেই। সমাজের সকল পেশার মানুষের মধ্যেই এই লোভী শ্রেণি বিদ্যমান। যাদের লোভের আগুনে পানি ঢালা দরকার রাষ্ট্রশাসক বা সরকারপ্রধানকেইÑ রাষ্ট্রের জনগণের শান্তিময় জীবন নিশ্চিত করার জন্য। তাদের লোভী প্রবণতার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই রাষ্ট্রের জনগণের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের পথ অনেক বেশি সহজসাধ্য হয়ে পড়বে এবং নাগরিকদের শান্তি ও ভাগ্যোন্নয়ন সুনিশ্চিত হবে।
১৭৯। বর্তমান পৃথিবীতে নারী-পুরুষের অবৈধ যৌনতার পাশাপাশি সমকামিতার পাপও চলছে। তবে এ কথা ঠিক যে, নারী-পুরুষের ব্যভিচারের চেয়ে সমকামিতা ঢের ভালো। আর সমকামিতার চেয়ে আত্মকামিতা আরো ভালো। এতে মানুষের জন্য অন্যায় কিছু নেই। তবে নারী-পুরুষের বৈধ যৌন সম্পর্কটাই সবচেয়ে মধুর। বৈধ সম্পর্কের প্রতিই আগ্রহী হওয়া উচিত যৌনশক্তির অধিকারী প্রত্যেকের।
১৮০। অন্ধবিশ্বাস মানুষকে বিভ্রান্ত ও মূর্খ করে দেয় এবং মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ বাড়িয়ে মানুষকে হিংসা-হানাহানিতে লিপ্ত করে, যা মানুষের জন্য ক্ষতিকর। আর সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্য অন্ধবিশ্বাসের ওপর ভরসা করতে হয় না, অসত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্যই অন্ধবিশ্বাসের সাহায্য নেয়ার প্রয়োজন হয়।
১৮১। পৃথিবীতে এ যাবৎ প্রতিষ্ঠিত সকল ধর্ম স¤প্রদায়ই পাপী ও অমানুষে ভরপুর। এমনকি প্রত্যেক ধর্ম স¤প্রদায়ের লোক এতোটাই অজ্ঞ যে, তারা বিভিন্নভাবে মানুষের ওপর জুলুম-অন্যায় করেও নিজেদেরকে ‘মানুষ’ মনে করে।
১৮২। ধর্মগ্রন্থ কোরআন, ইঞ্জিল ও তাওরাত মোতাবেক গন্ধম ফলই যৌনতা সম্বন্ধে মানুষের জ্ঞান লাভের উৎস। গন্ধম ফল খাওয়ার পরই প্রথম মানব ও প্রথম মানবী নগ্নতা সম্বন্ধে প্রথম জ্ঞানলাভ করে। নগ্নতা সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করার পর যখন প্রথম মানব ও প্রথম মানবীর নগ্নদেহ পরস্পরের কাছে উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল, তখন স্বাভাবিক নিয়মে প্রথম মানব ও প্রথম মানবী একে অপরের নগ্নদেহের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার কথা অনেকক্ষণ ধরে। এ সময় অন্য কোনো চিন্তা তাদের মাথায় আসারই কথা না। নগ্নতার জ্ঞান প্রথম মানব-প্রথম মানবী পাওয়ার পর নগ্নদেহে কি কাজ করতে হয়, সেই জ্ঞানও তাদের স্বাভাবিকভাবেই পাওয়ার কথা। তাছাড়া বৈধ সঙ্গী-সঙ্গিনীর একের অপরের কাছে লজ্জা পাওয়ারও কিছু নেই। আর স্রষ্টা যেহেতু নিরাকার সত্তা বলেই গ্রন্থ তিনটিতে উলে¬খ করা হয়েছে, সেহেতু স্রষ্টাকেও লজ্জা পাওয়ার কিছু ছিল না। স্রষ্টা প্রতিটি মানুষকে প্রতিনিয়তই দেখছেনÑ ধর্মশিক্ষকরা এমন শিক্ষাদানের পরও পৃথিবীতে প্রতিদিনই লাখো লাখো নর-নারী স্রষ্টার প্রতি লজ্জার তোয়াক্কা না করে ব্যভিচারে লিপ্ত হচ্ছে। অতএব, বৈধ সঙ্গী-সঙ্গিনী প্রথম মানব ও প্রথম মানবী পরস্পরকে নগ্ন অবস্থায় দেখার পর নগ্নদেহের আকর্ষণীয়তায় তারা একে অপরের দেহ থেকে চোখ সরাবারই কথা নয়। নগ্নতার জ্ঞান পাওয়ার পর এবং বৈধ সঙ্গী/সঙ্গিনীকে নগ্ন অবস্থায় দেখার পর যে কাজ করা দরকারÑ তা না করলে তো মাথা ঠাণ্ডা হবার এবং অন্যদিকে তাকানোরও প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু তারা আসল কাজ না সেরে গাছের লতাপাতা খুঁজতে শুরু করেন শরীর ঢাকার জন্যÑ এমন কাহিনী আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না বলে দুঃখিত। নগ্নদেহ পরস্পরের কাছে প্রকাশিত হয়ে যাবার পর তারা পরস্পরকে জড়িয়ে না ধরে এবং যৌনসুখ উপভোগ না করেই গাছের লতাপাতা খুঁজতে শুরু করেনÑ মানুষ এতোই মূর্খ, এমন কথা বলে ধর্মগ্রন্থ তিনটিতে মানবজাতিকে অপমান করা হয়েছে বলেই মনে করি আমি। কেননা, বাস্তবে নগ্নতার জ্ঞান পাওয়া কোনো তরুণ ও তরুণী ঘর কিংবা জঙ্গল যেখানেই পরস্পরকে নগ্ন অবস্থায় চোখের সামনে দেখুকÑ তারা যৌনসুখ উপভোগ করা ছাড়া কিছুতেই শরীর ঢাকার জন্য পোশাক বা গাছের লতাপাতা খুঁজতে যাবে না। তাহলে বৈধ সঙ্গী-সঙ্গিনী প্রথম মানব ও প্রথম মানবী তরুণ বয়সে পরস্পরকে নগ্ন অবস্থায় চোখের সামনে দেখার পর যৌনসুখ উপভোগ করা ছাড়াই শরীর ঢাকার জন্য গাছের লতাপাতা খুঁজতে শুরু করেÑ এমন কাহিনি কোনো বিবেচনাতেই বাস্তবসম্মত নয়।
১৮৩। অন্ধবিশ্বাস ও সত্য কখনোই এক কথা নয়। অন্ধবিশ্বাসের কারণে কোনো এলাকার মানুষের প্রধান শক্রু সেই এলাকার মানুষের বন্ধু বলে স্বীকৃতি পেয়ে যায়; মানুষকে মিথ্যে কথা বলে বোকা বানানো লোক সত্যবাদী হিসেবে পরিচিতি পায়; অসতী নারী সতী বলে বিবেচিত হয়; চরিত্রহীন পুরুষ চরিত্রবান পুরুষের মর্যাদা পায়। আর সত্য খুবই তেতো বলে মানুষের কাছে ‘অগৃহীত’ থেকে যায়। কেবল সত্যানুসন্ধানী তথা সত্যপ্রেমিক লোকেরাই সত্য সম্বন্ধে জানতে পারে এবং সত্য গ্রহণ করে। অন্যরা সত্য জানার এবং সত্য গ্রহণের যোগ্যতা রাখে না।
১৮৪। বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে অনেকেই অন্ধবিশ্বাসে ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে। মূলতঃ ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে দেয়া তার ভাষণই অনেকের এমন অন্ধবিশ্বাসের কারণ। কিন্তু ৭ মার্চ ও ২৫ মার্চের মধ্যে ব্যবধান ১৮ দিনের। এই ১৮ দিনে ৬৫ হাজার অতিরিক্ত পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য বাংলাদেশে ঢুকেছিলÑ যারা এ দেশের লাখ লাখ নিরীহ বাঙালি হত্যা ও নারীদের সম্ভ্রম কেড়ে নিয়েছিল। সাদা চোখে দেখলেও পশ্চিম পাকিস্তানি প্রশাসনকে এই ১৮ দিনে অতিরিক্ত সৈন্য মজুতের সুযোগ দেয়ার জন্য দায়ী ছিলেন প্রধানত শেখ মুজিবুর রহমানই। আর গভীরভাবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশে¬ষণ করলে দেখা যায় যে, মুখে স্বাধীনতার কথা বললেও ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়ী দলের নেতা হিসেবে পুরো পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা হাতের মুঠোয় পাওয়ার লোভে মুজিব তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আঁতাত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী নিরীহ জনগণের স্বাধীনতার আন্দোলন দমিয়ে দেয়ার জন্য বাঙালিদের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের লেলিয়ে দিয়েছিলেন এবং বিনিময়ে তার ও তার পরিবারের সদস্যদের জীবন রক্ষা করেছিলেন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আঁতাত না করলে ২৫ মার্চ রাতে বাঙালিদের ওপর আক্রমণের প্রথম শিকার হওয়ার কথা ছিল মুজিব ও তার পরিবারের। কেননা, দৃশ্যতঃ শেখ মুুজিবুর রহমানই ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় শক্রু। আর বড় শক্রুকে হাতের মুঠোয় পেয়েও বাঁচিয়ে রাখা এবং সাধারণ শক্রু ‘স্বাধীনতাকামী নিরস্ত্র বাঙালি’দের হত্যা করা কোনো যুক্তিতেই যথার্থ নয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাত্রিই ইতিহাসের জ্বলন্ত স্বাক্ষী যে, শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা পাওয়ার লোভেই বাঙালি ছাত্র-সৈনিক-জনতার বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে লেলিয়ে দিয়েছিলেন এবং পরিকল্পনামতো পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে ‘গ্রেফতার’ নাটকের দ্বারা পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন, কবে বাঙালিদের স্বাধীনতার আন্দোলন দমে যাবে এবং তার পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা লাভের পথ সুগম হবে। কেবল বাংলাদেশের শাসনক্ষমতা পেতে চাইলে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন। তাহলে অনেক কম রক্তপাতে এবং বাঙালি নারীদের সম্ভ্রমহানি অনেক কম ঘটেই বাংলাদেশ স্বাধীন হতে পারতো। ১৯৭১ সালের মার্চে মুজিবের চেয়ে জনগণেরই স্বাধীনতা লাভের আকাক্সক্ষা ছিল বেশি। এজন্য জনগণের যার যা আছে, তা নিয়ে তারা শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের আগেই রেসকোর্স ময়দানে হাজির হয়েছিল যুদ্ধে নেমে পড়ার ঘোষণা শোনার আশাতেই। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের মুখ কেউ চেপে ধরে না রাখলেও তিনি ভাষণে বললেনÑ ‘আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি, তোমাদের যার যা আছে, তা নিয়ে শক্রুর মোকাবেলা করবে।’ বাঙালির যার যা আছে, তা নিয়ে তো তারা সেদিন রেসকোর্স ময়দানে হাজির হয়েছিলই! তাহলে শেখ মুজিবুর রহমান তখন যুদ্ধে নেমে পড়ার হুকুম দিলেন না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলেই বোঝা যাবে যে, পুরো পাকিস্তানের ক্ষমতা লাভের পথ বন্ধ না করতেই সেদিন মুজিব ‘হুকুম’ দেন নাই। এ দেশের জনগণের সঙ্গে ‘রাজনৈতিক মোনাফেকী’ করেছিলেন সেদিন মুজিব এবং শক্রুপক্ষকে নিরীহ বাঙালিদের হত্যা করার পথ তৈরি করে দিয়েছিলেন। অতএব, এ কথাই স্পষ্ট যে, অন্ধবিশ্বাস ও সত্য এক কথা নয়। অন্ধবিশ্বাসে যাকে বঙ্গবন্ধু মনে করা হয়, বাস্তবে তিনি ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চÑ এই ১৮ দিনে পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে ৬৫ হাজার অতিরিক্ত পাকিস্তানি সৈন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢোকানোর সুযোগ দিয়ে বাংলাদেশিদের সবচেয়ে বড় দুশমনের কাজ করেছিলেন। পাকিস্তানের শাসক হবার লোভকে তিনি চাপা দিতে পারলে ৭ মার্চই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন এবং তাহলে অনেক কম রক্তপাত এবং মা-বোনের সম্ভ্রমহানির ঘটনা অনেক কম ঘটেই বাংলাদেশ স্বাধীন হতে পারত। আর ৭ই মার্চ বাঙালিরা ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের পুরো সাহস নিয়েই রেসকোর্স ময়দানে হাজির হয়েছিল। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিকে সেদিন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার স্পষ্ট নির্দেশ না দিয়ে জনগণের সঙ্গে ভাওতাবাজি করেছিলেন, যার কারণে পরবর্তীতে বাঙালিকে প্রচুর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছে। অতএব, একথা বলাই যায়Ñ ১৯৭১ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে মনে হলেও কার্যত ‘রাজাকার’ বলে আখ্যায়িতদের চেয়ে তার ভূমিকা বাঙালিদের জন্য অত্যন্ত ভয়ানক ছিল। মুজিবের প্রতি অন্ধপ্রেমের কারণেই তার এই ভয়ঙ্কর ভূমিকা বাংলাদেশের মানুষের অনেকেরই চোখে পড়ছে না।
১৮৫। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার পথে যে বিষয়গুলো অন্তরায় হয়ে দেখা দিয়েছেÑ তা হলো ধর্ম নিয়ে বিভেদ এবং এ প্রেক্ষিতে হিংসা-হানাহানি ও উগ্রতা; পাশাপাশি ক্ষমতা ও সম্পদের লোভে একশ্রেণির রাজনীতিবিদের অমানুষ হয়ে ওঠা। মানুষ যদি ‘মানুষ’ হতে পারে, তবে পৃথিবীব্যাপী এতো অশান্তি থাকার কোনো কারণ নেই। তার চেয়ে বড় কথাÑ ধর্মগুলোও মানুষকে ‘মানুষ’ হিসেবে এক প¬াটফর্মে সমবেত করার চেষ্টা না করে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদি, জৈন, পৌত্তলিক ইত্যাদি স¤প্রদায়ে বিভক্ত করে রেখেছে; যে প্রেক্ষিতে এক ধর্ম স¤প্রদায়ের লোক অপর ধর্ম স¤প্রদায়ের লোককে গণহারে হত্যা করার উদ্দেশ্যে পারমাণবিক বোমার মতো বিধ্বংসী অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতায় নেমেছে। কিন্তু ধর্ম নিয়ে বিভেদটা ভুলে গেলে এবং যথার্থ মানুষ হলে কোনো পক্ষেরই পারমাণবিক বা এমন বিধ্বংসী অস্ত্র তৈরির কোনো প্রয়োজন পড়ে না। সেজন্য প্রয়োজন এমন এক ধর্মীয় শিক্ষাÑ যে শিক্ষায় মানুষ যথার্থই মানুষ হবে এবং হিংসা-হানাহানি ভুলে এক প¬াটফর্মে সমবেত হয়ে অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলার তাগিদ অনুভব করবে।
১৮৬। ১০০ জন মানুষকে ডাকার বা চেনার জন্য প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন নাম দরকার। কিন্তু একজন স্রষ্টাকে ডাকার বা চেনার জন্য তার ভিন্ন ভিন্ন নাম দেয়ার দরকার নেই। তাকে স্রেফ ‘স্রষ্টা’ নামে ডাকলেই চলে।
১৮৭। পৃথিবীর সকল মানব-মানবীকে এক প¬াটফর্মে সমবেত করার লক্ষ্যে যে মূলসূত্রটি সবচেয়ে বেশি কার্যকর হবে, তা হচ্ছেÑ ‘স্রষ্টা ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, মানুষেরা সব তাঁর সৃষ্টি।’ এই মূলসূত্রের ওপর ভিত্তি করেই মানুষেরা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এক প¬াটফর্মে সমবেত হবার জন্য এগিয়ে আসতে পারে। আর ধর্মীয় মূলশিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করতে পারে যে কথাগুলো তা হচ্ছেÑ ‘মানুষ’ হওয়াই মানুষের ধর্ম, অমানুষ হওয়া পশুর কর্ম। মানুষ হলে তার জন্য পরবর্তী জীবনে শান্তিলাভ নিশ্চিত, অমানুষ হলে তাকে অবশ্যই যন্ত্রণাময় জীবনই ভোগ করতে হবে পরবর্তীকালে।
১৮৮। স্রষ্টা যেহেতু মানুষকে তার কর্মের ওপর ভিত্তি করেই পৃথিবীতে টিকে থাকার প্রতিযোগিতায় নামিয়েছেন, সেহেতু আত্মশক্তির ওপর ভরসা রেখে নিজের কর্মদক্ষতা বাড়িয়ে মানুষের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেই জীবনযাপনের চেষ্টা করা উচিত প্রত্যেকের। আর বিপদ-আপদের মুখোমুখি হলে সাহসের সঙ্গে মানুষের সহযোগিতা নিয়ে তা মোকাবেলা করার চেষ্টা করা উচিত।
১৮৯। স্রষ্টা যেহেতু মানুষকে দুই পা-বিশিষ্ট আকার দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, সেহেতু দুই পা-বিশিষ্ট আকারেই স্রষ্টাকে শ্রদ্ধা জানানো মানুষের জন্য যুক্তিযুক্ত। চার পা-বিশিষ্ট প্রাণীর রূপ ধরে স্রষ্টাকে শ্রদ্ধা জানানো মানুষের জন্য মূর্খতাই পরিচায়ক। আর পাপী হয়ে মানুষকে নানাভাবে কষ্ট দিয়ে স্রষ্টার প্রতি অবাধ্যতা প্রদর্শন করে এরপর মাটিতে মাথা ঠুকে স্রষ্টার প্রতি বাধ্যতা প্রমাণ করতে যাওয়াতো মহামূর্খতা ছাড়া কিছু নয়। স্রষ্টা যেহেতু জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান, সেহেতু মানুষ অন্তর থেকে স্রষ্টাকে শ্রদ্ধা জানালেই স্রষ্টা তা বুঝতে পারেন। স্রষ্টাকে অভিনয় করে দেখানোর দরকার নেইÑ কে স্রষ্টার প্রতি বাধ্য, আর কে অবাধ্য। যারা বলেন যে, স্রষ্টা মানুষের হৃদয় থেকে শ্রদ্ধা জানানোর বিষয়টি বুঝতে পারেন না, তাদের মত তাদের কাছেই থাক। স্রষ্টা বোঝেন নাÑ এমন কথা বলা অজ্ঞতার প্রকাশ ছাড়া কিছু নয়।
১৯০। বছরে ২ দিন আনন্দের, আর ৩৬৩ দিন বেদনারÑ এমন চিন্তা করা মূর্খতা। বছরে ২/১ মাস পবিত্র, আর বাকি ১০/১১ মাস অপবিত্রÑ এমন চিন্তাও মূর্খতারই পরিচায়ক। বছরে ১ মাস সংযমী হয়ে চলতে হবে, আর বাকি ১১ মাস অসংযমী হয়ে চলা যাবেÑ এমন চিন্তাও মানুষের মূর্খতার স্বাক্ষর রাখে। পৃথিবীর কয়েকটি স্থান পবিত্র, আর বাকি পৃথিবীটা অপবিত্রÑ এমন চিন্তাও মানুষের বুদ্ধির দীনতাকে প্রকাশ করে। জগতের কিছু কিছু স্থান স্রষ্টার ঘর, আর বাকি জায়গাগুলো শয়তান বা মানুষের ঘরÑ এমন কথা বলাও অজ্ঞতা ছাড়া কিছু নয়। পৃথিবীর প্রতিটি স্থানের সার্বভৌমত্ব স্রষ্টার। তাই পৃথিবীর সকল ঘরই স্রষ্টার ঘর।
১৯১। স্রষ্টাই যথার্থ ন্যায়বিচারক। ভালো কাজের জন্য ভালো ফল দিতে তিনি কখনোই দ্বিধান্বিত হবেন না। এরচেয়ে সত্য আর কিছুই নেই।
১৯২। স্রষ্টা ছাড়া যেহেতু সৃষ্টির অস্তিত্ব সম্ভব নয়Ñ তাই স্রষ্টার অস্তিত্ব আছে। আর যিনি অগণিত আকৃতিবিশিষ্ট সত্তা সৃষ্টি করতে পারেন, তিনি নিরাকার বা আকৃতিহীন হতে পারেন না। বরং বলা যায় যে, তিনি হচ্ছেন এমনই এক পরমসত্তাÑ যিনি প্রতিমুহূর্তে খুবই দ্রুতলয়ে তাঁর রূপ পরিবর্তন করতে সক্ষম। আর বর্তমানে পৃথিবীতে যত রূপ আমরা দেখছি, অতীতে দেখেছি এবং ভবিষ্যতেও দেখব, তার প্রতিটি রূপই তাঁর ধারণকৃত। তবে মানুষের মধ্যেই তাঁর গুণাবলি অধিক বিরাজিত এবং মানুষেরই কারো না কারো মধ্যে তাঁর মূলসত্তা প্রতিনিয়ত সক্রিয় থাকে। আর সেই সক্রিয়তাতেই জগতে বিভিন্ন কিছু সৃষ্টি হওয়া সম্ভব হয় স্রষ্টার দ্বারা। তবে যেহেতু একক কোনো রূপে তাঁর মূল সত্তা বেশিক্ষণ অবস্থান করেন না, সেহেতু মানুষের মধ্যে কেউই নিজেকে পরমসত্তা বলে দাবি করার অধিকার রাখেন না। আর মানুষের মধ্যে কাউকে পরমসত্তা বলে বিশ্বাস করলে তা ভুল বিশ্বাস ছাড়া কিছু নয়।
১৯৩। যদি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে, তবে তারা একে অপরকে ‘তালাক’ প্রদান না করে কিছুকাল আলাদা আলাদা বসবাস করাই ভালো। কিছুকালের দূরত্ব স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে পুনরায় স্বাভাবিক করতে অনেকক্ষেত্রেই সহায়তা করে। যদি এরপরও তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক না হয় এবং তারা একে অপরকে তালাক প্রদান করে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান এবং অতঃপর যদি আবার তাদের মনে হয় যে, তালাক দেয়ার সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল; তারা একত্রে থেকে সংসার জীবন যাপন করে যাওয়াই তাদের জন্য উত্তম, তবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতেই পুনরায় তাদেরকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে দেয়া উচিত ‘হিল্যে বিয়ে’ বা অন্য কোনো শর্ত ছাড়াই।
১৯৪। সংসারের কর্তা মারা গেলে সম্পত্তির বণ্টন করে পরিবারের সদস্যরা পৃথক হয়ে যাওয়া উচিত নয়। বিশেষ কারণে সম্পত্তির বণ্টন যদি করতেই হয় তবে ভাইবোনের মধ্যে কার কতটুকু পাওয়া উচিত বা দরকার, তা সমঝোতার সাথে বণ্টন করলেই ভালো। সমঝোতায় পৌঁছাতে কোনো কারণে সমস্যা হলে সকল ভাই-বোনের মধ্যে সম্পত্তি সমানভাবে বণ্টন করাই যথার্থ। সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে কাউকে ঠকালে কিংবা কারো ওপর জুলুম করলে সে তো তার পরবর্তীকালের শান্তিময় জীবনকেই অনিশ্চিত করে দেবে। মানুষকে বুঝতে হবে যে, মানুষের জন্য কোনো আইনের প্রয়োজন হয় নাÑ অমানুষের জন্যই আইনের প্রয়োজন হয়। আইনের ওপর ভিত্তি না করে মনুষ্যত্ববোধের ওপর ভিত্তি করেই জীবনযাপন করা উচিত মানুষের।
১৯৫। ধর্ম হচ্ছে এমন এক ঔষধÑ যার কাজই হচ্ছে মানুষকে পাপমুক্ত রাখা ও সমাজকে মানুষের বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তোলা। যে ধর্ম এ কাজটি করতে অপারগ, সেই ধর্ম মূলত অকার্যকর বা ভ্যালিডিটি ফুরিয়ে যাওয়া নষ্ট ঔষধজাতীয়। ভ্যালিডিটি ফুরিয়ে যাওয়া ঔষধ যেমন স্বাস্থ্য ও জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, তেমনি মেয়াদোত্তীর্ণ ধর্মও সমাজের জন্য ক্ষতিকর। অতএব, মেয়াদোত্তীর্ণ ধর্মের পাপী বা অমানুষের দলভুক্ত না থেকে মানুষের দলভুক্ত হতে চেষ্টা করা উচিত প্রত্যেকের।
১৯৬। মানুষের মধ্যে বিশেষ করে মহিলারা পুরুষের তুলনায় দুর্বল চিত্তের অধিকারী হওয়ায় এবং অতি আবেগপ্রবণতার কারণে নিজের বিবেকবোধ লোপ পাওয়ায় বা অতি অসহায়ত্ববোধ করলে তা মোকাবেলা করার সাহস না রাখলে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এজন্য দায়ী থাকে অনেকক্ষেত্রে তার প্রিয়জনের কেউÑ যেমন, প্রেমিক বা স্বামীর তাকে ত্যাগ করা বা তার মনে গভীর দুঃখ দেয়া। আবার অনেকক্ষেত্রে দায়ী থাকে সমাজের মানুষ নামের অমানুষÑ যার দ্বারা ধর্ষিত হয়ে ধর্ষণের লজ্জা সইতে না পেরে কিংবা অত্যাচারিত বা অপদস্থ হয়ে অনেক নারী আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। যদিও এ পথ বেছে না নিয়ে জীবনসংগ্রাম করে গেলে সময় একসময় নারীর পক্ষেই প্রবাহিত হতে পারে।
১৯৭। পৃথিবীতে প্রতিকূল পরিস্থিতি নারী-পুরুষ-শিশু-কিশোর প্রত্যেকের জীবনেই কমবেশি আসে। প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা না করে প্রাণ বিসর্জন দেয়া তো মূর্খতার এবং চিত্ত দুর্বলতারই পরিচায়কÑ নারীকে এ কথা না বুঝলে চলবে না। নারী কেন আত্মহত্যা করে ধর্মীয় দৃষ্টিতে মহাপাপ করতে যাবে? নারী কেন আত্মহত্যা করে পৃথিবীতে আরো অধিককাল বেঁচে থাকার অধিকার হাতছাড়া করবে? এক পুরুষ নারীকে প্রত্যাখ্যান করলে নিজেকে এমনভাবে যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবেÑ যাতে সেই পুরুষ স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে তার কাছে ফিরে আসে। কিংবা সেই পুরুষের চেয়ে যোগ্য পুরুষ তার প্রতি আগ্রহী হয়। এক সমাজ নারীকে অপদস্থ বা বহিষ্কার করলে আরেক সমাজে গিয়ে জীবনসংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার মানসিকতা নারীর ভেতর জাগ্রত করতে হবে। জীবনযুদ্ধে অল্পতেই পরাজিত হলে চলবে না। পৃথিবীর আলো-বাতাসে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা ও জীবনসংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার অধিকার পুরুষের মতো নারীরও আছে।
১৯৮। অনেকে ধর্মীয় অন্ধতার কারণে অনেকের প্রাণ কেড়ে নিতে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। কিন্তু এমন আত্মহত্যার মাধ্যমে মানুষ হত্যাকারীরা পরকালে এজন্য কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হবে। কেননা, সাধারণ মানুষের জীবন হরণের জন্য তাদের আত্মীয়-স্বজনের ক্ষমা না পেলে কাউকেই স্রষ্টা ক্ষমা করতে পারেন না।
১৯৯। বিবেকের দৃষ্টিতে সত্য হচ্ছে তাÑ যা প্রমাণিত। কিন্তু যা প্রমাণিত নয়Ñ যাকে সত্য বলে বিশ্বাস করতে হয়, তা মিথ্যাও হতে পারে। তার সত্যতা বিষয়ে যেহেতু সর্বজনগ্রাহ্য স্বীকৃতি পাওয়া যায় না, বিশ্বাসের নিরিখেই তাকে সত্য বলে ধরা হয়, তা মিথ্যারই নামান্তর। সত্য হিসেবে কেবল তা-ই গ্রহণযোগ্যÑ যা প্রত্যক্ষভাবে বা যুক্তিতে প্রমাণিত এবং যে বিষয়ে বিবেকের মাপকাঠিতে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না। কিন্তু মানুষেরা এমন অনেক কথা বা বিষয়কে সত্য বলে জানে, যা যুক্তির নিরিখে সত্য বলে প্রমাণ করা যায় না। এ ধরনের সত্যের ওপর ভিত্তি করে চললে মানুষেরা ক্ষতিগ্রস্তই হয়।
২০০। সত্যের জয় জগতে হতেই হবে। সত্য জয়ী না হলে তাতে মানুষেরই অপমান। সত্য যদি মিথ্যার কাছে পরাজিত হয়ে ধামাচাপা পড়ে যায়, তবে তাতে মানুষের বিবেকহীনতাই প্রকট হয়ে ফুটে ওঠে। দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা এই যে, জগতে মিথ্যা ও মিথ্যাচারই প্রবল প্রতাপে প্রতিষ্ঠিত। আর সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্য কম্পিত পায়ে চলতে হয়। মিথ্যার দাপটে সত্য জগতে অসহায়। মানুষের বিবেকহীন হয়ে চলাই এজন্য প্রধানত দায়ী। মানুষ বিবেকসম্পন্ন প্রাণী হলেও বিবেককে কাজে না লাগিয়ে আবেগকে প্রাধান্য দিয়ে চলে বলেই মিথ্যা বা অসত্যকে সত্য বলে জানছে ও মানছে। আর এভাবেই মিথ্যার কাছে সত্য ধামাচাপা পড়ে গেছে এবং জগতে মিথ্যার রাজত্ব প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কেবল একটাইÑ তা হচ্ছে, আবেগকে প্রাধান্য না দিয়ে বিবেককে সর্বোচ্চ সক্রিয় রেখে জীবনযাপন করা।
২০১। জগতে এমন অনেক বিষয়ই সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, যুক্তির নিরিখে যা মিথ্যা প্রমাণিত হবে। কিন্তু মানুষেরা এই বিষয়গুলোকে আবেগের বশবর্তী হয়ে সত্য বলে গ্রহণ করে নিয়েছে এবং এগুলো যে মিথ্যাÑ তার সপক্ষে কোনো যুক্তিও শুনতে ও মানতে নারাজ। যে কারণে সত্যকে সত্য বলাও কঠিন হয়ে পড়েছে। কিন্তু যাদের বিবেককে কাজে লাগানোর ক্ষমতা আছে, তারা ঠিকই সত্য খুঁজে পাবেন। আর মানুষেরা তাদের অন্ধ আবেগকে বর্জন করে যখন বিবেককে জাগাতে শুরু করবেন, তখন সত্য মানুষের চোখের সামনে জ্বলজ্বল করবে এবং তখন মানুষেরা বুঝবেনÑ অতীতে তারা কতোটা মূর্খ ছিলেন! মানুষের মধ্যে যখন এই বোধ জাগতে শুরু করবে এবং এই বোধসম্পন্ন মানুষের কোনো অভাব পৃথিবীতে থাকবে না, তখনই সত্য জয়ী ও জগতে প্রতিষ্ঠিত হবে।
২০২। মানুষ পৃথিবীর প্রাণীসমূহের মধ্যে এমন এক প্রাণী যাকে জীবিকার জন্য এবং নিজের অহং তথা সম্মান প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করতে হয়। আবার অর্জিত অর্থ ও সম্মান রক্ষার জন্যও মানুষকে সচেতন থাকতে হয়। জীবন-সংগ্রামে মানুষকে তাই প্রতিযোগিতার মনোভাব নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। আর প্রতিযোগিতার মনোভাব যার মধ্যে যত বেশি থাকে, সে ততই এগিয়ে যেতে পারে। কিছু ব্যতিক্রম ঘটলেও যারা আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে জীবনযাপন করে, তাদেরকে জীবনে সফল হতে দেখা যায় বেশি। পক্ষান্তরে যারা আত্মশক্তির ওপর ভরসা না করে অন্যের ওপর ভরসা করে চলতে চায়, তারা জীবনে পিছিয়েই থাকে।
