নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার একটি গল্প ছিল লিখবো বলে ফেলে রেখেছি...

গল্পক

নির্ঘুম জেগে থাকার নাম হতে পারে স্বপ্ন অথবা শুধুই একটি রাত..।

গল্পক › বিস্তারিত পোস্টঃ

বেহুদা জীবনের গল্পগুচ্ছ । (৫টা গল্প)

১৬ ই জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১:৫৭

টুকরো টুকরো ছবিগুলো ।

শীত সকালের উত্তাপহীন রোদ এখনো কুয়াশাগুলোকে গিলে ফেলে নি। ছোট্ট মেয়েটি সবুজ পাতায় জমে থাকা ফোঁটা ফোঁটা কুয়াশাগুলোকে ছোট একটি কৌটায় পুরছে। মেয়েটার নাম ফিঙে। তার বাবা সারারাত কাশতে কাশতে এমনি একটি শীতের ভোরে মারা যায়। তখন ফিঙের বয়স ছিল পাঁচ। এখন আট। ফিঙে তার মাকে কখনো দেখে নি। বাবাকে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলে বাবা খুব রেগে যেত। তাই ফিঙে ভয়ে আর কখনো জিজ্ঞেস করে নি। সেই শীতের সকালে সাদা কাপড়ে সাজানো বাবার নিথর দেহটিকে উঠোনে রাখা হয়েছিল। বাবার মুখটা তখনো খোলা ছিল। মানুষজন বাবাকে দেখতে আসছিলো।

ফিঙে অপলক তাকিয়েছিল চুষে যাওয়া রক্তহীন শুকনো কলাপাতার মত বাবার মুখটির দিকে। সে দেখলো কয়েক ফোঁটা কুয়াশা বাবার মুখের উপর এসে পড়লো। বাবার মুখের কাছে গিয়ে ফিঙে তার কোমল হাত দিয়ে কুয়াশা ফোঁটাগুলো মুছে দিল। বাবার মুখ থেকে চোখ ফেরাতে ফিঙে সামনে কিছুদূরে একটি গাছের আঁড়ালে ঘোমটা দেয়া একটা মহিলার মুখ দেখতে পায়। মুখটার দিকে ফিঙে তাকিয়ে থাকে। সে ভাবতে থাকে তার জোড়া লাগানো ছবিটার কথা। সে বাড়ির পেঁছনে জানালার পাশে পড়ে থাকা ছবির কিছু টুকরো টুকরো অংশ কুড়িয়ে পেয়েছিল। সেগুলো সে ঘরে এনে জোড়া লাগায়। এই খেলা সে শিখেছে বাবার মোবাইল থেকে। মোবাইলে এলোমেলো টুকরো দিয়ে ছবি মেলানোর একটা গেইম ছিল। ফিঙে বাবার মোবাইলে সারাক্ষণ সেই গেইমটি খেলতো। তাই সে এই টুকরোগুলোকে বসিয়ে বসিয়ে গেইমের মত মেলালো। তখন সে একটা মহিলার ছবি পায়। গাছের আঁড়ালে থাকা মহিলার মুখটিও সেই ছবির মুখের মত লাগছে ফিঙের কাছে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে মুখটি মিলিয়ে গেল ঘন কুয়াশার ভেতর।

বাবার মৃত মুখটিকে কুয়াশা স্পর্শ করেছিল তাই কুয়াশার প্রতি ফিঙের নিষ্পাপ মনে একধরণের ভালবাসা জন্ম নেয়। সে কুয়াশার মধ্যে তার বাবাকে অনুভব করে। তাই সে শীতের সকালগুলোতে গাছের পাতা থেকে কুয়াশা সংগ্রহ করে। আর সংগ্রহ করার সময় সেই গাছটার দিকে একটু পরপর তাকায় ঘুমটা দেয়া মুখটিকে আরেকবার দেখার জন্য, মেলানোর জন্য তার জোড়া লাগানো টুকরো হয়ে যাওয়া ছবিটার সাথে ।


