![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়া তেমন জ্ঞান নাই আমার। এতদিন দৌড়াইতাছিলাম দেশের চার কোণে ভর্তিযুদ্ধের সেনানি হিসেবে, সুতরাং খবর লয়া হয় নাই। আজকে বাসায় ফিরা টাটকা ঘুম দিয়া উঠার পর টিভি-ফেসবুক দেইখা চান্দি গরম হয়া গেল! হুয়াদ্দাফাক! আমার দেশের সীমানায় এত বড় অবিচার অন্যায় চলতাছে, কিছুই জানলাম না! নিজেকে বড়ই আ[*]দা মনে হইতে লাগল। সরকাররে মনে হইতে লাগল কুটিল, হৃদয়হীন, নির্দয়।
আমি, নিজের প্রশান্তির জন্যে, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে তথ্য খোঁজা শুরু করলাম।
দেখলাম, বার্মার সরকার এদেরকে নাগরিক কয় না, বরঞ্চ উলটা 'বাঙালি' উপাধি দেয় অনেক সময়, কয় তগো চেহারা-ভাষা কাছাকাছি, অইদেশেই যাগা। এদের ভোট, চাকরি, বিয়ে - সব কিছুতেই বাধা। মৌলিক অধিকার নাই। নোবেল বিজয়ী এবং দেশের মাথা অং সান সুচিকে এদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে কন - 'আমরা নতুন সরকার, পিলিজ চাপ দিয়েন না বাই। হ্যান্ডেল করতে দ্যান।' এদের জন্যে সমুদ্রের একেবারে কাছে এক কোণে এলাকা তথা বস্তি নির্দিষ্ট কৈরা দেওয়া হইছে, এর বাইরে যাইতে দেখলে রাখাইন পুলিশ গুলি করে। এই বদ্ধ কাজহীন-পড়ালেখার সুযোগহীন অবস্থায় স্বভাবতই স্বাভাবিক জীবন যাপন সম্ভব না, তাই অপরাধের হার বাইড়া গেছে অনেক বেশি। এই অযুহাতের সুযোগ নিয়া পুলিশ নিয়ম কৈরা তাঁদের বস্তি 'সাফ' করে। হেলিকপ্টার গানশিপ নিয়া অ্যাটাক হয়, পুলিশ-মিলিটারি ফোর্স মিলিতভাবে 'অভিযান' চালায়। রোহিঙ্গা মরে হাজারে হাজারে। কারো কোন ভ্রূক্ষেপ নাই। লন্ডনে ভাইগা যাওয়া রোহিঙ্গা নেতা কন, 'আমার মানুষ নরকের চেয়েও নিকৃষ্ট জায়গায় পড়ে মরছে'।
তো নরক থেকে মানুষ কি ভাগার চেষ্টা করে না? রোহিঙ্গারাও করে। ওদের চারপাশে আছে থাইল্যান্ড, চীন, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া। ওরা নৌকা নিয়া ঝাঁপাইয়া পড়া শুরু করল। এই সুযোগটা নিল পাচারকারি গোষ্ঠী। রোহিঙ্গা দেখে না, তারা দেখে জ্যান্ত চলতি ফিরতি টাকার বাক্স। কত রোহিঙ্গা মরল জঙ্গলে, নৌকায়; অনাহারে, ধর্ষিত হয়া, অত্যাচারিত হয়া। কারো কোন রাও নাই। আশেপাশের দেশগুলা উদাসিন। একটা দেশও তাঁদের নাগরিকত্ব দিবে না, আশ্রয় দিবে না। সীমান্ত সিলগালা করে রাখবে।
মাতবর দেশগুলা বলল, তোমরা অগো আশ্রয় দেও। আমরা সাহায্য করমু। ইন্টারনেশনাল ক্যাম্প বসান হইল। বাংলাদেশে তিনটা, মালয়শিয়ায় দুইটা। বাকি দেশগুলা ক্যাম্পও বসাইতে দিল না। থাইল্যান্ড কইল, শালারা রোহিঙ্গা না, বাঙালি ওয়ার্কার, এই সুযোগে ঢুকবার চায়। দিমু না অনুমতি। বাকিরাও একমত।
