নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নুজ্জাত জেরিন

যাহরা আফরিন

নুজাত জেরইন

যাহরা আফরিন › বিস্তারিত পোস্টঃ

নারীরা যেদিন অন্য নারীকে সম্মান করতে শিখবে সেদিনই আসবে পরিবর্তন

০৬ ই এপ্রিল, ২০১৭ রাত ৯:০১

আমাদের পরিবারটা একটু ভিন্ন। ভিন্ন মানে খুব ছোটবেলায় বাবা প্যারালাইজড হয়ে যান এবং চাকরী থেকে অব্যাহতি নেন এবং সমসাময়িক সময়েই বড় ভাইও বিদেশে চলে যান। ফলশ্রুতিতে পরিবারের কর্তা হয়ে ওঠেন আমাদের ‘মা’। মা যা বলতেন তাই ছিল আইন। আর অন্যান্য পরিবারে খেয়াল করে দেখতাম স্ত্রী-মা-বোন মিলে কিভাবে তাদের স্বামী-ছেলে সন্তান এবং ভাইদেরকে পরমেশ্বর বানিয়ে রীতিমত পূজো আর্চনা করত! ঘরের ছেলেগুলো যেন একেকজন সম্রাট শাহজাহান! দেরী করে ঘুম থেকে ওঠা, উঠলেই মা/বোন/বউ/ভাবী নাস্তা দিবে, ছেলেগুলো বাথরুমে তাদের ময়লা মোজা আর অন্তর্বাসটাও রেখে যাবে, সেগুলোও ধোঁবে ঘরের মেয়েরাই! আমার ভাই আর স্বামী ছাড়া আমি এদেশের আর কোন পুরুষকে দেখিনি যারা খাবার পর নিজের প্লেটটা রান্না ঘরে নিয়ে নিজেই ধুচ্ছে (হয়ত অনেক পরিবারেই নিজের কাজ নিজেই করার মত পুরুষ আছেন, তবে আফসোস! আমি দেখিনি!) একটু বড় হতে হতে একটা কমন ডায়ালগ চারপাশ থেকে শুনেছি “পুরুষকে পুরুষের মতই হতে হয়, আর মেয়েদেরকে হতে মেয়েদের মত!”
আমি যখন ঘরের বাইরে পা রাখতাম তখন আমার কাছে পৃথিবীটা অন্যরকম মনে হত! বাড়িতে মাকেই দেখতাম সর্বেসর্বা আর বাইরে অন্য মা’দের দেখতাম কি অসহায়, কি অত্যাচারিত!! অনেক কাছের মানুষকে বলতে শুনতাম “যতই ভাল পড়াশোনা কর, চাকরিবাকরি কর শেষে ঐ তো শ্বশুর বাড়ি যেতেই হবে, স্বামী সংসারই মেয়েদের আসল ঠিকানা!”
আমি মধ্যবিত্ত ঘরের সাধারণ মেয়ে। অতি সাদামাটা! আশেপাশের মানুষদের কথাতে প্রায়ই মনে হত ছেলেরা বুঝি মেয়েদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ! কিন্ডারগার্টেনে যখন পড়তাম, দেখলাম পরীক্ষায় সব ছেলেদের পেছনে রেখে আমি সবচেয়ে ভাল ফলাফল করেছি! সেদিন থেকে বুঝতে শিখেছি জীবনের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় শুধু যোগ্যতার বিচার হয়। ছেলেরা যোগ্য না হলে মেয়েরাও শ্রেষ্ঠ হতে পারে! তবে সামাজিক পরিস্থিতি বদলাতে দেখিনি। সবার মুখে ঐ এক কথা “পুরুষ সিংহ” আর “মেয়েরা কোমল লতা”!! মনে মনে প্রায়ই নিজেকে কয়েকটা প্রশ্ন করতাম-
১) “আচ্ছা, ছেলেদের আর মেয়েদের শারীরিক গঠন ছাড়া আর কি কোন পার্থক্য আছে?” উত্তর একটাই পেতাম, “না নেই”।