...বোধ ।

গুটি গুটি বৃষ্টি পড়ছে, শীত বেড়েছে । কুয়াশার গাঢ়ত্বের জন্য দুই ছাউনির মাঝখানের ফাঁকা অংশ দিয়ে কালো মেঘের আকাশটাকে ভালো মত দেখা যাচ্ছে না । সিয়াম রেল স্টেশনে অপেক্ষা করছে, কেউ একজন আসবে । সে মোবাইল হাতে নিয়ে বসে আছে মোটা পিলারের চারপাশ ঘিরে গোল করে বসানো সিমেন্টের বেঞ্চিতে । রাত এখন ১ টা ১০, স্টেশন প্রায় খালি হয়ে গেছে, এদিক ওদিক কয়েকজন গার্ডের হাঁটাহাঁটি আর কুকুরের বসে বসে মাছি তাড়ানো ছাড়া তেমন শোরগোল নেই । সিয়াম যে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে সেটা আসার কথা ছিলো ১১টায় কিন্তু এখনো এসে পৌঁছাই নি । রেল মাস্টারের ওখানে খবর নিয়ে সিয়াম জানতে পারে ট্রেনটা আসতে লেট হবে, কোথায় নাকি লাইন খুলে গেছে, তা মেরামতের কাজ চলছে, তাই তারাও সঠিক কোন টাইম বলতে পারছে না । দুই ঘন্টা পার হয়ে গেছে সিয়াম বসে আছে, মুখে খুব টেনশানের ছাপ । সে বার বার মোবাইলের দিকে তাকাচ্ছে একটি কলের জন্য, যার আসার কথা তার ফোন অনেকক্ষণ ধরে অফ পাচ্ছে ।

মোবাইলটা পাশে রেখে সিয়াম হাত দু'টো মুখের কাছে ধরে ঘষছে আর ফু দিচ্ছে, হাত দু'টো বরফের মত ঠান্ডা হয়ে গেছে । সে দেখছে একজন চা সিগারেট বিক্রেতা তার বাক্সপেট্রা নিয়ে এদিকে আসছে । এরা রাতের বিক্রেতা, রাত গভীর হলেই বের হয়, কাস্টমার খুঁজে খুঁজে চা সিগারেট বিক্রি করে । এদের বিক্রি দিনের চাওয়ালাদের থেকেও বেশি হয়, দিনে মানুষ থাকে অনেক কিন্তু কাস্টমার থাকে কম, প্রতি পঞ্চাশ জনে হয়তো এক দুইজন কাস্টমার মেলে । কিন্তু রাতের এই সময়টায় যা কয়জন স্টেশনে থাকে ধরা যায় সবাই কাস্টমার, কেউ সিগারেট নিচ্ছে নয়তো কেউ চা । আর কিছু নিয়মিত কাস্টমার থাকে যাদের জন্য শুকনো লতাপাতা, পাউডারও রাখে রাতের বিক্রেতারা, এতে রিক্স থাকে অনেক কিন্তু ইনকাম প্রচুর । সিয়ামের কাছে এসে লোকটা জিজ্ঞেস করলো চা সিগারেট কিছু লাগবে কিনা । সিয়াম চা দিতে বলে একটা সিগারেট ধরালো ।

