নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সত্যই সুন্দর

আমি সত্য জানতে চাই

কোবিদ

আমি লেখালেখি করি

কোবিদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা ও বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুদিনে আমাদের গভীর শ্রদ্ধা

২৩ শে এপ্রিল, ২০১৩ সকাল ১০:৩৪



রবীন্দ্রনাথের পর বাংলার সাংস্কৃতিক জগতের কেউই বিশ্বের দরবারে এতোখানি সম্মান পাননি, যতখানি পেয়েছেন সত্যজিৎ রায়। চলচ্চিত্রপ্রেমী সত্যজিৎ এক সময় সামান্য যন্ত্রপাতি, সামান্য আয়োজন, সাধারণ অভিনেতা-অভিনেত্রী নিয়ে শুরু করলেন পথের পাঁচালী নির্মাণ। ১৯৫৬ সালের কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার পেল পথের পাঁচালী। এরপর সত্যজিৎ একে একে তৈরী করেন অপরাজিত, জলসাঘর, অপুর সংসার, তিন কন্যা , কাঞ্চনজঙ্গা, মহানগর, চারুলতা, গুপী গাইন বাঘা বাইন, জন অরন্য, অশনি সংকেত, গণশত্র“, আগন্তুক সহ আরও অনেক বিখ্যাত সব ছবি। সাহিত্যস্রষ্টা হিসেবেও তাঁর খ্যাতি কিছু কম নয়। প্রফেসর শঙ্কু, ফেলুদা, এক ডজন গপ্পো, আরো এক ডজন, ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদানের জন্য সত্যজিৎকে ৩০শে মার্চ ১৯৯২ সালে অস্কারে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার দেওয়া হয়। অস্কার পুরস্কার পাওয়ার মাত্র তেইশ দিন পর ১৯৯২ সালের ২৩শে এপ্রিল চলচ্চিত্র জগতের কিংবদন্তী সত্যজিৎ রায় পার্থিব জীবন থেকে চির বিদায় নেন। আজ তার মৃত্যুদিন, তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।



(ছয় বছর বয়সে সত্যজিৎ রায়)

অসামান্য প্রতিভার অধিকারী সত্যজিত রায়ের জন্ম ১৯২১ সালের ২ই মে। কলকাতা শহরে সাহিত্য ও শিল্পের জগতে খ্যাতনামা এক বাঙালি পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। সত্যজিৎ রায়ের বংশানুক্রম প্রায় দশ প্রজন্ম অতীত পর্যন্ত বের করা সম্ভব। তার আদি পৈত্রিক ভিটা বর্তমান বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার মসূয়া গ্রামে। এখানে তাদের পৈত্রিক বাড়িটি এখনও রয়েছে যেখানে সত্যজিতের পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এবং বাবা সুকুমার রায় দুজনেরই জন্ম হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের অনেক আগেই উপেন্দ্রকিশোর সপরিবারে কলকাতা চলে যান। বর্তমানে তাদের প্রায় ৪ একরের এই বিশাল জমি ও বাড়ি বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব বিভাগের অধীনে রয়েছে এবং তারা এই বাড়িকে কেন্দ্র করে একটি পর্যটন কেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা নিচ্ছেন। এছাড়া সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষ হরি কিশোর রায় চৌধুরী প্রায় ২০০ বছর আগে মসূয়া গ্রামে শ্রীশ্রী কালভৈরব পূজা উপলক্ষ্যে একটি মেলার আয়োজন করেছিলেন। এখনও প্রতি বছর বৈশাখ মাসের শেষ বুধবার এই মেলা পালিত হয়ে আসছে।