২০৩। মানুষের মধ্যে এমন অনেকে আছেনÑ যারা নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতা বাড়াতে সচেষ্ট না হয়ে প্রকৃতি কিংবা স্রষ্টার ওপর ভরসা করে জীবনে সুখ-শান্তির দেখা পেতে চান। আবার এমন অনেকে আছেনÑ যারা বিপদে-আপদে নিজের শক্তিকে না জাগিয়ে স্রষ্টার দিকে তাকিয়ে থাকেন, স্রষ্টা তাকে বিপদ-আপদ থেকে উদ্ধার করে দেবেনÑ এমন আশায়। অদৃষ্টবাদী এই লোকদেরকে জীবনে দুর্গতি সইতে হয় বেশি।
২০৪। জগত হচ্ছে মানুষের প্রতিযোগিতার স্থান। আর মানুষের প্রতিযোগিতার এই স্থানে স্রষ্টা কাউকেই সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারেন না। কেননা, তাহলে তাঁর নিরপেক্ষতা বজায় থাকে না এবং অন্যের পরাজয়ের জন্য স্রষ্টা দায়ী হয়ে পড়েন। মানুষকে তার প্রয়োজনীয় বুদ্ধি স্রষ্টা দিয়ে দিয়েছেন। যারা তার বুদ্ধিকে যতটা কাজে লাগিয়ে নিজেকে দক্ষ ও যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারেন, তারা সফলতা ও সম্মান অর্জন করতে পারেন। আবার যারা তার বুদ্ধি ও শক্তিকে অন্যায় পথে কিংবা মানুষের অকল্যাণে ব্যয় করেন, তারা ধিক্কার পান এবং অনেক সময় এজন্য শাস্তিও ভোগ করেন, তথা দুর্ভোগের মুখোমুখি হন।
২০৫। মানুষের মধ্যে অনেকে ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসের কারণে দিবসের দেড়-দুই ঘণ্টা কিংবা তীর্থযাত্রায় বেরিয়ে সপ্তাহ কিংবা মাসাধিককাল নিজের পেশাগত শ্রমঘণ্টা নষ্ট করেন পরকালে উন্নত জীবনের আশায় স্রষ্টার সন্তুষ্টির জন্য। ডাক্তার, নার্স, বিদ্যুৎকর্মী, ফায়ার সার্ভিসের লোক, পুলিশ এবং এ জাতীয় জনস্বার্থ-সংশি¬ষ্ট পেশাজীবীদের অনেকের এমন শ্রমঘণ্টা নষ্টের জন্য ভুক্তভোগী হন সাধারণ মানুষেরা। এতে করে শ্রমঘণ্টা নষ্টকারীরা যেমন জীবনে অন্য অনেকের চেয়ে পিছিয়ে যাচ্ছেন, তেমনি তারা অনেকের দুর্ভোগের কারণও হচ্ছেন। অন্যের জন্য এ রকম দুর্ভোগ সৃষ্টিকারীরা যে স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারেন না, তা আবার তাদের বুদ্ধিতে ধরে না ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসের কারণে।
২০৬। স্রষ্টা এক সম্পূর্ণ সত্তা। তিনি মানুষের কাছ থেকে নরকের বা দোজখের ভয় দেখিয়ে যেমন শ্রদ্ধা আদায় করতে চাইতে পারেন না, তেমনি বেহেস্তের লোভ দেখিয়ে মানুষের উপাসনাও কামনা করতে পারেন না। কেননা, নরকের আগুন বা লাঠিপেটা করার ভয় দেখিয়ে শ্রদ্ধা বা উপাসনা আদায় করতে চাওয়া যে কোনো মহৎ সত্তাকে মানায় না, তা বোঝার যথেষ্ট জ্ঞান স্রষ্টার আছে। আর স্রষ্টার এই জ্ঞান আছে বলেই তিনি কিছুতেই নরক বা দোজখের আগুনের ভয় দেখিয়ে মানুষের কাছ থেকে উপাসনা বা শ্রদ্ধা কামনা করতে যাবেন না। একইভাবে বেহেস্তের লোভ দেখিয়েও স্রষ্টা মানুষের উপাসনা কামনা করতে পারেন না। কেননা, তাহলে মানুষকে স্রষ্টা যে বুদ্ধি দিয়েছেন, সেই বুদ্ধি মানুষের মধ্যে কে কতটা কাজে লাগাচ্ছে এবং কিভাবে কাজে লাগাচ্ছে, তার পরীক্ষা হয় না।
২০৭। যাদের স্রষ্টা সম্বন্ধে জ্ঞান নেই এবং যারা ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত, কেবল তারাই আত্মশক্তিকে কাজে না লাগিয়ে কিংবা স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নিজের শ্রমঘণ্টা নষ্ট করে অন্যের জন্য দুর্ভোগ বাড়িয়ে বরং স্রষ্টার বিরাগভাজন যে হয়ে চলেছেন এবং সেইসঙ্গে পার্থিব জীবনের প্রতিযোগিতায় অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে যে যাচ্ছেন, তা বোঝার শক্তি হারিয়ে ফেলেন। তাদের হৃদয়ে ও মস্তিষ্কে মূর্খতার যে মোহর বা আস্তর বা আবরণ পড়ে আছে, তা নিজে থেকে যতদিন পর্যন্ত তারা না সরাবেন, ততদিন পর্যন্ত অন্যদের থেকে পিছিয়েই থাকবেন।
২০৮। স্রষ্টাকে শ্রদ্ধা জানাতে হবেÑ এ কথা মানুষ যদি নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে না বোঝে, তবে মানুষকে বিবেকবান স¤প্রদায় বলার উপায় থাকে না। আর স্রষ্টাকে মানুষ যে প্রক্রিয়ায় প্রকাশ্যে কিংবা অন্তর থেকে যেভাবেই শ্রদ্ধা জানাক না কেন, তা বোঝার ক্ষমতা স্রষ্টা অবশ্যই রাখেনÑ এ কথাও মানুষকে বুঝতে হবে। আর যেহেতু মানুষের মধ্যে যে যেই প্রক্রিয়াতেই স্রষ্টাকে শ্রদ্ধা জানাক না কেন, তা বোঝার ক্ষমতা স্রষ্টা রাখেন, সেহেতু স্রষ্টার কারো মাধ্যমে মানুষকে এ কথা শিখিয়ে দেয়ার কোনোই প্রয়োজন নেই যে, কি প্রক্রিয়ায় স্রষ্টাকে শ্রদ্ধা জানাতে হবে। স্রষ্টা মানুষকে শিখিয়ে দিয়েছেনÑ কি প্রক্রিয়ায় তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে হবে, এমন কথা বলার অর্থ হলোÑ অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় স্রষ্টাকে শ্রদ্ধা জানালে স্রষ্টা তা বোঝার ক্ষমতা রাখেন না, এমনই নির্বোধ তিনিÑ এমন কথাই প্রকারান্তরে বলা। স্রষ্টাকে মানুষ শ্রদ্ধা না জানালে স্রষ্টা মানুষের জন্য ঝড়-সাইক্লোন-ভূমিকম্পসহ নানা বিপদ-আপদ উপস্থিত করেনÑ এমন চিন্তা থেকেই প্রাচীন যুগ হতে মানুষেরা স্রষ্টার বিভিন্ন রূপ কল্পনা করে তাঁর সন্তুষ্টির জন্য মানুষ বলিসহ নানা প্রকার ধর্মাচার পালন শুরু করে; যার সর্বশেষ সংস্করণ হচ্ছে ইসলাম ধর্ম। পূর্ববর্তী ধর্মগুলোর তুলনায় এ ধর্মের শিক্ষা কিছুটা উন্নত হলেও এটাই শেষ শিক্ষাÑ এমন কথা বলা যাবে না। কারণ, শিক্ষার কোনো শেষ নেই।
২০৯। পৃথিবীতে বহুকাল যাবৎ অমানুষের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। যদিও অমানুষের অনেকেই নিজেকে মানুষের দলভুক্ত বলে দাবি করে যাচ্ছে। কিন্তু ৫ মিনিটের হেঁটে যাওয়া পথের জন্য ১০ টাকা দাবি করে যে রিকশাচালক, কিংবা মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য-সামগ্রীর মূল্য বাড়িয়ে মানুষকে ভোগান্তির মধ্যে ফেলে যে ব্যবসায়ীরা, তারা এবং এ জাতীয় সকল লোকই অমানুষের দলভুক্ত।
২১০। যাদের মধ্যে ঈর্ষাবোধ বেশি কাজ করে, তারা বিভিন্ন ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষতি করে। মানুষেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই ধরনের অমানুষদের শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে সাধারণ মানুষের শান্তিপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করার জন্য।
২১১। অপশক্তি তথা অমানুষের সাম্রাজ্য ধ্বংস করা না গেলে সমাজে তথা রাষ্ট্রে মানুষের শান্তিপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করা কিছুতেই সম্ভবপর হয় না। অপশক্তি বা দুষ্টকে দমন করতে তাই মানুষের সম্মিলিত শক্তি কাজে লাগানো দরকার।
২১২। সমাজকে সন্ত্রাসমুক্ত না করা পর্যন্ত সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের দাপট দেখিয়ে রাষ্ট্রে ও সমাজে সন্ত্রাসের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই সন্ত্রাসীদের নির্মূলে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের হাতে প্রয়োজনীয় অস্ত্র রাখতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। তবে, দারিদ্র্যের কারণে সমাজে সন্ত্রাসীর জন্ম যেন না হয়, তা দেখা যেমন সমাজের ধনবানদের দায়িত্ব, তেমনি রাষ্ট্র সরকারেরও উচিত এ বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখা।
২১৩। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মারণাস্ত্রকে নিরুৎসাহিত করাই প্রয়োজন। কিন্তু দেখা যায় যে, এমন অনেকেই আছেন যারা অস্ত্রবাদিতাকে উস্কে দেয়ার পক্ষে। পৃথিবীতে অস্ত্রের খেলা চলুক এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই থাকুকÑ এমন মানসিকতার লোকের অভাব নেই। এমনকি বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যেখানে দারিদ্র্য বিমোচনে ধনীদের তাবৎ অর্থ বিনিয়োগ করা প্রয়োজন, সেখানে অস্ত্র তৈরি ও এর ব্যবহারে বিশাল অংকের পুঁজি খাটিয়ে চলেছে রাজনৈতিক-সামাজিক-ধর্মীয় স¤প্রদায়গত বা রাষ্ট্রীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও বজায় রাখতে চাওয়া ধনবান শ্রেণীর অনেকেই। আর তাদের অনুসৃত নীতিকেই আঞ্চলিক ও সামগ্রিকভাবে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সহায়ক বলে ভাবছে তারা। এদের মধ্যে অনেকে যে মানবতা বিমোচনের লক্ষ্যেই কূটবুদ্ধি প্রয়োগ করে অস্ত্রের খেলা চালিয়ে যাচ্ছেনÑ সেই বিষয়েও সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আর এই শ্রেণীর লোকদের সমর্থন ও উৎসাহ জুগিয়ে চলেছেন ধর্মান্ধ, গোষ্ঠীবাদী, বর্ণবাদী, অস্ত্রের খেলা পছন্দ করা লোকেরা। ‘মারণাস্ত্র মানুষকে শান্তি উপহার দিতে পারে না; বরং এসব অস্ত্র মানবজাতির নিরাপত্তার জন্য ভীষণ হুমকি’Ñ এই জ্ঞান বিভেদপ্রিয় আধিপত্যবাদী মানসিকতার লোকদের মস্তিষ্কে ঢোকানো সত্যিই খুব কঠিন কাজ। কেননা, এদের অধিকাংশেরই মগজে জ্ঞান গ্রহণ করার মতো জায়গা অবশিষ্ট নেই। এরা পৃথিবীতে চলমান বিভিন্ন যুদ্ধে হাজার হাজার লোকের মৃত্যু দেখেও অস্ত্রমুক্ত ও যুদ্ধমুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য নিজেদের বিবেক তথা চিন্তা-চেতনাকে কাজে লাগায় না। হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ও পঙ্গু হওয়া এদের হৃদয়কে ব্যথিত করে না। অস্ত্রবাদিতা যে অস্ত্রবাদিতাকেই উস্কে দেয় এবং রক্তপাত আরো রক্তপাতকে টেনে আনে, তাই অস্ত্রবাদিতা ও রক্তপাতকে উস্কে না দিয়ে অস্ত্রমুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলার জন্যই মানুষের চেষ্টা করা উচিতÑ এই উপলদ্ধিটা তাদের জাগে না। ধর্মান্ধতা ও স্বার্থান্ধতা তাদের মনুষ্যত্ববোধকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। মনুষ্যত্ববোধ যাদের মধ্যে নেইÑ তারা যে নিজেদের মানুষ বলে দাবি করতে পারে না, এই বোধও তাদের হারিয়ে গেছে।
২১৪। সৈন্যই হোক কিংবা সাধারণ মানুষÑ যে অস্ত্র স্পর্শ করে, তার হাতে মানুষ হত্যার মতো ভয়ানক পাপ হতে পারে। রাষ্ট্রীয় ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসবাদ বা বিদ্রোহ দমনের নামে মানুষ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলেও তা যে পাপমুক্ত কাজ হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কেননা, ক্ষমতাসীন স্বার্থবাদী গোষ্ঠী নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে সাধারণ মানুষকে হত্যা করতে সচেষ্ট হতে পারে সৈনিকদের ব্যবহার করে। আর এমন হত্যাকাণ্ডের জন্য নিহত ব্যক্তির পরিবারের ব্যয়ভার আজীবন বহন করলেও কেউ নিজেকে পাপমুক্ত করতে পারে না। কেননা, সে নিহত ব্যক্তির পরিবারের অর্থকষ্ট লাঘব করতে সক্ষম হলেও তার সন্তান-মা-বাবা-ভাই-বোন-স্ত্রীর কাক্সিক্ষত øেহ-মমতা-ভালোবাসার শূন্যতা পূরণ করতে পারে না। অতএব, সৈন্যই হোক কিংবা সাধারণ কেহÑ যে অস্ত্র স্পর্শ করে, সে ভীষণ পাপী হয়ে পড়তে পারে।
২১৫। ধর্মান্ধ ও স্বার্থান্ধ না হওয়ার বিষয়ে মানুষের সচেতন থাকা উচিত তরুণ বয়স থেকেই। কেননা, এ বিষয়ে সচেতন না থাকলে কখন যে তাদের মনুষ্যত্বের মৃত্যু ঘটবে, সে সম্বন্ধে বোঝার জ্ঞানও তারা হারিয়ে ফেলবে।
২১৬। অস্ত্রই পৃথিবীতে অশান্তির মূল উৎস। অতএব, রাষ্ট্রের ক্ষমতাবান, বিত্তবান, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, চলচ্চিত্র নির্মাতাসহ সকল পেশার লোকেরই উচিতÑ অস্ত্রের খেলা বন্ধ করতে যথার্থ ভূমিকা রাখা। অস্ত্রবাদিতাকে উৎসাহিত করলে কিংবা অস্ত্রের খেলা চালু রাখতে ভূমিকা রাখলে মনুষ্যত্বের মৃত্যুর জন্য দায়ী হবেন এসব লোক।
২১৭। ‘মৌলবাদ’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছেÑ ‘ধর্মশাস্ত্রের প্রতি অবৈজ্ঞানিক অন্ধবিশ্বাস’। অতএব, যিনি ধর্মশাস্ত্রের প্রতি অবৈজ্ঞানিক অন্ধবিশ্বাসীÑ তিনিই ‘মৌলবাদী’। আর যিনি ধর্মশাস্ত্রের প্রতি অবৈজ্ঞানিক অন্ধবিশ্বাসী ননÑ তিনি ‘বাস্তববাদী’। এ প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বর্তমান পৃথিবীতে বাস্তববাদী লোকের সংখ্যা খুবই কম।
২১৮। মানুষকে বাস্তববাদী হয়ে সত্য সম্বন্ধে জানার ও বোঝার চেষ্টা করতে হবে এবং নিজের বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়েই মানবতার কল্যাণে কাজ করে যেতে হবে। এটাই মানুষের মুক্তি ও শান্তিলাভের সঠিক পথ।
২১৯। বাস্তববাদী লোক হচ্ছেন তারাÑ যাদের প্রজ্ঞা বাস্তবতায় আছে। অর্থাৎ, যাদের জ্ঞান-বুদ্ধি-মনন শিশু-কিশোরকালের রূপকথাজাতীয় কাহিনির প্রতি আকৃষ্ট নয় এবং যারা অবাস্তব কাহিনি দ্বারা প্রভাবিত নয়, কেবল তারাই বাস্তববাদী লোক। পক্ষান্তরে, যাদের জ্ঞান-বুদ্ধি-মনন রূপকথাজাতীয় কাহিনির প্রতি আকৃষ্ট এবং যারা অবাস্তব কাহিনি দ্বারা প্রভাবিত হন, তারা বাস্তববাদী হওয়ার মতো প্রজ্ঞা লাভ করতে সক্ষম হননি এখনো। এদের প্রজ্ঞা ও মনন এখনো বাস্তবের শিশু-কিশোরদের স্তরে। তাইতো তারা রূপকথার ঘোরেই আছেন।
২২০। মানুষের বোঝা উচিত, শিশু ও কিশোর বয়সে অভিভাবকদের দ্বারা প্রদর্শিত ভূত-পেতœীর ভয়ে ভীত হয়ে কিংবা পরী লাভের লোভে দুষ্টুমি ও মারামারি থেকে বিরত থাকার মানসিকতা এবং লেখাপড়া শিখতে পড়ার টেবিলে বসার প্রবণতা সারাজীবন ধারণ করে থাকা নিজের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হয়ে থাকারই প্রমাণ বহন করে। মানুষ যদি বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার যুগে এসেও তাদের প্রজ্ঞাকে শিশু-কিশোরদের স্তরে রেখে দেয় এবং অবাস্তব কাহিনি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে চলে, তবে তাতে মানুষের বুদ্ধির দীনতাই প্রকাশ পায় প্রকটভাবে। ‘হাট্টিমা টিম টিম তারা মাঠে পাড়ে ডিম’ এ জাতীয় কল্পকাহিনিমূলক ছড়া শিশুবয়সে পড়াতে হয় জ্ঞানলাভের প্রতি শিশুদের উৎসাহিত করতে। কিন্তু তাই বলে ‘হাট্টিমা টিম টিম’ নামে প্রাণীর অস্তিত্ব বয়সকালেও বিশ্বাস করা বুদ্ধির দীনতা ছাড়া আর কি?
২২১। ধর্ম ‘বাণিজ্যিক’ কোনো বিষয় নয়। ধর্ম স¤প্রদায় প্রতিষ্ঠাতারা বিভিন্ন কৌশলে বিভিন্ন ধর্ম স¤প্রদায় সৃষ্টি করলেও তার মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষের ‘আত্মিক’ তথা নৈতিক উন্নতি সাধনের জন্য প্রয়োজনীয় পথনির্দেশনা মানুষের সামনে উপস্থাপন করা। মানুষের আত্মিক তথা নৈতিক উন্নতি ঘটিয়ে মানবসমাজ তথা বিশ্বকে শান্তিপূর্ণ করার লক্ষ্যেই মূলতঃ ধর্ম প্রতিষ্ঠাতারা ধর্ম স¤প্রদায় সৃষ্টি ও বিকাশের প্রয়াস পেয়েছিলেন। ধর্মকে ‘বাণিজ্যিক’ বিষয়ে পরিণত করার উদ্দেশ্যে কোনো ধর্ম স¤প্রদায় প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। কিন্তু যুগের পরিক্রমায় মানুষেরা ধর্মকে ‘বাণিজ্যিক’ বিষয়ে পরিণত করে ফেলেছেন।
২২২। মানুষের মধ্যে ধর্ম নিয়ে ‘বাণিজ্যিক মানসিকতা’ বেড়ে গিয়েছে বলেই মানুষেরা ধর্মীয় গণতন্ত্রে যেমন বিশ্বাস করে না, তেমনি মনুষ্যত্ববোধের শিক্ষাটাও অন্তরে ও মস্তিষ্কে ধারণ করে না। অথচ, ধর্ম কিন্তু মানুষের নৈতিক ও আত্মিক উন্নতি সাধনের উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি, মানুষকে ‘বুনো মহিষের’ রূপ ধারণ করার শিক্ষা ধর্ম দেয় না। বরং মানুষের পশুত্ববোধকে হত্যা করে মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত করার শিক্ষাই দেয় ধর্ম।
২২৩। ‘আল¬াহর আয়াতের বিনিময়ে পয়সা বা অর্থ না নেয়ার জন্য ইসলাম ধর্মে স্পষ্ট নির্দেশ থাকার পরও আল-াহর আয়াতের বিনিময়ে পয়সা বা অর্থ আয়ের ব্যবস্থাস্বরূপ ‘মাদ্রাসা শিক্ষা’ নামে এক শিক্ষা-ব্যবস্থাও গড়ে উঠেছে। তাছাড়া, হজ্ব-কোরবানি নিয়ে বাণিজ্য, মাজার বানিয়ে ওরশ করার নামে বাণিজ্য, পূজা-পার্বণ, ঈদ-রোজা, তাবলীগ জামায়াতের এস্তেমা, বড়দিন ইত্যাদি উপলক্ষে দ্রব্যমূল্য ও যানবাহনের ভাড়া বৃদ্ধিসহ নানাভাবে মানুষকে হয়রানি করে টাকা আদায়ের প্রবণতাও দিন দিন বেড়েই চলেছে। আবার ধর্মকে ব্যবহার করে বড় বড় দেশগুলোর অস্ত্র ব্যবসায়ীদের ‘অস্ত্র বাণিজ্য’ও চলছে পুরোদমে। পাশাপাশি ধর্মীয় সম্পদায়ের মানুষের প্রিয় শব্দ দ্বারা ব্যাংক-বীমাজাতীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করেও মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে মানুষকে ঠকানোর বা মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে অর্থ আয় করা লোকের সংখ্যাও পৃথিবীতে কম নয়। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ধর্মভীরু মানুষের কাছ থেকে টাকা আহরণের সুবিধা করে দেওয়ার জন্যই যেন ধর্ম-স¤প্রদায় প্রতিষ্ঠাকারীরা বিভিন্ন ধর্মীয় স¤প্রদায়ের জন্ম দিয়ে গেছেন।
২২৪। ধর্ম মূলতঃ মানুষের পরকালের ও ইহকালের শান্তিময় জীবন নিশ্চিত করার পথনির্দেশনা দানকারী তত্ত্ব। কেউ যদি পৃথিবীতে মানুষের জন্য ক্ষতিকর কোনো কাজে লিপ্ত না থাকে, তবে সে কোনো ধর্মতত্ত্ব অনুসরণ না করলে সেটা তার নিজস্ব ব্যাপার। আর এমন চরিত্রের কেউ কোনো ধর্মতত্ত্বের বিপক্ষে অবস্থান নিলে সে তো তার পরকালের শান্তিময় জীবনলাভকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবে। এতে কারো ক্ষতি হলে কেবল তার-ই হবে। কেউ তার পরকালের শান্তিলাভের বিষয়টিকে অনিশ্চিত করে নরকে বা দোজখে যেতে চাইলে সেই স্বাধীনতা তার থাকা উচিত। তাকে মারপিট করে বেহেস্তে প্রবেশের শিক্ষা দেয়া পিতামাতারও উচিত নয়। এটা তার ধর্মীয় গণতান্ত্রিক অধিকার। কেউ তাকে বেহেস্তে যাওয়ার চিন্তা করতে শেখাতে
চাইলে তার মানসিকতা পরিবর্তন করার চেষ্টা করতে পারে কেবল তাকে বুঝিয়ে, জোর-জবরদস্তি করে নয়। সে না বুঝলে, কিংবা দোজখে যেতে পণ করলে তাতে অন্য কারো তো কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়Ñ যদি না তারা সেই তত্ত্বের ‘বাণিজ্যিক ব্যবহার’ করেন পৃথিবীতে। আর ধর্মের ‘বাণিজ্যিক ব্যবহার’ কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। ধর্ম নিয়ে ‘বাণিজ্য’ বন্ধ করে সৎকর্মের মাধ্যমেই জীবিকা অর্জনের চেষ্টা করুক মানুষেরা।
২২৫। ভাববাদীরাইÑ অর্থাৎ মানুষের প্রতি যাদের মমত্ববোধ ও দায়িত্ববোধ আছে, তারাই যথার্থ ধার্মিক। যারা স্বার্থবাদী ও ভোগবাদীÑ অর্থাৎ নিজের স্বার্থ ও ভোগ-বিলাস নিশ্চিত করতেই যাদের প্রাণান্ত চেষ্টা, তারা যথার্থ ধার্মিক নয়।
২২৬। মানুষের মধ্যে এমন আনেকেই আছেনÑ যারা মনে করেন, নিজে পেট পুরে খেয়ে এবং আরাম-আয়েশের সাথে একাধিক নারী বা স্ত্রী সম্ভোগ করে স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্য ‘আলহামদুলিল¬াহ’, ‘সোবহানাল¬াহ’, ‘জয় শ্রী কৃষ্ণ’ বা এ জাতীয় স্রষ্টার প্রশংসাসূচক শব্দ বা বাক্য উচ্চারণ করে গেলেই তারা যথার্থ ধার্মিক ও ‘মানুষ’ হয়ে গেলেন। এমন লোকের জগতে অভাব নেই বলেই আফ্রিকায় এবং পৃথিবীর অন্য অনেক অঞ্চলেও মানুষের মধ্যে অনেকে দুর্ভিক্ষে বা দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে কষ্ট করে তিলে তিলে মৃত্যুবরণ করছে। কিন্তু স্বার্থবাদী ও ভোগবাদী শ্রেণিটি ৩/৪ বা ততোধিক বিয়ের মাধ্যমে বা বিয়ে ছাড়াই একের পর এক নারী সম্ভোগ করে যাচ্ছেন এবং ধর্মাচার পালন করার কারণে নিজেকে ধার্মিক ও স্রষ্টার প্রতিনিধি বলেও দাবি করছেন। তবে এরা নিজেদের ধার্মিক বা স্রষ্টার প্রতিনিধি বলে দাবি করার যোগ্যতা রাখেন না।
২২৭। স্রষ্টার প্রতিনিধি বা ধার্মিক বলে কেবল তারাই দাবি করতে পারেনÑ যারা মানুষের মধ্যে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ক্ষুধামুক্ত জীবন উপহার দেয়ার জন্য কার্যকরভাবেই নিজের শ্রম, মেধা ও অর্থ কাজে লাগায়। শ্রম, মেধা কাজে লাগিয়ে অর্থ উপার্জনের যোগ্যতা যাদের আছে, তাদের প্রতি মানবিকভাবে এই দায়িত্বটাও বর্তায় যে, স্রষ্টার সৃষ্ট মানুষের মধ্যে যাদের শ্রম ও মেধা কাজে লাগানোর উপায় বা ক্ষমতা নাই, তাদের জন্য সাধ্য অনুযায়ী নিজের অর্জিত অর্থ থেকে অপ্রয়োজনীয় অংশ ব্যয় করা। হাজার মাইল দূরে বসবাসকারী লোক দুর্ভিক্ষে বা দারিদ্র্যের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছেÑ এমন সংবাদ কানে আসার পর কিংবা সংবাদ মাধ্যমে জানার পরও ধনিক শ্রেণির যারা ক্ষুধার্তদের খাদ্য লাভের ব্যবস্থা করতে নিজের অর্থ ও মেধা খরচ করেন না, তারা কোনো বিবেচনাতেই নিজেকে ধার্মিক বা স্রষ্টার প্রতিনিধি বলে দাবি করার যোগ্যতা রাখেন না।
২২৮। স্রষ্টার প্রকৃত প্রতিনিধি বা ধার্মিক তারাইÑ যারা ক্ষুধামুক্ত মানবসমাজ নিশ্চিত করতে তাদের শ্রম, মেধা ও অর্থ ব্যয় করেন। স্বার্থবাদী ও ভোগবাদীরা কোনো বিবেচনাতেই স্রষ্টার প্রতিনিধি বা যথার্থ ধার্মিক বলে বিবেচিত হবেন না।
২২৯। মানুষের মধ্যে বিভিন্নজন বিভিন্ন বিশ্বাস লালন করে জীবনযাপন করছেন। মানুষের এসব বিশ্বাসের মধ্যে ধর্ম, রাজনীতি, সমাজব্যবস্থা প্রতিটি ক্ষেত্রেই পার্থক্য লক্ষ করা যায়। মানুষ যেহেতু বিবেকবান প্রাণী এবং প্রত্যেকেরই চিন্তা করার ক্ষমতা আছে, সেহেতু যার যার চিন্তার প্রেক্ষিতে যে যেমন করে কোনো কিছু গ্রহণ করতে চায়, তার কাছে তা-ই সত্য বলে মনে হয়।
২৩০। ধর্মীয় ক্ষেত্রে অন্য অনেকের সঙ্গেই যৌক্তিক বিশ্বাসের পার্থক্য আছে। যৌক্তিক বিশ্বাস হচ্ছে, স্রষ্টা এক সম্পূর্ণ সত্তা এবং তিনি কোনো বিষয়েই অপূর্ণ বা কাঙাল নন। অতএব, মানুষের কাছে স্রষ্টার কোনো চাওয়া-পাওয়া থাকতে পারে না। স্রষ্টা মানুষের সিজদা কামনা করেনÑ এমন কথা বলাও স্রষ্টাকে ‘মানুষের সিজদার কাঙাল’ বলে বর্ণনা করার শামিল। তাহলে তো স্রষ্টা অপূর্ণ সত্তা বলেই প্রমাণিত হয়ে যান। সম্পূর্ণ সত্তার তো কোনো কামনা থাকতে পারে না। অন্তত স্রষ্টা তা নির্দেশ দিয়ে ও মানুষকে দোজখের আগুনে পোড়ানোর ভয় দেখিয়ে মানুষের কাছ থেকে জোর করে আদায় করার মতো সত্তা কিছুতেই হতে পারেন না।
২৩১। বর্তমান পৃথিবীতে এমন অনেকেই আছেন, যারা নিজেদের ‘ঈমানদার’ বলে দাবি করেন। কিন্তু জগতটা যে স্রষ্টার ইচ্ছাতেই এবং তাঁর শক্তিতেই তাঁরই পরিকল্পনায় চলছে, মানুষের যে নিজের ইচ্ছাতে কিছুই করার ক্ষমতা নেই, মানুষের মধ্যে যে যেই ব্যাপারে চেষ্টা করে সে যে তা স্রষ্টার ইচ্ছাতেই করে এবং যে চেষ্টা করে না, সে যে স্রষ্টার ইচ্ছা নাই বলেই করে নাÑ ‘ঈমানদার’ বলে দাবিদাররা তা বোঝেনও না, বিশ্বাসও করেন না। তাইতো তারা সকল ক্ষেত্রে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তায় ভোগেন। অবশ্য, এটাও ঠিক যেÑ বাস্তববাদীরা যেভাবে বিশ্বাস করে, স্রষ্টা ঠিক সেভাবেই কার্যকারণ সম্পর্ক বজায় রেখে জগত পরিচালনা করেন। মাঝে মাঝে বা ক্ষেত্রবিশেষে অলৌকিকত্ব প্রদর্শনের ব্যবস্থা তিনি করেন। তবে তার উদ্দেশ্য থাকে ভিন্ন।
২৩২। স্রষ্টা জগতে যা কিছু ঘটাতে চান, তাঁর নির্ধারিত সময়ে তা ঠিকই ঘটান। মানুষেরা নির্ধারিত সেই সময়ের আগে কিছু করতে চাইলে স্রষ্টা তাতে বাধা দিতে থাকেন। সময় হলে স্রষ্টার পরিকল্পনা মতোই তাঁর কাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে যায়।
২৩৩। দেহ ছাড়া স্রষ্টার কিছুই করার ক্ষমতা নাই। এ পৃথিবীতে যত কল্যাণকর ও অকল্যাণকর কাজ হচ্ছে, সবকিছুই স্রষ্টা কোনো না কোনো দেহধারণ করেই করছেন। স্রষ্টার দেহ ও রূপ দেখা যায় না, এমন কোনো স্থান জগতে নেই। আমি যা-ই দেখি তা-ই স্রষ্টার কোনো না কোনো রূপ। বলা যায়, স্রষ্টার কোটি কোটি হাত কোটি কোটি পা কোটি কোটি মাথা রয়েছে। এর একেক হাত একেক মাথার সাহায্যে স্রষ্টা অপর হাত বা অপর মাথার কল্যাণ কিংবা অকল্যাণে ভূমিকা রেখে থাকেন। যার এ কথা বোঝার ক্ষমতা রয়েছে, কেবল সে-ই একথা বুঝবে। যার একথা বোঝার ক্ষমতা নাই, তাকে স্রষ্টা তার বিশ্বাসমতেই পরিচালিত করে থাকেন।
তবে যারা মনে করেন যে, স্রষ্টার কোনো রূপ নেইÑ তারাতো প্রকারান্তরে এমন কথাই বলেন যে, স্রষ্টা হচ্ছেন এমনই অযোগ্য এক সত্তাÑ যার নিজের রূপ প্রকাশের ক্ষমতা নেই। স্রষ্টা কী তেমন অযোগ্য সত্তা হতে পারেন?
