![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
একজন দায়ী, কবি, দার্শনিক ও সমালোচক
আনসার বিদ্রোহ: ১৯৯৪ সাল।
হেলিকপ্টার, মর্টার, রকেট লঞ্চার ও মেশিনগান দিয়ে যেভাবে দমন করা হয়েছিল বিদ্রোহী আনসারদের; বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার, রেশন-বেতন বৃদ্ধিসহ বেশ কিছু দাবিতে ১৯৯৪ সালে আনসার বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। যা ওই বছরের ৩০শে নভেম্বর বিদ্রোহে রুপ নেয়। ওই দিন আনসার সদস্যরা ৪০ জন সেনা কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারকে জিম্মি করে এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাত করতে চান। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ওই বছরের ৪ঠা ডিসেম্বর সেনাবাহিনী, বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) ও পুলিশ বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণ করে। যৌথ অভিযানে ৪ জন বিদ্রোহী মারা যায় ও ১৫০ জন আহত হয়। ব্যর্থ হয় আনসারদের বিদ্রোহ। ঘটনার পরে শাস্তি হিসেবে দুই হাজার ৪৯৬ জন আনসার সদস্যকে গ্রেপ্তার ও চাকরিচ্যুত করা হয়।
তারিখ- ৩০ নভেম্বর – ৪ ডিসেম্বর ১৯৯৪ সাল। অবস্থান- বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী একাডেমি, সফিপুর। বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী সদরদপ্তর, খিঁলগাও। ফলাফল- আনসার সদস্যদের আত্মসমর্পণ ও বিদ্রোহ ব্যর্থ। হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি- ৪ নিহত, আহত ১৫০ জন। উল্লেখ্য যে, পরবর্তীতে ৯৪ সালে আনসার বিদ্রোহের ঘটনায় শাস্তি হিসেবে প্রায় ২৫০০ আনসার সদস্যকে গ্রেপ্তার ও চাকরিচ্যুত করা হয়। এদের মধ্যে অনেকে নিজেদের নির্দোষ দাবি করে পরবর্তীতে আদালতের শরণাপন্ন হন। আদালতের মাধ্যমে ২০১৮ সালে ওই বিদ্রোহের অভিযোগ থেকে খালাস পান এক হাজার ৪৪৭ জন। তবে তাদের মধ্যে যাদের বয়স ও শারীরিক সক্ষমতা রয়েছে, তাদেরকে চাকরিতে পুনর্বহালের নির্দেশ দেয় আদালত। আর যাদের চাকরির বয়স শেষ, তারা চাকরিতে যতদিন ছিলেন তাদেরকে ততদিনের পেনশন সুবিধা দেয়ার জন্যও সরকারকে নির্দেশনা দেয়া হয়। সূত্র : বিবিসি।
আনসার বিদ্রোহ: ২০২৪ সাল।
নজিরবিহীন ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর, ১২ আগস্ট চাকরি স্থায়ী করার একদফা দাবিতে ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাব ও সুপ্রিম কোর্টের সামনে বিক্ষোভ করেন সাধারণ আনসার সদস্যরা। ২৪ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী আন্দোলনরত আনসার সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি বিতর্কিত ছয় মাসের বিশ্রাম ব্যবস্থা বাতিলের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন এবং তাঁদের আশ্বস্ত করেন যে চাকরি জাতীয়করণের দাবি একটি আসন্ন কমিটি দ্বারা পর্যালোচনা করা হবে। তা সত্ত্বেও চাকরি জাতীয়করণের বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো নিশ্চয়তা না থাকায় আনসার সদস্যরা অসন্তুষ্ট ছিলেন।
এরপর ২৫ আগস্ট আনসার সদস্যদের একটি অংশ তাদের চাকরি জাতীয়করণ এবং অন্যান্য সুবিধার মধ্যে ছয় মাসের "বিশ্রাম ব্যবস্থা" বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে। এই বিক্ষোভের ফলে ঢাকা জুড়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়, যার ফলে উল্লেখযোগ্য জনভোগান্তির সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ আনসারের কিছু সদস্য চাকরির সংস্কারের জন্য বাংলাদেশ সচিবালয়ের সম্মুখে একটি বিদ্রোহ সংঘটিত করে। সেখানে সেনাবাহিনী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আনসার সদস্যদের সশস্ত্র সংঘর্ষ হয়, এতে বহু মানুষ আহত হয়।