চাওয়ালা বড় ফ্লাক্সটার উপরের সুইচ টিপ দিয়ে কাপে চা পুরছে । চায়ের ধোঁয়ার সাথে তেজপাতা, এলাচের চমৎকার ঘ্রাণ বের হচ্ছে । রেললাইনের অপরপাশের চাউনি থেকে হঠাৎ একটা কুকুর তাদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করছে, নাইটগার্ড জোরে জোরে বাঁশি বাজাচ্ছে, ট্রেনটাও প্রায় এসে গেছে, ইঞ্জিনে টান দিয়ে দিয়েছে, ধীরে ধীরে ট্রেনটা স্টেশনের দিকে এগুচ্ছে, ট্রেনের টান টান হর্ণ উত্তর দিক থেকে দক্ষিণে বহুদূর পর্যন্ত উড়ে চলে গেল । চাওয়ালা ধোঁয়া ওঠা কাপটা সিয়ামের দিকে বাড়িয়ে দিলো। সিয়াম চাওয়ালার হাত থেকে চা নিলো, তখন ট্রেনও পুরোপুরি এসে থেমেছে । চাওয়ালা সিয়ামের দিকে মলিন চোখে তাকিয়ে চিতি পড়া বত্রিশটা দাঁত বের করে একটা হাসি দিল । সিয়াম লক্ষ করলো তার চারপাশে প্রচুর শোরগোল হচ্ছে, মানুষে মানুষে ছাউনিগুলো সব ভরে গেছে, যুবক, বৃদ্ধা, শিশু, মহিলা, হকার, চাওয়ালা, বাদামওয়ালা, ভিক্ষুক ।

স্টেশন গেইটের সামনের রাস্তা দিয়ে রিকশা করে যেতে যেতে এক ব্যাক্তি আরেক ব্যাক্তিকে বলছে, ....প্রায় বিশ বছর হয়, এই রেল স্টেশনটা সরকার বন্ধ করে দিয়েছে ।


সেখানে বৃষ্টি এসেছিল ।

বৃদ্ধ লোকটা মরুভূমি ঘেসে তৈরী হওয়া রাস্তার পাশে বসে অপেক্ষা করছে কারো জন্য । আর সামনে এগুতে এক কদমেরও নিঃশ্বাস তার কাছে নেই । এই তৃষ্ণাত্ব শরীর নিয়ে এতোদূর এসেও কোন জনবসতি খোঁজ পাওয়া যায় নি, পাওয়ার কথাও ছিল না । পানি রাখার রাবারের পোঁটলাটা বার বার ঝাঁকাচ্ছে লোকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়া ঠোঁটের উপর , এক ফোটা পানি দিয়ে ঠোঁটটাকে ভেজাতে । কিন্তু পোঁটলা থেকে অবশিষ্ট কোন পানি পড়লো না । পোঁটলাটা ফেলে সে তার গায়ের ছেঁড়াফাটা জামাটাকে খুলে মুখের উপর দুর্বল দু'হাত দিয়ে চাপ দিচ্ছে জামায় জমা হওয়া শরীর নিসৃত ঘামটুকু বের করার জন্য। দু' তিন ফোঁটা ঘাম জিহ্বায় পড়লো, তা সে খুব তৃপ্তি নিয়ে বড় ঢোক গিলে পান করলো, আরো চাপ দিতে লাগলো কিন্তু আর কোন ফোঁটা বের হচ্ছে না । এবার সে মুখ দিয়ে জামাটাকে চুষছে আরো একটু বের করার জন্য, আর কোন পানিরূপ ঘাম না বের হলেও জামার রঙ বের হয়ে আসছে । সে জামাটা গায়ের উপর দিয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে বসে আছে । তাকিয়ে আছে কোন পাথচারীর আশায়, হয়তো তার কাছ থেকে কিছু পানি পাবে হৃদপিণ্ডটাকে সচল করার জন্য।