২৩৪। প্রকৃত ঈমানদার হচ্ছে সেÑ যে কোনো পাপ করে না। অন্যদের এ কথা বোঝার ক্ষমতা নেই।
২৩৫। স্রষ্টার সঙ্গে যে যেমন সম্পর্ক গড়তে চায়, স্রষ্টা তার সঙ্গে তেমন সম্পর্কই গড়েন। স্রষ্টার সঙ্গে যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়তে চায়, স্রষ্টা তার বন্ধু হয়ে যান। আবার স্রষ্টাকে যে প্রভু মনে করে, স্রষ্টা তাকে দাস হিসেবে নিয়ে মালিকের মতোই আচরণ করেন তার সাথে।
২৩৬। মানুষ এককালে জানোয়ারের স্বভাবমতোই ব্যভিচারে লিপ্ত থাকতো ও রক্তপাত ঘটাতো পৃথিবীতে। তাই জানোয়ারের রূপ ধরেই স্রষ্টাকে শ্রদ্ধা জানানোর চিন্তাটাই বোধ হয় তাদের মাথায় এসেছিল। কিন্তু পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন মানুষের দ্বারা মনুষ্যত্বের শিক্ষা পৃথিবীতে প্রচারিত হলেও মানুষরূপী জানোয়ারদের অনেকের লেজগুলো যে এখনো কাটে নাই, অর্থাৎ জানোয়ার থেকে এখনো যে মানুষ ‘যথার্থ মানুষ’ হতে পারে নাই, তার সর্বোত্তম প্রমাণ হচ্ছেÑ মানুষ এখনো ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার পাশাপাশি স্বার্থগত দ্বন্দ্বে মানুষের রক্ত ঝরানোসহ জানোয়ারের রূপ ধরেই স্রষ্টাকে সিজদা করে, অন্তর থেকে স্রষ্টাকে হৃদয়ের ভালোবাসা জানাবার সাহস এখনো মানুষের হয়নি। কেবল যথার্থ মানুষ স্রষ্টাকে অন্তর থেকে ভালোবাসা জানাবার সাহস রাখে বলে তাকে পশুর রূপ ধারণের কোনো প্রয়োজন পড়ে না।
২৩৭। মদিনা ও মক্কা থেকে মুসলিমদের বসতি ছড়িয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দিকে। এর মধ্যে অস্ত্রের জোরে যুদ্ধ করে মুসলিমরা অনেক এলাকা নিজেদের অধীনে নিয়েছে। তেমনি মুসলমানদের কিছু এলাকা দখলে নিয়ে গড়ে উঠেছে ইসরায়েল রাষ্ট্র। পৃথিবীতে মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধদের যদি অনেকগুলো রাষ্ট্র থাকতে পারে, তবে ইহুদিরা কেবল একটি রাষ্ট্রের মালিকও কেন হতে পারবে না? তারা কি মনুষ্যাকৃতির অধিকারী নয়? তাদের কি পৃথিবীতে বসবাসের অধিকার নেই?
২৩৮। উকিল-ব্যারিস্টাররা তাদের জীবিকা নির্বাহে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করেন মক্কেল জুটিয়ে দেয়ার জন্য। আর স্রষ্টাকে উকিল-ব্যারিস্টারদের প্রার্থনা পূরণ করতেই প্রতিদিন অপরাধী সৃষ্টি করতে হয়। অতএব, রাষ্ট্রে অপরাধীর অস্তিত্ব দেখতে না চাইলে রাষ্ট্রসরকারের উচিত এমন বিচারব্যবস্থা গড়ে তোলাÑ যাতে উকিল-ব্যারিস্টার-পুলিশ কাউকেই জীবিকা নির্বাহের জন্য অপরাধীর ওপর নির্ভরশীল হতে না হয়।
২৩৯। চিত্ত যার সবল তার দেহ ও মনের কাছে বিপদ-আপদ ঘেষার সাহস পায় না। কখনো-সখনো সাহস করে এলেও তার চিত্তের সবলতায় দ্রুত পালিয়ে যায়।
২৪০। শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়াসহ বিএনপি-আওয়ামী লীগের সিংহভাগ নেতাকে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিচারকরা দীর্ঘদিন জেলে রেখেছিল। বিচারকদের তখনকার বিচার যদি শুদ্ধ বা সঠিক থেকে থাকে, তবে অভিযুক্ত নেতারা অবশ্যই অপরাধী। রাজনৈতিক কারণে মুক্তি পাওয়া তাদের ঠিক হয়নি। আর যদি তারা নির্দোষ হয়ে থাকে, তবে বিচারকরা অবশ্যই অযোগ্য ছিল। এই অযোগ্য বিচারকদের সেজন্য অবশ্যই জেলে পাঠানো উচিত শীর্ষ রাজনীতিবিদদের বিনা দোষে কারাভোগ করানোর জন্য। কোনপক্ষ সঠিক, আর কোনপক্ষকে কারাভোগ করানো দরকারÑ সেই বিষয়ে মীমাংসাটা যত তাড়াতাড়ি হয়, তত তাড়াতাড়িই বিচার ব্যবস্থার ওপর এ দেশবাসীর সন্দেহ দূর হবে।
২৪১। মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদিসহ যারা বিশ্বাস করে যে, মানুষের জন্য যা কিছু মন্দ ঘটে, তার জন্য দায়ী হচ্ছে শয়তান বা কোনো অপশক্তিÑ তারা প্রকৃতপক্ষে স্রষ্টার সঙ্গে শিরক্কারী। অর্থাৎ, স্রষ্টার ক্ষমতায় অন্যকে অংশীদার স্থাপনকারী। স্রষ্টা শিরক্কারীকে ক্ষমা করবেন নাÑ এমন কথা বিশ্বাস করা মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই ইবলিস বা শয়তান বা সর্পকে স্রষ্টার ক্ষমতায় অংশীদার স্থাপন করে চলেছেন। অথচ, তারা আবার নিজেদের জ্ঞানী ও ঈমানদার বলে ভাবেনÑ যা রীতিমতো হাস্যকর।
২৪২। মন্ত্রী-সংসদ সদস্য-রাষ্ট্রপতি-বিরোধী দলীয় নেত্রী-রাজনীতিবিদ শ্রেণীর লোকেরা তাদের নিজের কিংবা পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা করানোর ক্ষেত্রে বিদেশের পথেই পা বাড়ান বেশি। এর মাধ্যমে তারা ৩টি বিষয় স্পষ্ট করে তোলেনÑ (ক) তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের চেয়ে বিদেশপ্রেম বেশি, (খ) তারা দেশে উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন ও (গ) তারা দেশের সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য বিষয়ে নিরুদ্বিগ্ন থাকলেও নিজেদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে খুবই উদ্বিগ্ন; অর্থাৎ তারা জনদরদী নয়, আত্মদরদী।
২৪৩। ধর্মগ্রন্থ কোরআন, ইঞ্জিল, তাওরাত মোতাবেক স্রষ্টা মানুষকে পৃথিবীতে নামিয়ে দেয়ার সময় পুরো নগ্ন অবস্থাতেই নামিয়ে দিয়েছিলেন। পূর্ণ যুবক-যুবতী প্রথম মানব ও প্রথম মানবীকে নগ্নতার জ্ঞান থাকা ইবলিসের সাথে পৃথিবীতে নগ্ন অবস্থায় নামিয়ে দেয়ার কারণে বর্তমানে পৃথিবীর কোনো নারী-পুরুষ নগ্ন বা অর্ধনগ্ন হয়ে চলাফেরা করলে তাদেরকে কাপড় পরার আদেশ দেয়ার অধিকার স্রষ্টা রাখেন না। কারণ, যিনি কেবলমাত্র দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারীকে কাপড় পরিয়ে পৃথিবীতে পাঠানোর ক্ষমতা বা বোধ বা জ্ঞান রাখেননি, তিনি বর্তমানে কোনো মানুষকে কাপড় পরার কথা বললে তা তার জন্য প্রজ্ঞাসম্মত নয়। মানুষেরা নিজেদের লজ্জাস্থান ঢাকার জন্য যতটুকু কাপড় পরে স্বস্তি বা শান্তি পায়, ততটুকু কাপড় পরে চলাচলের অধিকার মানুষ রাখে। তবে নারী-পুরুষ প্রত্যেকেরই উচিতÑ শালীনতাবোধ বজায় রাখার মতো কাপড়-চোপড় পরে ঘর হতে বের হওয়া।
২৪৪। বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বলা যায় যে, মানুষ কাজ না করলে কিংবা চেষ্টা না করলে যেহেতু ফল পায় না, সেহেতু এ কথাই সত্যÑ মানুষই তার নিজের ভাগ্যনিয়ন্তা বা ভাগ্যবিধাতা। কাজ করতে গেলে মানুষ দুর্ঘটনারও শিকার হতে পারে। আবার সকল কাজে সফলতা নাও আসতে পারে। তাই বলে চিত্ত দুর্বল করা মানুষের উচিত নয়। চিত্ত সবল রেখে চেষ্টা করে যাওয়াই মানুষের জন্য যথার্থ। কেননা, সকল চেষ্টারই কিছু না কিছু ফল আসেÑ আজ না হলেও ভবিষ্যতে কখনো।
২৪৫। মানুষ পৃথিবীতে যেমন নিজেদের জন্য সুন্দর সুন্দর পোশাক তৈরি করে তা পরিধান করতে শিখেছে এবং সুস্বাদু করে খাবার খেতে জানছে, তেমনি পরবর্তী জীবনে যেখানেই বসবাসের সুযোগ লাভ করুক না কেন, নিজেদের খাবার ও পোশাক মানুষ নিজেরাই তৈরি করে নেবে। এজন্য স্রষ্টা কিংবা তার কোনো ফেরেশতার ওপর মানুষকে নির্ভর করতে হবে না; যেমনটি পৃথিবীতে করতে হয় না। আর ধর্মগ্রন্থ কোরআন, ইঞ্জিল, তাওরাত মোতাবেকÑ স্বর্গ বা বেহেশতে স্রষ্টা মানুষকে নগ্ন করেই রেখেছিলেন এবং মানুষ যে নগ্ন অবস্থায় আছে, তা বোঝার জ্ঞানও মানুষকে দেননি। যেদিন মানুষ সেই জ্ঞান প্রথম পেয়েছে, মানুষকে লজ্জাস্থান ঢাকার জন্য গাছের লতাপাতা খুঁজতে হয়েছে। অতএব, পরবর্তী জীবনেও মানুষকে পোশাক পরিধান করতে হবে নিজেরাই তৈরি করে। কেননা, ফেরেস্তাদের গার্মেন্টস কারখানা প্রতিষ্ঠা করে বা তাঁতশিল্পের মাধ্যমে কাপড় বা পোশাক তৈরির ক্ষমতা আছে, এমন বর্ণনা কোনো ধর্মগ্রন্থে পাওয়া যায় না। আর মানুষের নিজের পোশাক-পরিচ্ছদ তৈরির জন্য ফেরেস্তাদের ওপর নির্ভরশীল হওয়া উচিতও নয়। মানুষ কেন পরবর্তী জীবনেও পরনির্ভরশীল হতে যাবে? মানুষ যখন পৃথিবীতে নিজ প্রয়োজনে স্বীয় বিবেককে কাজে লাগিয়ে মানুষের আরাম-আয়েশের জন্য বিদ্যুৎ, বিদ্যুৎচালিত পাখা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র, বাতি, কম্পিউটার, ওয়াশিং মেশিন, লিফট, কাপড় ইস্ত্রি করার যন্ত্র, গাড়ি, রেলগাড়ি, উড়োজাহাজ, জলজাহাজ বা স্টিমার, লঞ্চ, সাবমেরিন, যুদ্ধজাহাজ, পণ্য পরিবহন বিমান, হেলিকপ্টার, মোবাইল ফোন, টেলিভিশন, সিনেমা, ভিসিডি, রেডিও, স্যাটেলাইট চ্যানেল, এক্স-রে মেশিনসহ চিকিৎসার জন্য নানারকম সরঞ্জাম আবিষ্কার ও তার ব্যবহার করতে শিখেছে, তখন পরবর্তী জীবনেও মানুষের আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা মানুষ নিজেরাই করে নিতে পারবে। ফেরেস্তা কিংবা অন্য কোনো সত্তার ওপর এজন্য মানুষকে নির্ভরশীল হতে হবে না। আর অন্য কোনো সত্তার মানুষের মতো এতো প্রজ্ঞা ও সৃষ্টিশীলতার জ্ঞানও নেই। মানুষের মধ্যে যারা মূর্খ, কেবল তারাই পরবর্তী জীবনে অন্য সত্তার ওপর নির্ভরশীল হতে চায় সেই জীবনের আরাম-আয়েশের জন্য।
২৪৬। আমি মানুষ বুঝি এবং মানুষের স্বার্থ বুঝি। মানুষের স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডে যে বা যারা লিপ্ত হয় বা লিপ্ত থাকেÑ সে স্রষ্টাই হোক কিংবা কোন অমানুষÑ আমি তাকে সেজন্য ঘৃণা করি।
২৪৭। ধর্মগ্রন্থ কোরআন, ইঞ্জিল, তাওরাতে স্রষ্টা ইবলিস বা সর্প বা অপশক্তিকে মানুষের ক্ষতি করার ক্ষমতা দিয়েছেনÑ এমন বর্ণনা থাকার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বর্ণনাগুলো সত্য হলে স্রষ্টা নিজের সতত্ব নষ্ট করে ফেলেছেন। আর যে স্রষ্টার নিজের সতত্ব বলবৎ নেই, সেই স্রষ্টা মানুষের সতত্ব পরীক্ষা করার অধিকার রাখেন না।
২৪৮। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অনেক শীর্ষ নেতাকে বিচারকরা জেল-হাজতে ঢুকিয়েছিল। যদি তারা দোষী হয়, তবে তাদের পরবর্তীতে ছেড়ে দেয়া হলো কেন? আর যদি তারা নির্দোষ হয়, তবে যে বিচারকরা পূর্বে তাদের জেলে ঢুকিয়ে রেখেছিল, তারা অবশ্যই ভুল বিচার করেছিলেন। আর ভুল বিচার করা বিচারকরা আজো বহাল তবিয়তে স্ব স্ব পদে পদস্থ আছেন। এর মানে বর্তমান বিচার বিভাগে ভুল বিচার করা বিচারকের সংখ্যা কম নয়। তাই এই বিচার বিভাগের ওপর আস্থা রাখা যায় না। অতএব, বিচার ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে।
২৪৯। বাংলাদেশের সংবিধান নিয়ে পূর্ববর্তী ও বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করছেন। রাষ্ট্রধর্ম ‘ইসলাম’ হলে বর্তমান বিচার ব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে ‘ইসলামি বিচার ব্যবস্থা’ রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে এবং রাষ্ট্রের প্রধান মসজিদের ইমাম রাষ্ট্রের সরকারপ্রধান হবেন। কিন্তু অজ্ঞতাবশতঃ এবং রাজনৈতিক স্বার্থে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হলেও ক্ষমতা আঁকড়ে আছেন অন্যরা, যা সংবিধানসম্মত নয়। এ রকম আরো কিছু অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিষয় আছে সংবিধানে, যার সংশোধন করা দরকার। নাহলে বাংলাদেশের নাগরিকদের ‘নাগরিক অধিকার’ যেমন সুরক্ষিত হবে না, তেমনি জনগণকে বোকা বানিয়ে রেখে দেশে দ্বন্দ্ব-সংঘাত অব্যাহত রাখার প্রবণতাও কমবে না রাজনীতিকদের।
২৫০। যুক্তিসঙ্গত সত্য কথা স্রষ্টার বিপক্ষে গেলেও তা বলতে আমার দ্বিধা নেই। যেমনÑ বিবাহিতদের অনেকেই ১৫/২০ জন করে সন্তান জন্ম দেয়ার ক্ষমতা রাখলেও যারা জন্ম নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে ২/১ জন সন্তান জন্ম দেন, তারাই বাস্তবতার আলোকে বুদ্ধিমান। জন্ম দেয়ার বা সৃষ্টি করার ক্ষমতা থাকলেই কেবল জন্ম দিতে হবেÑ এমন চিন্তা নির্বুদ্ধিতারই পরিচায়ক বলে মনে করা লোকের সংখ্যা পৃথিবীতে বেশি। সেই আলোকে বলা যায়Ñ মানুষ যাতে ফুটপাথে বা গৃহে বা সবুজে ঘেরা প্রকৃতির মাঝেও শান্তিতে ঘুমাতে না পারে, সেজন্য মশা, পিঁপড়া, সাপ ইত্যাদি প্রাণী সৃষ্টি করায় এবং মানুষের ফসলহানি বা খাবার-দাবার ও কাগজপত্রাদি নষ্ট করার জন্য ইঁদুর, তেলাপোকাসহ অন্যান্য প্রাণী জন্ম দিয়ে স্রষ্টা প্রমাণ করেছেন যে, তাঁর সৃষ্টি করার মতো যথেষ্ট গুণ থাকলেও কি কি প্রাণী সৃষ্টি করা দরকার আর কোন কোন প্রাণী সৃষ্টি করার দরকার নেই বা ছিল না, সেই বিষয়ে কমন সেন্সের যথেষ্ট অভাব ছিল এবং এখনো রয়েছে।
২৫১। স্বাধীনতাকালে যার যা কিছু সম্পদ ছিল, তা পুঁজি হিসেবে খাটিয়ে মাসে গড়ে সর্বাধিক এক লক্ষ টাকা করে আয় করলেও তাতে সাধারণ মানুষের ওপর অর্থনৈতিক জুলুম করা হয়েছে, এমনটা বলা যায়। তবুও এটাকে সহনীয় মাত্রা হিসেবে ধরলে বিগত ৪০ বছরে ৫ (পাঁচ) কোটি টাকার বেশি আয় করা লোকেরা অবশ্যই দেশের সাধারণ মানুষের ওপর জুলুম করার অপরাধে অপরাধী। অর্থাৎ, এদেরকেই পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠীর প্রেতাত্মা হিসেবে চিহ্নিত করে এদের ৫ (পাঁচ) কোটি টাকার বেশি স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে তা রাষ্ট্রের জনগণের কল্যাণে ব্যয় করা দরকার। এছাড়া, রাষ্ট্রের সরকারী-বেসরকারী সকল পর্যায়ে সর্বনিু বেতন ৫০০০ (পাঁচ হাজার) হলে সর্বোচ্চ বেতন ৫০০০০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা নির্ধারিত করা দরকার। ‘কেউ খাবে কেউ খাবে না, তা হবে না তা হবে না’ এই নীতিকে প্রাধান্য দিয়ে অর্থলোভীদের আয় নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। এর অংশ হিসেবে পাবলিক পরিবহনের ভাড়া কিলোমিটার-প্রতি এক টাকায় নামিয়ে আনতে হবে। অর্থাৎ, এক কিলোমিটারের মধ্যে কেউ বাস থেকে নামলে তার ভাড়া ১ টাকাই নিতে হবে। একইভাবে, ক্লিনিক/হাসপাতাল/ডাক্তারের চেম্বারে রোগী দেখার ফি সর্বোচ্চ একশ টাকায় নামিয়ে আনতে হবে। আর রাষ্ট্রে মাসিক ৫০ হাজার টাকার বেশি আয় করা লোকেদের অর্থ রাষ্ট্রীয় ভাণ্ডারে জমা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এই ব্যবস্থা রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হিসেবেই এবং রাষ্ট্রীয় ভাণ্ডারে জমা করা অর্থ রাষ্ট্রের অসহায় লোকদের কল্যাণে ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যয় করতে হবে। কেবল, খেলোয়াড়, শিল্পী, লেখকসহ সৃজনশীল পেশার লোকদের আয় এই ব্যবস্থার বাইরে থাকতে পারে। কেননা, এদের আয়ের পথে দেশের সাধারণ মানুষের ওপর জুলুম হয় কম, বিনোদন হয় বেশি।
২৫২। গন্ধম ফল = বিয়ে বা নারী-পুরুষের নগ্ন দেহের সম্পর্ক। এ ফল খেলে পুরুষ কিংবা নারী উভয়েরই শান্তিপূর্ণ বা বেহেস্তি জীবনের অবসান ঘটে। আর আপাতদৃষ্টিতে স্বপ্নময় মনে হলেও সংগ্রামমুখর বাস্তবতায় নানা দ্বন্দ্ব-সংঘাত মোকাবেলা করে মানুষকে বাকী জীবন কাটাতে হয়। অতএব, বেহেস্তি জীবনের মধ্যে থাকতে চাইলে গন্ধম ফল না খাওয়াই মানুষের জন্য উত্তম। কেননা, গন্ধম ফল খেলে এরপর যেমন স্বামী ও স্ত্রীর পৃথিবীতে সন্তানের ভরণ-পোষণ-লালন-সুখ-শান্তি ইত্যাদি নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার পড়ে, তেমনি মৃত্যুর মাধ্যমে পৃথিবী ত্যাগ করে গেলেও পরকালে স্বামী বা স্ত্রী এবং সন্তানেরা কেমন জীবন লাভ করবে, তা নিয়েও দুশ্চিন্তার শেষ থাকে না। কিন্তু যিশুর মতো গন্ধম ফল খাওয়া থেকে বিরত থাকতে পারলে ইহকালে যেমন স্ত্রী বা স্বামীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘাত থেকে মুক্ত থাকা যাবে, তেমনি পরকালেও সকল প্রকার দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থেকে সার্বিকভাবেই শান্তিপূর্ণ জীবনের অধিকারী হওয়া যাবে। তাই, যিশুর মতো গন্ধম ফল খাওয়া থেকে বিরত থাকাই মানুষের জন্য যথার্থ বুদ্ধিমানের কাজ।
২৫৩। পৃথিবীতে যখন কোন মানুষ বা প্রাণীর অস্তিত্ব ছিল না, তখন স্রেফ স্রষ্টার অস্তিত্ব ছিল। আর এ যাবত কোন মানুষ বা প্রাণীর সৃষ্টি না হলে স্রষ্টাকে চেনার বা জানার বা বোঝার জন্য কোনো সত্তাই থাকতো না। তাহলে একাকী থাকা স্রষ্টার মূল্য কি ছিল? কে তাঁকে চিনত-জানত? নিজেকে চেনানো-জানানোর জন্যই তো স্রষ্টা মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণী সৃষ্টি করেছেন। অতএব, মানুষ সৃষ্টি বা মানুষের বংশ বৃদ্ধির দায় মানুষের নয়। এ দায় স্রষ্টার। নিজেকে চেনানো-জানানোর জন্য স্রষ্টা মানুষকে কঠিন জীবন-সংগ্রামে নিপতিত করে দিয়েছেন। পক্ষান্তরে কাজ না করলে মানুষের জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা না থাকা সত্ত্বেও নবী বা ধর্মাচার পালনকারীরা উপাসনা বা সিজদা প্রদানের মাধ্যমে স্রষ্টাকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য মানুষের প্রচুর সময় অপচয়ের ব্যবস্থা করে দিয়ে মানুষের জীবন-যাপনকে আরো কঠিন করে দিয়েছেন (অন্তত যারা ধর্মমতে বিশ্বাসী, তাদের ক্ষেত্রে)।
২৫৪। পৃথিবী থেকে সকল প্রকার ধর্মাচার যদি রহিত হয়, তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেনÑ আলেম, ওলামা, মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন, গীর্জার পাদ্রী, মন্দিরের পুরোহিতÑ এই শ্রেণীর লোকেরা, যারা ধর্মাচারকে ভিত্তি করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করেন। আর এই শ্রেণীর লোকেদের জীবিকা নির্বাহের পথ যাতে বন্ধ হয়ে না যায়, সেজন্য তারা ধর্মাচারকেই অতি গুরুত্ব দিতে শেখান স্ব স্ব ধর্মের লোকদের। আর নীতি, সততা, সত্যবাদিতা ও মানবতাই যে পরম ধর্মÑ এই শিক্ষাটাকে গৌণ করে তোলেন। যে কারণে পৃথিবীতে ধর্মাচার যতটা পালিত হচ্ছে, ধর্মের মূল শিক্ষাটাÑ তথা মনুষ্যত্বের শিক্ষাটা ততটা জোরালোভাবে মানুষের অন্তরে ঠাঁই পায়নি। তাই ধর্মাচার পালনকারীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই মিথ্যেবাদী হচ্ছে, মানুষকে ঠকাচ্ছে-ভোগাচ্ছে, অন্যের ওপর জুলুম করে বা স্বীয় স্বার্থবাদিতা বজায় রেখে অর্থ-সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে। ধর্মাচার পালনকারীদের এ রকম জুলুম থেকে মানবজাতিকে মুক্ত করার জন্য সকল প্রকার ধর্মাচার রহিত করে বরং মনুষ্যত্বের শিক্ষাটাই মানবসমাজে জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হওয়া উচিত ভুক্তভোগী মানুষের; যাতে ধর্মাচার পালনকারীদের ধর্মবাণিজ্য থেকে মুক্তি পেয়ে সাধারণ মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারে।
২৫৫। যারা নিজের ঘরে থেকে স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেন না, তারা মক্কা বা জেরুজালেমে গিয়ে স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনÑ এমন কথা আমি বিশ্বাস করি না। স্রষ্টার যেহেতু জগতের সকল স্থানেই একইসঙ্গে বিচরণক্ষমতা আছে, সেহেতু যেকোনো স্থানে থেকেই তাঁকে প্রার্থনা জানানো সম্ভব।
২৫৬। পৃথিবীর প্রত্যেকেই কারো জন্য ভালো তো অপরের জন্য মন্দ। আবার একের জন্য কেউ আনন্দ সৃষ্টি করলে অপরের জন্য দুঃখ মজুত হয়ে যায়। অর্থাৎ, ভালো ও মন্দ, আনন্দ ও দুঃখ একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। একজন একপিঠ দেখলে অন্যজন অন্যপিঠ দেখে।
২৫৭। যে টাকা খরচ করে নেতা হয়, তার তো জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থাকার কোনো কারণই নেই। সে তার লগ্নীকৃত টাকার ২/৩ গুণ বা আরো বেশি আদায় করে নেবে জনগণ থেকে। আর জনগণ যাকে টাকা খাটিয়ে নেতা বানাবে, কেবল সে-ই জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে পারে। আর জনসেবা করেই জনগণের ঋণ শোধ করতে সচেষ্ট হতে পারে। কিন্তু যারা নিজেদের বা ব্যবসায়ীদের টাকায় সংসদ সদস্য, মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী হয়, তারা তো নিজেদের আর ব্যবসায়ীদের স্বার্থই দেখবে। যারা ভাবে যে, তারা নিজেদের আর ব্যবসায়ীদের স্বার্থ না দেখে জনস্বার্থ দেখবে, তাদের চেয়ে মূর্খ কারা আছে? জনস্বার্থ দেখবেÑ এমন নেতা চাইলে জনতাকেই অর্থ খরচ করে সেই নেতাকে ক্ষমতায় বসাতে হবে।
২৫৮। গণতন্ত্র মানে হচ্ছে জনগণের কল্যাণের তন্ত্র। জমিদার বা অর্থশালীদের কল্যাণের জন্য তন্ত্রকে তো আর গণতন্ত্র বলা যায় না। বাংলাদেশে এখন জমিদার বা অর্থশালীদের কল্যাণের তন্ত্রই জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত। তাই, একথা বলাই যায়Ñ দেশ এখন ‘জমিদারতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’ দ্বারা চলছে।
২৫৯। জনগণ রাষ্ট্রের মালিকÑ এ কথার অর্থ হলো, জনগণই রাষ্ট্রের মালিক। যারা ভোট পেয়ে বা ভোট কেড়ে নিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসল, তারা রাষ্ট্রের মালিক হতে পারে না। আর রাষ্ট্রের মালিকদের সুবিধাবঞ্চিত রেখে, অর্থনৈতিক কষ্টে ভুগিয়ে চাকরেরা বেতন-ভাতা বাড়িয়ে নেবে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ি-বাড়ির সুবিধা আদায় করে নেবে, তা তো উত্তম চাকরের কাজ নয়। নাটক-সিনেমায় যেমন দেখা যায় যে, ভিলেন বা খলনায়ক চরিত্রের চাকরেরা মালিককে ঠকিয়ে নিজেরা সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নেয় এবং অর্থ-সম্পদ গড়ে তোলে, বর্তমান যুগের রাজনীতিবিদেরা তেমন ভিলেন বা খলনায়ক জাতীয় চাকরের ভূমিকায় আছে।