২) “মেয়েরা কি অর্থনৈতিক ভাবে সংসারের দায়িত্ব নিতে পারেনা?” আমি যেই এলাকায় থেকেছি সে এলাকায় বেশির ভাগ মেয়েরাই গার্মেন্টসে বা বাসা বাড়িতে বুয়ার কাজ করত, এখনো করে। তো সেখানে দেখতাম পুরুষরা ব্যবসা করে, জুয়া খেলে, মদ খায়, মারামারি করে আর মেয়েরা সংসার চালায়! সেই অনুযায়ী আমার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর ছিল, “মেয়েরাও অর্থনৈতিক ভাবে সংসার চালাতে পারে”।
৩) শুধু কি অবশেষে মেয়েদের বিয়েই হয়? ছেলেদের হয়না? মেয়েদের কেন স্বামীর বাড়িই আসল ঠিকানা? উত্তর টা নিজেকে নিজেই দিয়েছি “বিয়ে ছেলেদেরও হয়, তবে মেয়েদের আসল কোন ঠিকানা নেই। কারণ মেয়েদের দায়িত্ব আরো বড়। মেয়েরাই এই পৃথিবীতে ইভালিউশনের কাজটি করে। তাই তাদের কখনো বাপের বাড়িতে, কখনো স্বামীর বাড়িতে আবার কখনো ছেলের বাড়িতে থাকতে হয়, তবে তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলে এবং চায়লে নিজের বাড়িতেও থাকতে পারে”।
৪) তাহলে সব কিছুতে শ্রেষ্ঠ হওয়া স্বত্ত্বেও কেন মেয়েরা পুরুষদের সবসময় তোয়াজ করে চলে? সেই প্রশ্নের উত্তরটি অবশ্য সঠিকভাবে খুঁজে পাইনি তখন।
মাঝে মাঝে মনে হতে মেয়েরা মমতাময়ী, তাই বুঝি সবাইকে মমতা দিয়ে আগলে রাখতে চায়!
তাহলে সেই মমতা তখন কোথায় যায় যখন সে একজন মেয়ের মা, ছেলের শ্বাশুড়ি, ননদ, ননাশ, ভাবী কিংবা কোন মেয়ের বান্ধবী অথবা সহকর্মী?? তারমানে নারীদের সব মমতা, ভালোবাসা, প্রেম, বন্ধুত্ব সব পুরুষদের জন্য??
আমাদের সমাজের প্রেক্ষিতে বিষয়টা আসলেই ঠিক তাই! আমার পরিবারটা ব্যতিক্রম হলেও ছোটবেলায় আমার মা-দাদীর দ্বন্দ এবং পরবর্তীতে আমার মা আর ভাবীর মাঝে মনোমালিন্যও হতে দেখেছি। প্রশ্ন হচ্ছে মনোমালিন্য কার সাথেই বা না হয় এ পৃথিবীতে? তবে নারীদের মধ্যে পুরুষদের নিয়ে অন্তর্দ্বন্দটা বোধহয় চিরন্তন!
সেসবের মধ্যে সবচেয়ে বড় লড়াইটা হয় পরিবারের ছেলেকে নিয়ে মা এবং বউয়ের, আর ভাইকে নিয়ে বোন এবং ভাবীর।
আর এসব লড়াইয়ে সবচেয়ে উপভোগ করেন যারা তারাই হলেন আমাদের পরমেশ্বর পুরুষ জাতি! ভাবা যায়?? আপনাকে ভালোবাসার জন্য আপনার মা, বোন, বউ প্রাণ দিতেও রাজি!!
এমনিতে তারা এসব লড়াইয়ে বিপর্যস্ত দেখালেও মনে মনে কিন্তু বেজায় খুশি! মা যদি বলেন “শোন এই বউ ভালো না, এরে ছেড়ে আরেকটা বিয়ে কর নাহলে এরে শুধরা”।
ছেলের মনেতো লাড্ডু! বউকে শাশায় “শুধরে যাও নয়তো তালাক অথবা আরেকটা বিয়ে করব”
বটে! একই মানুষের সাথে আর কতদিন ভাল লাগে বলুন?
ঐদিকে স্ত্রৈণ পুরুষ আছেন। সেদিকে আবার বৌ যদি বলে মা অমুক তমুক করেছে তাহলে সংসারে শান্তির জন্যই তারা বউয়ের পক্ষেই কথা বলেন, তাছাড়া মা তো আজ আছে কাল নেই, চলতেতো হবে বউকে নিয়েই!! আর যেহেতু ঘরে বউকে প্রায়োরিটি দিচ্ছে সেহেতু বাইরে পরকীয়াটা সে বেশ আরামেই চালিয়ে যেতে পারছে! সন্দেহের তো কোন অবকাশ নেই। সবাই যে জানেই ব্যক্তিটি স্ত্রৈণ!!