লোকটা লাঠির সাথে মাথা ভর দিয়ে ঝিমাচ্ছে ।চুলে, দাঁড়িতে বালুকণা পরম মায়ায় ওম নিচ্ছে, একটু পর পর লোকটা থু থু করে জিহ্বা থেকে বালি ফেলার চেষ্টা করছে, কিন্তু তার মুখে অবশিষ্ট কোন থু থু নেই যা মুখের বালিগুলোকে বাইরে বয়ে নিয়ে যাবে । কিছুক্ষণ পর উত্তর-পূর্ব কোণ থেকে হীম শীতল এক ঝটকা হাওয়া বয়ে গেল, ঠান্ডার পরশ গায়ে লাগাতে লোকটা একটু কেঁপে ওঠলো । তার কাছে একটু প্রশান্তি লাগছে, সে মুখ হা করে ঠান্ডা হাওয়া ভেতরে ঢোকানোর চেষ্টা করছে । কিন্তু এ বালু মিশ্রিত হাওয়া যেন গলা আরও শুকিয়ে চৌচির করে দিচ্ছে । দূরে দেখা যাচ্ছে আকাশে কালো মেঘ ঘুরছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে । লোকটা চোখের ছোট্ট ফাঁকা দিয়ে তাকিয়ে আছে, সেখানে বৃষ্টি হচ্ছে । তার মনে একটা আনন্দ খেলে যাচ্ছে । সে বৃষ্টির পথ চেয়ে আছে, এই বৃষ্টিতে তার জীবন বাঁধা । সে জিহবা বের করে বাতাসে ভেসে আসা কুয়াসার মত অতি ক্ষুদ্রকায় পানির ফোটাগুলোকে ছুঁতে চাচ্ছে, কিন্তু প্রতিটি ফোঁটা যেন বালির সহস্র কণা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সেই বালি কণাগুলো জলকে চুষে গিলে ফেলছে । তারপরও সে চাইছে শুকিয়ে যাওয়া জিহ্বাটাকে ভেজা বালুকণাগুলোর স্পর্শ দিতে ।

তার শরীর শীতে কাঁপছে, লাঠিতে ভর করে আর থাকতে পারছে না, সে শরীরটাকে এলিয়ে দিল জনমানবহীন এই বিস্তৃত বালির বিছানায় । বাষ্পীভূত জল তাকে শীতল করে দিচ্ছে ঠিকই কিন্তু শরীরের অবশিষ্ট সকল জল চুষে নিয়ে যাচ্ছে, শরীরের সমস্ত লোমকূপ ফুলে ওঠছে । সে তাকিয়া আছে সেই বহু ক্রোশ দূরের বৃষ্টি বন্ধুর দিকে, আকাশে কালো মেঘ ঘুরছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, অঝরধারায় বৃষ্টি হচ্ছে । লোকটা বালিতে লেপটে থাকা তার শরীরকে টেনে নিতে চাচ্ছে সে বৃষ্টির দিকে, কিন্তু শরীর সে জায়গায়ই গেঁথে রইলো । সে আধখোলা চোখ দিয়ে উল্টো হয়ে সেই বৃষ্টির দিকে অপলক তাকিয়ে আছে, মুখটাও সেই জল পান করার জন্য হা করে মুখিয়ে আছে ।

অবশেষে লোকটা সেই বৃষ্টির দেখা পেল । বৃষ্টি তার শুষ্ক শরীরে জীবন দেয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করলো, মুখ নাক কান দিয়ে ঝরনাধারায় পুরো শরীরের প্রতিটি কোষ স্পর্শ করলো, তাকে বালু মুড়িয়ে জলের ভেলায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল, শুধু তার আত্মাকে এক ফোঁটা বৃষ্টিও স্পর্শ করতে পারে নি।