২৬০। বর্তমান যুগের রাষ্ট্রপ্রধানরা পুরনো আমলের রাজা-বাদশা-সম্রাটদের মতো সৈন্যবল নিয়ে রাস্তা অতিক্রম করেন সাধারণ মানুষের চলাচলের পথ বন্ধ করে দিয়ে। অথচ, তারা নিজেদের গণতন্ত্রমনা এবং জনগণের নেতা বলে দাবি করেন। তাদের এই দাবি যে সত্য নয়, তা প্রমাণের পাশাপাশি তারা বরং এই বিষয়টাও স্পষ্ট করে তোলেন যে, জনগণকে তারা বন্ধু নয়Ñ বরং শক্রু মনে করেন। তাই পোষা সৈন্যদের মধ্যেই রাজা-বাদশা-সম্রাটদের মতো নিরাপদ আশ্রয় খোঁজেন। একথা তো অনুধাবনযোগ্য যে, যিনি জনতার কল্যাণে কাজ করে জনতার বন্ধু হতে পারেন, তিনি জনগণকে ভয় পাবেন কেন? জনতাই তো তার প্রধান নিরাপদ আশ্রয় হবে সেক্ষেত্রে। জনতা কি তাদের বন্ধুকে কখনো হত্যা করবে? নিশ্চয়ই নয়। জনতাকে কেবল তারাই ভয় পেতে পারেন ও অনিরাপদ ভাবতে পারেন, যারা জনতার সঙ্গে শক্রুতা সৃষ্টি করে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। আর জনতার সঙ্গে শক্রুতা সৃষ্টি করে রাষ্ট্র পরিচালনাকারীরা এক-দুই মেয়াদের বেশি ক্ষমতায় টিকে থাকতেও পারে না। এজন্যই বাংলাদেশে এক-দুই মেয়াদের বেশি কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় টিকে না।
২৬১। রাষ্ট্র পরিচালনা করার ক্ষেত্রে মানুষের জন্য মানুষিক আচার, অমানুষের জন্য কঠোরতাÑ এমন নীতিই অনুসরণ করা উচিত রাষ্ট্রশাসককে। কিন্তু বর্তমানে দেখা যায় যে, রাষ্ট্রশাসকেরা অনেক ক্ষেত্রেই অমানুষের জন্য মানুষিক আচার এবং মানুষের জন্য কঠোরতা প্রদর্শন করে চলেছেন।
২৬২। মহিলার পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকলে পুরুষেরা তাদের হাঁটার স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলবে, এটাই সুনিশ্চিত। আমাদের জাতীয় রাজনীতি ও দেশ দুই মহিলার আঁচল ধরে হাঁটতে গিয়ে পুরুষশাসিত রাষ্ট্রগুলোর তুলনায় অনেক পিছিয়ে পড়েছে বিগত দিনগুলোতে। ভবিষ্যতে আরো কত পিছিয়ে পড়বে, এ দুই নেত্রীর আঁচল ধরে চলতে গিয়েÑ তা অনুমান করলে এদেশের পুরুষদের প্রতি মনে কেবল ঘৃণাই জন্মে।
২৬৩। বাংলাদেশের অধিকাংশ পুরুষ স্ত্রৈণটাইপ রাজনৈতিক সমর্থক বা কর্মী বা নেতা। তাদের মেধা ও মনন পৌরুষত্বহীন হয়ে পড়েছে বলেই দুই মহিলার আঁচল ধরে রাজনীতি করছে। পুরুষ নেতার অধীনে গতিশীল রাজনীতি করার, কিংবা বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের চিন্তা করছে না। আমি লজ্জিত এই স্ত্রৈণটাইপ পুরুষ রাজনৈতিক সমর্থক/কর্মী/ নেতাদের জন্য।
২৬৪। ১৯৭১ সালে ‘জয় বাংলা’ ¯ে¬াগান প্রতিষ্ঠা এবং ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। পাকিস্তান থেকে আলাদা একটি রাষ্ট্র গড়ে এ লক্ষ্যে বাঙালিরা এক ধাপ এগিয়েছে বটে; কিন্তু ‘জয় বাংলা’ ¯ে¬াগান এবং ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা পায়নি আজো। ‘জয় বাংলা’ ¯ে¬াগান এবং ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা পাবে সেদিনইÑ যেদিন বাংলা ভাষাভাষি সকল মানুষ এক রাষ্ট্রের অধীনে আসবে। যেহেতু ‘জয় বাংলা’ ¯ে¬াগান এবং ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ প্রতিষ্ঠার দাবি বাংলাদেশেই প্রথম উঠেছিল ১৯৭১ সালে, সেহেতু সেই ধারাবাহিকতায় পশ্চিম বঙ্গ, আসামসহ বাংলা ভাষাভাষি সকল অঞ্চলকে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত করতে সংগ্রামটা শুরু করতে হবে বাংলাদেশ থেকেই। বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্ম ‘জয় বাংলা’ ¯ে¬াগান এবং ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ প্রতিষ্ঠার বাকী কাজটুকু সম্পন্ন করতে এগিয়ে আসবে কি?
২৬৫। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকার বাঙালিদের জন্য আলাদা একটি প্রদেশ ‘বঙ্গ’ গঠন করেছিল। কিন্তু তৎকালীন স্বার্থবাদী রাজনীতিকদের কারণে তা পরবর্তীতে রহিত করা হয়। তবে বর্তমান সময়ে এই দাবিটা জোরালো করা দরকার যে, তৎকালীন স্বার্থবাদী রাজনীতিকদের ভুল শোধরানোর জন্য ব্রিটিশরা যেমন বিনা যুদ্ধে ভারতের রাষ্ট্র পরিচালনার ভার ভারতীয়দের কাছে হস্তান্তর করেছিল, তদ্রুপ বর্তমান ভারত সরকার বিনা যুদ্ধে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত না হওয়া ১৯০৫ সালের ‘বঙ্গ’ প্রদেশের বাকী অংশটুকু পরিচালনার দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের হাতে হস্তান্তর করুক।
২৬৬। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশরা যে বঙ্গপ্রদেশ সৃষ্টি করেছিল, তা ভঙ্গেÑ তথা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল একত্রীকরণের পর পুনরায় পৃথকীকরণে সবচেয়ে বড় প্রভাবক ছিল হিন্দুইজম ও মুসলিমইজম। সম্পূর্ণ বাংলা এক রাষ্ট্র বা প্রদেশ হোকÑ তা তৎকালীন সংকীর্ণ চিন্তার রাজনীতিবিদেরা চায় নাই বলেই হিন্দুইজম ও মুসলিমইজমকে তারা উস্কে দিয়েছিল। বর্তমান এই আধুনিক যুগে সেই ‘বঙ্গ’ প্রদেশের বাঙালিরা যদি হিন্দুইজম ও মুসলিমইজমকে তুচ্ছ মনে করে বাঙালিইজম ও মনুষ্যইজমকে বড় করে দেখে, তাহলে সকল বাংলা ভাষাভাষি এক রাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে যেসব বাধা বর্তমানে আছে, তা সকল বাংলাভাষীর ইচ্ছার কাছে তুচ্ছ হয়ে যাবে। বাংলাভাষীরা এক হলে বর্তমান ভারতীয় বাঙালিরাও স্বাধীন একটি রাষ্ট্রের মালিক হিসেবে নিজেদের নিয়ে গর্ববোধ করতে পারবে এবং তাদের জীবন-জীবিকার মানও বৃদ্ধি পাবে। এ লক্ষ্যে বর্তমান ভারতবাসী বাঙালিরা ¯ে¬াগান ধরতে পারেÑ ‘বাঙালি বাঙালি ভাই ভাই, স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হতে চাই’; ‘বাঙালি বাঙালি ভাই ভাই, ধর্ম নিয়ে বিভেদ নাই’; ‘বাঙালি বাঙালি ভাই ভাই, সকল বাঙালির ঐক্য চাই’; ‘বাঙালি বাঙালি ভাই ভাই, এক দেশেই থাকতে চাই’।
২৬৭। আমরা প্রতিনিয়তই দেখছি যে, জাগতিক স্বার্থে শাসকগোষ্ঠী মিথ্যে প্রচারণার মাধ্যমে ইতিহাস বিকৃত করে চলেন। যেমনÑ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের ক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে স্বাধীনতার স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেনÑ এমন কোন তথ্য-প্রমাণ না থাকলেও তাকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক বলে প্রতিষ্ঠা করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। পক্ষান্তরে ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় জিয়াউর রহমান নামক এক মেজর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন বলে তথ্য-প্রমাণ থাকলেও তাকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে অস্বীকার করে আসছে ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্রটি সর্বপ্রথম পরিচালনার দায়িত্ব লাভকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। ঠিক একইভাবে ইসলামী প্রথম রাষ্ট্র মদিনার দায়িত্বভার এবং রাসুল মোহাম্মদ (সাঃ) এর ওফাতের পর তার উত্তরসূরীর পদটি নিয়েও জটিলতা সৃষ্টি হবার ইতিহাস পাওয়া যায় এবং এতে একই কায়দায় ক্ষমতাসীনদের প্রচারিত ইতিহাস সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেÑ এমনটাই দেখা যায়। কিন্তু এই ইতিহাসের বিপক্ষ ইতিহাসও বাতিলযোগ্য নয়। যুক্তির নিরিখে সেই ইতিহাসটিকেই সত্য বলে মনে হবে সত্যানুসন্ধানীদের কাছে। পাঠকদের বিবেচনার জন্য তা তুলে ধরছি। ঢাকার ২৬ বাংলাবাজারস্থ র্যামন পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত সদর উদ্দিন আহ্মদ চিশ্তী রচিত ‘মাওলার অভিষেক ও মতভেদের কারণ’ বইটি পড়ে মতভেদের যে ইতিহাস পাওয়া যায়, তার সার সংক্ষেপ হচ্ছে এ রকমÑ বিদায় হজ্ব থেকে ফেরার পথে ১৮ জিলহজ্ব তারিখে ‘গাদিরে খুম’ নামক স্থানে পৌঁছলে হজরত আলী (আঃ)কে রাসুল (সাঃ) এর ওফাতের পর আল¬াহর প্রতিনিধি হিসেবে স্থলাভিষিক্ত করার জন্য পূর্বেই রাসুল মোহাম্মদ (সাঃ) কে প্রদত্ত এক নির্দেশ বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়ে “হে রাসুল, আপনার রব হইতে যাহা নাজেল করা হইয়াছে, তাহা পৌঁছাইয়া দিন। আর যদি তাহা না করেন, তাহা হইলে তাঁহার (আল¬াহর) রেসালত পৌঁছাইয়া দেওয়া হইল না। আল¬াহ আপনাকে মানবমণ্ডলী হইতে লইয়া আসিবেন। নিশ্চয় আল¬াহ কাফের দলকে হেদায়েত করেন না” (৫ঃ৬৭) কোরআনের সব শেষের আগের এই আয়াতটি নাজেল করিয়াছিলেন। এই আয়াত নাজেল হবার পর রাসুল (সাঃ) সেখানেই থামিয়া গেলেন এবং বাহন হইতে নামিয়া গেলেন। কাফেলার অগ্রবর্তী এবং পশ্চাদবর্তী সকলকে একত্র করিয়া সেখানেই আলী (আঃ) এর অভিষেক ক্রিয়া সম্পাদন করার ব্যবস্থা করিলেন (প্রাগুক্ত: পৃষ্ঠা ১৩)। উটের উপরে বসার কয়েকটি আসন একর পর এক স্থাপন করে মিম্বার তৈরি করা হলো। তার ওপর উঠে রাসুল (সাঃ) জনতার কাছে অবতীর্ণ বাণী পেশ করলেন এবং বললেনÑ আমি কি তোমাদের আপন জীবন হতে অধিক প্রিয় নই? উত্তরে লোকেরা বললÑ হাঁ হাঁ ইয়া রাসুলুল-াহ। জনগণ হতে এই স্বীকৃতি লাভের পর তিনি আলী (আঃ) এর দুই বাহু ধরিয়া জনতার সম্মুখে তাঁকে শূন্যে তুলে ধরলেন এবং বললেনÑ “আমি যার মাওলা এই আলী তার মাওলা। হে আল¬াহ, তুমি তাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ কর যে তাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তাকে শক্রুরূপে গ্রহণ কর যে তার সঙ্গে শক্রুতা করে এবং সাহায্য কর তাকে যে সাহায্য করে এবং লাঞ্ছনা দাও তাকে যে লাঞ্ছনা দেয়।” তখন হজরত ওমর (রাঃ) সহ উপস্থিত সকলেই নবনিযুক্ত নেতার কাছে গিয়ে বায়াত গ্রহণ করেন। (প্রাগুক্ত: পৃষ্ঠা ১৪) । হজরত আলী (আঃ) এর নিকট উপস্থিতদের বায়াত গ্রহণের অনুষ্ঠানপর্ব শেষ হলে তখন নাজেল হয় কোরআনের শেষ আয়াত যার বঙ্গানুবাদ হচ্ছেÑ ‘আজ কাফেরগণ তোমাদের দ্বীন হইতে নিরাশ হইয়া গিয়াছে। অতএব তাহাদিগকে আর ভয় করিও না, ভয় কর আমাকে। আজ তোমাদের দ্বীন পূর্ণ করিয়া দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামতের পরিপূর্ণতা দান করিলাম এবং তোমাদের দ্বীন ইসলামের উপর আমি রাজি হইলাম।’ (৫ঃ৪)। (প্রাগুক্ত: পৃষ্ঠা ১৪)। ওপরোক্ত বর্ণনা অনুুযায়ী এটা পরিষ্কার যে, রাসুল মোহাম্মদ (সাঃ) এর ওফাতের পর ইসলাম ও ইসলামী রাষ্ট্র মদিনার শাসনভার পরিচালনার দায়িত্ব হজরত আলী (আঃ) এর ওপরই অর্পিত হয়েছিল। কিন্তু রাসুল মোহাম্মদ (সাঃ) এর ওফাতের সঙ্গে সঙ্গেই হজরত আবু বকর (রাঃ), হজরত ওমর (রাঃ), হজরত ওসমান (রাঃ) সহ অনেক সাহাবী (যারা মূলত উমাইয়া বংশীয়) হজরত আলী (আঃ) এর বিপক্ষে অবস্থান নিলেন। এ প্রসঙ্গে ওপরোক্ত বইয়ের ১২১-১২২ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছেÑ “সেদিন [রাসুল (সাঃ) এর ওফাতের দিন] মদিনায় গোলযোগের সৃষ্টি হইল। মাওলার বিরোধী দল মদিনা ত্যাগ করিয়া বনি সাকিফায় চলিয়া গেল এবং সেখানে উপস্থিত লোকজনেরা মিলিয়া একপ্রকার নির্বাচন করিয়া আবু বকরকে খলিফা নিয়োগ করিল। এই নির্বাচনের মধ্যে কিছু সংখ্যক আনসারও অংশগ্রহণ করিয়াছিল। নির্বাচন একেবারে নির্বিবাদে সম্পন্ন হয় নাই। কারণ এই নির্বাচন সম্পন্ন করিতে দীর্ঘ তিন দিন অতিবাহিত হইয়াছিল। যাহা হোক, রাসুলের দেহত্যাগের তৃতীয় দিবসে আবু বকর খলিফা নির্বাচিত হইয়া দলবল লইয়া মদিনায় ফিরিতেছেন। এদিকে হাসেমীগণ এবং মদিনার আনসারগণ নবীর বিয়োগে শোক-সন্তপ্ত অবস্থায় অভিভূত হইয়া পড়েন এবং তৃতীয় দিবসে আলীর নেতৃত্বে রাসুলুল¬াহর কাফন দাফন সম্পন্ন করেন। নির্বাচিত খলিফা তাহার দলবল লইয়া মদিনা প্রবেশের পূর্বেই জানিতে পারিলেন যে, রাসুলুল-াহর দাফন ক্রিয়া সম্পন্ন করা হইয়া গিয়াছে। তাহারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিলেন কবর হইতে উঠাইয়া রাসুলুল¬াহর দেহ পুনরায় তাহারা তাহাদের ইচ্ছামত দাফন করিবেন। ইহার উদ্দেশ্য অন্য কিছুই নহে। নেতার দাফনক্রিয়ার সঙ্গে রাষ্ট্রনৈতিক অধিকার এবং সর্বপ্রকার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ভাব নিহিত থাকে। তাহাদের এইরূপ সিদ্ধান্তের কথা জানিতে পারিয়া আলী তাঁহার জুলফিকার লইয়া মাটির কবরের উপর বসিয়া পড়িলেন তাহাদিগকে এই কাজে বাধা দেওয়ার জন্য। তাহারা নিকটে আসিয়া একে অন্যের মুখ চাহিতে লাগিল। তখন ওমর আবু বকরকে লক্ষ করিয়া বলিলেন: ‘আপনি আমাদের নির্বাচিত খলিফা, হুকুম করুন, আমরা আলীকে আক্রমণ করি।’ আবু বকর খানিক চিন্তা করিয়া বলিলেন: আমি রাসুলুল¬াহকে বলিতে শুনিয়াছিঃ ‘এমন সময় আসিবে যখন আলী মাটির ঘোড়ায় সওয়ার হইবেন তখন যে-ই তাহার মোকাবিলা করিবে সে কাফের হইয়া মারা যাইবে।’ আমার মনে হয় ইহাই সেই মাটির ঘোড়া। এইরূপে তাহারা তাহাদের সিদ্ধান্ত ত্যাগ করিল।” (প্রাগুক্ত: পৃষ্ঠা ১২১-১২২)। ওপরোক্ত গ্রন্থের ৮৩ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছেÑ “রাসুলের এন্তেকালের প্রায় ২১ বৎসর পরে খেলাফত কোরানের রাষ্ট্রীয় প্রকাশনা সংকলন করেন। এত বিলম্ব করিয়া প্রকাশ করার অন্যতম প্রধান একটি কারণ ছিল মাওলাইয়াতের বিরুদ্ধে এবং আহলে রাসুলের বিরুদ্ধে তাহাদের এই প্রকাশনাকে সাজাইয়া লওয়া। কি বাদ দিতে হইবে এবং কেমন করিয়া সাজাইতে হইবে ইত্যাদি নানারূপ বিষয় ছিল তাহাদের চিন্তার বিষয়। ক্ষমতা ও পরিবেশ সৃষ্টি করিয়া উপযুক্তভাবে উহার প্রকাশ পরিচালনা করাÑ যাহাতে জনমতে কোনরূপ বিদ্রোহ প্রকাশ না পায়। এত সাবধানতা সত্ত্বেও দেখা গেল কোরান সংকলন হজরত ওসমানের পতনের সর্বপ্রধান কারণ হইয়া দাঁড়াইল।” (প্রাগুক্ত: পৃষ্ঠা ৮৩)। ওপরোক্ত গ্রন্থের ৯৫ পৃষ্ঠায় উলে¬খ করা হয়েছেÑ “ইমাম বাকের (আঃ) বলিয়াছেন, তিন শতের উপর কোরানের বাক্য ‘তাহরীফ’ অর্থাৎ ‘বদল’ করা হইয়াছে যাহা আহলে বাইতের শানে ছিল।” বদলকৃত বাক্যের কিছু নমুনাও বইটিতে তুলে ধরা হয়। বইটির ৬ষ্ঠ পৃষ্ঠায় এ রকম একটি নমুনা দেয়া হয় যাতে কোরানের সর্বশেষ আয়াতটিকে খেলাফত সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ স্থানে যে বসিয়েছে, তা সহজেই বোধগম্য হয়। কোরানের ৫ নম্বর সুরার ৪ নম্বর আয়াতের শুরুতে বলা হয়েছেÑ “তোমাদের জন্য (খাদ্য হিসাবে) হারাম করা হইয়াছে শব এবং রক্ত এবং শুকরের মাংস এবং যাহা আল¬াহ ব্যতীত অপরের নামে উৎসর্গিত হইয়াছে এবং গলা চাপিয়া মারা (জন্তু) এবং প্রহারে মৃত (জন্তু) শৃংগাঘাতে মৃত (জন্তু) এবং হিংস্র পশুতে খাওয়া (জন্তু)Ñ তবে জবেহ দ্বারা যাহা পবিত্র করিয়াছ তাহা ব্যতীত এবং যাহা (মূর্তি পূজার) বেদীর উপর জবাই দেওয়া হয় এবং জুয়ার তীর দ্বারা অংশ নির্ণয়কৃত মাংস। এই সবই ফাসেকী।” এরপর কোরানের সর্বশেষ অবতীর্ণ বাক্যটি এখানে সংযোজিত করা হয়েছে, যাতে বলা হয়েছেÑ ‘আজ কাফেরগণ তোমাদের দ্বীন হইতে নিরাশ হইয়া গিয়াছে। অতএব তাহাদিগকে আর ভয় করিও না, ভয় কর আমাকে। আজ তোমাদের দ্বীন পূর্ণ করিয়া দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামতের পরিপূর্ণতা দান করিলাম এবং তোমাদের দ্বীন ইসলামের উপর আমি রাজি হইলাম।’ এরপর আবার খাদ্য সংক্রান্ত বাক্য “সুতরাং যে ব্যক্তি পাপের দিকে ঝুঁকিয়া নয়, ক্ষুধায় কাতরÑ তাহা হইলে নিশ্চয় আল¬াহ (তাহার প্রতি) ক্ষমাশীল রহিম।”(৫ঃ৪)। কোরআনের শেষ অবতীর্ণ এবং গুরুত্বপূর্ণ এই অহি বাক্যটি যাহা গাদিরে খুমে অবতীর্ণ হইয়াছিল তাহা এমন জায়গায় স্থাপন করা হইয়াছে যাহাতে ইহাই বোঝা যায় যে, কেবলমাত্র খাদ্যের ভাল মন্দ (এই আয়াতের নির্দেশমতে) বিচার করিয়া খাইলেই ধর্ম পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়। এই আয়াতটি হইল খাদ্য বাছাই করা বিষয়ে একটি সাধারণ ব্যবস্থা। অথচ মধ্যবর্তী কথাটি ইহাতে স্থাপন করাতে মনে হয় দেখিয়া শুনিয়া খানা খাইলেই দ্বীন কামেল হইয়া যায় অর্থাৎ পূর্ণতাপ্রাপ্ত হইয়া যায়। (প্রাগুক্ত: পৃষ্ঠা ৬-৭)। ওপরোক্ত গ্রন্থের ৬-৭ পৃষ্ঠায় প্রদত্ত ওপরোক্ত যুক্তিই এ কথা স্পষ্ট করে দেয় যে, হজরত আলীকে রাসুল (সাঃ) এর ওফাতের পর মদিনার রাষ্ট্রভার গ্রহণ থেকে বঞ্চিত করা অপর খলিফারা এ সংক্রান্ত কোরানের অপর আয়াতগুলি বাদ দিয়ে ‘আজ কাফেরগণ তোমাদের দ্বীন হইতে নিরাশ হইয়া গিয়াছে। অতএব তাহাদিগকে আর ভয় করিও না, ভয় কর আমাকে। আজ তোমাদের দ্বীন পূর্ণ করিয়া দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামতের পরিপূর্ণতা দান করিলাম এবং তোমাদের দ্বীন ইসলামের উপর আমি রাজি হইলাম।’ এই বাক্যটিকে কোথায় বসাবে সেই দিশা না পেয়ে হালাল খাবার সংক্রান্ত আয়াতসমূহের ভেতরেই ওপরোক্ত এই আয়াত ঢুকিয়ে দিয়েছে। ওপরোক্ত গ্রন্থটিতে ইসলামের প্রধান দুটি দল শিয়া ও সুন্নীর মধ্যে বিভেদের বিষয়ে যে ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে, সেই প্রেক্ষিতে এই প্রশ্নটিও এসে যায় যে, ইঞ্জিল শরীফ বিকৃত হয়ে যাওয়ার কারণে তা যদি আর মানুষের জন্য অনুসরণযোগ্য গ্রন্থ না থাকে, তবে ক্ষমতালাভ ও ভোগের স্বার্থে তৎকালীন ক্ষমতাসীনরা কোরানের যে বিকৃতি ঘটিয়েছেন (ঢাকার ২৬ বাংলাবাজারস্থ র্যামন পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত সদর উদ্দিন আহ্মদ চিশ্তী রচিত ‘মাওলার অভিষেক ও মতভেদের কারণ’ গ্রন্থের ওপরোক্ত বক্তব্য মতে) অন্যকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে, সেই বিকৃত কোরান কি মানুষের জন্য আর গ্রহণযোগ্য থাকে? তা-ও কি ইঞ্জিল শরীফের মতো বাতিলযোগ্য গ্রন্থ হয়ে যায় না? আর কোরান বাতিলযোগ্য গ্রন্থ হলে গ্রন্থটিকে ঘিরে যারা ধর্মবাণিজ্য করছেন, তাদের ধর্ম বাণিজ্যের কোনো সুযোগ কি থাকে? আর ওপরোক্ত গ্রন্থের বক্তব্য সত্য হলে রাসুল (সাঃ) এর ওফাতের পর যারা তাঁর মৃতদেহের দাফন-কাফনের ব্যবস্থা না করেই ক্ষমতার লোভে তাঁর লাশ মাটিতে ফেলে রেখে প্রায় ৩ দিন যাবৎ অন্যত্র গিয়ে রাসুল (সাঃ) এর উত্তরসূরী নির্বাচিত করেছেন, সেই ব্যক্তিদের যেমন রাসুলপ্রেমিক বলা যাবে না, তেমনি তাদের দ্বারা প্রচারিত বিকৃত ধর্মবাণী গ্রহণ না করাই মানুষের জন্য উত্তম। কেননা, স্বার্থবাদীদের দ্বারা প্রচারিত বিকৃত ধর্মবাণীর কারণেই মুসলিমরা আজ বিশ্বে শতাধিক ভাগে বিভক্ত হয়ে মসজিদে বোমা ফাটিয়ে মানুষ হত্যায় লিপ্ত। আর স্বার্থবাদিতাই বর্তমান মুসলিমদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে গিয়েছেÑ এজন্যও দায়ী স্বার্থবাদীদের দ্বারা প্রচারিত বিকৃত ধর্মবাণী, যা বর্জন করে চলা মুসলিমদের জন্য যেমন উত্তম, তেমনি উত্তম বিশ্ব মানবতার জন্যও।
২৬৮। মুসলিমদের ধর্মগ্রন্থ কোরআনে বলা হয়েছেÑ তোমরা যদি সীমা লঙ্ঘন করো, তবে আমি তোমাদের পরিবর্তে নতুন এক স¤প্রদায় সৃষ্টির ক্ষমতা রাখি। আর মুসলিমরা যে সীমা লঙ্ঘন করেছে এবং অনবরত করে চলেছে, তার বহু প্রমাণ বর্তমান পৃথিবীতে আছে। পৃথিবীর বহু এলাকায় মুসলিমরা নিরীহ মানুষকে গুলি বা বোমার আঘাতে হত্যা করেছে। শ্রীলঙ্কার শান্তিপ্রিয় ক্রিকেটারদের ওপরও হামলা চালিয়েছে মুসলিম নামধারীরা। যেহেতু মুসলিমরা সীমা লঙ্ঘন করলে তাদের বিশ্বাসকৃত আল¬াহ নতুন এক স¤প্রদায় সৃষ্টির ঘোষণা দিয়েই রেখেছেনÑ সেহেতু তাদের বিশ্বাসকৃত আল¬াহ কতোটা ক্ষমতাবান, তা দেখার আশায় নতুন এক স¤প্রদায় সৃষ্টির অপেক্ষায় রইলাম।
২৬৯। আমি মনুষ্য শ্রেণীকে দু ভাগে দেখিÑ মানুষ ও অমানুষ। যাদের মধ্যে মনুষ্যত্ব আছে, তারা যে ধর্ম স¤প্রদায়েই জন্ম গ্রহণ করুক না কেন, আমি তাদের শ্রদ্ধা করি। আর যাদের মধ্যে মনুষ্যত্ব নেই, তারা যে ধর্মাবলম্বীই হোক না কেন, আমি তাদের ঘৃণা করি।
২৭০। পশু কোরবানি বা পাঁঠা বলির ধর্মাচারের মাধ্যমে মূলতঃ সবল মানুষের দ্বারা নিরীহ প্রাণীর গলা কর্তনের উৎসব হয়। যদিও ধর্মীয় বিশ্বাস মোতাবেকÑ সবল মানুষের হাতে নিরীহ প্রাণীদের রক্ত ঝরিয়ে আল¬াহ ও ভগবান খুবই আনন্দিত হন এবং তাঁদেরকে এমন আনন্দ দেয়ার জন্যই আল¬াহ ও ভগবানভক্ত মানুষেরা পশু কোরবানি বা পাঁঠা বলি দিতে বাড়তি অর্থ খরচ করে হলেও নিরীহ পশুদের রক্ত ঝরানোর উৎসব পালন করে থাকেন। এ প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, যেহেতু আল¬াহ ও ভগবান সবল মানুষের হাতে নিরীহ প্রাণীদের রক্ত ঝরিয়ে আনন্দ পান, সেহেতু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে ইহুদি-হিন্দু-খ্রিস্টানদের হাতে নিরীহ মুসলিমদের রক্ত ঝরিয়েও আল¬াহ ভীষণ আনন্দ উপভোগ করে থাকেন। আর আল¬াহভক্ত যেসব মুসলমান আল¬াহকে আনন্দিত ও সন্তুষ্ট করতে চান, তাদের উচিত ইহুদি-খ্রিস্টান-হিন্দুদের যুদ্ধাস্ত্রের সামনে বুক পেতে দিয়ে কোরবানি বা বলি হয়ে যাওয়া। কেননা, দুর্বলের রক্ত ঝরানোতেই তো আল¬াহর আনন্দ! সবলের হাতে দুর্বলের প্রাণ হরণের বিধান দিয়েছেন আল¬াহ ও ভগবান তাঁদের ভক্তদের। তাঁরা কত মহান! আবার হিংস্র বাঘ-সিংহ ও বিষধর সর্পকে রক্ষায় মানুষের মনে দিয়েছেন তাঁরা বেজায় টান। ‘বন্য প্রাণী সংরক্ষণ’ আইনের মাধ্যমে এসব হিংস্র প্রাণীকে রক্ষায় মানুষকে করেছেন প্রজ্ঞাবান। ‘হিংস্রকে সুরক্ষা দান, আর নিরীহের কারো প্রাণ’Ñ আল¬াহ ও ভগবানের চমৎকার বিধান। তাঁরা কত মহান! রহিমে রহমান!