তাও ঠেলেঠুলে রোহিঙ্গারা পালায়। সবচে কাছে বাংলাদেশ, ওরা বাংলাদেশে ঢুকল সবচে বেশি। চুয়াত্তর সালের পর থিকা একানব্বই-বিরানব্বই, তারপর দুই হাজার দশ - নিয়মিত বিরতিতে আসতে আসতে বর্তমানে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা পাঁচ লাখের ওপরে, মতান্তরে সাত লাখের কাছাকাছি। বাকি সবগুলা দেশ মিলায়ে এইটার অর্ধেকও নিল না। এই সাত লাখের মধ্যে মাত্র অফিশিয়ালি বত্রিশ হাজার 'শরণার্থী', বাকি কারো কাগজ নাই, পরিচয়পত্র নাই। এরা না পারে কোথাও সরতে, না পারে কোথাও মরতে। ইন্টারনেশনাল সাহায্য ফুরায়ে আসে, বাংলাদেশ এক বছরে যে সাহায্য পাইল সেই বাজেটে এমনকি ঢালিউডের একটা শরীর-গরম-করা ফিল্মও বানানো কঠিন। জাতিসংঘ আর এঞ্জিওগুলা তখন গাল চুল্কাইতে চুল্কাইতে কয় - সাহায্য দিমু। ওয়েট। তোমাদের বড়ই তাড়াহুড়া, ইন্টারনেশনাল সাহায্য জড়ো করা সোজা কাজ নাকি? বাংলাদেশ সরকার বইসা বইসা সীমান্ত আরেকটু টাইট কৈরা মাথা আর পাছা থাপ্রায় তখন।
রোহিঙ্গা এক যুবকের সাক্ষাৎকার নেয়া হইল, পোলা কয় - 'দুনিয়াতে আল্লা দুইটা ভাগ কৈরা দিসেন। রোহিঙ্গা, আর মানুষ।'
মালয়শিয়ায় অবস্থা আরও খারাপ, সেইখানে খাবার নাই, শিক্ষার সুযোগ তো নাইই, থাকার জায়গাই নাই। চুরিচামারি আর অপরাধ বাড়ল। মালয়-রা কৈল রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসী, তাদের সুযোগ সুবিধা আরও কমায়া দেওয়া হইল। মালয় সরকার বার্মারে কয়, ফিরায়া লও তোমার নাগরিক, আমি পারি না। বার্মা কয়, কিসের নাগরিক? এগো তো আমি চিনি না! মারা খাও! মালয় সরকার ঠিক করল নির্বাচিত এক হাজার জনরে তারা ফিরত পাঠাবে, নির্বাচনের পরদিন দেখা গেল সেই এক হাজারের মধ্যে প্রায় দশটা পরিবার আত্মহত্যা কৈরা মইরা গেছে। তারা মরে যাবে, তবু বার্মা ফিরত যাবে না।
বাংলাদেশে জামাতে ইসলাম দেখল এই সুযোগ। ওরা রোহিঙ্গাদের ধইরা নিজেদের জঙ্গি কার্যক্রমে ঢুকান শুরু করল। র্যাব-পুলিশ জঙ্গি ধরে, দেখা যায় দলে দুই তিনটা রোহিঙ্গা। 'উপকূলীয় অশান্তি' বাড়ল, সেই পুরান কাহিনি, সেই বিষচক্র আবার শুরু হইল। অবকাঠামো এবং উপযুক্ত সাহায্য-সুবিধা-অধিকার ব্যতীত একটা অপরিচিত জনভূমিতে লাখ পাঁচেক মানুষরে ছাইড়া দিলে যা হবার তাই হইল। এলাকার লোক এদের দেখতে পারে না। পুলিশ সন্দেহের চোখে দেখে। খুন খারাপি হয়, রোহিঙ্গা পোলার নাম আসে অনেক সময়। পুরা শরণার্থী গোষ্ঠীর নাম খারাপ হয়া যায় হাজার খানেক পচা আপেলের জন্যে।
রোহিঙ্গা নারীরা-শিশুরা ঘুরেফিরা সেই বস্তিতেই থাকে। পুরুষেরা দশজনে আটজন ঘুরেফিরা এলাকায় কাজ করে, আর দুইজন অপরাধে ঢুকে। তাঁদের সাথে উপকূলীয় মানুষের দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষ খুব স্বাভাবিক ব্যাপার তখন। খবর পাওয়া যায় বাঙালি-রোহিঙ্গা সংঘর্ষের, তবে সে খবর ছড়ায় না সারা দেশে। দেশের সচেতন মানুষ আমার মতো চোখ বন্ধ কৈরা নিজের মতো সময় কাটাইতে থাকে আনন্দে। আমরা কক্সবাজারে ঘুরতে যাই, বার্মিজ মার্কেট আর নাফ নদীর চারপাশে রোহিঙ্গা দেইখা আনমনে ভাবি - শালাগো একেবারে গলা কাটা স্বভাব, আমারে এই শালটা স্যান্ডেলটা কিনার সময় ঠকায়া দিছে!
