![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
হযরত মোহাম্মদের (সা.) পুনর্জন্মে
মুসলিমরা খুশি হবে কি?
কাউসার ইকবাল
ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে না। যদিও হাদিস শরীফে হযরত মোহাম্মদের (সা.) ভবিষ্যদ্বাণীতে এমন তথ্য রয়েছে যে, কেয়ামতের একদিন পূর্বে হলেও পৃথিবীতে মোহাম্মদ নামে এমন এক ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব হবে, যার বাবা-মায়ের নাম আমার (মোহাম্মদের) বাবা-মায়ের নামের অনুরূপ হবে। এ হাদিস মোতাবেক যদি ধরেই নেই যে, হযরত মোহাম্মদই (সা.) পুনর্জন্ম নিয়ে পৃথিবীতে আসবেন মানুষের অধিকতর কল্যাণের জন্য, কিংবা মুসলিমরা যে নানাভাবে সমাজে অশান্তি বিস্তার করে চলেছে সে বিষয়ে তাঁর উম্মতদের কাছে কৈফিয়ত তলবের জন্য, তবে বর্তমানে যে মুসলিমরা মোহাম্মদের (সা.) প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করেন বিশাল র্যালিতে অংশগ্রহণ করে কিংবা সভা-সমাবেশে তাঁর প্রশংসাসূচক বক্তব্য রাখেন, তারা প্রকৃতপক্ষেই খুশি হবেন কি?
হযরত মোহাম্মদ (সা.) তার সমাজে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে পেরেছিলেন এ কারণেই যে, তিনি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে ধর্ম প্রতিষ্ঠার বিনিময়ে অর্থ রোজগারের কোন চিন্তা করেননি। তার পরবর্তী সময়ের ইমামরাও যদি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে চেষ্টা করতেন ব্যবসা বা অন্য কোন পেশা বেছে নিয়ে, তাহলে তারা সমাজের সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারতেন। কিন্তু তারা সে বিষয়ে সচেষ্ট না হওয়ায় সমাজের নেতৃত্ব স্রষ্টার অনুগামীদের মধ্যে না থেকে ক্রমান্বয়ে শয়তানের অনুগামীদের মধ্যে চলে গেছে। আর সেই সুযোগে সমাজের ভণ্ডরাই এখন ক্ষমতাধর ব্যক্তিত্ব যার যার সমাজে। এজন্য মসজিদের ইমাম পদবীধারীদের যদি মোহাম্মদ (সা.) সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতার দায়ে দোষারোপ করে কৈফিয়ত চান, তবে ইমাম পদবীধারীরা কি খুশি হবেন? কি জবাব দেবেন তারা মোহাম্মদ (সা.) এর কাছে? আজকাল চোর-ডাকাত-ব্যভিচারী-খুনি-দুর্নীতিবাজ-ভণ্ড-প্রতারকসহ অনেক অপরাধীই ‘মোহাম্মদ’ নাম ব্যবহার করছেন। এতে করে নানা অপরাধে অপরাধীরা যে কার্যত ‘মোহাম্মদ’ নামের প্রতি অসম্মানই প্রদর্শন করছেন, এ বিষয়ে মোহাম্মদ (সা.) অভিযোগ তুলে যদি বলেন যে, ‘মোহাম্মদ’ নাম ব্যবহার করলে তার যে পাপ করার কোন অধিকারই নেই, এ বিষয়ে কোনপ্রকার বোধ তোমাদের জাগেনি কেন? তোমরাতো আমার নামের মর্যাদাহানি করার অপরাধে অপরাধী। থানায় অপরাধীর নাম রেকর্ডে কিংবা পত্রিকার পাতায় ‘মোহাম্মদ’ নাম ছাপা হচ্ছে বিভিন্ন অপরাধী হিসেবে। এতে করে তোমরা কি প্রকৃত মোহাম্মদকে ভীষণভাবে অপমানিত করোনি? এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হলে মুসলিমরা কি খুশি হবে? আলেম-আল্লামা পরিচয়দানকারী অনেকে ঢাকার বায়তুল মোকাররমের সামনে অনেক সময়ই বিক্ষোভ মিছিল বা সমাবেশ করেছে-করছে। কিন্তু বায়তুল মোকাররমের এক মাইলের মধ্যেই চারপাশে শত রকমের অপরাধ ঘটলেও সেসব অপরাধ বন্ধে বা অপরাধীদের শাস্তি দিতে কোনপ্রকার ভূমিকা তাদের দেখা যায়নি। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে যে শঠতা-ভণ্ডামি, তা প্রতিরোধেও তাদের কার্যকর ভূমিকা দেখা যায়নি। আর ‘মোহাম্মদ’ নাম ধারণকারী অনেক রাজনীতিবিদের মুখ দিয়ে সমাজে অশান্তি ছড়ানোর সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা চলছে। কিন্তু এ ধরনের ব্যক্তিদের যে ‘মোহাম্মদ’ নাম ব্যবহারের অধিকার নেই, সে বিষয়েও আল্লামাদের কিংবা নবীপ্রেমিক দাবিদারদের কখনো সোচ্চার হতে দেখা যায়নি। তাই ‘মোহাম্মদ’ নামকে কলুষিত হওয়া থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থতার জন্য ইমাম-আলেম-আল্লামাদেরও যদি মোহাম্মদ (সা.) দায়ী করেন, তবে তারা খুশি হবে কি?