২৭১। পীর-ফকির বা কবিরাজদের মধ্যে যারা দুর্বল চিত্তের অধিকারী অসহায় মানুষের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য তাদেরকে রাতের আঁধারে নির্জন স্থানে বা দিনের বেলাতেও বিশেষ স্থানে হাজির হতে বলেন, তাদের নির্দেশনা মোতাবেক যারা সেই স্থানে হাজির হন, তাদের এই উপস্থিতিতে তাদের কোন লাভ হোক বা না হোক, কথিত পীর-ফকির বা কবিরাজদের উদ্দেশ্য ঠিকই হাসিল হয়ে যায় তাতে।
২৭২। শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ মানেই অন্যের জন্য গর্ত খুঁড়ে নিজে অর্থের পাহাড়ে ওঠার স্বপ্ন দেখা। আর বিজ্ঞজনেরা তো বলেই গেছেনÑ যিনি অন্যের জন্য গর্ত খোঁড়েন, তার নিজেরই সেই গর্তে পড়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ঠিক সেভাবেই যারা অন্যকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে নিজেরা লাভবান হবার মানসিকতা নিয়ে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে যান, তারা নিজেরাই গর্তে পড়ে বিনিয়োগকৃত অর্থ গচ্চা দেন এবং গুটিকয়েক কৌশলীকে অতি তাড়াতাড়ি অতি অর্থ-সম্পদের মালিক বানাবার পথ সুগম করেন। পক্ষান্তরে পুঁজি যার যতটুকু ছিল বা আছে, তা মানুষের জন্য কল্যাণকর কাজে বিনিয়োগের মানসিকতা নিয়ে যদি পুঁজির অধিকারীরা শ্রম দিতেন বা দেন, তবে ধীরে ধীরে টিলায় ওঠা তাদের দ্বারা সম্ভব হতো। গর্তে পড়ার সম্ভাবনা তাদের কমই থাকতো। কিন্তু অন্য দশজনকে গর্তে ফেলে নিজে তাদের পিঠে চড়ে পাহাড়ে ওঠার স্বপ্ন দেখলে বাস্তবতার পিচ্ছিল পথে পিছলে গিয়ে নিজেরই গর্তে পড়ে কবরস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকারীদের অধিকাংশেরই বিনিয়োগ এভাবেই কবরস্থ হয়ে যায়। আর এজন্য প্রধানত দায়ী বিনিয়োগকারীদেরই অতি অর্থ লোভ। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যুÑ এ শিক্ষাটা বিনিয়োগকারীদের অধিকাংশই স্কুলজীবনে পেয়ে থাকলেও বাস্তবজীবনে শিক্ষাটাকে মস্তিষ্কের বাইরে ঠেলে দিয়ে বিনিয়োগকারীরা পুঁজির বিনাশ বা অধঃপতনকেই দ্রুত কাছে টেনে আনেন।
২৭৩। মানুষের মধ্যে যাদের লেজ রয়েছেÑ অর্থাৎ, যারা পশুস্বভাবের অধিকারী, তাদের লেজ কেটে তাদেরকে মনুষ্য স্বভাবের অধিকারী বা যথার্থ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার শিক্ষাই আমি দিয়ে যেতে চাচ্ছি। এজন্য নিজেকে কোন নবী বা পয়গম্বর বলে আমি দাবি করি না। ¯্রফে মনুষ্যত্ব বিষয়ে শিক্ষাদানকারী একজন শিক্ষক বলেই নিজেকে দাবি করি আমি। তবে কাকতালীয়ভাবে কোরআনের সুরা কাউসারে অমানুষদের লেজ কেটে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। আর মুসলমানেরা বিশ্বাস করে যে, কেয়ামতের দিনে হাউজে কাউসারের পানি মুসলমানদের পান করানো হবেÑ এই আশ্বাস পেয়েই পৃথিবীর অমানুষদের লেজ কেটে গিয়ে তারা মুসলিম হয়ে যাবেন। সে যাই হোক, এই আশ্বাস পৃথিবীর তিন-চতুর্থাংশ মানুষকে প্রায় ১৪৩৩ বছর পরও মুসলমান বানাতে পারেনি; আর মুসলমানদের মধ্যেও অনেককে যথার্থ মানুষ বানাতে পারেনি। অর্থাৎ, অনেক মুসলমানই পশুস্বভাবের অধিকারী বা লেজবিশিষ্ট হয়ে আছেন। এ ধরনের লেজবিশিষ্ট মুসলিমসহ অন্য ধর্মাবলম্বী যারা ধর্মীয় মতপার্থক্যের কারণে অপরের প্রতি বিদ্রুপ করেন বা অন্তরে বিদ্বেষ পোষণ করেন, তাদের উদ্দেশে ¯্রফে এটুকুই বলতে চাইÑ অদৃশ্য হলেও লেজ থাকা তথা পশুস্বভাবের অধিকারী হওয়া মানুষের জন্য শোভনীয় নয়।
২৭৪। বর্তমান পৃথিবীর অনেকেই এমন স্বার্থবাদিতায় ডুবে আছেন যে, এদের দেখে মনে হয়Ñ তারা এখন কেয়ামতের ময়দানে আছেন এবং ‘ইয়া নফসি’, ‘ইয়া নফসি’ করছেন। তাদের নফস ছাড়াও যে পৃথিবীতে আরো নফস আছে এবং পৃথিবীর প্রত্যেক নফসের শান্তির জন্যই যে মানুষের কাজ করা উচিতÑ এই শিক্ষাটা তাদের মস্তিষ্ক থেকে হারিয়ে গেছে। কেয়ামতের ময়দান থেকে বের হয়ে এই স্বার্থবাদীরা মানবতাবাদী হোক এবং মানবতার কল্যাণে কাজ করুকÑ এটাই প্রত্যাশা আমার।
২৭৫। এক পাতিলে রান্না করা একই ধরনের চালের ভাত একই রকম হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় শেখ মুজিবুর রহমান যে রকম ভাবে জাতির সাথে রাজনৈতিক মোনাফেকী করেছিলেন, তেমনিভাবেই তার কন্যা শেখ হাসিনা বর্তমানে জাতির সাথে রাজনৈতিক মোনাফেকী করে যাচ্ছেন। ১৯৭১ সালে রক্ত ঝরেছিল এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সাধারণ মানুষের। আর এসব হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহায়তা করা বিভিন্ন অঞ্চলের ‘রাজাকার’, ‘আলবদর’, ‘আল শামস’দের বিচারের আওতায় না এনে কেবল রাজনীতির ময়দানে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠা গুটিকয়েক রাজনীতিবিদের বিচার করা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের নামান্তর মাত্র। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী মূল রাজনৈতিক নেতাদেরই যদি বিচার করতে হয়, তবে আন্দোলন-সংগ্রাম-হরতালের নামে বিগত ৪০ বছরে যত মানুষের মৃত্যু ঘটেছে বাংলাদেশে, তাদের হত্যার জন্য মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত করে শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়াসহ আওয়ামী লীগ, বিএনপি, মহাজোট ও চারদলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসিতে ঝোলানো দরকার ছিল সর্বোচ্চ আদালতের। বিশেষ করে হোটেল শেরাটনের সামনে হরতালের আগের রাতে দোতলা বাসে পেট্রোল বোমার আগুনে ১১ জনকে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় শেখ হাসিনা ও তার তখনকার সহযোগী রাজনৈতিক নীতি নির্ধারকদেরকে আগুনে পুড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া উচিত ছিল আদালতের স্বপ্রণোদিত হয়ে। কিন্তু তা না করে আদালত প্রমাণ করেছে যে, এদেশে সাধারণ মানুষের বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে আদালত বরাবরই নির্বিকার থাকে। আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে এসব রাজনৈতিক হুকুমের আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার ব্যবস্থা করলে রাজনীতিবিদদের দ্বারা মানবতাবিরোধী অপরাধ অনেক কমে যেত বাংলাদেশে।
২৭৬। পুরুষ ও নারীর সমঅধিকার অন্ততঃ একটি ক্ষেত্রে চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। তা হচ্ছেÑ চলচ্চিত্র বা স্যাটেলাইটের বিভিন্ন চ্যানেলে প্রদর্শনের জন্য চিত্রায়িত নানা অনুষ্ঠানে অভিনেতা বা পুরুষ মডেলকে ফুল প্যান্ট ও শার্ট/গেঞ্জি দ্বারা প্রায় সারা শরীর ঢাকা অবস্থায় উপস্থাপন করা হচ্ছে। পক্ষান্তরে অভিনেত্রী বা নারী মডেলকে কত কম কাপড় পরিয়ে উপস্থাপন করা যায়, সেই প্রতিযোগিতা চলছে। এতে করে চলচ্চিত্র বা স্যাটেলাইট চ্যানেলের বিভিন্ন দর্শকদের মধ্যে পুরুষ দর্শকরা নারীর প্রায় পুরো নগ্ন শরীর দেখার মজা উপভোগ করছে। কিন্তু সংশি¬ষ্ট নির্মাতারা অভিনেত্রী বা নারী মডেলদের মতো অভিনেতা বা পুরুষ মডেলদের নেংটি পরিয়ে নাচ-গান ও অন্যান্য দৃশ্যে উপস্থাপন না করাতে নারী দর্শকরা পুরুষের প্রায় পুরো নগ্ন দেহ দেখার মজা উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যা অনুষ্ঠানের মজা নেয়ার ক্ষেত্রে নারীর সমঅধিকার চরমভাবে লঙ্ঘন করার শামিল। এক্ষেত্রে নারীর সমঅধিকার নিশ্চিত করার জন্য নির্মাতাদের উচিতÑ অভিনেতা বা পুরুষ মডেলকে আদিম যুগের পুরুষদের মতো নেংটি পরিয়ে পর্দায় উপস্থাপন করা, যাতে করে বিনোদনের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমঅধিকার নিশ্চিত করা যায় এবং মানুষেরা গর্ব করে বলতে পারে যে, আদিম যুগের ঐতিহ্য একবিংশ শতাব্দীতেও তারা আধুনিক ঢঙ্গে বর্ণিল নেংটি দ্বারা ধরে রাখতে পেরেছে।
২৭৭। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি দক্ষ প্রশাসন দ্বারা চলছে না, চলছে অনুগত প্রশাসন দ্বারা। আর অনুগত প্রশাসন মানেই ধান্ধাবাজ, ফাঁকিবাজ, ফন্দিবাজ কিছু লোকের কর্মকাণ্ড; যা দ্বারা রাষ্ট্রের মানুষের পরিপূর্ণ কল্যাণ ও শান্তি কখনোই সম্ভব নয়।
২৭৮। বাংলাদেশের সর্বক্ষেত্রেই দলবাজি এ দেশের মানুষের শান্তি ও উন্নতির পথে প্রধান অন্তরায়। তবে দলবাজিতে যারা নেতৃত্ব দেয়, তাদের শান্তি ও উন্নতিতে প্রধান সহায়ক। দেশের অধিকাংশ মানুষ মূর্খ বলে তারা নিজেদের পায়ে কুড়াল মারতে দলবাজিতে নেতৃত্ব দেয়া লোকেদের শান্তি ও উন্নতিতে সহায়তা করে থাকে তাদের কূটবুদ্ধির কাছে নিজেদের বিবেককে সমর্পণ করে।
২৭৯। বর্তমান আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক নানা মতপার্থক্য থাকলেও উভয় দলের রাজনীতিই রাষ্ট্রের সকল অসাধু শক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা করে জনগণের ওপর জুলুম-নির্যাতন বাড়িয়ে দলীয় নেতাদের অর্থ-সম্পদ বাড়ানোর একই নীতিতে চলছে। আর এদেশের মূর্খ জনতা দেশপ্রেমের চেয়ে ব্যক্তিপ্রেম ও দলপ্রেমকে প্রাধান্য দিয়ে আবেগান্ধ হয়ে আছে বলে রাজনীতিবিদদের দ্বারা ভুগছে বেশি।
২৮০। আমি পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর ও সবচেয়ে বেশি অর্থশালী ব্যক্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারি। তবে কার্যকারণ সম্পর্ক ছাড়া আমার এই স্বপ্নপূরণ কখনোই সম্ভবপর হবে না। অর্থাৎ, মানুষকে স্বপ্ন দেখতে হবে বাস্তবতার আলোকে। নাহলে স্বপ্নভঙ্গের বেদনাতে ভুগতে হবে।
২৮১। পৃথিবীর সাধারণ মানুষের ওপর জুলুম ও নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে যেসব রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও প্রশাসনের বিভিন্ন লোক, তাদের জুলুম ও নিপীড়ন থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করতে আকাশ থেকে কেউ নেমে আসবে না। মানুষকেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে সকল প্রকার জুলুম ও অন্যায়ের অবসান করতে হবে, যদি তারা নিপীড়িত হতে না চায়। এতে অবশ্য কারো কারো জীবনাবসানের ঝুঁকিও থাকবে।
২৮২। একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার যুগে এসেও মানুষের যে ব্যর্থতা প্রকটভাবে চোখে পড়ছে, তা হলোÑ ডাইনোসরের মতো ভয়ংকর প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটা সম্ভব হলেও মানুষের নিত্যদিনের পীড়াদায়ক প্রাণী মশা, পিঁপড়া ও ইঁদুরের বিলুপ্তি ঘটাতে মানুষ অক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছে। মানুষের শান্তিপূর্ণ বসবাসের উপযোগী করে পৃথিবীটাকে গড়ার বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে হবে মানুষকেই। বিষয়টিকে বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে মানুষের ভোগান্তির শেষ হবে না কখনো।
২৮৩। আমার প্রজ্ঞা এবং বিশ্বাস এ কথা বলে যে, বর্তমানে মানুষেরা যখন তাদের শক্তিকে মানুষের কল্যাণে কাজে লাগায়, তখন সেই শক্তি ‘স্রষ্টার শক্তি’ বলে বিবেচিত হয় এবং মানুষেরা যখন তাদের শক্তিকে মানুষের জন্য ক্ষতিকর কাজে লাগায়, তখন সেই শক্তি ‘শয়তানি শক্তি’ হিসেবে ঘৃণিত হয়। অর্থাৎ, পৃথিবীতে বর্তমানে মানুষের জন্য যেসব ‘শয়তানি শক্তি’ বা অপশক্তি ক্রিয়া করছে, সেইসব অপশক্তিকে মোকাবিলা করার জন্য মনুষ্যত্ববোধসম্পন্নরা যতদিন পর্যন্ত না তাদের শক্তিকে সম্মিলিত করে ‘স্রষ্টার শক্তি’ সৃষ্টি করতে না পারবে, ততদিন পর্যন্ত অপশক্তি বা ‘শয়তানি শক্তি’র কাছে পরাজিত হবে সাধারণ মানুষেরা। কারণ, মানুষের সম্মিলিত শক্তিতেই স্রষ্টা সর্বশক্তিমান। মানুষের সম্মিলিত শক্তি চাইলে কাউকে প্রচুর অর্থ-সম্পদের মালিক বানাতে পারে, আবার চাইলে কোনো প্রজাতির প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটাতে পারে।
২৮৪। যিশুকে বলা হয় শান্তির প্রতীক। আর খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করেন যে, যিশুর প্রতি যারা অন্ধবিশ্বাস রাখবেন, তারা পরবর্তী জীবনে পরিপূর্ণ শান্তির মধ্যেই থাকবেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, যিশুর জন্মস্থান জেরুজালেমকেন্দ্রিক রাষ্ট্র ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলে দীর্ঘদিন যাবৎ শান্তি বিরাজিত নেই। এতে এ কথাই স্পষ্ট হয় যে, মানুষের মধ্যে অনেকে যিশুকে শান্তির প্রতীক এবং ঈশ্বর বলে ভাবলেও তিনি নিজ জন্মস্থানকেন্দ্রিক এলাকাতেই শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে অক্ষম এক সত্তা। এমন অক্ষম সত্তার আরাধনা না করাই মানুষের জন্য উত্তম।
২৮৫। বর্তমান পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত। এর মানে হচ্ছেÑ একবিংশ শতাব্দীতে এসেও মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠের বিবেক অন্ধ অবস্থায় আছে। যে যুগে মানুষের ঘরে ঘরে নানা রঙের আলো খেলা করছে, সেই যুগে প্রবেশ করেও মানুষের বিবেকে মোমবাতি বা কুপিবাতি জাতীয় আলোও জ্বলছে না, এটা রীতিমতো দুঃখজনক।
২৮৬। যে ব্যক্তি স্রষ্টার বন্ধু হতে পারে, তার ইহকাল-পরকাল নিশ্চিন্ত। তাকে স্রষ্টার কাছে মাথা নোয়ানোর প্রয়োজন নেই। কারণ, সে স্রষ্টার সঙ্গে প্রতিদিনই কোলাকুলি করার ক্ষমতা রাখে। আর যারা স্রষ্টার দাস হয়েই থাকে বা থাকতে চায়, তারাই স্র্ষ্টার কাছে মাথা নোয়ানোর প্রয়োজন বোধ করে। স্রষ্টাও তাদেরকে দাস বলেই বিবেচনা করেন প্রতিটি ক্ষেত্রে।
২৮৭। বাংলাদেশের সরকারি/বেসরকারি/স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন সংস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি এ কথাই প্রমাণ করে যে, এ দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান, আইন প্রণয়ন ও আইন কার্যকরের সঙ্গে সংশি¬ষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং দুর্নীতিযুক্ত সকল সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তিরাও দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। যদি তারা সম্পৃক্ত না হতেন, তবে নিজ নিজ অধীনস্থ সংস্থা হতে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করেই ছাড়তেন। ক্ষুদ্র কোন সংস্থায়ও দুর্নীতির বিদ্যমানতা এটাই প্রমাণ করে যে, রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের কর্তারা দুর্নীতিমুক্ত নয়। মুখে যে যতই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলুক না কেন, তা লোকদেখানো মাত্র এবং জাতিকে ধোঁকা দেয়ার শামিল। কারণ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যার অবস্থান, তার অধীনস্থ কোন সংস্থাতেই দুর্নীতি থাকার উপায় নেই। দুর্নীতিমুক্ত সংস্থাই কেবল সেই সংস্থার কর্মকর্তার দুর্নীতিমুক্ততা প্রমাণ করতে পারে। আর যার অধীনস্থ সংস্থায় দুর্নীতি হচ্ছে, তার মুখে দুর্নীতিবিরোধী কথা শোনা যাওয়ার অর্থ একটাইÑ তিনি ভণ্ডদের দলে যোগ দিয়েছেন।
২৮৮। বিএনপি’র রাজনৈতিক নেতাদের অভিযোগ মোতাবেক আওয়ামী লীগ হচ্ছে সন্ত্রাসের গডফাদার, লুটেরা, কালোবাজারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া সংগঠন। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ হচ্ছেÑ বিএনপি’র নেতারা হচ্ছেন দুর্নীতিবাজ এবং জনগণের অর্থ-সম্পদ লুটেরা। আর বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগÑ জাতীয় পার্টি হচ্ছে স্বৈরাচার ও দুর্নীতিবাজের দল। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়Ñ চোর-ডাকাত ও স্বৈরাচার বারবার ক্ষমতায় আসবে কেন? আর জনগণ বারবার এদের নির্বাচিত করে নিজেরাই নিজেদের ক্ষতির পথ তৈরি করে নেবে কেন? জনগণের কি সৎ ও আদর্শবান নেতা খুঁজে নেয়ার যোগ্যতা নেই?
২৮৯। আমি মানুষের মুখেই স্রষ্টার নানা রূপ দেখি। মানুষের হাতেই স্রষ্টার হাত দেখি। মানুষের সৃষ্টিতেই স্রষ্টার জ্ঞানের প্রকাশ দেখি। আর সেইসাথে এটাও দেখি যে, স্রষ্টা নিজেকে নানা রূপে প্রকাশের মাধ্যমে কেমন করে জীবনের আনন্দ নিচ্ছেন।
২৯০। এমন অনেক লোককে দেখেছিÑ যারা স্বার্থবাদিতায় এতোটাই ডুবে থাকেন যে, আত্মীয়-স্বজনের সহযোগিতায় ২/৩ হাজার টাকাও ব্যয় করতে যান না। কিন্তু অতি মুনাফার আশায় শেয়ার বাজার, ইউনিপে টু, যুবক এবং বিভিন্ন মাল্টিলেভেল মার্কেটিং সংস্থায় ২/৩ লাখ টাকা ঢেলে তাদের চেয়ে স্বার্থবাদীদের অর্থ বাড়াতেÑ তথা নিজের অর্থ লুটতে তাদেরকে সহযোগিতা করে নিজেরা নিঃস্ব হয়ে পড়েন। স্বার্থবাদী এবং অতি অর্থলোভী হওয়ার এই শাস্তিটা আসলে তাদের প্রাপ্যই। তবে অনেকে এমন শাস্তি একবার, দু’বার পাওয়ার পরও আবার পেতে চেষ্টা করেন। এদেরকে আহাম্মক ছাড়া আর কি বলা যায়!