এখন, সেই পুরান সমস্যা মাথা চাড়া দিসে আবার।
বার্মা আবার শুরু করছে এথনিক ক্লেঞ্জিং। বাকি আট লাখরেও দেশছাড়া করবে এই মনোভাব নিয়া মাঠে নামছে তারা। রোহিঙ্গা মরতাছে। মাতবর দেশগুলা বার্মারে বলছে, 'কি কর কি কর ইস, এইটা ভাল হইতাসে না কিন্তু' আর বার্মা উত্তর দিছে, 'আমার সমস্যা আমি দেখমু, পিলিজ ফাকঅফ। নাসাক, বেশি বুঝলে থাবড়া মাইরা এদের নাফ নদিতে ফালায় দিবা।'
চারপাশের দেশেরা আবার সীমান্ত সিলগালা করে ফেলছে।
জাতিসংঘ, মুসলমান কিছু দেশ আর বাকি মানবতাবাদি সংগঠনের এই ভায়লেন্সের ভায়াগ্রা খাওয়ার পর আবার খাড়ায়া গেছে মানবতা। তারা পার্শ্ববর্তী দেশ আর বার্মার কাছে আবেদন জানায়া 'রাস্তা মাপো' এর বিভিন্ন সংস্করণের উত্তর পাইছেন। সুবিধা না করতে পাইরা আবার আসছেন বাংলাদেশের কাছে।
''বাংলাদেশ?
-হুঁ
জায়গা দেও ব্যাচারাগো।
-আমার মাটিতে তো এম্নেই সাত লাখ আছে। আরও আট লাখ আইলে খাওয়ামু কি? রাখমু কৈ?
কিন্তু নারী-শিশু-বৃদ্ধ মরতাছে তো। দিল কাঁপে না?
-কাঁপে।
তাইলে বর্ডার খুইলা দ্যাও।
-আপ্নেরা বার্মারে কিছু কন। আমি বর্ডার খুইলা দিলে অয় আর কোনদিন ফিরত নিব না।
বার্মা তো বেদপ।
-তাইলে বাকি মুস্লিম কান্ট্রিগুলারে কন, বার্মার প্রতিবেশিগো কন। সবাই মিলা শেয়ার কৈরা রিফুজিগো বাঁচাই। একের লাঠি দশের বোঝা।
অরা তো কথা শুনে না।
-তাইলে এটলিস্ট আমারে কিছু সাহায্য দেন। মাতবর দেশগুলার সাথে কূটনৈতিক রাস্তা কিলিয়ার করেন। আমার মাটিতে যদি আনি অগো, আমারে খাদ্য সাহায্য পাঠাইবেন? অগো জন্যে স্কুল কলেজ করতে ট্যাকা দিবেন? রিলোকেট আর ইন্টিগ্রেট করার বাজেট দিবেন? বাঙালি-রোহিঙ্গা ঝামেলা হইলে সেইটা মিটায়া দিবেন?
উফ...কত কথা কয়...এত ঝামেলা করো ক্যান?
-ঝামেলা কিসের?
