নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভাষাহীন বাবুই

খেয়া ঘাট

ভাষাহীন বাবুই

খেয়া ঘাট › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাবা দিবসে জীবন বদলে দেয়া এক বাবা আর তার সন্তানের কাহিনী

১৯ শে জুন, ২০২০ রাত ১০:৪৯

"বাবা দিবসে জীবন বদলে দেয়া এক বাবা আর তার সন্তানের কাহিনী"

বিশাল ভূসম্পত্তির মালিকের এতো সাধারণ জীবন যাপন। উনার মেয়ের বিয়েতে গিয়ে আরো অবাক হই । সাদামাটা একটা বিয়ে। বড় কোনো আয়োজন নেই। উচ্চস্বরে গান-বাজনা নেই। প্লেটের ওপর উপচে পড়া খাবার নেই। চমৎকার, সুন্দর , মন শান্ত করে দেয়া পরিবেশ। বিয়ের সমস্ত আয়োজন শেষে উনার পাশে বসি। মেয়ের বিদায়ে বাবার অশ্রুসজল চোখ। চুপচাপ। কিছুক্ষণ পর কি মনে করে যেন বলেই ফেললাম- বিয়েটাও এতো সাধারণ হবে- ভাবতে পারিনি।
বুঝলাম- মনটাকে হালকা করার জন্য হয়তোবা উনিও এই সময় কাউকে খোঁজছিলেন।
বললেন- আসলে একটা রাতই আমার জীবনটাকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে।
বছরে পর বছরের সাধনা মানুষের জীবনকে বদলায় না। আর উনাকে একটা রাতই বদলে দিলো। কি এমন সে রাত?
উনি বলা শুরু করলেন।
আমার আব্বার ছিলো বেশ বড় একটা স্টোর। তো স্কুল ছুটির পর আমি স্টোর হয়ে ঘরে ফিরি। আব্বা আমাকে দোকানে বসিয়ে একটু বের হন। আর সেই ফাঁকে ক্যাশ ড্রয়ার থেকে আমি টাকা চুরি করি। প্রথমে দশ টাকা। তারপর বিশ টাকা। কিছুদিন পর আমার লোভ আরো বাড়ে। আমি পুরো একশত টাকাই নেয়া শুরু করি। ড্রয়ারের ভিতরে এতো এতো টাকা। আব্বা টের পান না। টাকা চুরি আমার নেশা হয়ে যায়। চুরির টাকায় আমি বন্ধুদের সাথে ফুর্তি করি। এক শত টাকা কিন্তু সে সময়ের জন্য অনেক টাকা।

একদিন আব্বা আমাকে বলেন- খোকা একদিন স্কুলে না গেলে কি তোমার কোনো অসুবিধা হবে? একটা ছেলে মায়ের অসুস্থতার জন্য বাড়ি গেছে। তুমি কি কাল আমাকে ওর বদলে একটু সাহায্য করতে পারো।

আমি আব্বার সাথে স্টোরে হাজির হই সকাল আটটা বাজে। মানুষের কোলাহল বাড়ে।। দুজন মানুষ কাজ করছে। কারো কোনো দম ফেলার ফুরসত নেই। এটা দাও, ওটা নাও। মাল প্যাক করো। গাড়িতে ওঠাও। চালান রেডি করো। কোন মাল দোকানে নেই- তার লিস্ট বানাও। কবে মাল আসবে তার খোঁজ নাও। তীব্র গরমের দাবদাহে সবার গায়ের জামা শরীরের সাথে লেগে গেছে। কিন্তু কারো কোনো ফুরসৎ নেই। আমার কাজ হলো- মাল বিক্রি করে টাকা নিয়ে ক্যাশে রাখা। আর কোন মাল বিক্রি হচ্ছে তার তালিকা রাখা। হঠাৎ এক বস্তা মালের শর্ট হলো। দোকানে নেই। কাস্টমার দাঁড়িয়ে আছে। আব্বা দোকানের এক কর্মচারীকে নির্দেশ দিতে গিয়ে তার ব্যস্ততা দেখে নিজেই রওয়ানা দেন। কিছুক্ষণ পর দেখি, মাথায় বেশ কয়েকটি বস্তা নিয়ে আব্বা ফিরছেন। শরীর বেয়ে ঘাম ঝরছে। কর্মচারীদের একজন আব্বার মাথা থেকে মালের বস্তা নামায়। আব্বা একটা টুলের ওপর বসে রীতিমত হাঁপাচ্ছেন। দেখে মন খারাপ হয়। মাথায় করে মালের বোঝা টানা এমন বাপকেতো আগে কখনো দেখিনি। লজ্জাও লাগে। আবার দুঃখও লাগে। কাউকে বিশটা টাকা দিলেইতো এই মালগুলো উনাকে আর নিজ মাথায় বহন করতে হতোনা। এতো কৃপণ হওয়ার দরকার কি?