উপেন্দ্রকিশোরের সময়েই সত্যজিতের পরিবারের ইতিহাস এক নতুন দিকে মোড় নেয়। লেখক, চিত্রকর, দার্শনিক, প্রকাশক ও শখের জ্যোতির্বিদ উপেন্দ্রকিশোরের মূল পরিচিতি ১৯শ শতকের বাংলার এক ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলন ব্রাহ্ম সমাজের অন্যতম নেতা হিসেবে। উপেন্দ্রকিশোরের ছেলে সুকুমার রায় ছিলেন বাংলা সাহিত্যের ননসেন্স ও শিশু সাহিত্যের সেরা লেখকদের একজন। দক্ষ চিত্রকর ও সমালোচক হিসেবেও সুকুমারের খ্যাতি ছিল। ১৯২১ সালে কলকাতায় জন্ম নেন সুকুমারের একমাত্র সন্তান সত্যজিৎ রায়। সত্যজিতের মাত্র তিন বছর বয়সেই বাবা সুকুমারের মৃত্যু ঘটে; মা সুপ্রভা দেবী বহু কষ্টে তাঁকে বড় করেন। সত্যজিৎ বড় হয়ে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতি পড়তে যান, যদিও চারুকলার প্রতি সবসময়েই তাঁর দুর্বলতা ছিল। ১৯৪০ সালে সত্যজিতের মা তাঁকে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। কলকাতাপ্রেমী সত্যজিৎ শান্তিনিকেতনের শিক্ষার পরিবেশ সম্বন্ধে খুব উঁচু ধারণা পোষণ করতেন না, কিন্তু শেষে মায়ের প্ররোচনা ও রবিঠাকুরের প্রতি শ্রদ্ধার ফলে রাজি হন। শান্তিনিকেতনে গিয়ে সত্যজিৎ প্রাচ্যের শিল্পের মর্যাদা উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। পরে তিনি স্বীকার করেন যে সেখানকার বিখ্যাত চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু এবং বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে তিনি অনেক কিছু শিখেছিলেন। সত্যজিৎ বিনোদবিহারীর ওপর পরবর্তীতে একটি প্রামাণ্যচিত্রও বানান। অজন্তা, ইলোরা এবং এলিফ্যান্টায় ভ্রমণের পর ভারতীয় শিল্পের ওপর সত্যজিতের গভীর শ্রদ্ধা ও অনুরাগ জন্মায়।



তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ ও শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। নিয়মানুযায়ী বিশ্বভারতীতে সত্যজিতের পাঁচ বছর পড়াশোনা করার কথা থাকলেও তার আগেই ১৯৪৩ সালে তিনি শান্তিনিকেতন ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন এবং সেখানে ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন সংস্থা ডি জে কিমারে মাত্র ৮০ টাকা বেতনের বিনিময়ে “জুনিয়র ভিজুয়ালাইজার” হিসেবে যোগ দেন। চিত্রসজ্জা বা ভিজুয়াল ডিজাইন সত্যজিতের পছন্দের একটি বিষয় ছিল ও সংস্থাটিতে তিনি ভালো সমাদরেই ছিলেন, কিন্তু সংস্থাটির ইংরেজ ও ভারতীয় কর্মচারীদের মধ্যে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছিল (ইংরেজ কর্মচারীদেরকে অনেক বেশি বেতন দেয়া হত), আর সত্যজিতের মনে হত প্রতিষ্ঠানটির "ক্লায়েন্টরা ছিলেন মূলত বোকা।" ১৯৪৩ সালের দিকে সত্যজিৎ ডি কে গুপ্তের প্রকাশনা সংস্থা 'সিগনেট প্রেস'-এর সাথে জড়িয়ে পড়েন। ডি কে গুপ্ত তাঁকে সিগনেট প্রেস থেকে ছাপা বইগুলোর প্রচ্ছদ আঁকার অনুরোধ করেন ও এ ব্যাপারে তাঁকে সম্পূর্ণ শৈল্পিক স্বাধীনতা দেন। এখানে সত্যজিৎ প্রচুর বইয়ের প্রচ্ছদ ডিজাইন করেন, যার মধ্যে জিম করবেটের ম্যানইটার্স অব কুমায়ুন ও জওহরলাল নেহেরুর দ্য ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া উল্লেখযোগ্য। এছাড়া তিনি বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা কালজয়ী বাংলা উপন্যাস পথের পাঁচালীর একটি শিশুতোষ সংস্করণ আম আঁটির ভেঁপু-র ওপরেও কাজ করেন। বিভুতিভূষণের লেখা এ উপন্যাসটি সত্যজিৎকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে এবং এটিকেই পরবর্তীতে সত্যজিৎ তাঁর প্রথম চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু হিসেবে নির্বাচন করেন। বইটির প্রচ্ছদ আঁকা ছাড়াও তিনি এর ভেতরের বিভিন্ন ছবিগুলোও এঁকে দেন। এই ছবিগুলোই পরে দৃশ্য বা শট হিসেবে তাঁর সাড়া জাগানো চলচ্চিত্রে স্থান পায়।