তুমি মানুষটা ভাল না।
-এর আগে সাহায্য করবেন কয়া তো ভাগছেন। বিরানব্বইয়ে, দুই হাজার দশে। এইবারও তো কোন কাজ করবেন না, খালি মানবতার কথাই আছে মুখে। আমি বার্মারে কইলাম আসো বসি, মানুষগুলারে ক্যান মারতাছো? বার্মা কয় এইটা অভ্যন্তরীণ ঝামেলা, তুমি কথা বলবা না। আমি প্রতিবেশিগুলারে বললাম, আসো একটা রিজিওনাল ফোর্স বানাই, শেল্টার বানাই, মানুষগুলারে তো বাঁচাইতে হবে। অরা কয়, ধুর, আমরা এই ঝামেলায় নাই। আমি আপনাদের, মাতবরদের বললাম, বার্মারে চাপ দেন, সে লোক ফিরত নিক নয় আমার সাথে একটা সমঝোতায় আসুক। উপকূলে আরেকটা রিফিউজি ক্যাম্প করতে হইলেও আমি রাজি, কিন্তু আমাকে ব্যাকাপ দিতে হবে। আপনারা সেইটা ব্যবস্থা করতে পারেন না, পারেন আমারে উলটা দুষতে।
তোমার মানুষ কিন্তু সাহায্য পাইছিল। ইন্ডিয়া বর্ডার আটকায় নাই। ভুইলা গেছ?
-ইন্ডিয়ার মতো রিসোর্স আছে আমার? আমার মানুষ দেশ স্বাধীন হবার পর ফিরত আসছে। রাখাইন স্টেট স্বাধীন করবে কে? অরা ফিরত যাবে কই? এখন কি মানবতার খাতিরে বার্মার সাথে যুদ্ধে যাইতে বলেন? আমি একা অসহায়, আমি একা নিরুপায়। আমার পক্ষে একা এত কিছু সম্ভব না।
তাইলে এই মানুষগুলা যাবে কই?
-পানিতে ডুইবা মরবে, অনাহারে মরবে, হেলিকপ্টার গানশিপের গুলিতে মরবে, রাখাইনদের দ্বারা ধর্ষিত হইয়া মরবে, পাচারকারিদের অত্যাচারে মরবে।
আর তুমি চায়া চায়া দ্যাখবা?
-আর 'আমরা' চায়া চায়া দেখবো। আপনি, আমি, দুনিয়ার সবাই। তারপর নিজেদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীবনে, ক্ষুদ্রতর স্বার্থপর অস্তিত্বে ফিরত যাব আবার। খুব স্বাভাবিকভাবে। এতদিন বেঁচে থাকতে থাকতে এই জিনিস খুব ভাল করে আয়ত্ত করে ফেলছি আমরা।''
সুতরাং, হে সচেতন নাগরিক, আমার মতো হন। ফেসবুকে মানবিক অবক্ষয় নিয়া দুঃখের স্ট্যাটাস দেন। রোহিঙ্গাদের মৃত্যুকালীন বীভৎস ছবিগুলা বিকৃত আনন্দের সাথে শেয়ার দেন, আর আনন্দ চেপে কান্দার ইমোর সাথে ক্যাপশন লেখেন, 'কি অমানবিক! আল্লা তুমি দেখো'। অফিসে কলিগের সাথে এই নিয়া ঝগড়া করেন। বাংলাদেশ আরাকান দখল করবে এই সুখস্বপ্ন দেখেন। সরকারকে গাইলান। চিন্তা নাই। পরবর্তী রসাল ইস্যু আসতেছে অতিসত্ত্বর, ততোক্ষণ পর্যন্ত জাতির বিবেকের সঙ্গেই থাকুন।
ধন্যবাদ।
২৩ শে নভেম্বর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৪০
বন্যলোচন বলেছেন: যে কারণে আপ্নে বইসা আছেন। আমি বইসা আছি।
আমাদের কি আসে যায়!
২| ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৬ সকাল ৯:৩৭
হাসান মাহবুব বলেছেন: আমি একটা স্ট্যাটাস দিছিলাম। অনেক গুলা লাইক আর ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাইছি।
২৩ শে নভেম্বর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৪২
বন্যলোচন বলেছেন: আমিও। আল্লার কাছে অজস্র শুক্রিয়া ফেসবুক ছিল। নইলে আমরা কবেই অমানবিক পশুতে পরিণত হইয়া যাইতাম!
©somewhere in net ltd.
১|
২৩ শে নভেম্বর, ২০১৬ সকাল ৮:৪৮
আলগা কপাল বলেছেন: অবাক কাণ্ড। বিশ্ব চুপচাপ বসে আছে কেন?