একটি ধূসর শহরের গল্প ।

শহরটির নাম টাইরানী, অনেকে বলে ধূসর শহর । বিজ্ঞানীরা ধারণা করছে এটি শতযুগ ধরে টিকে থাকা একটি পুরনো শহর, খুঁজে পাওয়া প্রসিন্ধ শহরগুলোর মধ্যে শুধু এই শহরটির রূপরেখা এখনো কিছুটা টিকে আছে, বাকিগুলো নানান ভৌগলিক বিবর্তন, প্রাকৃতিক ধ্বংসযজ্ঞে তলিয়ে গেছে । তবে এখন আর এখানে সেই চাকচিক্যময় জনমানবের চাঞ্চল্যকর বসতি নেই । যুগে যুগে নানান বিবর্তন, ক্ষয়-অবক্ষয়ের ফলে শহরটির প্রাকৃতিক কাঠামো পুরোপুরি ধ্বংস না হলেও জনবসতি হারিয়ে যায় বহুযুগ আগেই । ভেঙ্গে পড়া ঘরবাড়ি, ধ্বসে পড়া মাটি, পাথরের স্তর, বিবিধ স্থাপত্যের বিশাল আকৃতির খুঁটি পড়ে থাকা, সবুজ গাছগাছালি বিহীন রঙ রূপহীন ধুমড়ানো মোচড়ানো এই শহরটিকে ধূসর শহর বলা তাই যথার্থই । তবে এখানে কেন সবুজ গাছগাছালি জন্ম নেয় না তা এক রহস্য । ভূ-তত্ব বিজ্ঞানীরা নানাবিধ পরীক্ষা নিরীক্ষা, ইতিহাস গবেষণা করার পর একটা বিস্ময়কর তথ্য পেলেন- এই শহরের মাটি খুব উর্বর ছিল, তখনকার সময় এই শহরটির নাম টাইরানী সিটির পাশাপাশি এভারগ্রিন সিটি নামেও ব্যাপক পরিচিত ছিল, এমন কী শুধু গাছগাছালি দিয়েই নানান রকম শিল্পকর্মে শহরটা পরিবেষ্টিত ছিল । টুরিস্টের জন্য এই শহরটিই প্রথম পছন্দ ছিল, প্রাকৃতিক নির্মল নিঃশ্বাসে একটু সময় কাটানোর জন্য । অথচ সেখানে এখন তার কোন চিহ্ন নেই । কী কারণে শহরটির প্রাকৃতিক কাঠামোর এমন পরিবর্তন হলো তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন ।

শহরটির নাম টাইরানী হওয়ার পেছনে বিস্ময়কর এবং মজার একটি ইতিহাস রয়েছে । তখনকার সময় এক মহৎ রাজা ছিলেন ৬ষ্ট রাজ্যের অধিপতি । ছয়টা প্রসিদ্ধ রাজ্য নিয়ে তাঁর গৌরবজ্জল রাজত্ব ছিল । রাজা তখনো বিয়ে করেন নি । তবে তিনি এক নারীর রূপে মুগ্ধ হয়েছিলেন । কিন্তু সেই অপরূপা নারী ছিল সদ্য নিয়োগ পাওয়া তাঁর রাজমহলেরই অতি সামান্য এক দাসী । রাজার এই পাগলপনা দেখে রাজ্যের মন্ত্রীকুল, প্রজা সকলেই খুব আশ্চর্য হলেন । কিন্তু রাজা মশাই কারো তোয়াক্কা করলেন না, তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এই দাসীকেই রানী বানাবেন । তবে সমস্যা বাঁধলো অন্য জায়গায়, সেই দাসীটির বাড়ি ছিল রাজ্যের খুব নিম্নমানের এক গ্রামে, এবং মেয়েটির একটা কুঁড়েঘর ছাড়া আর কিছুই নেই । কিন্তু রাজা কোন রাজকন্যাকে বিয়ে করলেতো নিশ্চয় রানীকে একটা রাজ প্রাসাদ থেকে বিশাল রাজকীয় আয়োজন করে বরণ করতেন, তাছাড়া বিষয়টা রাজদরবারের ব্যপক সন্মান বহন করে । কিন্তু এ মেয়ে তো কোন রাজকন্যা নয় । এ নিয়ে মন্ত্রী পরিষদে দফায় দফায় আলোচনা চলতে লাগলো । পরে রাজা সিদ্ধান্ত নিলেন সেই গ্রামকে একটি প্রসিদ্ধ শহররূপে গড়ে তুলবেন, সেখানে রানীর খাস মহল থাকবে, প্রসিদ্ধ রাজ্যের মত রাজ্য গড়ে তুলবেন । যে সিদ্ধান্ত সেই কাজ, দীর্ঘ দুই বছর ধরে, দুই হাজার লোকবল, স্থাপত্যশিল্পী, নকশাকারীর অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে তুলেন এই গ্রামকে প্রাকৃতিক রূপ রঙে এক অন্যরকম প্রসিদ্ধ শহররূপে, রানীর জন্যও নির্মাণ করা হলো সবুজের কারুকার্যে সুবিশাল খাস মহল । রাজা শহরটির নামকরণ করলেন রাজার নামের সাথে রানী যোগ করে, রাজা টাইজিং থেকে 'টাই', আর 'রানী' । এর অর্থ রাজা টাইজিং এর রানী । সেই সাথে এই শহরটিকে সপ্তম প্রসিদ্ধ রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করেন । সেখান থেকে রাজা বিশাল সৈন্যবহর নিয়ে বেশ জাকজমক আয়োজনের মাধ্যমে রানীকে রাজপ্রাসাদে বরণ করে নেন ।