(সত্যজিৎ রায়ের ছবি হীরক রাজার দেশে)

সত্যজিতের কর্মজীবন একজন বাণিজ্যিক চিত্রকর হিসেবে শুরু হলেও প্রথমে কলকাতায় ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাতা জঁ রনোয়ারের সাথে সাক্ষাৎ ও পরে লন্ডন শহরে সফররত অবস্থায় ইতালীয় নব্য বাস্তবতাবাদী ছবি লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে (ইতালীয় ভাষায় Ladri di biciclette, "বাইসাইকেল চোর") দেখার পর তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্বুদ্ধ হন। চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে সত্যজিৎ ছিলেন বহুমুখী এবং তাঁর কাজের পরিমাণ বিপুল। তিনি ৩৭টি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র পথের পাঁচালী ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে, যাদের মধ্যে অন্যতম ছিল কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাওয়া “শ্রেষ্ঠ মানব দলিল” (Best Human Documentary) পুরস্কারটি।



(পথের পাঁচালীর একটি দৃশ্য)

পথের পাঁচালি, অপরাজিত ও অপুর সংসার – এই তিনটি চলচ্চিত্রকে একত্রে অপু ত্রয়ী বলা হয়, এবং এই চলচ্চিত্র-ত্রয়ী তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ বা ম্যাগনাম ওপাস হিসেবে বহুল স্বীকৃত। চলচ্চিত্র মাধ্যমে সত্যজিৎ চিত্রনাট্য রচনা, চরিত্রায়ন, সঙ্গীত স্বরলিপি রচনা, চিত্র গ্রহণ, শিল্প নির্দেশনা, সম্পাদনা, শিল্পী-কুশলীদের নামের তালিকা ও প্রচারণাপত্র নকশা করাসহ নানা কাজ করেছেন। চলচ্চিত্র নির্মাণের বাইরে তিনি ছিলেন একাধারে কল্পকাহিনী লেখক, প্রকাশক, চিত্রকর, গ্রাফিক নকশাবিদ ও চলচ্চিত্র সমালোচক। বর্ণময় কর্মজীবনে তিনি বহু পুরস্কার পেয়েছেন। তবে এগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হল ১৯৯১ সালে পাওয়া একাডেমি সম্মানসূচক পুরস্কারটি (অস্কার), যা তিনি সমগ্র কর্মজীবনের স্বীকৃতি হিসেবে অর্জন করেন।



(সৌমিত্র, রবিশঙ্কর ও সত্যজিৎ রায়)

১৯৪৭ সালে সত্যজিৎ চিদানন্দ দাসগুপ্ত ও অন্যান্যদের সাথে মিলে কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। সোসাইটির সদস্য হবার সুবাদে তাঁর অনেক বিদেশী চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ হয়। এ সময় তিনি প্রচুর ছবি গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি কলকাতায় অবস্থানরত মার্কিন সেনাদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন; তিনি তাদের কাছ থেকে শহরে আসা নতুন মার্কিন চলচ্চিত্রগুলোর খবর নিতেন। এ সময় তিনি নরম্যান ক্লেয়ার নামের রয়েল এয়ার ফোর্সের এক কর্মচারীর সংস্পর্শে আসেন, যিনি সত্যজিতের মতোই চলচ্চিত্র, দাবা ও পাশ্চাত্যের ধ্রুপদী সঙ্গীত পছন্দ করতেন। ১৯৪৯ সালে সত্যজিৎ তাঁর দূরসম্পর্কের বোন ও বহুদিনের বান্ধবী বিজয়া দাসকে বিয়ে করেন। সত্যজিৎ দম্পতির ঘরে ছেলে সন্দীপ রায়ের জন্ম হয়, যিনি নিজেও বর্তমানে একজন প্রথিতযশা চলচ্চিত্র পরিচালক। ঐ একই বছরে জঁ রনোয়ার তাঁর দ্য রিভার চলচ্চিত্রটির শুটিং করতে কলকাতায় আসেন। সত্যজিৎ রনোয়ারকে গ্রামাঞ্চলে চিত্রস্থান খুঁজতে সহায়তা করেন। ঐ সময়েই সত্যজিৎ রনোয়ারের সাথে “পথের পাঁচালী”-র চলচ্চিত্রায়ণ নিয়ে কথা বলেন এবং রনোয়ার এ ব্যাপারে তাঁকে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দেন।