বিকেলে ব্যস্ততা একটু কমলে- আব্বা দুজনকে খাবারের জন্য অবসর দেন। দোকানের ভিতর খুবই ছোট একটা জায়গায় দুজনে আহার করে। ওদের খাওয়া শেষ হলে- আব্বা, আমি আর আমার বয়সী ছেলেটি ছোট একটা জায়গায় খেতে বসি। যেখানে ভালো করে হাত পা নাড়ার পর্যন্ত জায়গা নেই।

খাওয়ার পর শুরু হয়- আবার পুরোদমে কাজ। মানুষের ঘরে ফেরা শুরু হয়েছে। ব্যস্ততা এবার আরো বাড়ে। রাত এগারোটা বাজলে প্রায় পনের ঘন্টা টানা কাজ শেষে স্টোর বন্ধ হয়। এরপর শুরু হয় পরের দিনের জন্য স্টোর গুছানো আর ক্যাশ মিলানোর কাজ।

আমি ক্যাশের টাকা গুনে রেডি করার পর আব্বা বলেন- লিস্ট দেখে এবার ঠিক করো কোন আইটেম কতটি বিক্রি হয়েছে। এগুলোর কেনা মূল্য কত তা দেখো । প্রতিদিনের লাভ ক্ষতি প্রতিদিন বের করে না রাখতে পারলে ব্যবসায় ঠিকে থাকা মুশকিল।

প্রতিটি আইটেম আলাদা আলাদা হিসাব করে দেখলাম বেশীরভাগ আইটেমেই লাভ হয়েছে। কিন্তু দুয়েকটা আইটেমে ক্ষতি হয়েছে।
আব্বা বললেন- ক্ষতি হলেও এগুলো রাখতে হয়। কারণ- এইসব আইটেম দোকানে না পেলে মানুষ অন্য দোকানে চলে যাবে। কাস্টমার হারানো ব্যবসার জন্য ভালো না।

সব হিসাব শেষ করে দেখলাম দিনের শেষে লাভ হয়েছে- নয় হাজার তিনশ টাকা। এখান থেকে আববা তাঁর কর্মচারী সবাইকে দিলেন ২ হাজার টাকা। বাকি রইলো ৭ হাজার তিনশ টাকা। একটা একশ টাকার নোট এক কর্মচারীকে দিয়ে বললেন- কালকে অবশ্যই তোমার মেয়েকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবা। লোকটি আব্বার হাত থেকে টাকা নিয়ে কেঁদে ফেলে। রইলো সাত হাজার দুইশ টাকা । আমি মনে মনে খুশী হলাম। দিন শেষে সাত হাজার দুইশ টাকা লাভ। খারাপ না ।

এরপর আব্বা বলেন- এই টাকা থেকে কর দিতে হবে, কিছু দিতে হবে বিভিন্ন সংগঠনকে বাধ্যতামূলক চাঁদা। এরপর আছে দোকান মেরামতের খরচ, বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল, দোকান ভাড়া, যাতায়াতের খরচ, তোমার পকেট খরচ, স্কুলের খরচ, আমি যে কাজ করি আমার নিজের বেতন- যেটা দিয়ে সংসার চলে- এসব কিছুর আলাদা খরচ আরেকটা আলাদা খাতায় লিখা আছে। আব্বা সেই খাতাটা বের করে বলেন- আজকের মোট লাভ থেকে তা বাদ দিতে ।
সব কিছু বাদ দেয়ার পর আমি চমকে ওঠি। প্রায় ষোল ঘন্টা করে সারাটা দিন পাঁচ জন মানুষের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর লাভ হয়েছে মাত্র ১১০০ টাকা। এখন বুঝতে পারছি- কেন বিশটা টাকা বাঁচাতে আব্বা নিজেই মালের বোঝা মাথায় বহন করে নিয়ে এসেছেন।