২৯১। মানুষের প্রত্যেকেই পৃথকভাবে মৃত্যুর স্বাদ পায়। তবে মানবজাতির মৃত্যু কখনোই ঘটবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। কেননা, মানবাত্মা এবং মানবের আলোকদেহ অমর।
২৯২। বিশিষ্ট প্রাণিবিজ্ঞানী ডারউইন যেমন তত্ত্ব দিয়ে গেছেন যে, বানর বিবর্তিত হয়ে মানুষ হয়েছেÑ তেমনি বিড়াল বিবর্তিত হয়েই বোধ হয় নারীজাতির সৃষ্টি হয়েছে। কেননা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কিছু পুরুষের বাস বা টেম্পোর হ্যান্ডেল ধরে ঝোলা ছাড়া বানরের সঙ্গে মানুষের আর কোনো বৈশিষ্ট্য তেমন মেলে না। কিন্তু নারীজাতির সাথে বিড়ালের অন্তত ৪টি মিল রয়েছেÑ ১. বিড়ালের শরীর যেমন নরম তুলতুলে, তেমনি নারীর শরীরও নরম তুলতুলে। ২. বিড়াল যেমন আরামপ্রিয়, তেমনি নারীও আরামপ্রিয়। ৩. বিড়ালকে যে আহার দেয়, বিড়াল তার গা ঘেঁষে থাকে। তেমনি নারীকে যে মুখরোচক খাবার বা টাকা-পয়সা দেয়, নারীও তার কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। ৪. বিড়াল যেমন সারাদিন মিউ মিউ করে, তেমনি নারীজাতি সারাদিন ভারতীয় হিন্দিভাষী নারীর ভাষায় কিঁউ-কিঁউ (কেন, কেন) করে।
২৯৩। রাসুল মোহাম্মদ (সাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন যে, পৃথিবীতে ইয়াযুয-মাযুয নামে একটা স¤প্রদায় আসবে, যাদের দাপটে সাধারণ মানুষ অসহায় থাকবে। আমার বিশে¬ষণ হচ্ছে, এই ইয়াযুয-মাযুয স¤প্রদায় বর্তমানে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত। মানুষের মধ্যে যারা অন্যের অর্থ-শ্রম শোষণ করে নিজেরা ঋষ্টপুষ্ট হয়ে উঠেছে, এরাই সেই ইয়াযুয-মাযুয। বর্তমানে যারা সিন্ডিকেট করে বা অতি মুনাফা অর্জনের প্রতিযোগিতায় নেমে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে, অতিরিক্ত গাড়ি-বাড়ি ভাড়া নিয়ে, চিকিৎসায় অতিরিক্ত ফি নিয়ে, শিক্ষাক্ষেত্রে বাণিজ্যিক প্রবণতা সৃষ্টি করে ঋষ্টপুষ্ট হয়ে উঠছেÑ এরা এবং ক্ষমতার দম্ভে প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে কাজে লাগিয়ে কিংবা রাজনীতির নামে যারা সাধারণ মানুষকে নানাভাবে ভোগাচ্ছে, এদেরকেই ইয়াযুয-মাযুয হিসেবে আখ্যায়িত করছি আমি।
২৯৪। মানুষকে ঠকিয়ে অর্থ উপার্জনের কোনো প্রতিযোগিতায় আমি নেই। তেমনি অস্থিরও হতে চাই না জীবিকার তাগিদে। সকল ক্ষেত্রেই আমি স্রষ্টার ওপরে নির্ভর করতে পছন্দ করি। এতে অনেকের দৃষ্টিতে আমার অবস্থান অপমানজনক হলেও স্রষ্টা যখন আমাকে সম্মানিত করতে চাইবেন, তখন আমি ঠিকই সম্মানিত হবো। এটাই আমার মতেÑ স্রষ্টার ওপর ঈমান বা বিশ্বাসের নিদর্শন। স্রষ্টা জীবিকার জন্য কাজের প্রতি তাগিদ দিলেও হালাল উপার্জনÑ অর্থাৎ অন্যকে না ঠকিয়ে না ভুগিয়ে উপার্জনের নির্দেশ দিয়েছেন আদমের বংশধরের প্রতি। আর ইবলিশের বংশধরকেই অন্যকে ঠকানোরÑ অন্যের প্রতি অন্যায় ও জুলুম করার ক্ষমতা দিয়েছেন। মানুষের ধর্ম সম্বন্ধে জ্ঞান কম বলেই ইবলিশের বংশধরেরাই এখন আদমের বংশধর হিসেবে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বহাল তবিয়তে আছে। আর আদমের সলিড বংশধরেরাই পৃথিবীতে কোণঠাসা হয়ে পড়ে আছে। আদমের বংশধরেরা আবার ইবলিশের বংশধরদের কারসাজিতে এমনই মূর্খ হয়ে আছে যে, ইবলিশের বংশধরকে সেরা আদমের মর্যাদা দিয়ে তাদের মাথায় তুলে রেখেছে।
২৯৫। নামাজ-রোজা-হজ্ব-যাকাত-পূজা-প্রার্থনা এসব ধর্মাচার কেন ধর্মপ্রবক্তারা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তা অনেক ইমাম-মাওলানা, পুরোহিত, পাদ্রীও বোঝেন না। বোঝেন না বলেই ধর্মাচার পৃথিবীতে অধিক গুরুত্ব পাচ্ছে। আর ধর্মীয় মূল শিক্ষাগুলি মাটিচাপা পড়ে কবরস্থ হচ্ছে। গণনায় মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, ইহুদির সংখ্যা পৃথিবীতে প্রতিদিনই বাড়ছে, কিন্তু মানুষকে মনুষ্যত্ববোধসম্পন্ন করে গড়ে তোলার জন্য ধর্মপ্রবর্তকদের যে প্রচেষ্টা ছিল, তা ধুলায় মিশে যাচ্ছে। আর সে কারণে পৃথিবীতে ইয়াযুয-মাযুয ও ইবলিশের বংশধর বেড়েই চলেছে।
২৯৬। ধর্মীয় মূল আদেশগুলো মানুষ যাতে মনে রাখে এবং তা যাতে পালন করে, সে জন্যই ধর্মাচারের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন ধর্মপ্রবক্তারা। কিন্তু আজকাল ধর্মাচার পালনকারী যত লোক দেখা যায়, তার দশ ভাগের এক ভাগ লোকও ধর্মীয় মূল শিক্ষাগুলি অনুসরণ করে চলছে না। তাই এসব ধর্মাচারের কোনো মূল্য নেই স্রষ্টার কাছে। ওরচেয়ে ধর্মীয় মূল শিক্ষাগুলি যদি মানুষ অনুসরণ করে চলত, তবে স্রষ্টা খুশি থাকতেন আরো বেশি।
২৯৭। কোরআন-বাইবেলে মানুষের বেহেস্তি জীবনের যে কাহিনি উঠে এসেছে, তার সারমর্ম হচ্ছে এই যেÑ তোমার যদি জীবিকার ব্যবস্থা থাকে এবং তুমি নিরোগ থাকো, তবে তুমি যে অবস্থায় আছো, তাতে সন্তুষ্ট থাকলেই তুমি বেহেস্তের বাগানে আছো। আর তা থেকে বেশি পাওয়ার লোভ করলে তুমি বেহেস্ত হারাবে বা দুর্যোগগ্রস্ত হবে। মানুষেরা কোরআন-বাইবেলের এই শিক্ষাটা বোঝে না। বেশি পাওয়ার লোভ করে হয় দুনিয়াতেই দুর্দশাগ্রস্ত হয়, না হয় পরবর্তী জীবনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পথ তৈরি করে। মানুষের মাঝে ধর্মীয় এই শিক্ষা না থাকাতেই মানুষেরা পৃথিবীতে অস্থির হয়। আর তাদের অস্থিরতাই তাদেরকে অশান্তিতে ভোগার পথ খুলে দেয়।
২৯৮। ধর্ম যদি মানুষে-মানুষে মহামিলনের পথ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়, তবে ধর্মের সার্থকতা কি? ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছেÑ স্বর্গ থেকে মানুষকে নামিয়ে দেয়ার সময় স্রষ্টা এই বলে মানুষকে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, মানুষের সবচেয়ে বড় শক্রু হচ্ছে সেই ফেরেশতাÑ যে মানুষকে সিজদা দেবে না বলে পণ করেছে। তবে অনেকের কাছে দুঃখজনক হলেও এটা প্রমাণিত সত্য যে, মানুষকে সিজদা না দেয়া সেই ফেরেশতার কারসাজিতেই আজ মানুষের মাঝে এত বিভাজন এবং মানুষে-মানুষে মহামিলনের পথ বন্ধ হয়ে আছে। মানুষে-মানুষে মহামিলনের পথে বাধা সেই ফেরেশতার কূট-কৌশলে সৃষ্ট ধর্মতত্ত্বগুলো তাই মানুষের বর্জন করা উচিত। মানুষে-মানুষে মহামিলন ঘটাবে যেই তত্ত্ব, তা-ইতো যথার্থ ধর্মীয় তত্ত্ব। অন্য তত্ত্বগুলো তো মানুষে-মানুষে বিভাজনের তত্ত্ব, যে বিষয়ে স্রষ্টা মানুষকে সতর্ক করেছিলেন। মানুষ স্রষ্টার সতর্কবাণী ভুলে বিভাজনের তত্ত্ব কেন আঁকড়ে থাকবে? তা হওয়া উচিত নয়। ইবলিস তার ষড়যন্ত্রে সফল হয়ে মানুষের মাঝে বিভক্তির দেয়াল বাড়িয়ে রেখে মানুষের হাতেই মানুষের রক্ত ঝরাচ্ছে এবং মানুষের চোখের আড়ালে থেকে ডুগডুগি বাজাচ্ছে। মানুষের এ বিষয়ে সচেতন হয়ে ইবলিসের সৃষ্ট ফাঁদ থেকে বের হয়ে আসা দরকার।
২৯৯। যারা মুসলমানদেরকে ধর্মশিক্ষা দেয়Ñ তারা তাদের ওয়াজ-নসিহতে গুরুত্ব দেয় মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায়ের প্রতি এবং মসজিদের দান বাক্সে বেশি টাকা দানের প্রতিÑ যাতে তাদের জীবন-জীবিকা নির্বাহে কষ্ট না হয়। ওরস শরীফের বয়ানেও মহিষ কেনার জন্য চাঁদা প্রদানই অধিক গুরুত্ব পায়। তাহলে যারা ধর্মশিক্ষা দেবেনÑ তাদের মধ্যেই যদি স্বার্থবাদিতা কাজ করে এবং নিজেদের স্বার্থ হাসিলে তারা মুসলমানদেরকে মনুষ্যত্ববোধের শিক্ষা দেয়ার পরিবর্তে ধর্মীয় গোঁড়ামিতে অন্ধ করে দিতে চায়, তাদের কাছ থেকে ধর্মশিক্ষা নিয়ে মুসলমানেরা বর্বর ও স্বার্থবাদী না হয়ে কি হবে? ধর্মীয় মূল শিক্ষা তো মুসলমানেরা পাচ্ছে না। শুধু মুসলিমরা কেনÑ খ্রিস্টান, ইহুদি, বৌদ্ধ কারো মধ্যেই ধর্মীয় মূলশিক্ষা তেমন একটা দেখা যায় না। যেমনÑ ঈসা নবী খ্রিস্টানদের শিখিয়ে গেছেন যে, ‘কেহ যদি তোমার একগালে চড় মারে, তাহলে অপর গালটিও তুমি পেতে দিও’। কিন্তু খ্রিস্টানদের মধ্যে এই সহিষ্ণুতার শিক্ষা কি আছে? আমেরিকার দুটো ভবনে ইসলামি জঙ্গিরা হামলা চালানোর অভিযোগে ইরাক ও আফগানিস্তানে হাজার হাজার ভবনে হামলা চালিয়েছে তারা। হাজার হাজার নিরীহ মানুষ হত্যা করেছে। তাহলে মনুষ্যত্বের শিক্ষা খ্রিস্টানদের মধ্যেও কোথায়? মুসা নবী (আ.) সংগ্রাম করেছিলেন ফেরাউনের অত্যাচারের বিরুদ্ধে। কিন্তু বর্তমানে মুসা নবী (আ.)-এর অনুসারী ইহুদিরা সেই ফেরাউনি চরিত্র অনুসরণ করে অত্যাচারীর ভূমিকায়। তাহলে মনুষ্যত্বের শিক্ষা ইহুদিদের মধ্যেও কোথায়? আবার গৌতম বুদ্ধ তথা রাজা সিদ্ধার্থ সিংহাসন ত্যাগ করে জঙ্গলে গিয়েছিলেনÑ মানুষের জন্য শান্তির পথ কি, তা খুঁজতে আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য। আর সা¤প্রতিক অতীতেই আমরা দেখেছি যে, সিংহাসনের লোভে অনেক বৌদ্ধ শ্রীলঙ্কায় ও বাংলাদেশের পার্বত্যাঞ্চলে নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরিয়েছে। তাহলে মনুষ্যত্বের শিক্ষা বৌদ্ধদের মধ্যেও যে খুব একটা আছে, তা-ওতো বলা যাবে না। কিন্তু মনুষ্যত্বের শিক্ষাটাই মানুষের জন্য আসল শিক্ষা। এই শিক্ষাটা যার মধ্যে নাই, সে কোনো বিবেচনাতেই মানুষ বলে বিবেচিত হতে পারে না।
৩০০। নিজেকে দেখো। তোমাতে কি স্রষ্টার অস্তিত্ব নেই? তাহলে অন্যত্র খোঁজ কেন?
৩০১। ক্ষমতা লাভের জন্য বাঙালির রক্ত ঝরাতে শেখ মুজিবুর রহমান যে মোটেই দ্বিধান্বিত থাকতেন না, তার প্রমাণ স্বাধীনতাপরবর্তীকালেও তিনি পরিষ্কার করেছেন সিরাজ সিকদারসহ তার বিরোধী প্রায় ৩০ হাজার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে হত্যা করে; যাকে অমানুষের কর্মকাণ্ড বলেই অভিহিত করা যায়। কোনো মানুষ কখনোই মানুষ হত্যায় নেতৃত্ব দিতে পারে না। ক্ষমতার লোভে মানুষ হত্যা করা অমানুষেরই কাজ। বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতারাও ক্ষমতার লোভে বিভিন্ন সময়ে প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক কর্মীর রক্তে হাত রাঙিয়েছেন। আর শেখ মুজিবুর রহমানকে মহান চরিত্রের অধিকারী বলে প্রচার করে ‘রাজনীতি বাণিজ্য’ চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু সত্য কি, তা দেশবাসীর জানা ও বোঝা উচিত।
৩০২। ভালবাসাকে উপজীব্য করা ছাড়া নাটক বা চলচ্চিত্রের কাহিনি নির্মাণ করা সম্ভব নয়Ñ একথা যেমন অনেকটাই সত্য, তেমনি একথাও সত্য যে ভালবাসাকে শিল্পিত রূপ দিয়ে উপস্থাপনেও আজকাল নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার বা ঔপন্যাসিকদের ব্যর্থতা আছে। পুরনো আমলের বাংলা চলচ্চিত্রÑ দর্পচূর্ণ, চকোরি, স্বরলিপি, অবুঝ মন ইত্যাদি সিনেমায় ভালবাসা বিষয়টি এমন গভীরভাবে উপস্থাপিত হয়েছেÑ তা যে কারুরই হৃদয় স্পর্শ করেছে। কিন্তু এসব সিনেমা দেখে কারো চরিত্রে বখাটেপনা ঢোকার কোনো সুযোগ ছিল না। বরং এসব সিনেমা একজন মানুষকে সৃষ্টিশীল কবি, লেখক বা শিল্পী হতে উৎসাহিত করেছে এবং সর্বদাই করবে। কিন্তু বর্তমানকালে তৈরি সিনেমাতে ভালবাসা বিষয়টিকে এমনভাবে উপস্থাপিত করা হয় যেন গুন্ডামি করতে পারার যোগ্যতাই ভালবাসা অর্জনের সবচেয়ে বড় মাপকাঠি। এমনকি আমাদের দেশের একজন জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকও এমন একটি টিভি নাটক দর্শকদের উপহার দিয়েছিলেন ‘বাকের ভাই’ চরিত্র সৃষ্টি করেÑ যাতে মাস্তানি করাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। সেই পথ ধরে আধুনিক অনেক নাট্যকার ও চলচ্চিত্রকার নাটক-সিনেমায় মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। তাহলে পাড়ায়-মহল¬ায় ইভটিজার জন্মাবে না কেন? আর পাড়ার-মহল¬ার এতো ইভটিজার এবং নারীকে দেখে বিভিন্ন মন্তব্যকারীর অত্যাচার থেকে নারী-কিশোরী-তরুণীদের রক্ষা করার মতো প্রশাসনযন্ত্র কি আমাদের আছে? তাহলে এমন অত্যাচার থেকে নারীদের মুক্তির পথ কোথায়? সুশিক্ষাই কেবল কুশিক্ষাকে পরাজিত করতে পারে। তাই ভালবাসার বাণিজ্যের নামে কুশিক্ষা প্রদানের প্রবণতা নাট্যকার-চলচ্চিত্রকার-ঔপন্যাসিকদের যেমন বন্ধ করতে হবে, তেমনি প্রশাসনযন্ত্রকে এমন অপরাধীদের বেলায় আরো কঠোর ভূমিকা রাখতে হবে। যাদের কারণে মেয়েদের প্রাণ দিতে হচ্ছে, তাদের আত্মা ও দেহকেও পৃথিবী থেকে বিতাড়িত করার ব্যবস্থা করতে পারাই উপযুক্ত শাস্তি হওয়া উচিত।
৩০৩। রাষ্ট্রে যদি সংজ্ঞা দিয়ে ‘বিরোধী দল’ থাকে, তবে বিরোধী দল সবসময়ই সরকারি দলকে পেরেশানি করতেই থাকবেÑ যেমনটি বর্তমান সরকারি দলও বিরোধী দলে থাকতে করেছিল। একটি রাষ্ট্রে কখনোই সরকারের বিরোধিতা করার মতো রাজনৈতিক দল থাকা উচিত নয়, যদি সেই রাষ্ট্রের লোকেরা স্থিতিশীলতা ও শান্তি চান। ১৯৭১ সালে আমরা একটি বিদেশি শক্তিশালী বাহিনীকে পরাজিত করতে পেরেছিলামÑ বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ ছিলাম বলেই। আজ দেশ গঠন বা দেশে স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে আমাদেরকে ১৯৭১ সালের মতোই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এজন্য আজ বড় প্রয়োজন সকল রাজনৈতিক দলকে বিলুপ্ত করে দিয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠন করা এবং সকলপ্রকার অতীত চর্চা বন্ধ করা।
৩০৪। দেশ স্বাধীন হয়েছে প্রায় ৪০ বছর হয়ে গেল। এই ৪০ বছরে আমাদের যে অবস্থানে যাওয়ার কথা ছিল, সেই অবস্থানে আমরা যেতে পারিনি কেবল অতীতচর্চা এবং নিজেদের মধ্যে বিভাজন রেখে চলেছি বলে। এই বিভাজন, অতীত চর্চা এবং ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি ও মারামারির দিন শেষ করা দরকার। কী পদ্ধতিতে বা কী আলাপে গিয়ে সকল রাজনৈতিক দল একতাবদ্ধ হয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে সম্মত হবেনÑ তা নিয়ে তারা নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতা শুরু করুক। আর বিদেশি শক্তির পরামর্শ ও সহযোগিতা এড়িয়ে সত্যিকার দেশপ্রেম নিয়ে দেশের কল্যাণে কাজ করতে থাকুকÑ নাহলে ভবিষ্যত প্রজš§ বর্তমান রাজনীতিবিদদের ক্ষমা করবে না।
৩০৫। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ কম হয়নি। ক্ষমতার লড়াইয়ে নেমে হরতাল ডেকে নিরীহ জনগণ কিংবা পেশাজীবীদের পুড়িয়ে মারা কিংবা বোমার আঘাতে হত্যা করাÑ এ সবই মানবতাবিরোধী কাজ; যুদ্ধাপরাধের চেয়ে এসব অপরাধ কোনোভাবেই খাটো নয়। এসব অপরাধের সুষ্ঠু বিচার করতে গেলে রাজনীতি করেনÑ এমন লোক খুব কমই নিরপরাধ বলে বিবেচিত হবেন। তাদের বিচার করার জন্য দেশের মানুষ কার কাছে যাবে? বরং বিবেক খাটালে স্বাধীনতাপরবর্তীতে যারা মানুষ হত্যা করেছে ক্ষমতার লোভে এবং এখনো করে চলেছে হরতাল-ধর্মঘটের নামে, এদের অপরাধ ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের চেয়ে বেশি। কেননা, যুদ্ধকালে একপক্ষ আরেকপক্ষকে হত্যা করবে, আরেকপক্ষের ওপর জুলুম-নির্যাতন করবেÑ এটাই যুদ্ধের ধর্ম। পৃথিবীর সব যুদ্ধেই এমনটি ঘটে থাকে। বাংলাদেশেও তেমনটি ঘটেছিল। আবার দেশ স্বাধীনের পরবর্তীতে যাদের হাতে অস্ত্র থাকে, সেই যোদ্ধারা প্রতিপক্ষ যাদের দ্বারা যুদ্ধকালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলÑ তাদেরকে হত্যা করে বা ভিন্নভাবে শাস্তি দিতে তৎপর থাকে। বাংলাদেশেও যুদ্ধপরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধারা দেশের প্রতিপক্ষ যাকে হাতের কাছে পেয়েছে, তাদেরকে অস্ত্রের ভাষাতেই শাস্তি দিয়েছেÑ যতটা যার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের পরও প্রায় ৫/৬ মাস মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে অস্ত্র ছিল। আর গোলাম আযমসহ যারা তখন পলাতক ছিল, তাদের বিচার মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সরকার সেই সময়ই করে রাখলে তারা আর কখনো বাংলাদেশে ঢোকার সাহস ও সুযোগ পেত নাÑ যেমনটি পাচ্ছে না শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরা এখন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সরকার সেই কাজটি করতে ব্যর্থ ছিল বলেই ’৭৬ পরবর্তীতে সকল রাজনৈতিক দলের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে বিলুপ্ত আওয়ামী লীগ যেমন রাজনীতি করার অধিকার লাভ করে, তেমনি করে ’৭১-এর যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীকে সাহায্য করার অপরাধীরাও। এজন্য প্রকৃতপক্ষে দায় কার? মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সরকারের ওপরই এর দায়টা বেশি পড়ে না কি? তারা এখন যদি তাদের অতীতের ব্যর্থতা স্বীকার না করে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে করেন এবং এ প্রেক্ষিতে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, তা জাতির জন্যÑ তথা দেশের সাধারণ মানুষের জন্য সত্যিই দুঃখজনক।
৩০৬। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান। এই জেনারেল ইয়াহিয়া খান মৃত্যুর ২ বছর আগে লাহোর হাইকোর্টে ১৯৭১ সালের ঘটনা নিয়ে গোপন এফিডেভিট করে যান। লাহোর হাইকোর্টে অ্যাডভোকেট মনজুর আহমাদ রানার মাধ্যমে ইয়াহিয়া খান তার এ এফিডেভিট করে যান। এতে রয়েছে ৫৭টি টাইপ করা পাতা। কোর্টে এফিডেভিটটি নথিভুক্ত করার আগে ২৯ মে ’৭৮ তারিখে রাওয়ালপিন্ডির বাড়িতে বসে ইয়াহিয়া প্রতিটি টাইপ করা পাতা পড়ে দেখেন এবং বেশ কিছু জায়গায় নিজ হাতে কিছু সংশোধন করে সবকিছু সত্য বলে স্বাক্ষর দেন। এফিডেভিটের প্রতিটি পাতাতেই তার অনুস্বাক্ষর রয়েছে। লাহোর কোর্টে এফিডেভিটের ক্রমিক নম্বর দেয়া হয় ২৪৪/১৯৭৮। তার মৃত্যুর ২৫ বছর পর ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তান সরকার এ গোপন এফিডেভিটটি প্রকাশ করে। (ইয়াহিয়া খানের এ এফিডেভিটটি বাংলাদেশি পাঠকদের উদ্দেশে প্রকাশ করে ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক প্রতিচিত্র, ২৫ ফেব্র“য়ারি ২০১১ ইং সংখ্যায়)। প্রকাশিত এফিডেভিটে দেখা যায়Ñ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিলেন পাকিস্তানি জান্তা ইয়াহিয়া খান। কয়েকবার তিনি সে সময় শেখ মুজিবুর রহমানকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। আর যিনি কাউকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেন, তার চেয়ে ভালো বন্ধু অন্যরা হতে পারে না। আবার পাকিস্তানের ভাঙনের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের চেয়ে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোকেই দায়ী করেছেন ইয়াহিয়া খান। তার মতে, ভুট্টোর চেয়ে বড় দেশপ্রেমিক (পাকিস্তানপ্রেমিক) ছিলেন শেখ মুজিব। বঙ্গশক্রু ইয়াহিয়ার দৃষ্টিতে যিনি ভুট্টোর চেয়ে বড় পাকিস্তানপ্রেমিক ছিলেন, তিনি কি করে ‘বঙ্গবন্ধু’ হন, তা নিয়ে ভাবার যথেষ্ট অবকাশ আছে বৈকী। ভুট্টোর চেয়ে বড় পাকিস্তানপ্রেমিককে ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে গ্রহণ করা বাঙালিদের বুদ্ধির দীনতাকেই প্রকট করে তোলে। আর ‘বুদ্ধি প্রতিবন্ধী’ জাতির উন্নতি করা সম্ভব নয়।
এফিডেভিটে বলা হয়, শেখ মুজিবকে জীবিত বা মৃত ধরে নিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছিলেন টিক্কা খান। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল টিক্কা খান নির্দেশ দিয়েছিলেনÑ ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুরু হলে শেখ মুজিবুর রহমানকে জীবিত অথবা মৃত, যেভাবেই হোক ধরে নিয়ে আসতে হবে। টিক্কা এই আদেশ দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের অজান্তে। যখন ইয়াহিয়া এ সম্পর্কে জানতে পারেন, তখনি তিনি মুজিবকে হত্যার যেকোন প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন ও তাকে জীবিত ধরে নিয়ে আসার জন্য নতুন আদেশ জারি করেন। এফিডেভিটে তিনি আরো বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দি থাকাবস্থায় বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলেও তিনি শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন এই শর্তে যেÑ তিনি (মুজিব) ক্ষমাপ্রার্থী হবেন ও পাকিস্তানের প্রতি তার আনুগত্য প্রকাশ করবেন। এক্ষেত্রে কোন লিখিত হলফনামা ছাড়াই মুজিবকে মুক্তি দেয়ার ইচ্ছা ছিল ইয়াহিয়ার। অন্যদিকে ভুট্টো চেয়েছিলেন সামরিক আদালতে দোষী সাব্যস্ত করে শেখ মুজিবকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলাতে। ইরানের পাহলভী রাজবংশের ২৫০০তম জয়ন্তীতে যোগ দিতে ইয়াহিয়ার ইরান যাত্রার প্রাক্কালে ভুট্টো মুজিবকে শেষ করে দেয়ার পরামর্শ দেন। তার (ভুট্টো) যুক্তি ছিলÑ ইরানসহ অন্যান্য দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানরা মুজিবকে মুক্তি দেয়ার জন্য ইয়াহিয়ার উপর চাপ প্রয়োগ করতে পারেন। তাই সেখানে যাওয়ার আগেই মুজিবকে ফাঁসিতে ঝোলানো উচিত। এ ব্যাপারে এফিডেভিটে ইয়াহিয়া বলেন যে, ভুট্টোর প্ররোচনায় তিনি রাজি হননি। কারণ তিনি আইন নিজের হাতে তুলে নিতে চাননি, চেয়েছেন বিচারকার্য স্বচ্ছ হোক। অবশ্য শুধু সেবারই নয় আরো বেশ ক’বার ভুট্টো সামরিক আদালতের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত করে মুজিবকে হত্যার জন্য ইয়াহিয়াকে উপদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু জান্তা প্রধান পিপিপি চেয়ারম্যানের কথায় কর্ণপাত করেননি বলে দাবি করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে কিংবা শক্রুতামূলক আচরণে প্রধান শক্রকে কখনো ছাড় দেয় না কেউই। কিন্তু ইয়াহিয়া খান বাঙালিদের নির্বিচারে হত্যা করার নির্দেশ দিলেও শেখ মুজিবুর রহমানকে রক্ষা করেছিলেন ভুট্টোর সকল প্রকার ষড়যন্ত্র থেকে। শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিদের প্রতি নয়Ñ বরং এক পাকিস্তানের অস্তিত্বের প্রতিই অধিক বিশ্বাসী, একথা বাঙালিরা অতি আবেগের কারণে না বুঝলেও ইয়াহিয়া খান ঠিকই বুঝে নিয়েছিলেন। তাই পাকিস্তানকে এক রাখার স্বার্থে তিনি মুজিবের মৃত্যু কামনা করেননি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ মুজিবের এই উচ্চারণ যে বাঙালিদের বোকা বানিয়ে পাকিস্তানকে অটুট রাখার এক কৌশল, তাও ইয়াহিয়া ভালো করেই বুঝেছিলেন। কারণ, সেদিন মুজিব ইচ্ছা করলেই পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করার ঘোষণা দিতে পারতেন। ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমাদের যার যা কিছু আছে, তা নিয়ে শক্রুর মোকাবেলা করবে’ মুজিবের এসব ঘোষণা যে স্রেফ রাজনৈতিক ভাওতাবাজির মাধ্যমে বাঙালিদের বোকা বানানোর চেষ্টা, তা বুঝতেও ইয়াহিয়া ভুল করেননি। কারণ, বাঙালির যার যা কিছু আছে, তা নিয়েই সেদিন বাঙালিরা রেসকোর্স ময়দানে হাজির হয়েছিল এবং মুজিবের হুকুম দেবার পথে কোন বাধা ছিল না। মুজিব সেদিন চাইলেই লাখো জনতাকে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করার হুকুম দিতে পারতেন এবং পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য সরাসরি অ্যাকশনে যেতে পারতেন। কিন্তু এক পাকিস্তানের প্রতি বিশ্বস্ত বলেই মুজিব তেমন পদক্ষেপ নেননি, একথা বুঝতে কোন অসুবিধা হয়নি ইয়াহিয়ার। কেননা, ইয়াহিয়া খানকে বাঙালিদের হত্যায় সৈন্য মজুতের সুযোগও দিয়েছিলেন মুজিব আলাপ-আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করার মাধ্যমে। এতে করে প্রায় ৬৫ হাজার অতিরিক্ত সৈন্য মজুতের সুযোগ পেয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান। পাকিস্তানকে এক রাখার জন্য সকল আর্মি অপারেশনের ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য মুজিব ইয়াহিয়া খানের বন্ধু না হয়ে শক্রু হবেন কোন বিবেচনায়? তাইতো বন্ধুর প্রাণ রক্ষায় ইয়াহিয়া খানের চেষ্টার কোন ত্র“টি ছিল না। স্বদেশী জুলফিকার আলী ভুট্টোর সকল ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিয়ে মুজিবকে বারবার রক্ষা করেছিলেন ইয়াহিয়া খান। পক্ষান্তরে নিরীহ বাঙালিদের হত্যার জন্য তিনি অপারেশন সার্চলাইটের নির্দেশ দিয়ে হাজার হাজার নিরীহ বাঙালি হত্যা করেছিলেন। অতএব, একথা স্পষ্ট যে, বাঙালির মহাশক্রু ইয়াহিয়া খানের দৃষ্টিতে যিনি পাকিস্তানের বন্ধু, সেই শেখ মুজিবুর রহমান প্রকৃতপক্ষে বাঙালিদের বন্ধু ছিলেন না। তাই মুজিবকে বাঙালিদের বন্ধু বা জাতির পিতা ভাবা বাঙালিদের বুদ্ধির দীনতা ছাড়া কিছু নয়। বাঙালিদের প্রকৃত বন্ধু আসলে ইয়াহিয়ার শত্র“ সেই সময়ের ছাত্র-জনতা এবং এ জাতির পিতাও সেই সময়ের দেশের আম-জনতা। ছাত্র-জনতা চেয়েছিল বলেই বাঙালিরা পাকিস্তানিদের যুদ্ধে পরাজিত করে দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে পেরেছিল।
৩০৭। জনগণই আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির স্রষ্টাÑ অর্থাৎ জনগণ চেয়েছে বলেই আমাদের রাষ্ট্রটি সৃষ্টি হওয়া সম্ভব হয়েছেÑ এটাই মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস। এইমর্মে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হলে তা সম্ভব হতে পারে। কেননা, ৭ মার্চে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের আগেই জনতা স্বাধীনতার জন্য ¯ে¬াগান দিয়ে বর্শা, বল¬ম যার যা আছে তা নিয়ে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়েছিল। অর্থাৎ, জনতা রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর ছিল। রাজনৈতিক নেতারা বরং স্বাধীনতার চেতনাকে কৌশলে দাবিয়ে দিতে চেয়েছিল ক্ষমতার লোভে ভিলেনের ভূমিকা নিয়ে। অথচ এখন জনতার কৃতিত্ব হরণ করে রাজনৈতিক নেতাকে কৃতিত্ব দেয়ার প্রতিযোগিতা চলছে। এক্ষেত্রে সত্য ইতিহাস প্রতিষ্ঠারÑ অর্থাৎ জনতাকেই স্বাধীনতার জন্য কৃতিত্ব দিয়ে ইতিহাস রচনা করলে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় কোনো বিতর্কের অবকাশ থাকবে না। অন্তত জনতার উচিত তাদের কৃতিত্ব প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হওয়া। কেননা, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত নায়ক হচ্ছে জনতা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে নায়কের কৃতিত্ব মুছে দিয়ে ভিলেনের কৃতিত্ব প্রতিষ্ঠার যে চেষ্টা চলে এসেছে, তা থামাতে হবে জনতাকেই।
৩০৮। ১৯৭১-এর মানবতাবিরোধীদের বিচার করার দায়িত্ব মূলত ছিল স্বাধীনতাপরবর্তী সরকারের। সেই সরকার সাড়ে ৩ বছর ক্ষমতায় থেকেও কেন মানবতাবিরোধীদের বিচার করল না? সেই একই আদর্শের লোকেরা তখন এ কাজে তৎপর না হয়ে এখন কেন তৎপর হচ্ছেন? এসব প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এ দাবি রাখার যৌক্তিকতাও আছে যে, সরকার যদি বিচার বিভাগকে অপরাধী নির্মূলে যথেষ্ট মনে না করে ‘র্যাবের ক্রশফায়ার’ আর ‘পুলিশের বন্দুকযুদ্ধ’ নাটক মঞ্চস্থ করতে পারে, তবে জনগণকে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্তদের ‘গণধোলাই’ দেয়ার অধিকার কেন দেবে না?