(অপুর সংসার চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য)

১৯৮৩ সালে ঘরে বাইরে ছবির কাজ করার সময় সত্যজিতের হার্ট অ্যাটাক ঘটে এবং এ ঘটনার ফলে জীবনের অবশিষ্ট নয় বছরে তাঁর কাজের পরিমাণ ছিল অত্যন্ত সীমিত। স্বাস্থ্যের অবনতির ফলে ছেলে সন্দ্বীপ রায়ের সহায়তায় সত্যজিৎ ১৯৮৪ সালে ঘরে বাইরে নির্মাণ সমাপ্ত করেন। এরপর থেকে তাঁর ছেলেই তাঁর হয়ে ক্যামেরার কাজ করতেন। অন্ধ জাতীয়তাবাদের ওপর লেখা রবীন্দ্রনাথের এই উপণ্যাসটি চলচ্চিত্রে রূপদানের ইচ্ছা সত্যজিতের অনেকদিন ধরেই ছিল এবং তিনি ৪০-এর দশকে ছবিটির একটি চিত্রনাট্যও লিখেছিলেন। যদিও ছবিটিতে সত্যজিতের অসুস্থতাজনিত ভুলের ছাপ দেখা যায়, তা সত্ত্বেও ছবিটি কিছু সমালোচকের প্রশংসা কুড়ায় এবং এই ছবিতেই সত্যজিৎ প্রথমবারের মত একটি চুম্বনদৃশ্য যোগ করেন। ১৯৮৭ সালে সত্যজিৎ তাঁর বাবা সুকুমার রায়ের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন।



শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে সত্যজিৎ তাঁর শেষ তিনটি ছবি অভ্যন্তরীণ মঞ্চে নির্মাণ করেন। এগুলি তাঁর আগের ছবিগুলির চেয়ে আলাদা ও অনেক বেশী সংলাপনির্ভর। ১৯৮৯ সালে নির্মিত গণশত্রু ছবিটিতে তাঁর পরিচালনা তুলনামূলকভাবে দুর্বল এবং এটিকে দীর্ঘদিনের অসুস্থতাশেষে ফিরে আসার পর সত্যজিতের চলচ্চিত্র নির্মাণের পুনর্প্রচেষ্টা হিসেবেই গণ্য করা হয়। ১৯৯০ সালে নির্মিত শাখা প্রশাখা সে তুলনায় উন্নততর ছবি হিসেবে গণ্য করা হয়। এ ছবিতে এক আজীবন সততার সাথে কাটানো বৃদ্ধ ব্যক্তি জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে তাঁর তিন ছেলের দুর্নীতির কথা জানতে পারেন; ছবির শেষ দৃশ্যে তিনি তাঁর মানসিকভাবে অসুস্থ কিন্তু দুর্নীতিমুক্ত চতুর্থ সন্তানের সান্নিধ্যে সান্ত্বনা খুঁজে পান। সত্যজিতের শেষ ছবি আগন্তুক ছিল হালকা আবহের। এ ছবিতে বহুদিনের হারিয়ে যাওয়া মামার পরিচয় দিয়ে একজন আগন্তুক এক পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাঁর এই সাক্ষাতের অভিজ্ঞতার (যেখানে পরিবারের ছোট ছেলেটি আগন্তুকটিকে আগ্রহভরে স্বাগত জানায়, কিন্তু পরিবারের বড়রা তাঁকে অনীহা ও সন্দেহের চোখে দেখেন) ভেতর দিয়ে সত্যজিৎ দর্শকের কাছে মানুষের পরিচয়, স্বভাব-প্রকৃতি ও সভ্যতা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জাল বোনেন।