তারিখ- ২৫ আগস্ট ২০২৪ সাল। অবস্থান- বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা, বাংলাদেশ। ফলাফল- বিদ্রোহ ব্যর্থ। হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি- ৪০ জন শিক্ষার্থী ও আনসার সদস্য আহত (হাসনাতসহ), ৬ জন সেনাসদস্য আহত (আইএসপিআর)। উল্লেখ্য যে, সংঘর্ষের সময় সচিবালয়ে থাকা ১০০ জনেরও বেশি আনসার সদস্যকে শাহবাগ থানায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং বেআইনি সমাবেশের অভিযোগে মোট ৩৭৭ জন আনসার সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তীকালে নয়জন উপপরিচালক এবং দশজন আনসার পরিচালককে তাঁদের পদ থেকে বদলি করা হয়। উপরন্তু ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ বাংলাদেশ সচিবালয় এবং প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন সংলগ্ন সমাবেশ, সভা বা বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করে।
ইতিহাসঃ
১৯৪৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি আনসার বাহিনী প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং তৎকালীন পূর্ববাংলা আইন পরিষদে আনসার এ্যাক্ট অনুমোদিত হলে ১৭ জুন ১৯৪৮ সালে তা কার্যকর হয়। তখন থেকে এ বাহিনীর প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সাময়িকভাবে ঢাকার শাহবাগে অনুষ্ঠিত হতো। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধকালে দেশের সীমান্ত ফাঁড়িগুলোতে আনসারদের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার এর শপথ গ্রহণ শেষে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে আনসার প্লাটুন কমান্ডার ইয়াদ আলীর নেতৃত্বে ১২ জন আনসার বাহিনীর সদস্য গার্ড অব অনার প্রদান করে। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে আনসার বাহিনীকে বিদ্রোহী আখ্যায়িত করে বিলুপ্ত করা হয়। প্রায় ৪০ হাজার রাইফেল নিয়ে আনসার সদস্যরা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেয়। যুদ্ধে আনসার বাহিনীর ৯ জন কর্মকর্তা, ৪ জন কর্মচারী ও ৬৫৭ জন আনসারসহ সর্বমোট ৬৭০ জন শহীদ হন। বাহিনীর ১ জন বীর বিক্রম এবং ২ জন বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হন। স্বাধীনতা উত্তরকালে ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ঢাকার অদূরে সাভারে আনসার বাহিনীর প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। ১৯৭৬ সালে গ্রাম প্রতিরক্ষা দল (ভিডিপি) ও ১৯৮০ সালে শহর প্রতিরক্ষা দলের (টিডিপি) সৃষ্টি হয়। পরবর্তী সময়ে এ দুটি বাহিনীই আনসার বাহিনীর সঙ্গে একীভূত হয়। ১৯৭৬ সালে গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার সফিপুরে জাতীয় আনসার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (এনএটিসি) প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৩ সালে এর নামকরণ হয় আনসার ট্রেনিং স্কুল। ১৯৮৬ সালে আনসার ট্রেনিং স্কুলকে আনসার একাডেমিতে উন্নীত করা হয়। ১৯৯৫ সালে এর নামকরণ হয় আনসার-ভিডিপি একাডেমি। বাহিনী বর্তমানে পরিচালিত হচ্ছে আনসার বাহিনী আইন-১৯৯৫ এবং ব্যাটালিয়ন আনসার আইন ১৯৯৫- দ্বারা, যা সংসদ কর্তৃক গৃহীত হলে ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫ সালে মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাভ করে এবং ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫ হতে কার্যকর হয়। এ দুটো আইন অনুসারে সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী আনসার বাহিনী একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী। বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী একটি বাংলাদেশী আধাসামরিক বাহিনী। বাহিনীটির কাজ দেশের অভ্যন্তরীন নিরাপত্তা, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও স্থাপনার নিরাপত্তা, মোবাইলকোর্ট পরিচালনা করা, দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার ও অন্যান্য বাহিনীকে সহায়তা প্রদান করাসহ বাহিনীর প্রধান দায়িত্ব হইবে-