আব্বা বলেন- এখান থেকেই ভবিষতের সন্চয়ের চিন্তা করতে হবে, ব্যবসা বাড়ানোর কাজে লাগাতে হবে, গরীব আত্মীয় স্বজনদের প্রয়োজনে সাহায্য করতে হবে। এই টাকায় ওদেরও হক আছে। জীবনে একটা জিনিস তোমার দাদা আমাকে শিখিয়ে গেছেন- টাকা আয় করাটা যেমন জানতে হয়। টাকা ব্যয় করাটা আরো ভালো করে জানতে হয়। এই দুটি জিনিস জানলে সৎ পথে থেকেও জীবনে সাফল্য আসে। অনেক মানুষ আছে বড় লটারি জেতার পরও দু বছরের মাথায় আবার ফকির হয়ে গেছে। কারণ- সে জানেনা কিভাবে টাকাটা ব্যয় করতে হয়। সৎ মানুষের কাছে সম্পদ আর ক্ষমতা থাকলে এটা মানুষের জন্য কল্যাণ। আর অসৎ মানুষের কাছে সম্পদ আর ক্ষমতা থাকলে এটা শয়তানের জন্য কল্যাণ। জীবনে তিনটি জিনিসের প্রতি খুবই গুরুত্ব দিয়ো। স্বস্বাস্থ্য , সুচরিত্র আর সন্চয়। কেউ কাউকে এসব দান করে দিয়ে দিতে পারেনা। এগুলো নিরবিচ্ছিন্ন সাধনায় তৈরি হয়। অপাত্রে সন্চয় দান করলেও কেউ রাখতে পারেনা। জীবনে সহজ সরল হয়ো, কিন্তু বোকা হয়োনা। বিনম্র হয়ো কিন্তু নতজানু হয়োনা। মিতব্যয়ী হয়ো কিন্তু কৃপণ হয়োনা। দান করো কিন্তু অপচয় করোনা। প্রয়োজনে খাবার রাস্তার কুকুরকে দিয়ো। সেও একটা প্রাণ। কিন্তু নষ্ট করে পঁচিয়ে ফেলোনা। আর, মনে রেখো- অযথা ব্যয় না করা মানেই সন্চয়।

আমার বুকের ভিতর কান্না ধলা পাকতে শুরু করে । চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাপের মাথায় মালের বোঝা, আব্বার হাঁপানি, ঘামে ভেজা শার্ট। আমি আব্বাকে বলি, দুঃখিত বাবা আমি অনেক অবিচার করেছি তোমার প্রতি। আজ থেকে শপথ নিলাম- জীবনে আর একটা টাকাও অযথা খরচ করবোনা। ঐ একদিনের শিক্ষাই আমাকে আজ এতোদূর পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। আর সেই এক রাতের হিসাব নিকাশ আমার সারাটি জীবনের হিসাব নিকাশটাই বদলে দিয়েছে।

অন্ধকার রাতে আমার বুকের ভিতরটা আলোকিত করে উনার গল্প শেষ হয়। কি বলবো বুঝতে পারছিনা। শুধু বুঝতে পারি , আজকের রাত আমার বুকে নক্ষত্রের এক অনুপম নদী হয়ে রইলো।

বললাম, চাচা- আপনি অনুমতি দিলে আপনার এই জীবন কাহিনীটি আমি লিখতে চাই।
উনি বললেন- হ্যাঁ লিখো। পড়ে যদি একজন মানুষেরও জীবন বদলে যায়। তবে, আমার নামটা প্রকাশ করার কোনো দরকার নেই।


উনাদের বাড়ির ম্যানেজার আমার সাথে আসেন। রাতের নীরবতা ভেঙ্গে উনি বলেন- আপনি কি জানেন-আমার পুরো বাড়িটাই উনার তৈরি করে দেয়া। শুধু তাই না, নিজের ছেলের-মেয়ের প্রত্যেকের বিয়ের খরচ বাঁচিয়ে এখানকার বেশ কয়েকজন মানুষের ঘরও উনি তৈরি করে দিয়েছেন। বিয়ের এক রাতের আনন্দের জন্য ব্যয় না করে একজন গৃহহীন মানুষের সারা জীবনের আনন্দ উনি তৈরি করে দিয়েছেন ।

নিজের অজান্তেই বলে ওঠি সুবহানাল্লাহ! একটা কলা হাতে ধরিয়ে দিয়ে যেখানে বিশজন মানুষ একসাথে ছবি তোলে। সেখানে গৃহহীনদের জন্য পুরো ঘর বানিয়ে দিয়েও উনি তা প্রকাশ করেন না। এরকম মানুষও পৃথিবীতে আছে। এই মানুষরাই কি তবে এই হিংসা, ঘৃণা, জুলুম, নির্যাতনের পৃথিবীতে রাব্বুল আলামীনের আসল প্রতিনিধি। বললাম, এসব কথাতো ভাই আগে কখনো শুনি নাই।

উনি বললেন - জ্বি কেউ শুনে নাই।

জানেন না, যে নদী যত গভীর হয় তার বয়ে চলার শব্দ কম থাকে।
যে বৃক্ষ যত বড় হয় তার শিকড়ও মাটির তত গভীরে লুকিয়ে থাকে।

সকল বাবা যারা বেঁচে আছেন তাদের সুস্বাস্থ্য কামনা করছি - আর যারা কবর বাসী হয়েছেন- তাদেরকে রাব্বুল আলামিন জান্নাতবাসী করুন এই প্রার্থণা করছি।
অন্ধকারের গভীরে প্রোথিত শিকড় হয়ে প্রতিটি সংসারকে শক্তভাবে ধরে রাখা পৃথিবীর সব সৎ বাবাদের বাবা দিবসের শুভেচ্ছা।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৮ ই নভেম্বর, ২০২০ রাত ৯:৫২

মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন: চমৎকার লিখেছেন ভাইয়া। দারুণ ভালো লাগলো। শুভেচ্ছা নিরন্তর।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.