সত্যজিৎ রায় তাঁর জীবদ্দশায় প্রচুর পুরস্কার পেয়েছেন। তিনিই দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব যাঁকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। প্রথম চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব হিসেবে অক্সফোর্ডের ডিলিট পেয়েছিলেন চার্লি চ্যাপলিন। ১৯৮৭ সালে ফ্রান্সের সরকার তাঁকে সেদেশের বিশেষ সম্মনসূচক পুরস্কার লেজিওঁ দনরে ভূষিত করে। ১৯৮৫ সালে পান ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার। ১৯৯২ সালে মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে একাডেমি অফ মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সাইন্সেস তাকে আজীবন সম্মাননাস্বরূপ একাডেমি সম্মানসূচক পুরস্কার প্রদান করে। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বেই ভারত সরকার তাঁকে প্রদান করেন দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা ভারতরত্ন। সেই বছরেই মৃত্যুর পরে তাঁকে মরণোত্তর আকিরা কুরোসাওয়া পুরস্কার প্রদান করা হয়। প্রয়াত পরিচালকের পক্ষে এই পুরস্কার গ্রহণ করেন শর্মিলা ঠাকুর।



ভারতে ও বিশ্বব্যাপী বাঙালি সম্প্রদায়ের কাছে সত্যজিৎ রায় একজন সাংস্কৃতিক প্রতিভূ। তাঁর মৃত্যুর পর কলকাতার জীবনযাত্রা থেমে পড়ে। হাজার হাজার লোক শেষ শ্রদ্ধা জানাতে তাঁর বাড়িতে আসেন। বাংলা চলচ্চিত্র জগতে সত্যজিৎ গভীর প্রভাব ফেলেন। সত্যজিতের চলচ্চিত্র কৌশল অপর্ণা সেন, ঋতুপর্ণ ঘোষ, গৌতম ঘোষ এবং বাংলাদেশের তারেক মাসুদ ও তানভীর মোকাম্মেল-কে অনুপ্রাণিত করেছে। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, মৃণাল সেন, ও আদুর গোপালকৃশনান-এর মত চলচ্চিত্র নির্মাতারা ভারতীয় চলচ্চিত্রে সত্যজিতের আসামান্য অবদান স্বীকার করেছেন।



ভারতের বাইরে মার্টিন স্কোরসেজি,জেমস আইভরি, আব্বাস কিয়ারোস্তামি ও এলিয়া কাজান-এর মত চিত্রনির্মাতারা তাঁর কাজ দেখে প্রভাবিত হয়েছেন বলে ধারণা করে হয়। ইরা সাক্‌স-এর ২০০৫ সালে নির্মিত Forty Shades of Blue ছিল চারুলতা-র একটি দুর্বলভাবে অনুসৃত পুনর্নির্মাণ, আর ১৯৯৫ সালের মাই ফ্যামিলি ছবিটির শেষ দৃশ্য অপুর সংসার-এর শেষ দৃশ্যকে অনুসরণ করে তৈরি। ইদানিংকার কিছু ছবি, যেমন স্যাক্রেড এভিল,দীপা মেহতার এলিমেন্ট্‌স ত্রয়ী, এমনকি জঁ-ল্যুক গদার-এর চলচ্চিত্রেও সত্যজিতের চলচ্চিত্রের প্রতি নির্দেশ খুঁজে পাওয়া যায়।



১৯৯২ সালে হৃদযন্ত্রের জটিলতা নিয়ে অসুস্থ সত্যজিৎ হাসপাতালে ভর্তি হন, এবং সে অবস্থা থেকে তাঁর স্বাস্থ্য আর ভালো হয়নি। মৃত্যুর কিছু সপ্তাহ আগে অত্যন্ত অসুস্থ ও শয্যাশায়ী অবস্থায় তিনি তাঁর জীবনের শেষ পুরস্কার একটি সম্মানসূচক অস্কার গ্রহণ করেন। ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল সত্যজিৎ মৃত্যুবরণ করেন। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুদিনে আমাদের গভীর শ্রদ্ধা

মন্তব্য ২১ টি রেটিং +৫/-০

মন্তব্য (২১) মন্তব্য লিখুন

১| ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৩ সকাল ১০:৩৯

বোকামন বলেছেন:
সত্যজিৎ রায় !!!

তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ....

২| ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৩ সকাল ১০:৫৫

লেখাজোকা শামীম বলেছেন: সত্যজিৎ রায়কে অশেষ শ্রদ্ধা। তার মতো পরিচালক শতাব্দীতে একজন জন্মে।

এই চমৎকার লেখাটির জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

৩| ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৩ সকাল ১০:৫৫

সাদা রং- বলেছেন: সত্যজিৎ রায়কে খুব ভালো লাগত তার অসাধারণ প্রতিভার জন্য। তার প্রফেসর শঙ্কু, ফেলুদা পড়ে এখনো আনন্দ পাই।

তার প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা

৪| ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৩ সকাল ১০:৫৬

আমিনুল ইসলাম মামুন বলেছেন: তথ্যবহুল চমৎকার এক্টি পোষ্ট।

৫| ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৩ সকাল ১০:৫৭

তৌহিদ নয়ন বলেছেন: আমার প্রিয়তম ব্যক্তিত্ব. ..

৬| ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৩ দুপুর ১২:৪৩

পারভেজ মোল্লাহ বলেছেন: আমি অনেক ঝামেলায় পরছি । প্লিজ হেল্প করুণ। আমার ব্লগে জান।

৭| ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৩ দুপুর ১:২৫

ঢাকাবাসী বলেছেন: চমৎকার একটা পোষ্টের জন্য ধন্যবাদ।

৮| ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৩ দুপুর ২:০৪

তৌহিদুল ইসলাম রাসেল বলেছেন: আমার প্রিয় লেখক ও বাক্তিত্ত। তার প্রতি শ্রদ্ধা।

৯| ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৩ দুপুর ২:১৪

সায়েম মুন বলেছেন: ওনার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা রইলো।

১০| ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৩ বিকাল ৩:৪৭

প্রকৃতির প্রতিফলন বলেছেন: "নবী ও মুমিনের উচিত নয় মুশরেকদের মাগফেরাত কামনা করে, যদিও তারা আত্নীয় হোক একথা সুস্পষ্ট হওয়ার পর যে তারা জাহান্নামী। (সুরা আত তওবাঃ ১১৩)

২৪ শে এপ্রিল, ২০১৩ সকাল ৯:০৯

কোবিদ বলেছেন: ধন্যবাদ প্রকৃতির প্রতিফলন সুরা আত তওবার ১১৩ নম্বর আয়াতের বঙ্গানুবাদের জন্য।
তবে আমরা কী এ কথা সুস্পষ্ট ভাবে জানি যে তিনি জামান্নামী?

মহান আল্লাহপাক কাকে কখন কোন উসিলায় মুক্তিদান করবেন এবং পাপীদের মুক্তির ফয়সালা করবেন তা আমাদের অজ্ঞাত। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরাক্রমশীল।

১১| ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৩ রাত ৯:২৫

ডানামনি বলেছেন: অসাধারণ পোস্ট। পোস্টে ++++++।
বেশ কিছু নতুন তথ্য জানলাম। সত্যজিৎ রায় আমার প্রিয় বাক্তিত্ত্ব । আপনার পোস্ট টা ফেবু তে শেয়ার দিলাম অনুমতি ছাড়াই ।

২৪ শে এপ্রিল, ২০১৩ সকাল ৯:১১

কোবিদ বলেছেন:
অনুগ্রহ করে লিংকটা দিলে খুশি হতাম

১২| ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১১:০৮

েরজা বাবু বলেছেন: আমি যানি না কি বলব তবুও বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। শুধু যানি সত্যজিৎ বায় আমার কাছে খারাপ না। আর যে লেখাটা পোষ্ট করেছে সে ও কম ধন্যবাদ পাওয়ার নয়।

২৪ শে এপ্রিল, ২০১৩ সকাল ৯:১৩

কোবিদ বলেছেন: রেজা বাবু অনেক অনেক ধন্যবাদ
আপনার সুন্দর মন্তব্য প্রদানের জন্য।
কিংবদন্তি পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের
মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য
আপনাকে আবারো ধন্যবাদ