৩০৯। যেহেতু দোষগুণের সমন্বয়েই একজন মানুষের চরিত্র গড়ে ওঠে, সেহেতু কাউকে নিয়ে অতি বাড়াবাড়ি করা বা কাউকে অতি উচ্চমাপের মানুষ বানানোর প্রচেষ্টা ঠিক নয়। আবার অতীতচর্চা করে রাষ্ট্রে বিভেদ ও বিভক্তি বাড়িয়ে যাওয়াও সমীচীন নয়। রাষ্ট্রের মানুষকে একত্রিত করে রাষ্ট্রের কল্যাণ কীভাবে করা যায়, সেই প্রচেষ্টাই সবসময় করা দরকার সমসাময়িক রাজনীতিবিদদের। গণতন্ত্রের নামে বিভেদ বাড়ানো কখনো একজন আদর্শ রাজনীতিবিদের কাজ হতে পারে না। সমসাময়িক রাজনীতিবিদকে তার আদর্শ দিয়েই নিজেকে ও নিজ দলকে প্রতিষ্ঠা করার ব্রত নিয়ে কাজ করতে হয়। তবেই তার দ্বারা রাষ্ট্রের মানুষের কল্যাণ হওয়া সম্ভব। নিজের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা না করে অতীত ব্যক্তিত্বদের বেচে খাওয়ার যে অপরাজনীতি বর্তমান রাজনীতিবিদেরা করে চলেছেন, তাতে এ দেশের অধঃপতন ছাড়া উন্নতি হবে না কখনো।
৩১০। যুগের প্রয়োজন যুগনেতা। যুগনেতাকে বেছে নিতে না পারলে জনগণের মুক্তি আসে না। বাংলাদেশে যুগনেতা হওয়ার যোগ্যতা আছে, এমন ব্যক্তিত্বও সমসাময়িক রাজনীতিবিদদের মধ্যে চোখে পড়ছে না। তবে এমন নেতা বাংলাদেশিদের দরকার যিনি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হবেন পরগাছাটাইপ রাজনীতির বৃত্ত থেকে বের হয়ে।
৩১১। রাজতন্ত্রের ট্র্যাজেডি ছিল এই যে, রাজা বদলাতে রাজাকে এবং ক্ষেত্রবিশেষে তার পরিবারের সদস্যদেরকেও রক্ত দিতে হতো। আর গণতন্ত্রের ট্র্যাজেডি যা আমরা দেখছি বাংলাদেশেÑ তা হচ্ছে, ‘রাজা’ বদলানোর সংগ্রামে জনগণকেই বরাবর রক্ত বা জীবন দিতে হয়। কেন জনগণ ‘রাজা’ বদলানোর খেলায় নেমে জনগণেরই প্রাণ কেড়ে নেবে? কিংবা ‘রাজা’দের জন্য কেন জীবন দেবে? ‘রাজা’রা কী জনগণের স্বার্থ দেখা লোক? তারা তো কিছু ব্যবসায়ী ও সরকারী চাকরিজীবীদের স্বার্থ দেখা লোক। তাহলে কেন জনগণ ‘রাজা’ বদলানোর সংগ্রামে একে অন্যের প্রাণ কেড়ে নেবে? জনগণ তো নীরব ভোট বিপ¬ব ঘটাবার সামর্থ্য রাখে। আর সেজন্য ৫ বছর অপেক্ষা করতেই অভ্যস্ত হোক জনতা। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যেও সে চর্চা গড়ে তুলতে বাধ্য করুক।
৩১২। আমাদের দেশের প্রতিহিংসার রাজনীতির কুফল বরাবরই জনগণকে ভোগ করতে হয়। আর এর সুফল ভোগ করেন শেখ হাসিনা বা বেগম খালেদা জিয়া এবং আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কিছু নেতা-কর্মী। হরতালের নামে জ্বালাও-পোড়াও নীতি গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা-কর্মীরা এ যাবৎ অনেক মায়ের কোল খালি করেছে এবং অনেককে পঙ্গু বানিয়েছে। আমরা সাধারণ জনগণ বিগত দিনগুলোতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছি বলেই তারা তাদের প্রতিহিংসার রাজনীতি আমাদের বুকে জগদ্দল পাথরের মতোই চাপিয়ে দিয়েছে।
৩১৩। মানুষকে শান্তিপূর্ণ রাখার ৪টি উপায় আছেÑ এর একটা হচ্ছে লোভ দেখানো, আরেকটা ভয় দেখানো, তৃতীয় পথ হচ্ছে রূপকথাজাতীয় কাহিনি শুনিয়ে ভুলিয়ে রাখা এবং সবচেয়ে কঠিন পথটি হচ্ছে সত্য জানিয়ে সঠিক জ্ঞান দেয়া। ধর্মপ্রচারকেরা ৪টি পদ্ধতির মধ্যে সহজ তিনটি পদ্ধতিকেই প্রয়োগ করেছে, সত্য জানিয়ে জ্ঞান দিয়ে মানুষকে শান্তিপূর্ণ করার পথটিই বর্জন করেছে। যে কারণে মানুষ সত্য সম্বন্ধে অবগত হতে পারেনি।
৩১৪। ‘দুধ সাদা’ একথা সত্য বলেই কাউকে এটা বলার দরকার নেই যে, ‘দুধ সাদা’ একথা বিশ্বাস করো। কিন্তু যা সত্য বলে প্রমাণিত নয়, তা-ই বিশ্বাস করতে শিক্ষা দিয়েছেন ধর্মপ্রচারকরা। একেকটা ধর্ম একেকটা রূপকথাজাতীয় কাহিনির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এবং মানুষকে প্রকৃত সত্য না জানিয়ে মিথ্যে কথা বিশ্বাস করার নামই ধর্ম, এমনটাই শিখিয়েছেন ধর্মপ্রচারকরা। আর মানুষের পরবর্তী জীবনের সুখ-শান্তি পাওয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে ধর্মপ্রচারকরা পৃথিবীতে ধর্ম প্রচার করেন নাই। মানুষের ইহলৌকিক জীবনের সুখ-শান্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই ধর্মপ্রচার করে গেছেন তারা, যাতে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়। বোমা মেরে মানুষ হত্যার জন্য ধর্মপ্রচারকরা ধর্ম প্রচার করেননি।
৩১৫। এমন একটা চিন্তা আমার মাথায় উঁকিঝুঁকি দেয় যেÑ ঊর্ধ্বলোকে স্বর্গ-নরক বলে কিছু নেই। পৃথিবীতেই মানুষ যখন সুখে থাকে, তখন সে স্বর্গে থাকে; আর যখন দুখে থাকে, তখন নরকযাতনা ভোগ করে। মানুষ মৃত্যুর মাধ্যমে এক শরীরের বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়ে আরো উন্নত ও শান্তিময় জীবনের আশায় আরেক শরীরে প্রবেশ করে। হয়তো কোনো নবজাতকের শরীরে কিংবা তার পরিচিত কোনো প্রিয় মানুষের শরীরে, কিংবা আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ায় যেখানে সুখ-শান্তি আছে বলে বিশ্বাস করে সেখানে কারো শরীরে প্রবেশ করতে চায়, কিন্তু অতীতের শরীরটাতে মানুষ কিছুতেই ফিরে যেতে চায় না। পার্থিব মৃত্যুর পরে আরো উন্নত জীবন লাভের যে সুযোগ, তা কেউ হাতছাড়া করতে চায় না। কিন্তু যারা পৃথিবীতে মানুষের জন্য দুঃখ উৎপাদন করেÑ মানুষকে নানাভাবে কষ্ট দেয়, নতুন শরীর নির্বাচন করতে গিয়ে দেখা যায় তারা এমন শরীরে প্রবেশ করেছে, যে শরীরে তাদেরকে আগের জীবনে অন্যদের ভোগানোর প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় নিজে ভুগে। সেই শরীরের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ওই শরীরে থেকেই তাকে কষ্ট-যাতনা ভোগ করতে হয়। অতএব পরবর্তী জীবনে অন্য শরীরে গিয়ে যারা সুখ-শান্তি পেতে চায়, তাদের উচিত পৃথিবীটাকেই স্বর্গে পরিণত করার চেষ্টা করা। পৃথিবী স্বর্গে পরিণত হলে বর্তমান দেহ থেকে মুক্তি পেয়ে আÍা পরবর্তীতে যে দেহেই আশ্রয় নেবে, সেখানে স্বর্গসুখ খুঁজে পাবে। আর পৃথিবীকে যারা নরকে পরিণত করে, তারা বর্তমান দেহ থেকে মুক্তি পেয়ে এমন দেহ বেছে নেবে, যেখানে তাকে নরকযাতনাই ভোগ করতে হবে। স্বর্গ ও নরকের বিষয়ে এটাই অনেক সময় আমার কাছে সত্য বলে মনে হয়।
৩১৬। পৃথিবীতে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে যে কথাটা সত্য তা হচ্ছে এই যে, মানুষের শরীরে বিষ ধরানো পিঁপড়া থেকে শুরু করে যত হিংস্র প্রাণী দেখা যায়Ñ তার যত বিনাশ করতে পারবে মানুষেরা, ততই তারা নিরুদ্বিগ্ন থাকবে ও শান্তি খুঁজে পাবে। বর্তমানে মানুষেরা নিরীহ মুরগি, ছাগল, গরু হত্যা করছে, আর হিংস্র বাঘ-সিংহকে রক্ষা করছে বন্য প্রাণী সংরক্ষণের নামে। এতে করে ‘নিরীহের গলা কর্তন আর হিংস্রের স্বার্থ সংরক্ষণ’ এমন একটা রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে পৃথিবীতে। আর এ রীতিটাই বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। মানুষের শরীরের প্রয়োজনীয় আমিষের চাহিদা মেটাতে মুরগির ডিম, আর গরু-ছাগলের দুগ্ধ শরীরে গ্রহণ করা ভালো। মাংস খেতে চাইলে হিংস্র প্রাণীদের বিনাশ করেই খাওয়া দরকার। তবেই ‘হিংস্রদের বিনাশ, আর নিরীহের স্বার্থ সংরক্ষণ’ এমন রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিশ্বে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। নিরীহ প্রাণীদের স্বার্থ সংরক্ষণের শিক্ষা যতদিন না পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হবে, ততদিন পর্যন্ত মানুষের মধ্যে যারা নিরীহÑ তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়টিও নিশ্চিত হবে না। মানুষের মানসিকতা পরিবর্তনটাই সবচেয়ে আগে দরকার। নাহলে নিরীহদের ওপর হিংস্রদের জুলুম চলতেই থাকবে।
৩১৭। মশা-পিঁপড়াসহ হিংস্র প্রাণীদের বংশ বিনাশেই মানুষের জন্য শান্তি ও স্বস্তি নিশ্চিত হবে। তবে এ বিষয়টিকে মানুষের মধ্যে অনেকে বাণিজ্যিক বিষয়ে পরিণত করে রাখতে চায় বলেই হিংস্র প্রাণীদের যেমন বিনাশ করা যাচ্ছে না, তেমনি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনযাপন অশান্তি ও অস্বস্বিতে ভরে আছে।
৩১৮। অন্ধবিশ্বাসের কারণে বর্তমান পৃথিবীর মানুষেরা যাকে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, কিংবা সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বলে জানে, বিবেক জাগ্রত হলে তারা বুঝতে পারবেÑ পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুুষ, কিংবা সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি আসলে অন্য কেহ।
৩১৯। কোনো কোনো ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছেÑ আদিকালে স্রষ্টার আরশ ছিল পানিতে। তারপর যখন তিনি তাঁর সৃষ্টিগুণের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে চাইলেন, তখন ছয়দিনে পানি থেকে আলো, বায়ু ও ভূমি পৃথক করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বাসের জন্য সকল প্রাণীর এক জোড়া করে সৃষ্টি করলেন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির এ ইতিহাসের মধ্যে রূপকথার গন্ধ পাওয়া যায় এবং একে বিজ্ঞানসম্মত বলা যায় না মোটেই। কারণ, আমরা দেখছি যে, কার্যকারণ নিয়মের বাইরে পৃথিবীতে কিছুই ঘটছে না। বাস্তবতার আলোকে তথা বিজ্ঞানসম্মতভাবে সাগর থেকে একটা দ্বীপ জাগতেও বহু বছর সময় লাগে। সেই নিয়মে চারভাগ পানির পৃথিবী থেকে একভাগ ভূমি জাগতে বহু বহু বছর সময় লাগার কথা। ছয়দিনেই পৃথিবীর চারভাগ পানি থেকে একভাগ ভূমি জেগেছেÑ এমন কথাও বাস্তবতার আলোকে গ্রহণযোগ্য নয়। অতএব, এসব ধর্মগ্রন্থকে যেমন বিজ্ঞানসম্মত গ্রন্থ বলা যাবে না, তেমনি রূপকথাজাতীয় এসব গ্রন্থের অন্যান্য কথাও বর্জন করে চলা উচিত প্রজ্ঞাবানদের। নাহলে একবিংশ শতাব্দীর এসব মানুষকে প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞানমনস্ক বলা যাবে না।
৩২০। আমি স্রষ্টার প্রতিপক্ষÑ কিংবা স্রষ্টা আমার প্রতিপক্ষ, এমন কথা আমি কোনোভাবেই মানতে নারাজ। স্রষ্টার চেয়ে আমার ভালো কোনো বন্ধু নাই। কিন্তু যাদের স্রষ্টা সম্বন্ধে ন্যূনতম জ্ঞানও ছিল না, তারা স্রষ্টার বিভিন্ন নাম ও বিভিন্ন রূপ বর্ণনা করে একেকজন স্রষ্টা সম্বন্ধে একেক রকমের ধারণা দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে গেছেন এবং সেই বিভ্রান্তি নিয়েই মানুষেরা পৃথিবীতে জীবনযাপন করে যাচ্ছেন। তাই, যাদের ভ্রান্ত বিশ্বাসের বিপক্ষে আমার কথা যায়, তারা মনে করতে পারেন যে, আমি স্রষ্টার প্রতিপক্ষ। কিন্তু বিভিন্ন ভ্রান্ত বিশ্বাসের জন্ম দিয়ে যারা মানবজাতিকে নানা বিভাজনে বিভাজিত করে ফেলেছেন, প্রকৃত সত্য তাদের কাছে উপস্থাপন করে ভ্রান্ত বিশ্বাস থেকে মুক্তির মাধ্যমে মানবজাতিকে এক প¬াটফর্মে সমবেত করার উদ্দেশ্য নিয়েই আমি কাজ করছি, যা আর কেউ না বুঝলেও স্রষ্টা ঠিকই বোঝেন। তাই স্রষ্টা আমাকে কোনোভাবেই তার প্রতিপক্ষ বলে বিবেচিত করতে পারেন নাÑ এমনটাই বিশ্বাস করি আমি।
৩২১। পৃথিবীর অন্ততঃ ষাট শতাংশ মানুষ নিজেদেরকে সত্যের ধারক তথা সত্য পছন্দ করা লোক বলে ভাবে। কিন্তু যখন যুক্তিসহকারে প্রকৃত সত্য এদের কাছে উপস্থাপন করা হয়, তখন এদের সকলকেই মুখ ফিরিয়ে নিতে দেখা যায়। অন্ধবিশ্বাসে এরা যে সকল কথা সত্য বলে জানে, তা-ই তাদের কাছে সত্য বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু অন্ধবিশ্বাস ও প্রকৃত সত্য তো এক কথা নয়। এদের এটা বোঝার ক্ষমতাও নেই। অথচ, এরা নিজেদের সত্যের ধারক বলে ভাবে; যা রীতিমতো হাস্যকর।
৩২২। মানুষের মধ্যে যাদের আত্মা ও দেহ মৃত্যুর মাধ্যমে বাস্তব পৃথিবী থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়, তারা কিন্তু ঠিকই জগতে ঘুরে বেড়ায়। বাস্তব পৃথিবীর অনেকেই বিশেষ করে রাতের বেলায় এসব আত্মার উপস্থিতি টের পায় তার শোবার ঘরে, কিংবা অন্যত্র। যদিও মানুষের অনেকে এদেরকে ভূত-প্রেত কিংবা ফেরেস্তা বা জ্বীনÑ এসব নানা নাম দিয়ে থাকে। কিন্তু একথাও সত্য যে, পরমাত্মাও মাঝে মাঝে কারো পাশে এসে দাঁড়ায়। যারা বোঝার তারা ঠিকই বোঝেন। আবার মানুষ স্বপ্নেও পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়া এসব আত্মার কাউকে না কাউকে দেখতে পায় অনেক সময়।
৩২৩। স্রষ্টা মানুষের জীবন ও জীবিকার নিয়ামকÑ এমন কথা কেবল তাদের ক্ষেত্রেই সত্য হয়, যারা এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে।
৩২৪। ‘মানুষের যুক্তদেশ’ নামে পৃথিবীব্যাপী একটি রাষ্ট্র গড়ে তোলা গেলে পৃথিবীতে বর্তমানে মানুষের নাগরিক অধিকার যতটুকু নিশ্চিত করা যাচ্ছে, তার তুলনায় অনেক বেশি নিশ্চিত করা সম্ভব হতো। কেননা, তখন একই দৃষ্টিতে পৃথিবীর সকল মানুষকে দেখার এবং একই নিয়মে সকলের ভাগ্যোন্নতির চেষ্টা করার প্রবণতাটা প্রশাসন পরিচালনাকারীদের মধ্যে থাকতো।
৩২৫। ভাগ্য বলে একটা বিষয় অবশ্যই আছে। কোটিপতির ঘরে জন্ম নেয়া আর রিকশাচালকের বস্তিতে জন্ম নেয়া শিশুর মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। সুশিক্ষিত সমাজে বেড়ে ওঠা এবং অশিক্ষিতদের এলাকায় দিনাতিপাত করা দুই ব্যক্তির মধ্যেও অনেক পার্থক্য থাকে। সৌদি আরবের বাদশাহ আবদুল¬াহ বিন আবদুল আজিজের সন্তান হওয়াটা যেমন স্রষ্টার বিধান মোতাবেকই সম্ভব হয়, তেমনি মোস্তাফিজুর রহমান ও শাহানারা বেগমের সংসারে জন্ম নেয়াটাও স্রষ্টা কর্তৃকই নিয়ন্ত্রিত। কারো জন্ম পৃথিবীতে আরাম-আয়েশের সঙ্গে জীবনকে উপভোগ করা ও মর্যাদালাভের জন্য, আর কারো জন্ম অন্যের শান্তির তরে শ্রম দিতে দিতে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার জন্য। তবে সকল ক্ষেত্রেই স্রষ্টার প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানানোর নামই ধর্ম। কেননা, স্রষ্টার প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করলে পরকালের শান্তি হারানোর পাশাপাশি ইহজীবনেও আরো অশান্তিময় জীবনলাভের ঝুঁকি তো থাকেই। আর এটাও এক বাস্তবতা যে, পৃথিবীতে যেহেতু কার্যকারণ নিয়মের বাইরে কিছু ঘটে না, সেহেতু কাউকে মালিক এবং কাউকে শ্রমিক না বানিয়ে স্রষ্টারও উপায় নেই। যার যার নিয়তি তার তার। আপন নিয়তিতে তুষ্ট থাকাটাই পরবর্তীতে আরো অধিক অশান্তি ভোগ থেকে বাঁচার প্রধান উপায়।
৩২৬। অনেক ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী দুটি মতের ফলাফল কিন্তু একই হয়। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম টসে জিতলে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নেবেন বলে ঠিক করে রেখেছেন। পক্ষান্তরে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্ক টসে জিতলে বোলিং করবেন বলে সিদ্ধান্ত পাকা করে রেখেছেন। দুই অধিনায়কের মত পরস্পরবিরোধী। একজন প্রথমে দলকে ব্যাটিং করানোর পক্ষে, অন্যজন প্রথমে দলকে বোলিং করানোর পক্ষে। কিন্তু ফলাফলটা একইÑ প্রথমে ব্যাটিং করাটাই বাংলাদেশ দলের নিয়তি। আবার যদি এমন হয় যে, বাংলাদেশ দলের অধিনায়কের প্রচণ্ড ইচ্ছা ও চেষ্টা প্রথমে ব্যাটিং করার, কিন্তু বিপক্ষ দলের অধিনায়ক টসে জিতে বাংলাদেশকে বোলিং করতে নামাল, সেক্ষেত্রেও বুঝতে হবে যেÑ প্রথমে বোলিং করাটাই বাংলাদেশ দলের নিয়তি। নিয়তি ও আপন ইচ্ছার মধ্যে এভাবেই গড়মিল হয়। আগ্রহ ও চেষ্টায় সব সময় সবকিছু পাওয়া যায় না। কিন্তু তাই বলে নিয়তির ওপর নিজেকে ছেড়ে দিয়ে নির্বাক বা নিশ্চুপ হয়ে থাকাটাও প্রজ্ঞাসম্মত কাজ নয়। নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা সকল ক্ষেত্রেই মানুষের করা উচিত। সর্বোচ্চ চেষ্টার ফল আজ বা তাৎক্ষণিক পাওয়া না গেলেও সেটাই মানুষের ভবিষ্যত প্রাপ্তির সোপান হয়ে দাঁড়াতে পারে।
৩২৭। পৃথিবীতে যে যতটুকু বোধশক্তি বা মেধা বা প্রজ্ঞা নিয়ে আছে, ততটুকু থাকাটাই তার তার নিয়তি। তবে নিজের প্রজ্ঞা ও মেধার উন্নতির জন্য সর্বদাই চেষ্টা করে যাওয়া উচিত। ১০ হাজার বছর পরও পৃথিবীর মানুষ তোমাকে তোমার মেধা ও প্রজ্ঞার জন্য চিনবে, এই চেষ্টাটা না করলে নিজের মেধা বিকাশের পথ তৈরি হবে না।
৩২৮। নায়িকা বা মডেল হওয়ার লোভে অনেক মেয়েই পর-পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হয়Ñ এমন কথা বর্তমানে হর-হামেশাই শোনা যায়। আবার ‘যা রটে, তা কিছুটা হলেও ঘটে’Ñ এমন প্রবাদও রয়েছে। পার্থিব যশ, খ্যাতি, অর্থ, স্বাচ্ছ্বন্দ্যের জন্য ধার্মিকদের বর্ণনামতেÑ পরকালের কোটি কোটি বছরের জীবন যদি সত্য সত্যই যন্ত্রণাময় হয়ে যায়, তবে পর-পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হওয়া এসব নারী কতইনা দুর্ভাগা!