(ক) জননিরাপত্তামূলক কাজে সরকার বা সরকারের অধীন কোন কর্তৃপক্ষকে সহায়তা প্রদান এবং অন্য কোন নিরাপত্তামূলক কাজে অংশগ্রহণ করা;
(খ) দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক নির্দেশিত কোন জনকল্যাণমূলক কাজে অংশ গ্রহণ করা৷ বিশেষ করে এবং উপরোক্ত বিধানের সামগ্রীকতাকে ক্ষুণ্ন না করে বাহিনী, সরকারের নির্দেশে, নিম্নে বর্ণিত বাহিনীসমূহকে সহায়তা ও সাহায্য প্রদান করবে, যথা:-
(ক) স্থল বাহিনী;
(খ) নৌ-বাহিনী;
(গ) বিমান বাহিনী;
(ঘ) বাংলাদেশ রাইফেলস্;
(ঙ) পুলিশ বাহিনী;
(চ) ব্যাটালিয়ান আনসার
অঙ্গীভূত আনসার: ৯৫ হাজার, ভিডিপি: ৫৮ লক্ষ ৮৭ হাজার, ব্যাটালিয়ন আনসার: ১৮ হাজার সহ মোট প্রায় ৬১ লক্ষ (আওয়ামী লীগের আমলে আনসার সদস্য নিয়োগ ৪২ হাজার তৎমধ্যে গোপালগঞ্জের ২৯ হাজার)।
উপরোল্লেখিত মতে দেশের চলমান দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ আনসার বাহিনীর উপর অর্পিত দায়-দায়িত্ব এবং এই সময়ের আনসার বিদ্রোহঃ
চুক্তিভিত্তিক এই আনসার ব্যাটালিয়ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সমূহে এবং ব্যক্তি বিশেষে নিরাপত্তা রক্ষী হিসেবে কর্মকান্ড উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। তদুপরি বিমান বন্দর, পাসপোর্ট অফিসসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জনসেবামূলক দপ্তরের আনসারের ঘুষ বাণিজ্য, দুনীর্তিতে সহযোগীতাসহ বিবিধ জনস্বার্থ পরিপন্থি কাজের সাক্ষী হিসেবে আনসার সদস্যরা জড়িত ছিলো। সবকিছুর বিপরীতে গরীব আনসার সদস্যদের জীবনমান উন্নয়নের দাবী বিবেচনার দাবী রাখে। কিন্তু তারা দু’টি ভুল সময়ে সহিংস হয়েছেন। এক. দেশে প্রলয়ঙ্কারী বন্যা চলছে। সেটা নিয়ে সারাদেশ দুশ্চিন্তায়। দুই. সরকার একটা অগোছালো অবস্থায় আছে। নানান কর্ণার থেকে ফ্যাসিস্টরা সাবোটাজ করার অপচেষ্টা করছে। দাবী যা’ই থাকুক দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় অন্যান্য বাহীনি কিংবা সাধারণ মানুষের সাথে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়িয়ে সর্বাত্মক সহযোগীতা প্রদান করে দেশ ও জাতির কল্যাণে তাঁদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারতো। কিন্তু তাঁরা তা করেনি। তাই, তাদের দাবীর যৌক্তিকতা থাকলেও, তা “ষড়যন্ত্র” হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাচ্ছে বিধায় বিচারের দাবী রাখে। বিগত ছাত্র আন্দোলনে কিছু অতি উৎসাহী আনসার কিন্তু কেবল নিপীড়নেই যুক্ত নয়, কেউ কেউ খুনি, গুলি করেছে ছাত্রজনতার ওপর; আর যার নেতৃত্বে ছিলেন এনামুল হক শামীমের ভাই। এমনকি, ২৫ আগস্ট গুলি বর্ষণ করেছে। ছাত্রদের মারধরও করেছে। এটা ধৃষ্টতা। তাদের নিয়োগে ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মী প্রাধান্য পেয়েছে। তারাই এই সহিংস আচরণ করেছে কিনা খতিয়ে দেখার বিষয়। আরও দেখার বিষয়, ২০০৯ সালে ক্ষুব্ধ বিডিআর সদস্যদের ঘাড়ে চড়ে আ’লীগ-ইন্ডিয়া যেমন ৫৭ আর্মি অফিসারকে খুন/শহীদ করেছে, তেমনি আনসারদের দাবীর উপর চেপে সরকার পতন/বিব্রত করার অপচেষ্টা/ষড়যন্ত্র করেছে কিনা- সেটা অনুসন্ধান করা যেতে পারে।
তদুপরি, আনসার সদস্যদের নিয়োগ সংক্রান্ত তথ্যাদি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিবেচনাপূর্বক (শিক্ষাগত যোগ্যতা, বয়স, নিয়োগ দুর্নীতির বিচারে) দোষীদের খোঁজে বের করে যোগ্য, নিরপেক্ষ সৎ আনসার নিয়োগ এখন সময়ের দাবী।
©somewhere in net ltd.