১৩| ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১১:১৬

গগণজয় বলেছেন: অসাধারন কাজ তার।
ভাল পস্ট।

১৪| ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৩ বিকাল ৪:৪৩

প্রকৃতির প্রতিফলন বলেছেন: সত্যজিৎ রায় কি মৃত্যুর আগে ঈমান এনেছিল?
নাকি তিনি অমুসলিম অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন?
-অমুসলিম অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তাহলে এটা তো সুস্পস্ট-ই হয়ে গেল যে তিনি মূর্তি পূজারী ছিলেন। অর্থাৎ মুশরিক ছিলেন। তাই আমারা এখন আল্লাহ্‌র এই আদেশ অমান্য করতে পারি না।
"নবী ও মুমিনের উচিত নয় মুশরেকদের মাগফেরাত কামনা করে, যদিও তারা আত্নীয় হোক একথা সুস্পষ্ট হওয়ার পর যে তারা জাহান্নামী। (সুরা আত তওবাঃ ১১৩)

২৭ শে এপ্রিল, ২০১৩ সকাল ৮:৫৮

কোবিদ বলেছেন: আমি জানিনা তিনি ঈমান এনেছিলেন কী না!
আপনি হয়তো জেনেছিলেন তাই সুস্পষ্ট করে বলতে পেরেছেন!!
তবে তাঁর বিচার বড় সুক্ষ সুতরাং শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত তাঁর করুণা
প্রার্থনা করা উচিত।

১৫| ২৫ শে এপ্রিল, ২০১৩ রাত ৯:২৫

ডানামনি বলেছেন: অনেক দেরিতে উত্তর দেবার জন্য দুঃখিত, কিন্তু পোস্টে কমেন্ট করে পরে আমিই ফেবু তে শেয়ার দিতে ভুলে গেছিলাম। :প
তাই দেরি হল ।

https://www.facebook.com/anjumanara.dana

২৭ শে এপ্রিল, ২০১৩ সকাল ৮:৫৫

কোবিদ বলেছেন: ধন্যবাদ
ভালো থাকবেন

১৬| ২৭ শে এপ্রিল, ২০১৩ দুপুর ১:০৩

প্রকৃতির প্রতিফলন বলেছেন: আল্লাহ্‌ তায়ালা বললেনঃ "নবী ও মুমিনের উচিত নয় মুশরেকদের মাগফেরাত কামনা করে, যদিও তারা আত্নীয় হোক একথা সুস্পষ্ট হওয়ার পর যে তারা জাহান্নামী। (সুরা আত তওবাঃ ১১৩)

আর আপনি বলছেন- তার বিচার বড় সুক্ষ সুতরাং শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত তাঁর করুণা প্রার্থনা করা উচিত।

শুনুন, আল্লাহ্‌র কাছে- কোন মানুষের আসীম জ্ঞান, বড় ব্যক্তিত্ব ইত্যাদির কোন মূল্য নেই। কেননা তিনিই এসব তার গোলামদের দান করে থাকেন। তার কাছে একমাত্র গ্রহণযোগ্য বিষয় হচ্ছে - ঈমান এবং তাঁর আদেশ -নিষেধ।

যে ঈমান এবং তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলবে তিঁনি তাকে মূল্যায়ন করবেন। আর যে গোলাম তাঁর বেঁধে দেয়া নিয়ম নীতি পরিহার করবে তার জন্য আল্লাহ্‌ কাছে কোন বিনিময় নেই জাহান্নাম ব্যতীত।

"যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোন জীবন ব্যাবস্থা তালাশ করে, কস্মিণকালেও তার কাছ থেকে তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখেরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের একজন। (সুরা আলে ইমরানঃ ৮৫)

"এমন লোকের শাস্তি হলো আল্লাহ, ফেরেশতাগণ এবং মানুষ সকলেরই অভিসম্পাত। সর্বক্ষণই তারা তাতে থাকবে। তাদের আযাব হালকাও হবে না এবং তার এত অবকাশও পাবে না। (সুরা আলে ইমরানঃ ৮৭-৮৮)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.