৩২৯। মানুষের প্রত্যেকের আত্মা যার যার শরীরের অন্তত ৪টি করে স্তরে ক্রিয়াশীল থাকে। কোন বিষয়ে আত্মার সকল স্তরের সিদ্ধান্ত একরূপ হলে সেই বিষয়ে তা-ই আত্মার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত। আর কোন বিষয়ে মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলে বুঝতে হবেÑ আত্মার সকল স্তর সেই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে একমত নয়। মানুষের আত্মার অন্ততঃ ৪টি স্তর আছে বলে মানুষ একই ঘুমের ভেতরে একেকবার একেক রকমের স্বপ্ন দেখে জেগে উঠে চতুর্থবারে বাস্তবের বিছানায় নিজেকে জাগ্রত দেখতে পায়। আত্মার এই ৪টি স্তরের সিদ্ধান্ত মোতাবেক যারা কাজ করে, তাদের কাজে ভুল হয় না। কিন্তু একটি স্তরেও লোভ বা অন্য কারণে ভিন্নমত থাকলে এবং সেই মোতাবেক মানুষেরা কাজ করলে তাতে ক্ষতির মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৩৩০। দার্শনিকেরা উত্তরাধিকার সূত্রেই সক্রেটিসের ন্যায় ঝগরাটে-টাইপ বউ পেয়ে থাকেন নিশ্চয়ই। দার্শনিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার চেষ্টার কারণেই নিত্যদিনের ঝগড়া-ঝাটি, এমনকি শীতের রাতে পৃথক ঘরে কেবল বিছানার চাদর গায়ে মুড়িয়ে কিছুটা ঘুম কিছুটা তন্দ্রায় শীতে কেঁপে রাত কাটানোর কষ্ট ভোগ করে অন্তত এ নিশ্চয়তাটা পেয়েছি যে, সক্রেটিসের যথার্থ উত্তরসূরি হতে পেরেছি। সত্য দেখা, সত্য বলা এবং সত্য লেখা দার্শনিকের ধর্ম। আর স্ত্রী জাতি জগৎ-সংসারের মিথ্যের প্রতিই অধিক আকৃষ্ট থাকে। তাই সত্য ও মিথ্যার মধ্যে যে দ্বন্দ্ব জগতে বিদ্যমান, দার্শনিকের সংসারেই তার প্রকাশটা বেশি। অন্য পুরুষেরা মিথ্যার সঙ্গে সমঝোতা বা আপস করে চলতে পারলেও দার্শনিক পুরুষেরা তা করতে অক্ষম। মিথ্যার সঙ্গে কোন আপস দার্শনিক করে না। করলে তার ‘দার্শনিক সত্তা’টার মৃত্যু ঘটে। এই বোধ দার্শনিক পুরুষ রাখে বলেই দার্শনিকের চেয়ে অধিক সত্যপ্রিয় লোক অন্য কোন সেক্টরে নেইÑ এমনটাই আমার বিশ্বাস।
৩৩১। অনেকেই সত্যবাদীকে ও সৎ স্বভাবের লোকদের ‘অকর্মা’ এবং দুষ্ট সত্তাদের সঙ্গে তুলনা করে ‘গাধা’ বলেও রায় দেয়। তাদের দৃষ্টিতে যারা মানুষকে নানাভাবে ঠকিয়ে হলেও অর্থ-সম্পদের মালিক হতে পারে, তারাই প্রকৃতপক্ষে ‘বুদ্ধিমান’ বা ‘চালু ছেলে’ বা ‘চালু মেয়ে’। এদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টাকা উপার্জন করতে না পারাটা পৃথিবীর অনেকের কাছে ‘পাপ’ বলে মনে হলেও পার্থিব ১০০ বছরের জীবনশেষে আলোকদেহে যে জীবনটা যাপন করতে হবে অনন্তকাল ধরে, কিংবা নতুন এক জৈবদেহ ধারণ করে পুনরায় এই পৃথিবীতেই, সেই জীবনে ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতে এই জীবনে সত্যবাদী থাকা এবং সৎ স্বভাবের অধিকারী হয়ে পৃথিবীটাকে সুন্দর করার চেষ্টা করাটাই সর্বোত্তম কাজ। আর মানুষের মানসিক শান্তি কেবল অর্থ আর প্রাচুর্যে আসে না। আসলেও অনেকের ক্ষেত্রে তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সেই তুলনায় যারা সততার সঙ্গে সত্যবাদী হয়ে জীবনযাপন করে, তারা অধিক মানসিক শান্তিতে জীবন কাটায় বলেই আমার বিশ্বাস। আর চিরকাল সর্বপ্রকারেই সুখ ভোগ করেÑ এমন মানুষ জগতে কজন পাওয়া যাবে? সামগ্রিক বিচার করলে পৃথিবীতে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে যাওয়াদের মর্যাদা মানুষকে ঠকিয়ে কোটিপতি হওয়াদের চেয়ে বেশি। নাহলে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করা ব্যক্তিত্বদের কোটি কোটি ভক্ত পৃথিবীতে থাকতো না।
৩৩২। প্রত্যেক রূপেই স্রষ্টা বিরাজিত এবং বিভিন্ন রূপধারীর হাত-পা-মাথা দিয়েই স্রষ্টার সাহায্য আসে মানুষের জন্য। এ কথা বিশ্বাস করার নামই ঈমান।
৩৩৩। অন্ধবিশ্বাসী হলেই সে ঈমানদারÑ এটা ভুল সংজ্ঞা। অন্ধবিশ্বাসী হলে সে মূর্খ। ঈমানের মূল কথাÑ স্রষ্টার ওপর নির্ভরতা। এক্ষেত্রে অফিসের কর্মকর্তা বা কোম্পানির মালিকের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার অর্থও হলো স্রষ্টার ক্ষমতায় অন্যকে অংশীদার স্থাপন তথা শিরক্ করা। কাজ করলে মজুরি পাওয়া যাবে, প্রয়োজনীয় মুহুর্তে মজুরি দাবিও করা যাবে; কিন্তু কোন মানুষ বা অন্য কোন সত্তাকে স্রষ্টার ক্ষমতায় অংশীদার স্থাপন করা যাবে নাÑ এটাই ঈমানের বিষয়ে প্রকৃত শিক্ষা। সর্বক্ষেত্রেই স্রষ্টার ওপর নির্ভর করতে হবে এবং স্রষ্টাই যার মাধ্যমে তার যা পাওয়া প্রয়োজন, তার মাধ্যমে তা পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন, এই বিশ্বাসে অটল থাকতে হবে।
৩৩৪। যেহেতু সকল প্রাণী ও উদ্ভিদের রূপেই এবং আলো, পানি, বায়ু সর্বত্র স্রষ্টার অস্তিত্ব বিরাজিত, সেহেতু কোন একক মানবকে স্রষ্টা বলে মেনে নেয়া অযৌক্তিক। এতে পরম সত্তাকে অস্বীকার করা হয়।
৩৩৫। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের ঘরে বিভিন্ন নামের টেলিভিশন শোভা পাচ্ছে এবং হাজার হাজার মানুষের কর্মকাণ্ড মানুষেরা ঘরে বসে দেখছে। কিন্তু টেলিভিশনের মূল আবিষ্কর্তাকে এজন্য কৃতিত্ব না দিয়ে মানুষেরা যদি যার যার ব্রান্ডের কোম্পানির মালিককে টেলিভিশন সৃষ্টির দাবিদার বানিয়ে দেন, তবে মূল আবিষ্কর্তার মনে যেমন দুঃখবোধের জন্ম হবে, তেমনি মূল স্রষ্টার পরিবর্তে যারা মানুষের মাঝে বিভিন্নজনকে স্রষ্টা ভেবে তার গুণকীর্তন করছেন, তারা পরম সত্তাকে দুঃখ দিয়ে চলেছেন।
৩৩৬। পৃথিবীর সকল মানুষই যদি যথার্থ ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে পারে, তবে পৃথিবীর চেয়ে উত্তম কোনো স্বর্গ বা বেহেস্ত অন্য কোনো গ্রহে থাকবে বলে আমি মনে করি না।
৩৩৭। যার মাঝে মনুষ্যত্ব নেই, তার মন পবিত্র নেই। আর যার মন পবিত্র নেই, তার দেহ পবিত্র হয় না কোনভাবেই। মন যার পবিত্র, তার দেহ প্রায় সর্বক্ষণই পবিত্র থাকে। এজন্য তাকে পবিত্রতা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকতে হয় না।
৩৩৮। স্রষ্টা হচ্ছেন এমন এক পরম সত্তাÑ যিনি সকল উদ্ভিদ ও প্রাণীর রূপেই জগতে বিরাজমান ছিলেন, আছেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেনÑ আলো, পানি ও বায়ুর শক্তির ঐক্যের মাধ্যমে। যেহেতু স্রষ্টার পরশ ছাড়া সৃষ্টির অস্তিত্ব সম্ভব নয়, সেহেতু আলো, পানি ও বায়ুর ঐক্যের মাধ্যমেই সকল প্রাণের সৃষ্টি ও স্থায়িত্ব সম্ভব হয়। এমনকি, জড় পদার্থÑ গাড়ি বা অন্যান্য যন্ত্রযানেও গতি সঞ্চারিত হয় আলোকশক্তি, জলীয় শক্তি ও বায়বীয় শক্তির ঐক্যের দ্বারাই।
৩৩৯। মানুষ যদি যথার্থ ‘মানুষ’ হতে না পারল, তবে ধর্মাচার দিয়ে সে পৃথিবীর মানুষের কাছে ধার্মিক বলে স্বীকৃতি পেতে পারে, কিন্তু স্রষ্টার দৃষ্টিতে সে অধার্মিকই থাকবে। কেননা, ধর্মাচারে স্রষ্টার কোনো লাভ-ক্ষতি নেই; ধর্ম নিয়ে যারা বাণিজ্য করছেÑ তাদের লাভ-ক্ষতি এতে জড়িত। কিন্তু মানুষ মনুষ্যত্ব হারালে তাতে স্রষ্টার ক্ষতি আছে। কারণ, একজন অমানুষের জুলুমের শিকার হয় অনেক মানুষÑ যাদের শরীরে বিরাজমান পরমসত্তা কষ্ট পান তাতে।
৩৪০। মানুষের ভালো বা মন্দ কাজের খবর জানতে ফেরেশতা বা এ জাতীয় কোনো সত্তার দ্বারা তথ্য সংগ্রহের দরকার নেই স্রষ্টার। কারণ, কম্পিউটার সফটওয়্যারের মতো এমন এক অদৃশ্য সফটওয়্যার তিনি স্থাপন করে রেখেছেন যে, প্রত্যেকের ভালো-মন্দ কাজ তাৎক্ষণিক সংরক্ষিত হয়ে যায় সেই সফটওয়্যারে।
৩৪১। স্বপ্ন ও বাস্তবের মধ্যে ব্যবধান অনেক। বলা যায়, বাস্তবে যা ঘটা সম্ভব নয়, স্বপ্নে তা-ই ঘটে। আবার অনেক সময় স্বপ্নে প্রজ্ঞাবানদের জন্য নিদর্শন থাকে। তবে সাধারণ মানুষের এতে বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশি। তাই স্বপ্নের ঘটনায় প্রভাবিত না হয়ে বাস্তবতার আলোকে বুদ্ধি খাটিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার মানুষের।
৩৪২। বাংলাদেশে যে ধরনের গণতন্ত্র বিরাজ করছে, তাকে ‘গণতন্ত্র’ না বলে রাজতন্ত্র বা রানিতন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ বলাই ভালো।
৩৪৩। অতিরিক্ত স্পিন নির্ভরতাই বাংলাদেশের ক্রিকেটের উন্নতির পথে একটি বড় বাধা। টেস্ট কিংবা ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে দেশে বা বিদেশে যেখানেই খেলুক না কেন, পেস বোলিং এ্যাটাককে সমান গুরুত্ব দেয়া শুরু না করলে বাংলাদেশ ক্রিকেটের উন্নতি যথাযথভাবে হবে না এবং জয়ের ধারাবাহিকতাও আসবে না। ৩ জন পেস বোলার, ৩ জন স্পিনার এবং ১/২ জন অলরাউন্ডার ও উইকেটকিপারসহ ৬ জন ভালো ব্যাটসম্যান যেন একাদশে প্রতিটি ম্যাচেই খেলার সুযোগ পায়, এই বিষয়টিকে বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্ট গুরুত্ব দিয়ে একাদশ গড়লে বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের খেলা দেখে ক্রিকেটভক্তদের দুঃখ পেতে হবে কম এবং বাংলাদেশ ভবিষ্যতে ক্রিকেটে উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হতে সক্ষম হবে। তা না করলে মাঝে-মাঝে দু-একটি ম্যাচে বাংলাদেশ জয় পাবে ঠিকই, কিন্তু ক্রিকেটভক্তদের পরাজয়ের বেদনাই বেশি সইতে হবে।
৩৪৪। সাধারণ বাঙালিরাই বাঙালি ও বাংলাদেশি জাতির পিতা ও মাতা। কিন্তু যিনি বাংলাদেশি বাঙালিদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে এদেশের জনগণের সাথে ‘মোনাফেকী’ করেছিলেন এবং যুদ্ধ শুরুর আগেই প্রতিপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ (নিজ বাসায় বসে থেকে শক্রুপক্ষের কাছে গ্রেফতারের জন্য অপেক্ষা করার নাম আত্মসমর্পণই। যুদ্ধের উদ্দেশ্যে কোথাও যাওয়ার সময় আটক হলে তাকে গ্রেফতার বলা যেতো) করেছিলেন, তাকে কোনোমতেই জাতির পিতা বলা যাবে না। কারণ, পাকিস্তানের ক্ষমতালাভের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান এতই একাত্ম ছিলেন যে, ১৯৭১ এর ২৫ মার্চের ক্র্যাক-ডাউনের পর আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীনতা ঘোষণার ছোট্ট একটি খসড়া তৈরি করে টেপ-রেকর্ডারে ধারণ করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে পড়তে দেন। শেখ মুজিব খসড়াটি পড়ে নিরুত্তর থাকেন এবং এড়িয়ে যান। তাজউদ্দীন আহমদ ঘোষণাটি দিতে অনুরোধ জানালে শেখ মুজিবুর রহমান উত্তর দেনÑ ‘এটা আমার বিরুদ্ধে একটি দলিল হয়ে থাকবে। এর জন্য পাকিস্তানিরা আমাকে দেশদ্রোহের অভিযোগে বিচার করতে পারবে।’ (দ্রষ্টব্য: ‘বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি’, সৈয়দ আবদাল আহমদ, ২৫ মার্চ ২০১০, দৈনিক আমার দেশ)। স্বাধীনতা ঘোষণার ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমানের এ বক্তব্যই প্রমাণ করে যে, তিনি বাংলাদেশ স্বাধীনে বা পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার ব্যাপারে আন্তরিক ছিলেন না। তাই তাজউদ্দীন আহমদ ভারতে গিয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে সক্ষম হলেও মুজিব পাকিস্তানের ক্ষমতালাভের পথ খোলা রাখতেই পাকিস্তানিদের কাছে ধরা দেয়া শ্রেয় মনে করেছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি বাঙালিদের অন্ধ ভালোবাসা এবং তার নামকে ব্যবহার করে ভারতের রাজনৈতিক হুমকি কমাতে পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন ভারতীয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধী। এ কাজে তার সরকারের সহযোগিতায় বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলা এবং শেষদিকে ভারতীয় বাহিনীকেও যুদ্ধে নিয়োজিত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা তথা পাকিস্তানের বিভক্তি নিশ্চিত করা হয়। এজন্য ইন্ধিরা গান্ধীকে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের ‘জাতির নানি’ হিসেবে উপাধি দেয়া গেলেও শেখ মুজিবুর রহমানকে কোনোভাবেই ‘জাতির পিতা’ বলে মেনে নেয়া যায় না। এ দেশের জাতির পিতা ও জাতির মাতা দেশের তৎকালীন সাধারণ জনগণÑ যারা স্বাধীনতার জন্য আন্তরিকভাবেই আন্দোলন-সংগ্রাম ও যুদ্ধ করেছিলেন।
৩৪৫। পৃথিবীতে মানুষের পুনর্জন্ম ঘটে থাকেÑ অনেকের এই বিশ্বাস যদি সত্য হয়ে থাকে, তবে আমি নিশ্চয়ই পূর্বজন্মে পৃথিবীর প্রথম মানব ছিলাম। কেননা, মানবজাতির মধ্যে ঐক্য পতিষ্ঠা এবং মানুষকে হিংসা-হানাহানিমুক্ত করার মাধ্যমে যথার্থ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আমার অন্তরে যে আকুতি ও তাড়না আছে, তা অন্য কারো মধ্যে দেখা যায় না। আর পুনর্জন্ম বিষয়ে অনেকের বিশ্বাস যদি সত্য হয়, তবে বলা যায় যে, আমিই মানবজাতির পিতা। যেহেতু পৃথিবীর প্রথম মানবের বসবাসকৃত স্থানেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার মোতাবেক সবচেয়ে বেশি ঘনত্বে মানুষের বসবাস করার কথা, সেহেতু এই দক্ষিণ এশিয়াতেই নিশ্চয় প্রথম মানব হিসেবে আমি পৃথিবীতে ছিলাম, আবার এই অঞ্চলেই জন্ম নিয়ে এসেছি এবং এই অঞ্চলেই জন্ম নিয়ে আবারো পৃথিবীতে আসবো। কারণ, আমি জন্মস্থানপ্রেমিক; অন্য অনেকের মতো বিদেশপ্রেমিক নই।
৩৪৬। ১৯৭১ সালে যারা অখণ্ড পাকিস্তান চেয়েছিলেন, অর্থাৎ বাংলাদেশপ্রেমের চেয়ে পাকিস্তানপ্রেম যাদের বেশি ছিল, তাদেরকে ‘রাজাকার’ বলা হয়। আর ১৯৭১ সালে বাঙালিদের সবচেয়ে বড় দুশমন ছিল তৎকালীন পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান। তার মৃত্যুর ২ বছর পূর্বে ২৯ মে ১৯৭৮ ইং পাকিস্তানের লাহোর কোর্টে এক গোপন এফিডেভিটে (ক্রমিক নং-২৪৪/১৯৭৮। ১৯৮০ সালের আগস্ট মাসে ইয়াহিয়া খানের মৃত্যুর ২৫ বছর পর ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তান সরকার এফিডেভিটটি জনসমক্ষে প্রকাশ করে) বলে যান যে, ‘শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর চেয়ে বড় দেশপ্রেমিক (পাকিস্তানপ্রেমিক) ছিলেন। ভুট্টো যেখানে ১৯৭০ সালের নির্বাচন থেকে শুরু করে সংসদ অধিবেশন তলব করা নিয়ে বারবার বাধা সৃষ্টি করেছেন, সেখানে শেখ মুজিব ছিলেন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ অনুসরণের পক্ষে।’ (দ্রষ্টব্য: সাপ্তাহিক প্রতিচিত্র, সংখ্যা: ২৫ ফেব্র“য়ারি ২০১১ ইং, পৃষ্ঠা: ৩০-৩১)। ইয়াহিয়া খানের এফিডেভিটে প্রকাশিত মতামতের প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খানের দৃষ্টিতে জুলফিকার আলী ভুট্টোর চেয়ে বড় দেশপ্রেমিক (পাকিস্তানপ্রেমিক) ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, সেহেতু একথা প্রমাণিত যে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাজাকারের নাম হচ্ছেÑ শেখ মুজিবুর রহমান।
৩৪৭। বিশ্বাস ও সত্যের মধ্যে তফাৎ হচ্ছে এই যে, বিশ্বাস সব সময় সত্য হয় না; তবে সত্য সব সময়ই সত্য। ‘বোরাক’ নামক যন্ত্রযান এক রাতের মধ্যেই দুইবার সপ্তম আকাশে যাতায়াতের বিষয়টা বাস্তবে প্রমাণিত কোনো সত্য নয়। কিংবা যিশু বা ঈসা নবী স্রষ্টার পুত্র বা স্বয়ং ঈশ্বরÑ এ কথাও প্রমাণিত কোনো সত্য নয়। আকাশ থেকে যিশু পুনরায় পৃথিবীতে নেমে আসবেনÑ অনেকের এই বিশ্বাসও বাস্তবে এখনো প্রমাণিত হয়নি। আর যা প্রমাণিত হয়নি, তা সত্য বলে গ্রহণ করা মূর্খতা ছাড়া কিছু নয়। আকাশ থেকে যিশু পৃথিবীতে নেমে এলেই কিংবা ‘বোরাক’ নামক যে যন্ত্রযান এক রাতের মধ্যেই দুইবার সপ্তম আকাশে যাতায়াতের ক্ষমতা রাখে, তা পৃথিবীতে নিয়মিত যাতায়াত করলেই তখন কেবল বলা যাবে যে, মানুষের বিশ্বাস সঠিক। আর তা যতদিন পর্যন্ত না ঘটবে, ততদিন পর্যন্ত এটাই বলতে হবে যে, মানুষেরা ভুল বিশ্বাস নিয়ে পৃথিবীতে রাতের ঘুম নষ্টসহ কষ্টকর জীবনযাপন করছে।
৩৪৮। স্রষ্টা মানুষকে ‘ঈমান’ নামক বটিকা খাইয়ে মূর্খ বানিয়ে রাখবেনÑ এমন কথা যারা বিশ্বাস করে, তারা মহামূর্খ ছাড়া কিছু নয়। স্রষ্টা কিছুতেই এমন চরিত্রের অধিকারী হতে পারেন নাÑ যিনি ‘ঈমান’ নামক বটিকা খাইয়ে মানুষকে প্রকৃত সত্য থেকে অন্ধকারে রাখবেন। স্রষ্টা মানুষকে জ্ঞানী ও সত্যপ্রেমিক বানানোর পক্ষপাতী বলেই বিশ্বাস করি আমি। অতএব, কোনো বিষয়ের প্রতি অন্ধবিশ্বাস স্থাপনের শিক্ষা স্রষ্টা কিছুতেই মানুষকে দিতে পারেন না। কারণ, মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে ‘মানুষ জ্ঞানী ও সত্যপ্রেমিক’ একথা প্রমাণের লক্ষ্যেই। কিন্তু অনেকেই মানুষকে ভুল শিক্ষা দিয়ে মহামূর্খ বানিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেÑ যা আদৌ কাম্য নয়।
৩৪৯। দিনে হোক কিংবা রাতেÑ দুই রাস্তা বা চার রাস্তার মোড়ে সব সময়ই গাড়ি বা যানবাহন ধীরগতিতে চালানো দরকার। সেইসাথে ডানে বা বামে গাড়ি ঘোরাতে হলে সিগনাল বা হাতের ইশারা দিয়ে পেছনের দ্রুত গতিশীল গাড়িকে ধীরগতিতে আনার পুরোপুরি সুযোগ ও সময় দিয়েই দেখেশুনে গাড়ি ঘোরানো দরকার। চালকেরা এ বিষয়ে সচেতন থাকে না বলেই প্রতিদিন দেশে-বিদেশে প্রচুর দুর্ঘটনা ঘটছে। এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে চালকদের অবশ্যই সচেতন করা দরকার।
৩৫০। মানুষের অনেকেই বিশ্বাস করে যে, তাদের চরিত্রের সকল সদ্গুণÑ দয়া-মায়া-শক্তিমত্তা স্রষ্টা হতে প্রাপ্ত। কিন্তু যৌনশক্তি স্রষ্টা হতে প্রাপ্ত নয়। যৌনশক্তি অন্য কারো ভাণ্ডার হতে আসেÑ এমন মনে করাটা কি স্রষ্টার ক্ষমতায় অন্যকে অংশীদারিত্ব স্থাপন করার শামিল নয়?
৩৫১। মানুষ ও জানোয়ারের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হচ্ছেÑ জানোয়ারদের যৌনতা বিষয়ে সংযমী হয়ে চলার বিবেক দেয়া হয় নাই। আর মানুষেরা যৌনতা বিষয়ে সংযমী হয়ে চলার বিবেক পেয়েছে বলেই এক্ষেত্রে সংযম বজায় রেখে না চললে মানুষ ও জানোয়ারের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না।
৩৫২। যৌনতা মানুষের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ বৈধ যৌন সম্পর্কের ওপর আস্থা রেখে চলে, ততক্ষণ পর্যন্তই সে মানুষের দলভুক্ত থাকে। যখন থেকে সে অবৈধ যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে যায়, তখন থেকেই সে জানোয়ারের দলভুক্ত হয়ে পড়ে। আর জানোয়ারের দলভুক্ত কারো পরবর্তী জীবনে শান্তিময় আবাসে বসবাসের কোনো সুযোগ নেই। কেননা, পরবর্তী জীবনে শান্তিময় আবাসে বসবাসের বিষয়টি কেবল মানুষের দলভুক্তদের জন্যই সংরক্ষিত। অতএব, যারা পরবর্তী জীবনে শান্তিময় আবাসস্থল লাভের আকাক্সক্ষা করেন, তাদের উচিত অবৈধ যৌনতার ব্যাপারে সব সময়ই সচেতন থাকা।
৩৫৩। যৌনতার বাণিজ্যের জন্য যারা নারী ও শিশু কেনাবেচা করে এবং যারা নারী-পুরুষকে ব্যভিচারে লিপ্ত করতে উৎসাহিত বা বাধ্য করে, তারা যেমন জানোয়ারের দলভুক্ত, তেমনি প্রশাসনের যারা এ কাজে সহযোগিতা করে, তারাও জানোয়ারের দলভুক্ত। রাষ্ট্রশাসক এদের শাস্তি দেয়ার ব্যাপারে দৃঢ়তা না দেখালে তাকে ‘জানোয়ারদের পৃষ্ঠপোষক’ বলা ছাড়া অন্য কিছু বলার উপায় থাকে না।
৩৫৪। প্রেম মানে না জাত-রঙ, ধনী-গরিবÑ গল্প-উপন্যাসের এ ধরনের কাহিনির বাস্তব রূপও মাঝে-মাঝে পৃথিবীতে দেখা যায়। আর সেইসঙ্গে এটাও দেখা যায় যে, একটি হিন্দু পরিবারের মেয়ের সঙ্গে মুসলিম পরিবারের ছেলের, কিংবা মুসলিম পরিবারের মেয়ের সঙ্গে বৌদ্ধ পরিবারের ছেলের বিয়ে হলে ধর্মীয় কারণে উভয়ের পরিবারের মধ্যে বিশাল দূরত্ব থেকে যায়; যা এই আধুনিক যুগে কাম্য নয়। ছেলে-মেয়ের মধ্যে একের অপরকে ভালো লাগতে পারে। পছন্দ করে একে অপরকে বিয়েও করতে পারে। কিন্তু এই বাস্তবতা যদি অভিভাবকরা মেনে নিতে না চায়, তা এই আধুনিক যুগে যেমন দুঃখজনক, তেমনি ধর্মীয় কারণে এমন দুই পরিবারের মধ্যে দূরত্ব থাকাও উচিত নয়। ধর্ম যদি প্রেম-বিয়ে-আত্মীয়তা-বন্ধুত্বের মধ্যে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়, তবে তা তো মনুষ্যত্বের মৃত্যুর কারণ হয়। প্রেম করে বিয়ে করার কারণে মেয়েকে যদি তার মা-বাবা-ভাই-বোন থেকে অনেক দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হয় এবং এ কারণে তার পরিবারের লোকেরা ছেলেপক্ষের পরিবারের লোকদের সাথে এক টেবিলে বসে খাওয়া-দাওয়া করার সুযোগ না পায়Ñ এতে তো মনুষ্যত্বেরই মৃত্যু ঘটে। আর ধর্ম যদি মনুষ্যত্বের মৃত্যুর কারণ হয়Ñ তবে ধর্মের সার্থকতা কোথায়?
৩৫৫। প্রেম করে বিয়ে করার কারণে ছেলে বা মেয়ে কাউকে জেলে যেতে হলে তা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। যেহেতু ছেলে ও মেয়ের প্রত্যেকের জীবনে সুখ-শান্তি খোঁজার অধিকার আছে, সেহেতু তাদের কাউকেই এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়। তবে যথার্থ জীবনসঙ্গী খুঁজে নেয়ার ব্যাপারে যৌবনকাল শুরু হওয়ার প্রারম্ভেই অভিভাবকের উচিত সন্তানকে কার্যকর শিক্ষা দেয়া, যাতে সঙ্গী বাছাই করতে সে ভুল না করে। আর সন্তানদের মধ্যে ছেলেদের বয়স ২২ এবং মেয়েদের ১৮ বছর পেরোলেই তাদের বিয়ে দেয়ার জন্য চিন্তা-ভাবনা করা উচিত অভিভাবকেরÑ যাতে তারা যৌবনকালে বিপথে যাওয়ার সুযোগ না পায়। এজন্য বিয়ে-শাদীর ক্ষেত্রে গয়না-গাটি, প্রচুর লোক খাওয়ানোর রীতি-রেওয়াজ থেকেও সরে আসা দরকার মানুষের; যাতে করে অর্থনৈতিক কারণে বিয়ে-শাদীর আনুষ্ঠানিকতায় বাধা সৃষ্টি না হয়। সন্তানদের তথা তরুণ-তরুণীর চরিত্র ঠিক রাখার বিষয়ে অভিভাবক ও সমাজপতিদের দায়িত্ব তো রয়েছেই। মানুষ যাতে জানোয়ারের দলভুক্ত হয়ে না যায়, সেজন্য সমাজপতি ও অভিভাবকদের যা কিছু করণীয়Ñ তার সবকিছুই করতে হবে। অন্যদিকে তরুণ-তরুণীকেও ধৈর্য্যধারণ করতে হবে এ ব্যাপারে। নাহলে ভুল করে জানোয়ারের দলভুক্ত হয়ে গেলে পরবর্তী জীবনের সঙ্গে ইহজীবনেও সুখ-শান্তি হারানোর সম্ভাবনা থাকবে। আর ইহকালের স্বাভাবিক জীবনটাও যেহেতু প্রায় ৭০/৮০ বছরের, সেহেতু এ দীর্ঘ জীবনের শান্তির কথাও ভাবতে হবে।
৩৫৬। স্রষ্টা ও মানুষের মাঝে কোনো অন্তরাল নেই। স্রষ্টাকে প্রার্থনা জানানোর জন্য কোনো মাধ্যম ধরার অর্থই হলো সেই মাধ্যমকে স্রষ্টার সঙ্গে অংশীদার স্থাপন করা। এতে বরং স্রষ্টা মানুষের ওপর রাগান্বিত হন। স্রষ্টাকে স্মরণ করলে স্রষ্টা যেমন মানুষের সকল সমস্যা সমাধানের পথ খুলে দেন, তেমনি স্রষ্টার ওপর ভরসা রাখলে স্রষ্টা মানুষকে বিপদ-আপদ হতেও রক্ষা করেন।
©somewhere in net ltd.
১|
২৯ শে এপ্রিল, ২০১৪ বিকাল ৩:৫৯
আজীব ০০৭ বলেছেন: এও বড় লিখা........................