বিজ্ঞানীরাও এই রাজকাহিণী কিছু কিছু বিশ্বাস করেন কারণ ইতিহাসের সাথে মিল পাওয়া অনেক স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষের সন্ধান তারা পেয়েছেন । শহরটির ধ্বংস নিয়েও আরেকটা কল্প কাহিনী প্রচলিত আছে, যদিও বিজ্ঞানীরা এটাকে তেমন পাত্তা দেন না । রাজা টাইজিং যখন গ্রামটাকে পুনঃ নির্মাণ করার কাজ শুরু করেন তখন সেই গ্রামে এক বৃদ্ধা মহিলা বাস করতো । অবকাঠামো নির্মানের সময় রাজার সৈন্যরা তার বাড়ি উচ্ছেদ করে দেয় । বৃদ্ধার এই বাড়িটাই একমাত্র সম্বল ছিল, দীর্ঘ বংশ পরমপরায় এই ভিটেটুকু সে পেয়েছিল, বলা যায় এখানে তাদের এই বসত ভিটা গত তিনশত বছর ধরে, প্রজন্ম পালটেছে, ঘরের সংস্কার চলেছে, শুধু জায়গা পালটে নি । এই ভিটেটুকু হারিয়ে বৃদ্ধা খুব মনঃক্ষুণ্ণ হয় , তার সেই সামর্থ এবং সাহসটুকু ছিলো না যে রাজাকে নালিশ করবে । তাকে রাস্তায় নেমে যেতে হয়, তার বাড়ির জায়গায় তৈরী হয় রানীর জাকজমকপূর্ণ সৌন্দর্যে মোড়ানো বিশাল খাস মহল । বৃদ্ধা দূরে একটি গাছের নিচে বসে বসে এই খাস মহলের দিকে তাকিয়ে থাকতেন । এভাবেই গাছের নিচে প্রায় বিশ বছর কাটিয়ে অন্ধ হয়ে বৃদ্ধা মহিলা মারা যান । এরপর থেকেই শহরে নানান দূর্যোগ শুরু হয়, একটার পর একটা ধ্বংসলীলা শহরটাকে দুমড়ে মুচড়ে দেয় । এমন কী রানীর গর্ভে যতবার সন্তান এসেছিল সবগুলোই মৃত প্রসব হয়েছিল, সেই দুঃখে কোন বংশধর ছাড়াই রাজা ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে মারা যান । এরপর থেকে লোক মুখে প্রজন্ম পরমপরায় প্রচলিত হয়ে এসেছে যে, সেই বৃদ্ধার অভিশাপে টাইরানী শহর ধ্বংস হয়ে যায় ।

এখনো শহরটির আশেপাশে বাসকরা জনবসতির অনেকে দাবী করে, তারা সেই শহরের ভেতর একজন বৃদ্ধাকে একটি মৃত গাছের গোড়ায় বসে থাকতে দেখেছে ।


নানা এবং নাতি, অতঃপর...!