সুতরাং দেখা যাচ্ছে পুরুষগন যতই মা ভক্ত অত্যাচারী স্বামী কিংবা স্ত্রৈণ হোক না কেন নিজেদের সূযোগ সুবিধা তারা কড়ায় গন্ডায় বুঝেই নিচ্ছে!
এর বাইরেও যে পুরুষ নেই তা নয়। আর সে সব পুরুষগন উভয়পক্ষের সমঝোতার জন্য আজীবন চেষ্টা চালইয়েই যান কারণ জানেন তো নারীগুলো তাকে ভালোবাসার নিমিত্তেই লড়াইটা করছে!
তবে সবচেয়ে কষ্ট হয় যখন দেখি এই আমরা, মানে মেয়েরাই পুরুষের দৃষ্টিতে একটু উপরে ওঠার জন্য কেমন উঠে পড়ে লেগে আরেকজনকে হেনস্তা করি! কিভাবে নিজের প্রতি বা নিজের মায়ের প্রতি হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ হিসেবে ছেলের বউ বা মাকে বেছে নিই। আর দিনের পর দিন নিজের অতৃপ্ত আত্নার শান্তির জন্য অপরজনকে হেয় করি!
হায়! এমন যদি হত মা বউ ভাবী ননদ সবাই একজন আরেকজনের প্রশংসা করছে সবার সামনে? বাড়ির পুরুষগুলো আর কোন অন্যায় করতেই পারছেনা! অন্যায় করলে কেও ছাড় দেয়না! মা বোন বউ সবাই এসে ধরে। বাড়িটা তখন আর স্বামীর বাড়ি বা ছেলের বাড়ি নয়; বাড়িটা তখন নিজের। আর সন্তানরাও দেখে বড় হচ্ছে যে যোগ্যতাই আসল। নারী পুরুষ শুধু শারীরিকভাবেই ভিন্ন, এছাড়া সবাই এক। আর একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবো যে এমনটা হলে সমাজে ক্রাইম নামক জিনিসটা কতখানি কমে আসবে!
এই কাল্পনিক চিন্তাটা কি খুব বেশি অসম্ভব? নারীরা কি চাইলে পারিনা নিজেদের ভেতর বন্ধনটা একটুখানি দৃঢ় করতে? আপনার শ্বশুরি আপনাকে অত্যাচার করেছে তাই আপনিও আপনার বউকে তাই করবেন এবং সেও তার ছেলের বউ কে তাই করবে? আপনি দেখেছেন আপনার মা কিভাবে আপনার বাবার কাছে নির্যাতিত হয়েছে তাই বলে আপনিও আপনার শ্বাশুড়ি কে মানষিকভাবে নির্যাতন করবেন? এবং আপনার মেয়েও তাই করবে? কে ভাঙ্গবে এই চক্র? আপনি? নাকি এই চক্র চলতেই থাকবে? এই পৃথিবী আর এই সমাজের পরিবর্তন কে আনবে যদি আমরা মেয়েরাই তা না চাই? ভুলে গেলে চলবে না যে আমরা মেয়েরাই এই সমাজ ব্যবস্থার মূল চাবিকাঠি। ইতিহাস স্বাক্ষী আমরা একতাবদ্ধ হলে পারিনা এমন কাজ নেই, তবে কেন নিজ বাড়িতেই আমরা একতাবদ্ধ হতে পারিনা?
আমি অবশ্য আশাবাদী। পরিবর্তন অনেকাংশে এসেছে এবং আরো আসবে। আর যেখানে পরিবর্তন সম্ভব নয় সেখানে বলব এই চক্রটাকে আর প্রলম্বিত না করে সেই সংসারকেই ত্যাগ করুন। কি লাভ অমন চতুর নরপশুর সঙ্গে সংসার করে যে আপনার নারীত্বের মূল্যায়নই করতে পারেনা? তার চেয়ে নিজের যোগ্যতায় দু বেলা দু মুঠো স্বাধীনভাবে খেয়ে পড়ে চলতে পারাটাও অনেক বেশি শান্তির, অনেক বেশি গর্বের।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.