স্কুলের শিক্ষার্থীদের ক্লাসে হাজির থেকে মূল পাঠ গ্রহণের জন্য যথাসময়ে পিটি ক্লাসে উপস্থিত হবার কড়াকড়ি আরোপ করেন প্রধান শিক্ষক বা পিটি’র শিক্ষক। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, পিটি ক্লাসে যে নিয়মিত হাজির থাকে, সে-ই বিদ্যালয়ের মূল পাঠে ভালো বা মেধাবী ছাত্র। ধর্মগুলোতেও ধর্মের মূল পাঠ শেখানোর জন্য ‘পিটি ক্লাস’র ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু ‘পিটি ক্লাস’ এ নিয়মিত হাজির থাকা ব্যক্তিই যে উত্তম ধার্মিক হবেন, তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। উত্তম ধার্মিক সে-ই, যে ধর্মের মূল পাঠ গ্রহণ করে মনুষ্যত্ববাদী হয়েছে ও পাপমুক্ত থেকে জীবনযাপন করতে পারছে। এ কথাটা যেমন ‘ধর্মজ্ঞানী’ বলে দাবিদাররা অনেকেই ঠিকমতো বোঝেনি, তেমনি তারা ধর্মগ্রন্থের উপমাগত অনেক কথাও বুঝতে অক্ষম হয়েছে। ধর্মগ্রন্থের বর্ণনাগুলোর দুটো রূপ রয়েছে। একটি মেধাগত নাবালগদের জন্য, অন্যটি যারা জ্ঞানের সাধনা করতে চায় তাদের জন্য। কোরআনেরই অনেক স্থানে ‘চিন্তাশীলদের জন্য এ কথায় নিদর্শন রয়েছে’ এমন বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে। মেধাগত নাবালগদের অর্থাৎ ৬-৭ বছরের শিশুদের যদি বলা হয় যে, বেহেশতে একজন তরুণ ও একজন তরুণী নগ্ন হয়ে ঘুরে বেরিয়েছে, একসঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছে; কিন্তু তারা যে নগ্ন অবস্থায় আছে, সে কথাটাই তারা বোঝেনি, এ কথার তাৎপর্য শিশুরা বুঝবে না। তারা এটাকে রূপকথার গল্পের মতো ব্যাপার হিসেবে ধরে নেবে। কিন্তু চিন্তাশীল ব্যক্তি বা মেধাগত সাবালগ ভাববে যে, স্রষ্টার গল্পটা এভাবে বলার অন্য কোন কারণ আছে। একজন তরুণ ও একজন তরুণী নগ্ন হয়ে ঘুরে বেরিয়েছে, একসঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছে, কিন্তু তারা যে নগ্ন অবস্থায় আছে এটা তারা বুঝবে না, ব্যাপারটা তো এমন হওয়ার কথা নয়। স্রষ্টা নিশ্চয়ই এ কাহিনী দ্বারা অন্য কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছেন। মেধাগত সাবালগরা বুঝতে পারার কথা যে, কোরআন-বাইবেলে প্রথম মানব আদম (আ.) ও প্রথম মানবী ইভ বা হাওয়া (রা.)-র যে কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে, তাতে স্রষ্টা মূলত মানুষকে এটা বোঝানোর চেষ্টাই করেছেন, মানুষের জীবনব্যবস্থা তিনি এমনভাবে সাজিয়েছেন যাতে জন্মলাভের পর মানুষ একটা সময় পর্যন্ত নগ্নতা সম্বন্ধে জ্ঞান রাখবে না; সেই সময়টা পর্যন্ত তার জীবনটা স্বর্গীয়। এরপর যখন তার নগ্নতা সম্বন্ধে বোঝার জ্ঞান হবে, তখন তাকে কাজ শুরু করতে হবে। সে সেই সময়টায় কাজের মাধ্যমে নিজেকে যেভাবে গড়ে তুলবে, তার ওপরই নির্ভর করবে তার পরবর্তী জীবনের সুখ-দুঃখ। সেইসঙ্গে এ কাহিনীতে মানুষের জন্য এ নির্দেশনাও রয়েছে যে, তোমরা যখন স্বামী-স্ত্রীতে সুখে-শান্তিতে জীবনযাপন করবে, তখন তৃতীয় কোন ব্যক্তি সর্পের ন্যায় বিষ নিয়ে কিংবা ইবলিসের ন্যায় তোমাদের প্রলুব্ধ করে তোমাদের সংসার ভাঙতে বা অন্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে সচেষ্ট হবে। তার ক্ষতি থেকে তোমরা সতর্ক থেকো এবং তোমাদের যে অবস্থায় রাখা হয়েছে, তাতেই সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা কোরো। তাহলে তোমরা দুষ্টদের বন্ধু সেজে ক্ষতি করা থেকে রক্ষা পাবে। কোরআন-বাইবেলের এ কাহিনীতে মানুষকে কাজের ওপর জোর দেয়ার শিক্ষাই মূলত দেয়া হয়েছে। আবার