শীতকালে বড়শিতে তেমন একটা মাছ ওঠে না, শীতের আমেজটা মনে হয় মাছকেও নাকাল করে দেয় । তাই তারাও পুকুরের মাটি কামড়ে উষ্ণতা খোঁজে । দালান কৌটার শহরে উশখুশ করা ছেলে শিশির স্কুল ছুটিতে এসেছে নানুবাড়ি বেড়াতে । মাছ তার তেমন একটা পছন্দের খাদ্য না হলেও বড়শি দিয়ে মাছ শিকার করতে তার খুব ভাল লাগে । গত গ্রীষ্মের ছুটিতে বড়শিতে সে অনেকগুলো মাছ ধরেছিল, মাছগুলো টপাটপ খাদ্য গিলছে আর ধরা পড়েছে । তার আনন্দ চিতকারে নানু অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল, একটু পরপর নানু !, নানু!! , বড়শি থেকে মাছ ছাড়ানোর জন্য ।

কিন্তু এই শীতের লম্বা ছুটিতে এখনো পর্যন্ত একটা মাছও সে শিকার করতে পারে নি । বড়শি নিয়ে বসে থাকে সকালের নাস্তাটা সেরে, মাঝে মাঝে হাই তুলে, চোখে ঘুমও চলে আসে, হাত থেকে বড়শি পড়ার আওয়াজে আবার জেগে ওঠে । তাই নানা বুদ্ধি দিয়েছে কেঁচো দিয়ে মাছ ধরবে, এসব আটা ভাত দিয়ে হবে না । নানার অবসর সময়ও নাতির সাথে ভালোই কাটছে । নানা তাকে সাথে নিয়ে নামাজ পড়তে যায়, চায়ের দোকানে যায়, কারো ক্ষেতের সবজি আনতে গেলেও তাকে নিয়ে যায়, খেজুরের রসের খোঁজে তাকে নিয়ে যায়, মাঝে মাঝে বাজারেও নিয়ে যায় । শিশির চোখ বড় বড় করে চারপাশে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে আর নানাকে নানান প্রশ্ন করে, নানাও সকল প্রশ্নের বিস্তারিত উত্তর দেয় । তবে মাঝে মাঝে এমন কিছু প্রশ্ন করে তার উত্তর নানাকে বিপদে ফেলে, এই যেমন, '' আচ্ছা নানা একটা গরু আরেকটা গরুর উপরে উঠেছে কেন !'' আশেপাশে কোন বাড়িতে তুমুল ঝগড়া চলছে তখন সে প্রশ্ন করে বসলো, ''আচ্ছা নানা, মাগিরপুতের অর্থ কী !'' বাড়িতে মামি নানুকে আম্মু ডাকছে দেখে বলে, ''আচ্ছা নানা, মামি নানুকে আম্মু ডাকে কেন !'' কখনো নানু নানাকে বলছে মুরগি ডিম দিচ্ছে, পাশের বাড়ির বড় রাতাটাও জবাই করে ফেলেছে, একটা রাতা মোরগ কিনে আনা দরকার, তখন শিশির নানাকে প্রশ্ন করে বসলো, ''আচ্ছা নানা, মুরগী ডিম পাড়ার জন্য রাতা মোরগ লাগে কেন ! '' শিশিরের এই অবুঝ প্রশ্নগুলো শুনে সবাই হো হো করে হাসলেও নানা পড়ে যান মহা বিপাকে ।

নানা খোন্তা দিয়ে টিলা খুড়ছে কেঁচো বের করার জন্য । শিশির খুব মনযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে কেঁচো দেখার জন্য । কেঁচোরাও লুকিয়ে গেছে, বৃষ্টির দিনে না খুঁড়তেই কেঁচো বেরিয়ে আসে আর এখন গভীর করে মাটি কাটলেও কেঁচোর দেখা পাওয়া যাচ্ছে না । পাশের রাস্তা দিয়ে কুদ্দুস হুজুর যাচ্ছে , সে নানাকে দেখে নানার কাছে এসে কাগজ মোড়ানো একটা বোতল হাতে দিয়ে ছোট্ট শিশিরকে তোয়াক্কা না করেই বললো, ''মিশু'কে বলবেন সঙ্গমের আগে এই পড়া পানিগুলো খেতে, এবার আল্লাহর রহমতে কাজ হবে ।'' হজুর চলে যাওয়ার পর শিশির নানাকে প্রশ্ন করে বসলো, আচ্ছা নানা, সঙ্গম কী !

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.