হাদিসে বলা হয়েছে, দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত বিদ্যার্জন করো। এ দ্বারা মোহাম্মদ (সা.) যে শুধু কোরআন-হাদিস থেকে বিদ্যার্জন করতে বলেছেন, তা কিন্তু নয়। যুগের প্রয়োজনে বিদ্যুতের ব্যবহার, কম্পিউটার ব্যবহার শিক্ষা সবই বিদ্যার্জনের মধ্যে পড়ে। কিন্তু ইমাম-আল্লামা দাবিদাররা ‘আমল’ ও ‘ইবাদত’ শব্দের অর্থও ঘুলিয়ে ফেলেছে। ‘আমল’ শব্দের অর্থ হচ্ছে কাজ। ‘নেক আমল’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘ভালো কাজ’। স্রষ্টার প্রতি নির্ধারিত সময় ইবাদত বা প্রার্থনার পর নেক আমল বা ভালো কাজে নিজেদের নিয়োজিত করার কথাই বলা হয়েছে ধর্মে। কিন্তু ভিন্ন কথা বুঝিয়ে মুসলিমদের কর্মবিমুখ করে রেখেছে ইমাম-আল্লামাদের অনেকেই, যাতে তাদের ধর্মবাণিজ্যে লাভ হয়। এ কারণে সমাজব্যবস্থায় প্রকারান্তরে কর্মবিমুখ শ্রেণী সৃষ্টি হবার পাশাপাশি সমাজে অপরাধপ্রবণতাও বেড়েছে। সেইসঙ্গে মুসলিমদের মধ্যে দায়িত্ববোধ সম্বন্ধে উদাসীনতা ও মানবকল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করার তাগিদও কমে যাচ্ছে। এমন অভিযোগ যদি হযরত মোহাম্মদ (সা.) তোলেন ইমাম-আল্লামাদের বিরুদ্ধে, তবে তারা কি খুশি হবেন? বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যদি হযরত মোহাম্মদ (সা.) নেতাদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ তোলেন যে, তোমরাতো গণতন্ত্র চর্চায় ব্যর্থ নিজেদের শঠতাপূর্ণ আচরণের জন্য এবং দেশের মানুষের শান্তি বিনষ্টের জন্য দায়ী, তবে ক্ষমতাসীন বা বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা কি খুশি থাকবেন মোহাম্মদ (সা.) এর প্রতি? জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকার রক্ষার কথা বলে ১৭৩ দিন হরতাল পালনকারী শেখ হাসিনাকেই যদি হযরত মোহাম্মদ (সা.) দেশের বর্তমান সংকটের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করে মহাপাপী বলে চিহ্নিত করেন, তবে শেখ হাসিনা কি খুশি হবেন? আর যদি হযরত মোহাম্মদ (সা.) এ দাবি তোলেন যে, যেহেতু তোমরা গণতন্ত্র চর্চায় ব্যর্থ হয়েছো, সেহেতু রাষ্ট্রধর্ম ‘ইসলাম’ হওয়ার সুবাদে এ রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতার অধিকার মোহাম্মদ (সা.) এর হাতেই ন্যস্ত করো, তাহলে মদিনা সনদ অনুযায়ী দেশ চালানোর দাবিদার শেখ হাসিনা কি তাঁর হাতে রাষ্ট্রের শাসনভার তুলে দেবেন?
মোদ্দাকথায়, ইমাম-আল্লামা-রাজনৈতিক নেতা সকলেরই স্বার্থবাদী চিন্তার কারণে ইসলাম ধর্ম যে কলুষিত হয়ে পড়েছে এবং এ কারণে সমাজে শান্তির পরিবর্তে অশান্তির মাত্রাই বেড়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন, এ অবস্থা মোহাম্মদ (সা.) যদি পুনর্জন্ম নিয়ে এসে দেখেন, তবে যারা তাঁর সুপারিশ লাভ করে বেহেশতে যাবার স্বপ্ন দেখছেন, তাদের সেই আশা কি দুরাশায় পরিণত হবে না? পুনর্জন্ম নিয়ে এসে মোহাম্মদ (সা.) যদি মুসলিমদের নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড দেখেন, তবে কি তিনি মর্মাহত হবেন না? এ উপলদ্ধিটাই কি তাঁর জাগবে না যে, ‘মুসলিমরা তাঁর প্রতি যে ভক্তি ও ভালবাসা দেখাচ্ছে, তা স্রেফ ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বাণিজ্যের স্বার্থে। প্রকৃতপক্ষে তাঁর শিক্ষা গ্রহণ করে আদর্শ মানুষের সংখ্যা সমাজে খুবই কম; ভীষণ কম। তাইতো স্বার্থপরে ভরে গেছে পৃথিবী, আর মনুষ্যত্ব এখন রয়েছে মুমূর্ষু অবস্থায়।’
©somewhere in net ltd.